এই_সাঝঁবেলাতে_তুমি_আমি পর্ব-০৫

0
1732

#এই_সাঝঁবেলাতে_তুমি_আমি🍁
পার্ট ৫
#সারা_মেহেক
🍀🍁

রাতের নিকষ কালো আধাঁর নামতে এখনো কিছু সময় বাকি আছে।সাঝেঁর আলো খেলা করছে যেনো সারা আকাশ জুড়ে।সেই আলো মুসকানের মুখে এসে পড়ছে।কেমন একটা নীলচে কালো লাল রংয়ের মিশ্রণ। এই আলোতে মুসকানকে দেখতে অপরুপ লাগছে।
সাঝেঁর এ সুন্দর আলোতে চোখের বেরঙ পানিও যেনো সুন্দর একটা মিশ্রিত রং ধারণ করেছে।
আফনানের বারবার ইচ্ছা হচ্ছে মুসকানের গাল বেয়ে পরা চোখের পানি আলতো হাতে মুছে দিতে।কিন্তু কোন অধিকারে সে মুছে দিবে এ পানি।এ চিন্তা করতে করতেই সে দেখলো মুসকান হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের জল মুছে নিলো।

দুজনই চুপচাপ দাঁড়ীয়ে আছে। এ চুপচাপ থাকাটা বেশ জ্বালাচ্ছে আফনানকে। তাই সে ভাবলো নিজেই কথা শুরু করবে। কিন্তু তার আগেই মুসকান বললো,

“আমি আবারো সরি বলছি।আমার জন্য আপনার জামা ভিজে গিয়েছে।আমি ইচ্ছা করে করিনি এমন।”

আফনান খুব নরম সুরে বললো,

“বারবার সরি বলার কোনো প্রয়োজন তো দেখছি না আমি। অজান্তেই হোক। যাই-ই হয়েছে ভালোর জন্য হয়েছে। এটলিস্ট কান্না করে একটু হালকা তো হতে পেরেছো।মাঝে মাঝে এভাবে মন খুলে কাঁদলে একটু মনের ব্যাথাটা দূর হয়। তখন অনেকটাই হালকা লাগে নিজেকে।
তোমরা মেয়েরা তো ইচ্ছামতো কান্না করতে পারো। কিন্তু দেখো ছেলেদের এভাবে কান্না করার অধিকারটুকুও নেই। কারন সবাই কি না কি বলবে।”

“সেটা অবশ্য ঠিক।”
মুসকান কিছুক্ষন চুপ থেকে আবার বললো,

“আমি ভাবিও নি যে আমার দ্বারা এমন ভুল হবে। অথচ আমি ঠিক জায়গায়ই গহনা রেখেছিলাম। না জানি গেলো কোথায়।এখন খুঁজে পাবে নাকি সেটাও জানি না। ”
বলতেই চোখ দিয়ে দুফোটা পানি গড়িয়ে পরলো মুসকানের।
.
.
মুসকানের আব্বু বাজার থেকে এসে দেখে ড্রইং রুমে কেউ নেই। প্রথমে খুব অবাক হোন উনি।পরে নিজের রুমে গিয়ে দেখেন ছোটোখাটো একটা ভীর। এ দেখে প্রথমে উনার বুক কেঁপে উঠে,না জানি কি হয়েছে।ভীর ঠেলে সামনে এগিয়ে দেখেন তনয়া বেগম কান্না করছেন। উনি তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে বলেন,

“মাহিরার আম্মু,এভাবে কান্না করছো কেনো?কি হয়েছে?”

মুসকানের মামি বললো,

“ভাইজান, মাহিরার বিয়ের সব গহনা মনে হয় চুরি হয়ে গিয়েছে। পাওয়া যাচ্ছে না কোথাও।”

এটা শুনে মুসকানের আব্বু আঁতকে উঠলেন। তিনি বললেন,

“কি বলছো কি!!!সব জায়গায় ভালো করে খুঁজেছো?লকারে খুঁজেছো?”

মুসকানের আম্মু কান্না জড়িত কন্ঠে বললেন,

“আলমারি তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পায়নি।”

মুসকানের আব্বু বললেন,

“বাইরের লকারে দেখেছো?”

মুসকানের আম্মু এ কথা শুনে কান্না বন্ধ করে বললেন,

“না তো। সেখানে তে দেখি নি। আর ওখানে থাকবেই বা কেনো??আমি মুসকানকে দিয়ে আলমারির লকারে রাখিয়েছি গহনাগুলো।”

মুসকানের আব্বু তৎক্ষণাৎ গিয়ে রুমের বড়, মজবুত লকার খুললেন। আর সৌভাগ্যক্রমে গহনাগুলো সেখানেই পেলেন।
সবাই গহনা দেখে অবাক হয়ে যায়। কেউই ভাবেনি যে গহনা এখানে থাকবে। সবাই ভেবেছিলো গহনা চুরি হয়ে গিয়েছে।

মুসকানের আব্বু বললেন,

,”আমি আজকে বিকালে বাজারে যাওয়ার আগে গহনা আলমারির লকার থেকে বাইরের লকারে রেখে গিয়েছি।কারন আলমারির লকারের চেয়ে এই লকার মজবুতও বেশি।আর পাসওয়ার্ড ও কঠিন। মুসকানের আম্মুকে এ কথা বলে যাবো কিন্তু সে তো কাজে ব্যস্ত ছিলো তখন।তাই ভাবলাম বাজার থেকে এসেই বলবো। কিন্তু কে জানতো এমন হবে।”

মুসকানের আম্মু এ কথা শুনে বললেন,

“এ একটা কাজ করলে তুমি!!এজন্য আমি মেয়ের গায়ে হাত উঠিয়েছি তাও আবার সবার সামনে!!”

মুসকানের আব্বু বললো,

“সে কি। তাই বলে ভালোভাবে না দেখে মেয়ের গায়ে হাত তুললে!!”

“প্রথমেই গহনা না পেয়ে আমার মাথা কাজ করছিলো না। ”

মুসকানের চাচি সুমনাকে বললো,

“সুমনা তাড়াতাড়ি মুসকানকে ডেকে নিয়ে আয়।না জানি কোথায় আছে মেয়েটা।”

সুমনা তখন মুসকানের কাছেই যেতে চাচ্ছিলো কিন্তু মামি সুমনাকে পানি আনার জন্য পাঠিয়ে দেয়,তাই তখন যাওয়া হয়নি।

সুমনা তাড়াতাড়ি ছাদে গেলো। ছাদে গিয়ে দেখলো আফনান আর মুসকান কথা বলছে। সুমনা আফনানকে এখানে আশা করেনি। সে মুসকানকে দূর থেকে ডেকে বলে,

“মুসকান নিচে চল তাড়াতাড়ি। গহনা পাওয়া গিয়েছে। তোকে ডাকছে।”

একথা শুনে মুসকান তাড়াতাড়ি রুমের উদ্দেশ্যে গেলো। পিছে পিছে আফনানও গেলো।

মুসকান রুমে আসার সাথে সাথে তনয়া বেগম মুসকানকে জড়িয়ে ধরে বললেন,

“এভাবে মারাটা সত্যিই উচিত হয়নি আমার। সব আগে ভালো করে দেখে নেওয়া উচিত ছিলো। গহনা ঐ বড় লকারে ছিলো। তোর আব্বু বিকালে রেখে গিয়েছিলো। আমদেরকে বলার সুযোগ পায়নি।কিছু মনে করিস না মা।”

মুসকান ধীর গলায় বললো,

“কিছু মনের করিনি আম্মু।”

.
.
.
আজকে রাতেও ঘুম আসছে না মুসকানের। কি যে হয়েছে নিজেও বুঝছে না সে।এপাশ ওপাশ করতে করতে আবার সেই গিটারের আওয়াজ। কিছুক্ষণ পর গান শুরু হলো,

“Mujhko baarsat bana lo
ek lambi raat banalo
apni jaazbaat bana lo jana
………………………………….”

পুরো গানটা গতকাল রাতের মতে আজকেও মন দিয়ে শুনেছে। গান শেষ হওয়ার পরও মনে হয় শেষ হলো কেনো গানটা। গানগুলো যেমন পছন্দের এখন গায়কও পছন্দের হয়ে গেলো। এই গায়কটাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে। গানগুলো আর কন্ঠটার প্রেমে পরে গিয়েছে সে। প্রেমে পরারই কথা।কারন এতোটা সুন্দর করে গান গাওয়া ব্যক্তিটার প্রতি একটা ঝোঁক চলে আসে। বারবার শুনতে ইচ্ছা করে তার গলা।

.
.
.
সকাল বেলা সবার চিৎকার চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙলো মুসকানের।প্রায় প্রতিদিন এভাবেই ঘুম ভাঙে বলা যায়।যেদিন একটু গভীর ঘুমে থাকে সেদিন সুমনার ঝাঁকুনিতে ঘুম ভাঙে তার। বাড়ীতে মেহমান আসা থেকে এমন হচ্ছে তার সাথে।

সকালের নাস্তা করে মুসকান ছাদে এসে দাঁড়ীয়েছে।সুমনা নিচে বসে ফোন টিপছে।জোর করেও তাকে আনা যায়নি ছাদে।
ছাদে দাঁড়ীয়ে সকালের স্নিগ্ধ বাতাস চোখ বন্ধ করে অনুভব করছে মুসকান। খুব একটা রোদ নেই আকাশে। হালকা মেঘলা আকাশ। হয়তো হুট করেই বৃষ্টির আগমন হতে পারে। বৃষ্টির কথা মনে পরতেই মুসকানের মনে তীব্র একটা ইচ্ছা জাগলো বৃষ্টিতে ভিজার। অনেকদিন ভিজে না সে। বৃষ্টিতে ভিজার মজাই আলাদা। অন্যরকম একটা অনুভুতি হয়। সে অনুভুতিটা হয়তো ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।

কিছুক্ষন পর ছাদে আসলো আকাশ আর আফনান।তারা এসে দেখলো মুসকান চোখ বন্ধ করে কিছু অনুভব করার চেষ্টা করছে।হয়তো এ পরিবেশটা।আকাশ ধীর গলায় বললো,

“মুসকান।তোমার সাথে কি একটু কথা বলা যাবে??”

এভাবে হুট করে কারোর গলার আওয়াজে চমকে উঠে মুসকান। কিম্তু সে ভাবটা বাইরে প্রকাশ করে না। সে পাশ ফিরে দেখলো আকাশ দাঁড়ীয়ে আছে। তার থেকে একটু দূরে দাঁড়ীয়ে আছে আফনান।

মুসকান আকাশকে লক্ষ করে বললো,

“কি বলবেন বলুন।”

আকাশ একটু ইতস্তত করে বললো,

“মুসকান আমরা কি আবার আগের মতো বন্ধু হতে পারি?”
বলে মুসকানের দিকে হাত বাড়ীয়ে দেয়।

এ দেখে মুসকান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

“চাইলেই কি আবার সব আগের মতো করা যায় নাকি??একটা ভাঙা গ্লাস কে কি আবার আগের মতো করে ফেলা সম্ভব?হয়তো জোড়া দেওয়া যায়।কিন্তু দাগ তো রয়েই যায়।”

মুসকানের এ কথা শুনে আকাশ মাথা নিচু করে নিজের হাত ফিরিয়ে নিলো।আর বললো,

“১০বছর আগের কথা এভাবে মনে গেঁথে নিয়ে থাকবে কতোদিন?অতিত নিয়ে কতোদিন বাঁচা যায় বলো।
আর ১০বছর আগে যেটা হয়েছিলো সেটা নিতান্তই আমার না বুঝার জন্য হয়েছিলো। আমি না বুঝে তোমাকে ওভাবে চড়টা মারি।
আসলে সে সময়টাতে বয়সের একটা প্রভাব ছিলো। তখন এসব পছন্দ,প্রেম, ভালোবাসার প্রতি স্বভাবতই মানুষের ঝোঁক থাকে বেশি। আমারও ছিলো। এজন্য না জেনে বুঝে তোমার সাথে এমন বিহেইভ করি।
এখন মনে হয় যে আসলে হয়তো তোমার কোনো ভুলই ছিলো না সেদিন। আমিই বেশি বেশি করে ফেলেছিলাম।এইজন্য সরি। আই এম এক্সট্রেমলি সরি।”

মুসকান হালকা হেসে বলে,

“সেদিন আমার আসলেই কোনো দোষ ছিলো না। সেদিনকার প্রতিটা ঘটনা যে আমার একদম ভালোভাবে মনে আছে তা না।কিন্তু এটুকু ঠিকই মনে আছে যে সেদিন আমি ছবিটা ইচ্ছা করে নেয়নি।”

আকাশ বিনতি সুরে বললো,

“আচ্ছা সেসব কি ভুলা যায় না??ওসব অনেক আগেকার বিষয়। অতিতকে মনে রেখে কেনো আমরা বর্তমান আর ভবিষ্যত কে নষ্ট করবো??
প্লিজ,মুসকান।আমি চাই আমাদের মধ্যে আগেকার মতো বন্ধুত্ব হোক।এটা চাওয়া কি অন্যায়??”

মুসকান কিছুক্ষণ ভেবে বললো,

“চেষ্টা করা যায়।যদিও আগের মতো সব সম্ভব না। তারপরও।”

মুসকানের কথা শুনে আকাশ মুচকি হেসে হাত বাড়িয়ে দেয় মুসকানের দিকে। মুসকানও হালকা হেসে হাত মিলিয়ে দেয় আকাশের হাতের সাথে।
আকাশ মুখে হাসি রেখেই বললো,

“তবে আজ থেকেই শুরু হোক এ বন্ধুত্বের পথ। নতুন রুপে?”

মুসকান কিছু না বলে শুধু মুখে হাসি রেখে মাথা নাড়ায়।

এদিকে যে আকাশ আর মুসকানের এভাবে হাত মিলানো দেখে আফনানের যে ভিতরে জ্বলে যাচ্ছে তা তো আর কেউ জানে না। আফনান মনে মনে বলছে,

“এতো হাত মিলানোর কি দরকার!!এমনিই তো বন্ধুত্বের শুরু করা যায়।
আচ্ছা এরা হাত মিলাক, আমার কি। এরা ছোটোবেলার বন্ধু।তো সমস্যা নেই তো। কিন্তু আবার এটা দেখতেও আমার রাগ লাগছে। কি এক ঝামেলা।উফ।”

আফনান আকাশকে বললো,

“কতোক্ষন এভাবে থাকবি??চল নিচে যাই।”

আকাশ বললো,

“আরে একটু কথা তো বলতে দিবি।”

“পরে কথা বলিস।এখন চল তো নিচে।”

এসব দেখে মুসকান হেসে বলে,

“নিচে যান তাড়াতাড়ি। আপনার বন্ধুর হয়তো কোনো কাজ আছে।”

আফনান মুসকানের কথা শুনে আকাশকে টানতে টানতে নিচে নিয়ে আসে।

মুসকান ছাদেই দাঁড়ীয়ে থাকে।সে অপেক্ষা করছে বৃষ্টির জন্য।কখন একটু বৃষ্টি হবে আর সে মনমতো ভিজবে। কিম্তু এ বৃষ্টি আসার নামই নেই। প্রায় আধ ঘন্টা দাঁড়ীেয় থেকে সে রুমে চলে আসে।

রুমে এসে দেখলো সুমনা এখনো ফোন টিপছে।মুসকান যে রুমে এসেছে সেদিকে তার খেয়ালই নেই। মুসকান গিয়ে সুমনার মাথায় হালকা একটা চাটি মেরে বললো,

“সেই কখন থেকে ফোন নিয়ে পরে আছিস। দেখছিস টা কি??”

সুমনা ফোনের দিকে তাকিয়েই বলে,

“একটা থ্রিলিং মুভি দেখছিলাম।”

মুসকান বিছানায় বসতে বসতে বলে,

“ও তাইনি?যাই হোক,একটা ভালো খবর শুনবি??”

সুমনা সেই আগের মতো ফোনের দিকে তাকিয়েই বলে,

“বল শুনি।”

“আকাশ ভাইয়ার সাথে আমার আবার ফ্রেন্ডশিপ হয়ে গিয়েছে।”

আকাশের কথা শুনে সুমনা সাথে সাথে ফোন রেখে বলে,

“কি বললি আরেকবার বলতো।”

মুসকান মুখ বাঁকা করে বললো,

“কানে কম শুনিস নাকি??”

“আরে বলনা কি বললি।”

“বললাম যে আমার আর আকাশ ভাইয়ার মধ্যে সব ঠিক হয়ে গিয়েছে।একদম আগের মতো। সব মিসআন্ডারস্ট্যান্ডং দূর হয়ে গিয়েছে।উনি সকালে ছাদে এসে কথা বলে সব ঠিক করে দিয়েছে।”

এটা শুনে সুমনা মুখে একটা জোরপূর্বক হাসি এনে বললো,

“বাহ ভালো তো।”

“হুম।আর তোর কি মনে আছে যে আজকে ব্যাচেলার্স পার্টি??”

“হুম মনে আছে তো।”

সুমনার মন এখন অন্যদিকে। সে ভাবছে আকাশ আর মুসকান যেহেতু আগের মতো বন্ধু হয়ে গিয়েছে তাই আকাশের মনে আবার মুসকানের জন্য কোনো ফিলিংস তো চলে আসবে না!!কারন ছেলে মেয়ের মধ্যে খুব কমই বন্ধুত্ব থাকে।কোনো না কোনো একসময়ে এটা ভালোলাগা এমনকি ভালোবাসায় পরিণত হয়। সুমনা ভাবছে বন্ধুত্ব থাকুক কিন্তু ভালোবাসায় যেনো এটা পরিনত না হয়। কারন সে যে আকাশকে পছন্দ করতে শুরু করেছে। এটা আর তার অজানা নয়।
এসব ভাবতে ভাবতে একটা অজানা ভয় গ্রাস করলো সুমনাকে।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে