এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায় পর্ব-১৩+১৪

0
488

#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_১৩

কাছের মানুষগুলো কাছে থাকলে, কোনো ব্যথাই যেন আর ব্যথা দিতে পারে না। এ পৃথিবীতে দুঃখ নেই কার? কমবেশি সবাই তো আমরা দুঃখী। দুঃখে, কষ্টে জর্জরিত একেকজন। কিন্তু এই ব্যথা-বেদনাগুলো আমরা ভুলে যেতে পারি। জখম আমাদের তা ভুলিয়ে দেয়া হয়!
এ দুনিয়ায় সব মানুষই কষ্ট পায়, কিন্তু সেই মানুষটিই কষ্টের প্রখরতা টের পায় না যার কাছে কষ্ট ভুলিয়ে দেয়ার জন্য কেউ থাকে। থাকে কাছের মানুষ, আপন মানুষ।
চারুর বুক ভর্তি দুঃখ আর হতাশা মেটাতে তার পুরো পরিবার সচেষ্ট হলো। অন্তর্মুখী মেয়েটা কখনো কারো কাছে নিজেকে প্রকাশ করতে পারে না। সারাক্ষণ অন্তরালে থাকে একা একা। তাই ওর কাছের মানুষগুলো নিজেরাই কাছে টেনে নিলেন। ফুপু গতরাতে ওর সঙ্গে ঘুমিয়েছেন। অনেকরাত পর্যন্ত চুলে বিলি কাটতে কাটতে পুরোনো দিনের গল্প করেছেন। সকালে রান্নাঘরে কাজ করতে থাকা মা – চাচীদের আড্ডায় ধরে শামিল করলো। বিকেলে ভাই-বোনেরা একসঙ্গে বসে মুভি দেখলো। ড্রইং রুমটার সোফা সরিয়ে মেঝেতে তোষক ফেলে, সামনে পপকর্নের বাটি নিয়ে বসে সবগুলো একত্রিত হলো। মুভি দেখার জন্য! হিন্দি ঘরানার একটা কমেডি মুভি দেখতে দেখতে হেসে গড়াগড়ি খেল ওরা। সে রাতটাও ওরা ক’ বোন একসঙ্গে থাকলো। বহুদিন পর ওরা একসঙ্গে এতো মিষ্টি সময় কাটালো। এতো এতো মানুষের সমাগমে থেকে নিজের ব্যথাটা ভুলতে বাধ্য হলো চারু। মন খারাপেরা দল বেঁধে পালালো। চুটিয়ে আড্ডা, হৈ-হুল্লোড় করতে করতে কেটে গেল প্রহর!

পরদিন আয়োজন করা হলো পিকনিকের। পিকনিক বলতে, সব ভাইবোনেরা মিলে রান্নাবান্নার ব্যবস্থা করলো। যাতে বড়রা রইলো আমন্ত্রিত অতিথিদের ভূমিকায়!

রোদ থেকে বাঁচতে বাগানের একজায়গায় সামিয়ানা টাঙানো হয়েছে।তার নিচে বড় বড় দু’টো গর্ত করে, ইট বসিয়ে চুলো বানিয়েছে রান্না করবে বলে। রান্নার দায়িত্ব সৌভিক আর চারুর। আগেই বলেছি, সৌভিক ভীষণ গোছালো আর কর্তব্যপরায়ণ ছেলে। তার প্রতি অগাধ আস্থা তার ছোট – ভাইবোনদের। বাজারের দায়িত্ব পড়েছে কাব্য আর কবিরের উপর। তাদের স্ত্রীরা রান্নার সহযোগী। ইমা, ইরা এবং ঋতু অন্যান্য কাজে। সবাইকেই মোটামুটি কাজে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। একমাত্র বাদ গেছে রিংকু – টিংকু। অতি আদরের ছোট দু’টি ভাই, তাদের জন্য কাজ মওকুফ। কিন্তু ভাইয়েরা ভালোবেসে কাজ থেকে রেহাই দিলে হবে কি? তারা নিজেরা তো মহা দেওয়ানী। অন্যরা খেটে মরবে আর ওরা আনন্দে ’তাইরে নাইরে না’ করতে করতে ঘুরবে? ভাই-বোনদের প্রতি এ অবিচার ওরা করবে কি করে? ওদের মানবিকতা বোধ আছে না?
তাই স্বেচ্ছায় তারা কাজে লেগে পড়লো। ইরা শরবৎ বানাচ্ছিল। দু’ জগ ভর্তি করে শরবৎ বানিয়ে ফ্রিজে রাখবে। বেলা একটু পরে গেলেই তো সকলে তৃষ্ণায় ছটফট করবে। মোক্ষম সময়ে যেন তড়িঘড়ি করে কিছু করতে কিংবা হা হুতাশ না করতে হয়, তার প্রস্তুতি আগে-ভাগেই নিচ্ছে। রিংকু – টিংকু এসে দাড়ালো ওরই কাছে। বললো,
— “আপা। দে সাহায্য করি।”
ইরা ভ্রু কুঁচকে তাকালো,
— “কি করবি?”
— “এভাবে তাকাস কেন? সাহায্য করতে চাইছি।”
ইরা তবুও একইভাবে চেয়ে, তাই বললো,
— “সাহায্য মানে বুঝিস না? ইংরেজিতে বলে হেল্প। এইচ-ই-এল-পি। হেল্প!”
— “হেল্প মানে জানি আমি। মূর্খ নই। কিন্তু তোরা এখানে কেন? কি কুকীর্তি করবার মতলব?”
সন্দিহান গলায় বললো। টিংকু ভারী বিরক্ত হলো তাতে,
— “এই জন্যই মহিলা মানুষরে ভাল্লাগে না। সব জায়গায় খালি প্যাঁচ খোঁজে। আরে ভাই, হেল্প করতে আসছি। কি করতে হবে বল!”
ওদের কথায় আশ্বস্ত হলো কি-না বোঝা গেল না। ক্ষণিক নিশ্চুপ থেকে কুঞ্চিত ভ্রূ সোজা করলো ইরা। বললো,
— “হেল্প করতে চাইছিস ভালো। কিন্তু আমার কোনো হেল্প লাগবে না। আমি নিজেই করতে পারবো। তোরা বরং চুপচাপ দাড়া।”
নিজের কাজে মনোনিবেশ করলো। লেবুর রস ঢাললো জগে। বয়াম থেকে চিনি ঢালতে উদ্যত হয়েছে তখনই হঠাৎ ডাক পড়লো তার। বাড়ির ভেতর থেকে ঋতুর ডাক শোনা যাচ্ছে,
— “ইরা? তোকে ছোট চাচী ডাকছেন! জলদি আয়।”
কাজ থামিয়ে উত্তর করলো ইরা,
— “আসছি।”
বলেই ছুটে গেল ভেতরে। যাবার পূর্বে ভাইদের সতর্ক করতে ভুলে নি। কিন্তু ওর সতর্ক বার্তায় কি যায় আসে দু’ভাইয়ের? তারা তো অকাজ করতে সদা পারদর্শী। তাই চিনির বদলে শরবতে লবণ দিতে কার্পণ্য করল না। একদম বয়াম উপুড় করে পুরোটাই ফেলে দিলো জগের পানিতে। অকাজটা করেই টিংকু শয়তানি হাসি দিলো। ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বললো,
— “লবণের সংকেত কি বল তো, রিংকু?”
— “সোডিয়াম ক্লোরাইড!”
–“আর এটা কি তৈরি হলো?”
— “লবণ আর পানির সম্পৃক্ত দ্রবণ!”
— “আর এরই মাধ্যমে সম্পন্ন হলো আমাদের বৈজ্ঞানিক অভিযান। বুঝলি রিংকু, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞানের কিন্তু কোনো বিকল্প নেই। হরহামেশাই দরকার!
দু’ ভাই কিটকিটিয়ে হেসে উঠলো। তারপর চুপ করে সটকে পড়লো ইরা আসবার আগেই!

নিখিলকে কেউ কোনো কাজ দেয় নি। সে মেহমান মানুষ, তাকে দিয়ে কাজ করানো যায়? তাছাড়া তারা এতোগুলো ভাইবোন যেভাবে কাজ ভাগ করে নিয়েছে তাতে ওর কষ্ট করবার কোনো প্রয়োজন নেই। তথাপি হাত গুটিয়ে থাকাটা নিখিলের পছন্দ হলো না। সে রান্নার জায়গায় বসে চারুর সহযোগিতা করবার জন্য বেশ কয়েকবার অনুরোধ করলো। কিন্তু সৌভিক কিংবা চারু কেউই তাতে রাজি হলো না। ওরা দু’জনে একসঙ্গে চুলোর সামনে বসে। গুটুর-গুটুর করে গল্প করছে, মাঝে মাঝে হাসছে। অদূরে বসে এই দৃশ্য দেখে অন্তর জ্বলে যাচ্ছে নিখিলের! অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগলো সে।
কিয়ৎক্ষণ পর ইমাকে ডাক দিলো চারু,
— “এ্যাই, ইমা? বাংলা ঘর থেকে কিছু খড়ি নিয়ে আয় তো!”
ইমা সম্ভবত আশেপাশে ছিল না। কিংবা বড়’পার ডাক শুনতে পায় নি। একটু পর সৌভিক ফের ডাকলো। কিন্তু এবারও ফলাফল শূণ্য। অগত্যা চারু বললো,
— “ভাইয়া? তুমি থাকো। আমি এনে দিচ্ছি।”
বলে নিজেই উঠে দাড়ালো লাকড়ি আনবার উদ্দেশ্যে। সৌভিক বাঁধা দিতে চাইলো। চারুর প্রতি তার বিশেষ দুর্বলতা আছে। বললো,
— “না, না। আমি যাই। তুই বস।”
— “তুমি থাকো তো। আমি যাবো আর আসবো।”
চারু এগোলো। নিখিলের চাতকী মন যেন এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল এতক্ষণ। সে চট করে উঠে চারুর কাছে এলো,
— “কি লাগবে আমাকে বলুন না? আমি এনে দিচ্ছি।”
চুলোর জ্বাল ঠিক করছিল সৌভিক। কথা শুনে বন্ধুর দিকে ফিরে তাকালো। অদ্ভুত দৃষ্টিতে। সে দৃষ্টিতে খানিক ক্রোধ আর বিরক্তি মিশে। নিখিল বুঝেও পাত্তা দিলো না। সৌভিককে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে চারুর পানে চেয়ে রইলো,
— “এতক্ষণ ধরে রিকোয়েস্ট করছি। আপনারা কিন্তু একটা কথাও রাখেন নি। এবার না বললে হবে না। বলুন, কি দরকার?”
— “সাহায্য তো আমিও করতে চেয়েছি। আমাকে সুযোগ দিলি কই?”
মাঝখান থেকে বলে ওঠে সৌভিক। তার দৃষ্টি এখন ঘুরে চারুর উপরে নিবদ্ধ। মেয়েটা পড়লো বিপাকে। সে কি করবে?
হাসলো অপ্রস্তুত ভাবে
— “তোমরা এমন করছ কেন? বললাম তো আমি করে নিবো।”
— “কিন্তু আমি…”
সৌভিক কিছু বলবার জন্য মুখ খুলতেই চারু অপ্রসন্ন গলায় ডাকে,
— “ভাইয়া, প্লিজ? সকাল থেকে খাটছ। তোমাকে আর কষ্ট দিতে চাইছি না।”
এবারে নিখিল নিজের আর্জি জানায়,
— “সৌভিক না হয় খুব খেটেছে, আমি তো খাটি নি। আমাকে করতে দিন। অন্তত এই একটি কাজ করে বলতে পারবো, পিকনিকে আমার অবদানও তুচ্ছ নয়।”
বলেই হাসবার চেষ্টা করলো। ওর এতো আন্তরিক আচরণ দেখে আর না করতে পারলো না চারু। কে জানে, এ যাত্রায় ‘না’ বললে হয় তোমন খারাপ করবে। এই সুন্দর সোনালী দিনটায় কেউ মনে কষ্ট নিয়ে থাকুক সে চায় না। মুচকি হেসে সায় দিলো।

বেলা দেড়টা নাগাদ রান্না-বান্নার পর্ব শেষ হলো। ততক্ষনে সব ক’টা ক্ষিদের জ্বালায় কুপোকাত! ঐতিহ্য রক্ষার্থে থালার উপর কলাপাতা নিয়ে অধৈর্য হয়ে বসে। সৌভিক চুলো থেকে হাড়ি নামাতেই ওরা ছুটে গেল। পরিবেশনের ধার ধারে নি কেউ। চটপট যে যা পারছে তাই নিচ্ছে তুলে। হৈহৈ করতে করতে প্লেট পূর্ণ করে ফিরে আসছে নিজ আসনে।ওদের ভীড় কমলে ধীরে – সুস্থে বোল নিয়ে এগোলো চারু। বড়দের পরিবেশন করতে হবে। সৌভিকও বসে গেছিল ভাইদের সঙ্গে। চারুকে কাজ করতে দেখে প্লেট রেখে উঠে এলো। কাজ তো চারুও কম করে নি। তবে তাকে রেখে কেন নিজে খেতে বসা?
কিন্তু এগিয়ে যেতেই দেখলো ইতোমধ্যে নিখিল চলে এসেছে চারুর কাছে। সবাই কাজ করে ক্ষুধার্ত হয়েছে। তাই খাবার প্রস্তুত হতে না হতেই যে যারটা নিয়ে হামলে পড়েছে। কিন্তু নিখিল তেমন কাজ করবার সুযোগ পায় নি। তাই তার অত খাওয়ার তাড়া নেই। এই ফাঁকে সে হাজির তার অব্যক্ত প্রিয়তমার কাছে, তার সহযোগিতার জন্য!
— “গোশতের বোলটা আমায় দিন, চারুলতা। আমি নিচ্ছি।”
— “আরে আপনি কেন এলেন! মেহমান মানুষ, খেতে বসুন।”
চারু বাঁধা দিতে চায়। নাছোড়বান্দা নিখিলের জবাব,
— “আপনারা আমাকে কি পেয়েছেন বলুন তো? মেহমান বলে কি কিচ্ছুটি করতে পারি না? আপনি তখন থেকে কাজ করছেন। সাহায্য করতেও দিচ্ছেন না। এ-তো ভারী অন্যায়। অন্যদের সুযোগই দিচ্ছেন না।”
সেই মুহূর্তে সৌভিক এসে দাড়ায়। ওকে দেখেই চারু বলে উঠলো,
— “আরে ভাইয়া, তুমি এলে যে? কিছু লাগবে?”
— “না। না। তোর কাছে এলাম। দে দেখি, কি করতে হবে।”
নিখিল ফট করে বললো,
— “তোকে আর কিছু করতে হবে না, দোস্ত। অনেক করেছিস। এবার যা, আরাম করে খা।”
নিখিলের উপস্থিতি কেন যেন মানতে পারছিল না সৌভিক। হয় তো, চারুর প্রতি ওর ভালোলাগার কথা জানে বলেই। আবার একই ব্যাপার ঘটছিল নিখিলের সঙ্গেও। বন্ধুবর সৌভিক এবং চারুর প্রতি তার আধিপত্য তার অসহ্য লাগছিল। সৌভিক বললো,
— “করেছি তো কি হয়েছে? বাড়ির ছেলেরা কাজ করবে তাই স্বাভাবিক। তুই অতিথি মানুষ। গিয়ে বসে পর। আমরা সামলে নিবো।”
এদের আচরণে চারু হতবাক। সকাল থেকে খেয়াল করছে এই দু’টো মানুষ তার পেছনে লেগেছে! সে যা করছে, করতে চাইছে সবকিছুতে তাদের আগ্রহ। তাকে সাহায্য করতে যেন এরা দু’জনই মুখিয়ে। সৌভিকের আচরণ ওর কাছে পরিচিত। সে বরাবরই এমন করে। ওর প্রতি অতি স্নেহশীল। কিন্তু তার বন্ধু নিখিল? সে এমন আচরণ করছে কেন!
সে অস্বস্তি নিয়ে বলে,
— “তোমরা যাও, প্লিজ। ভাইয়া? তোমাকে কিছু করতে হবে না। খেতে বসো। আমার একটু বাকি আছে কাজ, একাই করে নিবো। সমস্যা হবে যা। আর নিখিল সাহেব আপনিও যান। এমনই অনেক দেরি হয়েছে। আর দেরি করবেন না। প্লিজ।”
— “কিন্তু…”
— “কোনো কিন্তু নয়। যান।”
নিখিল দিরুক্ত করতে চাইলেও আর শোনে না। দুজনকেই পাঠিয়ে দেয়। তারপর নিজের কাজ গুছিয়ে নেয়। মহিলা মহলের দিকটায় পরিবেশন করতে গিয়ে তাদের সঙ্গেই খেতে বসে। পরমযত্নে বড় ফুপু ধরে খাইয়ে দেন ওকে। হাসি-ঠাট্টায় মেতে ওঠে সব!

কিন্তু এতসবের মাঝেও ওর মনের ভেতর কাঁটার মত খচখচ করে কি যেন। সে ছোট বাচ্চা নয়। অবুঝ – নাদান নয়। তার সঙ্গে কে কেমন আচরণ করছে সেটা বুঝবার ক্ষমতা তার আছে। এবং সেই আচরণের পেছনে কার কি উদ্দেশ্য থাকতে পারে তাও সে অবগত। পরিপূর্ণ অভিজ্ঞ একজন নারী সে। তার প্রতি একজন বিপরীত লিঙ্গের মানুষের ব্যবহার, কথাবার্তা, চাহনি যদি নাই বুঝে — তবে সে নারী হলো কি করে?
আর বুঝেই সে অবাক হচ্ছে। নিখিল সম্পর্কে কৌতুহল হচ্ছে। ছেলেটা কিছু জানে কি? সব জানবার পর তার প্রতি আগ্রহী হবার তো কোনো কারণ নেই!

চলবে___

#মৌরিন_আহমেদ

#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_১৪

পড়ন্ত বিকেল। একটু পরেই টুপ করে ডুবে যাবে সূয্যিমামা। লালিমার রঙে রাঙিয়ে দিয়ে যাবে আকাশ, আর কালোরা ঝাঁপিয়ে পড়বে দুনিয়ায়। আঁধারিতে ভরে উঠবে পরিবেশ। কিন্তু সে অনেক দেরি!
তার আগেই সবাই মিলে বসে পড়লো একসঙ্গে। সবুজ ঘাসের আচ্ছাদনে বাগানের মাঝখানটায় গোল হয়ে বসলো। এখন আড্ডা হবে, গান হবে। দৌড়ে বাড়ি থেকে কাব্যের গিটার আনলো রিংকু-টিংকু। কাব্য দারুণ গাইতে জানে। একসঙ্গে আড্ডায় বসলে প্রায় এক-আধটা গান গাইতেই হয় ওকে। সবাই অনুরোধ করে। আর আজ এরকম একটা আয়োজন। গান না হলে জমে? কাব্য গান গাইলো, ঋতু কৌতুক বললো। কবির ভালো আবৃত্তি করে। ওর মুখে নজরুলের কোনো কবিতা শুনে এতো প্রাণবন্ত লাগে যে সেটাকে তখন আর স্রেফ একটা কবিতা বলে মনে হয় না। মনে হয় কোনো দৈববাণী, যার প্রতিটি শব্দ উচ্চারণে গায়ের শিরা-উপশিরায় রlক্ত ছলকে ওঠে। তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে প্রাণ দীপ্তিমান হয়! ইরা আবার মূকাভিনয় জানে। ও সেটাই করে দেখালো। চার্লি চ্যাপলিনের একটা পার্ট। ওর অভিনয় দেখে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেল বাকি সবাই। যে যার মতো আনন্দের সঞ্চার করে যাচ্ছে আসরে। মেতে উঠেছে সোল্লাসে। কে যেন হঠাৎ প্রশ্ন তুললো,
— “নিখিল ভাই, আপনি কি করবেন? আপনার কোনো হিডেন ট্যালেন্ট নেই?”
সঙ্গে সঙ্গে নয় জোড়া চোখ একসঙ্গে ঘুরে তাক করলো নিখিলকে। আচম্বিতে এ প্রশ্নে চমকিত হলো নিখিল। অপ্রস্তুত চোখে চেয়ে হাসলো। ওর বিব্রতবোধ টের পেয়েই চট করে টিংকু বলে উঠলো,
— “গান হলো, কৌতুক হলো, অভিনয় হলো। আপনি কি করবেন? নাচবেন না-কি? একটু নাচুন না!”
ঝোপ বুঝে কোপটা মেরেই হাসলো ঠোঁট টিপে। তাল দিলো সহোদর রিংকুও,
— “হ্যাঁ , হ্যাঁ। নিখিল ভাই, একটু ড্যান্স হলে মন্দ হয় না!”
বলেই নিজেদের মধ্যে চোখাচোখি করলো দুই বিচ্ছু। বলা বাহুল্য, প্রথমোক্ত প্রশ্নবাণ রিংকুরই ছোঁড়া! চারু ওদের পাশেই বসেছিল। বাঁদর দু’টোর মতলব ধরতে অসুবিধা হলো না। সবার অলক্ষ্যে বাঁ হাতে সাঁই করে একটা চাটা মারলো দুটোর মাথায়। ফিসফিস করে বললো,
— “ভদ্রতা শিখিস নি? এগুলো কি কথা?”
বড় বোনের দিকে ফিরে দাঁতালো হাসি দিলো দু’জন,
— “কুল, বড়’পা! দেখই না কি হয়!”
— “বদমাইশ!”
কড়া সুরে শাসালো সে। ওদের কি আর তাতে কান দেবার সময় আছে! তখনও কুটিল হাসিতে মত্ত দু’জন!

রিংকু – টিংকু দুষ্টুমি করে নিখিলের নাচের প্রসঙ্গ উঠালেও এতক্ষণে সবার খেয়াল হলো ওর দিকে। সত্যিই তো, এই আসরে উপস্থিত সবচে’ অল্প পরিচিত মানুষটি সে। যার ভেতরে কোনো ‘হিডেন ট্যালেন্ট’ তথা ‘লুক্কায়িত গুণ’ আছে কি-না ওরা অবগত নয়। তাছাড়া বাদ-বাকি সবার গুণ – বেগুণ সব ব্যাপারেই তথ্য আছে ভুঁড়ি ভুঁড়ি!
ইমা বলে,
— “ও দুটোর কথায় কিছু মনে করবেন না, ভাইয়া। আপনি বরং বলুন আপনি কি জানেন? আবৃত্তি জানেন? করবেন?”
— “কি বলেন! আমি আর আবৃত্তি— তবেই হয়েছ!”
মুখ লটকে তাকায় ইমা। রিংকু – টিংকু ফের চেঁচায়,
— “নাচ, নাচ। একটু কোমড় দুলাতে হবে!”
এবার ওদের দিকে তাকিয়ে চোখ পাকিয়ে ধমক দেয় কবির, উপস্থিত সকলের শ্রদ্ধেয় বড় ভাই,
— “চুপ, ফাজিলের দল!”
ব্যস। ফাটা বেলুনের মতো চুপসে যায় দু’টোর হাসি হাসি মুখ। তথাপি বড় ভাইয়ের বিরুদ্ধে নালিশের উদ্দেশ্যে বড় ভাবীর দিকে করুণ চাহনিতে চায়। জাবিন অবশ্যি পাত্তা দেয় না!
গিটারে টুং করে একটা আওয়াজ তুলে কাব্য শুধালো,
— “গান জানো না-কি, নিখিল? গাইবে?”
তাচ্ছিল্য নয়, আন্তরিক আহ্বান। অস্বস্তির পুরু আস্তরণে পড়ে নিখিল হাসলো কোনোমতে,
— “আরে না, না। আমি…”
— “মিথ্যে কথা। উনি ভালো গান জানেন!”
ওর কথা শেষ না করতে দিয়েই হঠাৎ প্রতিবাদ করলো চারু। এক লহমায় সবার দৃষ্টি ঘুরে গেল ওর পানে। ভারী অবাক করা বিষয় তো! চারু আবার নিখিল সম্বন্ধে জানে কি করে? ওই অন্তর্মুখী মেয়েটা তো সারাদিন একা একাই থাকে। নিজের ঘরের চার দেয়ালের সঙ্গে তার যে সখ্যতা! বেরোতেই চায় না! ভাইবোনদের আসরে বসলেও মুখ খোলে কদাচিৎই। সেই কি-না আজ নিখিলকে নিয়ে বলছে? আশ্চর্য তো বটেই!
সবার মতো সৌভিকও আশ্চর্য হলো, নিখিল তার ভালো বন্ধু। অনেক পুরনো ইয়ারি তাদের। সেই সুবাদেই নিখিলের ভালো গায়কী সম্পর্কে সে অবগত। চাইলে আসরে সেই এই প্রসঙ্গ তুলতে পারতো!
কিন্তু আসরে তারচেয়ে তার বন্ধুর মূল্য বেড়ে যাক — তা ও চায় নি। বিশেষত চারুর সম্মুখে গান গেয়ে নিখিল বাহবা নিক, ওর পছন্দ হয় নি বিষয়টা। তাই চুপ ছিল। চারুর স্বীকারোক্তিতে সে আশায় গুড়ে বালি পড়লো। মনে মনে গাল দিলো বন্ধুকে,
‘শালা, এরমধ্যে গান শুনিয়েও ফেলেছিস!’

চারুর মুখে নিখিলের প্রসংশা শুনে সবাই চেপে ধরলো নিখিলকে। এবার গাইতেই হবে ওকে। অগত্যা বলি বা বাকরা হলো নিখিল। গান গাইতে তার আপত্তি নেই। কিন্তু এতোগুলো অপরিচিত কিংবা অর্ধপরিচিত মুখের সামনে গিটারে সুর তুলতে ওর ভারী লজ্জা লাগছিল। কিন্তু পুরুষের অল্পে-সল্পে লজ্জা পেলে চলে না। অতএব, গিটারে সুর উঠলো কাব্যের; গলা সাধলো নিখিল,
— “যদি বারেবারে একই সুরে
প্রেম তোমায় কাঁদায়,
তবে প্রেমিকা কোথায়
আর প্রেমই বা কোথায়?
যদি দিশেহারা ইশারাতে
প্রেমই ডেকে যায়,
তবে ইশারা কোথায়
আর আশারা কোথায়?
যদি মিথ্যে মনে হয় সব পুরোনো কথা,
যদি চায়ের কাপেতে জমে নীরবতা,
তবে বুঝে নিও চাঁদের আলো কত নিরুপায়!

লাললালা

যদি প্রতিদিন সেই রঙিন
হাসি ব্যথা দেয়,
যদি সত্যগুলো স্বপ্ন হয়ে
শুধু কথা দেয়,
তবে শুনে দেখো প্রেমিকের
গানও অসহায়।

লাললালালা

যদি অভিযোগ কেড়ে
নেয় সব অধিকার,
তবে অভিনয় হয়
সবগুলো অভিসার।
যদি ঝিলমিল নীল আলো কে
ঢেকে দেয় আঁধার,
তবে কি থাকে তোমার
বলো কি থাকে আমার?
যদি ভালোবাসা সরে গেলে
মরে যেতে হয়,
ক্যানো সেই প্রেম ফিরে এলে
হেরে যেতে ভয়?
শেষে কবিতারা দায়সারা
গান হয়ে যায়।

লাললালালা

যদি বারেবারে একই সুরে
প্রেম তোমায় কাঁদায়,
তবে প্রেমিকা কোথায়
আর প্রেমই বা কোথায়?
যদি দিশেহারা ইশারাতে
প্রেমই ডেকে যায়,
তবে ইশারা কোথায়
আর আশারা কোথায়?
যদি মিথ্যে মনে হয় সব পুরোনো কথা,
যদি চায়ের কাপেতে জমে নীরবতা,
তবে বুঝে নিও চাঁদের আলো কত নিরুপায়!

লাললালা

ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে আসে নিখিলের মোহনীয় কণ্ঠস্বর। হ্রাস পায় সুরের গতি। মধুর আবেশ তৈরি করে, সকলকে মূর্ছনায় হারিয়ে ফেলে একসময় থেমে যায় গিটার। সর্বশেষ বেসুরো টুং করে একটা আওয়াজ তুলে ওদের চটকা ভাঙলো কাব্য,
— “নাইস, ইয়ার! দারুণ গাইলে তো তুমি!”
কল্পনায় ছেদ ঘটলো। একমুহূর্তের জন্য সবাই নিশ্চুপ থেকে হঠাৎ চেঁচিয়ে অভিবাদন জানাতে উদগ্রীব হলো,
— “ফাটিয়ে দিয়েছ ভাই! সুপার! সুপার!”
— “ওয়ান্স মোর! প্লিজ!”
করতালিতে মুখরিত হলো স্বর্ণালী সন্ধ্যা। সকলে এতো এতো প্রসংশায় ভরিয়ে তুললো ওকে। মন ভালো করে দেয়া একেকটি শব্দ, বাক্য! একরাশ শুভকামনা আর শুভেচ্ছাবাণী যোগ হলো ঝুলিতে। বিনিময়ে লজ্জিত হয়ে শুধুই হাসলো নিখিল। হৈ-হৈ কলরবের মাঝে নির্নিমেষ চেয়ে রইলো একটি হাসিমুখের দিকে। কোমল পানপাতা মুখটিতে কোনো স্বর নেই, একেবারে নির্বাক শ্রোতা সে। অথচ তার দুটি চোখের দিকে চেয়েই যেন নিজের জন্যে হাজারও অনুপ্রেরণা খুঁজে পেল নিখিল!
সেই মুহূর্তে অনিমেষ চেয়ে রইলো দু’জনেই; নিখিল এবং চারু!

******
রাতের খাবার খেয়ে ব্যালকনিতে দাড়িয়েছে সৌভিক। মনটা বড্ডো উদাস উদাস লাগছে। কিছুতেই কিছু ভালো লাগছে না। চড়ুইভাতি করতে গিয়ে সারাদিন অনেক ব্যস্ততায় কেটেছে। প্রথমে রান্না – বান্না, গোছ-গাছ তারপর বিকেলের আড্ডা! সবকিছু গুছাতে গুছাতে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে গেল।

সন্ধ্যায় গান গাওয়ার পর এ-বাড়িতে নিখিলের কদর বেড়ে গেছে। না, আগেও ওকে সম্মান করা হতো। কিন্তু সেটা সৌভিকের বন্ধু হিসেবে, একজন অভ্যাগত অতিথি হিসেবে। এখন সবাই কদর করছে ভালো গাইয়ে হিসেবে। তাই তো রাতের খাবার টেবিলেও ওকে নিয়েই ছিল ভাইবোনদের সমস্ত আলাপন। কথা-বার্তা। খাবার শেষ হলেও কথা শেষ হয় নি। ফলস্বরূপ নিখিলকে টেনে নিয়ে ড্রইংরুমে বসে গেছে সবাই। টিভি দেখতে দেখতে এবার গল্প জমবে!

সৌভিকের তাতে কোনো সমস্যা ছিল না। তার বন্ধুকে সবাই ভালো বলুক, সে চায় না এমন নয়। সেও চায় হয় তো। নাহলে নিখিলকে কেন সে নিজেদের বাড়িতে বেড়াতে এনেছে? সে হিংসুটে হলে তো আনতো না!
কিন্তু ঘাপলা সেখানে নেই। রয়েছে অন্য জায়গায়। বাড়ির সকলে মিলে নিখিলের প্রসংশা করে, মুখে ফেনা তুলতে তুলতে মlরে যাক — ওর কিছু যায় আসে না। কিন্তু প্রসঙ্গ যখন চারুকে ঘিরে, তখন সৌভিক তো হিংসুটে হবেই! ওর বুকেও তো জ্বলন হবেই! সন্ধ্যায় কেউ না দেখুক, হাততালির কান ফাটানো শব্দ, সবার হুল্লোড় করা জমজমাট আসরের মাঝেও নিখিল কেমন বেহায়ার মতো চারুর দিকে চেয়ে ছিল সে ও দেখেছে। সঙ্গে চারুর মুগ্ধ দৃষ্টিও ওর চোখ এড়ায় নি। তাই তো ওর ভয় হয়! বুক জুড়ে হতাশা তড়পাতে থাকে। আহা রে, চারু কেন তার হলো না? কেন কেউ মানলো না তাকে? দিলো না চারুকে তার করে! একান্ত তার করে?

চলবে___

#মৌরিন_আহমেদ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে