এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায় পর্ব-২৯+৩০

0
511

#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_২৯

— “তুমি যাই বলো মা, আপার এসব কিন্তু একদম ঠিক হচ্ছে না। কোথাকার কার সঙ্গে কি করছে — শেষকালে আমাদের পরিবারের মান সম্মান না ডুবায়!”
ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো অনু। সহসা কি বলবেন ভেবে পেলেন না চমক। মিনমিন করেই বললেন,
— “চারুর উপর আমার আস্থা আছে। ওকে চিনিস না? এরকম কিছু ও কেন করবে!”
— “কেন করবে? মানুষ বদলায়, মা। আপা বদলেছে। তুমি খেয়াল করো নি? আগে সারাদিন মনমরা থাকতো। এখন কিন্তু তেমন থাকে না। বরং সারাক্ষণ কানে ফোন থাকে। গুজুর-গুজুর করে কার সাথে— ”
— “সে তো বন্ধুও হতে পারে। ও বদলেছে আমি লক্ষ্য করেছি। কিন্তু এতে খুশিই তো হওয়া উচিৎ, না? এতোদিন ধরে মেয়েটা মনের মধ্যে দুঃখ পুষে আছে— কারো সঙ্গে মিশে হাল্কা হতে পারা তো ভালো কথা।”

মায়ের সহজ-সরল যুক্তির বিপরীতে তেঁতে উঠলো অনু,
— “তোমরা কেন বিষয়টা এতো হেলা করে দেখছ, বলবে? ওর কথাবার্তা দেখেই তো আমি বুঝেছি ওটা বন্ধুত্ব নয়। একটা ছেলের সঙ্গে প্রেম করছে তোমার মেয়ে। শুধু ছেলে নয়, ছেলের চোদ্দো গুষ্ঠির সঙ্গে উনি ভাব জমিয়েছেন; আমি নিজ কানে শুনেছি। একবার না, বহুবার!”
চমক চুপ করে থাকলেন। চারু প্রেম করছে? ও কি তেমন মেয়ে? অবিশ্বাস্য!
তবুও তিনি আত্মজাকে বুঝালেন,
— “আচ্ছা, আমি দেখবো সেটা। তুই চিন্তা করিস না। এ-সময় এমন প্রেশার নেয়া ঠিক না। বাচ্চার ক্ষতি হবে। তুই যা, মাহাদ বোধ হয় তৈরি হয়ে এসেছে।”
সস্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। অনু তার কথার ধারে কাছেও গেল না। সে তার কথায় অটল,
— “না, মা। এখানে কিন্তু আমাদের সম্মান মিশে আছে। আপার হাবভাব ভালো না। আর ও যার সাথে প্রেম করছে, সে কে? কোনো পরিচয় জানো? আজেবাজে কেউ হলে? ফাঁদে ফেলে বাড়ির সম্মান— আচ্ছা বাদ দাও সে কথা। ও প্রেম করছে, শাশুড়ি পাতাচ্ছে; ওরা সবাই ওর অতীত জানে? ওর আগে বিয়ে হয়েছিল, বাচ্চা হবে না কোনোদিন — এসব শুনে কে ঘরে তুলবে ওকে?”
— “অনু!”
মেয়ের আজেবাজে কথা আর সহ্য হলনা তার। চিৎকার করে উঠলেন হঠাৎ। অনু কিন্তু দমলো না মোটেও, তার রোখ চেপেছে,
— “হ্যাঁ, এখন তো ধমকাবেই! আমি যখন মাহাদের সঙ্গে প্রেম করতাম, তখন কি করেছিলে মনে আছে? রাগারাগি, মারামারি — কতো কি! মাহাদ তো বিয়ে করেছে আমাকে, ওকে করবে কে? কিন্তু সেসব তোমাদের মাথায় নেই। থাকবে কি করে! বড় মেয়ে, আদরের দুলালী যে প্রেমের নামে নষ্টামি—”
— “চুপ করো, মেয়ে। এই বয়সে এসে তোমার গায়ে হাত তুলতে বাধ্য কর না আমাকে! চলে যাও!”
প্রচন্ড ধমক লাগালেন চমক। অনুও তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো,
— “যাচ্ছি। যাবই তো। আমি কি থাকতে এসেছি নাকি! একবারে চলে যাচ্ছি!”

হনহন করে বেরিয়ে গেল সে। বাইরে লন সাইডে লাগেজ হাতে দাড়িয়ে ছিল মাহাদ। ফোন স্ক্রোল করছিল একা একা। রাগে অগ্নিমূর্তি হয়ে ওর হাত থেকে ফোন কেড়ে নিলো অনু, প্রায় ধমকেই উঠলো,
— “চলো এই বাড়ি থেকে!”
মাহাদকে কিছু বলতে না দিয়েই টেনে নিয়ে গেল একদম!

দেয়ালের অপর প্রান্তে দাড়িয়ে ছিল রিংকু-টিংকু। এতক্ষণে মা-মেয়ের মধ্যে সমস্ত আলোচনাই ওদের কানে এসেছে। যদিও সেটা ইচ্ছাকৃত ছিল না। দু’ ভাই ঝগড়া করছিল কিছু নিয়ে। একপর্যায়ে টিংকুর চুল ছিঁড়ে দিয়ে দৌড়ে এসে বড়মার ঘরের কাছে এসে লুকিয়ে ছিল রিংকু। টিংকুও ছুটে এসেছে মারতে কিন্তু বদ্ধ কক্ষের ভেতর থেকে ছিটকে আসা কয়েকটা শব্দ শুনেই দাড়িয়ে গেল দুই ভাই। কৌতুহল বশতই নিশ্চুপে দাড়িয়ে শুনলো বাকিসব!
অনুর প্রস্থান দেখে তীব্র বিরক্তি নিয়ে মন্তব্য করলো রিংকু,
— “দেখলি, ভাই? কুটনিটার কাণ্ড?”
— “কোনদিন ভালো হবে না ওর,দেখিস! বড়’পার সঙ্গে যে কীসের এতো হিংসে ওর; আল্লাহ্ মালুম!”
প্রবল ক্রোধ নিয়ে বললো টিংকু। পরক্ষণেই সহোদরের কথায় চিন্তার ভাঁজ পড়লো কপালে,
— “কিন্তু কি হবে এখন? বড়ম্মুর কান ভাঙানি দিলো যে— নিখিল ভাই, চারু আপার বিয়ে ঠিকঠাক হবে তো!”

একটুপর চমকও বেরিয়ে গেলেন ঘর ছেড়ে। মেয়েদের তিনি সমানভাবে ভালোবাসেন, ভালো বেসে এসেছেন। তবুও ছোট কন্যাটি সর্বদা নিজেকে কেন আলাদা চোখে দেখে তিনি বুঝতে পারেন না। মেয়েটার ধারণা ওর পরিবার ওকে ভালোবাসে না, সব ভালোবাসা বড় বোনের জন্য! অথচ বাস্তবতা একদমই এমন নয়!
অদ্ভুত কারণে ছোটবেলা থেকেই চারুর প্রতি ওর বিদ্বেষ-রেষারেষি। চারু অবশ্য বরাবরই ছাড় দিয়ে এসেছে। চমক বুঝালে সবসময়ই বুঝদারের মতো মায়ের মত সুর করে বলতো, ‘আমি বুঝি, মা। আমি বড়। ও ছোট জন্যই এমন করে! বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে।’
অনু এখন আর ছোট নেই। বড় হয়ে গেছে। তবুও ঠিক হয়ে যায় নি কিছুই। বোনের প্রতি হিংসাত্মক আচরণ যেন বৃদ্ধি পেয়েছে আর বেশি করে!
___

আনিকার হাতে রিজাইন লেটার। সেটা ব্রাঞ্চের হেড তথা ম্যানেজিং ডিরক্টরের কাছে জমা দেয়ার কথা। তিনি অফিসে নেই। পিএস জানিয়েছে তাঁর ফিরতে দেরি হবে। আনিকা যেন অপেক্ষা না করে কাজে মন দেয়। স্যার এলে জানিয়ে দেবে ওকে। আনিকা মনে মনে তাচ্ছিল্য করেছে নিজেকে। কীসের কাজে মন দেবে সে? চাকরীই যখন করছে না — মেয়েটা অবশ্য জানে না সে কথা। আনিকা ঘড়ি দেখলো। এগারোটা চুয়ান্ন বাজছে। ডিরেক্টর স্যার আসছেন না কেন?
আনিকা আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো। এমডি সাহেব এলেন না। অগত্যা বিমর্ষ মন নিয়ে নিজের কেবিনে ফিরলো। দু’টো ফাইল দেখতে না দেখতেই লাঞ্চ আওয়ার হয়ে এলো। আনিকা ক্যান্টিনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবার আগে একবার উঁকি দিলো সৌভিকের কেবিনে। সৌভিকও নেই।

ক্যান্টিনে এসে কর্ণারের সিটটা দখল করলো আনিকা। অর্ডার দিলো চা-সিঙ্গারার। ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে রিজাইন লেটারটা বের করে ভাঁজ খুললো। ভুল-ত্রুটি আছে কিনা দেখতে হবে। তাই পুনরায় চোখ বুলিয়ে নেয়া!
অর্ডার চলে এসেছে। ট্রে থেকে কাপ-পিরিচ নামিয়ে দিয়ে ছেলেটা চলে গেল। আনিকা ধীরে-সুস্থে কাপটা ঠোঁটের কাছে নিয়েছে যবে তখনই চেয়ার টানার শব্দ হলো। হুড়মুড় করে সামনে এসে বসে পড়লো সৌভিক। চমকিত আনিকার কাপ ছলকে চা ছিটকে পড়লো, ঠোঁটও পুড়ল বোধ হয়!
— “উফ্! কী অবস্থা দেখুন! আপনার সঙ্গে থাকতে থাকতে আপনার মতোই দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে গেছে—”
জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজাল। কাপটা টেবিলে রেখে টিস্যু চেপে ধরলো মুখে। তার বুক ধড়ফড় করছে। নার্ভাস লাগছে খুব। এমনটা সবসময়ই হয়। এক খেয়ালে মগ্ন থাকতে থাকতে হুট করে কেউ চলে এলেই! সৌভিকের সামনে যেন একটু বেশিই হয়। ফলশ্রুতিতে ভুলভাল, উদ্ভট কিছু করে বসে সে। আর লোকটা বিরক্ত হয়!
সৌভিক এবারো বিরক্ত হলো। ভ্রু কুঁচকে বললো,
— “চা ফেললেন কি করে? মুখ পুড়ালেন নাকি?”
— “খুব গরম ছিল চা’টা।”
সৌভিকের কুঞ্চিত ভ্রূ সোজা হলো না। বরং আরো সূক্ষ্ম কয়েকটা ভাঁজ পড়লো। টেবিলে রাখা কাগজটার দিকে ইশারা করে বললো,
— “ওটা কি?”
— “এমনই কাগজ। তেমন কিছুই না।”
— “ওহ্।”
মুখ ঘুরিয়ে, স্বাভাবিকের চেয়ে খানিক গলা উঁচিয়ে ক্যান্টিনের মামার উদ্দেশ্যে চায়ের অর্ডার করলো। তারপর ওর দিকে ফিরে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— “তারপর কি ঠিক করলেন? কবে যাবেন মৌলভীবাজার?”
— “চাকরিটা আমি ছেড়ে দিচ্ছি, স্যার। আপনি বলেছিলেন এই সেক্টরে টেকা খুব কঠিন। সত্যিই অনেক বেশি কঠিন। আমি টিকতে পারলাম না!”
লহু স্বরে বললো মেয়েটা। সৌভিক চুপ থাকলো। তার শাণিত নজর একাধারে চেয়ে থেকে পড়ে নিলো ওর চোখের ভাষা। নীরব অভিব্যক্তি। সেকেন্ড ত্রিশেক পর হঠাৎ বলে বসলো,
— “উত্তরা ব্রাঞ্চে ট্রান্সফার করা হচ্ছে আপনাকে। এবার খুশি, আপনি?”
আচানক কথার মানে বুঝতে পারলো না আনিকা। হ্যাং হওয়া মস্তিষ্কে নির্বাক হয়ে বসে রইলো কেবল!

___

রাতের বেলা। সবার খাওয়া-দাওয়া শেষ। অরুণা ম্যানশনের রমণীগণ এখন ব্যস্ত সব গোছগাছে। চারু টেবিল মুছছিল, চমক ঠিক তখনই এলেন ওর কাছে,
— “কাজ হলো?”
মাকে দেখে মিষ্টি করে হাসলো,
— “হুঁ। এইতো। তুমি রান্নাঘর গুছিয়েছ?”
— “তোর ছোটচাচী করছে এখন।”
— “ওহ্।”
হাতের কাজ সেরে ফেললো চারু। এখন ঘরে গিয়ে শো’বে। লক্ষ্য করলো, চমক এখনো যান নি। দাঁড়িয়েই আছেন। মুখ তুলতেই চারুর চোখে চোখ পড়লো। একটু অপ্রস্তুত হলেন তিনি। চারু বললো,
— “কিছু বলবে, মা?”
— “হুঁ। তোর ঘরে চল।”

মাকে সঙ্গে নিয়ে চারু দোতলায় নিজের ঘরে এলো। চমক খুব উসখুস করছিলেন শুরুতে। দোনোমনায় ভুগতে ভুগতেই একসময়ে জিজ্ঞেস করে ফেললেন। চারু কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো তাতে। কিন্তু অস্বীকার করলো না। মৃদু স্বরে জানালো,
— “ওঁর নাম নিখিল। সৌভিক ভাইয়ার বন্ধু। অনুর বিয়েতেই পরিচয় হয়েছে।”
— “ওই কি প্রথমে এগিয়েছিল? বিয়ের পর আর দেখা হয়েছে তোদের?”
— “উহু।”
মাথা নাড়ালো কেবল। চমক সন্দিগ্ন চোখে তাকালেন,
— “তোর সবকিছু ছেলে জানে? ওর পরিবার জানে?”
চারু নীরবে সম্মতি দিলো। হতচকিত চমক,
— “সব জেনেও? ছেলেটা সব জেনে-বুঝেও রাজী হয়েছে? ওর পরিবারের কেউ কিচ্ছু বললো না! অবিশ্বাস্য!”
অবিশ্বাস্য তো বটেই! এ সমাজে যেমন বাচ্চা হবে না নক মাহতাবের মতো উচ্চ শিক্ষিত পুরুষও আছে; তেমনই বাচ্চা হোক বা না হোক, ডিভোর্সী হোক বা অন্য কিছু, ভালোবেসে ঘর করতে, সারাজীবন পাশে থাকতে চাওয়ার মত শুদ্ধ পুরুষও আছে! নিখিল বোধ হয় তেমনই কেউ!

চারুর মুখ থেকে সব শুনে কিয়ৎকাল নিঃস্তব্ধ থাকলেন চমক। অতঃপর মেয়ের হাত ধরে কোমল গলায় বললেন,
— “ছেলেটাকে বল প্রস্তাব পাঠাতে। দুই পরিবার কথা বলি, খোঁজ-খবর নেই। সবকিছু মিলে গেলে বিয়েটা জলদিই দিয়ে দেব। তোর পরিবার কি তোর খারাপ চায়? দেরি করিস না।”
চারু খুশি হয়ে সায় দিলো,
— “আচ্ছা, মা। আমি বলবো।”
মেয়ের কপালে চুমো খেয়ে বিদায় নিলেন চমক। সকাল থেকে তার মনের ভেতর সন্দেহের পোকারা কিলবিল করছিল। অনুলেখার কথাগুলো বারবার ভাবিয়ে তুলছিল তাকে। শত হোক, মা তো! সন্তানের অমঙ্গলের কথা কি ভাবতে পারেন!
কিন্তু চারুর সঙ্গে খোলাসা করে কথা বলে ভালো লাগছে। ছেলেটা নাকি নিখিল। ওই যে, অনুর বিয়েতে সৌভিকের সঙ্গে যে এলো? তখন অবশ্য তাকে তেমনভাবে খেয়াল করা হয় নি; তবে সৌভিকের কাছের বন্ধু যেহেতু; খারাপ নয়। একটু খোঁজ নিলেই হবে। তারপরেই মনে হলো, আরে! সৌভিকের কাছে কল দিলেই তো সব জানো যাবে!

চলবে___

#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_৩০

নাজিয়ার সঙ্গে কথা বলছিল চারু। এমন সময়ে ঘরের দরজায় টুকটুক শব্দ হলো। দৃষ্টি ফেরাতেই দেখলো চমক দাড়িয়ে। হাত নেড়ে ভেতরে আসতে বললো। ফোনের ওপাশে নাজিয়ার কাছে বিদায় নিতে উদ্যত হবে অমনই চমক বললেন,
— “নিখিলের সঙ্গে কথা বলছিস?”
— “ওঁর মা।”
— “তাহলে কাটছিস কেন? কথা বলা শেষ?”
— “হু.. তুমি বলবে নাকি?”
— “দিতে চাইছিস? দে!”
মুঠোফোনটা মায়ের দিকে বাড়িয়ে দিল চারু। একটু আগেই নাজিয়াও খোঁজ করছিলেন ওর মায়ের। নিখিলের কাছে শুনেছেন, চারুর পরিবার প্রস্তাব পাঠাতে বলেছে। তাই নিয়েই ওর সঙ্গে আলাপ করছিলেন আজ। কবে আসবেন এই জানতে। এরমধ্যে চমক এসে যাওয়ায় ভালোই হলো বেশ। বড়দের কথা, বড়রাই সারুক।
ফোনখানা মায়ের হস্তে সঁপে দিয়ে সে নীরবে প্রস্থান করলো। এখানে থাকা তার সমীচীন নয়, উপরন্তু থাকলে লজ্জাই পাবে। অতএব, সরে পরাই ভালো!

অল্প সময়ের মধ্যেই দু’জনের বেশ সখ্যতা গড়ে উঠলো। চারুর প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত নাজিয়া বললেন,
— “চারু তো আপনার চাঁদের টুকরা মেয়ে। এতো মিষ্টি, লক্ষ্মী একটা মেয়ে। ওকে আমার ভীষণ ভালো লাগে, আপা। কবে যে মেয়েটা আমার বাড়ি আসবে!”
পুরনো স্মৃতি মনে পড়ায় হঠাৎ বিষণ্ণ হলেন চমক। মাহতাবের সঙ্গে যখন চারুর বিয়ের কথা এগোচ্ছিল, তখনো তো কতো সুন্দর করে কথা বলেছিল ওর মা। ঠিক নিখিলের মায়ের মতোই তো মেয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ছিলেন। কল দিলেই স্তুতি বাক্যে সন্তুষ্ট করতেন রোজ। কতো মধুর ছিল সেই আলাপ!
মনে হতেই মলিন হাসলেন তিনি,
— “এত মিষ্টি হয়ে কি লাভ! চাঁদেরও যে কলঙ্ক থাকে আপা! মেয়েটার কপালে বোধ হয় সুখ নেই—”
মেয়ের বিয়ে দিতে গিয়ে সব মায়েরাই একটু আবেগী হয়ে ওঠেন। তাই চমকের এই আক্ষেপকে তেমন গুরুত্ব দিলেন না নাজিয়া। বললেন,
— “কে বলেছে? একবার মেয়েকে আমার কাছে দিয়েই দেখুন। কথা দিচ্ছি, ও আপনার বাড়িতেও যেমন রাজকুমারী হয়ে ছিল; আমার বাড়িতেও তেমন থাকবে। বরং এখানে ওর রাজ্যে ভাগ নেই, পুরো সাম্রাজ্যই হবে ওর। মনে সন্দেহ রাখবেন না। আমার কথায় বিশ্বাস রাখুন, বোন।”
— “বিশ্বাস তো রাখতেই চাই। কিন্তু মন মানে না। জানেন তো, ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায়! আমাদের হয়েছে সেই দশা। মেয়েটার যদি অতীত না থাকতো তাহলে— আমরা সবই ভুলে যেতে চাই। প্রথমে তো ভেবেছিলাম মেয়েটা আর বিয়েই করবে না। কিন্তু নিখিল বাবার সঙ্গে কি করে— আপনারা একদিন বাসায় আসুন, আপা। সাক্ষাতেই কথা হবে!”
কথাগুলো এতক্ষণ খুব হালকা ভাবে নিলেও এখন আর হালকা ভাবে নেয়া গেল না। বরং বেশ কঠিন এবং জটিলই মনে হল নাজিয়ার কাছে। কি এক দুর্বোধ্য ইশারা চমকের কথায়। অতীত? কিসের অতীত? চারু কিংবা নিখিল, কিছু কি লুকিয়েছে তার কাছ থেকে?
ভাবনার সুতো ছিঁড়লেন চমক,
— “আপনি কবে আসবেন সেটা বলুন, আপা। সে অনুযায়ী আয়োজন করবো। চারুর বাপ-চাচারা তো সবসময় বাড়ি থাকে না। আগে থেকে দিনক্ষণ জানিয়ে দিলে ভালো হয়।”
— “আমি আপনাকে জানিয়ে দেব। নিখিলের সঙ্গে কথা বলে নেই একটু। কবে ছুটি পায়!”
হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে কোনোমতে বললেন তিনি। চমক সৌজন্য করে হাসলেন,
— “আচ্ছা। রাখছি তাহলে। আল্লাহ্ হাফেজ!”
— “আল্লাহ্ হাফেজ!”
কল কেটে গেল। বিস্ময়ে হতবাক, হতবিহ্বল হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলেন নাজিয়া। তিনি কিছুই বুঝতে পারছেন না। কি হচ্ছে কি এসব?
___

মাহতাবের নতুন ফ্ল্যাটটা কেনা হয়ে গেছে। দলিল-দস্তাবেজ করা হয়ে যাওয়ার পর আজই সবাইকে নিয়ে এসেছে মাহতাব। উদ্দেশ্য ফ্ল্যাটটা দেখানো। সব কাজ যদিও এখনো শেষ হয় নি, আরও বাকি আছে। তবে মাহিয়ার তর সইছিল না। তার আবদারেই আজ সকলকে আনা হলো।

— “ভালোই আছে ফ্ল্যাটটা, কি বলো?”
আশেপাশে চোখ বুলাতে বুলাতে হাসিমুখে মন্তব্য করলো মাহাদ। স্ত্রীর অভিমত জানতে অনুর মুখের দিকে তাকালো।
— “আছে মোটামুটিই। আহামরি কিছু না।”
— “কেন? ভালোই তো আছে। শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত, চব্বিশ তলা ভবনের আটতলায়। পুরো ফ্ল্যাট মোজাইক করা, টাইলসের চেয়ে বেশ ভালো। এবং রুচিপূর্ণও—তবে?”
সহসা উত্তর দিতে পারলো না অনু। সে আসলে কথাটা অতশত ভেবে বলে নি। মাহতাবের কেনা ফ্ল্যাট, তাও মাহিয়ার নামে—একবাক্যে সেটাকে খারাপ বলাই তার উদ্দেশ্য। সেটা যতোই ভালো হোক!
তবুও মাহাদের প্রশ্নের জবাবে কিছু বলা উচিৎ। সে ব্যাপারটাকে সিরিয়াস করেই নিয়েছে। হঠাৎ চুপ করে গেলে বুঝে ফেলবে অনুর মনের কথা। তাই বললো,
— “আরে দেখো না, রুমগুলো কেমন এলোমেলো করা! প্ল্যান ঠিকঠাক নেই। মেইন ডোর খুলেই কার বাড়িতে কিচেন দেখা যায়? আর ঘরগুলোর সাইজ— ছোট ছোট। একটা কিং খাট ঢুকালেই রুম ব্লক…”
— “বলেছে তোমাকে! দশ বাই বারো’র রুম — তোমাকে বলেছে ছোট! বুঝি না আমি, কেন যে তোমরা ভালো জিনিসকে ভালো বলো না!”
কটাক্ষ করলো স্ত্রীকে। ধরা পড়ে গিয়ে চুপসে গেল অনু। মাহাদটা এতো বুদ্ধিমান কেন? উফ্!
দু’জনেই একা একা ঘুরছে ফ্ল্যাটে। অন্যদের মাহতাব নিজেই সবকিছু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখাচ্ছে, এটা-ওটা বলছে। কিন্তু ওরা সে দলে নেই। শুরুতে যদিও ছিল তবে একটু পর অনু বেরিয়ে এসেছে মাহাদকে নিয়ে। একেকটা রুম, ব্যালকনি দেখবার পর মাহিয়ার রিয়েকশন, মুখে হাত দিয়ে ‘ও মাগো, কি সুন্দর!’ বলার ভঙ্গিমা দেখেই মেজাজ বিগড়ে গিয়েছিল ওর। কে দেখে অতো ঢং, কে সয় অতো ন্যাকামো?
গেস্ট রুমে দাড়িয়ে আছে ওরা। এ ঘরের দক্ষিণদিকে একটা জানালা আছে। অনু এগিয়ে এসে জানালার থাই সরালো। বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে হঠাৎ স্বপ্নালু চোখে বললো,
— “আমাদের যখন নিজস্ব ফ্ল্যাট হবে; আমরা তখন খুব সুন্দর করে সেটাকে সাজাবো। মাস্টার বেডরুম করবো যে রুমে এমন দখিনা জানালা থাকবে। তাহলে দেখবে, বসন্তে কি সুন্দর বাতাস আসে ঘরের ভেতর! ঠিক আছে?”
স্ত্রীর কথায় মাহাদ হাসলো। ঘাড় নাড়িয়ে বললো,
— “সে না হয় ঠিক আছে। কিন্তু ম্যাডাম, আপনি যে স্বপ্ন দেখছেন তা কি পূরণ হবে? যে ছোট চাকরী আমার! এরকম ফ্ল্যাট কিনতে সারাজীবন লেগে যাবে—”
— “এহহ্! তোমারও যা কথা! ফ্ল্যাট কিনতে সারাজীবন লাগবে নাকি? এখন থেকে একটু একটু সেভিংস করলেই দেখবে ক’বছরের মধ্যেই এমন, না, এরচেয়েও ভালো একটা ফ্ল্যাট আমরা কিনে ফেলেছি। নিজেকে এতটাও ছোট ভেব না, বুঝলে?”
মাহাদ পুনরায় হাসলো। অনুর কথা সত্য, এখন থেকেই টাকা জমানোর চেষ্টা করলেই দেখা যাবে সত্যি সত্যিই ওরা একটা ফ্ল্যাট কিনে ফেলেছে! কিন্তু তার কি কোনো দরকার আছে?
বললো,
— “আমাদের ফ্ল্যাট কেনার কি প্রয়োজন, অনু? আমাদের তো বাড়ি আছেই। বাবা-মা নিয়ে আমরা তো সেখানেই সুখে থাকতে পারি।”
অনু চট করে ফিরে তাকালো,
— “কেন? মাহতাব ভাইয়া যে কিনলো? তার বেলা?”
— “সেটা তার ইচ্ছে। ওর অনেক টাকা! কি করবে — তাই ফ্ল্যাট কেনে, জমি কেনে! আমাদের অতো টাকা নেই। ফ্ল্যাট কেনার দরকারও নেই। তাছাড়া, ভাইয়ারা তো সামনের মাসেই শিফট্ হয়ে যাচ্ছে। তখন ও-বাড়ি তো শুধু আমরা থাকবো। বাবা-মা সহ।
আমরা বেরিয়ে আসলে ওরা বয়স্ক দুজন মানুষ তখন কি করবে একা একা? তাদের দেখতে হবে না?”
বুঝানোর অভিপ্রয়াসেই এতকিছু বললো। কিন্তু ওর সেই চেষ্টাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে উল্টো কথা ধরে টানলো অনু। হঠাৎ ক্ষেপে উঠলো,
— “ওও, তাদের দেখবার দায়িত্ব একমাত্র তোমার! তাদের জন্য আমার নিজস্ব কোনো শখ-আহ্লাদ থাকবে না? আমার নিজের সংসার হবে না? বড় ভাই তো ঠিকই মুলো দেখিয়ে বিদেয় হবেন। নিজের আখের তো গুছিয়েই নিয়েছে উনি। আর এখন হাদা পেয়েছে তোমাকে, তাই না?”
নয়ন জোড়া বিস্ফোরিত হলো ওর। প্রত্যুত্তরে কিছু একটা বলবে সে সুযোগটুকু অনু আর দিলো না ওকে। হনহন করে বেরিয়ে যাবার পূর্বে বলে গেল,
— “থাকো তুমি!”

ফ্ল্যাট দেখানোর পর মাহতাব সবাইকে নিয়ে একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকলো। দুপুরের খাওয়াটা এখানেই সারবে। পরিবারের সবাই এসেছে। সব মিলিয়ে বড়সড় বাহিনী। তিনটে টেবিল জোড়া লাগানো হলো তাদের খাতিরে। মধ্যমণি হয়ে বসলো মাহতাব-মাহিয়া। অনু আর মাহাদ বসলো পাশাপাশি। অর্ডার দেয়া হলো। কর্তৃপক্ষ জানালো খাবার আসতে সময় লাগবে কিছুক্ষণ। সেই সময়টায় ওরা গল্প মেতে উঠলো।
সবাই এটা-ওটা বলছে, হাসাহাসি করছে; কিন্তু এতসবের মধ্যে অনু কিংবা মাহাদ কেউই যোগ দিচ্ছে না। কেবল দু’ একবার হু হা করছে।

একটু আগে মাহাদের সঙ্গে চোটপাট করবার পর থেকে অনুর মেজাজ খারাপ। মুখটা তেঁতো হয়ে আছে। তারমধ্যে সামনে বসে আছে ন্যাকারানী মাহিয়া! কী ঢং করছে স্বামীকে নিয়ে! দেখেই আরও বেশি গা চিড়বিড় করছে ওর। মুখটা লালচে হয়ে আছে। বোঝাই যাচ্ছে, কোনোকিছু নিয়ে তীব্র ক্ষোভ পুষে রেখেছে ভেতরে। পাশ থেকে ব্যাপারটা খেয়াল করে মন উদাস হলো মাহাদের। সে আসলেই জানে না, তার কি করা উচিৎ! বিয়ের আগে কতোদিন তো ওরা প্রেম করলো, তখন ঘুণাক্ষরেও তো টের পায় নি এসব। তখনকার অনু আর এখনকার অনুর যে কী বিস্তর ফারাক! ভেবেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরোলো বুক চিরে।

খাবার এসে গেল আধা ঘণ্টার ভেতরেই। সবে খাবার মুখে তুলেছে, সেই মুহূর্তেই ফোনটা এলো মাহতাবের। কলটা রিসিভ করে সেখানেই কথা সারবার প্রয়াস করলো সে। কিন্তু হলো না। লাইনের ওপাশে থাকা ব্যক্তির কিছু কঠিন কথায় মাহতাবের মুখের রং পাল্টালো। সেও কঠিন স্বরে কিছু বললো। হাসি-ঠাট্টার আসরটা যেন হঠাৎ করেই থমথমে হয়ে উঠলো। কল কেটে গম্ভীর হয়ে বসে রইলো মাহতাব। ওর মা বললেন,
— “কি হয়েছে, বাবা? কে কল দিয়েছে?”
একপলক মাকে দেখলো, অতঃপর সবাইকে। বললো,
— “আমার একটু জরুরী কাজ আছে, আম্মু। আসছি।”
— “সে কি রে, হঠাৎ?”
প্রশ্নটা ঠোঁটের আগায় এসে গেলেও করা হলো না। কাউকে কিছু বলতে না দিয়েই ওয়ালেট নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটলো মাহতাব!

চলবে___

#মৌরিন_আহমেদ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে