#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_১৭
কলিং বেল বাজতেই দরজা খুলে দিলেন নিলুফার নাজিয়া। আর ঠিক সঙ্গে সঙ্গেই তাকে জাপটে ধরলো কেউ। উচ্ছাসে চেঁচিয়ে উঠলো প্রায়,
— “আসসালামু আলাইকুম, আম্মি।”
ছেলেকে দেখে ভীষণ রকমের খুশি হলেন নাজিয়া। একটু অবাকও। কারণ ছেলে যে ফিরবে সে কথা আগে জানায় নি তাকে। ওর তো আসবার কথা ছিল আগামীকাল। আজ হঠাৎ?
মাকে ছেড়ে চমৎকার হাসলো নিখিল,
— “আম্মি তুমি কিন্তু এ-কয়দিনে আরও বেশি সুন্দর হয়ে গেছ! সুইট লাগছে খুব!”
— “আর তুমি? তুমি কিন্তু শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছ, নিখিল। তোমার বন্ধুর বাড়িতে বোধ হয় তোমায় খেতেই দেয় নি!”
নাজিয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যুত্তর। নিখিল হেসে বললো,
— “চোখে ভুলভাল দেখছ। আমার শরীর ঠিকই আছে। বরং বলো, আমি মোটা হয়েছি। সৌভিকের বোনের বিয়ে ছিল না? কব্জি ডুবিয়ে খেয়েছি। ওজন বেড়ে গেছে আমার!”
জুতো খুলে ব্যাগ-পত্র নিয়ে ভেতরে ঢুকলো নিখিল। তারপর টুকটাক কথা হলো। নাজিয়া ছেলের খাবার দিতে চাইলেন। জিজ্ঞেস করলেন,
— “যা হাতমুখ ধুয়ে নে। তারপর ডাইন ইনে আয়। কি খাবি বলে যা। ভাত রাঁধি নি। রুটি করেছিলাম আমার জন্য। তুই আসবি জানতাম না তো…”
— “কোনো সমস্যা নেই, আম্মি। আমি এখন কিছু খাবো না। বাস থেকে নেমেই হোটেলে খেয়েছিলাম। এখন ঘুমাবো।”
বলেই নিজের ঘরের দিকে এগোয়। নাজিয়া ছেলের পিছু পিছু ছোটেন,
— “সে কি রে? হোটেলে খেলেই হলো নাকি? কিসব বাসি তেল-তুল দিয়ে রাঁধে ওরা…”
— “একদিন না খেলে কিচ্ছু হয় না। আমার ঘুম পাচ্ছে। গেলাম!”
ব্যস! আর কোনো কিছু না বলেই ঘরে চলে গেল। নাজিয়া বেশি জোর করলেন না। ছেলেকে কখনো কোনকিছুতে তিনি জোর করেন না। তাতে একটু স্বাধীনচেতা ধাঁচের হয়েছে বটে, কিন্তু সেচ্ছাচারি নয়। বোধশক্তি যথেষ্ট আছে!
ফ্রেশ হয়ে এসেই নিখিলের সর্বপ্রথম যে নামটি মনে এলো তা হলো, ‘চারুলতা’। চট করে পকেট থেকে ফোনটা বের করলো কল করবার জন্য। কিন্তু কন্ট্যাক্টসে গিয়ে নাম খুঁজতে গিয়েই মনে হলো, সে তো চারুর নাম্বারটা নিতেই ভুলে গিয়েছে! চারু তার হাতে লিখে দিয়েছিল নাম্বার। সে চেয়েছিলে, ঘরে ফিরে ফোনে সেভ করতে। কিন্তু করে নি! কোনো কারণে ভুলে গিয়েছে!
সেই মুহূর্তেই ছটফটানি শুরু হয়ে গেল বেচারার। মন উচাটন করতে লাগলো। এটা কেমন হলো? কি করবে ও এখন? চারুর সঙ্গে যোগাযোগ করবে কি করে? কইবে কি করে মনের কথা? ওর নাম্বারটাই যে নেই!
___
বিয়ের আগে সে নিজের বাড়ি নিয়ে যথেষ্ট বিরক্ত ছিল অনুলেখা। বাড়ির মানুষগুলো তাকে ঠিক পছন্দ করত না সে জানতো। আর করবেই বা কেন? তাদের ভালোবাসার ‘চারুলতা জাফরিন’ আছে না? তাকে ছেড়ে ওকে নিয়ে ভাবার সময় কারো আছে? তাই ওকে যখন কেউ ভালোবাসে নি, ওও কাউকে ভালোবাসে নি। ভাবতেই মনটা খারাপ হলো। অসহ্য হিংসেই বুক জ্বলতে থাকলো!
চারু! চারু তার সব কেড়ে নিয়েছে। সবার অ্যাটেনশন, অ্যাপ্রিশিয়েশন — সব! লেখাপড়া থেকে শুরু করে প্রতিটি বিষয়ে ওর চেয়ে এগিয়ে ছিল। কোনোকিছুতে চারুর চেয়ে ভালো করে কারো নজর কাড়তে পারে নি অনু। কোত্থাও না। না পড়ালেখায়, না নাচে – গানে! এমনকি জীবনে প্রথম কোনো পুরুষের প্রতি ভালোলাগাতেও চারুকে টেক্কা দিতে পারে নি সে!
ক্লাস নাইনে পাড়ার এক বড় ভাইকে দারুণ মনে ধরেছিল অনুলেখার। পড়ালেখায় ভালো, পাড়ার অনুষ্ঠানে দারুণ গান গাইয়ে, লোকজনের অ্যাটেনশন পাওয়া স্মার্ট, হ্যান্ডসাম, সুপুরুষ ছেলে। কিশোরী বয়সের প্রথম আবেগ ওর! মনে মনে তাকে নিয়ে ভাবতে গেলেও শরীর শিহরিত হয়। ইসস, কি লজ্জাময় সুখের অনুভুতি! কিন্তু মুখে কি করে বলবে তাকে? তবুও বলতে চেয়েছিল। ম্যাট্রিক পাশ করে প্রেমের প্রস্তাব দিবে বলে প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ঠিক তখনই তাকেও কেড়ে নিলো চারু!
ফট করে একদিন রাস্তায় দাড়িয়ে দেখলো, কলেজপড়ুয়া চারুকে প্রপোজ করছে সেই ছেলে! রাগে – দুঃখে – অপমানে গা জ্বলে যাচ্ছিল ওর। মন ভাঙার অনুভূতির সঙ্গে বড় বোনের প্রতি অদম্য হিংসেয় জ্বলে-পুড়ে অঙ্গার হচ্ছিল হৃদয়!
এভাবেই ছোট থেকে সবকিছুতে চারু হয়েছিল তার থেকে শ্রেষ্ঠ। পেয়েছিল যা যা ওর পাবার কথা! ওর আকাঙ্ক্ষিত!
বংশের বড় মেয়ে; তার উপর আচার – আচরণে মার্জিত, বিনম্র এবং দারুণ মেধাবী — তাকে তো সবাই ভালোবাসবেই! কিন্তু এসব ভাবার সময় কিংবা ইচ্ছে ছিল না অনুর। সে শুধু তাই জানত, বুঝত যা চোখের সম্মুখে দেখতে পেত। দেখতে পেত, বাড়িতে তার দাম নেই। তার কথার মূল্য নেই, প্রশংসা নেই। অতএব, ক্রমশই বাড়ির প্রতি অনাগ্রহ বাড়ছিল। বাড়ির মানুষগুলোর প্রতি বিতৃষ্ণা বাড়ছিল। বিশেষ করে ওর রোষানলে পুড়ছিল চারু। এতটাই রোষ ওর প্রতি যে কখনো কখনো অতিরিক্ত ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে প্রকাশ করেই ফেলতো। বিনিময়ে বাড়ির লোকেদের বকা জুটত কপালে, আরও ক্ষেপে গিয়ে বেশি করে হিংসা করত চারুকে!
স্বভাবে উগ্র, রগচটা মেয়েটা ধীরে ধীরে হয়ে গেল ভীষণ রকমের স্বেচ্ছাচারী, উড়নচন্ডী। কারো কথা শুনবে না, পরোয়া করবে না কোনো বাঁধা!
শ্বশুরবাড়িতে এসেও এই অভ্যাস অব্যাহত রইলো ওর। এতদিনের বহুল প্রতীক্ষিত মুক্তি পেয়ে আরও বেশি বিগড়ে গেল অনু। ভাবলো, এখানে চারু নেই। ওর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। সে এখানে যা খুশি তাই করতে পারে, যা খুশি তাই বলতে পারে! আনন্দে আত্মহারা হলো। নিজের এই নতুন সংসারকে নিয়ে তার গর্ব, অহংকারের সীমা রইল না!
কিন্তু অচিরেই ওর ভুল ভাঙলো ওর। বালুর প্রাসাদের মতো চুরচুর করে ওর চোখের সামনেই একে একে ভেঙে পড়তে লাগলো ওর সকল চিন্তা – চেতনা। সাতদিনেই অতিষ্ট হয়ে উঠলো অনু। সংসার জীবনে তিক্ততা ঢুকে গেল শুধুমাত্র, একটি মানুষের কারণে!
সে মাহিয়া!
বাড়ির বড় বধূ সে। ওর চেয়ে আগে এসেছে এই সংসারে। তাই বয়স, সম্পর্ক আর অভিজ্ঞতা — তিন ক্ষেত্রেই ওর চেয়ে বড়। সুতরাং, অনুর উপরে খবরদারী তো চলবেই!
কিন্তু এটাই ঠিক অসহ্য হয়ে উঠলো ওর কাছে। এক গ্যাড়াকল থেকে বেরোতে না বেরোতেই অন্য জায়গায় এসে ফাঁসলো? বাড়িতে চারুর সবকিছুতে দখলদারি, এখানে আবার এই মেয়ের? এতসব মানবে কেন অনু?
আর অত্যাচারেরও যেন শেষ নেই। সে রান্না-বান্না অতটা পারে না। সেসব জেনেও রোজ রোজ রান্না নিয়ে খোঁটা। অন্য কাজে দখলদারি দেখানো, অনু-মাহাদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে পর্যন্ত মাঝে মাঝে কথা বলে! সাহস কত!
কিন্তু মাহিয়াকে চেয়েও কিছু বলতে পারে না ও। চারুর মতো অতটা শান্ত তো নয় এই মেয়ে, আর নাই ওর মায়ের পেটের বোন। যে ছাড় দিবে। অনু কিছু বলতে এলে পাল্টা যুক্তি নিয়ে তেড়ে আসতে দেরি হবে না!
ঘরে বসে এমন কথা ভাবছিল অনু। তখনই কাজের মেয়েটা দরজা নক করলো। ভেতরে আসবার অনুমতি দিলেই এসে বলে গেল,
— “বড় ভাবী, আপনারে বিকেলের নাশতা বানাইতে বলছে। তার শরীলডা ভালা না। শুইয়া থাকবো। কইছে, আপনি য্যান চা – নাশতা কইরা আম্মা আর তার ঘরে পাঠায় দ্যান।”
বলেই দাড়ালো না ফুলির মা। চটপট পায়ে চলে গেল। অনু নিশ্চিত জানে, ও এখন গিয়ে কি করবে। টিভি ছেড়ে সিরিয়াল দেখতে বসবে। অন্যান্য দিন ওর পরাণের বড় ভাবীর সাথে মিলেমিশে সিরিয়াল দেখে, আজ তিনি নেই। অতএব, রাজত্ব তার একার দখলে!
সুখ তো এ-বাড়িতে এই দুজনের। একজন গর্ভ ধারণ করেছেন এই সুখে বাঁচছেন না। দুদিন পর পর ঢং করছেন, রান্না কিংবা কাজের সময় হলেই ‘শরীর ভালো না’র বাহানা! অন্যজন তার খেদমতদারিতে ব্যস্ত বলে কেটে পড়ার ধান্দা। কিছু বলেও লাভ নেই। ফট করে ‘কাজ ছাইড়া দিমু!’ বলে উড়াল দিতে উনি উতলা। আর এদিকে অনু? জ্বালার শেষ নেই তার!
অগত্যা বিছানা থেকে নামতে নামতে মনে মনে ভেংচি কাটলো অনু,
— “দেখাচ্ছি, তোমায়। খুব ঢং না? ঢং যদি বের না করেছি— ক’টা দিন যেতে দাও। সংসারটা গুছিয়ে নেই একটু! তোমারও হচ্ছে! ডাlইlনী কোথাকার!”
চলবে___
#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_১৮
লম্বা ছুটির পর কর্ম জীবনে প্রবেশ করতেই বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়লো নিখিল। অফিসে এখন চাপ আছে। ছুটিতে তার ডেস্কে ফাইল জমা পড়েছে বেশ কিছু। সেগুলো ঘাঁটতে ঘাঁটতেই কখন যে অফিস আওয়ার পার হলো টের পেল না।
ব্যাগ গুছিয়ে বাড়ি ফিরবার পথে ওর মনে হলো চারুর কথা। সৌভিকের কথা। সৌভিকের কাছে চারুর নাম্বারটা চেয়ে নেয়া যায় অনায়াসেই। কিন্তু সেটা করতে ওর বিবেকে বাঁধছে খুব। হয় তো, চারুর প্রতি ওর দুর্বলতা জেনেই!
সেই প্রথমদিন থেকেই লক্ষ্য করে এসেছে নিখিল, চারুর প্রতি অদ্ভুত একটা দুর্বলতা আছে সৌভিকের। ছেলে হিসেবে সে যথেষ্ট অমায়িক এবং আন্তরিক। ভাইবোনদের প্রতি দারুণ স্নেহশীল। তাদের মন রক্ষার্থে, তাদের খুশির জন্য অনেক কিছুই করে। কিন্তু এই স্নেহময়তা, ভালোবাসা যেন চারুর প্রতি একটু বেশিই! নিখিল প্রথম যেদিন বন্ধুর নিকট মনের কথা কইলো, সেদিনও বেশ অদ্ভুত আচরণ করেছিল সৌভিক। শান্ত ছেলেটা হুট করে তেঁতে উঠেছিল। ধুমধাম কিল-ঘুষি মেরে রীতিমত উন্মাদ হয়ে উঠেছিল যেন! নিখিল অবাক হয়েছিল, বুঝতে পারে নি ওর এমন মারমুখো ব্যবহারের কারণ!
কিন্তু দিন যতোই গিয়েছে, ও বেশ বুঝতে পেরেছে। চারুর সঙ্গে নিখিলের দেখা – সাক্ষাৎ, কথাবার্তা ঠিক ভালো চোখে দেখত না সৌভিক। অথচ ও নিশ্চিত জানে, নিখিলের মনের কথা। নিখিলকে দীর্ঘদিন ধরে সে চেনে, তার পরিবারিক অবস্থা জানে। সে যে পাত্র হিসেবে চারুর অযোগ্য নয় তাও জানে!
তবুও প্রিয় বন্ধুর ওর প্রতি বিদ্বেষী মনোভাব খেয়াল করেছে নিখিল। শুরুতে তেমন পাত্তা না দিলেও, ঢাকায় ফিরবার দিন সন্ধ্যায়, সৌভিকের ওই বিধ্বস্ত চেহারা দেখে আর কিছু বুঝতে বাকি নেই ওর! ওরই প্রিয় বন্ধু যে ওর ভালোবাসার মানুষটিকে বহু আগে থেকে ভালোবাসে এই চরম সত্য জানবার পর ওর অনুভূতিটা কেমন হয়েছিল সেটা ঠিক ভাষায় প্রকাশ করবার মতো নয়। নিজের প্রতি ধিক্কার জন্মেছিল খুব। খারাপ লেগেছে বন্ধুর জন্য। কিন্তু তখন তার আর ফিরে যাওয়ার পথ নেই। চারুকে যে সে মন-প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে! তাকে কি ভোলা সম্ভব?
সৌভিকের ব্যাপারটাও সে ভেবে দেখেছে। সে চারুর বিষয়ে সব জানে, তাকে ভালোবাসে। অথচ সে ওর বিয়ের সময়ে কিছু বলে নি, কেন? এখন চারুর অক্ষমতার কথা সবাই জানে, এবং এটা সত্যি যে সবটা জেনে-শুনে এরকম ত্যাগ করতে রাজি হওয়াটা কঠিনই! একজনকে যতই ভালবাসি জীবন সঙ্গী হিসেবে, কিন্তু দিন শেষে নিজের সন্তান তো একজন চাইতেই পারে! পিতৃত্বের স্বাদ নিতে চাওয়া অন্যায় নয়। বাচ্চারা যখন ছুটে এসে কোলে চড়ে ছোট ছোট হাতে গলা আঁকড়ে ধরবে, আধো আধো গলায় ডাকবে ‘বাবা’— সেই অনুভূতি কেমন সেটা জানবার আকাঙ্ক্ষা থাকে তো সবারই!
তবে কি এমন যে, সৌভিক ভালোবেসেও তার পরিবারের কাছে বাঁধা পড়ে আছে? সমাজ – সংস্কারকে ভেঙে এগোতে পারছে না বলেই চারুকে কখনোই জানায় নি তার অব্যক্ত ভালোবাসার কথা? নিখিল ভাবতে থাকে। খোলা জানালায় চোখ রেখে রাতের ব্যস্ত নগরী দেখতে দেখতে আনমনে ভাবতে থাকে সে!
___
কয়েকদিন পেরোলো। চারুলতার জীবন আগের মত নিস্পন্দ, ছন্দহীন। সময়ের স্বাভাবিক গতিতে ওর জীবন স্রোতের মত বয়ে গেল। একেবারে নির্বিকারে। কোনো উত্তালতা নেই, উচাটন নেই। শুধু হঠাৎ হঠাৎ নিরিবিলি শ্রান্ত মধ্যাহ্নে একলা ঘরে বসলে নিখিলের কথা ওর মনে আসত। মনে আসত, অনুর বিয়ের দিন ওকে প্রথম দেখার কথা। সেইরাতে কান্নারত অবস্থায় নিখিলের সান্ত্বনা বাণী, তিস্তা পাড়ে বেড়াতে গিয়ে লোকটার সঙ্গে গল্প আর সবশেষে সেদিনের সেই মনোমুগ্ধকর হৃদয়হরিণী প্রেমত্তাপী কথামালা!
লোকটা চারুকে তাকে ভালোবাসতে বলে নি। কোনো জোর করে নি। আকুল আবেদনে শুধু তার হাত ধরতে অনুরুদ্ধ করেছে। চারু শুধু তার অনুরোধে সাড়া দিয়ে হাত ধরেছিল। লোকটা তাতেই খুশি হয়েছে। শুধু সেই হাত ধরা থেকেই সে ওকে ভালোবাসবে বলে অঙ্গীকার করেছে। ওর দুঃখের সময়ে পাশে থাকবে বলেছে। ওর সুখ-দুঃখের সাথী হতে চেয়েছে। কিন্তু কই?
এখান থেকে ফিরবার পর তো একটিবারও লোকটা ওর খোঁজ নিলো না! না ওকে দিলো কোনো খবর!
একটা ফোনকলের আশায় আশায় চারু কতো গুমড়ে মরলো। চিরকাল নিজের ফোন সম্পর্কে উদাসীন মানুষটা, এক মুহূর্তের জন্য মুঠোফোনকে কাছছাড়া করলো না। পাছে নিখিল কল দিয়ে তার ধরা না পায়?
অথচ নিষ্ঠুর লোকটা? মনেই করলো না ওকে!
সব প্রেম, সান্ত্বনা বাণী, পাশে থাকবার অঙ্গীকার অবলীলায় ভুলে গেল!
লোকটাকে সে ভালোবাসে নি। কিন্তু বিশ্বাস তো করেছিল। তার কথায় বিবর্ণ-মলিন মনের দুয়ারে স্বপ্নের প্রজাপতিরা তো ডানা মেলেছিল? ক্ষণিকের জন্য হলেও তার মনে হয়েছিল, শীতের নিশ্চুপ শুষ্কতা শেষে তার জীবন রাঙিয়ে দিতে বসন্তের আগমন হয়েছে!
কিন্তু কোথায়! সবই যে মিথ্যে! আগের মত বিবর্ণ!
___
পৃথিবীতে দু’ ধরণের মানুষ আছে। একধরণের, যারা ব্রাশে পেস্ট নিয়ে বেসিনের সামনে দাড়িয়েই ব্রাশ করে। অন্যটা যারা ব্রাশে পেস্ট লাগানোর পর পুরো বাড়ি (পারলে এলাকার) চারধারে একপাক চক্কর লাগিয়ে আসে। আমাদের রিংকু – টিংকু ঠিক সেই ধরণের মানুষ। সকাল সকাল ব্রাশ হাতে নিয়ে বাড়ির এ-কোণা থেকে ও-কোণা চক্কর দিয়ে বেড়ানো যাদের কাজ।
স্কুল যেতে হবে আটটায়। মায়ের ঠেলাঠেলিতে আগে আগেই ঘুম থেকে উঠেছে বটে, কিন্তু দু’ ভাইয়ের তাতে মন নেই। ঘুম ভাঙবার পরই তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে আজ স্কুলমুখো হবে না। তাই রোজকার চেয়ে আজকে যেন ব্রাশ করতে সময় লাগাচ্ছে দ্বিগুণ বেশি! লন এরিয়ায় হেঁটে বেড়াচ্ছে দুই ভাই। হেমন্তের সকালের মিঠে রোদ গায়ে মাখছে। আর গুটুর-গুটুর করে গল্প সারছে। হাঁটতে-হাঁটতে বাড়ির মূল ফটকের কাছে গিয়ে পৌঁছলো টিংকু। ব্রাশ মুখে দিয়ে এদিক – ওদিক তাকাতে তাকাতেই একটা লোককে দেখলো এদিকেই আসতে। সাইকেলে চড়ে আসছে লোকটা। সোজা বাড়ির ভেতরেই হয় তো ঢুকতো, কিন্তু ওর প্রশ্নে দাড়িয়ে গেল,
— “কি চাই?”
— “অরুণা ম্যানশন? বাড়ি নং ৩৪, রোড নং ৩/৪, ওয়ার্ড আঠারো?”
টিংকু কিছু না বলে গেটের পাশের নামফলকে হাত রাখলো। মুখটা অসম্ভব গম্ভীর করে ফলকে লেখা ঠিকানাটার প্রতিটি শব্দের নিচে আঙুল ঠেকিয়ে বুঝালো, ঠিকানা ঠিক না ভুল। লোকটা ওর ইশারা বুঝলো। মাথা নাড়তে নাড়তে বললো,
— “এই বাড়ির একটা চিঠি আছে।”
বলতে বলতেই লোকটা তার ব্যাগে হাত ঢুকালো। এতক্ষণে তার দিকে জহুরি চোখে চেয়ে ছিল টিংকু। পোশাক-আশাক, হাবভাব দেখে চিনতে পারলো। ছোটবেলায় বইয়ের ছবিতে দেখেছে ডাকপিয়ন। কিন্তু বাস্তবে কখনো দেখে নি বলে চিনতে একটু কষ্টই হচ্ছিল।
মুখটাকে যথাসম্ভব গম্ভীর শুধালো,
— “কার চিঠি?”
রিংকু ছুটে এসে উপস্থিত হলো সেখানে। কোনো কারণে সে একটু বাগানের দিকটায় ঢুকেছিল। ভাইকে অপরিচিত লোকের সঙ্গে কথা বলতে দেখে ছুটে এসেছে। লোকটা ওর দিকে একপল তাকালো। মাথা নেড়ে বললো,
— “চারুলতা জাফরিন। প্রযত্নে আজমীর রাজা।”
— “চিঠিটা দিন। চারুলতা আমার আপার নাম।”
কিশোরের চিকন গলায় রাশভারী আওয়াজটা ঠিকঠাক এলো না, বরং হাস্যকর শোনালো ওর এই ঢং করে কথা বলা। লোকটা একটু হেসে বললো,
— “তোমাকে তো দেয়া যাবে না, বাবু। প্রাপক যে, তাকে ডাকো। তাকেই লাগবে।”
বাবু? তাদের দেখে এই লোকের ছোট বাবু মনে হয়? দু’ ভাই মহাবিরক্ত হলো। মুখ থেকে ব্রাশ বের করে। থু করে একদলা পেস্টের ফেনা ভর্তি থুথু মাটিতে ছুঁড়ে রিংকু বললো,
— “আপা বাড়িতে নেই। চিঠি নিতে পারবেন না।”
স্বভাব সুলভ পেশাদার ভঙ্গিতে জানালো,
— “রেজিষ্টার করা চিঠি। সাক্ষর লাগবে। প্রাপক না থাকলে আজমীর রাজাকে ডাকুন। ওনাকে দিচ্ছি।”
দু’ ভাই চোখাচোখি করলো। রাগে দু’ জনেরই গা জ্বলছে। আরে ভাই, আমরা থাকতে বড় আব্বাকে লাগবে ক্যান? আমরা কি যথেষ্ট না?
টিংকুর ত্যক্ত কণ্ঠ,
— “বড় আব্বা বাড়িতে নেই। শুধু সে কেন কোনো বড় মানুষই বাড়িতে নেই। দাওয়াতে গেছে সবাই। চিঠি দিলে আমাদের দ্যান, নাহলে চলে যান।”
কথাগুলো ডাহা মিথ্যা। তবুও কি নির্দ্বিধায় বলে দিলো দু’জন!
চিঠি ওয়ালা তবুও ইতস্তত করতে লাগলো। যমজ দ্বয় পাত্তা দিলো না আর। লোকটার মুখের উপর দরজা আটকে দিতে উদ্যত হলো। ভাবখানা এই —‘আমাদের চিঠি দিবি না তো? আপাকেও দিতে হবে? দরজা আটকালে তখন দিতে পারবি? ব্যাটা উজবুক!’
অগত্যা চিঠিওয়ালা হার মানলো। টিংকুর সাক্ষর সম্বলিত কাগজখানা রেজিস্ট্রি খাতায় রেখে, খামভরা চিঠি দিয়ে বিদায় হলো!
আপাকে কে চিঠি দিতে পারে সে নিয়ে আগ্রহের সীমা ছিল না ওদের। বহুত ঝুট – ঝামেলার পর কাঙ্ক্ষিত চিঠিখানা হাতে পেয়ে উল্লসিত হলো। লাফিয়ে উঠে খামটা নেড়েচেড়ে দেখতেই আবিষ্কার করলো, প্রেরক নিখিল নওশাদ!
বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠলো রিংকু,
— “নিখিল ভাই চিঠি লিখেছে? ওরেম্মা! কি রোমান্টিক ভাই!”
বলেই চাপড় লাগাল সহোদরের পিঠে। খাম হাতে নিয়ে গম্ভীর হলো টিংকু। কিয়ৎক্ষণ উল্টেপাল্টে দেখে বললো,
— “ফেসবুক – হোয়াটস অ্যাপের যুগে চিঠি? আশ্চর্য!”
রিংকু মুখ কুঁচকে তাকালো,
— “আশ্চর্যের কি আছে? নিখিল ভাই বাকি সবার মত না। আলাদা অনেক। তাই হয় তো, চিঠি দিয়েছে। নব্বই দশকের চিঠি যুগের প্রেম দেখিস নি? কি সুইট আর প্রীটি শুনতে লাগে ওদের লাভ স্টোরিগুলো!”
সহসা জবাব দেয় না টিংকু। খানিক চুপ থেকে কি যেন ভেবে নেয়।
তারপর গম্ভীর মুখটাতে কুটিল হাসি ফুটিয়ে বলে,
— “তাহলে তো চিঠি পড়ে দেখতে হচ্ছে! দেখি, নিখিল ভাই কি লিখেছে!”
— “কীহ্?”
রিংকু ভীষণ অবাক হয়। দু’ জনেই দুষ্টের শিরোমণি বটে, কিন্তু এই প্রথমবার বড়’পার চিঠি নিয়ে দুষ্টুমি করতে ইচ্ছে করে না রিংকুর। এরমধ্যে বাড়ির কাজের মহিলাটাকে দেখা গেল। হলরুমের দরজায় দাড়িয়ে উনি ডেকে গেলেন,
— “ভাইজানেরা তাড়াতাড়ি আয়েন। ইস্কুল যাওয়ার সময় পার হইয়া যাইতেছে!”
সেদিকে একঝলক চেয়ে হাত নাড়িয়ে রিংকুর জবাব,
— “যাচ্ছি। যাও!”
তারপর ভাইয়ের দিকে ফিরে বলে,
— “মানে এই চিঠি আমরা আগে পড়বো। দেখবো, নিখিল ভাই কি কি লিখেছ। তারপর আপাকে দেব! ঘরে চল এখন—”
খামটা পকেটে লুকিয়ে সহোদরকে টানতে টানতে ভেতরে চলে গেল। অনেক হয়েছে দাঁত ঘষাঘষি। কোনোমতে মুখটা ধুয়েই ঘরে গিয়ে দোর দিয়ে চিঠি পড়তে বসবে! আহা, নিখিল ভাইয়ের প্রেমময় চিঠি পড়বার জন্য তর সইছে না পরাণে—
চলবে___
#মৌরিন_আহমেদ