#একগুচ্ছ_ভালোবাসা
#অরনিশা_সাথী
|৫|
জলের হাতে ব্যান্ডেজ দেখে জলের মা জাহানারা আঁতকে উঠলো। জলকে ধরে এনে সোফায় বসিয়ে তিনি একের পর এক প্রশ্ন করছেন। বাবা আনিসুজ্জামান’ও বেশ চিন্তিত মেয়েকে এভাবে দেখে। জল ওর বাবা মা’কে শান্ত করে সবটা বুঝিয়ে বললো। আনিসুজ্জামান বললো,
–“এরপর থেকে সাবধানে চলাফেরা করবে। আল্লাহ সহায় ছিলেন বলে ওই ভদ্রমহিলা আর তোমার কিছু হয়নি।”
জল সম্মতি জানিয়ে বললো,
–“চিন্তা করো না দুদিনেই ক্ষত শুঁকিয়ে যাবে, আমি ঘরে যাচ্ছি।”
–
জোনাকির ফাইল দেখা শেষ। আঁধার তখনো কফির খালি মগটা হাতেই জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছে। জোনাকি দাঁড়িয়ে কাঁপা স্বরে বললো,
–“ফাইল চেক করা শেষ, সবকিছু ঠিকঠাক আছে স্যার।”
বাইরের দিকে নজর রেখেই আঁধার ছোট্ট করে জবাব দিলো,
–“গুড।”
–“আমি তাহলে আসছি।”
কথাটা বলে জোনাকি বের হতে গেলেই আঁধার থমথমে গলায় বললো,
–“যেতে বলিনি, চুপচাপ বসে থাকুন আপনি।”
জোনাকি আমতা আমতা করে বলে,
–“কিন্তু কোনো কাজ___”
আঁধার ঘাড় ঘুরিয়ে বাঁকা চোখে তাকাতেই জোনাকি দ্রুত বসে পড়লো। আঁধার আগের ন্যায় বাইরের দিকেই দৃষ্টি তাক করে। জোনাকি টেবিলে মাথা রেখে আপন মনে বিড়বিড় করতে থাকে।
প্রায় মিনিট দশেক পরে আঁধার এদিকে ঘুরে। জোনাকি’কে টেবিলে মাথা রেখে ঘুমাতে দেখে ভ্রু কুঁচকে আসে ওর। এভাবে এত দ্রুত কারো ঘুম আসে? জানা ছিলো না তো। মেয়েটা বোধহয় নিজেই ভাবেনি এভাবে ঘুমিয়ে পড়বে ও। আঁধার বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে জোনাকির পাশের চেয়ারটা টেনে ওর সামনে বসে। তারপর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে। ছিমছাম গড়নের সাদামাটা দেখতে একটা মেয়ে। মুখে কোনো আধুনিকতার ছোঁয়া নেই। নেই কোনো সাজগোজের চিহ্ন। গায়ের রংটা উজ্জ্বল শ্যামলা। ছোট ছোট কাটা চুলগুলো কপাল আর সারা মুখে এসে লেপ্টে আছে। অতি সাধারণ একটা মেয়ে অথচ চোখমুখে মায়া যেন উপচে পড়ছে। স্নিগ্ধ সুন্দর লাগছে। হঠাৎই একটা নিষিদ্ধ ইচ্ছে জাগলো আঁধারের মনে। কেন জাগলো ও জানে না। তবে মনে হচ্ছে চোখ মুখে লেপ্টে থাকা চুলগুলো মেয়েটার ঘুমে ডিস্টার্ব করছে। চুলগুলো কানের পিঠে গুজে দিতে ইচ্ছে করছে। হঠাৎ এই ইচ্ছে উদয় হলো কেন? বুঝতে পারছে না। তবে নিজের ইচ্ছেকে প্রশ্রয় দিলো না সে। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে হনহনিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো।
–
ঘড়ির কাটায় রাত সাড়ে দশটা। ❝স্বপ্ন নীড়❞ এর সকলেই খেয়ে দেয়ে যার যার রুমে চলে গিয়েছেন এই মূহুর্তে। আমিনা বেগম ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। এমন সময় শাহাদাত রেজওয়ান এবং রাজিয়া দরজায় কড়া নাড়ে। আমিনা বেগম ভিতরে আসতে বললো। আমিনা বেগম দুজনকেই বসতে বলে বললো,
–“কিছু বলবা ছোট বউ?”
রাজিয়া উশখুশ করছে বলতে, কিন্তু পারছে না। শাহাদাত রেজওয়ানকে ইশারা করছে বলার জন্য। সেদিকে তাকিয়ে আমিনা বেগম ফের বললো,
–“শাহাদাত? তুমি বলো, কি বলতে চাও?”
–“আসলে মা স্বচ্ছ’র মায়ের একটা মেয়েকে খুব পছন্দ হয়েছে। ও চায় মেয়েটাকে আমাদের স্বচ্ছের বউ করে আনতে।”
–“বেশ, তাতে সমস্যা কোথায়?”
রাজিয়া এবার বললো,
–“আসলে মা আঁধার তো এ বাড়ির বড় ছেলে ওর আগে স্বচ্ছ’কে বিয়ে করানোটা কেমন না? বলছিলাম কি আঁধারের থেকে অনুমতি নিয়ে ওর জন্য মেয়ে দেখলে হয় না? তারপর না হয় দুই ভাইয়ের বিয়ে একসাথেই হবে।”
কথাটা আমিনা বেগমের বেশ মনে ধরেছে। কিন্তু আঁধার যে ছেলে সে কি বিয়ে করতে রাজি হবে? ভাবলেন কিছুক্ষণ তিনি। তারপর বললেন,
–“নিশি বু আর আঁধার আর স্বচ্ছ’কে ডাকো। ও হ্যাঁ তৈমুর’ও যাতে আসে।”
মিনিট দুয়েকের মধ্যেই আমিনা বেগমের ঘরে নিশি, আঁধার আর স্বচ্ছ এবং তৈমুর এসে হাজির হলো। আমিনা বেগম সবকিছু বলতেই নিশি ভাইয়ের দিকে তাকালো। তার কোনো ভাবাবেগ নেই। তারপর আবার স্বচ্ছ’র দিকে তাকালো ওর মুখটা একটু মলিন লাগছে। নিশি ভ্রু কুঁচকে ফেললো। তৈমুর বললো,
–“এ তো বেশ ভালো কথা দাদু। তা কাকীমা, আমাদের স্বচ্ছ’র জন্য কোন মেয়ে পছন্দ করেছেন?”
শেষ কথাটা রাজিয়াকে উদ্দেশ্য করে বললো তৈমুর। রাজিয়া বেশ হাসিমুখেই বললো,
–“কাল বললাম না সবাইকে জলের কথা? মেয়েটা বড় একটা দূর্ঘটনার হাত থেকে বাঁচিয়েছে, ওকে আমার বেশ ভালো লেগেছে। কি সুন্দর মায়া মুখ। আমি সিয়র তোমাদেরও ভালো লাগবে ওকে।”
মায়ের মুখে জলের কথা শুনে চমকে তাকায় স্বচ্ছ। জল’কে পছন্দ হয়েছে রাজিয়ার? বাহ! তাহলে তো সোনায় সোহাগা আর স্বচ্ছ’কে আলাদা করে কিছুই করা লাগবে না। ছক্কা তো রাজিয়া’ই মেরে দিয়েছে। এখন শুধু দেখার পালা জলের পরিবার কি বলে। এতক্ষণ চুপচাপ থেকে আঁধার বললো,
–“হ্যাঁ তো স্বচ্ছ’কে বিয়ে করাও, সমস্যা কি এতে?”
নিশি বললো,
–“ভাই আমরা একটা সোসাইটিতে থাকি। সবাইকে নিয়ে আমাদের চলতে হয়। এখন তোর আগে যদি স্বচ্ছ বিয়ে করে নানান মানুষে নানান কথা বলবে না?”
–“সোসাইটির কথায় কান না দিলেই হয়।”
তৈমুর বললো,
–“কি হচ্ছে আঁধার? বিয়ের মালা তো একদিন গলায় পড়তেই হবে তাহলে এখনই পড়লে সমস্যা কি? তোমার আলাদা কোনো পছন্দ থাকলে বলো আমরা সেখানেই কথা বলবো। আর যদি সেরকম কিছু না থাকে তবে আমরা মেয়ে দেখা শুরু করি?”
–“প্রয়োজন নেই তৈমুর ভাই।”
–“আচ্ছা আমরা দেখবো না মেয়ে। তবে পছন্দের কেউ আছে নিশ্চয়ই?”
তৈমুরের প্রশ্নের জবাবে আঁধার ছোট্ট করে বললো,
–“না।”
আমিনা বেগম তেজি গলায় বললো,
–“তাহলে তুমি বলতে চাইছো, তুমি বিয়ে করবে না? এভাবেই থাকবে?”
–“এভাবেই থাকবো আজীবন সেটা বলিনি। যখন মনে হবে, না এখন বিয়েটা করে নেওয়া দরকার তখনই করবো। তোমরা স্বচ্ছ’র বিয়ে নিয়ে ভাবো।”
কথাটা বলে চলে যেতে চেয়েও থামে আঁধার। রাজিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে,
–“কাকীমা? তোমার যে মেয়েকে পছন্দ, কাল সবাই মিলে গিয়ে কথাবার্তা বলে বিয়ে পাকা করে ফেলো।”
গটগট করে চলে যায় আঁধার৷ আমিনা বেগম, নিশি আর তৈমুর সেদিকে তাকিয়ে তপ্ত শ্বাস ফেলে। ছেলেটা ছোট থেকেই একগুঁয়ে, নিজে যা বলবে তাই করবে। ছোট থেকে মা-বাবার আদর ছাড়া বড় হওয়া ছেলেরা বুঝি এমনই হয়? আমিনা বেগম, শাহাদাত রেজওয়ান, রাজিয়া উনারা কখনো নিশি আর আঁধারকে মা-বাবার অভাব বুঝতে দেয়নি তবুও তাদের অভাব কি কখনো পূরণ হয়? হয় না।
–
তৈমুর হাসান। পেশায় একজন ব্যাংকার। ❝স্বপ্ন নীড়❞ এর একমাত্র মেয়ে জামাই। বাবা মা দুজনেই গ্রামে থাকেন। আর কোনো ভাই বোন নেই তৈমুরের। তৈমুর আর নিশি মাঝে মধ্যেই সেখান থেকে গিয়ে ঘুরে আসেন। উনাদের অনেক বার বলা স্বত্তেও তারা নিজেদের বাপ-দাদার ভিটা ছেড়ে শহরের ইট পাথরের দালানে এসে থাকবে না। তৈমুর প্রথমে আলাদা ফ্ল্যাট নিয়েই থাকতো নিশিকে নিয়ে। কিন্তু নিশি সেখানে একা একা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। তাই এই বাড়ির সকলের অনুরোধে তৈমুর এ বাড়িতে থাকতে রাজি হয়েছে।
আমিনা বেগমের ঘর থেকে এসেই তৈমুর ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে। কিছু কাজ ইনকমপ্লিট আছে সেগুলোই কমপ্লিট করছে এই মূহুর্তে। নিশি এখনো আসেনি ঘরে। তৈমুরের কাজ শেষ হতেই ও বিছানায় টান টান হয়ে শুয়ে অপেক্ষায় রইলো তার এক মাত্র বউয়ের। মিনিট পাঁচেক পেরোতেই নিশি এসে ঘরের দরজা লক করলো। লাইট অফ করে বিছানায় শুতে শুতেই প্রশ্ন করলো,
–“ঘুমিয়ে পড়েছো? স্যরি দাদু’র সাথে কথা বলে আসতে আসতে লেট হয়ে গেলো।”
তৈমুর একটানে নিশিকে নিজের বুকের উপর নিয়ে কপালে চুমু খেয়ে বললো,
–“আমাকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করাবা না, বলেছিলাম না? বাড়িতে থাকলে তোমার অনুপস্থিতি ভালো লাগে না আমার।”
–“আচ্ছা বাবা স্যরি। আর হ্যাঁ শুনো না, পরশু তো শুক্রবার, ওইদিন সবার অফডে। তাই দাদু ঠিক করেছে শুক্রবারেই সবাই মিলে স্বচ্ছ’র জন্য জলকে দেখতে যাবে শুনলেই তো তখন। তোমাকেও কিন্তু যেতে হবে।”
–“না গেলে হয় না?”
–“কেন হবে তৈমুর? তুমি আঁধার, স্বচ্ছ ওদের একমাত্র দুলাভাই। আর তুমি যাবে না?”
–“আচ্ছা, আচ্ছা যাবো। খুশি এবার?”
–“হু ভীষণ।”
–
সপ্তাহে শুক্রবারের এই একটা দিন জোনাকি’কে বারবার ডাকা স্বত্তেও বেলা নয়’টার আগে ঘুম থেকে টেনে তোলা যায় না। আজকেও তার ব্যাতিক্রম হলো না। নয়’টার দিকে উঠে ফ্রেশ হয়ে দুই বোনে একসাথে নাস্তা করতে বসলো। আনিসুজ্জামান সোফায় বসে টিভিতে খবর দেখছেন। জাহানারা পাশেই বসা। তিনি দুই মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন,
–“কি খাবি আজকে? যা খাবি দ্রুত বল, ঝটপট রান্না সারতে হবে। আজকে তো আবার জুম্মা’র দিন।”
দুজনেই জবাব দিলো, যা খুশি রাঁধো। জাহানারা’ও আর প্রশ্ন করলো না।
দুপুরের খাবার দাবার খেয়ে যার যার ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছে জোনাকি ওরা। জোনাকি আর জল অবশ্য এক ঘরেই থাকে। আর একটা ঘর সবসময় ফাঁকা পড়েই থাকে। দুই বোন জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠলো। জোনাকি গায়ে উড়না জড়িয়ে এসে দরজা খুলতেই সামনের মানুষগুলোকে দেখে অবাক। তেমনি অবাক হয়েছে নিশি, আমিনা বেগম উনারা’ও। জোনাকি দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে বললো,
–“আরেহ ম্যাম, দাদু আপনারা? আসুন প্লিজ।”
সবাই হাসিমুখেই ঘরে ঢুকে সোফায় বসলো। ততক্ষণে জাহানারা এবং আনিসুজ্জামান এসে উপস্থিত হয়েছেন। এসেছে জল’ও। স্বচ্ছ এক পলক জলের দিকে তাকাতেই জল মাথা নামিয়ে ফেলে। জোনাকি স্বচ্ছ’র পাশে দাঁড়িয়ে বলে,
–“দাঁড়িয়ে আছেন কেন স্বচ্ছ স্যার? প্লিজ বসুন।”
স্বচ্ছ বসলো। জোনাকি ওর বাবা মায়ের সাথে সকলের পরিচয় করিয়ে দিলো। আমিনা বেগম সরাসরি বলে দিলেন,
–“আপনাদের অনুমতি না নিয়েই আমরা স্বচ্ছ’র জন্য আপনার মেয়ে জলকে দেখতে এসেছি, দুঃখিত।”
কথাটা শুনেই জল দ্রুত নিজের ঘরে ঢুকে পড়লো। হুট করেই লজ্জা লজ্জা লাগছে ওর। আনিসুজ্জামান বললো,
–“ছিঃ ছিঃ এভাবে বলবেন না, মেয়ে বড় হয়েছে সম্বন্ধ কম বেশি আসবেই।”
এভাবে কথা চালাতে শুরু করলেন সকলে। জোনাকি আর জাহানারা রান্নাঘরে গেলো। ফ্রিজে অল্প কিছু ফলমূল আছে। এতে হবে না। তাই জাহানারা জোনাকিকে দ্রুত সামনের বাজার থেকে কিছু জিনিসপত্র কেনাকাটা করে নিয়ে আসতে বললো। জোনাকি ঘরে ঢুকে পার্স হাতে নিয়েই হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে গেলো ফ্ল্যাট থেকে। সিড়ি বেয়ে দ্রুত নামতে গেলেই কারো সাথে ধাক্কা লেগে থেমে যায়। মাথা ডলতে ডলতে বললো,
–“স্যরি আমি আসলে খেয়াল___”
উপরে তাকাতেই আঁধারকে ভ্রু কোঁচকানো অবস্থায় দেখে ভয়ে ঢোক গিললো। সবাই এসেছে বেশ ভালো কথা৷ এই কাটখোট্টা লোকটাকে কে আসতে বলেছিলো? ভাবছে জোনাকি। কিছু সেকেন্ড বাদেই ভাবনা চিন্তা সাইডে ফেলে বললো,
–“স্যার আপনি? আপনি’ও এসেছেন?”
–“আমি আসাতে খুশি না?”
থমথমে গলায় প্রশ্ন আঁধারের। জোনাকি জোর করে হাসার চেষ্টা করে বললো,
–“অবশ্যই খুশি, আপনি ভিতরে গিয়ে বসুন।”
কথাটা বলেই ছুঁটে চলে গেলো জোনাকি। আঁধার সেদিকে তাকিয়ে তপ্ত শ্বাস ফেলে। মেয়েটা কি সবসময় এরকম দৌড় ঝাপের উপরেই থাকে?
চলবে~