#এই_ভালো_এই_খারাপ(২০)
#Jannat_prema
আবদ্ধ সেই কখোন থেকে ভোরে ফুলিয়ে রাখা গালের দিকে তাকিয়ে আছে। ঘুম থেকে উঠার পর থেকেই দেখছে এমন। নাস্তা করার সময়ও এমন ছিলো তার সাথে। অথচ সবার সাথে স্বাভাবিক ছিলো। আবদ্ধ ভাবলো তার বউটা ক্ষণে ক্ষণে এতো মুড চেঞ্জ করে কিভাবে? কই তার তো চেঞ্জ হয় না। সারাদিনই তো ইচ্ছে করে ভোরকে আদর করতে। ওই ছোট্ট দেহটাকে নিজের প্রসস্থ বুকের মাঝে রাখতে। এভাবে গাল ফুলিয়ে থাকলে যে আবদ্ধর আদর করতে ইচ্ছে করে। সেটা কি এই বুঝের ন্যায় অবুঝ মেয়েটা বুঝবে? উহু বুঝবে না। আবদ্ধ ফোস করে দম ছেড়ে ভোরের পাশে বসলো। ভোর খানিকটা দূরে সরে গেলো। আবদ্ধ আবারো ভোরের কাছে গিয়ে বসলে ভোরও ঠিক আগের মতো দূরে সরে বসলো। আবদ্ধ আবারো আসলো তবে ভোরকে আর সরে যাওয়ার সুযোগ দিলো না। টেনে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো। ভোরের ফুলো গালে হালকা করে কামড় দিয়ে বললো,
” আমার ভোর পাখির কি হয়েছে। গাল ফুলিয়ে রেখেছিস কেনো? সেই সকাল থেকে দেখছি। নাস্তা করার সময়ও দেখলাম সবার সাথে স্বাভাবিক অথচ আমার সময় অস্বাভাবিক। কারণটা কি? ”
ভোর কিছু বললো না। চুপচাপ আবদ্ধর কাছ থেকে উঠে গিয়ে কিছু একটা করলো। মুহুর্তেই আবদ্ধর দিকে সেটা ফিরে ধরলো। আবদ্ধ তাকালো। ভ্রু কুচকে নিজের মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে পড়তে লাগলো,
” আপনার ওই দুই চোখের মায়ায় হারিয়ে যাচ্ছি। ডুবে যাচ্ছি এক অতল সাগরের গহীনে। যেখান থেকে আপনি নামক হৃদয় হরণ পুরুষটা আমার এই নিষ্পাপ মনটাকে উদ্ধার করতে পারে। ”
আবদ্ধ আইডির নাম চেক করতেই চোয়াল শক্ত করলো। প্রেমা নামের মেয়েটা এতো ধুরন্ধর! আবদ্ধর ইচ্ছে হচ্ছে মেয়েটাকে কঠিন কিছু বলতে। আবদ্ধ দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
” এই ডাফার মেয়েটা ফেসবুকে এসেও শান্তি দিচ্ছে না৷ ”
ভোর ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে আবদ্ধের দিকে। আবদ্ধ নিজেকে শান্ত করলো। ভোরকে আপাতত বুঝাতে হবে সব। কোনো তৃতীয় ব্যাক্তির কারণে তাদের মাঝে ভুল বোঝাবুঝি হোক এমন কিছুই চাইবে না ৷ মোবাইল ফোনটা বিছানায় রেখে ফোঁস করে শ্বাস ফেললো। ভোরকে হেচকা টানে নিজের কাছে বসিয়ে ভোরের গালটা দু’হাতে আগলে ধরে বললো,
” চোখে পানি কেনো? ”
টলমলে চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ার আগেই আবদ্ধ মুছে দিলো। ভোর নিষ্পলক তাকিয়ে থাকার মাঝেই বললো,
” মেয়েটা তোমাকে ভালোবাসে আবদ্ধ। ”
আবদ্ধ ঠোঁট কামড়ে হাসলো। ভোরকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে বললো,
” কিন্তু আমি তো আমার ভোরকে ভালোবাসি। আমার সবটুকু ভালোবাসা তো ভোরের কাছে। সেখানে ভাগ বসানোর তো কোনো চান্স-ই নেই৷ ”
ভোর নাক টানলো। আবদ্ধর বুকে নাক ডলে বললো,
” আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, আবদ্ধ! আমি চাই না কেউ আমার জিনিসে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকুক। তোমাকে নিয়ে সপ্ন না বুনুক। মেয়েটা হয়তো তোমাকে নিয়ে কত সপ্ন সাজিয়েছে। এটা ভাবলেই আমার অন্তস্থলে খুব জ্বলে। তুমি শুধু একান্ত আমার। তোমার সব কিছুও আমার। ”
কথাটুকু শেষে করে মাথা উঠিয়ে আবদ্ধর চোখে চোখ রেখে বললো,
” আবদ্ধ শুধু ভোরের। ভোরের আবদ্ধ তুমি। ”
আবদ্ধ হেসে তাকিয়ে আছে ভোরের দিকে। ভোর আবারো আবদ্ধকে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ নিঃশ্বাস টানলো। আবদ্ধর গায়ের ঘ্রাণে যেনো মাদকতা মিশে আছে। ভোরের খুব ইচ্ছে করে সেই ঘ্রাণের মাঝে ডুবে যেতে।
” মেয়েটা কে জানিস? কালকের সে জুনিয়র ডক্টর মেয়েটা। মিস প্রেমা! ”
আচমকা আবদ্ধর কথা শুনে চট করে মাথা উঠিয়ে তাকালো। ভোর বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে বললো,
” এটা সেই মেয়ে? ”
আবদ্ধ হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়লে ভোর জ্বলন্ত দৃষ্টি তাক করলো। চট করে আবদ্ধর কাছ থেকে সরে এসে আবদ্ধর ফোনটা হাতে নিয়ে ফেসবুকে গিয়ে আবদ্ধর যত ছবি ছিলো একে একে সব ডিলিট
করে দিলো। আবদ্ধ বুকে হাত ভাঁজ করে তাকিয়ে তাকিয়ে ভোরের কান্ড দেখছে। মেয়েটা তো মনে হয় ওর থেকেও পজেসিভ। আবদ্ধর সবগুলো ছবি ডিলিট করে শান্ত হলো। আবদ্ধর দিকে তাকিয়ে দেখলো সে তার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে। ভোর থতমত খেয়ে আবদ্ধর ফোনটা রেখে মেকি হাসি দিয়ে আবদ্ধকে ঝাপটে ধরে বললো,
” এখন অনেক শান্তি লাগছে। ফেসবুকে আর কোনো ছবি ছাড়লে খবর আছে তোমার। ”
.
” মেয়েটা আজ দুদিন অভিমান করে কথা বলছে না। মনটা কেমন আনচান করছে ওকে এক পলক দেখার। ভাবছি কালকে ভোরকে দেখতে যাবো। ”
শ্রাবন্তী আক্তার চা খেতে খেতে স্বামীর বিষন্ন চেহারার দিকে তাকালো। অতঃপর খ্যাক করে উঠলেন,
” এতো ঢং করতে কে বলেছে তোমাকে? মেয়ে আর জামাইকে আলাদা করতেও বা কে বলেছিলো। আমার এখোনো মনে পড়লে বুক ফেটে আসছে। কিভাবে মেয়েটা কাঁদতো। রাতে না ঘুমিয়েও কেঁদে কেঁদে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলতো। আমাকে না বললেও মায়ের মনতো বুঝতে পারতাম মেয়েটা আমার কোনো কিছুর কারণে কষ্ট পাচ্ছিলো। এদিকে তুমি নিষ্ঠুর পুরুষ চুপচাপ দেখতে। ”
বাদল সাহেব দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে চোখে চশমা লাগিয়ে বললেন,
” এই যে যা করেছি আমার মেয়ের ভালোর,জন্য । দুজনের ভালোর জন্যই। এখন দু’জনে একসাথে আছে। আল্লাহ পাকের অশেষ রহমতে ভালো আছে। মেয়েটার একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের,কথা চিন্তা করেই করেছি। যদি এমন না করতাম, তাহলে দুজনের ভবিষ্যৎ কোথায় এসে দাড়াতো এখন? আবদ্ধ হয়তো এখন চাকরির জন্য এদিক সেদিক ছুটতো। আমার মেয়েটা আশায় থাকতো আবদ্ধর একটা চাকরির অপেক্ষায়। আমি সারাক্ষণ চিন্তা করতাম, মেয়েটা যে ছেলেটাকে ভালোবাসে সে মানুষটা সঠিক তো? তুমি তো জানো আজ কালকার রিলেশন গুলো কেমন৷ কয়েকদিন এতো মায়া মহব্বত দেখিয়ে শেষে ছেড়ে চলে যায়। আমি চাইনি আমার এতো মিষ্টি মেয়েটার সাথেও কেউ এমন করুক। ”
শ্রাবন্তী আক্তার তাচ্ছিল্য করে বললো,
” তুমি আর আমি কি রিলেশন করিনি? তুমি ছেড়েছিলে আমার হাত নাকি আমি তোমার হাত ছেড়েছি। ভালোবাসায় সবচেয়ে জরুরি জিনিসটা হলো বিশ্বাস। দুজনের দুজনের প্রতি বিশ্বাস ছিলো বলেই একসাথে ছিলো। ”
বাদল সাহেব প্রশান্তির হাসি হেসে স্ত্রীকে একপাশে জড়িয়ে ধরে বললো,
” তুমি কতো বুদ্ধিমান শ্রাবু! সেই আগের মতোই সুন্দর আর বুদ্ধিমান আছো। ”
লজ্জায় দু গাল লাল রাঙ্গা হয়ে উঠলো শ্রাবন্তি আক্তারের। স্বামীর বুকে আলতো থাপ্পড় মেরে বললো,
” বেশরম। বুড়ো বয়সে এসেও ভীমরতি ধরেছে। ”
সকাল মুচকি হেসে দরজার আড়াল থেকে সরে রুমে আসলো। মা বাবার এমন ভালোবাসার মুহূর্তটা ক্যাপচার করে রাখতে পারলে ভালো হতো। মাঝে মাঝে এমন ভালোবাসা দেখতেও ভালো লাগে। বিমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হবে৷ তার আপু আর আবদ্ধ ভাইয়ার ভালোবাসাটও সুন্দর। সকাল আফসোস করলো, ইশ কেউ যদি তাকে আবদ্ধ ভাইয়ার মতো ভালোবাসতো। তাকে পাওয়ার জন্য সব কিছু ত্যাগ করতো। সকাল বুকে বালিশ জড়িয়ে চোখ বন্ধ করে হাসতে গিয়েও হাসলো না। আদিলের হাসি হাসি মুখটা ভেসে উঠলো। চট করে চোখ খুলে উঠে বসলো। বুকের বাম পাশে হাত রাখতেই কেঁপে উঠলো। তীব্র ভাবে ধুকপুক করছে। কালকে রাত থেকেই এমনটা হচ্ছে। যতবার আদিলের কথা মাথায় আসে, ঠিক ততবার হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে যায়। ছেলেটা কি জাদু জানে? যদি জাদু জানে তাহলে সকালের উপর কোন জাদুটা এপ্লাই করলো? যে সারাক্ষণ তার কথা তার মন, মস্তিকে বিচরণ করতে থাকে। সকাল মাথা ঝাকালো কয়েকবার। পাগল হয়ে যাবে সে। সকাল নিজের মনকে কঠোর ভাবে নিষেধ করলো।
” সকাল তুই খুব ভালো মেয়ে। একদম ওই বদমাশ, ঝগড়ুটে লোকটার কথা ভাববি না। লোকটা একটা দুষ্টু লোক। তোকে ফাঁসানোর ধান্দায় আছে। ”
চলবে!
#এই_ভালো_এই_খারাপ(২১)
#Jannat_prema
উত্তপ্ত রোদে নাজেহাল অবস্থা শহর বাসির। বৃষ্টি হয় না প্রায় অনেক দিন। অক্টোবর মাসেও যে কিভাবে এতো গরম পড়ে ভেবে পেলো না সকাল। চট্টগ্রামে ঢাকা শহরের মতো অত বেশি জ্যাম না থাকলেও মোটামুটি জ্যাম তো হই। সকাল আর লিজা তিতিবিরক্ত। রিকশার হুড তোলায়ও গরম কোনো অংশে কম লাগছে না। আজকে বাবা গাড়ি নিয়ে যাওয়ায় রিকশা দিয়ে দুই বান্ধবী ভার্সিটির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো।প্রায় দুই মিনিট ধরে জ্যামে বসে আছে। সকাল রিকশাওয়ালা চাচার দিকে একবার তাকালো। গায়ের সাদা ফ্যাকাশে শার্টটা গরমের কারণে ঘেমে ভিজে আছে৷ সকালের ভীষণ মায়া হলো। এরা কত কষ্ট করেই না জীবন নামক যুদ্ধে টিকে আছে৷ মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পরিবার চালানোর জন্য রোজগার করছে। জ্যাম ছাড়তেই হাফ ছাড়লো সকাল। গরমে তার অবস্থা যেনো পাগলের মতো হয়েছিলো৷ একেতো হিজাব করা ছিলো বিধায় গরমটা বেশিই লাগছিলো।
ভার্সিটিতে ঢুকে সকাল একবার পুরো ক্যাম্পাসে চোখ বুলালো। লিজা ভ্রু কুঁচকে আছে। এই মেয়েটা দাড়িয়ে দাড়িয়ে কাকে খুজছে? লিজা শেষমেশ ব’লে উঠলো,
” কাকে খুজছিস তুই? ”
” কাউকে না। ”
” তো কাউকে না খুজলে এভাবে দাড়িয়ে এদিক ওদিক কি দেখছিস? ”
সকালের মনঃক্ষুণ্ন হলো৷ যাকে দেখতে চেয়েছিলো তাকে দেখতে পেলো না। লিজার হাত ধরে বললো,
” কিছু না চল! ”
এখনো এক পা বাড়ালো না৷ তার আগেই সকালের কানের কাছে কেউ ফিসফিস করে বলে উঠলো,
” আমাকে খুজছিলে? ”
সকাল থেমে গেলো। পরিচিত কন্ঠ কানে আসতেই আবারো হৃদযন্ত্রের গতিবিধি অস্বাভাবিক হয়ে উঠলো। লিজা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আদিলের দিকে। অথচ সকাল এখনো মুর্তির মতো দাড়িয়ে আছে। আদিল ওদের সামনে এসে দাড়িয়ে দু অধর চওড়া করে হাসলো। ডান ভ্রু নাচিয়ে সকালের উদ্দেশ্যে বললো,
” কি সকালের রানি! বললে না তো আমাকে খুজছিলে? ”
সকাল ঢো’গ গিললো। সত্যি কথাকে গিলে মিথ্যা বললো,
” না তো! আপনাকে খুজবো কেনো? ”
” আচ্ছা! তাহলে কাকে খুঁজছিলে এদিক ওদিক তাকিয়ে? ”
সকাল এই মুহুর্তে কি বলবে ভেবে পেলো না। লিজা কিছু না বুঝে অবুঝের মতো ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। আদিল আবারো বললো,
” বলো কাকে খুজছিলে? ”
সকাল আমতা আমতা করে বললো,
” আমি তো কাউকে খুজছিলাম না। ”
” মিথ্যে বলছো তুমি। ”
আদিলের প্রতিবাদি কন্ঠ। সে জানে সকাল তাকেই খুজছিলো। সকাল স্বীকার করলো না। বললো,
” আমি মিথ্যে বলছি না। ”
” তাহলে মুখ গোমড়া করে চলে যাচ্ছিলে কেনো?”
সকাল অবাক হয়ে তাকালো আদিলের দিকে। ছেলেটা বুঝলো কিভাবে সে মন খারাপ করে চলে যাচ্ছিলো? জানতেই পারে। এ ছেলে তো জাদু করতে পারে। লিজা গরমে হতাশ হয়ে বললো,
” সকাল সত্যিটা বললেই তো হয়। আমি নিজেও দেখেছি তুই ক্যাম্পাসের দিকে তাকিয়ে কাউকে খুঁজছিলি। বল কাকে খুঁজছিলি? সত্যি কি আদিল ভাইকে খুঁজছিলি? ”
” এই যে তোমার বান্ধবীও দেখেছে তুমি কাউকে খুঁজছিলে। এবার বলে ফেলো কাকে খুঁজছিলে? ”
সকাল মনে মনে মনে দাঁত খিঁচে লিজাকে গালাগাল করলো। মেয়েটা সব কিছুতেই পন্ডিত। সকাল হেসে বললো,
” কি বলতো! কালকে হ্যান্ডসাম, ড্যাশিং, কিলার লুক, সুন্দর একটা ছেলেকে দেখে ক্রাশ খেয়েছিলাম। এতোক্ষণ ধরে ওই ভাইয়াটাকেই খুঁজছিলাম দেখার জন্য। ”
আদিল হাতের মুঠো শক্ত করে তাকিয়ে আছে সকালের দিকে। চোয়াল জোড়া রাগে শক্ত হয়ে আছে। একে-তো সত্যিটা বলছেই না তার উপর মিথ্যে বলে তার রাগ বাড়াচ্ছে। লিজা কপাল কুঁচকে কিছু বলতে নেওয়ার আগে আদিলের উপর চোখ পড়তেই অবাক হয়ে থেমে গেলো। সকাল ঠোঁট ভিজিয়ে ঢো*গ গিললো। ভার্সিটির অনেকে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আদিল রাগ নিয়ন্ত্রণ করলো। সকালের কথাগুলো মিথ্যে হোক বা সত্যি তার মোটেও ভালো লাগেনি। আদিল চোখ বন্ধ করে নিঃশব্দে নিঃশ্বাস ছাড়লো। সকালের এক কদম সামনে এসে বললো,
” ফাজলামো করছো আমার সাথে? বয়ফ্রেন্ড থাকতে আরেকটা ছেলের উপর নজর দিতে বুক কাঁপে না তোমার? ”
সকাল হতভম্ব হয়ে আশ্চর্য হয়ে আছে। একই দশা লিজারও। আশ্চর্য ভাবটা গিলে সকাল বললো,
” কে বললো, আপনি আমার বয়ফ্রেন্ড? ”
” কেনো? তুমি জানো না? ”
” না জানি না! ”
” ওকে ফাইন! আমি জানিয়ে দিচ্ছি। আমি মিস্টার নুবায়ের আদিল মিস সকালের রানির অনলি ওয়ান প্রেজেন্ট বয়ফ্রেন্ড এন্ড ফিউচার হাসবেন্ড। কথাটা ভালো করে মাথায় ক্যাচাপ করে নাও সুইটহার্ট! আর ভুলেও আমি ব্যাতিত কোনো পরপুরুষের দিকে তাকালে সোজা কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করে ফেলবো৷ যদিও আমি এখন তোমার জন্য পরপুরুষ বাট মার্স্টাসের ফাইনালটা দিয়েই সোজা তোমাকে বিয়ে করে ফেলবো। মাথায় রেখো! ”
এতোগুলা কথা বলে চলে গেলো আদিল। অথচ পিছনে ফেলে গেলো দুটো পাথর বনে থাকা মানবিদেরকে। লিজা অন্য কারণে অবাক হলেও সকাল আদিলের এমন অদ্ভুত ব্যাবহারে তব্দা খেয়ে আছে। মানুষ পরিবর্তনশীল কথাটা সত্য তাই বলে গিরগিটিকেও হার মানাবে!
.
দু ওষ্ঠে গোলাপি রঙের লিপস্টিকটা হালকা করে লাগিয়ে দু ঠোঁট ভালো করে মিশিয়ে মুচকি হাসলো প্রেমা। হাসার কারণে দুগালে টোল স্পষ্ট ভাবে ফুটে উঠলো। কি সুন্দর সেই হাসি! নাঈমা রেডি হতে হতে চাইলো প্রেমার পাণে। সকাল থেকেই নাঈমার মনটা কেমন বিষাদ প্রহরে ছেয়ে আছে। খালি মনে হচ্ছে তার অতীব প্রিয় কিছু তার নিকট হতে হারিয়ে যাবে। বারবার কেনো জানি প্রেমার দিকে তাকাতে ইচ্ছে করছে। কালো রঙের কুর্তিতে মেয়েটাকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। অথচ যার জন্য সাঁজলো, সে তার জন্য সঠিক মানুষ নয়। নাঈমা সত্যিটা বললো না। বলতে গেলে তার বুক ভার হয়ে আসে। মেয়েটা ভিতরে ভিতরে ভেঙে পড়বে। এসব ভাবতে নাঈমার ভালো লাগছে না। প্রেমা ওড়না দু কাঁধের দুই সাইডে মেলে খিলখিল করে হেসে ঘুরলো। আজকে তার আনন্দ লাগছে। আবদ্ধ স্যারকে আজ নিজের মনের কথাটা বলবে। সে যে ভালেবাসে আবদ্ধকে। প্রেমা ঘুরা থামিয়ে আয়নার সামনে এসে চোখের উপরে দেওয়া আইলাইনার চেক করলো। লেপ্টে গেলো নাকি মনোযোগ দিয়ে চাইলো। না সব ঠিকঠাক আছে।
” আজকে কি হসপিটালে যাওয়ার ইচ্ছে নেই?
নাঈমার প্রশ্ন। প্রেমা শেষ বারের মতো আয়না দেখে তাকালো,নাঈমার দিকে। চওড়া হাসি দিয়ে বললো,
” যাবো না কেনো? অবশ্যই যাবো। আমার মনের মানুষটা তো সেখানে। ”
নাঈমার অসহায় চাহনি। প্রেমা কপাল কুঁচকে বললো,
” এনি থিং রং নামু? তোকে এমন লাগছে কেনো?”
নাঈমা কিছু বললো না। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো প্রেমাকে। মুহুর্তেই মনটা কেমন হুহু করে কেঁদে উঠলো। চোখ জোড়া ঝাপসা হয়ে উঠলো। মনটা কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না। নাঈমার আচমকা এমন কাজে বিস্ময় খেলে গেলো প্রেমার মাঝে। সেও নাঈমাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
” আজকে তুই এমন অদ্ভুত কাজ করছিস কেনো? কি হয়েছে বল আমাকে? ”
” কিছু না! ”
আড়ালে চোখ মুছে মুচকি হাসি দিয়ে প্রেমাকে ছেড়ে বললো নাঈমা। নাঈমা হঠাৎ তাড়া দেখিয়ে বললো,
” তাড়াতাড়ি চল! অলরেডি আমাদের লেট হয়ে গেছে। ”
.
” মা! ওওও মা! মাগো! ”
নায়েলি বেগম ঠোঁট টিপে হাসলেন। মেয়েটা এতো মিষ্টি করে ‘ মা ‘ বলে ডাকলে তিনি কি সাড়া না দিয়ে বেশিক্ষণ থাকতে পরবেন? উহু পারবেন না। তবুও তিনি চুপচাপ আলু তরকারি কাটতে থাকলেন। ভোর ওড়নার কোণাটা আঙুলে প্যাচিয়ে শ্বাশুড়ি মায়ের গা ঘেঁষে দাড়িয়ে আবারো বললো,
” আবদ্ধকে একটু বলো না, আমাকে বাইরে যাওয়ার,অনুমতিটা দিতে। আমি সত্যি বলছি এক ঘন্টার ভিতর বাসায় চলে আসবো। আমার বান্ধুবিটা সেই সুদুর ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম আসছে আমার সাথে দেখা করতে।
নায়েলি বেগম হাতের আলুটা রেখে ভোরের দিকে তাকালো। ওমনি তার হাসি পেলেও দমে গেলো। বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টে দাড়িয়ে আছে ভোর৷ নায়েলি বেগম মিথ্যে রাগ দেখিয়ে বললো,
” তোদের জামাই বউয়ের মাঝে আমাকে জড়াস না। আমি আবদ্ধকে কিছু বলতে পারবো না। এক কাজ কর তুই তোর ওই বান্ধবীটাকে বাসায় নিয়ে আয়। ”
ভোর মুখ কালো করে শ্বাশুড়ি মায়ের আরো গা ঘেঁষলো। আজকে সকালেই তার সুদুর ঢাকায় থাকা বান্ধবীটা আজকে হুট করে কল করে বললো তার সাথে দেখা করবে। প্রায় অনেক দিন সায়মার সাথে তার দেখা হয়নি। তার বিয়েতেও মেয়েটা কোনো এক সমস্যার কারণে আসতে পারেনি। আজকে সকালে আচানক কল করে বললো কোনো এক কাজে নাকি চট্টগ্রাম আসছে৷ দুজনে প্ল্যান করলো দেখা করবে। ভোর সায়মার সাথে কথা শেষ করে কল দিয়েছিলো আবদ্ধকে। আবদ্ধ সাথে সাথে ব’লে উঠলো,
” কোনো দরকার নেই একা একা বের হওয়ার। দরকার পড়লে আমার সাথে বের হবি। ”
ভোর মুখ ভেঙ্গিয়ে বললো,
” আমি মনে হয় আগে একা একা বের হয়নি!”
আবদ্ধ হেসে বললো,
” তুই আগেও একা একা বের হতি না। কারণ তখন শ্বশুর মশাই থাকতো তোর সাথে। যাই হোক তুই বের হচ্ছিস না ব্যাস! ”
ভোর হতবিহ্বল হয়ে আছে। এ ছেলে এটাও জানে? জানবে না তলে তলে ঠিকই তো তার খোঁজ নিতো। ভোর কোনো উপায় না পেয়ে গেলো তার শ্বাশুড়ির কাছে। ভোর নিজের ওড়নার কোণা ছেড়ে নায়লি বেগমের কাপড়ের আঁচল ধরে বললো,
” এমন করছো কেনো? তুমি আবদ্ধকে বলে দেখো। ও তোমার কথা নিশ্চয় শুনবে। একবার কল করে বলো না৷ প্লিজ মা প্লিজ! ”
নায়েলি বেগম ফোঁস করে শ্বাস ফেলে তাকালো ভোরের দিকে। হাত বাড়িয়ে বললো,
” আবদ্ধকে কল লাগিয়ে আমাকে দে। তবে আমি বলার পরেও যদি যেতে না দেয় তাহলে আমার কিছু করার নেই। ”
ভোর হেসে আবদ্ধকে কল লাগিয়ে বললো,
” আচ্ছা! ঠিক আছে। ”
ওপাশ থেকে কল রিসিভ করেই আবদ্ধ বললো,
” তোকে না আমি বলে দিয়েছি আজকে বাইরে যাওয়া যাবে __”
” কেনো বের হওয়া যাবে না শুনি? ”
আবদ্ধ কপাল কুঁচকে ফোনের দিকে তাকালো। ভোর তাহলে শেষমেশ মাকে হায়্যার করলো? কি পঁচা বুদ্ধি! আবদ্ধ মনে মনে ভাবলো ভোরকে আজকে একা বাইরে যেতে দিবে না। মা বললেও দিবে না। নায়েলি বেগম আবদ্ধর কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে বললেন,
” তুই এতো ভাবা ভাবি বাদ দে। মেয়েটা কতদিন হলো একটু বাইরে ঘুরতে যায় না। তুই তো সময়ই পাস না। আলিফাটাও এখন বাসায় নেই দুই দিন পর আসবে। আর আমিও সারাদিন মেয়েটাকে সময় দিতে পারিনা। তাই বলে একগুয়ে হয়ে ঘরে বসে থাকবে? ”
” ওমা! আমার মা জননী দরকারী কথাটা যদি বলতেন তাহলে খুব উপকৃত হতাম। সো দেরি না করে আপনার বউমা যে আবদারটুকু করেছে আপনার কাছে সেটা,বলে ফেলুন! ”
নায়েলি বেগম আর ভোর আবদ্ধর কথায় শব্দহীন ভাবে হাসলো। ভোর ইশারায় ‘ বলো ‘ বলে তাড়া দেখালো। নায়েলি বেগম স্বাভাবিক হয়ে বললেন,
” এতো ঢং করিস না! বউমার আজকে একটা বান্ধুবি ঢাকা থেকে তার সাথে দেখা করতে আসছে। কত দিন পর মেয়েটার মন হালকা হওয়ার,একটা সুযোগ পেলো সেটাও তুই দিচ্ছিস না। দেখ আবদ্ধ তুই যদি এখন আমি বলার পরেও না করিস তাহলে আমি ভোরকে ওর বাবার বাসায় পাঠিয়ে দিবো। সেখানে কয়েকদিন বেড়িয়ে আসুক। ”
আবদ্ধ পিলে চমকে গেলো বেড়ানির কথা শুনে। বিয়ের আগে ভোরকে ছাড়া কোনো রকম থাকতে পারলেও বিয়ের পরে ভোরকে ছাড়া সে একরাতও থাকতে পারবে না৷ আবদ্ধ ডান হাতের তর্জনী আঙ্গুল দিয়ে কপাল চুলকে বললো,
” থাক মা! কোনো দরকার নেই আমার বউকে কোথাও পাঠানোর৷ তোমার ভালো ছেলের দুষ্টু বউকে বলো সাবধানে যেতে। সে তো আবার সোজা হাটতে পারে না৷ হাটতে হাটতে রাস্তার মাঝখানে চলে যায়। রাখছি রোগি দেখতে হবে আমায়। ”
আবদ্ধ কল কাটাতেই নায়েলি বেগম আর ভোর খিলখিল করে হেসে উঠলো। ভোর নায়েলি বেগমকে জড়িয়ে ধরে বললে,
” দেখেছো মা? তোমার ছেলে কিভাবে আমাকে অপমান করলো? থাক এটা কোনো ব্যাপার না৷ থ্যাংকিউ আমাকে পারমিশন দেওয়ার জন্য! ”
নায়েলি বেগম হেসে ভোরের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
” পাগলি মেয়ে! এখন যা রেডি হয়ে নে। পরে আবার তোর দেরি হয়ে যাবে। ”
চলবে!