#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_১১
আকস্মিক হওয়া কাণ্ডে হতভম্ব চারু। ফ্যালফ্যাল নয়নে, চোয়াল ঝুলিয়ে ছোট ভাইদের মুখের দিকে চেয়ে! রিংকু – টিংকু আনন্দে চেঁচাচ্ছে,
— “বড়’পা ভীতু! ভীতুর ডিম!”
উল্লাসে ফেটে পড়ছে যেন। সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলো চারু। দোয়া পড়ে বুকে ফুঁ দিয়ে ভাইদের দিকে তাকালো। একটু রাগবার চেষ্টা করে বললো,
— “কেমন আচরণ এটা রিংকু-টিংকু? তোরা আমাকে ভয় দেখালি কেন?”
— “কোথায় ভয় দেখিয়েছি?”
অবাক হবার ভান ধরলো টিংকু। রিংকুর সায় তাতে,
— “আমরা তো তোমার কানটা একটু দেখছিলাম। তুমি যে ভীতু, তাতেই ভয় পেয়েছ। এতে আমাদের দোষ কোথায়?”
অতি সরল জবাব। নিষ্পাপ চেহারা। চারু রাগ করলো,
— “আমার কান তোদের দেখতে হবে কেন? নিজেদের কান দেখতে পারিস না?”
বড়’পা সহজে রাগে না — এটা ওদের অজানা নয়। তাই চারুর এই রাগবার আপ্রাণ চেষ্টাটা যেন পাত্তাই দিলো না ওরা। নির্বিকার গলায় বললো,
— “কি যে বলো না, বড়’পা। তোমার প্রতি আমাদের দায়িত্ব আছে না? এই যে তুমি কান পরিষ্কার না করতে করতে, দিন-কে-দিন ঠসা হয়ে যাচ্ছো; কতক্ষণ ধরে আমরা তোমাকে ডেকে যাচ্ছি তুমি শুনছোও না, উঠছোও না— এটা আমাদের দেখতে হবে না? তাই তোমার কানটা একটু—”
চারু হাত দেখিয়ে মৃদু স্বরে চেঁচিয়ে উঠলো,
— “এই থাম, ফাজিলের দল! কান পরিষ্কার করছিলি না সুড়সুড়ি দিচ্ছিলি?”
দু’ ভাই হেসে উঠলো কিছু না বলে। সেই সুন্দর হাসির দিকে তাকিয়ে চারু রাগতে গিয়েও আর পারলো না। তবুও সেটা ওদের বুঝতে না দিয়ে চেহারায় কপট একটা গাম্ভীর্য ধরবার প্রয়াস চালালো। নয় তো এরা যা বিচ্ছু, ওর দুর্বলতা ধরে ফেললে আরও বেশি বlদমাlয়েশি করবে! বললো,
— “কি জন্য এসেছিলি তোরা? ডাকছিলি কেন?”
হাসি থামিয়ে রিংকুর জবাব,
— “সৌভিক ভাইয়া সবাইকে নিয়ে তিস্তার পাড়ে বেড়াতে যাবে বলেছে। তাই তোমাকে ডাকতে এলাম।”
— “সবাই বলতে?”
চারু জিজ্ঞেস করে। টিংকুর চটপট প্রত্যুত্তর,
— “সবাই বলতে সবাই। আমাদের সবক’টা ভাই-বোন। তবে বড়রা কেউ যাচ্ছে না। ওরা কেউ গেলে আমরা যেতে রাজি হতাম না-কি? গিয়েই বলবে, এটা করিস না, সেটা করিস না। দুনিয়ার রেlস্ট্রিকlশন!”
শেষের কথা বলবার সময় ওর চেহারার বিরক্তি ভাব লক্ষ্য করলো চারু। একহাতে ওর কান মুচড়ে বললো,
— “তারা মনে হয় ওসব এমনি এমনি বলে? তোমরা যেন খুব সাধু?”
— “আহা, বড়’পা। ব্যথা লাগছে তো!”
হাত ছাড়িয়ে নিতে চায়। চারু হেসে ছেড়ে দিতে দিতে শুধায়,
— “তাহলে বল, আজ কোনো দুষ্টুমি করবি না? কোনো রকমের দুর্নাম শুনলে কিন্তু বাড়ি এসে চাচাকে বলে দেব!”
— “আচ্ছা, আচ্ছা। সে দেখা যাবে!”
বলেই কান ডলতে থাকে। যদিও চারু অতো জোড়ে ধরে নি। কিন্তু টিংকু ঢং করেই বলে,
— “আগে তুমি ভালো ছিলে। এখন তুমিও বদ হয়ে যাচ্ছো, সুযোগ পেলেই মাসুম বাচ্চাগুলোকে ধরো! হুহ!”
চারু হেসে বিছানা ছাড়লো। বাইরে যাবার জন্য ড্রয়ার থেকে জামা-কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে গেল তৈরি হতে। রিংকু – টিংকু ততোক্ষণে বসে বসে বড়’পার ফোন ঘাঁটায় ব্যস্ত!
**********
বিকেলের দিকে অরুণা ম্যানশন থেকে তেরোজনের একটা গ্রুপ বেরোল তিস্তা পাড়ে বেড়াতে যাওয়ার জন্য। কবির আর কাব্য ছাড়া গ্রুপের সবগুলোই ব্যাচেলর। এতোগুলো মানুষ কীভাবে যাবে? দফায় দফায় রিকশা ঠিক করা হলো। কবির আর কাব্য দু’জনেই তাদের যার যার বৌ বিয়ে বাইক ছুটিয়ে চললো। বাকিগুলো ধীরে-সুস্থে আসতে থাকলো সুবিধা মত।
নিখিল তৈরি হয়ে বেরিয়ে বাগানে পায়চারি করছে। বাইরে সৌভিক তার বোনদের নিয়ে ব্যস্ত। কি যেন নাম ওদের, ঋতু ইরা, আর ইমা বোধ হয়। ওদের জন্য রিকশা ঠিক করছে। কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে না বিধায় দাড়িয়ে আছে রাস্তায়। অদূরেই দুই জমজ ভাই গুজগুজ করছে বসে বসে। এতো মানুষের মাঝে নিখিলের দু’ চোখ যে নারীর প্রিয় বদন দেখবার অপেক্ষায় চাতকের মতো চেয়ে, তারই দেখা নেই!
চারু এখনো আসে নি। আচ্ছা, কেন আসে নি? সে কি যাবে না? তাকে কি জানানো হয় নি? তবে?
রিংকু – টিংকু দুই ছটফটে ধরনের ছেলে, তাদেরও প্রস্তুত হতে মিনিট পাঁচেকের বেশি লাগে নি। তৈরি হয়েই ওরা নেমে পরেছে অভিযানে। দখিন হাওয়ায় বসে দুজন লক্ষ্য রাখছে নিখিলের উপর। বাজের শাণিত নজরে নজরবন্দি করে রেখেছে ওকে!
রিংকু বললো,
— “আমার মনে হচ্ছে তুই বেশি বেশি ভাবছিস, ব্যাপারটা মোটেও এমন না। তোর ভুল হচ্ছে।”
টিংকু তার যুক্তিতে অটল,
— “কাউকে দেখেই কিছু ধারণা করা ঠিক না রে, পাগলা! চোখের দেখায় ভুল আছে। সেজন্য গভীর ভাবে ভাবতে হয়। নিখিল ভাইকে আমি সেভাবেই দেখছি। দেখেই বুঝেছি, ডাল মে কুচ কালা হ্যায়!”
— “তেরা মাথা ভি ডাল হ্যায়!”
রাগ করে ছেলেটা। টিংকু অভিজ্ঞ ব্যক্তির মতো হাসে। ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আদেশি সুরে বলে,
— “শোন, আজকেই আমি তোর কাছে প্রমাণ করে দেব সবকিছু। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, নিখিল ভাই বড়’পাকে লাইন মারছে। আগে ভেবেছিলাম, ঋতু’পার পেছনে, পড়ে ভালো করে বুঝলাম তা নয়। চারু’পার পিছে পড়েছে এই ব্যাটা!”
— “কি করে প্রমাণ করবি?”
অনেকটা রাগত স্বরেই বললো। টিংকুর এই জ্যাঠামি ওর ঠিক ভালো লাগছে না। জানা নেই, শোনা নেই — এমনি একটা কথা!
প্রত্যুত্তরে বাঁকা হাসে টিংকু। শার্টের গলায় ঝুলতে থাকা কালো রোদ চশমাটা তুলে ফুঁ দেয় তাতে। দারুণ একটা ভাব নিয়ে সেটা চোখে পড়তে পড়তে বলে,
— “আগে আগে দেখো হোতা হ্যায় কেয়া!”
পরপরই বেরিয়ে আসে দখিন হাওয়ার থেকে। অগত্যা রিংকুও ভাইকে অনুসরণ করে।
ইমাদের রিকশায় তুলে দিয়ে ভেতরে ফিরে আসে সৌভিক। নিখিল তখনো একা দাড়িয়ে। এসেই হাঁক ছাড়ে ছেলেটা,
— “কি রে, চারু এখনো এলো না? এ্যাই চারু? তাড়াতাড়ি আয়! আর ওই বিচ্ছু দুটো কই? এ্যাই রিংকু? টিংকু?”
— “আসছি, ব্রাদার। টেনশন নট!”
বলেই হেলেদুলে আসতে থাকে দুই ভাই। তার ঠিক মিনিট দুয়েক পরেই দেখা মিলে চারুলতার। সাদা আর পার্পলের মিশেলে সাদামাটা একটা শাড়ি পরনে মেয়েটার। মাথায় শাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে পরা হিজাবে মেয়েটার চেহারায় অন্যরকম স্নিগ্ধতা খেলা করছে। বড় বড় পা ফেলে ত্বরিতে কাছে এসে দাড়ায় চারু। ভাইদের উদ্দেশ্যে বলে,
— “স্যরি, সৌভিক ভাইয়া। বড় ফুপু ডেকেছিল বলে দেরি হয়ে গেল। তুমি রাগ করো না।”
রাগ? তাও করবে সৌভিক, চারুর উপর? ওর এই শুভ্র-নির্মল দেবীর মতো সুন্দর মুখটির দিকে চেয়ে সে কখনো রাগ করতে পারে? সে তো কিছুক্ষণের জন্য কথা বলতেই ভুলে গেল। পাশে দাড়ানো নিখিলের অবস্থাও ব্যতিক্রম নয়। সেও চারুর লাবণ্যময়ী রূপের ঝলকানিতে মুগ্ধ, বিমোহিত!
রিংকু – টিংকুর চিৎকারে চটকা ভাঙলো ওদের,
— “আরে বড়’পা! কি দারুণ লাগছে তোমায়! উফ্, তোমাকে তো কোত্থাও নিয়ে যাওয়া যাবে না। লোকে দেখলেই নিতে যেতে চাইবে!”
বলেই ছুটে গিয়ে দু’ জন হাত ধরলো ওর। চারু হেসে কথা বলতে লাগলো ওদের সঙ্গে। নিজেকে ধাতস্থ করে সৌভিকও তারা দিলো ওদেরকে,
— “এ্যাই, চল। চল। রিকশা ঠিক করা হয়েছে। চারু আর তোরা দু’জন এক রিকশায়। একজন উপরে উঠবি। আর নিখিল, আমি পেছনের রিকশায় আসছি!”
*******
হেমন্তের বেলা। নদীতে পানির প্রবাহ কম। চর জেগেছে স্থানে স্থানে। সেই চরের উপর খুব লোকে সবজি চাষ করেছে। মিষ্টি কুমড়া, বাদাম, আর কিছু সবুজ শাক-পাতা। নদীর বেশি গভীর অংশটুকুতেই শুধু পানি বিদ্যমান। দু’একটা ইঞ্জিনচালিত নৌকা তাতেই ঘাট বেঁধে দাড়িয়ে। যাত্রী পারাপার করবে, নয় তো নদীতে ঘুরিয়ে আনবে!
চারুরা নামতেই ইমাদের সঙ্গে দেখা হলো। সময়টা হেমন্ত হলেও এখনো কাশফুল ফোটে। নদীর পাড়ের একদিকে বেশ বড় এক ফাঁকা জায়গায় সেরকমই এক কাশবাগান। ইমারা ছুটে এলো বড় বোনকে দেখে। তাকে বগলদাবা করে ফের ছুটলো, কাশবাগানের দিকে। ছবি তুলতে হবে তো!
ছবি তোলার পর্ব শেষ হতেই ভাইদের ডাক পড়ে। অদূরেই একটা ফুচকার স্টল আছে। আজ সবাইকে ফুচকা খাওয়াবে সৌভিক। প্রস্তাব শুনেই হৈহৈ করে ওঠে রিংকু – টিংকু, ইরা, ঋতুরা। ভাবীরাও বেশ সায় দেয়। একমাত্র নির্বিকার থাকে চারু। ফুচকা তার পছন্দের নয় বলে!
একে-একে অর্ডার দেয়া সবগুলো প্লেট এসে হাজির হয়। যে যারটা নেবার পর দেখা যায়, দুটি হাত খালি। চারু নেয় নি। নিখিলও নয়। নিজের ভুলটা বুঝতে পেরে ওদের কাছে মাফ চায় সৌভিক। তার একটুও মনে ছিল না এ-কথা। ওদের জন্য আলাদা করে চটপটির অর্ডার করে অপেক্ষা করতে বলে। চারু হেসে সায় দেয়। কিছুক্ষণ নীরবে হাঁটতে বেরিয়ে আসে দোকান থেকে।
এখন প্রায় সন্ধ্যা। ডুবুডুবু সূর্যটা পশ্চিমে, রlক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। নদীর ওই পাড়ে, দূরের গাছগুলোকে দেখাচ্ছে কালচে কালচে। ইতোমধ্যেই জ্বলে উঠেছে সড়কের বাতিগুলো। ব্রিজের নিচে, সড়ক সেতু থেকে রেল সেতুতে যাওয়ার কংক্রিটের পথটায় দাড়ানো চারু। নিরিবিলি সন্ধ্যের বাতাস গায়ে মাখছে। হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন বলে উঠলো,
— “কি করছেন, চারুলতা?”
ফিরে তাকালে আবছা আলোয় নিখিলকে চোখে পড়ে ওর। লোকটা না ভেতরে ছিল? এলো কখন? অবাক হলেও তা প্রকাশ না করে বলে,
— “কি করবো বলুন, দাড়িয়ে দাড়িয়ে বাতাস খাওয়া ছাড়া?—”
— “ফুচকা তো জুটলো না কপালে!”
ওর অর্ধসমাপ্ত কথাটা শেষ করে দিলো নিখিল। তারপরেই হেসে উঠলো হো হো করে। চারুও হাসলো, তবে মার্জিত হয়ে। ঠোঁট নাড়িয়ে। একটুপর নিখিল বললো,
— “তা কি করা হয় আপনার? পড়ালেখা? না চাকরি?”
নদীর দিকে তাকিয়ে ছিল চারু। সেভাবেই উত্তর দিলো,
— “আপাদত অনার্স শেষ করেছি। মাস্টার্সে ভর্তি হওয়া বাকি। আপনি? সৌভিক ভাইয়ার কলিগ তো, না?”
— “হুম। বেশ জানেন দেখছি!”
মাথা ঝাঁকায় নিখিল। চারু একঝলক চেয়ে মুচকি হাসে। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে নিতে শুধায়,
— “একা এসেছেন কেন? ভাবীকে আনলেই পারতেন। অনুর বিয়ে ছিল, আনন্দ হতো।”
ঠোঁটের হাসি চওড়া হয় নিখিলের,
— “আনা যেত অবশ্য। কিন্তু কি করব বলুন? তার সঙ্গে যে এখনো পরিচয়ই হলো না।”
— “মা-নে?”
অবাক চোখে তাকাতেই হঠাৎ বুঝে ফেলে লজ্জিত গলায় বললো,
— “দুঃখিত, আপনি অবিবাহিত ভাবি না।”
— “ভাববেন না কেন? সৌভিকও তো ব্যাচেলর!”
— “না, মানে। ভাইদের সবার বন্ধু-বান্ধবরাই বিবাহিত তো। তাই—”
মাথা নোয়ায় চারু। নিখিল আর কিছু বলবে তার আগেই সেখানে এসে হাজির হয় দুই বিচ্ছু। রিংকু – টিংকু এসেই চেঁচায়,
— “ট্যান ট্যানান। আপা! তোমাদের চটপটি রেডি। চল, চল।”
বলেই ওর দু’হাত ধরে দুজন দুপাশে টানতে থাকে। চারু ওদের বুঝিয়ে নিরস্ত্র করে,
— “একটু পর যাচ্ছি। তোরা যা।”
দুজনেই মাথা নাড়িয়ে দিরুক্তি জানায়,
— “না, না, না। তোমাদের তো ফেলে যাওয়াই যাবে না!”
চারু ভ্রু কুঁচকায়,
— “কেন?”
কেউ কোনো উত্তর দেয়ার প্রয়োজন মনে করে না। চারুর হাত ছেড়ে দু ভাই এগোয় নিখিলের দিকে। নদীর পানি নিয়ে গম্ভীর মুখভঙ্গি করে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা শুরু করে দেয় ওর সঙ্গে। সারাবছর বইখাতার আশেপাশে না গিয়েও দুজন, তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে হাজারটা কথা কি অবলীলায় বলে যাচ্ছে। বলছে, ফারাক্কা বাঁধ থেকে শুরু করে নানা রকমের নদী বন্দর নিয়ে আলাপ। নিখিলকেও দেখা গেল সেই সকল আলোচনাকে গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে। আকস্মিক, হাওয়া পাল্টাতে দেখে চারু অবাক হয়। ওদের হাবভাব বুঝতে পারে না। হঠাৎ কি হলো? তার সঙ্গে দুষ্টুমি করতে করতে আবার, দেশের আলোচনায় ঢুকে গেল কেন দুই বিচ্ছু?
ওর বিস্ময়ের রেশ ছাড়ায় তখন যখন দেখে, রিংকু – টিংকু খুব দ্রুতই প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলে। নদীর পানির গুরুত্ব থেকে ওরা এগোয় সাঁতারের দিকে। ছেলেবেলায় নদীতে গোসলের গল্প বলে নিখিলকে। সেও মনোযোগ দিয়ে শোনে। একটুপর দেখা যায়, দু’ বlদমাশ কি কি ভুজুং-ভাজুং বুঝাচ্ছে নিখিলকে এই ভর সন্ধ্যায় পানিতে নামবার জন্য,
— “বুঝলে ভাইয়া, আমার খুব শখ। চল না, নামি? সৌভিক ভাইয়াকে এর আগেও বলেছিলাম, ভাইয়া রাজী হয় না। ও একটা আস্ত ভীতু। আরে বাবা সন্ধ্যা হয়েছে তো কি? নদীতে নামা যাবে না? আরে — ”
— “হ্যাঁ, চাইলেই অবশ্য নামা যেত। কিন্তু প্রিপারেশন নেই নি যে?”
— “ওটা কোনো ব্যাপার না। তুমি চাইলেই হবে। আসলে আমাদের দুই জনের খুব ইচ্ছে ছিল একদিন বিকেলে এসে নদীতে গোসল করে যাবো। কিন্তু সময়ের যে টানাটানি। স্কুল গিয়েই কুল পাচ্ছি না —”
মুখটা দুঃখী দুঃখী করে ওরা। ভাইদের মতলব বুঝে পেরে আঁতকে ওঠে চারু। চোখ বড় বড় করে ওদের দিকে তাকায়। রিংকুর হাত চেপে ফিসফিস করে বলে,
— “তোদের মাথা ঠিক আছে? কি করতে চাইছিস কি তোরা?”
টিংকু তখনও নিখিলের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত। ওকে ভুলিয়ে কিভাবে নদীর পানিতে চুবানো যায়, সেই চিন্তায় মস্তিষ্কে চলছে। ভাইয়ের দিকে একপল চেয়ে চোখ টিপে দেয় রিংকু,
— “আহ্ হা। আপা! মজা দেখই না! নিখিল ভাই তো আস্ত হাঁদারাম! এক্ষুনি লাফিয়ে পড়বে—”
— “খবরদার, রিংকু! তোদের কিন্তু দুষ্টুমি করতে মানা করেছি। আমি কিন্তু ছোট চাচাকে সব বলবো!”
— “তুমি দেখই না, বড়’পা! মজা হবে তো!”
চারু হতভম্ব হয়ে যায়। তার আগেই বোঝা উচিৎ ছিল, এই দুই বিচ্ছু ঠিক কী পরিমাণ বাঁদর! সে তৎক্ষণাৎ কান মুচড়ে ধরে রিংকুর, ওকে সহ এগিয়ে যায় নিখিলের দিকে। হড়বড় করে বলে,
— “নিখিল সাহেব, শুনুন? আপনি এই বদমায়েশ দুটোর কথা শুনবেন না প্লিজ! ওরা কিন্তু আপনাকে পানিতে চুবিয়ে ছাড়বে। প্লিজ, নিখিল সাহেব। শুনুন আমার কথা!”
হঠাৎ চারুর এমন ব্যাকুলতা টিংকু ভড়কায়। বড়’পাটা কি? একটু মজাও করত দেবে না? আর কিছু ভাববার আগেই চারু এসে অন্য হাতে কান মুচড়ে ধরে ওরও। বলে,
— “তোরা এত ফাজিল? আজ বাড়ি যাই শুধু, তোদের হবে! দিন-কে-দিন বেয়াদব হচ্ছিস! নিখিল সাহেব, আপনি চলুন। এদের বিচার হবে।”
দু হাতে দুজনের কান ধরে চারু এগোতে থাকে। নিখিলেরও তখন হুশ হয়। কি বোকামিটাই না করতে যাচ্ছিল সে? আসলে সৌভিক ঠিকই বলে, এই দুই ভাই আস্ত ফাজিল! তাকে কীভাবে ভুলিয়ে – ভালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। আর সেও কি বোকা!
চারুর সামনে নিজের বোকামি প্রকাশ পেয়ে যাওয়ায় ভীষণ লজ্জিত হয় নিখিল। কিছু না বলে সরে আসে।
একটু দূর যাবার পরেই বোনের কাছ থেকে নিজেদের কান উদ্ধার করে রিংকু – টিংকু। বড়’পা বেশ ক্ষেপে আছে। তারমানে বাসায় গিয়ে সত্যি সত্যিই বাবার কাছে নালিশ দিয়ে বসবে! সেই ভয়েই হোক, বা অন্য কারণে দু’ভাই ওর হাত জড়িয়ে ধরে। নিজেদের কৃতকর্মের জন্য মাফ চাইতে থাকে। অন্যসময় হলে চারু ছেড়ে দিতো। কিন্তু এখন ছাড়তে চাইলো না। অপরিচিত একজন মানুষের সঙ্গে ওদের এই মজা ও ঠিক মানতে পারছিল না। এসব কি? নিখিলের সঙ্গে কেন ওদের এমন আচরণ? সবার সঙ্গে কি সবকিছু মানায়? সে তো এ-বাড়ির আত্মীয়!
যাহোক, নিখিলের হস্তক্ষেপেই শেষমেষ পরিস্থিতি সামাল দেয়া গেল। নিখিল নিজেই অনুরোধ করলো ওকে, কাউকে কিছু না বলবার জন্য। আর ওদেরও ছেড়ে দেবার জন্য। ছোট মানুষ দুষ্টুমি করতে গিয়ে করেছে, ছেড়ে দেয়াই ভালো। শুধু শুধু সিনক্রিয়েট করা!
চারু ছেড়ে দিলো বটে। কিন্তু খুব রাগ করলো ওদের উপর। এতটা সে আশা করে নি। রিংকু – টিংকুকে দাড় করিয়ে সে বকাঝকা করতে লাগল। এমন কেউ করে? ফাজলামির একটা সীমা থাকা উচিৎ!
হঠাৎ বিপরীত দিক থেকে আসা এক দম্পতিকে চোখে পড়তেই মুখের কথা বিলীন হলো চারুর। থমকে যাওয়া চাহনিতে তাকালো সে অনিমেষ। নিখিল ওদের গিহয়ে কি যেন বলছিল, সেসব আর কানে এলো না। নিরুত্তর চারুর হতবিহ্বল দৃষ্টি তখনো সম্মুখে। মুখ তুলে বড়’পার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকাতেই নিজেরাও দেখতে পেল রিংকু – টিংকু; সেই দম্পতিকে। কালো পাঞ্জাবি পরনে লোকটা, সঙ্গে কালো শাড়ির আব্রুতে ঢাকা রূপসী নারী। গোল-গাল মুখচ্ছবিতে হাসি লেপ্টে; সঙ্গের পুরুষের বাহুতে মাথা ঠেকানো। দু’জনের মুগ্ধ দৃষ্টি, শুধু দু’জনাতে নিবদ্ধ!
দেখতে দেখতেই ওরা এগিয়ে এলো। ওদের প্রায় কাছাকাছি। এতক্ষণে চারুকে খেয়াল করলো ওরা। নিমিষেই হাসিমাখা মুখ দু’টোতে কালো ছায়া নামলো। তথাপি সৌজন্যতার খাতিরে পুরুষটি শুধায়,
— “কেমন আছ, চারু?”
ধ্যান ভাঙে চারুর। হতবাক চোখে সে খুব কাছ থেকে দম্পতিটিকে দেখে, অবলোকন করে তাদের শক্ত হাতের বাঁধন আর হাসি হাসি চেহারা। পুরোনো স্মৃতির দুয়ারে আঘাত হানে যেন কিছু, পলকেই ঝাপসা হয়ে আসে চোখ। নেহাৎ সৌজন্যের ধারও ধারে না সে, প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই হঠাৎ উল্টো ঘুরে হাঁটতে শুরু করে!
চলবে___
#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_১২
সন্ধ্যা থেকে চারুর ঘরের দরজা বন্ধ। কেউ তাই চেয়েও আসতে পারছে না ভেতরে। একা একা মেয়েটা কি করছে কে জানে? মা-চাচীরা দফায় দফায় ডেকে যাচ্ছে। কোনো সাড়াশব্দ নেই। চারুর এই নিশ্চুপ-নির্বিকার অবস্থা যেন ওদের ভয় বাড়িয়ে দিচ্ছে। দুশ্চিন্তার পাহাড় জমছে বুকে। না জানি, কি করছে মেয়েটা!
বড়’পার ঘরের দরজায় দাড়িয়ে রিংকু – টিংকু। না, আপাকে বিরক্ত করবার কোনো মতলব নেই ওদের। বরং পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য তারাও প্রচেষ্টা। অন্যদের মতো এসেই নরম সুরে আপাকে ডাকা, দরজায় টুকটুক শব্দ করা — কোনোটাই ওরা করে নি। নিঃশব্দে দাড়িয়ে আছে দু’জনে। দেয়ালে কান পেতে রিংকু শুনবার চেষ্টা করছে সূক্ষ্ম কোনো আওয়াজ। দীর্ঘক্ষণ হলো এরও কোনো হেলদোল নেই। অধৈর্য হলো টিংকু। ভাইকে ঠেলা মেরে বললো,
— “কি রে? কিছু পেলি? ভেতর থেকে কোনো আওয়াজ আসছে? বড়’পা কাঁদছে নাকি?”
অসহায় শোনায় কণ্ঠ। ওর দ্বিধান্বিত উত্তর,
— “বুঝতে পারছি না। থাম!”
বিরক্ত চোখে রয় টিংকু। একথা খুব সত্য যে, তারা দু’টি ভাই এ বাড়ির সক্কলকেই জ্বালিয়ে ওস্তাদ, চারুও ব্যতিক্রম নয়। বরং বলা চলে, একটু বেশি মোলায়েম আর শান্ত-শিষ্ট স্বভাবের জন্য চারুকেই ওরা জব্দ করে মজা পায়। চারু’পা ওদের বকে না, মারে না, বড়দের কাছে নালিশও দেয় না। শত দুষ্টুমির বদলে হঠাৎ কানটা মুচড়ে একটু রাগ করে। এরকম মানুষের উপর উপদ্রব না করে ওরা করবে কাকে? তাই তাদের অধিকাংশ বদমায়েশি, দুষ্টুমি, পাকামো করে করা এক্সপেরিমেন্ট তথা অকাজের জন্য চারুই উপযুক্ত। কিন্তু এরসঙ্গে এ-কথাও সত্য যে, দুষ্টুমি করুক আর যাই করুক চারুকে ওরা ভালোবাসে। প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে। ওদের করা সকল অপরাধ, সকল দোষ-ত্রুটির উর্ধ্বে গিয়ে এই সত্য, সবচে’ বড় সত্য!
বিরক্তিটা রাগে রূপান্তরিত হতে সময় লাগে না বেশি। জমজকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে ত্যক্ত গলায় বলে,
— “সর তো। ঘণ্টা ধরে দাড়িয়ে থাকলেও তুই কিছু বুঝবি না।”
আকস্মিক ধাক্কা খেয়ে টাল সামলাতে না পেরে দু’ পা পিছিয়ে যায় রিংকু। রাগ করে ভাইয়ের দিকে তাকায়। কিন্তু ওকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে টিংকু কান পাতলো দেয়ালে। মিনিট দুয়েকের নীরবতার পর একটা মিহি সুর কর্ণকুহরে প্রবেশ করলো তার। খুব চিকন সেই সুরের সাথে কান্নার সূক্ষ্ম ধ্বনি! ব্যাপারটা আবিষ্কার করে গভীর বেদনায় বুক ভরে এলো ওর। বড়’পা কাঁদছে! কাঁদতে কাঁদতেই তার প্রিয় গানের সুর তুলছে ঠোঁটে। আহা রে, কি অসীম কষ্ট তাদের প্রিয় আপার!
ছলছল চোখে অধীর আগ্রহে চেয়ে থাকা রিংকুর দিকে ফিরলো। অস্পষ্ট স্বরে উচ্চারণ করলো,
— “আপা, খুব কষ্ট পেয়েছে রে। কাঁদছে একা একা!”
কথাটা শুনে আপনাপনিই ঝাপসা হয়ে এলো চোখ। মুখ কুঁচকে অবরুদ্ধ কান্নাটা আটকে অন্য দিকে ফিরলো রিংকু। বড়’পার জন্য তার বুকটাও পুড়ছে ভীষণ! আপা’টা এত্তো ভালো, তবুও তার এতো দুঃখ কেন?
দু’ ভাই বাষ্পচোখে একে অপরের দিকে চেয়ে, হঠাৎ চটকা ভাঙলো বড় ফুপু আলেয়ার কণ্ঠে,
— “এখানে কি করছিস তোরা? সন্ধ্যাবেলায় পড়া নেই?”
বড় ফুপু প্রাইমারি স্কুলের মাস্টারনী। পড়ালেখা নিয়ে সবসময়ই জোর দেন ওদের। রাগারাগিও কম করেন না। তাই ওরা একটু ভয়ই পায় তাকে! সমীহও করে।
ফুপুর রাশভারী প্রশ্নের জবাবে ওরা মাথা নুইয়ে দাড়িয়ে রইলো। উত্তর দিলো না। ফুপু অবশ্য সে অপেক্ষাতেও ছিলেন না; ওদের পড়তে বসবার হুকুম দিয়ে চারুর দরজায় করাঘাত করলেন সরাসরি,
— “চারু মা? দরজা খোল তো।”
কিছুক্ষণের জন্য একটি নারী কণ্ঠের গুনগুন, তারপর সব চুপ! একদম নিস্তব্ধ হয়ে রইলো। পরপরই চারুর কান্না ভেজা আওয়াজ পাওয়া গেল,
— “তুমি যাও ফুপু। আমি দরজা খুলবো না!”
বড় ফুপু আদর করে ডাকলেন,
— “তা কেন, মা? রাতের খাবার খাবে না? সময় গড়াচ্ছে তো!”
— “আমি আজ খাবো না। তুমি জোর করো না, ফুপু।”
— “আচ্ছা, আচ্ছা। খেতে হবে না। তুমি দরজাটা খোল। বেশিক্ষণ না আমি একটু কথা বলবো মাত্র। একটু?”
আহ্লাদ পেয়েও গললো না মেয়েটা। কান্না ভেজা কণ্ঠ, কিন্তু একটু জেদি,
— “প্লিজ ফুপু! তুমি যাও, না? আমার কিছু ভালো লাগছে না।”
— “তোমার কষ্টটাও আমার ভালো লাগছে না, চারু। বড় ফুপু ডাকছি, দরজাটা খোল? এবার না খুললে কিন্তু আমি কষ্ট পাবো!”
ভেতর থেকে আর কোনো কথা শোনা যায় না। বড় ফুপু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ফিরে তাকাতেই রিংকু – টিংকুকে পুনরায় চোখে পড়ে। ইশারায় ওদের চলে যেতে বলেন তিনি। অগত্যা দু’ ভাই মুখ লটকে পা বাড়ায় ঘরের উদ্দেশ্যে। তারপরেই দরজা খোলার আওয়াজ পাওয়া যায়। দোর খুলেই বড় ফুপুকে দেখে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে চারু। দু হাতে তাকে জড়িয়ে, তার মাতৃ সমতুল্য পরম নির্ভরযোগ্য বুকে মুখ গুঁজে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। কাঁদতে থাকে ছোট্ট শিশুটির মতো, যেমন শৈশবে কাঁদতো!
*******
বাড়ির পরিবেশ গুমোট। বিকেলে এক সঙ্গে সবগুলো ছেলেমেয়ে হুল্লোড় করতে করতে বেরিয়ে গেল, এলো কেমন মন খারাপ করে। বড়দের কারোরও মন বিশেষ ভালো নেই। সব নিশ্চুপ – নীরব। অদ্ভুত নিঃস্তব্ধতায় ঘেরা!
নিজের ঘরে চুপচাপ বসে আছে সৌভিক। মুখোমুখি বন্ধুবর নিখিল বসে, কিন্তু কোনো আলাপ হচ্ছে না। দুজনেই গভীর ভাবনায় নিমজ্জিত। একটুপর সৌভিকই প্রথম কথা বললো। শান্ত থাকতে থাকতে হঠাৎ অশান্ত হয়ে উঠলো ওর চিত্ত,
— “নিখিল, সত্যি করে বল তো! ওই শা* বাlটপাlর চারুকে কি কি বলেছে? হার্ট করেছে? আর ওর বৌটা? ঢং করছিস চারুর সামনে?”
‘শা* বাটপার’ বলে গালিটা কাকে দিলো তা বুঝতে অসুবিধে হয় নি ওর। ঠোঁট বাঁকা করে হাসবার চেষ্টা করলো; বললো,
— “এতো চটছিস কেন? ওরা কিছু বলে নি।”
— “চটব না, মানে? আলবৎ চটবো। শা* শয়**! চারুর মতো এতো ভালো একটা মেয়েকে ডিভোর্স দিয়ে ওর জীবনটা ধ্বংস করে দিলো, আর আমি চুপ করে থাকবো? পারলে, তক্ষুনি একটা ঘুষি মেরে ব্যাটার নাক ফাটিয়ে দিতাম আমি!”
সৌভিক রাগে গজগজ করতে থাকে। নিখিল হাসে। যুক্তি দিয়ে বলে,
— “এখন খুব রাগ দেখাচ্ছিস, ওকে পেলে মারতি। পাস নি, তাই আফসোস! কিন্তু কই, অনুলেখার বিয়েতে যে ও-বাড়ি গেলি তখন তো কিছু বললি না? তোর এত রাগ থাকলে তখন সবার সামনে ওকে পিটাতি?”
কথা সত্য। সৌভিক এখন যতটা ক্ষেপে আছে, রাগ দেখাচ্ছে, হম্বি-তম্বি করছে মাহতাবকে পিটানোর; কিন্তু সেসব আসলে আকাশে ছোঁড়া ফাঁকা গুলির আওয়াজ ছাড়া আর কিছু নয়। মাহতাবকে সে আগেও সামনে পেয়েছে। কারণে-অকারণে বহুবার দেখা হয়েছে কিন্তু কিছু বলে নি। আজও সেখানে উপস্থিত থাকলে কিছু বলতে পারতো না। হয় তো, ভবিষ্যতেও পারবে না!
সৌভিক নিরুত্তর রয়। চাপা ক্ষোভে ভেতরে ভেতরে ফুঁসতে থাকে। কিন্তু বাহিরে সেটা প্রকাশ করবার সুযোগ পায় না!
বন্ধুর ছেলেমানুষী রাগ দেখে নিখিল মনে মনে হাসে। তারপর হঠাৎ সে নিজেও খুব গম্ভীর হয়ে ওঠে। একটা গভীর ভাবনায় তলিয়ে যায় পুনর্বার!
সন্ধ্যায় তিস্তা পাড়ে বেড়াতে গিয়ে চারুর সহিত মাহতাব আর তার স্ত্রী মাহিয়ার দেখা হবার ঘটনাটা চারু নিজমুখে কাউকে জানায় নি। নিঃশব্দে সেখান থেকে প্রস্থান করে ভাইবোনদের আড্ডায় ফেরে। মাথা ব্যথার অজুহাত দেখিয়ে ওদের সবার কাছে অনুরোধ করে বাড়ি ফেরার। পুরো ঘটনা না জানায় কেউ দ্বিমত করে নি। কাব্য তার বাইকে করে ছোট বোনকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে। চারু ফেরবার পরপরই মাহতাবের কথাটা ভাইবোনদের সবার মাঝে চাউর করে দেয় রিংকু – টিংকু। সে কথা শুনে সবাই মোটামুটি অবাক হয়। খানিক দুঃখবোধ, খানিক ক্রোধ আর খানিক হতাশার আস্তরণ পরে মনে। এই যে অনুর বিয়েটা হলো, কতো আয়োজন, কতো কিছু, সেখানে চারুর সঙ্গে মাহতাবের দেখা হবার সুযোগ ছিল কতগুলো! দেখা হলে, চারু দুঃখ পাবে পরিস্থিতি সামলানো কষ্টকর হবে — সেরকম মানসিক প্রস্তুতি সবার নেয়া ছিল। বলতে গেলে, সেসব ভেবেই ওরা কেউ অনুর বিয়েতে কোনো প্রকার হৈ-চৈ করে নি। এমন কিছু করে নি যাতে মাহতাবের কথা চারুর স্মরণে আসে। অথচ আজ! সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ভাবেই মাহতাবের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল চারুর। দেখা হলো সেই অতীতের সঙ্গে, যাকে সে ফেলে এসেছে বহু আগেই! যাকে ফেলে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা করেছিল এতোগুলো দিন, কিন্তু দেখুন, নিয়তির পরিহাস কেমন? আমরা যাদের এড়াতে চাই জীবনে, তারাই আরও বেশি করে জুড়ে বসে!
বৃদ্ধ আহাদ রাজা নিয়মিতই তার পুত্র – পূত্রবধূদের নিয়ে সান্ধ্যকালীন চায়ের আসর জমান। আগে সেখানে নাতি – নাতনীগুলো যোগ দিলেও, লেখাপড়া আর চাকরির সুবাদে এখন আর কারো এই আসরে থাকা হয় না তেমন। চারুরা যখন বাড়ি ফিরলো তখন হামেশার মতোই বড়রা সবাই একসঙ্গে বসেছেন। মুড়িমাখা চিবনোর কচর-কচর শব্দ আর চায়ের কাপের টুং-টাংয়ে আড্ডা সরগরম। কথাবার্তা চলছে, মাঝে মাঝে উচ্চস্বরে হেসেও উঠছেন কেউ কেউ। সম্পূর্ণই নিজেদের মতো ছিলেন। কাব্যদের ওরা খেয়াল করে নি। তাই হয় তো অনাহুত প্রসঙ্গটা কখন উঠে ছিল কেউ ঠাহর করতে পারেন না।
বিকেলবেলা অনুর শ্বশুরবাড়ি থেকে কল এসেছিল। বেয়াই-বেয়াইন আজমীর রাজার পরিবারের খোঁজ-খবর নিচ্ছিলেন। তারই একফাঁকে খবরটা জানান। তাদের বাড়িতে খুশির জোয়ার এসেছে। ছোট ছেলের বিয়ের পরপরই আরও একটা সুসংবাদ তাদের পরিবারকে হাতছানি দিয়ে যাচ্ছে। তাদের বহুল আকাঙ্ক্ষিত একটি স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে, বাড়িতে আসছে নতুন সদস্য। কেননা, মাহতাবের স্ত্রী সন্তানসম্ভবা। আজ দুপুরেই ব্যাপারটা সম্পর্কে অবগত হয় তারা!
বাড়িতে সন্তান আসছে, এ অবশ্যই খুব ভালো খবর। আনন্দ করা উচিৎ, হৈচৈও শোভা পায়। খুশির ঠেলায় বেয়াইকে কল দিয়ে জানানোও হয় তো যায়; কিন্তু বেয়াই যদি হয় পুত্রের প্রাক্তন শ্বশুর তখন? এই অতি আনন্দের আতিশয্যে ত্বরিতে বেয়াই মশাইকে ফোনকলে মিষ্টি খাবার দাওয়াত দেয়া কতটুকু যুক্তিযুক্ত?
এই নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন আসাদ রাজা। অনুর বিয়ে ওই বাড়িতে দেয়া নিয়ে শুরু থেকেই তার ভেটো ছিল, তার প্রধান কারণ মাহতাব ছিল না বরং ও-বাড়ির মানুষগুলোকেও তার ব্যক্তিগত ভাবে অপছন্দ। তাদের রুচি, চালচলনের সঙ্গে যেন বেশ ফারাক আছে; সহজ ভাষায় ‘ওদের আচরণ যেন কেমন তর!’— এই ছিল তার অভিমত। অতএব, অনুর শ্বশুরের এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন ব্যবহারে তিনি বিরক্তি প্রকাশ করে কিছু বলছিলেন সভায়। পরিস্থিতি গরম ছিল, প্রসঙ্গক্রমেই অতীত ইতিহাস টেনে আনা হয়েছিল। ফাঁক তালে কখন যে আলোচনার মধ্যমণি ‘চারু’ এসে হাজির হয়েছে এবং না চেয়েও সবটা ওর কানে গেছে তারা টেরও পায় নি!
চলবে___
#মৌরিন_আহমেদ