এই_সাঁঝবেলাতে_তুমি_আমি পর্ব-০৩

0
1994

#এই_সাঁঝবেলাতে_তুমি_আমি🍁
পার্ট ৩
#সারা_মেহেক

🍀🍁

আফনান আর আকাশের এমন আশ্চর্য হওয়ায় কোনো ভাবাবেগই হলো না মুসকানের। এতে যেনো তার কিছুই আসে যায় না।
সে ধীরে ধীরে নিজের প্লেটে ভাত উঠিয়ে তরকারি নিতে যাবে তখনই দেখলো আকাশের মা আকাশকে ভাত নিজ হাতে খাইয়ে দেওয়ার জন্য জোর করছে।কিন্তু আকাশ এভাবে সবার সামনে খেতে চাচ্ছে না। তার কাছে এখন মনে হচ্ছে এতোগুলো মানুষের সামনে মায়ের হাতে এভাবে ভাত খেলে সবাই ‘বাচ্চা বাচ্চা’ বলে রাগাবে।

আকাশের এমন করা দেখে মুসকান চট করে বলে উঠলো,

“আন্টী গো শুনছো।তোমার ছেলে এভাবে খাবে না বুঝলে।বাগানে যে কোদাল আছে না,ওটাতে ভাত নিয়ে মুখের মধ্যে ঠুশে দাও। এমনিই গপাগপ খেয়ে শেষ করে ফেলবে।”বলেই মুসকান মুখ টিপে হাসতে লাগলো। আর পাশে সুমনা নিশ্চুপে হেসে যাচ্ছে।

মুসকানের বলা কথাগুলো গিয়ে লাগলো আকাশের সম্মানে। আকাশের মা বললো,

“ঐ তুই চুপ করবি??চুপচাপ খেয়েদেয়ে শুয়ে পর। এতো বছর পর আমার সোনার টুকরো ছেলেটা এসেছে। এতোটুকু যত্নআত্তি তো করবোই।”

মুসকান খেতে খেেত বললো,

“সে করো। আমার সমস্যা নেই।”

আকাশের মা আবার আকাশের মুখের কাছে ভাত নিয়ে গেলো। এবার ঠিকই মুখের মধ্যে ভাত পুরে নিলো আকাশ।এ দেখে মুসকান ভাব নিয়ে বললো,

“দেখলে আন্টী।কিভাবে ভাতটা খেয়ে নিলো। এমন ছোটো ছোটো বাচ্চাদের খাওয়ানোর জন্য এমন ভয় দেখাতেই হয়।
আরে আন্টী দেখো দেখো,লিটল বেবিটার ঠোটের কোনায় ভাত লেগে আছে।মুছে দাও,নয়তো পুচকি বাবুটা মাইন্ড করবে।”
এসব কথা শুনে রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে আকাশের।এভাবে সবার সামনে অপমান করার মানেটা কি। তারপর আবার কি বলে, “পুচকি বাবু”!!!

আকাশের মা এক ধমক দিয়ে মুসকানকে বললেন,

“এতো বড় ছেলেটাকে তুই বাচ্চা বলিস কোন দিক দিয়ে হুম??গুনে গুনে ২৭বছর হয়েছে আকাশের।বাচ্চা তো তুই। এবার একটা কথাও না বলে চুপচাপ খেয়ে নে।

এদের এসব কান্ড দেখে আফনান না হেসে পারছে না। কিন্তু এতো মানুষের সামনে আকাশের এমন হাস্যকর অপমানে যদি না সে হেসেছে তাহলে রুমে গিয়ে ইচ্ছামতো কিল ঘুষি পরবে তার পিঠে।তাই চেষ্টা করছে হাসি থামানোর। কিন্তু নাহ, পারছে না। তাই বাম হাত দিয়ে ঠোট ঢেকে নিঃশব্দে হাসতে লাগলো সে।
ডাইনিং এর অনেকেই মুসকানের কথায় হেসেছে বেশ।
.
.
.
খেতে খেতে মুসকানের মনে হলো কেউ পা দিয়ে তার পায়ে গুতা দিচ্ছে। প্রথমে ভাবলো হয়তো ভুলে লেগে গিেয়ছে। কিন্তু না , আবারো সেই একই কাজ।
মুসকান রেগে সামনে তাকিয়ে দেখলো আফনান মুচকি মুচকি হাসছে।মুসকান আবার লক্ষও করলো যে তার সোজাসুজি আফনান বসেছে। সুতরাং পা দিয়ে গুতোটা সেই ই দিয়েছে।প্রচন্ড রাগ লাগছে তার।কিন্তু আপাতত রাগটাকে কন্ট্রোল করে ভাত খেতে লাগলো।একবার সে ভাবলো সবার সামনে আফনানের এ কাজের কথা বলবে।কিন্তু পরমূহুর্তে নিজের সিদ্ধান্ত বদলে ফেললো।ভাবলো সবার সামনে এভাবে সিন ক্রিয়েট করার কোনো মানেই হয় না।বরং রুমে গিয়ে আচ্ছামতো ধ্যাতানী দিবে সে।
.
.
.
খেয়েদেয়ে রুমে ঢুকে দরজা ভালো করে না আটকিয়েই আচমকা আফনানের পিঠে এক ঘা বসিয়ে দিলো আকাশ।এভাবে হঠাৎ করে পিঠে ঘা পরায় নিজের হাত দিয়ে পিঠ ঢলতে লাগলো আফনান। আকাশের এমন কাজে পিঠ ঢলতে ঢলতে আফনান বললো,

“এভাবে মারলি কেনো আমাকে??”

আকাশ পরনের টি পার্ট খুলতে খুলতে বললো,

“বেশ করেছি মেরেছি।সবার সামনে আমাকে যখন ঐ পুচকি মেয়ে অপমান করছিলে তখন কিছু বললি না কেনো তুই?নিজেকে তো আমার বেস্ট ফ্রেন্ড বলে দাবি করিস।আর ফ্রেন্ড কে যে এভাবে অপমান করা হলো তখন কিছুই বললি না!!”

আকাশের কথায় পিঠ থেকে হাত সরিয়ে বিছানায় বসে হাসতে হাসতে বললো,

“তুই কি করছিলি তখন?তুই তো মুখ বুজে সহ্য করছিলি সব।”

আকাশ স্যান্ড গেঞ্জীটা পরে বললো,

“আমি তো মায়ের জন্য চুপ ছিলাম।”

আফনান হাসতে হাসতে বললো,

“সব জানি হুম। সাহস ছিলো না তোর মধ্যে।সে যাই ই হোক।মুসির অপমান করাটা আমার কাছে জোস লেগেছে। এতো কিউট করে কেউ এভাবে অপমান করে বুঝি?”

আকাশ ফোন নিয়ে বারান্দায় যেতে যেতে বলে,

“এতো হাসবি না। পরে আরেক ঘা দিবো। আর এসব ভুলে যা। শুয়ে পর।আমি সিয়ার সাথে কথা বলে আসি। এ অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর তো কাজ শুরু করতে হবে।সিয়া আমাদের ফার্স্ট ক্লায়েন্টকে জোগাড় তো করবে।”

“হুম যা।”
.
.
.
হঠাৎ করে দরজা খুলে দরজা খুলে কেউ বললো,

“এটা কোন ধরনের অসভ্যতামি??”

ফোনে গেমস খেলতে খেলতে আফনানের প্রায় চোখ বুজে এসেছিলো। এমন হুট করে দরজা খুলার আওয়াজে তড়িঘড়ি উঠে দেখলো সামনে মুসকান দাঁড়ীয়ে আছে।তার মানে এ কথাটা মুসকান বলেছে।
দরজা খুলার আওয়াজে বারান্দা থেকে আকাশ রুমে আসে। এসে দেখলো মুসকানকে।

কোনো জবাব না পেয়ে মুসকান আবারে আফনানকে উদ্দেশ্য করে বললো,

“বলুন,এগুলো কোন ধরনের অসভ্যতামি হুম??”

মুসকানের এ কথায় আকাশ আর আফনান নিজেকে একবার দেখে নিলো। আকাশের পরনে রয়েছে থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট আর স্যান্ডু গ্যাঞ্জী।আর আফনানের পরনে রয়েছে শুধু থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট।খালি গা।মুসকানের কথা শুনে তে তারা দুজনেই ভেবেছে যে তাদের এমন ড্রেসআপে হয়তো মুসকান এমন বলছে।
তাই আফনান পাশে থাকা গ্যাঞ্জীটা গায়ে জড়াতে জড়াতে বলে,

“আজব মেয়ে তো তুমি।পার্সোনাল রুমে যার যেমন ইচ্ছা সে তেমন ড্রেসআপে থাকবে। এতে তোমার সমস্যা কোথায়??”

আফনানের কথায় মুসকান খেয়াল করলো যে এ রুমের দুজনের একজনও ফুল ড্রেস এ নেই। দুজনের লোমশ পা দুটো চোখে ধরছে যেনো।
সিচুয়েশনটা বুঝতে পেরে দাঁত দিয়ে নিজের জিব কাটলো মুসকান।কি এক লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে সে এসে পরেছে।কি দরকার ছিলো এভাবে রুমে ঢুকার?দরজায় নক করেও তো ঢুকতে পারতো সে। সব ভেবে মনে মনে নিজেকে হাজারটা গালি দিচ্ছে সে।
কিন্তু পরক্ষনেই নিজেকে সামলে নিয়ে আমতাআমতা করে বললো,

“ডাইনিং এ যা করেছেন সেটার কথা বলছি।”

আকাশ বললো,

“ডাইনিং এ তো তুমি সব করেছো।এতোগুলো মানুষের সামনে আমাকে এভাবে অপমান করে।”

“আমি আপনার সাথে কথা বলছি না। আমি উনার সাথে কথা বলছি। আর ডাইনিং এ যা করেছি তাতে আমার কোনো আফসোস নেই। আমি ঠিকই করেছি।”

মুসকানের কথা আকাশ অবাক না হয়ে পারে না। সে ভাবছে এতোটুকু মেয়ের তেজ তো দেখো।

মুসকান আফনানকে বললো,

“এবার বলুন মিস্টার আফনান,আপনি ডাইনিং এ খাওয়ার সময় আমাকে পা দিয়ে গুঁতো কেনো দিয়েছিলেন??”

আফনান অবাক হয়ে বললো,
“আমি এমন কেনো করতে যাবো!!আর কখন করলাম এমন??”

“মিথ্যা কথা বলবেন না। আপনি আমাকে একবার নয়,দুই দুই বার পা দুয়ে গুঁতো দিয়েছেন।আবার মুচকি মুচকি হেসেছিলেন ও।”

এবার আফনানের মাথায় আসে যে মুসকান কোন সময়ের কথা বলছে।আফনান বললো,

“আরে তুমি ভুল বুঝছে আমাকে….”
মাঝপথে আফনানের কথা থামিয়ে মুসকান বললো,

“আমি কোনো ভুল বুঝি নি।”

মুসকানের কথায় আফনান বিরক্তি নিয়ে বললো,

“আগে আমার কথা শেষ তে করতে দিবা?কথার মাঝে কথা বললে হয় নাকি।”

“আচ্ছা বলুন।”

“একচুয়ালি তখন আমার পায়ে হঠাৎ করে একটা মশা কামড় দেয়। এখন সবার সামনে তো আর নিচে ঝুঁকে হাত দিয়ে পা চুলকাতে পারবো না,তাই এক পা দিয়ে আরেক পা চুলকাচ্ছিলাম।
আর হাসার কারন হলো আকাশকে বলা তোমার কথাগুলো। দ্যাটস ইট।”

আফনানের কথা যেনো বিশ্বাস হচ্ছে না মুসকানের।সে ভ্রু উঁচিয়ে সন্দেহের সুরে বললো,

“সত্যি বলছেন তো?এ কারনই??”

আফনান বললো,

“আরে হ্যাঁ। সত্যি বলছি।মিথ্য বলবো কেনো।”

“আচ্ছা মানলাম।বাট নেক্সট টাইম এমন কিছু ভুলেও করবেন না।
আমি তাহলে যাই।”

আকাশ বিরক্তি নিয়ে বললো,

“হুম যাও। এন্ড নেক্সট টাইম দরজা নক করে ঢুকবে। ইটস কল্ড ম্যানার্স।”

আকাশের কথায় চরম অপমানিত বোধ করলো মুসকান। মনে হয় নিচে করা অপমানের শোধ নিলো।অবশ্য ঠিকই তো বলেছে সে।এভাবে রুমে ঢুকা সত্যিই উচিত হয়নি তার। কি এক বিরক্তিকর সিচুয়েশন। উফ।
দরজা হালকা করে লাগিয়ে সেখান থেকে চলে আসলো মুসকান।
নিজ রুমে এসে দেখলো সুমনা,লিয়া আর রুমা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। সারা বাড়ী মেহমানে পূর্ণ বলে কাজিনরা এভাবে একসাথে ঘুমাচ্ছে।মুসকান নিশ্চুপে গিয়ে নিজের জায়গায় শুয়ে পরলো।

রাত প্রায় দুইটা। এখনো ঘুম আসছে না মুসকানের।সেই কখন থেকে এপাশ ওপাশ করছে।কিন্তু ঘুম চোখে আসার নাম নেই।চোখ বন্ধ করে আছে তবুও। হঠাৎ করে গিটারের সুরের আওয়াজে চোখ খুলে মুসকান।এখন কে গিটার বাজাচ্ছে সে চিন্তা করতে করতে পাশে থাকা ফোনের স্ক্রিন অন করে দেখলো ২.০২ বাজে।সময় দেখে আপনাআপনিই চোখ বড় হয়ে গেলো মুসকানের। শুকনো একটা ঢোক গিলে বিড়বিড় করে বলতে লাগলে,

“এই মাঝরাতে গিটা বাজায় কে রে!!কোনো ভুত টুত নাকি!!ইয়া আল্লাহ বাঁচাও।

আরে নাহ।ভুত হতে যাবে কেনো।কিন্তু এতোরাতে গিটার বাজাবে কোন পাগলা।”

সুরের শেষে গান শুরু হলো,
“Chal dia dil tere piche piche
dekhta may reh gaya.
Kuch toh hay tere mere darmiyan
Jo ankahan sa reh gaya.

May jo kavi keh na saka
aj kehta hu pehli dafa
Dil mein ho tum
aakhon mein tum
pehli najar se o yara.
Iye ishq ki hay sajishe
lo aa mile hum dobara……..
……………………………………………….”

এতোক্ষন মন দিয়ে গানটা উপভোগ করছিলো মুসকান।যদিও দূরে হওয়ার কারনে কিছুটা হালকা গলা শুনতে পেয়েছে।
অসম্ভব ভালো লাগে তার কাছে এ গানটা।যখনই শুনে একদম হৃদয় জুড়িয়ে যায়। আরমান মালিকের কন্ঠে এতোদিন গানটা শুনেছে সে।আজকে অন্য একটা কন্ঠে শুনলো। এ অপরিচিত কন্ঠেও গানটা দারুন লেগেছে তার কাছে।ইচ্ছা তো করছে সে গায়ককে দেখতে যার কন্ঠে দারুন মানিয়েছে গানটা আর থ্যাংকস ও বলতে ইচ্ছা করছে ব্যক্তিটাকে যে তার ফেবারিট গান শুনিয়েছে।
প্রথম প্রথম তো মুসকান ভেবেছিলো হয়তে কোনো ভুতই হবে। কিন্তু গান শুনার পর তার মনে হলো,ভুত হলে এমন গান গাইতো যে,
“হু হু আমি ভুত।মানুষকে ভয় দেখানো আমার কাজ।”
এন্ড ব্লা ব্লা।কিন্তু মনুষ্যজাতির গান শুনে বুঝলো যে এটা মানুষই।

এভাবে নানা চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে গেলো মুসকান।
.
.
.
সকাল বেলা প্রচন্ড ঝাঁকিতে ঘুম ভাঙলো মুসকানের।আধো আধো করে চোখ খুলে দেখলো সুমনা দাঁড়ীয়ে আছে।চোখে মুখে চরম বিরক্তি।সুমনার এমন বিরক্তি উপেক্ষা করে মুসকান আরেক পাশ ফিরে বললো,

“আমার জানু পাখিটা সকাল সকাল এমন পেঁচার মতো চেহারা করে কেনো দাঁড়ীয়ে আছে?”

সুমনা রেগে মুসকানকে শোয়া থেকে জোর করে উঠিয়ে বলে,

“ঐ তোকে সেই কখন থেকে ডাকছি জানিস??গত একটা ঘন্টা ধরে তোকে ডেকেই যাচ্ছি কিন্তু তুই উঠলিই না। শেষপর্যন্ত এমন ঝাঁকুনি দেওয়ায় উঠলি।
আর কয়টা বাজে জানিস?? ৯টা বেজে গিয়েছে।নিজের বোনের গায়ে হলুদের দিন বলে কেউ এভাবে ঘুমায় বলে!!!”

নিজের বয়সী কাজিনের কাছে ঘুম নিয়ে এতো কথা শুনতে বিরক্তি এসে গিয়েছিলো মুসকানের।চোখ দুটো এখনো আধবোজা করে রেখেছে সে।কিন্তু সময়ের কথা শুনে চোখ দুটো যেনো অটোমেটিকভাবে বড় হয়ে এলো মুসকানের।নিজের বোনের গায়ে হলুদ আর সে কি না এতোক্ষন ধরে মরার মতো ঘুমাচ্ছিলো!!তার এ অতিরিক্ত ঘুমটাই একদিন ডুবাবে তাকে।ঘুম নামক এ জিনিসটা যেনো শুধু তার চোখেই আছে।রাজ্যের ঘুম এসে যেনো জড়ো হয় শুধু তার চোখেই।
তড়িঘড়ি করে সুমনাকে পাশ কাটিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে ওয়াশরুমে গেলো মুসকান।
.
.
.
খাবার টেবিলে বসার সাথে সাথে মুসকানের মাথায় একটা চাপড় পরলো।এ কাজটা কে করেছে দেখার জন্য পাশ ফিরে তাকিয়ে সে মাহিরার রাগি চেহারা দেখলো।
মাহিরা চেয়ারে বসতে বসতে বললো,

“তুই যে আমাকে একটুও ভালোবাসিস না আজ তার প্রমান পেলাম।”

মাহিরার এ কথায় মুসকান ভ্রু কুঁচকে বললো,

“কি করলাম আমি যে তুমি এমন কথা বলছো আপু?”

মাহিরা সামনে থাকা একটা ব্রেড নিয়ে চিবুতে চিবুতে বললো,

“তা নয়তো কি হুম? আমার বিয়েতে কই তুই সারাদিন হইহুল্লর করবি সেখানে তুই সকাল ৯টা পর্যন্ত পরে পরে ঘুমাচ্ছিস!!ঠিক বলেনি রে সুমু??”

সুমনা ভাত মুখে নিয়ে অস্পষ্ট গলায় বললো,

“একদম ঠিক বলেছো আপু।”

মুসকান কিছু না বলে আরামে ভাত খাচ্ছে।আর ভাবছে,এরেঞ্জ ম্যারেজে কোনো মেয়ে যে এতোটা শান্তা স্বাভবিক হতে পারে তা জানা ছিলো না তার।মাহিরার বিয়েটা পারিবারিকভাবেই ঠিক হয়েছে।আগে যে কোনো জায়গায় রিলেশন ছিলো তা না। মুসকানদের পরিবারে কারোর লাভ ম্যারেজ হয়নি।বড় দুইটা চাচাতো ভাই, আর একটা মামতো বোনের বিয়ে হয়েছে পারিবারিকভাবে।তাদের এখন হ্যাপি ফ্যামিলি।
মুসকানের জানামতে এভাবে পারিবারিকভাবে বিয়েতে মেয়েরা সারাদিন বসে শুধু কান্নাই করে।বলা কওয়া নেই কান্না শুরু।সে ভেবেছিলো তার বোনটাও এমন কাজ করবে,কিন্তু না সে ও বেশ ইনজয় করছে। অবশ্য কান্নাকাটি করছে না,এরজন্য অবশ্য মুসকান বেশ খুশিই, কারন কান্না করলে কোনো মজাই তারা করতে পারতো না।

মুসকানের কোনো জবাব না পেয়ে মাহিরা বললো,

“শোন,আব্বু বলেছে ৪টার দিকে হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হবে তাই আগে থেকেই সব ঠিকঠাক যেনো করে রাখি।অনুষ্ঠান শুরু করতে যেনো দেরী না হয়।”

মুসকান বাঁকা হেসে বললো,

“একদমই দেরী হবে না।আর আপু তুমি বলছিলে না যে আনরা হহইহুল্লর কেনো করছি না।তবে আজকে থেকে দেখো আমাদের হইহুল্লর। হহইহুল্লর কাকে বলে আর কতো প্রকার ও কি কি সব চিনিয়ে দিবো”

মাহিরা কিছু না বলে একটা মুচকি হাসি দিয়ে চলে গেলো।

খাবার শেষে নিজের রুমে গিয়ে বসলো মুসকান।প্রচুর আলসেমি লাগছে তার।যেই না একটু বিছানায় গা এলিয়ে দিতে যাবে তার আগেই সুমনা সহ ছোটোবড় সব কাজিন তার রুমে একগাদা জিনিসপত্র নিয়ে হাজির।সব জিনিসের মধ্যে সবই আজকের অনুষ্ঠানের জন্য সাজাগোজার জিনিস।সবাই এসব নিয়ে মুসকানের রুমে এসেছে এইজন্য যে গোলমিটিং করে কার কি আছে,কার কি নেই,কার কি ম্যাচিং প্রয়োজন সব জানার জন্য।কারন সাজার সময়ে এসব নিয়ে প্রচুর ঝামেলা হয়।
সব কিছু ঠিকঠাক করার পর রুমা জিদ ধরলো যে বাগানে গিয়ে হলুদের স্টেজ দেখবে।কেমন কি ডেকোরেশন হয়েছে তা দেখবে।
যেই ভাব সেই কাজ। মুসকান তো প্রথমে আলসেমির জন্য যেতে চাচ্ছিলো না কিন্তু পরে রুমা তাকে জোর করে নিয়ে যায়।সাথে আছে সুমনা।

বাগানে গিয়ে সব ডেকোরেশন দেখে রীতিমতে মুগ্ধ মুসকান। এতো সুন্দর করে ফুল দিয়ে সাজিয়েছে যে দেখলে শুধু দেখতেই ইচ্ছা করে।
স্টেজ এর আশেপাশে ঘুরে ঘুরে দেখছে মুসকান,রুমা আর সুমনা।হঠাৎ মুসকানের চোখ আটকে যায় বাগানে রাখা বেতের চেয়ারে বসা আফনানের উপর।সাদা টিশার্ট আর ব্লাক জিনস এ একদম নজর কেড়ে নেওয়ার মতো সুন্দর লাগছে।হালকা বাতাসে মাথার অবাধ্য চুলগুলো বেশ জ্বালাতন করছে। ফোন টিপতে টিপতে হাত দিয়ে চুলগুলো ঠিক করলো আফনান।এটা দেখতে বেশ লাগছে মুসকানের কাছে।মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে সে।কেনো যেনো তার কাছে আফনানের এ সাধারনভাবে বসে থাকাও অসাধারণ কিছু লাগছে।

বেশ কিছুক্ষন আফনানের দিকে তাকিয়ে রইলো মুসকান।কিন্তু পরক্ষনেই নিজেকে সামলে নিলো সে।নিজের ডান হাত দিয়ে বাম হাতে একটা চিমটি কাটলো সে।আফনানকে এভাবে দেখার কি আছে আর কেনোই বা দেখছে সে ধ্যাত।সে আর একমূহুর্ত সেখানে দাঁড়ীয়ে না থেকে সুমনার হাত ধরে বাড়ীর ভিতরে চলে যেতো লাগলো সে।কিন্তু প্রবেশপথেই কারোর সাথে ধাক্কা খেলো মুসকান।ধাক্কা খাওয়ায় পরে যেতে নিলেও সুমনাকে ধরে নিজেকে সামলে নিলো মুসকান।তাকে কে ধাক্কা দিলো এটা দেখার জন্য চোখ তুলে তাকালো সে।সামনে থাকা ব্যক্তিটাকে দেখে রাগ হয়ে গেলো।ব্যক্তিটা আর কেউ না আকাশ।মুসকান বললো,

“ঐ মিস্টার খাটাশ খাম্বা,দেখে চলতে পারেন না।চোখ কি মাথার পিছনে রেখে হাঁটেন?সরি বলুন এখনি।”

আকাশের কানে মনে হয় মুসকানের কথাটা গেলো না।সে পকেটে হাত দিয়ে একটা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে চলে গেলো।আকাশের এমন কাজে মুসকান তো থ বনে গেলো।
.
.
.
সারাবাড়ী বাচ্চাদের চিল্লাচিল্লিতে আর বড়দের ব্যস্ততায় পরিপূর্ণ।
ছেলেরা পরেছে নীল রংয়ের পাঞ্জাবী।আর মেয়েরা পরেছে সিল্কের নীল রংয়ের শাড়ী।সবাইকেই এ রংয়ে বেশ মানিয়েছে।মাহিরাকে পরানো হয়েছে হলুদ রংয়ের শাড়ী।বাঙালী স্টাইলে শাড়ী পরিয়ে ফুলের গহনা পরানো হয়েছে।খুব মিষ্টি লাগছে তাকে দেখতে।
সবাই রেডি হয়ে গার্ডেনে গেলো।
আফনানকে নীল পাঞ্জাবীতে অন্যান্য দিনের চেয়ে বেশিই হ্যান্ডসাম লাগছে আজকে।ডান হাতে বেল্টের ঘড়ি।আর পাঞ্জাবীর হাতা গুটানো।লোমশ হাত দুটো যেনো মুসকানকে বারবার তাকাতে জোর করছে।
আকাশকেও অনেক হ্যান্ডসাম লাগছে।তার পাঞ্জাবীর হাতা দুটো একদম কব্জী পর্যন্ত রাখা। গার্ডেনে প্রবেশ করার স্টাইলটা সুমনাকে বেশ আকর্ষন করছে কেনো যেনো এক অদ্ভুত কারনে।সাধারন প্রবেশ কিন্তু তাও যেনো একটা নায়ক নায়ক ভাব আছে।
মুসকান শাড়ী পরেছে ঠিকই অন্য জনের মতো কিন্তু আঁচলটা অন্যান্যদের মতো রাখেনি।রেখেছে কাঁধের উপর সেফটিপিন আটকে।কারন আঁচল সে সামলাতে পারেনা।এতে অল্প একটু পেট দেখা যাচ্ছে তার তবে হাতটা এদিক ওদিক করলে।শাড়ী পরার সময় পেটের দিকটায় ব্লাউজের সাথে শাড়ী সেফটিপিন করতে চেয়েছিলো কিন্তু পরে ভুলে যায়।
একজনের যে মুসকানের এমন শাড়ী পরা দেখে রাগ উঠে তা তো আর মুসকান নিজে জানে না।

মুসকান রুমে ফোন রেখে আসে ভুলে তাই সেটা আনার জন্য আবার রুমে গেলো সে।এদিকে যে তার পিছে পিছে কেউ আসছে সেটা খেয়াল করেনি সে।
রুমে এসে বিছানার উপর থেকে ফোনটা হাতে নিলো মুসকান। হঠাৎ করে দরজা আটকানোর আওয়াজে চমকে উঠলো সে।সামনে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলো সে। কারন সামনে থাকা ব্যক্তিটি আর কেউ না আফনান।
মুসকানকে কিছুই বলার সুযোগ না দিয়ে আফনান মুসকানের হাত ধরে একদম কাছে এনে শাড়ীর আঁচল থেকে পিন খুলে আঁচলের ভাঁজ খুলে ছড়িয়ে দেয় আঁচল।আর বলে,

“নাও ইটস পারফেক্ট।”
তারপর মুসকানের গালে ছোটো করে একটা করে একটা চুমু দিয়ে তাকে ছেড়ে দরজার কাছে গেলো আফনান।
আফনানের এমন হুটহাট কাজে পুরাই থ বনে গেলো মুসকান।চোখদুটো একাই যেনো বড় হয়ে এলো তার। কি দিয়ে কি হয়ে গেলো!!মাথা কাজ করছে না তার।পুরো শরীর যেনো জমে গিয়েছে তার।
মুসকানের এমন অবস্থা দেখে আফনান বাঁকা হেসে বলে,

“বারি বারি দেশো মে এছি ছোটি ছোটি বাতে হতি রেহতি হ্যয় সেনোরিটা।”

#চলব

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে