#একগুচ্ছ_ভালোবাসা
#অরনিশা_সাথী
|৬|
স্বচ্ছ’র পরিবারের সকলেরই বেশ পছন্দ হয়েছে জল’কে। আনিসুজ্জামানের’ও না বলার কোনো উপায় নেই। ছেলে ভালো, শিক্ষিত তার উপর এত ভালো ঘর থেকে সম্বন্ধ আসলে কোন মেয়ের বাবা না করে? সবাই তো চায় তার মেয়েটাকে আজীবন সুখী দেখতে। এদের দেখে যতটা মনে হলো এরা বেশ ভালো মনের মানুষই। রাজিয়া সাথে আংটি নিয়েই এসেছিলো। আজকেই জল’কে আংটি পড়িয়ে যায় উনারা। সাথে আমিনা বেগমও এক জোড়া সোনার বালা পড়িয়ে দেয় জলের হাতে।
সামনের শুক্রবারেই ওদের বিয়ে। ঘরোয়া ভাবেই আয়োজন করবে বিয়ের। প্রস্তাব’টা শাহাদাত রেজওয়ানের। খোঁজ খবর নেওয়ার সময় উনি আনিসুজ্জামানের আর্থিক অবস্থার কথা’ও জেনেছেন। আপাতত রিটায়ার্ড উনি, ছোট মেয়ে জোনাকি সবে সবেই কাজে জয়েন করেছে তা’ও আবার উনাদের অফিসেই। এই মূহুর্তে বড় করে বিয়ের আয়োজন করতে গেলে আনিসুজ্জামানের যেটুকু জমা অর্থ আছে সব খরচ হয়ে যাবে। ছোট মেয়েটা’ও তো এখনো আছে, তার উপর আনিসুজ্জামানের চিকিৎসার খরচ, সাংসারিক খরচ তো আছেই। তাই আর ঝামেলায় ফেললেন না উনাকে। আনিসুজ্জামান চেয়েছিলেন দুই মেয়ের বিয়ে ধুমধাম করেই দিতে। যতটুকু উনার সামর্থ্যের মধ্যে আছে ততটুকুই করতে চেয়েছিলেন। সেটুকুতেও বারণ করে শাহাদাত রেজওয়ান এবং আমিনা বেগম। রাজিয়া নিজেও সায় জানিয়েছে। উনাদের বক্তব্য সামনে শুক্রবারে অল্প কয়েকজন এসে বিয়ে পড়িয়ে মেয়ে নিয়ে যাবে। তারপর ❝স্বপ্ন নীড়❞ এ বেশ বড়সড় করেই রিসিপশনের আয়োজন করবে। তাতেই নিরব সম্মতি জানিয়েছেন আনিসুজ্জামান।
–
আজকেও নিলয়ের সাথে সবেই আড্ডা’টা জমে উঠেছিলো জোনাকি’র। সাথে আরো দুজন কলিগ, রেহান এবং বৃষ্টি’ও ছিলো। নিজের কেবিনে প্রবেশ করার আগে জোনাকি’র দিকে বাঁকা চোখে একবার তাকালো। তারপর ওদের চারজনের সামনে দাঁড়াতেই সকলে দাঁড়িয়ে সালাম জানিয়ে বললো,
–“গুড মর্নিং স্যার।”
–“মর্নিং।”
ছোট্ট করে জবাব দিয়ে ফের বাঁকা চোখে তাকায় জোনাকি’র দিকে। জোনাকি মাথা নিচু করে নেয়। আঁধার দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
–“এটা অফিস, আপনাদের আড্ডাখানা না। নেক্সট টাইম থেকে যেন অফিস টাইমে কোনো আড্ডা না দেখি আমি।”
কথাগুলো বলে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। তারপর আবার থেমে গিয়ে পেছন ফিরে জোনাকি’র দিকে তাকিয়ে বলে,
–“মিস জোনাকি? কাল যে ফাইল গুলো দিয়েছিলাম সে গুলো নিয়ে কেবিনে আসুন আপনি।”
কথাটা বলে আর দাঁড়ায় না আঁধার। সবাই ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে যার যার ডেস্কে বসে পড়ে। জোনাকি নিজের কেবিনে ঢুকে ফাইলগুলো নিয়ে দ্রুত আঁধারের কেবিনের দিকে পা বাড়ায়।
–
–“আসসালামু আলাইকুম, কে বলছেন?”
–“ওয়ালাইকুমুস সালাম, স্বচ্ছ বলছিলাম।”
নামটা শুনেই জলের হৃদপিণ্ড লাফিয়ে উঠে। ওদের বিয়ে পাকা হওয়ার আজকে দুদিন হলো। এই দুদিনে লোকটা ওকে একবারের জন্য’ও ফোন করেনি। ভেবেছিলো লোকটার বোধহয় এই বিয়েতে মত নেই নতুবা একেবারে বিয়ের পরেই কথা বলবে। নিজে নিজেই সব ভেবে নিয়েছিলো জল। তাই এই মূহুর্তে স্বচ্ছ’র ফোন সে নিজেও আশা করেনি। কখনো ভেবেছিলো যে লোকটাকে ভুলবশত ও ভিজিয়ে দিয়েছিলো সে লোকটার সাথেই ওর বিয়ে হবে? জল তো প্রায় ভুলেই গিয়েছিলো স্বচ্ছ’কে। চারদিন আগে স্বচ্ছ’র মা’কে বাঁচাতে গিয়ে আবার দেখা হলো স্বচ্ছ’র সাথে। দুদিন পরেই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে স্ব-পরিবারে। সত্যিই এমনটা কোনো কালেই চিন্তা ভাবনাতে আসেনি জলের। জল’কে চুপ থাকতে দেখে স্বচ্ছ বললো,
–“কথা বলছ না যে?”
কাঁপা কাঁপা স্বরে জবাব জলের,
–“হ্যাঁ শুনছি বলুন।”
–“কেমন আছো? আংকেল আন্টি সবাই ভালো আছে?”
–“জ্বি আলহামদুলিল্লাহ, আপনারা সবাই?”
–“আলহামদুলিল্লাহ সবাই ভালো।”
প্রত্যুত্তরে জল কি বলবে আর ভেবে পেলো না। স্বচ্ছ ফের বললো,
–“বিকেলে দেখা করি আজ?”
নিশ্চুপ রইলো জল। স্বচ্ছ আবারো বললো,
–“আসবে?”
–“উঁহু।”
–“দেখা করতে চাও না? চাও না আর একটু ভালোভাবে জানা-শোনা হোক আমাদের?”
–“না মানে আসলে___”
জাহানারা ডাকলেন জল’কে। জল যেন সুযোগ পেলো পালানোর। দ্রুত কন্ঠে বললো,
–“মা ডাকছে, রাখছি।”
কথাটা বলেই চট জলদি লাইন কেটে দেয় জল। স্বচ্ছ জলের নাম্বারের দিকে তাকিয়ে মাথা চুলকে মুচকি হাসে।
–
আঁধারের কেবিনের সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে জোনাকি। হাতে তিনদিনের ছুটি চেয়ে এপ্লিকেশন লেটার নিয়ে এসেছে। কাল জল আর স্বচ্ছ’র হলুদ। যদি’ওবা তেমন অনুষ্ঠান হবে না হলুদে। জোনাকি ওরা নিজেরা নিজেরাই হলুদ লাগাবে জল’কে। স্বচ্ছ’র পরিবার থেকে কেউ আসবে কিনা সেটাও এখনো ঠিক করা হয়নি। আঁধার ছুটি দিবে কিনা সেটাই ভাবছে ও। মনে সাহস জুগিয়ে দরজা খুলে বললো,
–“মে আই___”
জোনাকি পুরো কথা শেষ করার আগেই ভেতর থেকে আঁধার বললো,
–“কাম।”
গুটিগুটি পায়ে ভেতরে ঢুকে জোনাকি। আঁধার ল্যাপটপে ব্যস্ত। একবারের জন্যও সেখান থেকে দৃষ্টি সরেনি। জোনাকি খামটা টেবিলে রাখলো। কিছু সেকেন্ড বাদে আঁধার খাম খুলে এপ্লিকেশন দেখে বলে,
–“কাজে নতুন জয়েন করেছেন আপনি। বড়োজোর একমাস কি তার কিছু বেশি এর মাঝেই তিন দিনের ছুটি?”
জোনাকি মাথা নিচু করে ফেললো। ভেবে নিলো লোকটা ছুটি দেবে না। ছুটি দিবি না ভালোই কথা, কড়া কড়া কথা শোনাবি ক্যান? ব্যাটা বজ্জাত। মনে মনে দাঁতে দাঁত চেপে কথা গুলো বললো জোনাকি। তারপর উলটো ঘুরে চলেই আসছিলো। তখনই আঁধার থমথমে রাশভারী গলায় বললো,
–“কাল হাফ ডে অফিস। অফিস শেষ করে তারপর বোনকে হলুদ লাগাবেন। আমি যতদূর জানি হলুদের প্রোগ্রাম সন্ধ্যার পরেই হয়। ফুল ডে ছুটি নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।”
আঁধারের দিকে ঘুরে দাঁড়ালো জোনাকি। তারপর নিচু কন্ঠে বললো,
–“জ্বি স্যার।”
–“পরশু শুক্রবার। শনিবার ফুল ডে ছুটি আপনার। এবং রবিবারে অফিস হাফ ডে করে তারপর যাবেন।”
জোনাকি কিছু বললো না। আঁধার ফের বললো,
–“তিনদিনের ছুটিকে কাট ঝাট করে দেড় দিন করা হলো। গট ইট?”
–“জ্বি।”
আঁধার কয়েকটা ফাইল জোনাকিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
–“দুই ঘন্টার মধ্যে এর ডিটেইলস চাই আমার।”
জোনাকি ফাইল দুটো নিয়ে দ্রুত বেড়িয়ে গেলো কেবিন থেকে।
–
–“জল’কে কেমন লেগেছে তোমার? আমার তো বেশ লেগেছে।”
নিশির প্রশ্নে তৈমুর ল্যাপটপ বন্ধ করলো। নড়েচড়ে বসে বললো,
–“বেশ ভালো, তবে জোনাকি’কেও কিন্তু বেশ লেগেছে। বিশেষ করে তোমার রসকষহীন ভাইয়ের সাথে।”
নিশি ভ্রু কুঁচকে বললো,
–“মানে?”
–“আঁধার আর আমি তো একসাথেই ঢুকলাম জল’দের বাসায়। তার আগে সিড়িতে আঁধারের সাথে জোনাকি’র ধাক্কা লাগে একটা। তখনই দুজনকে কাছাকাছি পাশাপাশি দেখলাম। ভালোই মানাবে ওদের। দেখো স্বচ্ছ জলের সাথে সাথে আঁধার জোনাকি’র বিয়েটাও দিয়ে দিতে পারো কিনা।”
নিশি অন্যমনস্ক ভাবে বললো,
–“হ্যাঁ জোনাকি বেশ ভালো। ওর সাথে একদিন আলাপ হয়েছিলো আমার। অফিসের ফাইল দিতেই ভাই বাসায় ডেকেছিলো ওকে। কিন্তু কি বলো তো মেয়েটা ভাইকে প্রচুর ভয় পায়। আর ভাইকে’ও দেখি ওর সাথে খুব রুড বিহেভিয়ার করার জন্য।”
তৈমুর মুচকি হেসে বলে,
–“সবার প্রেমের সূচনা তো এক না বউ। সবার ভালোবাসা তো আর ভালো লাগা থেকে হয় না। কারো কারো ভালোবাসার সূচনা ঝগড়া থেকেও হয়। তোমার ভাই তো অন্য সবার থেকে আলাদা, তাই ওর লাভ স্টোরিটা’ও অন্যসবার থেকে আলাদা’ই হবে দেখে নিও।”
নিশি মৃদু হেসে বলে,
–“ধুর! কি যে বলো না, ওদের মধ্যে বনিবনা হবে না। ভাইয়ের দ্বারা এসব প্রেম ভালোবাসা হবে বলে তোমার মনে হয়?”
তৈমুর বালিশ ঠিক করে বিছানায় শুয়ে বললো,
–“বলা তো যায় না, কখন কে ডুবে ডুবে জল খায়। এই স্বচ্ছ’কেই দেখো না, জল’কে তো ওর আগে থেকেই পছন্দ কিন্তু ওর আলাদা করে কিছুই করতে হলো না। কাকিমা নিজেই জল’কে স্বচ্ছ’র জন্য পছন্দ করেছেন। উপরওয়ালা জল’কে পাওয়ার রাস্তা’টা স্বচ্ছ’র জন্য সহজ করে দিয়েছে। কিন্তু সবার ক্ষেত্রে তো সহজ হয় না বউ। কেউ খুব সহজেই ভালোবাসাকে জয় করে। আবার কারো ক্ষেত্রে ভালোবাসা জয়ের রাস্তা’টা হয় বেশ দূর্গম, কঠিন। কেউ কেউ তো আবার নিজের ভালোবাসা’কে পায়’ও না। কার ভাগ্যে কি আছে তা সয়ং উপরওয়ালা ছাড়া কেউ জানে না। উপরওয়ালা চাইলে আমাদের আঁধার বাবুর কপালে জোনাকি’ও থাকতে পারে।”
–
–“মিস জোনাকি কাম টু মাই কেবিন, রাইট নাও।”
কথাটা বলেই খট করে লাইন কেটে দিলো আঁধার। জোনাকি আর দেরি না করে দ্রুত আঁধারের কেবিনে গিয়ে নক করলো। সাথে সাথেই ভেতরে যেতে বললো আঁধার। জোনাকি গিয়ে দাঁড়াতেই আঁধার ইশারা করলো বসার জন্য। জড়সড় হয়ে বসে জোনাকি। আঁধার একটা ফাইল এগিয়ে দিয়ে বলে,
–“এটা দ্রুত শেষ করুন, ঠিক এক ঘন্টা বাদে একটা মিটিং আছে।”
জোনাকি ফাইল দেখায় মনোযোগ দিলো। আঁধার’ও আবার মনোযোগ রাখলো ল্যাপটপে। ল্যাপটপের কী-বোর্ডে আঙুল বেশ দ্রুত এবং দক্ষ ভাবে চলছে। হয়তো কোনো জরুরী কাজ করছে। জোনাকি ভালোভাবে ফাইল দেখে আঁধারের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
–“স্যার ফাইলটা?”
আঁধার ফাইলটাতে চোখ বুলালো একবার। না সব ঠিকঠাক আছে। তারপর উঠে দাঁড়ায়। চেয়ার থেকে কোর্ট’টা নিয়ে গায়ে জড়িয়ে বললো,
–“চলুন।”
–“আ্ আমি?”
আঁধার হাঁটা থামিয়ে বলে,
–“হ্যাঁ তো আর কে? আপনি ছাড়া কি আমার আর কোনো পিএ আছে?”
জোনাকি মাথা নাড়ালো। আঁধার ফের বললো,
–“তাহলে কোনো কথা না বলে চুপচাপ চলুন আমার সাথে।”
–“ফোনটা ডেস্কের উপর রেখে এসেছি, নিয়ে আসি?”
আঁধার ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
–“গাড়িতে ওয়টে করছি, আপনি আসুন।”
কথাটা বলেই হনহনিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায় আঁধার। জোনাকি এক দৌড়ে নিজের কেবিনে গিয়ে ফোন আর পার্সটা নিয়ে আবার দৌড় লাগায় লিফটের দিকে। জোনাকি’কে দৌড়ে আসতে দেখে আঁধার ভ্রু কুঁচকে তাকায় তারপর আবার সঙ্গে সঙ্গে চোখ রাঙায়। এতেই জোনাকির দৌড়ানো বন্ধ হয়ে যায়। আচমকা থামতে গিয়ে স্লিপ কেটে পড়ে যেতে যেতেও নিজেকে সামলে নেয় জোনাকি। মনে মনে বলে,
–“একটু আগেই তো বললো গাড়িতে অপেক্ষা করছি, তাহলে এখন লিফটে অপেক্ষা করার মানে কি? এর জন্য আজকাল শান্তিতে একটু ছোটাছুটি করা যায় না। আচ্ছা হুড়োহুড়ি করতে বারণ করেছিলো তো স্যার, বিশেষ করে উনার সামনে। উনি তো ফের আমাকে ছুটতে দেখে ফেললো, এবার কি তাহলে বেশ বড়সড় ভাবে ধমক দিবে একটা?”
অন্যমনস্ক ভাবে কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই লিফটের সামনে এসে দাঁড়িয়ে যায় জোনাকি। সে এখন বিশাল চিন্তায় বিভোর। আঁধার ধমক দিবে কি দিবে না? দিলেও জোরে দিবে না আস্তে দিবে? জোনাকি কে আবার দাঁড়াতে দেখে এবার বেশ বিরক্ত হয় আঁধার। জোনাকির হাতের কব্জি চেপে ধরে টান দিয়ে লিফটের ভেতর নিয়ে আসে। আচমকা টান পড়ায় হুশ ফিরে জোনাকির। নিজেকে আঁধারের অনেকটা কাছাকাছি দেখে থতমত খেয়ে যায়। দ্রুত সরে একপাশে গিয়ে দাঁড়ায় সে।
চলবে~