#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৫৯||
১২৩।
পুষ্প আর লিনাশা পদ্মের পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে আছে। পদ্মের দৃষ্টি নত। আহি দাঁড়িয়ে পদ্মের দিকে তাকিয়ে আছে। পুষ্প রাগী স্বরে পদ্মকে জিজ্ঞেস করলো,
“আহি যাকে ভালোবাসতো, সেই মানুষটা আফিফ ভাইয়া ছিলেন?”
লিনাশা বলল,
“ওকে আর কি জিজ্ঞেস করছিস। সবটাই তো পরিষ্কার। ও সব জেনেশুনে আহির ভালোবাসা কেঁড়ে নিয়েছে।”
“কীভাবে করলি এমনটা, পদ্ম? বুক কাঁপে নি তোর? ক্লাস থ্রি থেকে আমরা ফ্রেন্ড। কলেজ পর্যন্ত একসাথে ছিলাম।”
“শুধু বন্ধুত্ব না হারানোর জন্য আহি সেই কলেজে ভর্তি হয়েছে, যেই কলেজে পড়া তুই এফোর্ড করিস।”
“ছি! ছি! আমার রেজাল্ট ভালো এসেছিল। আমাকে বাবা ঢাকায় ভর্তি করাতে চেয়েছিল। লিনাশা আর আহির রেজাল্ট অনুসারে ওরাও ওখানে আসতো। শুধু তোর জন্য আমরা সেই কলেজে পড়েছি।”
“আমার মনে হচ্ছে, আমরা সেদিন বাবা-মার কথা মেনে নিলে, আহিকে কখনোই তার ভালোবাসার মানুষকে হারাতে হতো না। বন্ধুত্বকে বেছে নিয়ে এতো বড় ভুল করেছে মেয়েটা?”
পদ্ম নিরবে কাঁদছে। আহি তাদের কথার মাঝখানে এসে বলল,
“আমি পদ্মকে ক্ষমা করে দেবো।”
লিনাশা আর পুষ্প চোখ-মুখ কুঁচকে বলল,
“কখনো না। এর কোনো ক্ষমা নেই।”
আহি বলল, “করবো। কিন্তু এক শর্তে।”
পদ্ম কাঁপা কন্ঠে বললো, “কি শর্ত!”
“আমি আফিফকে ঠিক সেভাবেই পেতে চাই, যেভাবে আমার প্রেমের গল্পটা আমি সাজাতে চেয়েছিলাম।”
পদ্ম নিশ্চুপ। আহি আবার বলল,
“তুই আফিফকে সেখানেই ছেড়ে আয়।”
পদ্ম ভ্রূ কুঁচকে বললো, “মানে?”
“আহি পাগলের মতো ভালোবাসে তার এআরকে। আগেও ভালোবাসতো। এখনো ভালোবাসে। আমৃত্যু ভালোবাসবে। তুই হাসি-মুখে আফিফের কাছে সম্বন্ধ নিয়ে যাবি। তাও আমার বিয়ের।”
লিনাশা আহির বাহু ধরে বলল,
“এই মেয়েকে তুই আফিফের ব্রেইন-ওয়াশ করতে পাঠাচ্ছিস?”
“আফিফ যদি সত্যিই আমাকে ভালোবাসে, তাহলে কারো কথার জালে সে আটকাবে না। এবার আমার মায়ায় ওকে ছুটে আসতেই হবে।”
পদ্ম বলল,
“তুই আমাকে ক্ষমা করছিস, না-কি শাস্তি দিচ্ছিস, আহি।”
“সরি, আমাকে ক্ষমা করে দে, এই একটা বাক্যে কি আমি আমার দশ বছর ফিরে পাবো? চার বছরের এক তরফা ভালোবেসে যাওয়া, এরপর চার বছরের ট্রমা, তারপর এক বছর সামনা-সামনি তার সংসার দেখে যাওয়া, আর এরপর পাঁচ বছর এই ভেবে জীবন কাটানো যে সে আমাকে ঘৃণা করে। মোট দশ বছরের বিচ্ছেদ। চৌদ্দ বছরের একাকীত্ব। এতোগুলো সময় শুধু সরি, আমাকে ক্ষমা করে দে, এই এক বাক্যে শেষ হয়ে যাবে? তোকে সব দেখতে হবে। তুই আমার পাওয়া সব কষ্টকে সুখ হতে দেখবি। এটাই তোর ক্ষমা।”
আহি চলে গেলো। পদ্ম বউ সেজে অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে আছে এখনো। লিনাশা পদ্মকে বলল,
“আই হেইট ইউ। পলি আপু গ্রুপ এখানেই শেষ। তুই আমার বেস্টিকে কষ্ট দিয়েছিস। আমিও দিয়েছিলাম একটা সময়। কিন্তু আমার সিচুয়েশন এমন ছিলো না। আমার বাবা মারা গিয়েছিল। আমার কোনো ভাই নেই। আমি ছোট ছিলাম। মা অসুস্থ ছিল। মা বার-বার বলছিল, আহির সাথে বন্ধুত্ব রাখায় আমি আমার বাবাকে হারিয়েছি। ফ্রাস্ট্রেশনে ছিলাম আমি। তাই সব যোগাযোগ শেষ করে দিয়েছি। কীভাবে রাখতাম যোগাযোগ? আহির নতুন মা আমারই বড় আপু। কীভাবে বাবার খুনীর পরিবারের সাথে সম্পর্ক রাখতাম? কিন্তু এমন একদিনও যায় নি, যেদিন আমি আহিকে মিস করিনি। সবসময় চাইতাম, আহি যাতে মুভ অন করতে পারে। কারণ আমি জানি, ওর জীবনে আসা সব ট্রাজেডির চেয়ে ভয়ংকর ট্রাজেডি ছিল আফিফকে হারানো। যেই আঘাতটা তুই ওকে ইচ্ছেকৃত ভাবে দিয়েছিস। আর আমি তোর ভালোর জন্য আহিকে বলতাম, তোর সংসার যাতে না ভাঙে। তুই জেনে গেলে কষ্ট পাবি। বোকা আমি! একবার যদি সত্যটা জানতাম, তোকে খুন করে আহি আর আফিফের পথের কাঁটা সরিয়ে দিতাম। আই হেইট ইউ, পদ্ম।”
পুষ্প বলল,
“আমি তো আর ভাবতেই চাই না, তুই আমার বন্ধু ছিলি। না জানি কখন, কার বরের প্রেমে পড়ে তাকে জীবন থেকেই কেঁড়ে নিস।”
পদ্ম কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো,
“ভুল করেছি আমি। কিন্তু যা করেছি, আফিফকে পাওয়ার জন্য করেছি।”
“এখনো নিজেকে ডিফেন্ড করবি? তোর কাছে আশাও কেন করছি? অশিক্ষিত, মূর্খ তুই।”
পদ্ম বলল,
“যা বলার বল। আমি আফিফকে ভালোবাসি। এখনো ভালোবাসি। আমি কখনো চাইবো না, আহি আফিফের হোক। আর আমি আফিফকে রাজী করাবো না।”
“তোর রাজী করানো, না করানোতে কোনো যায় আসে না আহির।”
লিনাশা বলল,
“আহি যেটা চায়, সেটা তোর রাজী হওয়া না হওয়াতে নির্ভর করবে না। সেটা হয়েই যাবে। দুঃখের কথা কি জানিস? তুই আফিফকেই নয়, তিনটে ভালো বন্ধুও হারিয়েছিস। তোর মতো দুর্ভাগা যাতে কেউ না হয়! না আফিফ আছে, না বন্ধু আছে, না নৈতিকতা আছে, না সম্মান আছে, না একটা সন্তান আছে। তুই আলটিমেট লুজার। তাজওয়ার খানের মতো। তাজওয়ার তো অন্তত তোর চেয়ে একটু ভালো। সে যায় করেছে, আহির ক্ষতি করে নি। তুই তো আফিফকে বিক্রি করে দিয়েছিস। তার সম্মান, তার বোনের সম্মান সবটাই তাজওয়ারের হাতে তুলে দিলি। নিজেরটাও ছাড় দিলি না। জেনেশুনে আফিফকে খানস গ্রুপের কাজটা করতে দিলি। এখনো আফিফ লোন শোধ করছে। আসলে তোর মতো ইডিয়ট ভালোবাসারই যোগ্য না।”
১২৪।
আহি পদ্মের স্বামী বোরহান আলী হাতে একটা কার্ড এগিয়ে দিলো। পদ্ম স্বামীর পাশেই দাঁড়ানো। সে ভ্রূ কুঁচকে আহির দিকে তাকিয়ে আছে। পদ্মের স্বামী, বোরহান আলীর বয়স চল্লিশের একটু এপার-ওপার। কাঠ ব্যবসায়ী। যেখানে খুব একটা সুবিধা করতে পারছেন না তিনি। দুই সন্তানের পিতা। একটার বয়স সাত। অন্যটার বয়স এক। আহি বোরহান আলীকে বলল,
“আপনার ব্যবসা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। আপনি যদি এই কাজটা নেন, বেশ খুশি হবো।”
বোরহান আলী খুশিতে গদগদ। তিনি আহির এগিয়ে দেওয়া কার্ডটি নিয়ে বললেন,
“কাজটা কি!”
আহি মুচকি হেসে বলল,
“কক্সবাজারে আমার একটা বাংলো বাড়ি আছে। ওখানের জন্য একজন বিশ্বস্ত গার্ড লাগবে। নাইট গার্ড। আপনার থাকার ব্যবস্থা আমিই করে দেবো। বাকিটা আপনি চালাবেন।”
পদ্মের মুখ লাল হয়ে গেলো। বোরহান আলী বললেন,
“বেতন কতো!”
“মাসে ত্রিশ হাজার টাকা। ওভার টাইম করতে চাইলে বাড়িয়ে দেওয়া হবে।”
বোরহান আলী যেন আকাশ থেকে পড়লেন। তিনি সানন্দে রাজি হলেন। পদ্ম বলল,
“অপমান করছিস?”
বোরহান আলী ভ্রূ কুঁচকে পদ্মের দিকে তাকালেন। আহি বলল,
“আহি কাউকে অপমান করে না। সাহায্য করে। শোন কোনো কাজই ছোট না। মোজাম্মেল চাচা আমার খুব কাছের মানুষ ছিলেন। তিনি এখনো শক্ত থাকলে এই কাজ আমি উনাকেই দিতাম। তোর স্বামী আমার ভাইয়ের মতো। তার শিক্ষাগত যোগ্যতা অনুসারে এই কাজটা অনেক সহজ, আর এর বেতনও অনেক বেশি। সরাসরি কোম্পানিতে কাজ দিলে, খাটতেও হতো, এমপ্লয়িদের কথাও শুনতে হতো।”
বোরহান আলী বললেন,
“আমার এই কাজ খুব পছন্দ হয়েছে। আমি করবো কাজটা।”
আহি পদ্মের দিকে তাকিয়ে হাসলো। লিনাশা চাপা স্বরে আহিকে বলল,
“কেন দিয়েছিস উনাকে কাজ? মরুক না ও।”
“অভাব তো পদ্মের জন্য কিছুই না। পদ্মের অভাব তখন হবে যখন ভালোবাসার অভাবে তার হৃদয়ে খরা হবে। আমি যেভাবে দহন যন্ত্রণায় ছটফট করেছি, পদ্মকেও একই ভাবে ছটফট করতে হবে। তখনই আমি শান্তি পাবো। এবার সব ওর সামনে হবে। এবার ও আমার সংসার দেখবে।”
(***)
দুই দিন চট্টগ্রাম ঘুরে কক্সবাজার ফিরলো পুষ্প, আহি আর লিনাশা। নায়ীব লিনাশাকে দেখেই বলল,
“কেমন বউ তুমি, স্বামী-সন্তান ফেলে চলে গেছো।”
লিনাশা বলল,
“কেন? তোমার ছেলে তো তোমার সাথেই বেশি থাকে।”
লাবীব বলল,
“পিয়ালী তো ছোট। পুষ্প, তুমি তো আমার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিলে!”
পুষ্প বলল,
“এখন বুঝেছো, অফিস আর বাচ্চা একসাথে দেখা আমার জন্য কতোটা কষ্টকর? বাসায় এসে তো শুধু হাত-পা ছড়িয়ে টিভি দেখো। এসে তো রান্নাঘরে একটা প্লেট এগিয়ে দাও না।”
আহি বলল,
“হয়েছে হয়েছে। এতো অভিযোগ! আমি যদি সংসারী হয়, আমার বরকে শুধু রান্না করে খাওয়াবো।”
লিনাশা আর পুষ্প ভ্রূ কুঁচকে আহির দিকে তাকালো। আহি মুখ চেপে হাসলো। নায়ীব আর লাবীব বলল,
“শেখো কিছু আহির থেকে।”
লিনাশা বলল,
“খুব ফ্যান্টাসি লাগছে এখন! সংসার শুরু কর, তারপর বুঝবি।”
আহি নায়ীব আর লাবীবকে বলল,
“ফ্যান্টাসি তো আমার লাগবেই। রানীরা কি করে? রাজার আশেপাশে ঘুরঘুর করে। ঘরে হেঁটে সময় নষ্ট করে। কারণ তাদের কোনো কিছুর অভাব নেই। আল্লাহ আমাকেও কিছুর অভাব দেন নি। অভাব ছিল ভালোবাসার। জীবন যুদ্ধে নেমে পড়লে, একটা মেয়ে রানী হয়ে থাকতে পারে না। তাকে রানীর মতো রাখতে জানতে হয়। তারপরই একজন পুরুষ বিনা মুকুটে রাজা হতে পারে। আর রাজাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ মানায় না। ভাইয়ারা, অভিযোগ না করে, রানী করে রাখুন, দেখবেন রাজার হালে থাকবেন। একদিন না হয় সংসারটা একাই করলেন। অন্তত এটা তো বুঝলেন, আমার বান্ধবীদের ছাড়া আপনারা কতোটা ছন্নছাড়া।”
নায়ীব লিনাশার হাত ধরে বলল,
“লিনাশা তো আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ।”
লাবীব পুষ্পকে কাছে টেনে এনে বলল,
“সরি, বউ। বেশি বলে ফেলেছি। রাগ করো না। তুমি তো জানোই, তোমাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি।”
আহি দুই বান্ধবীর লাজুক হাসি দেখে মুচকি হাসলো। মনে মনে বলল,
“আমার তৃষাতুর কান তোমার মুখ থেকে ভালোবাসি শব্দটা শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে, আফিফ। কখন বলবে আমাকে ভালোবাসো?”
(***)
সালমা ফাওজিয়া মেয়ের হাত ধরে তাকে টেনে নিজের রুমে নিয়ে এলেন। ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন,
“হুট করে আমাদের এখানে ফেলে চট্টগ্রাম কেন গিয়েছিলে?”
“জরুরি কাজ ছিল।”
“তোমার সব জরুরি কাজ আমি মেনে নিয়েছি। তোমার সব আবদার আমি মেনে নিয়েছি। মা হয়ে কি আমার এতোটুকু অধিকার নেই? আমার একটা আবদার রাখা যাবে না?”
আহি মায়ের হাত ধরে বলল,
“কি বলছো তুমি? তুমি যা বলবে, আমি তা-ই শুনবো।”
“উজ্জ্বল ছেলেটা ভালো। তোমাকে অনেক সাহায্য করেছে। তাজওয়ার আর লাবণির বিরুদ্ধে কেইসটা ও নিয়েছিলো। তুমি রাজি হয়ে যাও, মা।”
“মা, আমি উজ্জ্বলকে বিয়ে করতে পারবো না।”
“তাহলে তোমার কি করতে ইচ্ছে করছে? বিয়ে না করে সারাজীবন এভাবেই থাকবে? ত্রিশ বছর চলছে তোমার। কয়েকমাস পর একত্রিশ হবে। এই বয়সে এসে তোমার জন্য আমি কোথায় যোগ্য পাত্র পাবো? একটাও তোমার মন মতো হয় না। আমি সারাজীবন বেঁচে থাকবো না। তোমার বাবা নেই। আমি ছাড়া তোমার কেউ নেই। তোমার মামাদের ভরসায় তোমাকে রেখে আমি শান্তিতে মরতে পারবো না। তুমি মা হলে, আমার চিন্তাটা বুঝতে।”
আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি বিয়ে করবো।”
সালমা ফাওজিয়া আনন্দিত কণ্ঠে বললেন,
“আমি তাহলে আমিনা আপার সাথে কথা বলি। বিয়ের কথা পাকাপাকি করে ফেলি?”
“না। আমি বিয়ে করবো বলেছি। উজ্জ্বলকে করবো বলি নি। তবে আমি উজ্জ্বলের সাথে কথা বলবো।”
“তুমি কি কাউকে পছন্দ করো?”
“হ্যাঁ।”
সালমা ফাওজিয়া মেয়ের থুতনি ধরে বললেন,
“আমাকে আগে বলবে না? কি করে ছেলেটা? দেখতে কেমন? পরিবার ভালো তো!”
“কি করে? দেখতে কেমন? পরিবার কেমন? এর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তোমার মেয়ের তাকে খুব পছন্দ। আমার পছন্দ কখনো খারাপ হয় না।”
“আলহামদুলিল্লাহ। বিয়েটা তাড়াতাড়ি হয়ে যাক। ছেলের মা-বাবা কেউ থাকলে নম্বরটা দাও। কথা বলি আমি। আর দেরী করো না। তোমার নানু বেঁচে থাকতেই বিয়েটা হয়ে যাক।”
আহি মুচকি হাসলো। মনে মনে ভাবলো,
“এতো সহজে বিয়ে হবে না। এতো বছরের কষ্টের শোধ তো আমি নেবোই, মিস্টার আফিফ রাফাত।”
(***)
এ আর টি গ্যালারির সামনে বাগানের বেঞ্চে উজ্জ্বল আর আহি পাশাপাশি বসে আছে। আহি উজ্জ্বলের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
“বিয়ে করছেন না কেন?”
উজ্জ্বল হালকা হেসে বলল,
“বয়স হলেই যে বিয়ে করতে হবে এমনটাও নয়। আমি মনমতো জীবনসঙ্গী পাচ্ছি না।”
“আপনার কেন মনে হলো, আমি আপনার মনের মতো মানুষ?”
“তোমাকে যতোটুকু জেনেছি, তাতেই মনে হলো।”
“আমি একজনকে ভালোবাসি।”
উজ্জ্বল আহির দিকে তাকালো। সেকেন্ড খানিক নিরব থেকে বলল,
“আগের সেই মানুষটা? না-কি নতুন কেউ?”
“যাকে ভালোবাসেছিলাম, তাকে ভালোবাসতেই আমার মন ভরে নি। মনে হচ্ছে আরো কিছু বাকি রয়ে গেছে। তাহলে দ্বিতীয় কাউকে কীভাবে সেখানে জায়গা দেই?”
“শুনেছি সে বিবাহিত।”
“এখন ডিভোর্স হয়ে গেছে।”
উজ্জ্বল হাসলো। বলল, “তাহলে তো ভালোই হলো।”
আহি উজ্জ্বলের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি তাকে যতোটা ভালোবাসি, অন্য কাউকে সেভাবে কখনোই ভালোবাসতে পারবো না। ভালোবাসার থাকলে আমার জন্য তার পরের স্থানটা রাদেরই হতো। যেখানে আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুটাই আমার ভালোবাসা পায় নি, আমি অন্য কাউকে কীভাবে সেই স্থান দেবো? অন্যায় হবে, আপনার সাথে, বা অন্য কোনো পুরুষের সাথে। আর আমাকে সেই মানুষটার চেয়ে বেশি কেউ ভালোবাসতে পারবে না। যদি বেসে থাকে, তাহলে সেও আমার প্রিয় বন্ধু রাদই ছিল। এবার বলুন, যাকে আমি ভালোবাসি, তাকে না পেলে আমি দ্বিতীয় কোনো মানুষের জীবনে যাওয়াটা তো অন্যায় হবে, তাই না? এটা রাদের সাথে অন্যায় হবে। রাদ খুশি হবে, আমি যদি আফিফের সাথে ভালো থাকি৷ কারণ আমি জানি, সে আফিফ ছাড়া আর কাউকে আমার সাথে সহ্য করতে পারবে না।”
উজ্জ্বল বলল, “আফিফ খুব ভাগ্যবান পুরুষ।”
আহি হাসলো। হঠাৎ তার চোখ আটকালো নন্দনকানন স্কুলের গেটের সামনে। আফিফ ওয়াসিফকে নিতে এসেছে স্কুল থেকে। আহি আফিফকে দেখিয়ে দিয়ে উজ্জ্বলকে বলল,
“মানুষটা মনে করে ও আমার অযোগ্য। ভালোবাসি বলতে ভয় পায়। আমার খুব কষ্ট হয়৷ আমি কতো বার বলেছি, আমি তাকে ভালোবাসি। কতো বার বুঝিয়েছি। সে একবার কি আমাকে ভালোবাসি বলতে পারে না? আমার কি শুনতে ইচ্ছে করে না?”
“জিজ্ঞেস করে দেখো।”
“বলবে না। ওর মাথা নষ্ট হয়ে গেছে। ঠিক করতে হবে মাথাটা।”
“কীভাবে করবে?”
“জানি না। ছেলেরা ভালোবাসি কখন বলে?”
উজ্জ্বল কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
“এমন মুহূর্তে যখন তাকে পাওয়ার কোনো সম্ভাবনায় নেই। ভালোবাসি বলে মনের চাপ কমিয়ে ফেলে। বা কোনো ইমোশনাল সিচুয়েশনে।”
আহি হালকা হেসে বলল,
“মানুষটা খুব চাপা স্বভাবের। ও এতো সহজে মুখ খুলবে না।”
“তাহলে?”
“একটা সাহায্য করলে, আমি আপনার একটা উপকার করতে পারি।”
“কেমন?”
আহি উজ্জ্বলকে তার পরিকল্পনাটা বললো। উজ্জ্বল সব শুনে হাসলো। সামনে তাকিয়ে দেখলো আফিফ এদিকেই তাকিয়ে আছে। উজ্জ্বল বলল,
“মিস্টার আফিফ তো এদিকেই তাকিয়ে আছেন।”
আহি আফিফের দিকে না তাকিয়ে বলল,
“তাহলে প্ল্যান এক্সিকিউট করি।”
“আমার কি উপকার করবে?”
“আপনার আর আমার বিয়েটা একসাথেই না হয় হবে।”
“কীভাবে?”
“আমার জুনিয়র, চয়নিকা। বেশ মিষ্টি মেয়ে। ওর বাসা থেকে ছেলে দেখছে। আমার ওর সাথে পরিচয় আঁকা-আঁকি থেকেই। ভালোই ছবি আঁকে। সংসারীও মনে হয়।”
“তোমার কি মনে হয়, ভালো হবে?”
“হ্যাঁ, আমার তো ভালোই মনে হয়।”
“তোমার পছন্দের উপর আস্থা আছে আমার।”
আহি হাসলো। উজ্জ্বলের দিকে হাত এগিয়ে দিলো। উজ্জ্বল আহির সাথে হাত মেলাতেই আহি বলল,
“আমি চয়নিকার মায়ের সাথে কথা বলবো। আপনার বায়োডাটাটাও পাঠিয়ে দেবেন।”
১২৫।
পরদিন চয়নিকার মায়ের সাথে কথা বললো আহি। উজ্জ্বলের বায়োডাটাও পাঠানো হলো। দুই পক্ষই এক সপ্তাহ সময় নিলো। আহি এই এক সপ্তাহ উজ্জ্বলের সাথে ভালোই সময় কাটালো। প্রতিদিন ওয়াসিফের স্কুল ছুটির আগ মুহূর্তে এ আর টি গ্যালারির বাগানে বসে আহি আর উজ্জ্বল গল্প জুড়িয়ে দেয়। আর প্রায়ই আফিফ তাদের দেখে ক্ষণিকের জন্য দাঁড়িয়ে যায়। আহির বেশ ভালোই লাগছে এসব। মনে মনে ভাবছে,
“দহন যন্ত্রণায় পুড়িয়েছো আমাকে৷ এবার বুঝো, তোমাকে আর পদ্মকে একসাথে দেখে আমার কতোটা কষ্ট হতো!”
এক সপ্তাহ পর চট্টগ্রামে গেলো উজ্জ্বল। পারিবারিক ভাবে চয়নিকার সাথে দেখা হলো তার। আহি আর পুষ্পও সাথে ছিলো। পনেরো মিনিটের আলাপে চয়নিকা আর উজ্জ্বল বেশ খুশি। কথাবার্তা শেষে বেরিয়ে আসার সময় উজ্জ্বল আহিকে বলল,
“চয়নিকাকে আমার ভালোই লেগেছে।”
আহি হেসে বলল,
“তাহলে বিয়ের কথাবার্তা আগানো যাবে।”
“ওদের রেসপন্সটাও তো জরুরি।”
দু’দিন পর উজ্জ্বলের পরিবার আনুষ্ঠানিকভাবে চয়নিকার পরিবারের সাথে দেখা করতে চাইলো। চয়নিকার পরিবারও রাজি হলো। তাদেরও উজ্জ্বলকে বেশ পছন্দ হয়েছে। এরপর কথাবার্তা পাকাপোক্ত হতেই আহি আবার কক্সবাজার ফিরলো।
আজ বোরহান আলী পদ্মকে নিয়ে কক্সবাজার এসেছেন। আজ থেকেই তিনি নাইট গার্ডের দায়িত্ব নিচ্ছেন। আহি তার বাংলো বাড়ির পাশেই একটা সেমি পাকা বাড়িতে তাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিলো। তিন রুমের বড় বাড়ি। পাশে আরো কয়েকটা সেমি পাকা বাড়ি আছে। আহি তার বাংলো বাড়ির দারোয়ানদের আর ব্যক্তিগত ড্রাইভারের রেস্ট হাউজ হিসেবে এই সেমি পাকা বাড়িগুলো বানিয়েছিলো। যদিও এখানে থাকার সম্পূর্ণ খরচ আহি নিজেই দেয়। চিকিৎসা খরচও আহি চালায়। কিন্তু পদ্মের ক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্নতা রাখলো আহি। ভেতরের আসবাবপত্রও আহি নিজেই পছন্দ করে কিনে দিয়েছে। বোরহান আলীর বাচ্চাদের পড়াশুনার খরচ চালানোর দায়িত্বও নিয়েছে। সাথে একটা মোটর সাইকেল দিয়েছে বোরহান আলীকে। আপতত মোটর সাইকেল চালানোর জন্য একটা প্রশিক্ষকের ব্যবস্থা করেছে আহি। পদ্ম আহিকে এতোকিছু করতে দেখে বলল,
“কেন করছিস এসব আমার জন্য?”
“অন্তত কেউ নিমকহারামি যাতে করতে না আসে।”
“তুই ভাবছিস এসব করে তুই আমার কাছ থেকে আফিফকে কেঁড়ে নিবি?”
আহি হেসে বলল,
“প্রথমত তুই আমার কাছ থেকে আফিফকে কেঁড়ে নিয়েছিলি। আর এখন আফিফ তোর নেই। তাহলে কেঁড়ে নেওয়ার প্রশ্নই আসে না।”
“আমি উনাকে তালাক দিয়ে আফিফকে আবার বিয়ে করবো।”
আহি হাসলো। একটু জোরেই হাসলো। আহির হাসির শব্দ শুনে পদ্ম অবাক হলো। আহি পদ্মের হাত ধরে বলল,
“বোন, তোর তো আমার চেয়েও বাজে অবস্থা। নায়ীব ভাইয়ার শরণাপন্ন হতে হবে তোকে। বান্ধবীর বর কিন্তু, সাবধান। আমি তাই ছাড় পেয়েছিস, ওদিকে নজর দিলে লিনু তোর চোখ গেলে দেবে।”
“আহি, আফিফ আমার স্বামী ছিল।”
“তোর সেই স্বামী আমার ভালোবাসার মানুষ ছিল।”
“প্রেমিকার চেয়ে স্ত্রীর মর্যাদা অনেক বেশি।”
“এজন্যই তো তখন আমার হাতে কিছু ছিল না। কিন্তু এখন সময়টাও আমার, আফিফও আমার। আর তুই স্ত্রীর কথা বলছিস? মাথা টাথা কি খারাপ হয়ে গেছে না-কি? আফিফ আর তোর ডিভোর্স হয়ে গেছে। কোথাকার স্ত্রী তুই? যা, বোরহান আলীর সেবা কর। মানুষটা ওতোটাও খারাপ না। নয়তো পরে শ্যাম রাখি না কুল রাখি অবস্থা হবে।”
চলবে-
#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৬০|| (১৮+ এলার্ট)
১২৬।
রাত ১টা। আহি ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে। স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে আফিফের নম্বর। সে ভাবছে, আফিফকে একবার কল দেবে কি দেবে না। অনেক ভাবনার পর সে কল দিয়েই ফেললো। ওপাশে আফিফ তখন অফিসের ফাইল গুছিয়ে অফিস ব্যাগে ঢুকাচ্ছিলো। ফোন বেজে উঠতেই সে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলো। আহির নাম ভেসে উঠেছে। আফিফ তড়িঘড়ি করে ফোনটা হাতে নিলো। বেশিক্ষণ ভাবলো না। ধরেই ফেললো কল। ওপাশে নিরবতা। আফিফও চুপ করে আছে। মিনিট খানিক পর আহি বলে উঠলো,
“তোমাকে ভালোবেসে আমি কি পেয়েছি, বলো তো?”
আফিফ আহির এমন প্রশ্ন শুনে চমকে উঠলো। সে কী উত্তর দেবে বুঝতে পারছে না। আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আচ্ছা, তোমাকে বলতে হবে না। আমি বলছি। তোমাকে ভালোবেসে আমি তোমার নির্বিকার ভাব দেখেছি। তোমার থমকে যাওয়া দেখেছি। তোমাকে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি।”
আফিফ ক্ষীণ কন্ঠে বললো, “হয়তো আমি…”
আহি আফিফকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“হয়তো তুমি না। তুমিই এমন করেছো। রেনু আমাকে তোমার ব্যাপারে যা বলেছে তা কি আদৌ সত্য?”
আফিফ এবারও নিশ্চুপ। আহি চেঁচিয়ে বলল,
“তুমি এতোটাই নির্লিপ্ত?”
“আমার মনে হয় না তুমি কখনো আমার সাথে সুখী হবে। আমি হয়তো তোমাকে ভালো রাখতে পারবো না।”
আহি হাসলো। বলল,
“এটাই শুনতে চেয়েছিলাম। থাক এসব বাদ দাও। অনেকদিন পর দেখা হয়েছে। অন্তত ক্ষণিকের পরিচিতি তো ছিল। আমার আর উজ্জ্বলের বিয়েতে তোমাকে নিমন্ত্রণ দিয়ে রাখলাম। বিয়ে সেই রিসোর্টে হবে, যেখানে তোমার আর পদ্মের বাসর হয়েছিল।”
আফিফ থমকে গেলো। আহি বলল,
“আমি যাকে ভালোবাসি, তাকে পাওয়ার জন্য যতোটা করার সবটাই করেছি। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, এক তরফা কিছু হয় না। আর আমি এর জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ।”
আফিফ নিশ্চুপ। আহি আবার বলল,
“আজ যদি তোমার জায়গায় আমি থাকতাম, তাহলে হয়তো বেহায়া হয়েই যেতাম। জীবনে একবার দুঃসাহসিক কাজ করা উচিত। ফল যদি অনুকূলে না থাকে, অন্তত আফসোস থাকবে না। আমি চেষ্টা করি নি, আমার ভালোবাসায় খাদ ছিল, এই আফসোস অন্তত থাকবে না। যার ভালোবাসায় খাদ থাকে, তারা মুখোমুখি দাঁড়াতে ভয় পায়। তাদের সাহস নেই। তারা ভীতু। আমি ভীতু ছিলাম না। তাই আমার অনুভূতি প্রকাশে আমি একটুও কার্পণ্য করি নি।”
আফিফ বলল, “আহি, আমি হয়তো….”
“হয়তো, হয়তো বা, এসব বন্ধ করো, মিস্টার আফিফ রাফাত। চৌদ্দ বছর শেষ হয়ে গেছে। আমার জীবন থেকে চৌদ্দটা বসন্ত হারিয়ে গেছে। আমি ভয়ংকর দশটা বর্ষা যেতে দেখেছি। কখনো তো এসে কেউ আমাকে বলে নি, এই অন্ধকার রাতে বর্ষায় ভিজতে হবে না, আমি তোমার পাশে আছি। তুমি জানো, আমি প্রতি বর্ষায় সেই দিনটিতে রাতভর ঝমঝম বৃষ্টির মধ্যে ছাদে শুয়ে থাকি। আর আমার চোখের সামনে ভাসে, একটা পুরুষ অবয়ব ডোবায় নেমে পদ্মফুল তুলছে। আর সেই দিনটিতে যদি বৃষ্টি না হয়, আমি সারারাত ওয়াশরুমের ঝর্ণায় নিজেকে ভেজাই। কিন্তু কেউ আমার মাথা মুছতে আসে না।”
আফিফ কাঁপা কন্ঠে বললো, “আমাকে একটু কথা বলার সুযোগ দাও।”
“সুযোগ শেষ। সময় আর নেই। শুনো, তোমার আর পদ্মের সংসার দেখেছি আমি। খুব মিষ্টি করে জড়িয়ে ধরতে তাকে। কতো রাত তোমরা প্রেম লীলায় মত্ত ছিলে, নয়তো কি আর এমনি এমনি সন্তান হওয়ার আশায় থাকতে? তুমি আমার সামনে ওর সাথে জড়াজড়ি করতে। হ্যাঁ, তোমার বউ ছিল। আমি তো কেউ না এসব বলার। কিন্তু খারাপ লাগতো। আমার খারাপ লাগতো, আফিফ। কষ্ট হতো খুব। কারণ পদ্মের আগে আমিই তোমাকে ভালোবেসেছিলাম। মেয়েটা হয়তো ভুল করেছে। আজ যদি পদ্ম এমন না হতো? সে যদি সত্যিই ভালো মেয়ে হতো? তখন কি সংসারটা কখনো ভাঙতো? এখন তো তাজওয়ার নেই। তোমাকে থ্রেট দেওয়ারও কেউ থাকতো না। আমাকে বাঁচিয়ে রেখে কী লাভ হয়েছে বলো তো? আমার সম্মান বাঁচানোর জন্য তোমাকে বীরপুরুষ কে হতে বলেছে? যেদিন তাজওয়ার আমার গায়ে হাত দিয়েছিল। আমার গলায় ওর ওষ্ঠদ্বয়ের স্পর্শ…”
আফিফ আহিকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “আহি, প্লিজ।”
“ওমা, বীরপুরুষের এতো গায়ে লাগছে কেন?”
“আমাকে ক্ষমা করে দাও, আহি।”
“মিস্টার আফিফ, আমার বাবা আর তোমার মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। বাবা জেনেশুনে আমাকে তাজওয়ারের হাতে তুলে দিয়েছিল। আর তুমি আমাকে বাঁচানোর জন্য সেই পুরুষের হাতেই আমাকে তুলে দিলে৷ আমাকে সেদিন ছেড়ে গিয়েছিলে, যাতে তাজওয়ার আমার ক্ষতি না করে। একবারও ভাবো নি, তুমি ছেড়ে দেওয়া মানেই, তাজওয়ারের আমাকে পাওয়া!”
“আহি, আমার এতো ক্ষমতা ছিল না। আমি তাজওয়ারের বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু করতে পারতাম না। আমার আর্থিক অবস্থা, মানসিক অবস্থা কোনোটাই ভালো ছিল না। হ্যাঁ, আমি ভীতু ছিলাম। আমি এমন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। হিরোইজম ছিল না আমার মধ্যে।”
“তবুও তোমার মতো জিরোকে আমি ভালোবেসেছি।”
আফিফ চুপ হয়ে গেলো। আহি আবার বলল,
“আমার জীবনের গল্পে কোনো হিরো নেই, আফিফ। আমার জন্য আমি একাই লড়াই করেছি। তাজওয়ার যেদিন আমার সাথে জোরাজুরি করতে এসেছিলো, কোথায় ছিলো আমার হিরো? আমি নিজের জীবন দিয়ে নিজেকে বাঁচাতে চেয়েছি। সেদিন লিনাশার বিয়ে থেকে ফেরার পথে যখন তাজওয়ার আমাকে বিরক্ত করছিলো, আমি একাই পালিয়েছি। আমি একদম একা। তোমার মতো কাপুরুষ, ওপস, বীরপুরুষ। তুমি তো আবার মহান হৃদয়ের মানুষ। তাজওয়ার এসে আমাকে স্পর্শ করলো, আর তুমি কিছুই করতে পারলে না। তুমি তো পদ্মফুলের সাথে জড়াজড়িতে ব্যস্ত ছিলে। এদিকে তুমি রাদের সাথেও আমার বিয়ে ঠিক করে দিতে চাচ্ছিলে। একবারও ভাবো নি, আমি কী চাই। ওকে ফাইন, মিস্টার আফিফ রাফাত। এবার আমি না হয় বিয়ে করে একটা নতুন জীবন শুরু করবো। তুমি সো কল্ড বীরপুরুষ হয়েই থেকো। এবার তুমি যা চাইতে, তাই হবে। আমার বিয়ে হবে। আমাকে অন্য কেউ স্পর্শ করবে। আমার শরীরে অন্য কারো….”
আফিফ থমথমে কন্ঠে বলল, “আহি প্লিজ। প্লিজ। প্লিজ।”
“ওপস, সরি। আমার প্রাইভেট কথা আমি তোমাকে কেন বলছি? এটা তো একান্ত আমার আর আমার স্বামীর অনুভূতি। আমি কি তোমার পদ্মফুল না-কি? যে রুমের দরজা খোলা রেখে অন্য কারো সামনে স্বামীর সাথে রঙ্গলীলায় মেতে উঠব? আর আমার স্বামী কি সো কল্ড বীরপুরুষ যে অন্য কাউকে মুভ অন করতে বাধ্য করার জন্য রুমের দরজা খোলা রেখে বউকে আদর করবে।”
আফিফ কল কেটে দিলো। ফোনটা বিছানায় ছুঁড়ে মারলো। তিক্ত হলেও সত্য কথায় বলেছে আহি। চাইলে তো সে আহির হাত ধরে রাখতে পারতো। এতোটা দুর্বল মানুষ সে? মেঝেতে বসে পড়লো আফিফ। মাথার চুল আঁকড়ে ধরলো দুই হাত দিয়ে। শরীর কাঁপছে তার। হাত মুঠো করে জোরে জোরে মেঝেতে আঘাত করলো সে। শব্দ শুনে রেনু দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো। আফিফকে এই অবস্থায় দেখে রেনু ভাইয়ের পাশে এসে বসলো। ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“ভাইয়া, কি হয়েছে তোমার?”
আফিফ কাঁপা কন্ঠে বললো,
“আমি ব্যর্থ। আমি কাপুরুষ। আমি কিছুই করতে পারি নি। আমার ভয়, ভীতি, আমাকে দুর্বল করে রেখেছে। আমি বোকা। আমার একটুও বুদ্ধি নেই। আমি.. আমি অনেক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। আমি অনেক ভুল করেছি। আমি আহির সাথে খুব অন্যায় করেছি। সময়গুলো আর ফিরে আসবে না। আমি চাইলেও সময়গুলো ফিরিয়ে আনতে পারবো না। আমার কষ্ট হচ্ছে, রেনু। আমি দুর্বল, আমি একদম দুর্বল।”
আফিফ রেনুর কোলে মাথা রেখে কাঁদতে লাগলো। আফিফা বেগম ছেলের কান্না শুনে ছুটে এলেন। ছেলের পাশে বসে পড়লেন তিনি। ছেলের কান্না সহ্য করার ক্ষমতা নেই তার। তিনি ঘটনা না জেনেই কেঁদে ফেললেন। ছেলের পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন,
“কি হয়েছে, বাবা? আফিফ, কাঁদছিস কেন তুই?”
আফিফ আর কিছু বলতে পারলো না। সে মায়ের হাত ধরে কাঁদছে। রেনু ভাইয়ের কান্না দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আজ প্রথম তার ভাই এভাবে পাগলের মতো কাঁদছে। এটা এই মুহূর্তে তার জীবনের সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য খুবই জরুরি ছিল। আহি তাকে আগেই সব বলে দিয়েছিল। রেনু বিছানায় পড়ে থাকা আফিফের ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু সময়ের মানসিক যন্ত্রণা থেকে যদি কোনো ভালো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সাহস সৃষ্টি হয়, তাহলে কোনো ক্ষতি নেই। অন্যদিকে আহি ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে আর মনে মনে ভাবছে,
“এটাই তোমাকে জাগিয়ে দেওয়ার শেষ সুযোগ। তুমি এবার ফিরে আসতে বাধ্য, আফিফ।”
১২৭।
উজ্জ্বল আর চয়নিকার ডেস্টিনেশন ওয়েডিংয়ের পরিকল্পনা করেছে উজ্জ্বলের কাজিনরা। আহিকে সাহায্য করবে বলেছিল উজ্জ্বল। সেই সূত্রে কক্সবাজারেই আয়োজন করা হলো সেই বিয়ের অনুষ্ঠানের। আহির বাবার সেই বিলাসবহুল হোটেলেই তারা উঠেছে। আহি চয়নিকা আর উজ্জ্বলের বাবা-মার সাথে দেখা করে হোটেল ম্যানেজারকে সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় চয়নিকা তার সামনে এসে দাঁড়ালো। আহি চয়নিকার হাত ধরে বলল,
“ভালো লাগছে তো!”
চয়নিকা মুচকি হেসে বলল,
“হ্যাঁ, আপু। ভালোই লাগছে। একটা কথা শুনেছি মার কাছে।”
“কি কথা?”
“উজ্জ্বলের মা আপনার জন্য প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলেন!”
আহি হাসলো। চয়নিকার থুতনি ধরে বলল,
“তুমি ভাবছো আমি কেন না করে দিয়েছি? দেখো, এরেঞ্জ ম্যারেজ মানেই মেয়ে দেখা-দেখি। আন্টি আমাকে পছন্দ করেছেন, আমি তার স্টুডেন্ট ছিলাম সেই ক্ষেত্রে। আর তোমার ননদ পুষ্প, আমার খুব ভালো ফ্রেন্ড। আর আমি না করেছি, কারণ আমি অন্য একজনকে পছন্দ করি। উজ্জ্বল সাহেব অনেক ভালো মানুষ। একজন সাকসেসফুল লয়ার। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় কেইসটা উনিই নিয়েছিলেন। উজ্জ্বল সাহেব আমার বন্ধু ছিলেন না। কিন্তু আমার অনেক বড় উপকার করেছেন। আমি খুব একটা সাহসী ছিলাম না। আমার মাঝে যেই বোল্ড আহি লুকিয়ে ছিল, সেটা উনিই দেখিয়েছেন। আরো দু’জন মানুষ আছে। নায়ীব ভাইয়া আর আমার বেস্ট ফ্রেন্ড রাদ।”
কথাটি বলেই আহি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। চয়নিকা উজ্জ্বলের দিকে তাকালো। মুচকি হেসে বলল,
“আপু, আপনার উপর আস্থা আছে। নিশ্চয় ভালো হবেন উজ্জ্বল।”
উজ্জ্বল ফোনে কারো সাথে কথা বলতে ব্যস্ত। চয়নিকা তার দিকে এগিয়ে গেলো। উজ্জ্বল ফোন রেখে চয়নিকার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। চয়নিকাও পালটা হাসি ফেরত দিলো। তখনই পুষ্প মাঝখানে এসে বলল,
“বিয়ের আগে নো কথাবার্তা।”
কথাটি বলেই চয়নিকাকে টেনে নিয়ে গেলো সে। উজ্জ্বল কপাল চুলকে হাসছে। আহি তাদের চোখাচোখি দেখে হাসতে লাগলো। মনে মনে বলল,
“খুব মনে পড়ছে তোকে, রাদ। খুব বেশি। হুট করে হারিয়ে গেলি তুই। কেন বলেছিলি সেদিন, আমার হাসি দেখতে দেখতেই মরে যাবি? এখনো সেই বাক্যটা আমার কানে বাজে। তোকে কোনোদিন ভুলতে পারবো না। তুই আমার মেডিসিন ছিলি। আর এখন মেডিসিন ছাড়াই আমি বেঁচে আছি। কেউই চলে যাওয়া মানুষটিকে ভুলতে পারে না, কিন্তু তাকে ছাড়া চলতে শিখে যায়। সত্যি রাদ, খুব মিস করছি তোকে আজ। দেখছিস রাদ, আমার জীবনে সব ঠিক হয়ে যাচ্ছে। শুধু তুই নেই আমার পাশে।”
(***)
মেঘলা আকাশ। ঘুটঘুটে অন্ধকারে এ আর টি গ্যালারি ছেয়ে গেছে। একটু আগেও গেটের বাইরে জ্বলছিল সোডিয়াম বাতি। হুট করে বন্ধ হয়ে গেলো সব ক’টা। গ্যালারির ভেতর ছোট একটা রুম। রুমটি ধীরে ধীরে আলোকিত হচ্ছে একের পর এক মোমের আলোতে। আহি দেয়ালের তাকের উপর একের পর এক মোম বসিয়ে সেগুলো জ্বালিয়ে দিচ্ছে। গ্রিল বিহীন খোলা জানালা। আহি জানালা খুলে দিলো। বাইরে এক নজর চোখ বোলালো। শহরে হয়তো বিদ্যুৎ নেই। অবশ্য খবর পেয়েছে সে। কয়েক ঘন্টা এই এলাকায় বিদ্যুৎ থাকবে না। অন্য ব্যবস্থাও আছে। কিন্তু আহি এই মুহূর্তে নিস্তব্ধতা চাইছে। চাইছে অন্ধকার ঘর। তাই কৃত্রিম ব্যবস্থা বন্ধ রাখলো সে।
বর্ষার মাস শুরু হয়েছে অনেক দিন হলো। এক সপ্তাহ টানা বৃষ্টির পর, আজ একটু বিশ্রাম নিচ্ছে মেঘেরা। আহি জানালার পাশ থেকে সরে তার ইজেলের সামনে এসে দাঁড়ালো। ইজেলের উপর রাখা ক্যানভাসে অর্ধেক রঙ মাখানো। ভিন্ন একটা ছবি আঁকছে সে। আলো-আঁধারির ভিন্ন রূপের মিশ্রণে আঁকবে একটা ছবি। আহি মোটা ব্রাশ হাতে নিলো। মনোযোগ দিয়ে রং মেশাতে লাগলো। হঠাৎ আহি থমকে গেলো। নিস্তব্ধ ঘরে কারো পদশব্দ শোনা যাচ্ছে। গ্যালারিতে কেউ হাঁটছে। কে এসেছে এই অসময়ে? গ্যালারির বাইরে রহমান, এ আর টি গ্যালারির নাইট গার্ড। আহি ঘড়ির দিকে তাকালো। ঘড়িতে দশটা বেজে পাঁচ মিনিট। ঠিক দশটায় রহমান বিরতি নেয়। রাতের খাবার খেতে যায়। পাশেই তার বাড়ি। যাওয়ার আগে বাইরের গেট লাগিয়ে দিয়ে যায়। তাহলে কি রহমানের অনুপস্থিতিতে কেউ গেট টপকে ভেতরে এসেছে? গ্যালারিতে কোনো দামি জিনিস নেই। দামি জিনিস মাসে একবারই গ্যালারিতে এনে রাখা হয়। সেদিন গার্ডের সংখ্যাও বাড়ে। কিন্তু আজ কে এসেছে? আহি পাশের টিস্যু বক্স থেকে টিস্যু নিয়ে হাত মুছলো। হঠাৎ সে অনুভব করলো রুমের দরজাটা খুলে গেছে। ক্যানভাসের পাশের টুলে কাঁচি রাখা। আহি কাঁচিটির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। হাতে তুলে নেওয়ার জন্য কাঁচিটির দিকে হাত বাড়াতেই সেই পরিচিত পারফিউমের গন্ধটি নাকে এসে ঠেকলো। আহির হৃদ স্পন্দন বেড়ে গেলো। অস্ফুটস্বরে বলল,
“আফিফ!”
আহির অনেকটা কাছেই এসে গেছে মানুষটি। নিস্তব্ধ ঘরে নিঃশ্বাসের শব্দ বেশ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। আহি তবুও কাঁচিটা হাতে নিলো। একই পারফিউম তো অনেকেই ব্যবহার করতে পারে। আহি পেছন ঘুরতেই আফিফের মুখোমুখি হলো। আফিফকে দেখেই কাঁচিটা হাত থেকে পড়ে গেলো তার। ফাঁকা ঘরে কাঁচি হাত থেকে পড়ার শব্দ বেশ কানে লাগলো। আফিফ নিচের দিকে তাকিয়ে ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“কি ভেবেছিলে?”
আহি বলল, “যা-ই ভাবি, তুমি আসবে ভাবি নি।”
“এসে তো গেছি।”
আহির নিঃশ্বাস আটকে গেলো যেন। এসে তো গেছি, বাক্যটা বুকে এসে বিঁধেছে তার। ইচ্ছে করছিলো আফিফের হাত ধরে বলতে,
“আমাকে ফেলে আর যেও না, এআর। থেকে যাও। আমার হয়ে যাও।”
আহি নিজেকে সামলে নিলো। মুখ ঘুরিয়ে বলল,
“ভেতরে কীভাবে এসেছো?”
“তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি। দারোয়ান আসতে দিচ্ছিলো না। কিন্তু আমার সাথে লিনাশা আর নায়ীব এসেছিল। তাই ঢুকতে পেরেছি। আমি প্রথমে তোমার বাড়িতে গিয়েছিলাম। তুমি ওখানে ছিলে না। লিনাশা আর নায়ীব আমাকে দেখলো। তারাই গাড়ি নিয়ে আমাকে এখানে নামিয়ে দিয়েছে। দারোয়ান হয়তো লিনাশাকে চেনে।”
“হ্যাঁ।”
আফিফ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। আহি ক্যানভাসটি ইজেল থেকে নামিয়ে রেখে বলল,
“কাল আমার এনগেজমেন্ট। আমাকে বাসায় গিয়ে রেস্ট নিতে হবে।”
“তো এখানে কি করছিলে?”
“মন ভালো নেই, তাই ছবি আঁকতে এসেছি।”
“তুমি বাধ্য হয়ে বিয়ে করছো, তাই না!”
আহি আফিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোমার কি মনে হয়, আমি সব বাধ্য হয়ে করি তোমার মতো?”
আহি আফিফকে পাশ কাটিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে চাইলে আফিফ তার হাত ধরে ফেললো। আহি আফিফের চোখে চোখ রাখতেই আফিফ চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল,
“তোমার সাথে কথা আছে আমার।”
আহি এক ঝটকায় হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,
“বললাম না, সময় সুযোগ সব শেষ।”
আফিফ আহির দু’বাহু ধরে তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,
“এভাবে বলো না, প্লিজ। অনেক সাহস নিয়ে এসেছি।”
“কেন, বীরপুরুষের সাহস এতোদিন কোথায় ছিল?”
“সরি, রিয়েলি ভেরি সরি, আহি।”
“ডোন্ট বি সরি, আফিফ। তুমি তোমার প্রায়োরিটি চুজ করেছিলে।”
“তুমিই আমার…”
থমকে গেলো আফিফ। আহি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,
“এভাবেই থেমে যাবে তুমি। মাঝপথে এভাবেই থেমে যাবে।”
আহি আফিফকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতেই আফিফ টাল সামলাতে না পেরে পাশের ছোট টুলের সাথে ধাক্কা খেলো। টুলটি হালকা ছিল। আফিফের গায়ের সাথে ধাক্কা খেয়ে সেটা উল্টে নিচে পড়ে গেলো। আর সাথে সাথেই টুলের উপর রাখা রঙগুলো পুরো মেঝেতে ছড়িয়ে পড়লো। আফিফ মেঝেতে রঙ ছড়িয়ে যেতে দেখে বলল,
“রিয়েলি সরি, আহি।”
আহি কিছু বলার আগেই আফিফ ব্যস্ত হয়ে রঙের বোতলগুলো তোলার জন্য সামনে পা বাড়াতেই রঙের উপর পা পড়লো তার। আর সাথে সাথেই পিছলে পড়লো সে। আহিও মুহূর্তে তার হাতে টান অনুভব করলো। আফিফ নিজেকে পিছলে পড়া থেকে বাঁচানোর জন্য আহির হাত ধরে ফেলেছিলো। এবার দু’জনই মেঝেতে পড়ে গেলো। আফিফের পাশেই আহি উপুড় হয়ে পড়েছে। আফিফের পিঠে লেগেছে খুব। সে পিঠ আঁকড়ে ধরে বলল,
“আহি, তোমার কি খুব লেগেছে?”
আহি দু’হাতে ভর দিয়ে উঠে আফিফের দিকে তাকাতেই দেখলো আফিফ চোখ-মুখ কুঁচকে রেখেছে। আহি ব্যস্ত হয়ে উঠে আফিফের পিঠে হাত রাখলো। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,
“ইশ, ব্যথা পেয়েছো?”
এরপর সে আফিফের হাতে হালকা চাপড় মেরে বলল,
“এতো অদ্ভুত কেন তুমি?”
আফিফ চোখ খুললো। আহির চুলগুলো সব তার মুখে এসে পড়েছে। আফিফ হাত দিয়ে তা সরাতেই আহি চুলে টান অনুভব করলো। বিরক্ত মুখে সে আফিফের দিকে তাকাতেই থমকে গেলো। দু’জনই মুখোমুখি। আফিফের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, যা মোমের আলোয় চিকচিক করছে। আহির হঠাৎ কি হলো, সে আফিফের গালে হাত রাখলো। আহির হাতে রঙ মাখানো ছিল। আফিফের গালে লেগে গেলো সবটাই। আহি ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“এমন কেন তুমি?”
আফিফ চোখ বন্ধ করলো। আহি আফিফের বন্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ ভিজে আসছে তার। এতোটা কাছ থেকে আফিফকে অনুভব করার অনেক বছরের ইচ্ছে পূরণ হচ্ছে তার। আহির চোখ বেয়ে হুট করেই অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। আফিফ সাথে সাথেই চোখ খুললো। আহির কোমড় আঁকড়ে ধরলো শক্ত করে। আহি আরেকটু ঝুঁকে আফিফের আরো কাছে চলে গেলো। নিস্তব্ধ পরিবেশ উন্মাদ করে দিচ্ছে এক উন্মাদ প্রেমিকাকে। আহির অস্থিরতা আফিফের শরীরে প্রবেশ করলো। সে আহিকে জড়িয়ে ধরলো। আহিও আফিফের ঘাড়ে মুখ গুঁজলো। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো সে। আফিফ আহির চুলে হাত ডুবিয়ে দিলো। আহির ফুঁপানোর বেগ আরো বাড়ছে। আফিফ এবার আহিকে সরিয়ে মেঝেতে শুইয়ে দিলো। এক হাতে ভর দিয়ে আহির দিকে ঝুঁকে আহির চোখ মুছে দিলো। আহি আফিফের হাত ধরে বলল,
“বেশি দেরী করে ফেলেছো তুমি! অনেক বেশি।”
আফিফ এবার আহির গালে হাত রাখলো। আর সাথে সাথেই হাত সরিয়ে নিজের হাতের দিকে তাকালো সে। তার হাতেও রঙ লেগে আছে। আহি কাঁপা কন্ঠে বললো,
“তোমার স্পর্শ পাওয়ার স্বপ্ন আমার অনেক বছরের পুরোনো।”
আফিফ কথাটি শুনেই আবার আহির গালে হাত রাখলো। আহি চোখ বন্ধ করলো। তার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তেই আফিফ তার ওষ্ঠদ্বয় এগিয়ে দিলো আহির চোখের দিকে। আফিফের নিঃশ্বাসের ধাক্কা লাগলো আহির কপালে। খামচে ধরলো সে আফিফের শার্ট। আফিফ থেমে গেলো। আহি চোখ খুলে আফিফের দিকে তাকালো। আফিফ তাকিয়ে আছে তার দিকে। আহি বেশ লজ্জা পেলো। চোখ নামিয়ে নিলো সে। আফিফ তার অন্য হাতে ভর দিয়ে উঠে বসতে যাবে, কিন্তু তার হাত মেঝেতে পড়ে থাকা রঙের উপর পড়ায় হাত পিছলে সে আহির উপর এসে পড়লো। তার ওষ্ঠদ্বয় এসে ঠেকলো আহির থুতনিতে। আর আফিফের নাক স্পর্শ করলো আহির অধর। বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো দু’জনই। থমকে গেলো কয়েক মিনিটের জন্য। ভারী হয়ে আসছে উভয়ের নিঃশ্বাস। আহি মুখ সরিয়ে নিলো। চুলগুলো আছড়ে পড়লো মেঝেতে। উন্মুক্ত হলো আহির ঘাড়। আফিফের চোখ আটকালো সেদিকেই। চোখ বন্ধ করে নিলো সে।
হঠাৎ দমকা হাওয়া জানালা গলে ভেতরে ঢুকলো। বেশ কয়েকটা মোম নিভিয়ে দিলো এক ধাক্কায়। আরো অন্ধকার হয়ে গেলো রুমটা। আফিফ অনুভব করতে লাগলো অদ্ভুত আকর্ষণ। পুরো ঘর হঠাৎ ক্ষণিকের জন্য আলোকিত হলো। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সেকেন্ডের মধ্যেই শব্দটা শোনা যাবে। আলোর ঝলকানিই বুঝিয়ে দিচ্ছে শব্দটা খুব জোরে শোনা যাবে। আলো রুমে ঢুকতেই আহি আফিফকে জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে। এরপর বেশ জোরেই শব্দ হলো। আফিফ আহির ঘাড়ে মুখ গুঁজলো। ওষ্ঠদ্বয়ের স্পর্শ পেলো আহির তৃষাতুর মন। আহিকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো আফিফ। তার খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি আহির গালে লাগলো। এমন মিষ্টি স্পর্শে আহি মুচকি হাসলো। আফিফের কাঁধে তার অধর ছোঁয়ালো। আফিফ মিনিট খানিক পর আহির গলায় আলতো করে হাত রাখলো। রঙ লাগিয়ে দিলো আহির গলায়, কাঁধে, ঘাড়ে। এরপর উঠে বসলো আফিফ। আহির কোমড় ধরে টেনে উঠালো। আহি উঠে বসে আফিফের বুকে মাথা রাখলো। আফিফ এবার আহির গালে অধর ছোঁয়ালো। আহি তার বুকে মুখ গুঁজে বলল,
“মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছি।”
আফিফ আহির কানের কাছে মুখ এনে বলল,
“স্বপ্ন নয়, এটা সত্যি। আহি, ভালোবাসি।”
আহি আফিফের চোখের দিকে তাকালো। মেঝে থেকে সাদা রঙ তুলে আফিফের গালে লাগিয়ে দিয়ে বলল,
“তোমার প্রিয় রঙ!”
“ভালোবাসি, আহি।”
আহি মুচকি হাসলো। আহি আশেপাশে তাকালো। আরেকটু দূরে হলুদ রঙের কৌটা। আহি সেটা নিয়ে আফিফের সামনে বসে তার কপালে রঙ লাগিয়ে দিয়ে বলল,
“তোমার প্রিয় ফুল, অলকানন্দা।”
“ভালোবাসি, আহি। ভালোবাসি তোমাকে।”
আহি আফিফের কপালে কপাল ঠেকালো। তার গালে গাল লাগিয়ে বলল,
“তোমার সব প্রিয় জিনিস আমার প্রিয়।”
“আমি তোমাকে ভালোবাসি, আহি।”
আহি মুচকি হাসলো। আহি এবারও উত্তর দিলো না। আফিফ আহির দিকে এগিয়ে এসে তার অধরে অধর ছোঁয়ালো। আহি চমকে উঠলো। আফিফ বলল,
“ভালোবাসি, আহি।”
আহি বলল,
“আমি গত চৌদ্দ বছরে যতোবার এই বাক্যটা উচ্চারণ করেছি, তোমার কয়েক মিনিটে বার-বার বলাতেও সেটা গ্রহণযোহ্যতা পাবে না।”
“তাহলে কি করবো আমি?”
“তুমি জানো না, আমি কি চাই?”
আফিফ নিশ্চুপ। আহি আফিফকে সরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। আফিফও সাথে সাথে উঠে দাঁড়িয়ে আহির হাত ধরে বলল,
“উজ্জ্বলকে বিয়ে করো না, আহি।”
আহি অন্যদিকে ফিরে মুখ চেপে হাসলো। আফিফ আবার বলল,
“কিছু তো বলো! অস্থির লাগছে আমার।”
আহি আফিফের দিকে ঘুরে বলল, “কেন অস্থির লাগছে?”
“ভালোবাসি তাই।”
আহি অবাক কন্ঠে বলল, “হঠাৎ ভালোবেসে ফেললে?”
“আগেও তো বাসতাম।”
“আগে তো অস্থির লাগে নি!”
“লাগতো। কিন্তু আমি বলতে পারি নি।”
“কেন?”
“সাহস ছিল না।”
“এখন এতো সাহস হয়ে গেছে, আমার গ্যালারিতে এসে আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছো?”
আফিফ আহির হাত ছেড়ে দিলো। অস্থিরতা তার চোখে-মুখে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। আহির সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো আফিফ। জড়িয়ে ধরলো আহির কোমড়। কান্নাভেজা কন্ঠে বলল,
“আমাকে বকো, যা ইচ্ছে বলো। হ্যাঁ, আমি মানছি আমি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারি নি। কিন্তু আমাকে ছেড়ে যেও না, আহি। উজ্জ্বলকে বিয়ে করো না। আমার হাতটা ধরো। আমি আমার সাধ্যের মধ্যে তোমাকে ভালো রাখবো।”
আহি আফিফের চুলে হাত ডুবিয়ে দিয়ে বলল,
“সময়-সুযোগ শেষ।”
আফিফ আহির দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালো। আহির হাত ধরে বলল,
“প্লিজ, প্লিজ আহি। এভাবে বলো না।”
আহি আফিফকে সরিয়ে দিয়ে সামনে পা বাড়ালো। আফিফ আহির পিছু পিছু আসতে লাগলো। আহি হাসছে মনে মনে। গ্যালারির সাদা মেঝেতে দু’জোড়া পায়ের ছাপ পড়ছে। আহি ঘুরছে পুরো গ্যালারিতে। আর আফিফ তার পিছু নিচ্ছে। কিন্তু ধরতে পারছে না আহিকে।
চলবে-