এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায় পর্ব-০৭

0
551

#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_০৭

বাংলায় ‘কিংকর্তব্যবিমূঢ়’ বলে একটা শব্দ আছে। যার অর্থ — কিং সাহেব যখন তার কর্তব্য পালন করতে না পেরে বিমূঢ় হয়ে যান! নিখিলের একটু আগে বলা কথাটা শুনে সৌভিকও নতুন একটি শব্দের আবিষ্কার করলো– সৌভিককর্তব্যবিমূঢ়!
হতবুদ্ধি চোখে বন্ধুর দিকে চেয়ে আছে সৌভিক। কোনমতে মুখ খুলে বললো,
— “কি বললি তুই? কে?”
ওর এমন আশ্চর্যজনক চাহনি, নিখিলকে ভাবান্বিত করে তুললো। সে কি কোনো ভুল কিছু বলে ফেলেছে? চারুলতাকে কি ভালোবাসা যায় না? নাকি সে অধিকার তার পাওয়ার যোগ্যতা নেই? মৃদু কণ্ঠে ফের স্বগোক্তি করলো,
— “চারুলতা জাফরিন!”
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নিজস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো সৌভিক,
— “আর ইয়্যু কিডিং? ফাজলামি করছিস তুই?”
— “না। মজা করবো কে—”
হঠাৎ করেই ছেলেটাকে কেমন ক্ষেপাটে মনে হতে লাগলো। গৌড় বর্ণের উজ্জ্বল দেহকান্তের রং পাল্টাতে লাগলো। রক্তিমাভা ধারণ করলো মুখশ্রী, চোয়াল হলো শক্ত। আকস্মিক ওর এই পরিবর্তনে অবাক হলো নিখিল। কিছু বলবে তার আগেই ধমকে উঠলো ও,
— “চারুকে তুই কতটুকু চিনিস? তুই কি জানিস ওর সম্বন্ধে? তাতেই ওকে নিয়ে এসব ভাবতে পারিস কি করে?”
— “তুই এতো রেগে যাচ্ছিস কেন?”
ফ্যাকাশে মুখে জিজ্ঞেস করে। সৌভিক আরও তেঁতে গেল। বারুদের মত দপ করে জ্বলে উঠলো,
— “রেগে যাচ্ছি কেন, মানে? তুই রাগার মত কথা বলে বলিস, রাগছি কেন? হু?”
বলেই ওর বুকের বাঁ পাশে হাত দিয়ে ধাক্কা দিলো। তাল সামলাতে দু’ কদম ছিটকে বিছানার অন্যপ্রান্তে পড়ে গেল নিখিল। সেভাবেই ওর গাল বরাবর ছুঁড়ে দিলো একটি শক্তপোক্ত, মুখ তুবড়ে দেয়া ঘুষি। উঠতে গিয়েও, উঠতে পারলো না ছেলেটা। পড়ে যেতে গিয়েও বাঁদুরঝোলা হয়ে ঝুলে রইলো মশারির সঙ্গে! ভাগ্যিস, ওটা টাঙানো ছিল! তাই রক্ষে!
অকস্মাৎ আক্রমণে অপ্রস্তুত হলেও, দিশেহারা হলো না নিখিল। দ্বিতীয়বার ওর দিকে আঘাতের মুষ্ঠি ধেয়ে এলেই, আটকে দিলো সবেগে। ঝপ করে উঠে বসে সৌভিকের বাড়িয়ে দেয়া মুঠবদ্ধ হাত করায়ত্ত করে ফেললো নিমিষেই। তারপর একেবারে ফিল্মি স্টাইলে ওরই বাড়িয়ে দেয়া মুঠি, ওরই মুখের সামনে ধরে হিসহিস করে উঠলো,
— “হোয়াট আর ইয়্যু ডুইং? হ্যাভ ইয়্যু গন ম্যাড? শুধু তো ভালোবাসার কথা বলেছি। তাতেই এতো ক্ষেপছিস কেন? বোন হয় তোর। কোনো সম্পত্তি না যে, এরকম পাগলের মতো আচরণ করবি! আর আমি তো খারাপ কিছুও বলি নি। তাহলে?”
সৌভিক সহসা কোনো কথা বলতে পারলো না। ফ্যালফ্যাল নয়নে চেয়ে রইলো কেবল। একটু ধাতস্থ হতেই ওকে ছেড়ে দিলো নিখিল। কাছ থেকে সরে গিয়ে, নিরাপদ দূরত্বে বসলো। শান্ত কিন্তু দৃঢ়তার সহিত বললো,
— “এতো ছোট একটা ব্যাপার নিয়ে মারামারি করতে পারে আমার ধারণাই ছিল না! তুই এরকম ইমম্যাচিউর তাও জানতাম না। চারুলতাকে আমার প্রথম দেখায় ভালোলেগেছে। আমি ভাবছিলাম, কীভাবে তোকে কথাটা জানাবো। একটু লজ্জা লাগছিল, ভেবে পাচ্ছিলাম না কিছু। এরমধ্যে তুই জিজ্ঞেস করলি — আমি বলে দিলাম আমার মনে কি আছে। কিন্তু তোর এরকম রিয়েকশন—”
একটু থেমে আবার বললো,
— “তোর সমস্যা কি আমি জানি না। কেন এরকম ষাঁড়ের মতো তেড়ে এলি, জানি না। কিন্তু আমি আশা করবো, তুই আমাকে কারণটা বলবি। এখন হয় তো বলতে চাচ্ছিস না। যখন ইচ্ছে হবে তবে তখন বলিস। কিন্তু একটা কথা মনে রাখিস, চারুকে আমি ভালোবেসেছি। সবসময়ই বাসবো!”
কথা শেষ করে ওর দিকে চোখ তুলে চাইলো। সৌভিকের কোনো হেলদোল নেই। এখনো ঠায় বসে আছে। মুখটা নিচু, ঘনঘন শ্বাস ফেলার আওয়াজ আসছে। ওকে চেনে নিখিল। সহজে এমন রাগ করবার পাত্র নয়। তবে আজ হঠাৎ কেন এতো রেগে গেল কারণটা বোধগম্য হচ্ছে না। ওকে ওর মতো সময় নিতে দিয়ে ঘুমিয়ে গেল নিখিল। থাকুক, ও ওর মতন। শান্ত হয়ে ভাবুক!
___

দোতলায় চারুর ঘরটার সামনে দাড়িয়ে আছে অনুলেখা – মাহাদ। দু’ জনের পরনেই বাইরে যাবার পোশাক। মাহাদের হাতে একটা লাগেজ। বোঝাই যাচ্ছে, চলে যাবার প্রস্তুতি! বৌভাতের দ্বিতীয়দিন আজ। বাঙালিয়ানা নিয়মে বিয়ের পর নাইওর এসেছিল অনু। আজ তার সময় ফুরালো, ফেরৎ যেতে হবে নতুন ঠিকানায়। তার স্বামীর ঠিকানায়!
যাওয়ার আগে চারুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে ওরা। অনুর আসবার মন ছিল না, হয় তো আসতোও না। কিন্তু মাহাদের অনুরোধ ফেলতে পারলো না। ছেলেটা এতো মিষ্টি করে বললো, “যাওয়ার আগে চারু ভাবীকে বলবে না?” — ওর সরল চাহনির বিপরীতে কোনো ত্যাড়া উত্তর দিতে ইচ্ছে হলো না আর। শতহোক, প্রিয় মানুষের আবদার!
দরজা খুলে অনুকে দেখে বেশ অবাকই হলো চারু। গত দুদিন এই মেয়ের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয় নি বললেই চলে। হলেও দু’ জনেই এড়িয়ে গেছে। আজ হঠাৎ? জিজ্ঞেস করবার জন্য মুখ খুলতে গেলেই অনু সোজাসাপ্টা বললো,
— “আমি শশুরবাড়ি যাচ্ছি। যাওয়ার আগে দেখা করতে এসেছি।”
ওর দায়সারা গোছের কথাটা শুনে একটু হাসলো চারু। শ্লেষ মিশ্রিত কণ্ঠে বললো,
— “না এলেই পারতি। শুধু শুধু এতটা রাস্তা হেঁটে কষ্ট করা!”
এরচেয়েও ত্যাড়া জবাব তৈরি ছিল অনুর। ও সেটা প্রয়োগ করেই ফেলতো, কিন্তু মাহাদের উপস্থিতির জন্য সতর্ক হতে হলো। বিচিত্র কারণে চারুকে ভীষণ শ্রদ্ধা করে মাহাদ। সেই বড় আপার সঙ্গে খারাপ আচরণ ও সহ্য করবে না। নব পরিণীতার জীবনে ঝঞ্ঝাট চায় না অনু। তাই চুপ রইলো।
ওর পক্ষ থেকে উত্তরটা দিলো মাহাদ। বিনয়ী হেসে বললো,
— “ওভাবে বলছ কেন, ভাবী? তোমার সঙ্গে দেখা না করে আমি চলে যেতে পারি?”
মাহাদের এমন সহজ স্বীকারক্তি পুরোনো কিছু স্মৃতি জাগিয়ে দিলো মনে। খুব যত্ন করে আবদ্ধ রাখা, বুকের গভীরে লুকোনো কিছু মধুর সম্পর্ক, কিছু অমলিন সময়! পরক্ষণেই পুরোনো ঘায়ে টান পড়লো যেন। রlক্ত ছলকে বেরোলো, ভিজিয়ে তাজা করে দিলো ক্ষতটা। ঠোঁটটা কেমন বাঁকা করে বললো চারু,
— “পরশু বিয়ের সময় তো আমাকে মনেও করো নি। এখন হঠাৎ?”
— “কে বলেছে মনে করিনি? আম্মা তো বললো, তুমি অসুস্থ ছিলে। তাই আর— তুমি ভুল বুঝ না, ভাবী! আমি তোমার খোঁজ নিয়েছিলাম।”
কাঠিন্য স্বরে চারুর প্রত্যুত্তর,
— “আমাকে ভাবী ডাকা বন্ধ করো, মাহাদ। তোমার সঙ্গে সে সম্পর্ক আর আমার নেই।”
— “কিন্তু ভাবী ডেকেই তো আমি অভ্যস্ত। ভাইয়া, ও-বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হতে পারে, তাই বলে কি আমার সঙ্গেও?”
আকুল চোখে তাকায়। চারু নির্বিকার,
— “যেখানে আসল মানুষটার সঙ্গেই সব চুকে-বুকে গেছে, সেখানে তুমি তো— যাক গে, বাদ দাও। আমি যেহেতু তোমার স্ত্রীর বড় বোন, সে হিসেবে আপু ডাকলেই খুশি হব। পুরোন সম্পর্ক, যার কিনা কোনো অস্তিত্ব নেই তার প্রয়োজন কি?”
হাসার চেষ্টা করলো। ভাবী ডাকায় ঘোর আপত্তি বুঝতে পেরে দমে গেল মাহাদ। কিছুই আর আগের মত নেই। সেই সুন্দর ভাবী- দেবরের সম্পর্ক, খুনসুটি — হারিয়ে গেছে সব! মিইয়ে যাওয়া গলায় বলে,
— “ঠিক আছে। আপা ডাকবো তবে।”
— “আচ্ছা।” চারু হাসে।
মাহাদ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অনুকে বললো,
— “তুমি যাও। আম্মা – আব্বার কাছে বিদায় নাও। আমি আসছি।”
ওকে চারুর কাছে ফেলে চলে যেতে যদিও ইচ্ছে ছিল না অনুর তবুও দিরুক্তি না করে নিঃশব্দে প্রস্থান করলো।
চারু প্রশ্নাত্মক চোখে চাইলো,
— “কিছু বলবে, মাহাদ?”
কয়েক সেকেন্ড নীরবতার পর মাহাদ শুধায়,
— “তুমি কি আমাদের উপর রাগ করে আছ? বিয়েটাকে মেনে নিয়েছ তো?”
— “তোমার কেন মনে হচ্ছে, আমি রাগ করবো? কেন মানব না তোমাদের বিয়ে? যেটা আমার পুরো পরিবার মেনে নিয়েছে সেটা আমি না মানার কে? আর আমার না মানা দিয়ে তোমাদের কি যায় আসে?”
ইতঃস্তত হয়ে বলে,
— “তোমাকে অনুর বড় আপা বলবার আগে, ভাবী বলে ডেকেছি। তুমি যদিও সব ভুলে যেতে চাও। ভুলে যাওয়াই উচিৎ। কিন্তু আমার কাছে সেই সম্পর্কটার গুরুত্ব আছে। জীবনে প্রথম যে নারীকে বড় ভাবীর জায়গা দিয়েছি; মায়ের পর যাকে শ্রদ্ধা করেছি; তার দোয়া না নিয়ে আমি সংসার করতে পারি? তাকে ব্যথা দিয়ে আমি—”
ঠোঁটের কোণে হাসিটা লেগেই রয়েছে ওর,
— “হয়েছে হয়েছে। আর বলতে হবে না। আমি বুঝেছি মাহাদ। তুমি এখনও সেরকমই আছো। পাল্টাও নি। তেমন সহজ – সরল। আমি দুঃখ পাই নি মোটেও। খুশি হয়েছি এই ভেবে যে আমার উড়নচন্ডী, বেখেয়ালি বোনটাকে তোমার কাছে তুলে দিতে পেরেছি। দোয়া করি, সুখী হও। অনেক বেশি সুখী হও।”
কাঙ্ক্ষিত প্রতিক্রিয়া পেয়ে ভীষণ খুশি হয় ছেলেটা। উজ্জ্বল অনুপ্রভা ছড়িয়ে পড়ে ওর সুদর্শন চেহারাখানা জুড়ে। মাথা হেলিয়ে বিদায় নেয় সে,
— “আসছি, ভাবী। তুমি ভালো থেকো!”
শেষবারের মতো ভাবী ডাকটা শুনে চোখে জল ভীড় করলো চারুর। ঝাপসা দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে থাকে ধীরে ধীরে গমনদ্যোত মাহাদের পানে। বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরোয়,
— “আহা রে, জীবন!”
___

অন্ধকার ‘দখিন হাওয়া’য় একা বসে নিখিল। আশেপাশে কেউ নেই। নির্জন, জনশূণ্য। আজ সারাদিনে সৌভিকের সঙ্গে দেখা হয় নি ওর। ঘুম থেকে উঠে ঘরে পায় নি। সৌভিক ছিল না। অথচ, গতোকাল দুই বন্ধু একসঙ্গে বাইরে বেরিয়ে নাশতা করেছে, ঘুরেছে আশেপাশের এলাকা। আজকের জন্যও প্ল্যানিং করা ছিল। কোথায় কোথায় যাবে, এ এলাকার আর কি কি জায়গা দেখবার মতো। কিন্তু তারমধ্যেই কি-না-কি হয়ে গেল!
সৌভিকের ব্যাপারটা নিয়ে ও খুব অবাক হয়েছে। সেই আমলের বাংলা সিনেমার ভিলেনের মত আচরণ! নায়িকাকে পছন্দ করে শুনলে, নায়কের উপর নায়িকার ভাই যেমন চড়াও হয়! খলনায়কের ভূমিকায় অবতরণ করে, ঠিক তেমন! অথচ সৌভিকের চরিত্রের সাথে এ যায় না। একদমই না! তাহলে?
উদাস হয়ে ভাবে। আচ্ছা, কোনোভাবে কি সে ভুল করে ফেললো? সৌভিক নিজেই চারুকে পছন্দ করে না তো? কিংবা ওদের মধ্যে সম্পর্ক নেই তো? ওদের সম্পর্কে ও নিজেই অনধিকার প্রবেশ করে ফেললো কি?
কিন্তু তাও বা কি করে হয়? সৌভিকের সঙ্গে দীর্ঘদিনের পরিচয়, বন্ধুত্ত্ব। প্রাণের সম্পর্ক ওদের। কই, কোনদিন তো দেখে নি এমন কিছু! এমনকি ওর কোনো মেয়ের সাথে সম্পর্ক আছে — এমন কিছুও শোনে নি। চারুকে দেখেও তো মনে হয় নি। তবে? কি করে?
ছটফট করে ওঠে সমস্ত মন। আনচান করে প্রাণ। অদ্ভুত গোলকধাঁধায় ফেঁসে গেছে সে! যার কোনো কূল-কিনারা খুঁজে পাচ্ছে না!

চলবে___

#মৌরিন_আহমেদ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে