#একগুচ্ছ_ভালোবাসা
#অরনিশা_সাথী
|৪|
–“আমার অফিসে জয়েন করার আগে আপনি কন্ট্রাক্ট পেপারে সাইন করেছিলেন। আর সেখানে স্পষ্ট লিখা ছিলো, এক বছরের আগে কাজ ছাড়তে পারবেন না আপনি। যদি রিজাইন করেন তো সেক্ষেত্রে আমি আইনি পদক্ষেপ নেবো।”
আঁধারের কথায় জোনাকি ছলছলে চোখে তাকালো। সেদিকে আঁধারের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। অতঃপর জোনাকির কোনো কথা না শুনেই গটগট করে সেখান থেকে চলে যায় সে। জোনাকি বেশ কিছুক্ষণ সেখানে একই ভাবে দাঁড়িয়ে থেকে বাসায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়।
সাড়ে আটটার মতো বাজে। এলোমেলো পায়ে রাস্তায় হাঁটছে জোনাকি। ওর সবকিছু অসহ্য লাগছে। বিশেষ করে এই আঁধার রেজওয়ান নামের মানুষ’টাকে। ওর জীবনটা তেজপাতা বানিয়ে ফেলছে একেবারে। একটা বছর যে কবে শেষ হবে।
–
–“আপুই খেতে দে তাড়াতাড়ি, পেটে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে।”
খাবার টেবিলে বসে উক্ত কথাটি বললো জোনাকি। জল দ্রুত হাতে কিচেনে খাবার গরম করে প্লেটে সাজাতে সাজাতেই বললো,
–“এই তো হয়ে গেছে, আর একটু।”
জোনাকি টেবিলে কুনইয়ে ভর দিয়ে গালে হাত রেখে বসে আছে। ঘড়ির কাটায় বিকাল চারটা বেজে নয় মিনিট। জল দুই প্লেটে সুন্দর করে খাবার সাজিয়ে এনে রাখলো টেবিলে। দুই প্লেটে খাবার দেখে জোনাকি ভ্রু কুঁচকে বললো,
–“আপুই তুই আজও না খেয়ে বসে আছিস?”
জল চেয়ার টেনে বসে মুচকি হেসে বললো,
–“অফিস জয়েন করেছিস পর থেকে তো আর এক সঙ্গে দুপুরের খাবারটা খাওয়া হয়না। বৃহস্পতিবার আর শুক্রবার দুটো দিন যেহেতু একসাথে খাওয়ার সময় থাকে তাহলে কেন সেই সময়টা হাতছাড়া করবো?”
এ ব্যাপারে আর কিছু বললো না জোনাকি। ও জানে এ বিষয়ে যতই বারণ করা হোক, জল সে বারণ শুনবে না। জোনাকি খাবার প্লেট টেনে নিজের সামনে নিয়ে বললো,
–“আমার ফেভারিট চিংড়ি ভূনা। বাহ! আজকের খাবারটা একদম জমে যাবে।”
–
নিজের কেবিনে অলস ভঙ্গিতে বসে আছে জোনাকি। আঁধারের বাড়িতে সেদিনকার সেই ঘটনার আজকে সতেরো দিন চলে। সেদিনের পর থেকে আঁধার আর কোনোরুপ বাজে ব্যবহার করেনি, আর একগাদা কাজ বা ফাইল দিয়েও বসিয়ে রাখেনি। পর্যাপ্ত পরিমানের কাজ’ই দেয় জোনাকিকে। এই যে এখন যেমন কাজ নেই তাই চুপচাপ বসে আছে। আবার যখন আঁধারের ডাক পড়বে তখনই হুড়মুড়িয়ে তার কেবিনে যেতে হবে। এভাবেই চলছে সবকিছু।
–“জোনাকি আসবো?”
মাথা তুলে দরজার দিকে তাকায় জোনাকি। নিলয় দাঁড়িয়ে আছে। ও এই অফিসেই কাজ করে। জোনাকির সাথে মোটামুটি ভালোই সম্পর্ক। জোনাকি একগাল হেসে বললো,
–“হ্যাঁ হ্যাঁ, আসুন না।”
নিলয় হেসে কেবিনে প্রবেশ করে। চেয়ার টেনে বসে বলে,
–“ঝিমাচ্ছো যে? কাজবাজ নেই কোনো? চা কফি কিছু দিতে বলি?”
–“চা হলে মন্দ হয় না।”
নিলয় একজন স্টাফকে ডেকে দুই কাপ চা দিয়ে যেতে বললো। চা দিয়ে যেতেই শুরু হলো দুজনের টুকটাক আড্ডা। আড্ডার ফাঁকে নিলয় ছেলেটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে দেখছে জোনাকিকে। জোনাকির সেদিকে কোনো হেলদোল নেই। ও নিজের মতো চা খাচ্ছে আর নিলয়ের কথা শুনছে। মাঝে প্রয়োজন পড়লে হু হা করছে।
এতক্ষণ এ সবকিছুই নিজের কেবিন থেকে দেখছিলো আঁধার। এবারে আর নিতে পারলো না। সাথে সাথেই ফোন করলো। জোনাকি ফোন তুলতেই আঁধার দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–“মিস জোনাকি এটা আপনাদের আড্ডার জায়গা না। আড্ডা দিতে হলে আমার অফিস থেকে বেরিয়ে তারপর দিন, কাজের এখানে কাজ বাদ দিয়ে এরকম হাসি আড্ডা চলবে না।”
জোনাকি মিনমিন করে বললো,
–“আমার তো আপাতত কোনো কাজ নেই স্যার, কি করবো আমি?”
–“এক্ষুনি আমার কেবিনে আসুন, এক সেকেন্ডও যাতে লেট না হয়।”
কথাটা বলেই খট করে লাইন কেটে দেয় আঁধার। জোনাকি হুড়মুড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
–“আপনার সাথে পড়ে কথা হবে, স্যার ডেকেছেন আমাকে।”
কথাটা বলেই একরকম ছুটে গেলো সে। জোনাকি যেতেই আঁধার বললো,
–“বসুন।”
ভয়ে ভয়ে বসলো জোনাকি। আঁধার দুইটা ফাইল এগিয়ে দিয়ে বললো,
–“এই দুটো এখানে বসেই চেক করে দেখাবেন আমাকে।”
জোনাকি মাথা নাড়িয়ে ফাইল দেখায় মনোযোগ দেয়। আঁধার চেয়ারে হেলান দিয়ে সেদিকে ক্ষানিকটা সময় তাকিয়ে থেকে উঠে যায়। তারপর নিজেই দুই মগ কফি বানিয়ে একটা জোনাকির সামনে রাখে। জোনাকি অপ্রস্তুত ভাবে তাকায়। এরকম কিছুর জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। কল্পনা’ও করেনি আঁধার রেজওয়ান কখনো নিজে কফি বানিয়ে ওর দিকে বাড়িয়ে দিবে। আঁধার থমথমে গলায় বললো,
–“ফাইল দেখতে দেখতেই কফিটা শেষ করুন, তাহলে আর ঝিমুনি ভাবটা থাকবে না। ফলে ফাইল দেখাতেও কোনো ভুল হবে না।”
কথাটা বলেই সে নিজের মগ নিয়ে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। মনোযোগ সহকারে দৃষ্টি রাখে ঢাকার ব্যস্ত নগরীর দিকে।
জোনাকি কিছুক্ষণ কফির দিকে তাকিয়ে রইলো। লোকটা নিজে ব্ল্যাক কফি চিনি ছাড়া খেলেও ওর জন্য দুধ চিনি সহকারেই কফিটা বানিয়েছে। অতঃপর এক চুমুক কফি নিতেই বুঝলো, না লোকটা মুখে তেঁতো তেঁতো কথা বললেও কফিটা বেশ ভালোই বানায়।
–
হসপিটাল থেকে সবেই বেরিয়েছেন রাজিয়া। তার খুব কাছের বান্ধবী হসপিটালে ভর্তি, তাকে দেখতেই এসেছিলেন রাজিয়া। এখন বাসায় ফিরবেন। হসপিটাল থেকে বেরিয়ে বেশ ক’বার ড্রাইভারকে কল করলেন। শেষ বার ড্রাইভার কল তুলে বললো,
–“ম্যাডাম, আমি স্বচ্ছ ভাইকে ফোন করে বলছি আপনাকে নিয়ে আসতে। গাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে, গ্যারেজে আছি আমি, ঠিক করতে বেশ কিছুটা সময় লাগবে।”
–“তার প্রয়োজন নেই, আমি ট্যাক্সি ডেকে চলে যাচ্ছি।”
লাইন কেটে দিলো রাজিয়া৷ তিনি জানেন স্বচ্ছ এই মূহুর্তে নতুন একটা প্রজেক্ট নিয়ে বেশ ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে, তাই আর ছেলের ঝামেলা বাড়াতে চাইলেন না তিনি। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েও ট্যাক্সি না পেয়ে এবার উনি ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করলেন। এক কিনার দিয়েই হাঁটছিলেন তিনি হুট করেই একজনের সাথে ধাক্কা লেগে কিছুটা রাস্তায় চলে যান। সেই মূহুর্তেই একটা বাস ধেয়ে আসে এদিকে। আচমকা হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে রইলেন তিনি। হঠাৎই কেউ একজন উনার হাত ধরে টেনে সরিয়ে আনেন। রাজিয়া বেঁচে গেলেও সেই ব্যক্তিটি একটা রিকশার সাথে বাড়ি খেয়ে তার কনুইটা বিচ্ছিরি ভাবে কেটে যায়। রাজিয়া দ্রুত পায়ে মেয়েটিকে ধরে এক সাইডে নিয়ে আসে। মেয়েটির কনুই থেকে রক্ত বেরোচ্ছে ততক্ষণে। রাজিয়া ব্যস্ত কন্ঠে বলে,
–“ইশ্! আমাকে বাঁচাতে গিয়ে তুমি রক্তাক্ত হলে। নাম কি তোমার মা?”
মেয়েটা একবার নিজের কেটে যাওয়া কনুইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
–“জ্বি জল, আমার নাম জল।”
–“রক্ত এভাবে থামবে না মনে হচ্ছে, পাশেই হসপিটাল চলো আমার সাথে।”
জল যেতে না চাইলেও রাজিয়া ওকে একপ্রকার জোর করেই হসপিটালে নিয়ে যায়। সেখানে কনুইয় ড্রেসিং করিয়ে ব্যান্ডেজ করালো। ততক্ষণে স্বচ্ছ চলে এসেছে সেখানে। রাজিয়া নিজেই ফোন করে ছেলেকে ডেকেছেন, মেয়েটাকে বাসায় পৌঁছে দিতে হবে। ট্যাক্সির জন্য কতক্ষণ আর অপেক্ষা করবে? তাই ডেকে নিলেন ছেলেকে। স্বচ্ছ হন্তদন্ত হয়ে ছুঁটে রাজিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে তার দুই বাহু চেপে ধরে বললো,
–“তুমি ঠিক আছো মা? তোমার লাগেনি তো কোথাও?”
–“আমার কিচ্ছু হয়নি বাবা, আমার জন্য জলের কনুইটা বিচ্ছিরি ভাবে কেটে গিয়েছে।”
স্বচ্ছ জলের দিকে তাকাতেই থমকালো। এটা তো সেই মেয়েটা যে ওকে ভুলবশত ভিজিয়ে দিয়েছিলো। জল’ও বেশ অবাক’ই হয়েছে স্বচ্ছকে দেখে। সেদিনের ঘটনার জন্য লজ্জায় মাথা নুয়ালো সে। স্বচ্ছ জলের সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
–“আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জল, আমার মায়ের জীবন বাঁচানোর জন্য। অবশ্য ধন্যবাদেও এটা কম হয়ে যায়। আর আমরা সত্যিই খুব দুঃখিত আমাদের জন্য আপনার হাত কেটে গেছে।”
জল ধীর স্বরে জবাব দেয়,
–“এখানে ধন্যবাদ দেওয়ার কিছু নেই, একজন মানুষ হিসেবে একজন মানুষকে বিপদের হাত থেকে বাঁচিয়েছি জাস্ট এতটুকুই।”
স্বচ্ছ আর কিছু বললো না। রাজিয়া জলকে নিয়ে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে বললো,
–“বসো মা।”
–“আমি চলে যেতে পারবো আন্টি। সমস্যা হবে না কোনো।”
–“আহা বসো না, তোমাকে এভাবে একা ছাড়তে পারি না আমি। তার উপর আমার জন্যই তোমার এই অবস্থা।”
অগ্যতা গাড়িতে বসতেই হলো জলের। পাশে রাজিয়া’ও বসেছে। স্বচ্ছ সিটবেল্ট লাগিয়ে গাড়ি স্টার্ট দেয়। রাজিয়া জলের পরিবার সম্পর্কে খুঁটিনাটি সব কিছু জিজ্ঞেস করছে। জল’ও হাসিমুখে উত্তর দিচ্ছে সবকিছুর। সেই হাসিমাখা মুখটাকেই লুকিয়ে চুড়িয়ে বারবার লুকিং গ্লাসে দেখছে স্বচ্ছ।
–
রাত আটটা বাজে। অফিসের সব কাজ শেষ। কেবিনের সবকিছু গোছগাছ করে বেরোতে জোনাকির সামান্য দেরি হয়ে গেলো। লিফটের কাছে এসে দেখলো দরজা বন্ধ হয়ে আসছে। হুড়মুড়িয়ে লিফটে ঢুকেই একজনের শক্তপোক্ত বুকের সাথে বেশ জোরেসোরেই একটা ধাক্কা খেলো জোনাকি। ততক্ষণে লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। ধাক্কা খেয়ে আবার পেছনে লিফটের দরজার সাথে বাড়ি খেতে গেলেই আঁধার জোনাকির বাহু চেপে ধরে। জোনাকি ভয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। পিটপিট করে চোখ খুলতেই দেখে আঁধারের মুখটা। শেষ পর্যন্ত এই লোকটার সাথেই ধাক্কা খেতে হলো ওর? এখন নিশ্চয়ই কয়েকটা কড়া কড়া কথা শুনিয় দিবে। এই ভেবে জোনাকি নিজেকে প্রস্তুত করে নিলো কথাগুলো হজম করতে। কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে আঁধার কিছুই বললো না। জোনাকির বাহু ধরে টেনে সোজা ভাবে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বললো,
–“নেক্সট টাইম যেন আপনাকে এভাবে ছোটাছুটি করতে না দেখি আমি। আপনি এখন আর বাচ্চ নন, সবকিছুতে এত হুড়োহুড়ি কেন আপনার?”
জোনাকি মাথা নিচু করে বললো,
–“স্যরি স্যার, আর এমন হবে না।”
তারপর পিনপতন নিরবতা। লিফটে এই মূহুর্তে ওরা দুজন ছাড়া আর কেউ’ই নেই। নিচতলায় এসে লিফট থামতেই আঁধার হনহনিয়ে বেরিয়ে চলে গেলো। এবার আর জোনাকি বের হবার জন্য তাড়াহুড়ো করেনি, ধীরে সুস্থেই বেরিয়েছে। পাছে লোকটা যদি আবার কিছু বলে? যদি ধমকায় সেই ভয়ে।
চলবে~