এই মন তোমাকে দিলাম পর্ব-১৭

0
2680

#এই_মন_তোমাকে_দিলাম
#পর্বঃ১৭
#Arshi_Ayat

একসপ্তাহ হয়ে গেছে আকাশের সাথে নাতাশার কোনো যোগাযোগ নেই।থাকবেই বা কিভাবে বিয়ের পরের দিনই নাতাশা আর ওর স্বামী হানিমুনে চলে গেছে।আকাশ অনেকবার চেষ্টা করেছিলো নাতাশার সাথে কথা বলার কিন্তু নাতাশা সেই সুযোগই দেয় নি।চলে গেছে।আজ একসপ্তাহ ধরে আকাশ নিজের রুমের দরজা বন্ধ করে পড়ে আছে।কয়েকবার আত্নহত্যাও করতে চেয়েছিলো কিন্তু পারে নি।এখন কারো সাথে কথাও বলে না তেমন।ভেতরে ভেতরে তীব্র ভাবে অপরাধ বোধে জ্বলছে।এখন মনে হচ্ছে জীবনে সবচেয়ে বড় ভুল করেছে নাতাশাকে বিশ্বাস করা আর রুহির ভালোবাসাকে অপমান করা।কিন্তু এখন আর কিছুই করার নেই রুহির সাথে ওর ডিভোর্স হয়ে গেছে আর ও কখনো আকাশকে মাফ করবে না সেটা আকাশও জানে তবুও একবার মন বলছে রুহির কাছে ক্ষমা চাইতে।কিন্তু কোন মুখে চাইবে!ওর সামনে দাড়ানোর মতো মুখও নেই।

আকাশের বুকের ভেতর প্রচন্ড যন্ত্রনা হয়।পুরোনো দিনের কথা মনে পড়ে যখন রুহি ছিলো ওর জীবনে নাতাশা নামের কোনো অস্তিত্ব ছিলো না।দিব্যি চলছিলো দুজনের সংসার।রুহির ভালোবাসায় নিজেকে ধন্য মনে হতো কিন্তু নাতাশা আসার পর চোখে কালো কাপড় পড়ে গেলো।রুহির পবিত্র ভালোবাসাগুলো চোখে পড়তো না।ন্যাকামি মনে হতো ওর ভালোবাসাগুলো।কতো মানষিক আর শারীরিক অত্যাচার সহ্য করেও রুহি পড়েছিলো।চেয়েছিলো থেকে যেতে কিন্তু নিজের গাফিলতির কারণে আজ রুহিও দূরে।আকাশের চোখ বেয়ে নোনাজলের ধারা বইছে।গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না।মনে হচ্ছে কেউ যেনো টুটি চেপে ধরে রেখেছে।কাঁদতে কাঁদতে চোখ লাল হয়ে গেছে।অসহায়ের চুড়ান্ত পর্যায়ে লাগছে নিজেকে।অসহ্য লাগছে নিজেকেই নিজের কাছে।একটা প্রচন্ড আত্মগ্লানিতে বারবার শিরা উপশিরা দগ্ধ হচ্ছে।ইচ্ছে হচ্ছে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে তবে যদি মুক্তি মেলে!
————————
ইদানীং প্রিয়ম রাত নয়টায় বাড়ি ফেরে।এইতো একসপ্তাহ ধরে এমন হচ্ছে।বাড়িতে ওর বাবা মা ভাবছে হয়তো কাজের চাপ কম সেইজন্যই তাড়াতাড়ি আসে কিন্তু ছেলের ভেতরে যে অন্যকিছু চলছে তার বাবা মা বুঝতে পারে নি।

আজও প্রিয়ম নয়টায় থানা থেকে বেরিয়ে পড়লো আর রুহি যেখানে দাড়ায় সেখানে গাড়ি থামালো।কিন্তু আজকে রুহিকে না দেখতে পেয়ে প্রিয়মের বেচারা মনের মন খারাপ হয়ে গেলো।দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের বাড়ির দিকে রওনা হলো প্রিয়ম। প্রতিদিন রাত নয়টার সময় বাড়ি ফেরার পথে রুহিকে দেখতে পায় সে এই জায়গায় প্রতিদিন এখন থেকে প্রিয়মের সাথেই সে বাড়ি ফেরে।কখনো কথার ঝুলি নিয়ে বসে আবার কখনো চুপচাপ গাড়ির কাচ দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রাতের আকাশ দেখতে দেখতে যায়।কিন্তু তার বিপরীত পাশের মানুষটা গাড়ি চালাতে চালাতে তাকে লুকিয়ে চুরিয়ে দেখে যে সেটা সে টের পায় না।রুহি নিজের বাড়ির সামনে নেমে গেলে বাকি রাস্তা প্রিয়মের মন খারাপ থাকে।মন বলে ‘এই পথ যদি না শেষ হয়,তবে কেমন হতো তুমি বলো তো?’

তবে মনের কথা মনেই রয়ে যায় যার জন্য এই আকুতি তাকে আর জানানো হয় না।মনে আক্ষেপ থেকে যায় ইশ!সে যদি জানতো!

আজকাল রুহিকে দেখলে মনের মধ্যে এক অজানা আকর্ষণ জাগে।মন হয় কতোটা সরলতা লুকিয়ে আছে মেয়েটার মাঝে।প্রিয়ম বুঝতে পারছে সেও বাদ যায় নি ভালোবাসার মরণ ছোবল থেকে।কিন্তু এ কথা তার সখীকে বলবে কিভাবে?আর বললেই বা কি সে মানবে?প্রিয়ম একটু চিন্তিত হলো।
তারপর ভাবলো কোনো একদিন এক আকাশ তারা আর একটা মুধময় চাঁদকে সামনে রেখে স্বীকার করেই ফেলবে ভালোবাসি!ভালোবাসি!ভালোবাসি!

প্রিয়ম এগুলো ভাবতে ভাবতে কবে যে বাসায় এসে পৌঁছুলো সে খবরই নেই তার।ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিচে নামতেই পায়েল চৌধুরী বললেন “প্রিয়ম শোন বাবু।এই ছবিগুলো দেখতো একটু।”

প্রিয়ম ভ্রু কুচকে বলল”কিসের ছবি মা?

“আরে তুই আগে দেখ তো!” এই বলে পায়েল চৌধুরী প্রিয়মের হাতে ছবিগুলো দিলে।প্রিয়ম ছবিগুলো নিয়ে দেখলে পাঁচটা মেয়ের ছবি।ছবিগুলো দেখে বলল”এই ছবিগুলো আমাকে দেখাচ্ছো কেন?”

“দেখ এর মধ্যে কাকে ভালো লাগে?”

“সবগুলোকেই তো ভালো লাগে।”

“প্রিয়ম ঠাট্টা করিস না।ভালোভাবে বল কাকে ভালো লাগে।আমরা তোর বিয়ের জন্য মেয়ে দেখছি।”

“ঠাট্টা না মা।সত্যিই আমার পাঁচজনকেই পছন্দ হয়েছে।পাঁচজনকেই বিয়ে করবো।তোমার যদি আমাকে বিয়ে করাতেই হয় তবে এই পাঁচজনের সাথে করাও।”এটা বলে প্রিয়ম গিয়ে সোফায় বসলো।

প্রিয়মের মা রেগে বলল” আমি মরলে তুই বুঝবি।এর আগে কখনো আমার কথার মূল্য দিবি না।”

এবার প্রিয়ম ওর সামনে গিয়ে দাড়িয়ে বলল”কি বলছো এসব মা?তোমার যদি আমাকে বিয়ে করাতেই হয় তবে আমার পছন্দমতো করাতে হবে।আমি একটা মেয়েকে ভালোবাসি।”

পায়েল বেগমের মুখে একটুরো সূর্যের আলোর ন্যায় হাসির ঝিলিক ঘুটে উঠলো।খুশীতে টগবগিয়ে প্রিয়মকে জিগ্যেস করলেন”কে রে সেই মেয়ে?”

“বলবো।তবে আমাকে আরো কিছুদিন সময় দাও।আমিই ওকে তোমাদের সাথে পরিচয় করাবো।কিন্তু এখন খাবার দাও।”

পায়েল চৌধুরী ছেলেকে ডাইনিং টেবিলে বসতে দিয়ে খাবার বাড়তে লাগলেন।তারপর নিজেও ছেলের পাশে বসলেন।আজকে মা আর ছেলে একসাথে খেতে বসলো।রাহাত চৌধুরী গতকাল ব্যবসার কাজে সিলেট চলে গেছেন।
——————–
অরুণী আজ প্রচুর রেগে আছে প্রণয়ের ওপর।বারবার না করা স্বত্বেও আজকে সকালে সে বৃষ্টিতে ভিজিয়ে জ্বর আনিয়েছে।সাথে ঠান্ডা কাশিতো ফ্রি!অরুণী প্রণয়ের মাথার পাশে বসে জলপট্টি দিচ্ছে আর মনেমনে ইচ্ছেমতো প্রণয়ের চৌদ্দগোষ্ঠি উদ্ধার করছে।আর বেচার প্রণয় জ্বরে কাঁপছে।অনেক্ক্ষণ জলপট্টি দেওয়ার পরও যখন জ্বর কমছিলো না তখন অরুণীর চিন্তা হতে লাগলো।অরুণী ওর ফোনটা হাতে নিয়ে ডাক্তার রশিদকে ফোন করলো।উনি সব শুনে বললেন সারা শরীর একবার মুছে দিয়ে মাথায় পানি ঢালতে।উনি বাসায় ফেরার সময় একবার প্রণয়কে দেখে যাবেন।ডাক্তারের কথা মতো অরুণী কাপড় ভিজিয়ে এনে প্রণয়ের মুখ,হাত,মা মুছে দিলো কিন্তু এখন সমস্যা হচ্ছে বুক মুছবে কি করে।ইতস্তত করতে করতে প্রণয়ের শার্ট খুলে বুক আর পিঠ মুছে দিয়ে আবারও শুইয়ে দিলো।এখন কিছুটা কম আছে জ্বর।একটু পর ডাক্তার রশিদ এসে ঔষধ দিয়ে গেলেন।ভাত খাওয়ার পর খাওয়াতে বললেন কিন্তু সন্ধ্যা থেকে একটু কিছুও প্রণয়কে খাওয়াতে পারে নি অরুণী।কিছু খাওয়াতে নিলেই নাকি তিতা লাগে।কি মসিবত!ডাক্তার চলে যাওয়ার পর অরুণী স্যুপ নিয়ে এলো।প্রণয়ের মুখের সামনে ধরতেই প্রণয় মুখটা সরিয়ে নিলো।অরুণী রেগে চোখ রাঙানি দিতেই প্রণয় কাদো কাদো গলায় বলল”তিতা লাগে।খাবো না।”

“না খেলে এক সপ্তাহ কথা বলবো না।” অরুণী এটা বলে টেবিলের ওপর স্যুপের বাটি রেখে দিলো।অরুণীর এমন কঠিন শর্ত শুনে প্রণয় ব্যাথাতুর মুখে বলল”আচ্ছা খাবো।কিন্তু অল্প!”

অরুণী টেবিলের ওপর থেকে স্যুপের বাটিটা নিয়ে প্রণয়কে খাওয়াতে লাগলো।প্রণয়ের অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে অরুণীর হাসি পাচ্ছে কিন্তু ও হাসছে না।প্রণয়কে ধমকে পুরো স্যুপ খাওয়ালো তারপর অ্যান্টিবায়োটিক খাইয়ে শুইয়ে দিলো।আর পাশে নিজেও শুয়ে পড়লো।অরুণীকে নিজের পাশে শুতে দেখে প্রণয় বলল”তুমি এখানে শুবে?”

“হ্যাঁ।এখানেই শোব।আপনি কথা না বলে ঘুমান।চুপচাপ ঘুমাবেন।যদি দেখি উঠে বসে আছেন তাহলে খবর আছে।”

“কিন্তু আমার তো ঘুম আসছে না।” প্রণয় করুণ স্বরে বলল।

প্রণয়ের কথা শুনে অরুণী ওর শিয়রে বসে পর মাথটা নিজের কোলে রেখে চুলে হাত বুলতে লাগলো।প্রণয় চোখ বন্ধ করে মুচকি হাসি দিলো।সেই সাথে অরুণীর ঠোঁটেও মৃদু হাসির ঝিলিক খেলে গেলো।অরুণী কখনো ভাবতে পারে নি এই মানুষটাই তার জীবনের সাথে জড়িয়ে যাবে যাকে একটা সময় পাত্তাই দিতো না।এখন সে তার স্বামী।প্রায় দেড় মাসের মতো প্রণয়ের সাথে থেকে অরুণীর ভালোবাসার ওপর হারানো বিশ্বাস আস্তে আস্তে জোড়া লাগছে।মনে হচ্ছে আসলেই ভালোবাসা বলতে কিছু আছে।
.
.
তবুও কোথাও একটা বাধা এসে আর বলা হয় না ভালোবাসি।মনে হয় বললেই হারিয়ে যাবে।অরুণীর ভয় হয়!যদি রুহির মতো ওর জীবনটাও তছনছ হয়ে যায় তখন!
———–
রোদের আলোর ঝিলিক খেলে যাচ্ছে প্রণয়ের চোখে মুখে প্রণয় এক হাত চোখের ওপর দিয়ে রোদটাকে আড়াল করে চোখ খুললো।তারপর উঠে বসতেই দেখলো অরুণী ওর পাশে নেই।প্রণয় বিছানা ছেড়ে কিচেনে গিয়ে দেখে তার হৃদয়ের রাণী রুটি বানাচ্ছে!প্রণয় অরুণীর পাশে এসে দাড়ালো।প্রণয়কে ওর পাশে দাড়াতে দেখে বলল”জ্বর কমেছে?”

“বুঝতে পারছি না।তুমি একটু দেখে বলো তো।”

অরুণী প্রণয়ের পায়ের ওপর দাড়াতেই প্রণয় অরুণীর কোমড় জড়িয়ে ধরলো।তারপর অরুণী প্রণয়ের কপাল ছুয়ে দেখলো জ্বর ছেড়ে দিয়েছে কিনা।কিন্তু প্রণয় সে খেয়ালে নেই তো ব্যাস্ত অরুণীকে দেখতে।হঠাৎ দরজায় বেল পড়ায় দুজনেই আলাদা হয়ে যায় আর প্রণয় দরজা খুলতে চলে যায়!!

চলবে…

(ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে