#একগুচ্ছ_ভালোবাসা
#অরনিশা_সাথী
|৩|
বিশাল বড় দোতালা ডুপ্লেক্স বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো জোনাকি। অফিস থেকে আঁধার রেজওয়ান এর বাসার এড্রেস নিয়ে তারপর এসেছে এখানে। দরজার একপাশে ডোরবেল এর উপরে বাসার নেমপ্লেটে ″স্বপ্ন নীড়″ লিখা। নামটার উপর একবার হাত বুলিয়ে দিলো জোনাকি। মুচকি হেসে বিড়বিড় করে বললো,
–“স্বপ্ন নীড়, বেশ সুন্দর তো নামটা।”
জোনাকি ডোরবেল বাজাতে নিচ্ছিলো এমন সময় কেউ একজন দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। জোনাকি লোকটাকে ভালো করে লক্ষ্য করলো। দেখে মনে হচ্ছে এ বাসাতেই থাকে। হেল্পিং হ্যান্ড হতে পারে। লোকটা জোনাকি’কে দেখে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
–“কেডা আপনে, কারে চাই?”
–“আঁধার স্যার বাড়িতে আছেন চাচা? আমি উনার অফিস থেকে এসেছি।”
লোকটা কিছু বলার আগেই ভিতর থেকে একজন মেয়েলি কন্ঠে বললো,
–“আফজাল চাচা, কে এসেছে?”
কথাটা বলতে বলতেই একটা ফর্সা করে লম্বা মেয়ে এসে দাঁড়ালো আফজালের পাশে। আফজাল বললো,
–“আঁধার বাবার অফিস থেকে আইছে মামণি।”
মেয়েটা একগাল হেসে বললো,
–“আচ্ছা তুমি বাজারে যাও, আমি ওকে ভাইয়ের ঘরটা দেখিয়ে দিবো।”
আফজাল সম্মতি জানিয়ে চলে গেলো। মেয়েটা জোনাকি’কে ভিতরে আসতে বললো। জোনাকি গুটিগুটি পায়ে ভিতরে ঢুকে থ হয়ে গেলো। বাইরে থেকে বাসাটা যত সুন্দর ভিতরে তার থেকেও অনেক বেশি সুন্দর। মেয়েটা জোনাকি’কে সোফায় বসিয়ে বললো,
–“আমি নিশি, তোমার বস আঁধার রেজওয়ান ওর বড় বোন। তোমার নাম কি?”
–“জো্ জোনাকি।”
নিশি একগাল হেসে বললো,
–“বাহ! তোমার মতো তোমার নামটাও বেশ সুন্দর। তুমি কি ভয় পাচ্ছো?”
–“না আসলে একটু নার্ভাস আপু।”
–“ভাইকে ভয় পাও?”
–“সারাক্ষণ তো রেগে বোম হয়েই থাকে উনি। নাকের ডগায় রাগ নিয়ে ঘুরে।”
জোনাকি’র এহেন কথা শুনে নিশি শব্দ করে হাসলো। নিশির হাসি দেখে জোনাকি মুচকি হাসলো। হঠাৎই দেয়াল ঘড়ির দিকে চোখ গেলো জোনাকি’র, আটটা পেরিয়ে গেছে। জোনাকি একলাফে দাঁড়িয়ে গিয়ে বললো,
–“আল্লাহ! আটটা দুই বাজে। স্যার আমাকে ঠিক আটটায় ফাইলগুলো দিতে বলেছিলো।”
–“ভয় পেও না, দু মিনিট এদিক ওদিক হলে কিচ্ছু হবে না। উপরে বাম দিকের তিন নাম্বার ঘরটাই ভাইয়ের। তুমি গিয়ে ফাইল দিয়ে আসো।”
জোনাকি সম্মতি জানিয়ে উঠে পড়লো। এক প্রকার দৌড়ে গেলো আঁধারের ঘরে দিকে। নিশি হাসলো। ওর ভাইটাও না সবার সাথেই রাগ দেখায়। নিশ্চয় বলেছে আটটার এদিক ওদিক হলে খবর আছে, তাই তো মেয়েটা এরকম ভয় পেয়ে আছে। জোনাকি দরজায় টোকা দিয়ে বললো,
–“আসবো স্যার?”
–“কাম।”
জোনাকি গিয়ে দেখলো আঁধার সোফায় বসে ল্যাপটপে কাজ করছে। জোনাকি ফাইলগুলো এগিয়ে দিলো আঁধার এর দিকে। আঁধার ফাইলগুলো নিয়ে বললো,
–“ইউ আর টু মিনিট লেট।”
–“আ্ আসলে স্যার নিচে নিশি ম্যামের সাথে কথা বলতে বলতে___”
–“ইট’স নট মাই কনসার্ন। পানিশমেন্ট তো পেতেই হবে মিস জোনাকি।”
জোনাকি মাথা নিচু করে নিলো। আঁধার ফাইল চেক করতে করতে বললো,
–“আজ অফিসে না আমার বাসায় ডিউটি করবেন আপনি।”
আঁধারের কথায় কপাল কুঁচকে ফেললো জোনাকি। বিস্ময় নিয়ে বললো,
–“মানে?”
–“মানে খুব সহজ, আমি আজ অফিস যাচ্ছি না। সো, আপনি এখানে আমার সামনে বসে অফিসের কাজ করবেন। কিছু পেন্ডিং জমা হয়ে আছে, সেগুলো টাইপ করে প্রিন্ট আউট করবেন।”
কথাটা বলে আঁধার ল্যাপটপ এগিয়ে দিয়ে পেন্ডিংগুলো বুঝিয়ে দিলো। জোনাকি ভেবেছিলো দুই/একটা পেন্ডিং জমা থাকতে পারে৷ কিন্তু এখানে তো অসংখ্য পেন্ডিং জমা হয়ে আছে। এতগুলো পেন্ডিং একা হাতে টাইপিং করে প্রিন্ট আউট করতে গেলে রাত হয়ে যাবে। কি করে করবে এসব? জোনাকি আমতা আমতা করে বললো,
–“কিন্তু স্যার এখানে তো অনেক___”
–“নো সাউন্ড, কাজটা আপনাকেই করতে হবে। আফটার অল, ইউ আর মাই পারসোনাল এসিস্ট্যান্ট। দিস ইজ অল ইউ হ্যাভ টু ডু।”
–“এতগুলো পেন্ডিং আমি একা কি করে করবো স্যার?”
–“সবে তো শুরু, পিকচার আভি বাকি হ্যায় মিস জোনাকি।”
কথাটা বলেই বেরিয়ে গেলো আঁধার। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো জোনাকি। কোন অলক্ষুণে যে এই আঁধার রেজওয়ান এর কোম্পানিতেই ওর চাকরিটা হলো। ও কালই রেজিগনেশন লেটার পাঠিয়ে দিবে। মনে মনে ঠিক করে কাজে মন দিলো জোনাকি।
–
আঁধারকে ব্রেকফাস্টের জন্য ডাকতে ওর ঘরে এলো নিশি। এসেই দেখলো জোনাকি খুব মন দিয়ে টাইপ করে যাচ্ছে। নিশি এগিয়ে গিয়ে বিছানার এক কোনে বসে বললো,
–“তুমি ভাইয়ের ঘরে বসে কাজ করছো? আর আমি ভেবেছিলাম চলে গেছো বোধহয়।”
–“যাওয়ারই তো কথা ছিলো ম্যাম, কিন্তু স্যার একগাদা পেন্ডিং ধরিয়ে দিয়ে বললো টাইপিং করে প্রিন্ট আউট করতে। এতগুলো পেন্ডিং আমার মতো মেয়ে একা শেষ করতে পারে বলুন?”
নিশি চোখ ছোট ছোট করে বললো,
–“এ তো ভারী অন্যায়, ভাই তোমাকে এতগুলো কাজ ধরিয়ে দিয়ে মোটেও ঠিক করেনি। ওকে বকে দিবো আমি।”
–“না না ম্যাম একদম না। পরে আঁধার স্যার আবার রেগে বোম হয়ে আমাকে ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিবে।”
জোনাকি’র কথা বলার ভঙ্গি দেখে নিশি শব্দ করে হেসে দিলো৷ জোনাকি কাজে মন দিলো। নিশি হাসি থামিয়ে বললো,
–“তুমি আমাকে ম্যাম না বলে আপু ডাকতে পারো।”
জোনাকি সম্মতি জানালো। এমন সময় ওদের বাসায় কাজ করে রেহানা, ও এলো সেখানে৷ নিশিকে বললো,
–“নিশি আপা দাদীজান নাস্তার জন্য ডাকছে।”
–“তুমি যাও আমি আসছি।”
রেহানা মাথা নেড়ে চলে গেলো। নিশি জোনাকি’র হাত ধরে বললো,
–“পরে কাজ করবে, এখন নাস্তা করবে আমাদের সাথে চলো।”
–“না না নিশিপু আমি___”
–“অনেক সকালে এসেছো, অত সকালে নিশ্চয়ই খেয়ে আসোনি, এবার চলো তো।”
জোনাকি’র কোনো কথা না শুনেই নিশি ওকে নিয়ে ডাইনিংয়ে চলে গেলো। ডাইনিংয়ে গিয়ে নিশি সকলের সাথে জোনাকি’র পরিচয় করিয়ে দিলো। আঁধার আর নিশি আপন ভাই বোন। ওদের মা-বাবা বেঁচে নেই। ওরা দুজন বাদে এ বাড়িতে আরো পাঁচ জন মানুষ আছে। আঁধারের দাদু আমিনা বেগম, এবং কাকা-কাকিমা, শাহাদাত রেজওয়ান এবং উনার স্ত্রী রাজিয়া এবং তাদের একমাত্র ছেলে স্বচ্ছ রেজওয়ান। এবং আঁধারের ফুপ্পির ছেলে রিশাদ। এতবড় বাড়িতে মাত্র সাতজন লোক থাকে ভেবে অবাক হলো জোনাকি। সবার সাথে পরিচিত হয়ে বেশ ভালো লাগলো জোনাকি’র। তবে আঁধারের কাকিমা জোনাকি’কে ঠিক একটা পছন্দ করেনি যা উনার চোখমুখ দেখে স্পষ্ট।
একসাথে সকলে নাস্তা শুরু করেছে। এমন সময় আঁধার এসে চেয়ার টেনে বসলো। জোনাকি’কে এখানে দেখে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–“আপনি কাজ রেখে এখানে কি করছেন?”
আঁধারের ধমকে জোনাকি ভয় পেয়ে উঠে দাঁড়ালো। আঁধারের দাদু আমিনা বেগম জোনাকি’কে বসতে বলে আঁধারকে বললো,
–“এসব কি হচ্ছে আঁধার? এমন ব্যবহার করছো কেন মেয়েটার সাথে?”
–“উনাকে এখানে কাজের জন্য আসতে বলা হয়েছে দাদু।”
নিশি রাগান্বিত কন্ঠে বললো,
–“তুই না দিনে দিনে কেমন জানি হয়ে যাচ্ছিস ভাই। ও এখানে আসতে চায়নি, আমিই জোরে করে এনেছি।”
আঁধার খেতে খেতে বললো,
–“নাস্তা শেষ করে দ্রুত কাজে হাত লাগান।”
জোনাকি সম্মতি জানালো। আঁধার নাস্তা শেষ করে চলে গেলো। জোনাকি’ও দ্রুত নাস্তা শেষ করে দৌড়ে আঁধারের ঘরে চলে গেলো। হঠাৎই পা স্লিপ করে পড়ে যেতে নিলেই আঁধার দুহাতে আগলে নেয়। ভয়ে চোখ বন্ধ করে আছে জোনাকি। নিজেকে সামলে নিয়ে দ্রুত আঁধারের থেকে সরে দাঁড়ায়৷ আমতা আমতা করে বললো,
–“স্যরি স্যার আ্ আসলে___”
–“দেখে শুনেও চলতে পারেন না নাকি ছেলে দেখলেই গাঁয়ে পড়ার স্বভাব? অবশ্য আপনাদের মতো মেয়েরা বড় ঘরের ছেলে দেখলে গাঁয়ে তো পড়বেই।”
–“আমি ইচ্ছে করে___”
–“কাজ শেষ করুন এক্ষুনি।”
ধমকের স্বরে কথাটা বলে আঁধার ফাইল নিয়ে বসলো। জোনাকি’র চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছিল। চোখের জল মুছে আবারো টাইপিংয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। কিন্তু চোখের জল বাঁধ মানছে না। জোনাকি’কে কাঁদতে দেখে আঁধার থমকে গেলো। মেয়েটাকে কি বেশিই হার্ট করছে ও? ঘুরেফিরে জোনাকি’র দিকে গিয়েই দৃষ্টি আটকাচ্ছে আঁধারের। জোনাকি কিছুক্ষণ বাদে বাদেই বা হাতের উল্টো-পিঠ দিয়ে চোখের জল মুছছে৷ বিষয়টা খারাপ লাগলো আঁধারের কাছে৷ ওর সাথে সামান্য উঁচু গলায় কথা বলার জন্য কম কাজের প্রেশারে রাখেনি তো মেয়েটাকে। ইচ্ছে করে অপ্রয়োজনীয় কাজগুলো জোনাকি’কে দিয়ে করাচ্ছে শুধুমাত্র আঁধারের সাথে উঁচু স্বরে কথা বলার জন্য। আঁধারের কেন জানি মনে হচ্ছে ও এসব ঠিক করছে না। অন্যায় করছে মেয়েটার সাথে। উঠে দাঁড়ালো আঁধার৷ হনহনিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
–
আট-টা নাগাদ জোনাকি কাজ শেষ করে স্বস্তির শ্বাস নিলো। চলেই যাচ্ছিলো। কিন্তু কিছু একটা ভেবে আবারো বসে পড়লো টাইপিং মেশিনের সামনে। রেজিগনেশন লেটার টাইপ করে প্রিন্ট আউট করে নিলো। আঁধার ঘরে নেই। সকালে বের হয়ে যাওয়ার পর দুপুরের দিকে এসে শাওয়ার নিয়ে আবারো চলে যায়। জোনাকি নিজের ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে নিচে নেমে এলো। নিশির সাথে দেখা হলে জোনাকি জিজ্ঞেস করলো,
–“স্যার কোথায়?”
–“ভাই? ও তো পুল সাইডে আছে। কোনো দরকার? দাঁড়াও ডেকে দিচ্ছি আমি।”
–“না না তার দরকার নেই। আপনি আমাকে দেখিয়ে দিন আমি চলে যাচ্ছি।”
নিশি জোনাকি’কে পুল সাইড দেখিয়ে দিয়ে আমিনা বেগমের ঘরে চলে গেলো। জোনাকি পুল সাইডে গিয়ে দেখলো আঁধার ফুলের গাছ গুলোতে পানি দিচ্ছে। এই লোকটাকে এখন দেখলে কে বলবে এই মানুষটা রাগচটা, নির্দয় একজন মানুষ? জোনাকি আঁধারের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। আঁধার অপলক কিছুক্ষণ জোনাকি’র দিকে তাকিয়ে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
–“কাজ শেষ?”
জোনাকি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। আঁধার আগের মতোই গম্ভীর গলায় বললো,
–“তাহলে আসতে পারেন এখন।”
জোনাকি রেজিগনেশন লেটারটা আঁধারের দিকে এগিয়ে দিতেই আঁধার ভ্রু কুঁচকে তাকালো। জোনাকি আমতা আমতা করে বললো,
–“আ্ আমার রেজিগনেশন লেটার এটা৷ আমি আর আপ্ আপনার অফিসে কাজ করবো না।”
জোনাকি’র কথায় চোয়াল শক্ত হয়ে এলো আঁধারের। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–“রিজন?”
–“অফিসের শুরুর দিন থেকে দেখে আসছি, আপনি আমাকে একদমই পছন্দ করেন না। আপনার সাথে উঁচু স্বরে কথা বলার জন্যই আমাকে আপনার পায়ের তলায় রাখার জন্য এই চাকরিটা দিয়েছেন। নয়তো প্রথমে তো বেরই করে দিয়েছিলেন। তবুও চাকরিটা আমার প্রয়োজন ছিলো বলে আমি করেছি, করতে চেয়েছি। কিন্তু আপনি আমাকে মানুষ বলে মনেই করেননি। একের পর এক অপ্রয়োজনীয় পেন্ডিং টাইপিং করে প্রিন্ট আউট করিয়েছেন আমাকে দিয়ে। বহু বছর আগের অপ্রয়োজনীয় ফাইল নতুন করে চেক করিয়েছেন আমায় দিয়ে অথচ সেগুলো কোনো কাজেই লাগবে না। আর সব থেকে বড় কথা আজ আমার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আপনি। এরপরেও আপনার অফিসে কাজ করার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। অন্য কোথাও কাজ করবো তবুও আপনার অফিসে আর একদিনও নয়। আমারও সেল্ফ রেসপেক্ট আছে। তাই এই চাকরিটা আর করছি না আমি।”
আঁধার রেজিগনেশন লেটার’টা হাতে নিয়ে মুচড়ে ছুড়ে মারলো। জোনাকি ভয়ে ভয়ে বললো,
–“দে্ দেখুন ওটা ফেলে দিলেই হলো না। আমি কাজ করবো না যখন বলেছি তাহলে করবো না।”
কথাটা বলে জোনাকি চলে যেতে নিলেই আঁধার জোনাকি’র হাত চেপে ধরে। একটানে নিজের দিকে ঘুরিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–“এতক্ষণ আপনি বলেছেন আমি শুনেছি। এইবার আমি বলবো আপনি শুনবেন।”
চলবে~