#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_০৬
বাড়িতে খুশির আমেজ। কতো কতো মানুষ! সবই অপরিচিত, কাউকেই চেনে না নিখিল। তারপরও এই হাস্যোজ্বল মুখগুলো দেখতে ভালোলাগছে। আনমনে হাঁটতে হাঁটতেই হঠাৎ রিংকু-টিংকুর সঙ্গে দেখা হলো ওর। ওরা দু’ জনে দাড়িয়ে আছে একগাদা মেয়ের মাঝখানে। ঠাট্টা-তামাশা করছে। নিখিলকে দেখতে পেয়েই রিংকু ডাকলো,
— “নিখিল ভাইয়া, এদিকে এসো তো। জলদি জলদিই!”
এগিয়ে এসে ওর হাত ধরলো টিংকু। একপ্রকার টেনেই নিয়ে গেল ওকে। নিখিল বিপন্ন হলো,
— “আরে, আরে! হয়েছে কি? টানছ কেন?”
হুড়মুড়িয়ে মেয়েদের মাঝখানে ঢুকানো হলো ওকে। ও আসতেই কলকলিয়ে উঠলো মেয়েরা। বিদ্রুপের সুরে বললো নেত্রী গোছের কেউ একজন,
— “ভাইয়া? ভয় পাচ্ছেন নাকি? আমরা কি খেয়ে ফেলবো?”
নিখিল একটু অপ্রস্তুত হাসি দিলো,
— “খেতেও পারো। বলা তো যায় না, মানুষরূপী রাক্ষস যদি হও!”
সঙ্গে সঙ্গে হাততালি দিয়ে উঠলো রিংকু-টিংকু। সাবাশি দিলো,
— “ফাটিয়ে দিয়েছ, ভাইয়া। চালিয়ে যাও!”
মেয়েগুলোও সাড়া দিলো,
— “বাপ রে, ছেলে মানুষের এতো ভয়! আমরা তো ভেবেছিলাম—”
হৈ-হৈ করে উঠলো বাকিরা। নিখিলের বুঝতে বাকি রইলো না কেন তাকে এভাবে বগলদাবা করে হাজির হলো টিংকু। ওকে নিয়ে হুল্লোড় থেকে একটু সরে গিয়ে ফিসফিস করে বললো,
— “আমাকে এখানে এনেছ কেন, টিংকু? এসব কি?”
টিংকু হড়বড় করে বললো,
— “আরে ভাইয়া দেখছেন না মেয়েগুলো কেমন তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করছে আমাদের? কেমন ভাবটা নিচ্ছে? যেন আমরা কিছুই না! এখন ওদেরকে দেখিয়ে দিতে হবে না, কাদের সঙ্গে পাঙ্গা নিচ্ছে? তাই—”
ওদের সমস্যাটা বুঝলো নিখিল। দু’ জন ছোট ছেলে সাত-আটটা মেয়ের সঙ্গে চাপার জোরে পারবে নাকি? তাই দলভারী করতে ওকে ডাকা। কিন্তু নিখিল যে এসব পারে না। মেয়েদের সাথে বচসা করা ওর স্বভাববিরুদ্ধ। মেয়েরা হয় নরম – কোমল। ওদের সঙ্গে গল্প করে আরাম। তা না করে ঝগড়া?
বিব্রত হয়ে বললো,
— “ইয়ে, টিংকু কিছু মনে করো না। একটা কথা বলি। মেয়েদের সঙ্গে আর যাই করো, ঝগড়ায় যেও না। তুমি মরে গেলেও ওদের যুক্তির সাথে পারবে না। ওরা চাইলেই আকাশকে মাটি, মাটিকে আকাশ বানিয়ে দিতে পারে শুধু চাপার জোরে! তাই বলছি ভাই–”
— “তুমি মেয়েদের ভয় পাও?”
ভ্রু কুঁচকে তাকালো। নিখিল চটপট বললো,
— “না, ভাই। মেয়েরা ভয় পাওয়ার জিনিস না। কিন্তু ওদের সাথে ঝগড়াটা ভয় পাওয়ার। ওরা কখন কি করে বসে, পরে কি-না-কি হয়! তোমরা এসব সামলাও। আমি নেই।”
সটকে পড়ার মতলব। টিংকু অসহায় গলায় বললো,
— “নিজেদের এতো ছোট ভাবলে হয়, ভাইয়া? ছেলে হয়ে ছেলেমানুষের ক্ষমতাকে মূল্যায়ন করতে পারো না? আমি বলছি, একবার এসো তুমি। দেখো আগে ওদের কি করে তুলোধুনা করি!”
হাত ধরে এগোতে চাইলো। নিখিল ওকে ফিরালো,
— “কিছু কিছু জায়গায় ছোট ভাবার দরকার আছে। ছোট তাই বুঝবা না। এককাজ কর, তোমাদের দলে তোমাদের বড় আপুদের এনে ঢুকাও। মেয়েতে-মেয়েতে ঝগড়া হলে জিতলেও জিততে পার!”
নিজেকে মুক্ত করবার চেষ্টা করলো। টিংকু কিন্তু হাত ছাড়লো না। বিরস মুখে বললো,
— “তুমি এমন করছ কেন? আপুরা কেউ আসলে কি আর তোমায় ধরে টানাটানি করি? বলো?”
— “কেন? আসবে না কেন?”
— “ঋতু আপু, প্রমি আপু ছবি তোলায় মগ্ন। ডেকে মরে গেলেও নড়বে না। ইমা আপু তো আরেক। সারাক্ষণ এটা-ওটা নিয়ে ব্যস্ত! আমাদের কথায় আসবে, ভেবেছ?”
নিখিলের হুট করেই চারুর কথা মনে পড়লো। সাত-পাঁচ না ভেবেই জিজ্ঞেস করে ফেললো,
— “আর চারুলতা? সেও আসবে না?”
— “দূর! বড় আপা কি করে আসবে। ও তো এ-বাড়িতেই আসে নি।”
এতক্ষণে আসল কথাটা শুনলো। চারু তবে আসে নি? কিন্তু কেন? শুধালো,
— “কেন? অনু তার ছোট বোন না?”
সঠিক কারণটা যদিও জানা, কিন্তু তবুও সেটা ওকে জানালো না টিংকু। সে ছোট হলেও জানে, সবকথা সবাইকে বলতে নেই। এড়িয়ে গেল কথাটা,
— “আসলে বড়পা একটু অসুস্থ। এতো চিৎকার-চেঁচামেচিও পছন্দ করে না। তাই বাড়িতেই থেকে গেছে!”
— “ওহ্ আচ্ছা।”
নিরাসক্ত গলায় প্রত্যুত্তর করলো ছেলেটা। টিংকু চেয়েই ছিল ওর পানে। চারু আসে নি শুনে, কীভাবে ওর চেহারার ঔজ্জ্বল্য হারিয়ে গেল সেটা ঠিকই নজরে এলো ওর। সন্দেহী মনে খটকা লাগলো বেশ!
___
নব পরিণীত বর-বধূকে নিয়ে যখন অরুণা ম্যানশনে প্রবেশ করলেন আহাদ রাজা তখন বেলা গড়িয়ে গেছে। গোধূলির হলদে আলোয় রাঙিয়ে, তুমূল ঢাকঢোল পিটিয়ে সকলে ফিরলো বাড়ি। দুদিন আগেই যে মেয়েটা ছিল এবাড়ির পরম কাছের মানুষ, হেসে-খেলে বেড়াতো যে সারা বাড়িময়, সেই মেয়েটাই আজ এথায় হয়েছে আত্মীয়। সদ্য পরিণয় প্রাপ্ত অনুলেখা আজ এ-বাড়ির অতিথি!
সদ্য বিবাহিত দম্পতিটিকে প্রথমেই তাদের ঘরে পাঠিয়ে দেয়া হলো না, বরং বসবার ঘরে পুতুলের মতো সাজিয়ে রাখা হলো। আত্মীয়-স্বজনের ভীড় অনেক। ইতোমধ্যেই অনেকে চলে যাবার তোড়জোড় শুরু করেছেন। বিদায় নিতে আসছেন অনুলেখার কাছে। নব্য জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় উপদেশ দিয়ে; প্রাণভরে দোয়া করে, তারা একেকজন বিদায় নিচ্ছেন। অনেক্ষণ হল এই চলছে।
কিছুক্ষণ পর ওদের রেখে নাশতা আনতে ছুটলেন বড়রা। সোফায় অনু হাসিমুখে বসে। কিন্তু কেমন উসখুস করছে মাহাদ। যেন বসে থেকে স্বস্তি পাচ্ছে না। ক্রমাগত এদিক-সেদিক তাকাচ্ছে। অনু চাপা গলায় শুধালো,
— “হয়েছে কি তোমার? এদিক-ওদিক তাকাচ্ছ কেন? কাউকে খুঁজছ?”
মাহাদ অন্য দিকে তাকিয়েই বললো,
— “আচ্ছা, চারুভাবীকে দেখছি না যে? কাল বিয়ের আসরেও তো ওনাকে দেখলাম না? আমাদের বাড়িও তো যায় নি বোধ হয়—”
চারুর নাম শুনতেই ভ্রু কুঁচকে এলো অনুর। ত্যক্ত গলায় বললো,
— “যাবে কি করে? যাওয়ার মুখ থাকলে তো!”
মাহাদ কেমন যেন চোখে তাকালো। অবাকের সুরেই বললো,
— “এভাবে বলছ কেন? ইট ওয়াজ অ্যান এম্ব্যারেসিং সিচুয়েশন ফর বোথ ওফ্ দেম। ভাইয়ার জন্যও, আর ভাবীর জন্যও। কিন্তু আমার কথা হলো, এ-বাড়িতে তার দেখা নেই কেন? উনি কি এই বিয়েটাতে খুশি হন নি?”
— “যাও যাও। ওর খুশি-অখুশির দাম কে দিচ্ছে!”
মাছি তাড়ানোর ভঙ্গি করলো অনু। বোনের সম্পর্কে ওর এহেন উদাসীন মন্তব্য মাহাদ কে ভাবিয়ে তুললো। বরাবরই দেখছে, অনু এ ব্যাপারে একটু কেমন যেন! সন্দিহান হয়ে জানতে চাইলো,
— “তারমানে চারু ভাবী এই বিয়েটায় নাখোশ? তাই উনি নেই?”
অনু বিপাকে পড়লো। কি মুসিবত হলো! মাহাদ কেন বারবার চারুর প্রসঙ্গ টানছে? ওদের মধ্যে তাকে আনার কি প্রয়োজন? অগত্যা বললো,
— “ও বাড়িতেই আছে, আর খুশিও হয়েছে। বিয়েতেও ছিল তুমি হয় তো দেখো নি।”
— “আর এখন?”
খুব বিরক্ত হলো এবারে,
— “তুমিও তো মাত্র এলে, আমিও মাত্র এলাম। তো কি করে বলবো কে কোথায়?”
অন্য দিকে তাকালো। মাহাদের এই জাতীয় কথাবার্তা তার পছন্দ হচ্ছে না। একদম না! মাহাদ কিন্তু দমে গেল না। স্ত্রীর কোমল হাত দুটো শক্ত করে ধরলো। অনুকে ফেরালো নিজের দিকে। নমনীয় স্বরে বললো,
— “শোনো, অনু। কখনো কাউকে কষ্ট দেবে না। যদি ভুল করেও দিয়ে ফেলো তবে মাফ চেয়ে নিবে। কাউকে কষ্ট দিয়ে কিন্তু কখনোই পার পাওয়া যায় না! সেই কষ্ট কোনো না কোনো ভাবে ঠিকই ফিরে আসে নিজের দিকে।”
অনু বুঝেও না বোঝার ভান করলো,
— “এসব বলছো কেন? আমি কাকে কষ্ট দিলাম?”
— “কষ্ট দাও নি হয় তো। কিন্তু তবুও বললাম। আমাদের এই বিয়েটা অনেকেই পছন্দ করে নি, অনু। ভাইয়া-ভাবীর গল্পে বিচ্ছেদটা না থাকলে হয় তো এমন হতো না। কিন্তু কি আর করা— আমি চাই না, এ নিয়ে তোমার কারো সঙ্গে মনোমালিন্য থাকুক। যদি থেকে থাকে তবে তুমি সেটা ঠিক করে নেবে। ঠিক আছে?”
ওর দু’ গালে হাত রেখে কথাগুলো বললো মাহাদ। কথাগুলো ভালো না লাগলেও স্বামীর মন রক্ষার্থেই ঘাড় নাড়িয়ে সায় দিলো অনু। খুশি হয়ে ওর কপালে উষ্ণ চুম্বনের পরশ বুলিয়ে দিলো মাহাদ! সে চায় না, তাদের নতুন জীবনে কোনো দুঃখ আসুক। কারো হতাশার হাহাকার লাগুক! সে চায়, সুখী হতে! ভীষণ রকমের সুখী হতে!
___
রাতের খাবার শেষে সবে ঘরে ঢুকেছে নিখিল। এসেই দেখলো, সৌভিক ইতোমধ্যেই মশারি টাঙিয়ে প্রস্তুত করে ফেলেছে শয্যা। কাঁথা-টাথা খুলে গায়েও পেঁচানো শেষ! নিখিল হাসলো,
— “কি রে? ন’টা নাই বাজতে ঘুম?”
— “বাজে নি কে বলেছে? দেখ তো, ঘড়ির দিকে! ন’টা তেতাল্লিশ বাজে! একটু পর দশটা বাজবে।”
দেয়াল ঘড়ির দিকে ইশারা করলো। ওর দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলিয়ে নিখিলও চাইলো ওই দিকে। অতঃপর হাসলো খানিক,
— “তা না হয়, বাজলো। কিন্তু তারপরও। দশটায় ঘুমিয়ে যাবি, এটা কোনো কথা? লোকে শুনলে কি বলবে?”
— “লোকের কথায় আমার কি? ওরা কি জানে, দু’দিন ধরে ঘুম হয় না আমার? ছোট বোনের বিয়ে দিয়েছি – ঝক্কি কতো জানে? কতো খাটনি!”
ঠোঁট বেঁকালো সৌভিক। নিখিল হাসলো আবারও,
— “ও বাবা! খুব পরিশ্রম গেছে, না? কাজ করে তো একেবারে উল্টে দিয়েছ তুমি! দেখলাম না?”
— “হ্যাঁ, দেখলিই তো।”
তারপর মাথা চুলকে বললো,
— “কথা বাদ দিয়ে ঘুমোতে আয় তো। চটপট শুয়ে একটা লম্বা ঘুম দেব।”
নিখিল এলো ঠিকই কিন্তু শুয়ে পড়লো না। আধশোয়া হয়ে বসলো। বন্ধুকে প্রস্তাব দিলো,
— “এত তাড়াতাড়ি ঘুমোতে ভাল্লাগছে না। চ’ গল্প করি?”
সৌভিক বিরক্ত হয়,
— “কি গল্প করবি? তোর বৌ-বাচ্চার? বিয়ে করেছিস তুই?”
নিখিল কপট লাজুকতায় মুড়িয়ে নেয় নিজেকে,
— “করিনি। কিন্তু করতে কতক্ষণ?”
— “আচ্ছা?”
নড়েচড়ে বসলো সৌভিক। এবার কথার বিষয় খুঁজে পেয়েছে সে। বিছানা থেকে বালিশটা তুলে, কোলের উপর রাখলো। বন্ধুর দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ ভ্রু নাচালো,
— “তারমানে মেয়ে তোর পছন্দ করা আছে? হু?”
বলেই ঠেলা মারে। কোনোমতে মাথা নেড়ে নিখিল সায় দিতেই, উত্তেজনায় লাফিয়ে উঠে সৌভিক,
— “আমি জানতাম! জানতাম তোর মধ্যে একটা খিচুড়ি পাকছে। তোর ফেইস দেখেই আমি টের পেয়েছিলাম। তা বলতো, কে এই ছাম্মাক ছাল্লো? কি দেখে পাগল হইলি, মাম্মা?”
শেষের কথায় দুষ্টুমি মিশে। ঠোঁট কামড়ে হাসতে থাকে সৌভিক। যেন, বন্ধুর মনের গোপন দুয়ার খুলে গুপ্তকথা বের করাটা কোনো মহান কীর্তি! ওর মনোভাব বুঝতে নিখিল বিব্রত হয় তাতে। কথাটা কীভাবে বলবে ভেবে পায় না! অবশেষে বলে,
— “এভাবে বলিস না। মেয়েটা খুব ভালো। তুই চিনবি।”
— “চিনবো? ও বাপ রে? কোনখানে দাও মারলি, ভাই? কে এই মেয়ে!”
নিখিল দু’ সেকেণ্ড সময় নেয় উত্তর দিতে। তারপর ঢিমে যাওয়া গলায় বলে,
— “চারু।”
আশেপাশেই কোথাও বিস্ফোরণ ঘটলো। হতবিহ্বল সৌভিক সর্বোচ্চ স্বরে চেঁচায়,
— “কীহ্?”
বিস্ময়ে হা হয়ে গেল ওর মুখ। চোখ দুটো এতো বড় করে তাকালো যে মনে হতে লাগলো, কিছুক্ষণের মধ্যেই কোটর থেকে ঠিকরে বেরোবে তারা!
চলবে___
#মৌরিন_আহমেদ