এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায় পর্ব-০৩

0
533

#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_০৩

নাচ শেষ করে সৌভিকদের কাছেই আসতে দেখা গেল কবির – জাবিনকে। ওদের দেখেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালো সৌভিক। উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো,
— “আরে, ভাইয়া! তোমরা তো ফাটিয়ে দিয়েছ একেবারে!”
— “তাই, না?”
হাসলো ওরা দু’জনেই। নিখিলের সঙ্গে তখন পরিচয় করিয়ে দিলো সৌভিক,
— “দোস্ত, এই যে আমার বড় ভাই-ভাবী। এদের কথাই তো বলছিলাম তোকে। আর ভাইয়া, এ হলো নিখিল। আমরা সহকর্মী হলেও সম্পর্কটা একদম বন্ধুত্বের।”
কবির হাত বাড়িয়ে দিলো নিখিলের দিকে। করমর্দন করতে করতে বললো,
— “পরিচয় হয়ে ভালো লাগলো।”
— “আমারও।”
এরপর একে একে প্রায় সকলের সঙ্গেই পরিচিত হয়ে নিলো নিখিল। সৌভিকের সব ভাইবোনের সঙ্গেই দেখা হলো, কথা হলো। শুধু কথা হলো না একজনের সঙ্গে। সন্ধ্যার সেই হৃদয় হরিণী নারী, ডাগর ডাগর আঁখিতে যে দৃষ্টি মেলে ধরে, পানপাতার ন্যায় ছোট্ট মুখখানিতে যার সর্বদা মিষ্টতা লেপ্টে, সেই চারুলতারই সাক্ষাৎ পেল না নিখিল। সারা বিয়েবাড়ি জুড়ে এতো এতো মানুষের মাঝেও নিখিলের দুটি চোখ শুধু তাকেই খুঁজে বেরালো। এতো এতো সুন্দরীর ভীড়কে উপেক্ষা করে তার মানসপটে ভেসে এলো সেই সরলার সুশ্রী চেহারা। তার বলা প্রতিটি শব্দের ঝংকার বাজতে লাগলো কানে। হৃদয় মাঝে জাগলো এক গোপন সুখের ব্যথা। নিজের অজান্তেই গুনগুন করে উঠলো সদ্য প্রেমে পিছলে পড়া দামাল সাতাশের যুবক,
“মাঝে মাঝে তব দেখা পাই,
চিরদিন কেন পাই না~”
__

‘বিয়ে’ — শব্দটা দু’ অক্ষরের হলেও এটা আদৌ কোনো ছোট ব্যাপার নয়। এতে দুটি মানুষকে সারাজীবনের জন্য তো এক করে দেয়া হয়ই, সঙ্গে দুটি ভিন্ন পরিবারের মধ্যেও সৃষ্টি করে দেয় নতুন সম্পর্কের। যার সূচনা বিয়ের অনুষ্ঠান থেকেই। মুসলিম মত অনুসারে বিয়ের কালেমা পড়তে আর রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করতে কখনো মিনিট বিশেকের বেশি লাগে না। অথচ এই ছোট্ট কাজ সারবার জন্য কতো যে আয়োজন মানুষ করে, তার ইয়াত্তা নেই। গায়ে হলুদ, মেহেদী কতকিছু করে, বিয়ে! আবার সেই বিয়েতেও কি কম ঝক্কি?
অন্যান্য বিয়ের ক্ষেত্রে যা হয়, গাড়ি থেকে বর নামতেই সারা বাড়িতে সাড়া পড়ে যায়, “বর এসেছে, বর এসেছে!” তার সঙ্গে সঙ্গেই উঠতি বয়সী সব ছেলেপুলেরা ভীড় জমায় গেটের কাছে। বরের পথ আটকে তারস্বরে চেঁচায়,
— “টাকা দাও, নইলে ভেতরে যাওয়া হবে না!”
বরপক্ষ প্রথমে রাজী হলেও কনেপক্ষের আকাশছোঁয়া চাহিদা দেখে পিছিয়ে যেতে বাধ্য হয়। দু’ পক্ষের চলে কাচা বাজারে সবজি কেনার মত দরকষাকষি। পরিবেশ সরগরম হয়ে উঠে মুহূর্তেই। চিৎকার – চেঁচামেচিতে মুখরিত হয় সবকিছু। কয়েক প্রস্থ কথা কাটাকাটি শেষে, মুরব্বী স্থানীয় কারো হস্তক্ষেপে বর ভেতরে ঢুকবার অনুমতি পায়। মিষ্টি মুখ করে, ফুলের তোড়া উপহার নিয়ে বর হেলেদুলে গিয়ে স্টেজে বসে। আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে সেখানে চলে হাসি – ঠাট্টার আসর। কোনো একফাঁকে বরের জুতো চুরি যায়। ওই পক্ষের সব বাঘা বাঘা লোকেরা এসে ছেঁকে ধরে কনে পক্ষকে। জুতো চুরি নিয়েই ঘণ্টা দেড়েকের বিরাট ঝগড়া হতে দেখা যায় অধিকাংশ বিয়েতে। তারপর বর-কনের খাওয়ার সময়ও চলে সমবয়সীদের নতুন মশকরা। নতুন জামাইকে কতো রকম উপায়েই যে ওরা উত্যক্ত করে! টক-ঝাল-মিষ্টির মিশেলে সময়টা দারুণ উপভোগ্য হয়ে ওঠে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বর্ণিত এই লোকরীতির দু’ একটার ব্যতিক্রম দেখা যায় বটে কিন্তু খুশির কমতি থাকে না কোথাও এক ছটাক অবধি! সবাই আনন্দ করে, উল্লাসে মেতে ওঠে। চারুর বিয়েতেও এসবই হতে দেখেছে এ-বাড়ির সবাই। বংশের প্রথম মেয়ের বিয়েতে সবাই ভীষণ আনন্দ করেছিল। গেট ধরা, জুতো চুরি থেকে শুরু করে সবটাই করেছিল ওরা সব ভাইবোনেরা মিলে। কিন্তু এবার অনুর বিয়েতে এসবের কিছুই যেন হলো না। বড়রা আয়োজনের কোনো ত্রুটি রাখেন নি। অ্যাপায়নেও কিছু কমতি নেই। তবুও সেরকম ভাবে জমলো না অনুষ্ঠান!

মূল স্টেজের থেকে বেশ দূরত্বে এসে আড্ডা সাজিয়েছে ওরা। ছোট ফুপু দেশে আসতে পারেন নি বলে, তার ছেলে অমিত ছাড়া এখানে প্রায় সব ভাইবোনই উপস্থিত। বরযাত্রী আসবার আগ পর্যন্ত ওরা নিজেদের মতো হুল্লোড় করেছে। কিন্তু আপাদত সবাই। যে যার নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। ফোন স্ক্রোল করতে করতে কখনো বা দুটো কথা বলছে। ঋতু একবার ছোট দুই বিচ্ছুকে খোঁচা দিলো,
— “কি রে, রিংকু-টিংকু দুলাভাইয়ের জুতো চুরি করবি না?”
রিংকু বিরস বদনে বোনের দিকে তাকালো। কিছু বললো না। বড় ফুপুর ছোট মেয়ে প্রমি, ঋতুর ব্যাচমেট। জিগরি দোস্ত ওরা একে-অপরের। বান্ধবীর কথায় সায় দিয়ে বললো,
— “তাই তো রে, বিয়ের এতো ইম্পর্ট্যান্ট একটা সেগমেন্ট তোরা বাদ দিয়ে দিবি? এক্কেবারে বাতিলুন?”
বলেই চাপড় দিলো টিংকুর কাঁধের উপর। টিংকু মহাবিরক্ত হয়ে ওর হাতটা সরিয়ে দিলো,
— “তোমার এতো শখ থাকলে তুমি যাও, না। চুরি করো গে! আমাদের সাধছ কেন?”
— “না, বাবা। দরকার নাই।”
— “তাহলে আমাদের গুঁতোগুঁতি করছো কেন?”
মুখভার করে বসে রইলো ঋতু। এ ঘটনায় আশেপাশের কারো ভাবান্তর হলো না। শুধু একপ্রান্তে বসে থাক নিখিলের এই বিষয়টা কেমন খটকা লাগলো। এটা বিয়েবাড়ি, এখানে বর-কনে দু’ পক্ষেই আছে, তাদের মধ্যে বেয়াই-বেয়াইন সম্পর্কের মিষ্টি ঝগড়া হবে, হৈচৈ করবে, আমোদে-আহ্লাদে আনন্দ করবে — অথচ সেরকম কোনো ব্যাপার যেন চোখে পড়ছে না। শুরুতে তাও যা গান-টান গাইছিল, নাচানাচি করছিল, এখন আর কারো তেমন আগ্রহ নেই। কেমন বিমর্ষ হয়ে বসে আছে সবগুলো!

নির্বিঘ্নে বিয়ের কাজ সম্পন্ন হলো। সে সময়ও এরা কেউ জায়গা ছেড়ে উঠলো না। বর – কনের ফটোশ্যুটের সময় ছোট চাচী এসে ডাকলেন ওদের। কারোর বিশেষ কোনো ভাবাবেগ হলো না। রিতা বিরক্ত হয়ে বললেন,
— “তোরা এরকম শুরু করেছিস কেন? ওখানে সবাই ছবি তুলছে, অনুটা ডাকছে তোদের। যেতে পারছিস না?”
কাব্য ভাই ফোন স্ক্রোল করছিলো। সেভাবে থেকেই বললো,
— “আমাকে এখন ডেকো না, চাচী। আমি একটা কাজ করছি।”
হতাশ হয়ে পাশে থাকা কাব্যের বৌ রাত্রির দিকে তাকালেন রিতা,
— “তুমিও কি কাজ করছ?”
— “না, চাচী। যাচ্ছি।”
দোনোমনা করতে করতেই উঠে দাড়ালো রাত্রি। একে-একে টিংকু, প্রমি আর বুশরাকেও সাথে নিলেন চাচী। সৌভিক গেল না, ভীড় পছন্দ করে না বলে। জাবিন ভাবী আর ঋতু খুব মনোযোগ দিয়ে কি যেন করছিল, চাচীকে পাত্তাও দিলো না। ইমা মাথা ব্যথার অজুহাতে পার পেল। আর রিংকু তো সোজাসাপ্টা বলেই ফেললো,
— “শোনো মা, অনু আপার ওই আলগা ঢং দেখার জন্য তুমি আমাকে ডাকবে না। ওই ঢংগীর সাথে ছবি তোলার কোনো শখ আমার নাই।”
ছেলের এই ধৃষ্টতা দেখে তেড়ে এসে কানমলে দিলেন রিতা,
— “বিরাট শখওয়ালা হয়েছ তুমি, না? বের করছি তোমার শখ, দাড়াও!”
— “উহ্, মা! ছাড়ো তো।”
জবরদস্তি করে নিজের কানটাকে রিতার কাছ থেকে উদ্ধার করে রিংকু। তারপর আসন ছেড়ে উঠে চলে আসে নিখিলের কাছে। ওর পিছে আশ্রয় নিয়ে বলে,
— “আমি নিখিল ভাইয়ার সাথে থাকবো। তুমি যাও তো!”
বিপন্ন হয়ে নিখিল ওকে বলে,
— “তোমার মা যখন ডাকছেন তখন গেলেই ভালো হতো না, রিংকু?”
— “না। আমি যাচ্ছি না।”
একগুঁয়ে উত্তর দেয় ছেলেটা। অগত্যা রিতাকে চলে যেতে হয়। বরযাত্রীদের খাইয়ে – দাইয়ে বিদায় দিতে দিতে রাত সাড়ে এগারোটা বাজলো। বিদায়বেলায় সাধারণত খুব কান্নাকাটি হয়। এখানেও ব্যতিক্রম হলো না। খুব কাঁদলো অনুলেখা। মা – চাচী – ফুপুদের গলা ধরে কাঁদলো। এতক্ষণ হাসি-খুশি হয়ে রঙিন ফানুসের মতো উড়তে থাকা মেয়েটাকে এমন হাউমাউ করে কাঁদতে দেখে একটু খারাপই লাগলো নিখিলের। মেয়েদেরকে চিরায়িত এই নিয়মটা মেনে নিয়ে চলতে হয়। নিজের বাড়ি ছেড়ে পরের বাড়ি গিয়ে থাকতে হয়, নিজের সারাজীবনের পরিচয়, বাবা নামক বটগাছের আশ্রয় ছেড়ে নিত্যান্ত অল্পপরিচিত বা স্বল্পপরিচিত একটি পুরুষ যাকে বলা হয় তার স্বামী; তার পরিচয়ে বাঁচতে হয় — এইতো নিয়ম। সব জেনেশুনেও মেয়েটার এই অঝোরে বৃষ্টির মতো কান্না, ওর শুষ্ক মনটাকে বাষ্পীভূত করে দিলো। অনু একটু ধাতস্থ হলে ওকে গাড়িতে তুলে দিতে এগোলো সবাই। তখনই কথাটা শুনলো নিখিল, কে যেন বলছে,
— “অনু তো যাইবো গা, চারু মাইয়াটা কই? বইনের বিদায়ে থাকবো না সে?”
ভীড়ের একপাশে দাড়িয়ে পান চিবোতে চিবোতে দু’টো মহিলা কথা বলছিলেন। চারুর প্রসঙ্গ উঠতেই প্রবল আগ্রহ নিয়ে কান খাড়া করলো নিখিল। ওদের সামন দিয়ে যাচ্ছিলেন একজন মহিলা। খুব সম্ভব মহিলাটি সৌভিকের বড় চাচী। পূর্বোক্ত মহিলাটি তার যেন হাত টেনে ধরে শুধালেন,
— “আপা, আপনার বড় মাইয়া কই? ছোট বইনের বিয়াত সে আইসে নাই?”
— “চারু? এসেছে তো। আসবে না কেন? আসলে, মেয়েটা একটু অসুস্থ। তাই—”
— “ওহ্ আইচ্ছা।”
বলেই পিচ করে শব্দ করে ওখানেই পানের পিক ফেললেন মহিলাটি। সৌভিকের বড় চাচী ব্যস্ততায় ছিলেন, মহিলা হাত ছাড়া মাত্রই দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলেন। তার মেয়ের বিদায় হচ্ছে, উনি যাবেন না?
তার প্রস্থানের পরপরই নিখিলের কানে ফের বাজলো দুটো কথা। মহিলা দুটি একে-অপরের সঙ্গে বলাবলি করছেন,
— “বুঝলা, রাজুর মা। চমক আপার এইসব হইলো ঢং। চারুয় অসুস্থ, না? এক্কেরে মিছা কথা। আসলে ছেরিটারে অনুষ্ঠানে এরাই আইতে দেয় নাই।”
তথাকথিত রাজুর মায়ের কণ্ঠ শোনা গেল। হাঁসের মতো ফ্যাঁস ফ্যাঁসে গলায় তিনি পরচর্চা করলেন,
— “ঠিকই কইছ তুমি। ওই ছেরি যে অলক্ষুণে— ভয় পায়, ছোটটার কপালও যদি পুড়ায়!”
বলেই ফ্যাক ফ্যাক করে হাসলেন দু’জন। নিখিলের বিরক্ত লাগছিল কথা শুনতে। সে আশা করেছিল এরা চারুলতার সম্বন্ধে ভালো কিছু বলবে। ক্ষণিক দেখায় সেই হৃদহরিণীকে নিয়ে এমন কিছু বলবে যা শুনে সে তার কর্ণকুহর ধন্য করবে, প্রাণ জুড়াবে। বাকিটা রাত ওই মনমোহিনীকে নিয়ে মিষ্টি মিষ্টি স্বপ্ন দেখে পার করবে। কিন্তু কথাবার্তার ধরনে বুঝলো, এদের চরিত্র বাংলা সিরিয়ালের অতি পরিচিত সেই কুটিল মহিলাদের মতোই। যাদের কাজই হলো, অন্যের পিঠ-পিছে বদনাম রটানো। ত্যক্ত হয়ে বেরোতে চাইলো এখান থেকে কিন্তু ভীড় কাটিয়ে বেরোনো গেল না। রাজুর মায়ের বিশ্রী হাসির সাথে শুনতে পেল; তাদের এতক্ষণের বোগাস আলাপকে পাত্তা না দিলেও এই কথাটা তার ভেতরে একটা খচখচানির সৃষ্টি করলো,
— “কথায় আছে না, অতি বড় ঘরনী না পায় ঘর,
অতি বড় সুন্দরী না পায় বর? ওদের চারুর সেই দশা! হা হা।”

চলবে___

#মৌরিন_আহমেদ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে