#এই_ভালো_এই_খারাপ(৫)
#Jannat_prema
ভোর নিরবে চোখ মুছলো। সে অনেক আগেই জেগে গিয়েছিলো। যখন আবদ্ধ তার সামনে বসে কথা বলছিলো ঠিক তখন ভোরের ঘুম ভেঙে গেলেও চোখ খুললো না। পাছে আবদ্ধ যেনো টের না পায় আস্তে করে নাক টানলো। আবদ্ধ বারান্দায় যেতেই ভোর ডুব দিলো অতীতের কিছু স্মৃতির পাতায়। ভোর ভাবলো আবদ্ধ যাওয়ার পর তার দিনগুলো যেনো রঙহীন হয়ে গিয়েছিলো। খাওয়া দাওয়ার প্রতি অনিহা বেড়ে গিয়েছিলো। মাঝরাতে যখন ঘুম ভেঙে যেতো, তখন আবদ্ধর নাম্বারে কল দিতো। ভোর জানতো নাম্বারটা বন্ধ তবুও অবুঝ মন মানতে চাইতো না। মনে হতো আবদ্ধ হুট করে কল রিসিভ করবে। তারপর শান্ত কন্ঠে তাকে বলবে,
” নিচে আয়। তোকে দেখতে ইচ্ছে করছে? ”
তখন ভোর কি করতো? ছুটে নিচে গিয়ে আবদ্ধর চুল টেনে ধরে বলতো,
” অভদ্র! বেয়াদব! আমাকে ছেড়ে কোথায় চলে গিয়েছিলি? বল!
কিন্তু সব যে ছিলো ভোরের কল্পনা। আবদ্ধ যাওয়ার পর ছয়টা বছর কেটে গিয়েছিল। ততদিনে ভোর অনার্স কমপ্লিট করে ফেলেছিলো। শ্রাবন্তী এর মধ্যে হাজারবার বিয়ের কথা উঠালে ভোর নাকচ করে দিতো। শ্রাবন্তী মেয়ের নাকচে নারাজ হলেও বাদল সাহেব যখন বলেছেন,
” মেয়ে আগে পড়াশোনা শেষ করুক৷ হয়তো ওর পছন্দর কেউ আছে। সময় হলে নিজেই বলবে। অযথা মেয়ের উপর প্রেশার দিওনা। ”
শ্রাবন্তী চুপ হয়ে যেতেন। অবশেষে ভোরের পড়াশোনা শেষ হওয়ার মাসখানেক পর আবদ্ধর চাচাতো ভাই সিফাতের জন্য তার সম্বন্ধ আসলো। ভোর তখন জানতো না সিফাত আবদ্ধর ভাই। তখন বিকাল বেলা। তাদের বাসাটা চার তলায় হওয়া বারান্দায় বসলে বাতাসে মন জুড়িয়ে যায়। দু বোন বারান্দায় বসে গল্প করার মাঝে হাজির হলেন শ্রাবন্তী। কৌতুহল নিয়ে দুবোন তাকালো মায়ের দিকে। শ্রাবন্তী মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
” তোর জন্য বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে৷ উনারা তোকে দেখতে ড্রয়িংরুমে বসে আছেন। অমত করিস না তোর বাবাই কিন্তু এ সম্বন্ধটা এনেছেন। ”
সকাল তখন ভোরের দিকে চেয়ে ছিলো। মায়ের কথায় কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেলো তার সুন্দর বোনের চেহারাটা। ভোরের মনে ছিলো তখন হাহাকার। আবদ্ধ কি আসবে না? তার অপেক্ষার সুতোটা যে বৃহৎ নয়। কারণ সে মেয়ে। এতোদিন মা বাবা বিয়ের কথা বলেনি৷ এখন যখন তার পড়াশোনা শেষ, মেয়ে বিয়ের উপযুক্তও হয়ে গেছে তাহলে তো আর বসে থাকবে না। ভোর কান্না গিলে মায়ের দিকে তাকিয়ে প্রানহীন হাসি হেসে বললো,
” তুমি যাও আমি রেডি হয়ে আসছি। ”
মেয়ের কথায় খুশিতে গদগদকণ্ঠ শ্রাবন্তী বললো,
” আচ্ছা তুই রেডি হ। এই সকাল তুই আমার সাথে আয়। হাতে হাতে কাজ এগিয়ে দিবি। ”
সকাল মুখটাকে পেঁচার মতো করে হাটা দিলো মায়ের পিছু পিছু। সবাই যেতেই ভোর ডুকরে কেঁদে উঠলো। ফোন হাতে নিয়ে আবারো ডায়াল করলো সেই চিরপরিচিত নাম্বারে। সে আগের মতোই নাম্বার বন্ধ। ভোর মুখে হাত চেপে বিরবির করে বললো,
” আমাদের কি আর দেখা হবে না, আবদ্ধ। আমার যে আর অপেক্ষার ক্ষমতাটা কুলচ্ছে না।”
.
সিফাতদের ভোরকে পছন্দ হলে সেদিনই আংটি পড়িয়ে যায়। বিয়ের তারিখ পড়েছিলো ঠিক বিশ দিন পর। ভোর খেয়াল করেছিলো যে ছেলেটার সাথে তার বিয়ে ঠিক হয়েছে সেই ছেলেটার তার প্রতি কোনো ফিলিংস ছিলো না। শুধু মাঝে মাঝে ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে হাই, হ্যালো পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিলো। ভোরও তখন এতো গুরুত্ব দিলো না। ভোরকে যখন বিয়ের দিন স্টেজে নিয়ে যাচ্ছিলো, তখন কেনো জানি মনে হচ্ছিল কেউ তার দিকে গভীর মনোযোগে তাকিয়ে আছে। ভোর সংশয় কাটাতে সামনে তাকালে থমকে যায়। সিফাতের জায়গায় এতো বছর পর বর বেশে বসে থাকা ছেলেটাকে চিনতে ভুল হলো না। আবদ্ধকে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলো ভোর। নিজের ভ্রম ভেবে বার কয়েক চোখের পলক ফেলে তাকালো ভোর । না এটা আবদ্ধই। আবদ্ধ আগের থেকেও আরো সুন্দর হয়ে গেছে। ভোর নিষ্পলক তাকিয়ে ছিলো ক্ষন কাল। তবে হৃদয়ের কোথাও যেনো অভীমান, রাগ, জেদ জেগে উঠেছিল আবদ্ধর জন্য। বার বার মস্তিষ্কের ভিতর থেকে কেউ যেনো বলছে,
” তোকে ধোকা দেওয়া মানুষটা তোর সামনে। ”
সেই থেকে ভোর আবদ্ধর সাথে ভালো করে কথা বলছে না। ভোর বারান্দায় তাকালো। আবদ্ধর প্রশস্ত শরীরটা বুঝা যাচ্ছে। আগের থেকেও আরো লম্বা হয়ে গেছে। চাপ দাড়িতে ফর্সা মুখটা ভীষণ আকর্ষনীয় লাগছে আবদ্ধর। হাতের পেশিগুলো জিম করার কারণে ফুলে আছে। আবদ্ধকে দেখলেই বুঝা যায় প্রতিদিন জিম করেছে। ভোর মনে মনে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো,
” তুই পুরোটাই পাল্টে গিয়েছিস। ”
.
মুখের উপর কারো উষ্ণ শ্বাস পড়তেই ঘুমের মাঝে কপাল কুঁচকালো ভোর। পিটপিট করে চোখ খুলে মুখের উপর আবদ্ধকে দেখে থমকে গেলো ভোর। আবদ্ধ ঝুকে আছে ভোরের দিকে। মুখে তার বাঁকা হাসি। ভোর সন্দেহের চোখে তাকিয়ে কিছু বলবে, তার আগেই আবদ্ধ ভোরের গালের সাথে নিজের গাল লাগিয়ে ঘষা দিতেই ভোর আর্তনাদ করে সরে উঠে গেলো।
” উফ! জ্বলে গেলো আমার গাল। জ্বলছে রে পুরো গাল। ”
আবদ্ধ ট্রাউজারের পকেটে দুহাত ঢুকিয়ে সোজা হয়ে দাড়ালো। ভোর গালে হাত দিয়ে তপ্ত চোখে তাকালো। আবদ্ধ ভাবলেশহীন হয়ে গম্ভীর সুরে বললো,
” অলরেডি সাড়ে সাতটা বেজে গেছে। আবদ্ধ লেট করে উঠা পছন্দ করে না। সেখানে তুই আমার ওয়াইফ হয়ে এতোটা স্লো হলেতো চলবে না। ”
ভোর দাঁত কটমট করে আবদ্ধর দিকে তাকালো। তার এখন আবদ্ধকে দুই তিনটা ঘুষি মারতে পারলে শান্তি লাগতো। ভোর ধুপধাপ পা ফেলে চলে গেলো কাবার্ডের কাছে। কাল রাতে আলিফা তার সকল জামা কাপড় কাবার্ডে গুছিয়ে দিয়েছে। আজকে বৌ ভাত তাই গোলাপি শাড়িটা হাতে নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে যাওয়ার সময় আচমকা হাতে টান অনুভব হতে পিছনে তাকালো। আবদ্ধ ভোরকে এক টানে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে ভোরের কোমড় জড়িয়ে ধরলো। আবদ্ধর এমন আচমকা টানে হকচকিয়ে গেলো ভোর। মাথা উঠিয়ে আবদ্ধর মুখের দিকে তাকালো। আবদ্ধ ঘোর লাগা নয়নে তাকিয়ে বললো,
” আমার থেকে দূরে দূরে থাকার চেষ্টা করলে ঠিক এভাবে তোকে নিজের সাথে জড়িয়ে মিশিয়ে রাখবো সারাজীবন । ”
ভোর আবদ্ধর বুকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। চোখ গরম করে আবদ্ধর দিকে আঙ্গুল উচিয়ে বললো,
” আমি তোর থেকে সেই কখোন দূরে সরে গিয়েছি। এখন আর নতুন করে দূরে সরার মতো কিছু নেই। ”
ভোর পা ঘুরিয়ে চলে গেলো ওয়াশরুমের দিকে। আবদ্ধ আহত চোখে তাকিয়ে আছে। বুকের ভিতর চিনচিনে ব্যাথাটা যেনো আবারো শুরু হলো। যে ব্যাথাটা আবদ্ধ গত ছয় বছর ধরে বয়ে চলছে।
ভোর ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে পুরো ঘরে চোখ বুলিয়ে কোথাও আবদ্ধকে দেখতে পেলো না। আবদ্ধ হয়তো নিচে আছে ভেবে সে পরিপাটি হওয়ার মাঝেই ফুলো পেট নিয়ে হাজির হয় আলিফা৷ আলিফাকে দেখে ভোর মিষ্টি করে হেসে এগিয়ে গেলো। আলিফা ভোরের পা থেকে মাথা অব্দি দেখে মুগ্ধ হয়ে বললো,
” মাশাল্লাহ! তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে। গোলাপি শাড়িটাতে তোমাকে ফুটন্ত গোলাপের মতো লাগছে, ভোর। ”
আলিফার প্রশংসায় লজ্জা পেলো ভোর। লজ্জায় গালে লাল আভা ফুটে উঠলো। আলিফা মিটমিট করে হেসে বললো,
” থাক লজ্জা পেতে হবে না। চলো নিচে যাই। নাস্তা করতে হবে তো? ”
ভোর সায় জানিয়ে আলিফার সাথে নিচে গেলো।
.
এতো সকালে সকালকে ছাদে দেখে থেমে গেলো আদিল। তার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধির আবিষ্কার হতেই আশেপাশে চোখ বুলিয়ে এগোলো সকালের দিকে। আবদ্ধদের বাড়ির ছাদটা দারুণ সুন্দর বলে সকাল সকাল ছাঁদে হাজির হলো সকাল। মিম আর রাইসাকে আসতে বললে ওরা আসেনি। বোনের শ্বশুর বাড়িতে এসে এতো ঘুরাঘুরি করলে উনার কি মনে করবে ভেবে দু বোন আসলো না। ওদেরকে পাত্তা না দিয়ে সকাল রুম থেকে বের হতে দেখা হলো নায়েলি বেগমের সাথে। তিনি সকালকে দেখে মিষ্টি করে হেসে বললো,
” ওমা তুমি উঠে গেছো? ”
সকাল হাসলো। বোনের শ্বাশুড়িকে তার ভীষণ ভালো লেগেছে। দেখতেও কি সুন্দর এই মহিলা। সকাল মাথা নাড়িয়ে বললো,
” জ্বী আন্টি৷ আমি সকালে তাড়াতাড়ি উঠতে পছন্দ করি। ”
শেষের কথাটা চাপা মারলো সকাল।অথচ সে বাসায় থাকলে ঘুম থেকে বারোটা এগারোটা করে উঠে। তার বিপরীত হলো তার আপু। ভোর একদম ফজরের সময় উঠে আর ঘুমোয় না। নায়েলি বেগম সকালের গালে হাত রেখে বললেন,
” খুব ভালো। তুমি যখন উঠেই গেছো তাহলে আমাদের ছাদটা ঘুরে আসো। সকালের ঠান্ডা হাওয়ায় ভালো লাগবে। ”
সকাল মনে মনে খুশিতে নেচে উঠলো। যাক তাকে আর কষ্ট করে বলতে হলো না। নায়েলি বেগম চলে যেতেই সকাল নাচতে নাচতে চলে গেলো ছাঁদে। আদিল সকালের পিছনে এসে দাড়ালো। ধীর ভাবে সকালের কানের কাছে মুখ নিয়ে চিল্লিয়ে উঠলো,
” ভাউউউউউউউ!”
চলবে!