এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায় পর্ব-১৫+১৬

0
474

#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_১৫

ভাতিজির বিয়ে উপলক্ষ্যে বাপের বাড়ি এসে এবার অনেকদিন থাকা হয়ে গেল আলেয়ার। গৃহিণী হলে বাপের বাড়ি থাকবার জন্য স্বামীকে মানালেই হয়। তাতে আবার তিনি করেন চাকরী! এখন স্বামীকে মানানোর সঙ্গে সঙ্গে কর্মক্ষেত্রের বসকেও মানিয়ে ছুটি নিতে হয়। ঘরে স্বামী, অফিসে বস্ — সব সামলিয়ে পাওয়া ছুটিতে বাপের বাড়ি আসা খুব কমই হয়ে ওঠে!
যাই হোক, অনেকদিন পর এবার এরকম লম্বা ছুটি পেয়েছিলেন। বাড়িতে এসে সবার কাছাকাছি থাকতে ভালোই লাগছে। ইচ্ছে করছে, চিরদিন থেকে যেতে। বাবা, ভাই-বোন আর ভাস্তে-ভাস্তিদের নিয়ে কি হৈচৈ করে থাকা হয়। মিলেমিশে, একসঙ্গে! কিন্তু তা তো হবার নয়। নির্ধারিত সময় ফুরোলেই চলে যাবার ঘণ্টা বাজে! দেখতে দেখতে নয়দিনের সময়টা কি করে যে পেরিয়ে গেল—
বিকেলের বাস। দুই কন্যা সহ আলেয়া ফিরবেন শ্বশুরবাড়ি। কন্যাদের বাপ সঙ্গে নেই। তিনি বৌভাতের অনুষ্ঠান থেকে ফিরে রাতেই সিলেটে গিয়েছেন।
এখন বসে বসে নিজের আর কন্যাদের জিনিসপত্র গুছিয়ে ব্যাগে তুলছেন। একগাদা কাপড় – চোপড়, কয়েক পদের ক্রিম, বডি লোশন, চিরুনি, ফোনের চার্জার, পাওয়ার ব্যাংক, ইয়ারফোন — কতো কিছু! সবই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা। বারবার খুঁজে খুঁজে এনে ব্যাগে নিতে হচ্ছে। তাও একা। নিজেদের জিনিসপত্র গুছানোর সময় তো কন্যাদের হাতে নেই! তারা তাদের ভাইবোনদের সঙ্গে হৈহৈ করেই কূল পাচ্ছে না, কাজ করবে কখন?
এই নিয়ে রাগ হলেও সেটা প্রকাশ করতে পারছেন না। বাড়িতে তো মেয়েরা সবকিছুই করে। রান্না-বান্না থেকে শুরু করে সবটাই। অবশ্য মা চাকরীজীবি হলে ছেলে-মেয়েদের সবকিছু শিখতেই হয়। করতেই হয়। কিন্তু তার দুই তনয়া বাড়িতে লক্ষ্মীই থাকে! বহুদিন পর নানাবাড়ি এসে খেই হারিয়েছে। হয় তো একটু মজেছে হুল্লোড়ে! তাই রাগ করতে গিয়েও করছেন না। করুক একটু হৈ-চৈ। বছরে ক’টা দিনই বা এ সুযোগ পায় ওরা?
অগত্যা নিজেকেই সব করতে হচ্ছে। হঠাৎ দরজায় করাঘাত শুনে চটকা ভাঙলো আলেয়ার। হাতের কাপড় ভাঁজ করে অনুমতি দিলেন,
— “আসো!”
আগন্তুক খুব সংগোপনে অনুপ্রবেশ করতে চেয়েছিলেন বলেই হয় তো দরজাখানা ‘ক্যাচ ক্যাচ’ রব তুলে খুলে গেল। অনাহুত শব্দটায় বিরক্ত হয়ে মুখ কুঁচকালেন চমক। আলেয়ার উদ্দেশ্যে বললেন,
— “গোছগাছ হয়ে গেল বুঝি, আলেয়া?”
বড় ভাবীকে দেখে হাসলেন তিনি। ব্যাগটা বিছানার একপাশে সরিয়ে বসবার জায়গা করে দিয়ে বললেন,
— “এই হয়ে এলো প্রায়। তুমি এসো, ভাবী। বসো এখানটায়।”
চমক বসলেন। হাতে হাতে ননদীনির একটু সাহায্যও করলেন। একটা জামা ভাঁজ করবার জন্য নিয়ে আহ্লাদ করে বললেন,
— “আর ক’টা দিন থাকলে হতো না? এই তো সেদিন এলে!”
— “সেদিন কই, ভাবী? নয়দিন হয়ে গেছে এরমধ্যেই!”
হাসলেন আলেয়া। চমক তবুও বলেন,
— “তাতে কি? আরও কটা দিন থেকে গেলে কি আমরা তোমাদের বের করে দিবো? বাপের বাড়ি তোমার। থাকতে পারো না?”
বলেই ভাঁজকৃত জামাটা ননদের হাতে তুলে দেন। আলেয়া সেটা যথা স্থানে রেখে প্রত্যুত্তর করলেন,
— “বিয়ের পর বাপের বাড়ি বলে তো আর নিজের কিছু থাকে না, ভাবী। আমার যেমন নেই, তোমারও তেমন নেই। এই যে অনু গেল, ওরও নেই। এখন সবার ওই শ্বশুরবাড়িই আসল!”
মেয়ের কথা ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলেন চমক। বললেন,
— “এক মেয়েকে তো তার ঠিকানায় পৌঁছে দিলাম। অন্যটাকে কি করবো, আলেয়া?”
অদ্ভুত করুণ সেই কণ্ঠস্বর। কেমন অসহায়ত্ব মিশে! আলেয়ার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। নরম সুরে বললেন,
— “অতো ভাবছ কেন? চারুর জন্য তোমরা তো আছই!”
— “বাবা – মা কি চিরদিন থাকে? চিরদিন কি ওকে আমরা আগলে রাখতে পারব? মlরবো না আমরা? তখন কি হবে ওর?”
কেঁদেই ফেললেন চমক। কাঁদতে কাঁদতেই প্রশ্নগুলো ছুঁড়লেন ননদের পানে। ক্রন্দনরত ভাতৃজায়ার মলিন মুখশ্রী দেখে সহসা কি বলবেন ভেবে পেলেন না তিনি। সান্ত্বনার বাণী শুনাবেন? কিন্তু শুনিয়ে কি লাভ?
একসময়ে বললেন,
— “চারু ছোট নয়, ভাবী। একজন আত্মনির্ভরশীল নারী কখনো স্বামীর উপর নির্ভর করে থাকে না। আর না-ই বিয়ের জন্য উতলা হয়ে থাকে। নিজেকে গুছানোর সময় ওকে দাও। ও ঠিক গুছিয়ে নিবে!”
— “আর বিয়ে? বিয়ে দিতে হবে না?”
এ কথায় ফিরে তাকায় আলেয়া। রোষ আর বিদ্বেষের মিশ্রণে অদ্ভুত এক দৃষ্টি তার,
— “একবার তো দিয়েছিলে, লাভ কিছু হয়েছে?”
নিরুত্তর থাকেন চমক। কিচ্ছুটি বলেন না আর। ভাতিজির পক্ষে শেষ সিদ্ধান্তটা আলেয়াই জানিয়ে দেন,
— “চারু না চাইলে ওর আর বিয়ে দেবার কোনো প্রয়োজন দেখছি না। চাকরি – বাকরি কিছু করতে চাইলে ওকে করতে দিও। না করলেও আপত্তি নেই। বাপের তো কম নেই। পাড়া প্রতিবেশী কি বলবে সেটা ভাবতে যেও না। পাড়ার লোক তোমায় ভাত – কাপড় দেবে না। যদি কখনো চারু সম্বন্ধ আসে তো, সর্বপ্রথম ওর মতামত নেবে। আগের মত কোনো ভুল করে, দ্বিতীয়বার ওর জীবনটাকে নরক বানাবে না, প্লিজ!”

*****

বসার ঘরে বসে সবাই টিভি দেখছিল রাতে। কাব্য, ঋতু, রিংকু – টিংকু আর নিখিল। আজ ওদের দলটা বেশ হালকা হালকা মনে হচ্ছে। কবির গেছে বৌকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি। ইমা – ইরাও তাদের মায়ের সঙ্গে বিকেলে চলে গেছে। সৌভিক আপাদত বাড়ি নেই। কোথায় গেছে বলে যায় নি।
সালমান খানের মুভি হচ্ছে একটা। কিসি কা ভাই কিসি কা জান। ফাইটিং সিন চলছে, সবগুলো তাই হা করে গিলছে। এমন সময় সৌভিককে ফিরতে দেখা গেল। স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে নিখিল ডাকলো,
— “কোথা থেকে ফিরলি?”
— “শহরে গিয়েছিলাম। টিকেট কাউন্টারে।”
চট করে ফিরে তাকিয়ে দেয়ালে ঝুলানো ক্যালেন্ডারে তাকালো নিখিল। অনেকদিন তো হয়ে এলো! ছুটির তো আর বেশি বাকি নেই! ফিরতে হবে। সপ্রতিভ গলায় বললো,
— “কনফার্ম করলি?”
— “হুঁ। গুছিয়ে নিস। কাল রাতের বাস। দশটায় টার্মিনাল থেকে উঠবো।”
বলেই পকেট থেকে দু’টো টিকিট বের করে হাতে দিলো ওর। তারপর সোজা উপরে চলে গেল ফ্রেশ হতে।
টিকিট দু’খানা নিয়ে নিশ্চুপ বসে রইল নিখিল। অনিমেষ চেয়ে কি যেন ভাবতে থাকলো। ছন্দপতন হলো আড্ডার। এতক্ষণের গল্প-গুজবের মৃদু আওয়াজ নিঃশেষ হয়ে কর্ণকুহরে শুধুই বাজতে লাগলো টিভির সালমান যান্ত্রিক স্বর!

****
যে আসে, তারে যেতে হয়!
কেউ থাকে না চিরকাল!
আজ রাতেই নিখিল – সৌভিকের ফেরার পালা। মাথার উপর বিদায় ঘণ্টি বাজছে। ইতোমধ্যেই নিজের সবকিছু গুছিয়ে নিয়েছে নিখিল। তবুও তার মনে হচ্ছে, এখনো অনেক কিছুই গোছানো বাকি!
সেসব কি করে গোছাবে সে? আদৌ কি গুছিয়ে নিতে পারবে?
সারাটা দিন অদ্ভুত এক অস্থিরতায় কাটলো বেচারার। চারুর সঙ্গে একটু কথা বলবার জন্য প্রাণ ছটফট করতে লাগলো। অথচ কথা বলবার উপায় নেই!
এই তো কয়েক ঘর পরেই ওর ঘর; চাইলেই দরজায় নক করে ডেকে নেয়া যায়। বলে ফেলা যায়, মনের কথা। কিন্তু চাইলেই কি সব পাওয়া যায়?
উচাটন করতে করতে বেলা গড়ালো। বিকেলে রিংকু – টিংকু এলো ওর কাছে। ক’দিনে বেশ ভাব হয়েছে কি-না। নিখিল ভাবলো, ওদেরকেই বলে দেখা যাক। চারুকে ডেকে এনে দেবে। কিন্তু কিছু বুঝে ফেলবে না তো? যদি কিছু মনে করে?
পরক্ষণেই মনে হলো, আরে কি ভাববে? ছোট মানুষ। ক্লাস এইটে পড়ে। এসব ভাবার সময় আছে না-কি? তারপরও, একটা কিন্তু থেকেই যায়!
কিছুক্ষণ ভাবলো। অবশেষে দ্বিধাদ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে বললো,
— “রিংকু – টিংকু? একটা কথা শুনবে?”
দু’জনে বিছানায় আসাম করে বসে ফোনে গেম খেলছিল। স্ক্রিন থেকে চোখ না তুলে বললো,
— “কি?”
— “একটা কাজ ছিল। করবে?”
ইতস্তত করলো।
— “কি কাজ? বলো।”
— “তোমাদের বড় আপা, মানে চারুলতা। তাকে একটু ডেকে দেবে?”
ওর বাচন ভঙ্গিতেই কি যেন ছিল। ত্বরিতে মাথা তুলে দু’ ভাই বাজের দৃষ্টি তাক করলো ওর উপর। রহস্যের গন্ধ পেয়েছে তারা!
রিংকুর ঘোর সন্দিহান গলা,
— “কেন? আপাকে দিয়ে কি কাজ?”
— “আছে। একটু কাজ। ডাকো না?”
অনুরুদ্ধ স্বর। টিংকু একটু ভাব নিয়ে বললো,
— “বড়’পা সবার সাথে কথা বলে না। আর এখন তো বলবেই না। দুপুরে ওর ঘুমোনোর সময়। এখনও ঘুমোচ্ছে।”
— “হোক। তুমি তবুও যাও না? কথা আছে আমার।”
করুণ শোনাল কণ্ঠটা। রিংকু আবারও শুধাল,
— “কি কথা?”
নিখিল বিপাকে পড়লো। তথাপি একটু রাগত স্বরেই বললো,
— “সে আছে। তোমাকে ডাকতে বলেছি। ডাকো।”
দু’ ভাই পরস্পরের দিকে তাকালো একপল। কি একটা ইশারা চোখে চোখেই বিনিময় হলো, নিখিল বুঝলো না। তারপর দু’জন একসঙ্গে বলে উঠলো,
— “বেশ। তবে মাকে ডাকছি। আপাকে ঘুম থেকে তুলতে মায়ের আপত্তি নেই।”
তারপর স্বর উঁচিয়ে ডাকলো,
— “মা-আ-আ!”
সঙ্গে সঙ্গেই নিখিল লাফ দিয়ে উঠে এসে দু’ ভাইয়ের মুখ চেপে ধরলো। করুণ থেকে করুণতর সুরে মিনতি করলো,
— “এমন করে না, সোনা ভাই। প্লিজ! আপাকে একটু ডেকে দাও। প্লিজ?”
চোখে – চোখেই হাসে দু’ ভাই। আচ্ছা জব্দ করা যাচ্ছে তবে!

বেশ কিছুক্ষণ তোষামোদ, চকলেট, ফুসকার লোভ, ওর শহরে বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার বাহানা, ইত্যাদি ইত্যাদি বলবার মানানো গেল দুই জমজকে। তারা রাজি হয়ে বললো,
— “তুমি ছাদে যাও। আমরা আপাকে আনছি।”
— “তোমাদের ছাদে আসতে হবে না। তোমার আপা এলেই হবে।”
আঁতকে ওঠে নিখিল। দুজন বিটকেলে হাসে,
— “আচ্ছা। আপা যাবে। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো।”
নিখিল নিশ্চিন্ত হয় না। তার হাঁসফাঁস লাগে। দম আটকে আসে। সে ত্বরিত পায়ে ছাদের দিকে এগোয়।

*****
গোধূলী বেলা। নীল অন্তরীক্ষে অদ্ভূত সুন্দর মেঘের ছড়াছড়ি। কিরণময় সূর্যের হলদে রোদের সঙ্গে সাদা পাহাড়ের মতো চমৎকার মেঘের লুকোচুরি। অক্টোবরের মৃদু – মন্দা সমীরণ ছোঁয়ায় মন ভালো হয় নিমিষেই। জুড়িয়ে যায় পরাণ। এমন দারুণ আবহাওয়ায় একা ছাদে দাড়িয়ে চারুর অপেক্ষার প্রহর গুনছিল নিখিল। কখন আসবে, কইবে সে মনের কথা!

চারু অবশ্য বেশি দেরি করলো না। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই চলে এলো। এসেই শুধালো,
— “কি ব্যাপার, নিখিল সাহেব? হঠাৎ তলব করলেন যে!”
নিখিল অন্যদিকে চেয়ে ছিল। ওর কথায় ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। চোখের দিকে তাকিয়ে হেসে বললো,
— “কেমন আছেন?”
মুচকি হাসলো মেয়েটা,
— “ভালো। আপনি?”
— “আলহামদুলিল্লাহ্!”
বলেই চুপ করলো নিখিল। তার ভাণ্ডারে হঠাৎ শব্দেরা নিখোঁজ। এতক্ষণের সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখা প্রস্তুতির সমস্তই বৃথা গেল। অস্বস্তিতে পড়ে মনের গহীনে হাতড়ে বেড়াতে লাগলো দু’ একটি শব্দ, যদি পরিস্থিতি সামাল দেয়া যায়!

নিখিলের অবস্থা বুঝতে পেরে হঠাৎ খুব হাসি পেয়ে ফিক করে হেসে ফেললো। বিব্রত নিখিল হঠাৎ সেই সুন্দর হাসির দিকে চেয়ে সব ভুলে গেল। চারুর হাসিটা যে মারাত্মক সুন্দর, সেটা আবিষ্কার করে অভিভূত হলো। কি সুন্দর শরীর দুলিয়ে হাসে মেয়েটা! নিটোল কোমল গাল দু’টিতে চমৎকার ভাবে ভাঁজ পড়ে, মিষ্টি রঙের পাতলা ওষ্ঠদ্বয়ের প্রাচীর ভেদ করে বেরিয়ে আসে ঝকঝকে মুক্তোর ন্যায় দাঁত! ঝংকার তোলা হাসির আওয়াজে ধ্যান ভঙ্গ হতে বাধ্য হয় যেকোনো ঋষির!
আনমনে ওই হাস্যোজ্বল কন্যার দিকে চেয়ে একটি নিষিদ্ধ ইচ্ছে জাগ্রত হয় নিখিলের মাঝে। ইচ্ছে করে, ওই মিষ্টি অধরের ভাঁজে অধর ডুবিয়ে দীর্ঘ এক চুম্বনের। চারিদিক শীতল বাতাস বইবে, চারুর অগোছালো রেশমি চুলগুলো উড়বে বেখেয়ালি হয়ে, তারই মাঝে দু’টি মানুষ মিলে যাবে দুটিতে!
পরক্ষণেই নিজের ভাবনায় লাগাম টেনে দিলো। যতোই সে চারুকে পছন্দ করে থাকুক, বিয়ের আগে, পরিপূর্ণ অধিকার পাবার আগে সে ওর কাছে পরনারী! আর পরনারীকে নিয়ে এমন চিন্তা পাপ, মহা অন্যায়!

চারু হাসি থামিয়ে ওর দিকে তাকালো। ওর অনিমেষ চাহনিতে লজ্জিত হলো খুব। লাজে গাল গরম হলো, আরক্তিম হলো চেহারা। বুঝতে পারলো, হুট করে হাসা ঠিক হয় নি। বললো,
— “কিছু কি বলবেন আপনি? বললে তাড়াতাড়ি বলাই ভালো। শুনে চলে যাই।”
নিখিল হঠাৎ মোহাবিষ্টের ন্যায় স্বগতোক্তি করলো,
—“আপনাকে যদি আমার বুকের বাঁ পাশের খালি জায়গাটায় বসাতে চাই, আপনি রাজি হবেন, চারুলতা?”

চলবে___

#মৌরিন_আহমেদ

#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_১৬

চারু হতচকিত হয়ে তাকায়। ফ্যাল ফ্যাল নয়নে চেয়ে রয় অনিমেষ। নিখিল সময় নেয় না। মনের কথা সব ব্যক্ত করতে হড়বড় করে বলে,

— “আমি জানি, আপনি কি অজুহাত দেখাবেন। আপনার আগে বিয়ে হয়েছিল; ডিভোর্স হয়েছে। আপনার কখনো বাচ্চা হবে না। এজন্যে আমি আপনা কে মানবো কি-না; আমার পরিবার—ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু বিশ্বাস করুন। এগুলোতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না। আমার কাছে আপনার অতীত গুরুত্বপূর্ণ নয়, আর নয়ই বাচ্চা হওয়া না হওয়ার ব্যাপার। আমার নিজের ক্ষেত্রেও বাচ্চা না হওয়ার বিষয়টা ঘটতে পারতো। নিজের ক্ষেত্রে হলে যেটা আমাকে মানতে বাধ্য, সেখানে ভালোবাসার মানুষের ক্ষেত্রে হলে কেন মানব না? আপনি ইচ্ছে করে নিশ্চয়, নিজের অক্ষমতা সৃষ্টি করেন নি?”

বলেই নিশ্বাস ছেড়ে চারুর দিকে তাকালো। মেয়েটার জল টলমলে আঁখি ওর বুকে চিনচিনে ব্যথার অনুভূতি দিলো। একটু দম নিয়ে বললো,

— “আর রইলো পরিবার। আমার বাবা নেই। মাকে নিয়েই ছোট্ট সংসার। সেখানে আমরা দু’জনেই দু’জনের ভালো বন্ধু। দুজন দুজনকে প্রাধান্য দেই। তাই আমার মনে হয় না, আমার ভালোবাসাকে অযোগ্য ভাবার কোনো কারণই মা’র আছে! তিনি তা করবেনও না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।”

চারু মলিন গলায় শুধায়,

— “আর সমাজ? আত্মীয়-স্বজন? তারা বাঁধা দিবে না?”
নিখিল যেন আশার আলো পেল ওকে মুখ খুলতে দেখে। খানিক হেসে বললো,

— “আমাদের সমাজের খারাপ দিক কি জানেন? এখানে নিন্দুকের সংখ্যা বেশি। আর এই নিন্দুকেরা কখনো কারো ভালো দেখতে পারে না। ভালোকে নিরুৎসাহিত করাই এদের অভ্যাস। ওদের আমি পাত্তা দেই না। আর আত্মীয়-স্বজনের কথা বলছেন? ওরা হয় তো, সুযোগ পেলে একটু – আধটু বলবার চেষ্টা করবে। কিন্তু ভাববেন না, ও আপনার শাশুড়িই সামলে নেবে। তার বৌমাকে কিছু বলে পার পাবে নাকি?”

হাসলো নিখিল। সেই সঙ্গে ঠোঁটের কোণটা একটু প্রসারিত হলো চারুরও। নিঃশব্দ হাসির তালে দু’ ফোঁটা জল কখন যে গড়ালো কপোল বেয়ে সে টের পেল না। কিন্তু নজর এড়ালো না নিখিলের। এই প্রথম সাহস করে ওর অশ্রু মুছে দিতে হাত বাড়ালো নিখিল। ডান হাত দিয়ে ওর চোখের কোলের সবটুকু জল কণা শুষে নিয়ে বললো,

— “আপনাকে আগে একটা কথা মনে রাখতে বলছিলাম, রেখেছেন? চাঁদের মুখে কান্না মানায় না। তাকে উজ্জ্বল হাসিতেই শোভা পায়। আপনি চাঁদ চারুলতা; আমি আপনাকে আমি পাই বা না পাই, কিন্তু আপনার চোখে অশ্রু দেখার দুর্ভাগ্য আমি চাই না। কখনো কাঁদবেন না!”

চারু না চাইতেও ফুঁপিয়ে উঠলো,

— “কেউ কি শখ করে কাঁদতে চায়?”

— “চায় না, জানি। জীবনে হাসি – কান্না সবই থাকে। কিন্তু আমি চেষ্টা করবো, আপনার জীবনে সেই দুঃসময় গুলো না আসুক। অনেক তো সয়েছেন! আর না—”

বলেই হাতটা বাড়িয়ে দিলো ওর দিকে; ছোট্ট করে বললো,

— “বাকিজীবনটা আমার হাত ধরে থাকবেন, চারুলতা? প্লিজ?”

ওর সেই নরম গলার ছোট্ট আবদারটা এতো বেশি আদুরে ঠেকলো চারুর কাছে! একটু-একটু করে কোমল হাতটা এগিয়ে এলো নিখিলের পোক্ত হাতের তালুতে। মুঠো করে সেই কোমল হাতের পিঠে চুমু এঁকে দিলো সে! অস্পষ্ট স্বরে আওড়ালো,

— “ভালোবাসি, চারু। অনেক বেশিই ভালোবাসি!”

পুরুষালি সৌষ্ঠবপূর্ণ অধরের উষ্ণ ছোঁয়ায় আবেশে চোখ বুঁজলো চারু। অনুভূতির জোয়ারে ভেসে গেল সিক্তমন। হৃদ পিঞ্জিরায় ডানা ঝাপটালো বিহঙ্গের দল। কানে কানে ফিসফিসিয়ে গেল প্রজাপতিরা,

— “অবশেষে তোমার জীবনেও ভালোবাসা এলো, চারুলতা!”

*****

সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় নামতেই হাসিতে ফেটে পড়লো দুই ভাই। মুখ হাত চাপা দিয়ে ‘হা হা’ করে পেট থেকে উৎলে আসা হাসিটা আটকানোর ভঙ্গি করলেও হলো না। প্রাণ খুলে হাসতে লাগলো ওরা। এতদিন দুষ্টুমি করে, অন্যকে জব্দ করে তো প্রচুর হেসেছে; কিন্তু আজ— তাদের প্রিয় বোন বড়’পার জন্যে খুশিতে তৃপ্তি নিয়ে হাসলো। উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠলো টিংকু,

— “আমি বলেছিলাম! বলেছিলাম তোকে! দেখলিই?”

— “হুঁ।”

মাথা নাড়ে রিংকু। ও আবার চেঁচায়,

— “আমি জানতাম। আগেই টের পেয়েছিলাম। নিখিল ভাইয়ের পেটে খিচুড়ি পাকছে! ও যেভাবে বড়’পার দিকে তাকাতো না—”

— “একটু-একটু সন্দেহ তো আমারও জাগত। কখনো সেভাবে খতিয়ে দেখি নি।”

সঙ্গে সঙ্গেই হৈহৈ করে উঠলো টিংকু,

— “ওও? এখন সন্দেহ তোমারও হতো, না? মিথ্যেবাদী! আমি শুরু থেকেই তোকে বলতাম, তুইই বিরুদ্ধে যেতি। বলতি, ‘না-আ-আ! নিখিল ভাইয়া সরল মানুষ। এসবের ধান্দা নেই।’ ইসস, যেন কতো সাধু?”

শেষের অংশে ভেংচিয়ে বললো। রিংকু জবাব না দিয়ে হাসলো। নীরবে মাথা পেতে নিলো দোষ। তাই দেখে প্রসন্ন হলো সহোদর,

— “শোন, বড় বড় সাধুদেরও ধ্যান ভাঙে সুন্দরী নারীর সাহচর্যে এসে। ঋষিত্ব ছেড়ে সংসারী হয় কেবল নারীর প্রেমের টানে। আর সেখানে বড়’পার মতো এতো প্রীটি একটা মেয়েকে দেখে নিখিল ভাই পিছলাবে না? এও হয়! আমাদের আপা কত্তো সুইট!”

বোনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলো দুষ্টু দুই জমজও। হবু দুলাভাইকে নিয়েও মন্তব্য করলো,

— “নিখিল ভাইও কিন্তু হ্যান্ডসাম। বলিউড হিরোর মতো ড্যাশিং লুক ওনার, না?”

টিংকু দাম্ভিক হাসলো। কলার ঝাঁকিয়ে বললো,

— “দেখতে হবে না, দুলাভাইটা কার?”

ভাইয়ের অহেতুক দর্পে রাগ করলো না রিংকু। একটু ভেবে বললো,

— “তবে যাই বলিস, মাহতাব ভাইয়ের থেকে নিখিল ভাই অনেক ম্যাচিউর। অনেক ভালো। আপাকে ভালো রাখবে উনি, তাই না?”

মাহতাবের নাম শুনতেই মুখ কুঁচকে ফেললো ও। ঠোঁট উল্টে তীব্র অবজ্ঞাভরে উচ্চারণ করলো,

— “ওই ক্ষ্যাতের নাম নিস না তো। অশিক্ষিত একটা! নাম শুনলেও আপার সুখে নজর লাগবে। ফালতু লোক!”

— “ঠিকই বলছিস। ওর নাম নিলেও কু-নজর লাগবে আপার। কতো খুশির দিন ওর!”

— “তারচে’ চল, পার্টি করি। হোল নাইট মাস্তি!”

বলেই কাঁধ চাপড়ে দিল ভাইয়ের। রিংকু একঝলক হাবার মতো চেয়ে,
‘কিন্তু পড়া —’ প্রসঙ্গ তুলতে চাইলেও, জমজের যুক্তির উপর যুক্তিতে ধোপে টিকলো না কিছু। আনন্দে আত্মহারা হয়ে দু’ ভাই জড়িয়ে ধরলো দুজনকে! তারপর হাঁটা দিলো নিজেদের ঘরের দিকে।

****
অন্ধকার কক্ষে একলা বসে সৌভিক। সন্ধ্যা নেমেছে সেই কখন! এখনো আলো জ্বালে নি। জানালাও খুলে রাখা আলগোছে। অক্টোবরের হিম ধরানো মাতাল হাওয়ায় পর্দা উড়ছে সবেগে, হাতছানি দিয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছে ওকে। তবুও তার কোনো হেলদোল নেই!

বাগানের আলোয় দেখা আবছা ঘরে চেয়ে দেখলে বোঝা যায়, ছেলেটা স্তব্ধ মূর্তির ন্যায় নিশ্চুপ বসে। যার চোখের কার্নিশে চিকচিক করছে নোনা জলবিন্দু!

কিয়ৎক্ষণ পর দরজা খুলবার আওয়াজ হলো। বাতি জ্বালিয়ে নিখিল বললো,

— “কি রে, ঘুটঘুটে অন্ধকারে কি করছিস? জানালাও বন্ধ করিস নি? মশা এসে তো ভরে গেল—–”

বলেই ওর দিকে তাকালো। বিমূঢ় সৌভিক হঠাৎ যান্ত্রিক ভঙ্গিতে মুখ ফিরালো। ওর প্রশ্নকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে কেমন অদ্ভুত গলায় বললো,

— “চারু এতো সহজেই রাজি হয়ে গেল, তাই না? কি জাদু করলি ওকে?”

তাচ্ছিল্য নয়, উপহাসও নয়। বরং নিদারুণ অসহায়ত্ব মিশে। বন্ধুর এমন বিধ্বস্ত দশা দেখে নিখিল হতবাক!

চলবে___

#মৌরিন_আহমেদ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে