#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_২১
দুপুরে খেয়ে একটু শুয়েছিল অনুলেখা। সাধারণত সে এসময় ঘুমোয় না। শুয়ে শুয়ে একটু ফেসবুক স্ক্রোল করে, ইউটিউব ঘাঁটে। আজ কেন যেন চোখ লেগে এসেছিল। নিদ্রা দেবীর কৃপায় অক্ষিপাতা জুড়ে নেমে এসেছিল শান্তিময় ঘুম!
অনুর সেই সুখ বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। গাঢ় সুপ্তির পুরু আস্তর খুব শীঘ্রই ক্ষয় হতে লাগলো কানের কাছে ক্যাচ-ম্যাচ শব্দ শুনে। হালকা হতে হতে একসময় পুরোপুরি ঘোর কেটে গেল ওর। বিরক্ত চোখ কচলে হাই তুলতে তুলতে শয্যা ছাড়লো অনু। আলগা করে চাপিয়ে দেয়া দরজার ওপাশে পোর্চ থেকে আলোর রেখা আসছে। মেহমান এসেছে বোধ হয়, ভাবলো অনু। আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বিছানা থেকে নামল।
ফ্রেশ হয়ে ঘর থেকে বেরোতেই অনু দেখতে পেল বসবার ঘরে কিছু মানুষজনের সমাগম। কলহাস্যে মুখরিত সভা। ভালো করে চেয়ে দেখলো, সবাই অপরিচিত ওর। একমাত্র সমাগমের মধ্যমণি মাহিয়া ছাড়া। অনু দাড়িয়ে থাকতে থাকতেই কোত্থেকে ওর শাশুড়ি চলে এলেন। ছোট বৌকে ডাকলেন সাদরে,
— “বৌমা, এসো এসো। বেয়াই – বেয়াইনের সাথে পরিচিত হও। আরে, মাহিয়ার বাবা – মা এসেছে তো!”
অনু এতক্ষণ চুপচাপ দাড়িয়ে থেকে দেখছিল সব। এবারে বুঝলো মাহিয়ার এতো হাসিখুশি ভাবের কারণ। বাপের বাড়ি থেকে লোক এসেছে! হুহ, মনে মনে ভেংচি কাটলো। পরক্ষণেই ধ্যান ভাঙলো শাশুড়ির ডাকে,
— “কই? এলে না যে?”
মনে মনে বিরক্ত হলেও শান্ত হয়ে এগিয়ে এলো অনু। বসলো গিয়ে ওদের সামনে।
___
বিকেলবেলা। ফোনের ওপাশে নিখিলের সঙ্গে মৃদু স্বরে আলাপ করছে চারুলতা। টুকটাক গল্প শেষে কল কাটবার আগমুহূর্তে বললো,
— “রাখছি তবে…”
তৎক্ষণাৎ নিখিলের মন খারাপের গলা,
— “এতো জলদিই? তাড়া আছে কোনো? কোনো জরুরি কাজ?”
চারু ইতস্তত করে,
— “না, তেমন কোনো কাজ নেই। তবে…”
— “আমার সঙ্গে আর কথা বলতে ভালোলাগছে না? আমি প্রচুর কথা বলি, তাই?”
দাঁত দিয়ে জিভ কামড়ে ধরলো। ইসস, লোকটা বুঝে ফেললো? ভীষণ লজ্জিত হলো চারু। সত্যিই সে একটু-আধটু বিরক্ত বোধ করছিল। নিখিল আসলেই প্রচুর কথা বলে!
কিন্তু ওর এই ছোট্ট কথাতে লোকটা জেনে ফেললো কি করে?
বললো,
— “না, আসলে…”
নিখিল সহাস্যে জানালো,
— “আমি বোকা নই, চারুলতা। কিংবা সহজে রাগ করবার মানুষও নই। আপনি আমাকে যতটুকু সময় দিবেন আমি ততটুকুতেই খুশি। আর তাছাড়া সম্পর্কের এখনো শুরুই হয় নি। যেদিন পূর্ণ অধিকার পাবো, সেদিন আপনি যতই বিরক্ত হোন না কেন ঠেসে ধরে বসিয়ে রাখবো। কোলের উপর বসিয়ে কানের কাছে ইচ্ছেমত বকবক করবো। কিচ্ছু বলতে পারবেন না!”
ওর বলবার ঢং দেখে হেসে ফেললো চারু। নিজেও ততোধিক রসিয়ে বললো,
— “মুখের ভেতর আলু ঠুসে দেব না!”
বলেই আবার হাসি। নিখিলও এবার হো হো করে হেসে উঠলো।
নিখিল কল কাটবার পর ফোনটা পাশে রেখে দিলো চারু। বিছানায় আধশোয়া হয়ে আছে সে, বাঁ পাশে খোলা জানালা। চোখ ঘুরিয়ে তাকালে দূরের নীল অন্তরীক্ষ খুব সুন্দর ভাবে দেখা যায়। চারু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো সেদিকে। ধূসর মেঘগুলো পেঁজা তুলোর একটু একটু করে ছড়িয়ে, সুদূরে তপন মশাইকে ঢেকে লুকোচুরি খেলছে যেন। মুগ্ধ চোখে চেয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ পুরনো কথা মনে হলো ওর। আড়াই বছর আগের, তার সেই বিবাহিত জীবনের দিনগুলো…
মাহতাবের ঘরেও এরকম একটা জানালা ছিল দক্ষিণ দিকে। জানালা সংলগ্ন হয়ে বিছানা। চারু রোজ ঘুম থেকে উঠে কিছুক্ষণ ওই জানালা দিয়ে চেয়ে থাকতো। দৃষ্টি ন্যস্ত করতো গগনমানে। মন তখনো থাকতো অদ্ভুৎ বিষাদময়!
বিয়ের পর ও-বাড়িতে গিয়ে একটুও ভালো লাগে নি ওর। একদম অপরিচিত একটা জায়গা। অপরিচিত মানুষজন। সবাইকে মানিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছিল। সবচেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছিল মাহতাবকে মানতে। লোকটা যেন কেমন!
একটুও সময় দেয় নি তাকে। কবুল বলে যেই না বিয়েটা হলো, অমনই সমস্ত অধিকার চেয়ে বসলো? ভালো করে মিশবার আগেই তার থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল চারু। লোকটা তাকে কি যে ভাবত!
‘আমার নীল শাড়ি পছন্দ, তুমি নীল পরবে। কমলা আমার একটুও পছন্দ নয়। কক্ষণো পরবে না!’ —অথচ চারুর নীল রঙ ভালো লাগতো না, কমলা ছিল প্রিয়!
চিংড়িতে মাহতাবের এলার্জি, বিবাহিত জীবনের ক’ মাস চারু বোধ চিংড়ি ছুঁয়েও দেখে নি। খুঁজতে গেলে এরকম আরো কতো গল্প বের হবে!
মাহতাব খুব ব্যস্ত মানুষ। উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। স্বভাবতই সে ব্যস্ত। সপ্তাহের ছুটির দিনগুলোতেও কীভাবে কীভাবে যেন তার স্ক্যাজিউল পড়ে যেত। বৌকে নিয়ে ঘুরবে কথা দিয়েও, শেষ মুহূর্তে সব ছেড়ে সে ফিল্ডে ছুটতো। হুট করে পাওয়া ছুটিগুলোতেও সে নিজের মতো প্ল্যানিং করত বেরোবার। চারুকে হয় তো সারপ্রাইজ দিতেই এমন করতো। কিন্তু কখনো চারু কোথায় যেতে ইচ্ছুক বা অনাগ্রহী — সে মতটুকু নিতে প্রয়োজন বোধ করে নি।
শরীরের টানে একে – অপরের কাছাকাছি ওরা বহুবার গিয়েছে; কিন্তু মনের টানে কোনদিন গিয়ে এসেছিল সংস্পর্শে?
প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরোলো বুক চিড়ে।
একই ছাদের নিচে থেকেও বহুদিন যেন লোকটা ওর অচেনাই ছিল। হয় তো সেও অচেনা ছিল মাহতাবের কাছে।
ধীরে-ধীরে যখন সব চেনা হয়ে গেল, তখন চারু তার পরিবারের করা ভুলটা বুঝতে পারলো। বড় বড় পাশ দিয়ে ডিগ্রি নিলেই কেউ শিক্ষিত হয়ে যায় না। শিক্ষা অন্তরের ব্যাপার। যা সবাই পাশ করেও অর্জন করতে সক্ষম হয় না!
হঠাৎ দরজায় টুকটুক শব্দে ধ্যান ভাঙলো চারুর। কপোলে অনুভব করলো নোনা জলের। হাতের উল্টো পিঠে অশ্রু মোচন করতে করতে পেছনে ঘুরলো সে, ভেজা গলায় শুধালো,
— “কে?”
— “বড়’পা, আসবো?”
একসঙ্গে দুটি কণ্ঠস্বর। চারু শুনলো, ছোট ভাইদের গলা। রিংকু – টিংকু এসেছে। গত দুদিন ধরেই ওর আশেপাশে ঘুরঘুর করছে এরা। চারু ইচ্ছে করেই এড়িয়ে গেছে। একটু সাজা দেয়া দরকার! যা বিচ্ছু হচ্ছে!
চোখ দুটো পুনরায় ভালো করে মুছে নিলো চারু। হালকা কেশে গলা ঝেড়ে ডাকলো,
— “আয়।”
সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে গেল। অনুমতি পেয়ে সুরসুর করে ভেতরে প্রবেশ করলো জমজ দ্বয়। মুখ নিচু করে, অপরাধী ন্যায় দুজনে এগিয়ে এলো বড় বোনের কাছে। ওদের এই চুপসানো চেহারা দেখে ভেতরে ভেতরে হাসি ঠিকরে বেরোতে চাইলেও, নিজেকে যথাসম্ভব গাম্ভীর্যের খোলসে মুড়িয়ে চারু বললো,
— “কি চাই?”
— “তোমার কাছে একটু বসবো, আপা?”
কি করুণ শোনালো টিংকুর গলাটা। চারু রাগ করে কিছু বলতে চাইলো, কিন্তু ভাইয়ের মুখ দেখে আর বলা হলো না। আবদার রাখলো,
— “বস্।”
দু’ জনে উঠে বসলো ওর পাশে। মিনমিন করে জড়িয়ে ধরতে চাইলো ওকে। মুখ ঘুরিয়ে কপট রাগ দেখালো চারু,
— “অতো ঢং কীসের? অকারণে জড়াজড়ি ভালো লাগে না আমার!”
— “তুমি এখনো রেগে আছো?”
কণ্ঠের স্বর খাদে নামিয়ে শুধায় টিংকু।
— “আমি কে, যে রাগ করবো? আমাকে কেউ ভালোবাসে? না আলাদা করে গুরুত্ব দেয়?”
অভিমানি ভঙ্গিতে কথাগুলো বলছিল চারু। মুখ থেকে ধ্বনি নিঃসৃত হতে না হতেই হঠাৎ দু’ ভাই জাপটে ধরলো ওকে। দু’জনে দু’হাত আঁকড়ে ছোট্ট আদুরে বাচ্চা ছেলের মত মাফ চাইলো তাদের বড় বোনের কাছে,
— “স্যরি, আপা। খুব খুব খুব স্যরি। তুমি প্লিজ রাগ করে থেকো না! প্লিজ, আপা!”
চারু গলে মোম তখন! আর রাগ করে থাকা যায় যায়? সেও দু’ বাহু প্রসারিত করে দুজনকে আগলে নিলো। আদুরে স্বরে বললো,
— “দুষ্টুমি ভালো, ভাইয়া। কিন্তু সেটা অতিরিক্ত করতে গিয়ে বেয়াদবির পর্যায়ে যাওয়া ভালো নয়। আশা করি পরের বার এমন হবে না!”
— “আর হবে না, আপা। আর হবে না!”
অস্পষ্ট স্বরে আওড়ায়। চারু শান্তির শ্বাস ছাড়ে। এদেরকে সে ভীষণ ভালোবাসে, শাসন করতে তারও বুকে লাগে! কিন্তু বাচ্চাদের শাসন না করলে কি হয়?
__
ক্যান্টিনে আজ কেন যেন ভীড় খুব। সচারচর এমন হয় না। ছোট্ট ক্যান্টিনটা ফাঁকাই থাকে। আজ হঠাৎ এতো মানুষ কোত্থেকে উদয় হলো ভেবে পেল না সৌভিক। এদিক – সেদিক তাকিয়ে ফাঁকা টেবিলের সন্ধান করলো। একটা যদি থাকতো!
সবগুলোতে লোকে ভর্তি। মাত্র দু’টো টেবিলে জায়গা আছে বসবার। তাও একটাতে এক দম্পতি বসেছেন, অন্যটাতে একটা মেয়ে। সৌভিক কোথায় বসবে? দম্পতির কাছে বসায় মন সায় দিচ্ছিল না। অগত্যা নাশতার প্লেট হাতে মেয়েটির টেবিলের কাছেই এগোলো।
মেয়েটি পেছনে ফিরে বসেছে। খোলা রেশম চুলগুলো এলোমেলো ভাবে ছড়ানো। ‘এভাবে এরা কাজ করে কি করে? বিরক্ত হয় না? চুল বাঁধলে কি ক্ষতি?’– ভাবনাটা সৌভিকের মনে আসার কথা নয়। তবুও এসে গেল। সে কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে সামনে এসে দাড়ালো মেয়েটির, দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বললো,
— “মিস, এখানে বসা যাবে? কেউ আছে এখানে? আমি আসলে জায়গা পাচ্ছিলাম না…”
বলতে বলতেই মেয়েটা চকিতে মুখ তুলে তাকালো। ওকে দেখে এমন ভাব করলো যেন, লহমার কোনো জাদুকর চিল্লিয়ে ‘স্ট্যাচু’ বলে মূর্তি বানিয়ে দিয়েছে তাকে। অপলক চেয়ে রইলো মুহূর্তগুলো। হাতে সসের বোতল ছিল, পেটিসে ঢালছিল; প্রয়োজনের অতিরিক্ত হওয়ায় উপচেও পড়লো — সেটা মেয়েটা খেয়াল না করলেও সৌভিকের অগোচর রইলো না!
সে বিরক্ত মুখে সামনে বসা মূর্তি আনিকা’র উদ্দেশ্যে বললো,
— “কি হলো? অমন করে চেয়ে আছেন কেন? বসবো আমি?”
চটকা ভাঙলো আনিকার। তড়িঘড়ি করে সসের বোতল রাখতে রাখতে বললো,
— “জ্বি, স্যার। জ্বি, স্যার আপনি বসুন। আমি যাই।”
— “আপনাকে যেতে হবে না, খাচ্ছেন খান। আমি বরং একটু বসি।”
মেয়েটার বিনয় দেখে বলতে বাধ্য হলো সৌভিক।
কিন্তু আনিকা নামক এলোমেলো টlর্নেlডো থামলো না।
— “না, না, স্যার। আমি উঠছি।”
বলতে বলতে সে হন্তদন্ত হয়ে উঠতে গিয়ে চেয়ারের সঙ্গে হোঁচট খেল, প্যাঁচ প্যাঁচ করে ওড়না ফাঁড়লো। শব্দে ভ্রু কুঁচকে সৌভিকসহ অনেকেই ফিরে তাকাতেই জিভ কামড়ে টেবিল থেকে ব্যাগ তুলতে গিয়ে প্লেটের উপর থেকে একটা সিঙারা, পাশের পানির বোতল উল্টে ফেলে দিলো!
এই মেয়ের কাণ্ড দেখে এবার বেশ রাগ হলো ওর। চেঁচিয়ে উঠলো প্রায়,
— “এ্যাই, আপনি বসুন তো। এতো কিসের তাড়া আপনার? ট্রেন ছুটে যাচ্ছে?”
ধমকে চুপসে গেল মেয়েটা। তৎক্ষণাৎ মাথা নিচু করে ফেললো। অস্ফুট স্বরে বলবার চেষ্টা করলো,
— “না, মানে…”
— “কীসের ‘না, মানে’? বসেন বলছি, এক্ষুণি বসেন!”
চিৎকার করে উঠলো সৌভিক। আশেপাশে দৃষ্টি ফেলে ত্বরিতে বসে পড়লো আনিকা। ইসস, কতগুলো মানুষের সামনে লজ্জা!
একটু সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলো সৌভিক। নিচু গলায় বললো,
— “আপনি আমাকে এত ভয় পান কেন? আমি কি বাlঘ – ভাlল্লুlক যে আপনাকে খেয়ে ফেলবো?”
আনিকা ভীতু হরিণীর ন্যায় করুণ চোখে তাকালো। লজ্জায় নুইয়ে গিয়ে কোনোমতে বললো,
— “আপনি অনেক রাগী!”
বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেল সৌভিক। সে এই মেয়েকে রাগ করলো কখন? আশ্চর্য!
চলবে___
#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_২২
রান্নাঘর থেকে খুঁট-খাঁট শব্দ আসছে। অত্যন্ত বিরক্ত মুখে এক ধারছে কাজ করছে অনু। তার মেজাজের পারদ চড়চড় করে বাড়ছে। সেই মেজাজ কাঙ্খিত জায়গায় দেখাতে না পেরে রান্নাঘরের থালা – বাটির উপর তুফানি ঝড় তুলছে সে।
গতকাল বিকেলে মাহতাবের শ্বশুর-শাশুড়ি, তার একমাত্র শ্যালক- শ্যালক স্ত্রী এসেছে। সঙ্গে এসেছে মাহিয়ার এক হাড়ে বজ্জাত ভাইঝি। ছোট ভাইয়ের তিন বছরের বাচ্চা, অথচ কাজ কারবার কি ডা-কা-ত মার্কা! কাল রাতের খাবার খাওয়ার সময় সবাই যখন খাবার ঘরে, ওই বদমাইশ পিচ্চি তখন হানা দিয়েছিল ওর ঘরে। ড্রেসিং টেবিলে রাখা অর সমস্ত সাজগোজের জিনিসপত্র এলোমেলো করেছে। বডি লোশন ফেলেছে বিছানার চাদরে। তেলের বোতলের মুখ খুলে সবটা উল্টে দিয়েছে মেঝেতে। ওর দামী দামী লিপস্টিকের স্টিক ভেঙে গায়ে – হাতে ল্যাপ্টেছে, ফাউন্ডেশন, শ্যাডোর বক্স নাগাল পায় নি বোধ হয়, উপর থেকে ফেলে গুড়ো গুড়ো করেছে!
সব গুছিয়ে ক্লান্ত শরীর নিয়ে অনু যখন ঘরে ফিরলো তখন সেই দlস্যু মার্কা বাচ্চা মনের সুখের পাউডার মাখছে মেঝেতে বসে!
রাগে সারা গা জ্বলে উঠেছিল ওর। এতো সাধের, ভালোবাসার ওই জিনিসগুলো। কতো আহ্লাদ করে, যত্ন করে মাহাদ একেকটা জিনিস ওকে গিফট করেছিল!
কিন্তু কিছু বলবার নেই। অনুর এতবড় ক্ষতি করেও বাচ্চাটা পার পেয়ে গেল আরামসে!
বাপের বাড়ির লোকজন দেখে মাহিয়া কাল থেকেই বেশ ফুরফুরে। এমনিতেই প্রেগন্যান্সি পিরিয়ড চলছে, বাড়িতে তার খাতিরের অভাব নেই। এখন বাড়তি হিসেবে বাপের বাড়ির গোষ্ঠী পেয়ে তার ভাব এখন চাঙে!
আগে তাও সকালে রান্নাঘরে একটু ঢুঁ মারতো। দু’ একটা কাজে সাহায্য করতো। কিন্তু আজ যেই দেখেছে, বাড়ি-ভর্তি লোকজন, অমনি তার ঢং শুরু হয়েছে। ‘এখানে ব্যথা – সেখানে ব্যথা! ইসস, ন্যাকা! তোর কাহিনী যেন বুঝি না আমি?’– ভেঙচি কাটলো অনু। ঘসঘস করে গত রাতের এঁটো বাসনগুলো ধুচ্ছে আর বিড়বিড় করছে,
— “নিজের চোদ্দো গুষ্ঠি এসেছে, কোথায় রান্নাঘরে এসে দেখবে কি কি করা লাগবে, তা না! নিজে ঠ্যাংয়ের উপর ঠ্যাং তুলে অর্ডার করছে, ‘আমার বাবা – মা এসেছে, ছোট বৌ ভালো করে রেঁধ। মা কিন্তু ইলিশের পাতুরি খুব পছন্দ করে। কালকের ইলিশটার পাতুরি করো! স্বাদ লাগবে!’ — কেন রে? এতোই যখন তোর দরদ, তখন নিজে রাঁধতে পারিস না? নিজে রেঁধে ইচ্ছে মত খাওয়া। কে মানা করেছে? অন্যের উপর কাজ চাপাস কেন রে, শlয়তান বেটি? আমি কি তোর কাজের লোক? আমার কীসের অত ঠ্যাকা?”
‘কাজের লোক’ প্রসঙ্গ উঠতেই আরও বেশি বিরক্ত হলো অনু। বেলা এগারোটা বাজছে প্রায়, এখনো সেই কাজের মেয়ের আসবার নাম নেই। আজকালকার কাজের মেয়েগুলোও না!
একেকটার জমিদারি চালচলন! ইসস!
ওর ভাবনার মাঝেই হুড়মুড় করে ভেতরে প্রবেশ করলো ফুলি। এ বাড়ির কাজের মেয়েটা।
অনু ফিরে তাকালো ওর দিকে। কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
— “এতদেরি হলো কেন তোর?”
আঁচল দিয়ে মুখ – কপালের ঘাম মুছতে মুছতে ফুলির সেই রোজকার একঘেঁয়ে জবাব,
— “মেলাক্ষণ দাড়ায় থাইক্যা রিসকা পাই নাই। যখন রিসকায় চরছি, সেইসম রাস্তায় জ্যাম আছিল। বাইরে যেই চিক্কুর দিয়া রোইদটা উডছে—”
— “রোজই তোর রাস্তায় জ্যাম থাকে, তাই না?”
রাগ দেখিয়ে বললো অনু। হাতের প্লেটটা শব্দ করে রাখলো সিঙ্কের পাশে। ফুলি হয় তো সহজ করেই উত্তর দিত, কিন্তু অনুর রাগটা টের পেয়েই আরও বেশি ত্যাড়ামি করলো,
— “আপনের কি মনে হয়, আমি ফুলি মিথ্যা কইছি? আমি মিথ্যা কওনের মানুষ? আমার দাদা কেডা আছিল আপনি জানেন? শেখ ফরিদউদ্দিন বখশ, মাইনষে তারে কইত জিন্দা পীর। জিন্দা পীরের নাতনি হইয়া আমি মিথ্যা কমু? এতবড় কথা কইলেন? এই বাড়িত আমি কাজ করুম না। ছাইড়া দিমু। দিমু ক্যান, দিছি। যহন আপনি কইছেন আমি মিথ্যা—”
ফুলির লম্বা লেকচার আর বংশ গৌরবের কথা শুনতে ইচ্ছে করছে না। অন্য সময় হলে সে ঠাস করে ওর গালে চর বিষয়ে দিতে দু বার ভাবত না। কিন্তু এখন বাড়ি ভর্তি মেহমানের সামনে কোনো তামাশা করতে মন চাইলো না। ত্যক্ত গলায় বললো,
— “তুই দয়া করে চুপ কর, ফুলি। অসহ্য লাগছে!”
— “অসহ্য? কীসের অসহ্য? আমি কইছি না কাজ ছাড়ছি? এখন আপনের অসহ্য লাগলেও আমি শুনুম ক্যান? আমি কমুই…”
ফুলি বলে চলেছে। ধীরে ধীরে তার গলার স্বরের তীক্ষ্ণতা বাড়ছে। আস্তে আস্তে চেঁচিয়ে উঠছে সে। অনুর অস্থির লাগতে শুরু হলো। সে সারাজীবন নিজের বাড়ির রাণী হয়ে ছিল। বড় আপা ও বাড়ির রাজ কুমারী, সবার ‘চোখের মণি’ ছিল বটে, তার সব কথা সবাই শুনত। কিন্তু সেও কোনো অংশে কম ছিল না। তার কথা কেউ শুনত না বলেই নিজেকে স্বেচ্ছাচারী করে গড়ে নিয়েছিল। রাজ্যের স্বেচ্ছাচারী রাণীর মতো অধীনস্তের উপরে হুকুমদারি চালাত। সেই অনুকে কোথাকার কোন ‘ফুলি’, কোন জিন্দা পীরের নাতনি; এতো কথা শুনাবে?
আর অনু চুপচাপ দেখবে? তাই হয়?
তবুও সে ধৈর্য রেখেছিল। নিজের বাড়িতে গত বাইশ বছর ধরে যা করে নি, তাই করেছে। ঠাণ্ডা মাথায় নিষেধ করেছে ফুলিকে। চুপ করতে বলেছে। এখনো শোনে নি সে। ও রাগবে না?
গতকাল সন্ধ্যা থেকে জমা একটু একটু বিরক্তি-রাগ, আজকের সকালে ফুলির এই বয়ান শুনবার পর সব একসঙ্গে ক্রোধের আগুনের মত মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো।
আর সইতে না পেরে ঠাস ঠাস করে ফুলির দু’ গালে দুটো চড় মেরে দিল অনু।
ফুলি হতবাক, হতবিহ্বল!
অবিশ্বাস্য চোখে অনুর রাগান্বিত লালচে মুখের দিকে চেয়ে থাকতে হঠাৎ চিৎকার দিয়ে রোদন শুরু করলো। যে গগনবিদারি চিৎকারে বাড়ির সবাই ছুটে এলো এক লহমায়। এমনকি অসুস্থ মাহিয়াও!
___
সকালে নিখিলের কল করবার কথা ছিল। কিন্তু কোনো ব্যস্ততায় শেষ পর্যন্ত কলটা আর আসে নি চারুর ফোনে। তাই মনটা একটু উদাসই ছিল ওর। নিখিলের সময়ের অনেক দাম সে জানে। কর্পোরেট দুনিয়ার মানুষ, এদের তো দম ফেলারও জো নেই!
বাইরে থেকে লোকে দেখে তাচ্ছিল্য হেসে উক্তি করে, ‘কি যে ওদের ব্যস্ততা! অফিসের এসির নিচে সারাদিন বসে বসে ওইতো কয়টা কাগজে সই করে, ঘটঘট করে কম্পিউটারের কি-বোর্ড চেপে কতগুলো টাইপ করে, এ আর এমন কি—” কিন্তু যে মানুষগুলো ওখানে বসে তথাকথিত এসির হাওয়া খেতে খেতে ক’টা কাগজে কলম চালায় ওরাই জানে, মাথা খাটিয়ে এই সেক্টরে টিকে থাকার যুlদ্ধটা কেমন!
আমরা তো বাইরেরটাই দেখি। কারো চাকচিক্য দেখেই চোখ ঘুরিয়ে বাঁকা মন্তব্য করি। অথচ ভেতরে যে কী চলে কখনোই জানতে চাই না। রিকশা ওয়ালার কাছে বড় অফিসের কর্মকর্তাদের দেখে মনে হয় কোনো কাজই করে না। অফিস ওয়ালাদের আবার এর বিপরীত ধ্যান-ধারণা। অথচ কোনো কাজই যে এত সহজ নয়, হাড় ভাঙা পরিশ্রম যে সবটাতেই আছে এটা আমরা বুঝেও যেন বুঝি না। সবসময়ই নিজেরটা বুঝি। ভাবি, ‘আমারটাই বড় কষ্ট, এমন কষ্ট কেউ কোনদিন করে নাই, ভবিষ্যতেও করবে না।’ কিন্তু এরচেয়েও বড় কষ্টে মানুষ থাকে আমরা ভাবি না!
কারণ ওসব ভেবে আমাদের লাভ নেই।
দুপুরে অফিসের লাঞ্চ ব্রেকে নিখিল কল করলো চারুকে। এখন চারুও ব্যস্ত ছিল, কিন্তু সব ফেলে রেখে সে ফোনের কাছে ছুটলো। নিখিল নওশাদ কল করেছে যে!
রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো নিখিলের ক্লান্ত কণ্ঠস্বর,
— “কি করছেন চারু?”
— “তেমন কিছু না। চাচিদের সঙ্গে একটু রান্নায় সাহায্য করছিলাম।”
— “শুধু সাহায্যই করেন? রাঁধেন না কখনো? রান্না পারেন তো?”
একটু দুষ্টুমি করে বললো নিখিল। চারুও হয় তো মজার ছলেই বলতে উদ্যত হয়েছে, কিন্তু হঠাৎ অপ্রিয় প্রসঙ্গটা চলে এলো,
— “এতো ঠুনকো ভাববেন না, মশাই। ভর্তা থেকে ভাজি, পুডিং থেকে কাচ্চি — সমস্তই আমার নখদর্পণে আছে! আপনি হয় তো ভুলে গেছেন আমি বিবাহিত জীবন পার করে এসেছি বহুদিনের। শ্বশুরবাড়ির সবাই এই রান্না খেয়ে আঙুল অবধি চেটে তুলতো—”
বলেই মুখের হাসিটা বিলীন হলো ওর। কথায় পুরোনো প্রসঙ্গ কোনদিন নিখিল টানে না। এমনকি অতীত নিয়ে একটা প্রশ্নও আজ পর্যন্ত করে নি সে। চারুও এড়িয়ে গেছে, যায় সব। কিন্তু তবুও!
চারুকে আপসেট হতে দিলো না নিখিল। হেসে বললো,
— “আচ্ছা, দেখা যাবে! আপনার হবু শাশুড়ি মিসেস. নাজিয়া নিলুফার কিন্তু সেরা রাঁধুনি। টেলিভিশনের প্রোগ্রামে গিয়ে মাস্টার শেফ হয়ে এসেছে। তাকে যদি রেঁধে খাইয়ে সন্তুষ্টি করতে পারেন— তো ভাবা যাবে। পাশ দিলেও দিতে পারি।”
ওর বলবার ভঙ্গিমায় চেয়েও আর মন খারাপ করা হলো না ওর। ততোধিক রসিয়ে শুধালো,
— “পাশ করলে কি দিবেন? সে বলুন আগে, নয় পরীক্ষা দিয়ে লাভ কি!”
— “দিবো না হয় কিছু। কেন সমস্যা?”
— “সমস্যা নয়? বলছেন কি? আমি এতো কষ্ট করে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করবো, আর আপনি যদি রেজাল্টের সময় শুকনো মুখে ‘অভিনন্দন’ বলেন, তা তো হবে না! এতবড় লস হবে আমার—”
চারুর আহাজারি শুনে ফিক করে হেসে উঠলো। ভাগ্যিস বন্ধ কেবিন। নয় তো ওর বেসামাল হাসির তোরে আশেপাশের সবাই কাজ ফেলে অবাক চোখে দেখত ওকে!
হাসি থামিয়ে বললো,
— “আপনার লস হবে না, ম্যাডাম। বরং আমি লোকসান করিয়ে হলেও আপনাকে সবচেয়ে দামী গিফট্ দেব। প্রমিজ!”
চারু মাথা নাড়লো। আনমনে বিড়বিড় করে বললো,
“আপনি শুধু আমায় ভালোবাসুন, নিখিল। পৃথিবীতে এরচেয়ে বড় গিফট্ আর হতে পারে না!”
___
দরজায় কড়া নাড়তেই অনুমতি দিলো সৌভিক। গুটিগুটি পায়ে ভেতরে এসে প্রবেশ করলো আনিকা। হাতে কয়েকটা ফাইল। সেগুলো সৌভিকের টেবিলে দিয়ে, সন্তর্পণে সরে দাড়িয়ে বললো,
— “ফাইল গুলো একটু চেক করে দিন, স্যার। এমডি স্যার এই ফাইলগুলো আজকের মধ্যে কমপ্লিট করতে বলেছেন।”
মুখ তুলে তাকালো সৌভিক। টেবিলের অপর প্রান্তে দাড়ানো আনিকা। অনেকটা জবুথবু হয়ে। ওর কপাল কুঁচকে এলো। মেয়েটা ওকে বেশ ভয় পায় ও জানে। এই নিয়ে গতকাল প্রশ্ন করায় সে নির্দ্বিধায় জানিয়েছে, ‘সৌভিক অনেক রাগী!’
শুনে তাজ্জব বনে গিয়েছিল সে। রাগী তাও সৌভিক? কদিনের পরিচয়ে এই মেয়ে তাকে উগ্র মেজাজী বলে দিলো? অথচ নিজের সমগ্র জীবনে এই কথা কোনদিনও শোনে নি সে। পরিবারের বাধ্য ছেলে, কখনো কারো সঙ্গে উচ্চবাচ্য করে না। দশবার গুঁতোলেও যে একবার ছোট্ট করে নিষেধ করে, সে কি-না রাগীর তকমা পেল! তাকে দেখে নাকি এই মেয়ে কাঁপাকাঁপি করে! কি আশ্চর্য!
অবশ্য ক’টা দিন ওর মন-মেজাজ ভালো ছিল না। তখন সবকিছুতে একটু বিরক্তি এসে গিয়েছিল ওর। একথা অস্বীকার করবার উপায় নেই। কিন্তু তাই বলে সে তো আনিকাকে অকারণে ধমকায় নি। মেয়েটা বোকামি না করলে—
সৌভিক শ্বাস ফেলে ফাইলগুলো হাতে নিল। ভালো করে চেক করলো। নাহ্, উন্নতি হয়েছে মেয়েটার। ভুল তেমন চোখে পড়লো না। সাইন করে দিলো চটপট।
কাজ হয়ে যাওয়ায় হাসি মুখে বেরিয়ে যাচ্ছিল আনিকা। হঠাৎ কি মনে করে পিছু ডাকলো সৌভিক,
— “আনিকা শুনুন?”
চকিতে ফিরে তাকালো মেয়েটা। নিমিষেই হাসি মুখে নেমে এলো ভয়ের ছায়া,
— “কিছু বলবেন, স্যার?”
কি বলবে সৌভিক? মেয়েটা তার ডাক শুনেই কেমন ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকায়। কিছু বললে, জ্ঞান হারাবে না কে গ্যারান্টি দিবে?
তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
— “আপনি আমাকে অকারণে ভয় পাওয়া বন্ধ করুন, প্লিজ। আমি বাঘ – ভালুক নই। নেহাৎ ছা-পোষা কর্মজীবী মানুষ। জুনিয়র হিসেবে আপনাকে কিছু কাজ শিখানোর দায়িত্ব পড়েছে কাঁধে। তাই করতে গিয়ে, বিরক্ত হয়ে ধমকেছি। সেজন্যে এমন ভয় পাওয়ার কারণ নেই।”
বলেই থেমে পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ওর উপর। নিশ্চিন্ত হতে জিজ্ঞেস করলো,
— “বুঝেছেন?”
— “হু।”
— “এবার যান।”
— “হু।”
ছাড়া পেয়েই ডানা ঝাপটানো পাখির মতো ছটফটিয়ে উঠলো আনিকা। এতক্ষণ যেন বাঘের খাঁচায় ছিল। মুক্তি মিলতেই হুড়মুড় করে বেড়িয়ে যেতে গিয়ে দরজার সাথে বাড়ি খেয়ে উল্টে পড়লো মেঝেতে। বিকট এক‘ধপাস’ শব্দ করে পড়ে গেল নিচে!
কপালে হাত ঘষে ক্রোধ দমনের দোয়া করলো সৌভিক,
–“আল্লাহ্, এই মেয়েকে সহ্য করবার ক্ষমতা দাও আমায়!”
চলবে___
#মৌরিন_আহমেদ