উধয়রনী পর্ব-৫৭+৫৮

0
449

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৫৭||

১১৯।
ডায়েরীর প্রতিটি পাতায় স্কেচ। কোথাও খোলা মাঠে বসে একটা ছেলে ছবি আঁকছে, আর তার পাশে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোথাও রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা একটি ছেলে বোতল থেকে পানি খাচ্ছে, পাশে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ে। মেয়েটির দৃষ্টি ছেলেটির দিকে। ঠোঁটে মিষ্টি হাসি। কোথাও বা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা একটি ছেলে, অন্যদিকে সেই ছেলের দিকে ভাবুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে একটি মেয়ে।
আহি চারুশিল্পে এমন কোনো বৃহস্পতিবার, শুক্রবার যায় নি, যেদিন আফিফকে ডায়েরীতে ধারণ করে নি। তারিখসহ লেখা আছে৷ প্রতিদিন আফিফের পিছু নেওয়া ছাড়াও, সপ্তাহের বাকি দিনেও টুকিটাকি আফিফকে নিয়ে লেখায় পুরো ডায়েরীর অর্ধেক পাতা ভর্তি। আফিফের চোখে পড়ছে ছোট ছোট বাক্য। কোথাও লেখা,
“এআর, এই ভালোবাসার নাম কি দেওয়া যায়?”

কোথাও লেখা,
“ভালোবাসি, প্রিয় এআর। ইচ্ছে করছে তোমাকে বসিয়ে রাখি আমার সামনে।”

কোথাও বা লেখা,
“কি সুন্দর করে আকাশ দেখো তুমি! আমাকেও একটু দেখো ওভাবে।”

প্রতিটি বাক্য পড়েই আফিফের বুক চিরে বেরিয়ে আসছে দীর্ঘশ্বাস। অদ্ভুত ভাবে অশ্রুও ভীড় করছে চোখের কোণে। শার্টের হাতায় মুছছে সে। বেয়ে পড়ার সুযোগ দিচ্ছে না।

ডায়েরীর অনেক পাতা পড়ার পর আফিফ হঠাৎ থমকে গেলো একটি পৃষ্ঠায় এসে। আহি বিভিন্ন মাধ্যমে আফিফের ছবি এঁকেছে ক্যানভাসে। আর সেই ছবিগুলো বের করে ডায়েরীতে আঠা দিয়ে লাগিয়েছে। কিছু কিছু ছবি চারুশিল্পে পড়া অবস্থায় এঁকেছে। আর কিছু কিছু ছবি এঁকেছে পদ্ম আর আফিফের বিয়ের পর। ছবিগুলোর মধ্যে এক্রাইলিক পদ্ধতিতে আফিফের ছবি আঁকার একটি মুহূর্ত এঁকেছে। জলরঙ দিয়ে দোকানে দাঁড়িয়ে চা খাওয়ার একটি মুহূর্ত এঁকেছে। সবচেয়ে চমৎকার একটা ছবি ছিল অস্বচ্ছ জলরঙের মিশ্রণে আফিফের মোটর সাইকেলের উপর বসে থাকা। কক্সবাজারে আফিফের সমুদ্র দেখার একটা তৈলচিত্রও এঁকেছে আহি। প্যাস্টেল রঙের ধারণ করেছে মাস্টার্সের ক্লাসে একা একা বসে থাকা। কাঠের উপর আফিফের খোঁদাই করা ছবি, ফটোরিয়্যালিজমেও আফিফকে আঁকা বাদ যায় নি তার। এসব দেখে আফিফের বুক ভারী হয়ে এলো।
কয়েক পৃষ্ঠা পর আফিফের চোখ আটকে গেলো আহির একটি লেখায়। আহি লিখেছে,
“আজ থেকে আমার প্রিয় রঙ হয়ে গেলো সাদা। এতোদিন ধূসর বেগুনি ছিল আমার পছন্দের রঙ। কিন্তু এখন আমি শুধু সাদা জামায় পছন্দ করি। প্রতি সপ্তাহে সাদা জামা পরেই চারুশিল্পে যাচ্ছি, অন্তত এআরের দৃষ্টি আকর্ষণের লোভে। কিন্তু সে তো আমাকে দেখেই না। ইশ, রং যদি কথা বলতে পারতো, তাহলে তাকে গিয়ে বলতো, দেখো আফিফ। মেয়েটা তোমার জন্য বেরঙিন হয়েছে। তুমি কি তার জীবনটা রাঙিয়ে দিতে আসবে না?”

আফিফ এতোটুকু পড়েই মলিন হাসলো। চোখ মুছে মনে মনে বলল,
“সরি, তোমাকে রাঙিয়ে দেওয়ার জন্য আমি তোমার পাশে ছিলাম না। নিজেকে এতোদিন তোমার অযোগ্য মনে হয়েছিল। এখন তো মনে হচ্ছে তোমার মুখোমুখি দাঁড়ানোরও কোনো যোগ্যতা নেই আমার।”

আফিফ পরের পৃষ্ঠা উল্টাতেই দেখলো ডায়েরীতে কয়েকটা অলকানন্দা ফুলের পাপড়ি আঠা দিয়ে লাগানো। তার মাঝখানে লেখা,
“এআর, সেদিন দেখলাম তুমি অলকানন্দা ফুলের চারা কিনছো। আমি আগে কখনো এই ফুল সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। সেদিন চিনেছি। এটাও জানলাম, অলকানন্দা তোমার প্রিয় ফুল। জানো, এখন আমার বাগানে এতো এতো অলকানন্দা গাছ! আমি তোমার মাঝে এতোটাই ডুবে গেছি যে তোমার প্রিয় ফুল স্পর্শ করেই আমার সকাল শুরু হয়। আমার খুব ইচ্ছে তোমার ফুল হওয়ার। তোমার অলকানন্দা হওয়ার। অন্তত আমাকে আলতো করে ছুঁয়ে দিলেই হবে।”

দীর্ঘশ্বাস ফেললো আফিফ। পরের পৃষ্ঠায় যেতেই আফিফ খুব বড়সড় ধাক্কা খেলো। এমন কিছু সে কখনো কল্পনা করে নি। সেখানে লেখা ছিল,
“তোমাকে তো স্পর্শ করা যায় না। আমার কল্পনায় তুমি যাওয়া আসা করো। আর এভাবে দ্বিমাত্রিক ছবি এঁকে আমি তোমাকে অনুভব করতে পারছি না। মনে হচ্ছে তুমি অনেক দূরে। আমার এবার একটু সম্রাট শাহজাহান হতে ইচ্ছে করলো। সম্রাট যেমন তার প্রেমের সাক্ষী রূপে তাজমহল বানিয়েছে। আমিও একই কাজ করে ফেলেছি। কি করেছি জানো? হুম, তোমার ভাস্কর্য বানিয়েছি। একদম তোমার প্রতিরূপ। সাদা শার্ট সেই ভাস্কর্যের গায়ে। একটা অলকানন্দা ফুল গুঁজে দিয়েছি খাঁজ কাটা পকেটে। তোমাকে স্পর্শ করার এটাই একমাত্র সুযোগ। এআর, এখন তুমি শুধু আমার। তোমাকে স্পর্শ করার অধিকার শুধুই আমার।”

আফিফ ডায়েরীটা বন্ধ করে ঘড়ির দিকে তাকালো। রাত তিনটা। ইচ্ছে করছে আহির নম্বরে একবার ডায়াল করতে। এখনো কি এভাবেই আহি তাকে ভালোবাসে? তার কি আহির সাথে একবার কথা বলা উচিত?

(***)

এক্সিভিশনের আগে জায়গা খুঁজে আফিফের জন্য নিজেকে সাজিয়ে ছবি তোলার ঘটনাগুলোও ডায়েরীতে লিখেছে আহি। কিন্তু এরপর অনেকদিন আহি ডায়েরীতে হাত দেয় নি। পরের বার লিখেছে, আফিফের কার্ড রিজেকশনের ঘটনা। লেখাগুলো পড়তেই আফিফের গলা কাঁপছে। আহি লিখেছে,
“এভাবে না করে দিলে আমাকে? জানো, খুব কেঁদেছি আমি। আচ্ছা, আমি দেখতে কেমন ওটাও কি জানতে ইচ্ছে করে নি? খুব রাগ হচ্ছে আমার। তোমার ভাস্কর্যটা জড়িয়ে ধরে কতো বার করে বললাম, আমার ভালোবাসা মেনে নাও। আমি তোমাকে খুব সুখে রাখবো। কিন্তু তুমি তো শুনলেই না। মুভিতে দেখায় না, নায়িকা কিছু ভাবছে, আর নায়ক অনুভব করছে। আচ্ছা, বাস্তবেও এমন হয় না কেন? একটু কি বুঝবে না আমার অনুভূতি। গলায় কথা আটকে যাচ্ছে আমার। কলম চলছে না। কিন্তু এসব তো তুমি সামনে থাকলেই বুঝতে। চার দেয়ালের ফাঁকে আমার আর্তনাদ কেউ শুনছে না। কতোবার কলম হাত নিয়ে রেখে দিচ্ছি। লিখতে গেলেই কান্না পাই। কথা বললেই গলা কাঁপে। মা বুঝেছে আমি কষ্ট পাচ্ছি। কিন্তু জিজ্ঞেস করবে না। মা-বাবাও হ্যাপি না। আমিও হ্যাপি না। আমি মায়ের মতো কষ্ট পেতে চাই না। আমি তোমার ভালোবাসা চাই। আমাকে একটু ভালোবাসো, প্লিজ। কি করবো আমি?”

এতোটুকুই লিখেছে আহি। আফিফ বুঝতে পারলো এতোটুকু অসমাপ্ত লেখা। আহি আরো কিছু লিখতো। কিন্তু পারে নি। হয়তো সেদিন বালিশে মুখ গুঁজে কেঁদেছিল। হয়তো ভাস্কর্যটির সামনে সারারাত দাঁড়িয়ে অনুরোধ করে বলেছিল, আমার ভালোবাসা মেনে নাও। এসব ভাবতেই নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে আফিফের। পরের পৃষ্ঠায় কি থাকবে আফিফ জানতে চাচ্ছে না। এতোটুকু পড়েই তার কষ্ট হচ্ছে, বাকীগুলো কীভাবে পড়বে?

তারপরের বিশ পৃষ্ঠা জুড়ে ছিল আহির আফিফকে একা একা অনুভব করার ঘটনা। আফিফের রিজেকশনের পর আড়াই বছর আহি আফিফের পিছু করেছে। কখনো আফিফের ক্যাম্পাস, কখনো ফেইসবুকের ছবিগুলো ছাপিয়ে বের করা বা স্কেচ করা, কখনো আফিফের টাইমলাইনে লেখা ছোট ছোট স্ট্যাটাসের দেয়ালিকা তৈরী করার ঘটনা। বিশ পৃষ্ঠার পরের পৃষ্ঠায় লেখা ছিল, সেই ভয়ংকর রাতের মুহূর্তটি। উপরে খুব সুন্দর করে আহি লিখেছে,
“আমার এআরের বিয়ে তার পদ্মফুলের সাথে।”

আফিফ আর পড়তে পারবে না। এতোটুকু বর্ণনায় যদি তার বুক কাঁপিয়ে দেয়, তাহলে পরের গুলোতে কি হবে। ডায়েরী রেখে দিলো আফিফ। মেঝেতে শুয়ে পড়লো সে। নীরবে কাঁদলো কিছুক্ষণ। হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো তার। অপরিচিত নম্বর। ঘড়ির দিকে তাকালো আফিফ। ফজরের আযান দেবে একটু পর। আফিফ কল রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে ভেসে এলো পদ্মের কণ্ঠ।

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৫৮ (১ম ভাগ)||

১২০।
পদ্মের কন্ঠ শুনেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো আফিফের। এমনিতেই আহির ডায়েরীটা পড়ে মন ভালো নেই, তার উপর আহিকে হারিয়ে ফেলার মূল কারণ পদ্ম এখনো তার পিছু ছাড়ছে না। এই মুহূর্তে পদ্মকে তার উপদ্রব মনে হচ্ছে। পদ্ম ওপাশ থেকে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল,
“আফিফ, মা আমাকে আজ ভীষণ মেরেছে। আমাকে একটু বাঁচান। জানি, আমি আপনার অপরাধী। কিন্তু এতোটাও তো খারাপ নই যে আমাকে এমন বিপদ থেকে বাঁচাতে আসবেন না।”

আফিফ গম্ভীর সুরে বলল,
“তুমি যদি তাজওয়ারের মতো নরপশুর মার খেয়ে আমাকে ফোন করতে তাহলে ভেবে দেখতাম। কিন্তু তুমি এখন তোমার অভিভাবকের হাতে। ওরা তোমার ভালো তোমার চেয়ে বেশি বুঝবে। মার খেয়েছো, বুঝে নাও ভালোর জন্যই খেয়েছো।”

কথাটা বলেই আফিফ কল কেটে দিলো। ওপাশে পদ্ম ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তার অপরাধের শাস্তি সে পাচ্ছে। আফিফকে হারিয়ে ফেলায় তার শাস্তি। কিন্তু কখনো যদি আফিফ সংসারী হয়ে যায়? তখন তো চাইলেও আফিফকে পাওয়া সম্ভব না৷ এখন যেহেতু তালাক হয়ে গেছে, আফিফকে দ্বিতীয় বার পাওয়ার একমাত্র সুযোগ, অন্য কাউকে বিয়ে করে তার কাছ থেকে তালাক নেওয়া। পদ্ম মনে মনে ভাবছে,
“বাবা যে প্রস্তাবটা এনেছে আমি কি তাহলে সেই লোকটাকে বিয়ে করে নেবো? তারপর না হয়, তাকে ছেড়ে দিলাম। এরপর আফিফের সাথে আবার বিয়ে হবে।”

এমন ভাবনা আসতেই পদ্মের মন ভালো হয়ে গেলো। পদ্ম ভুলেই গেলো আবেগের তাড়নায় অবাস্তব চিন্তা করছে সে।

(***)

“ভাবতেই পারি নি সেদিন আমাকে জীবনের এতোটা ভয়ংকর অধ্যায়ের মুখোমুখি হতে হবে। বাবা-মার ডিভোর্স হয়ে গেছে অনেক দিন। আমি একা থাকি। বাবা দেরী করে বাসায় আসে। আমার জীবনে কোনো সার ছিলো না। কোনো আনন্দ ছিল না। লিনাশা ছিল হাসির কারণ। সেও নেই এখন। কেউ নেই। সবাই চলে গেছে আমাকে ফেলে। এই মুহূর্তে আমার শরীরে জ্বর প্রায় ১০২ ডিগ্রী। আমি ডায়েরী লিখছি এমন অবস্থায়৷ গত কয়েক সপ্তাহে আমার জীবনে অদ্ভুত ঝড় বয়ে গেছে। আর এতো ঝড়-ঝাপটার কাছে ১০২ ডিগ্রী জ্বর খুবই হাস্যকর। বাবা-মায়ের আলাদা হয়ে যাওয়াটা আমার ভাবনার মধ্যে ছিল। বরং তাদের বিচ্ছেদ না হওয়াটাই আমাকে ভাবাতো। ভাবতাম মা কিভাবে এতো কম্প্রোমাইজ করছে? কিভাবে সহ্য করছে বাবাকে? এখন তো বুঝতে পারছি, বাধ্য হয়েই করেছে। যেমন আমাকে কম্প্রোমাইজ করতে হচ্ছে, সত্যটা বাধ্য হয়ে মেনে নিতে হচ্ছে। বর্ষার রাত। পদ্মের বিয়েতে আমি একাই গিয়েছি। দেখলাম পদ্মকে নিতে তার বর এসেছে। পদ্মের দিকে হাত এগিয়ে দিলো মানুষটা। আমি থমকে গেলাম তাকে দেখে। আমার ভালোবাসার মানুষ, পদ্মের বর। আক্দ আরো অনেক মাস আগেই হয়ে গিয়েছিল। এখন তো পদ্মকে নিয়ে যাবে। সরি, পদ্ম না। পদ্মফুল। এখন তো পদ্ম আমার কাছে পদ্মফুল। যেই সম্বোধন তার, সেই সম্বোধন আমারও হওয়া উচিত। তার ভালো লাগার সবকিছুকেই নিজের ভালো লাগা ভেবে নিয়েছিলাম। পদ্মকে যদি ফুলের মতো না দেখি, তাহলে হিংসে হবে। ঘৃণা জন্মাবে। কেন শুধু শুধু তার প্রিয় মানুষকে নিজের অপ্রিয় করবো? তার প্রিয় রং, তার প্রিয় ফুল, তার প্রিয় সবটাই যেহেতু আমার প্রিয়, তবে তার প্রিয় মানুষটা কেন আমার প্রিয় হবে না? সেদিন বর্ষার রাতে আমি তার আর পদ্মফুলের বিয়েতে গেলাম। যেই কন্ঠ শুনে আমার ফ্রেমে তুলে রাখতে ইচ্ছে হতো, সেই কন্ঠে শুনলাম, পদ্মফুল। যার স্পর্শ পাওয়ার লোভে ভাস্কর্য বানিয়েছিলাম, সেই মানুষটা ধরলো অন্য কারো হাত। তাদের বিয়ের খাবার গলা দিয়ে নামছিলো না। জোর করে খেয়েছি। কেঁদেছিও ভীষণ। পদ্মের বড় আপুকে বললাম, আমার ঝাল লেগেছে। আসলেই তো। ভীষণ ঝাল লেগেছে। আমার ভালোবাসা যাকে আমি মিষ্টি অনুভূতি ভাবতাম, সে আমাকে মরিচ লাগিয়ে দিয়ে চলে গেছে। হা হা হা। হাসি পাচ্ছে খুব। হাসিটা শুনলে ভয়ংকর লাগবে। পাগলের হাসি। বিশ্রী হাসি। আমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছি একটু আগে। মোটেও কম সুন্দরী নই আমি। কিন্তু এই মুহূর্তে আমাকে দেখলে মনে হবে মানসিক হাসপাতাল থেকে পালিয়ে আসা পাগল। আচ্ছা, তারপর বলি। কিভাবে যেন সেদিন আফিফ জেনে গেলো আমি সেই মেয়েটি। আমি ঘোরের মধ্যে ছিলাম, ওতো কিছু মনে পড়ছে না। হয়তো পদ্ম আমার পরিচয় দিয়েছিল। আমি তো এতোকিছু খেয়াল করি নি। আমার শুধু মনে আছে, তার হাসি হাসি চেহারায় আমার নাম শুনে গ্রহণ লেগেছিল। সে ভেবেছিল, আমি তার পদ্মফুলকে বলে দেবো, আমার ভালোবাসার কথা। তার সংসার ভেঙে দেবো। এরপর আমি তাকে সত্যটা সামনা-সামনি জানিয়েছিলাম। যা বুঝলাম, সে আমাকে চায় না। আমি তার জীবনে এক্সিস্টও করি না। চড় বসিয়ে দিতে ইচ্ছে হলো নিজের গালে। চলে এলাম বৃষ্টির মধ্যে। ভিজতে ভিজতে দামী লেহেঙ্গা কাঁদায় মাখামাখি অবস্থা। লেহেঙ্গাটা আমি ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছি। ব্যাড লাক সিম্বল রেখে কী লাভ? কাউকে দেবো না এই লেহেঙ্গা। কারণ আমি চাই না, আমার শত্রুও এমন ব্যাড লাকের মুখোমুখি হোক। বিভীষিকাময় রাত ছিল সেদিন। এরপর যখন জ্ঞান ফিরলো। একের পর এক ধাক্কা খেলাম। জানলাম আমি ব্রেইন স্ট্রোক করেছি। এরপর বাবা বিয়ে করলো লিনাশার বড় আপুকে। লিনাশার বাবা মারা গেলো। আমাদের বন্ধুত্বও ভাঙলো। সব হারালাম। আর এখন আমি বড়লোক ভিখারিনী। যার সব আছে, অথচ কিছুই নেই। কেউ আমাকে ঠকায় নি। আমার ভাগ্য আমাকে ঠকিয়েছে। তাহলে আমি কাকে অপরাধী বলবো? তবে আমার জীবনের এক অংশের জন্য আমি একজনকে অপরাধী ভাবতে পারি। লাবণি মেহেরা। সারাজীবন ঘৃণা করতে থাকবো তাকে৷ অন্য অংশের জন্য কাকে দায়ী করবো? আফিফকে হারিয়ে ফেলার জন্য কাকে দায়ী করবো আমি?”

এতোটুকু পড়েই আফিফ নিজের আলমারিতে যত্নের সাথে ডায়েরীটা রেখে দিলো। এরপর ওজু করে নিলো। নামাজে দাঁড়ালো। সেজদায় কাঁদলো অনেকক্ষণ। মোনাজাত ধরলো। চাইলো, যেটা সঠিক, যেটা সবার জন্য ভালো, সেটাই যাতে হয়। দিনশেষে আহি যাতে সুখী হয়। আর সেই সুখ আহি যার মাঝে খুঁজে পায়, তাকেই যাতে আহি জীবনসঙ্গী করে নেয়।

১২১।

ভোর ৬টা। আহি সবে মাত্র একটা ছবি এঁকে শেষ করলো। ছবি আঁকা শেষ করেই কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো ছবিটির দিকে। ভাবতে লাগলো কি নামকরণ করা যায় ছবিটির। অদ্ভুত এক ছবি। প্রথম দেখায় মনে হবে শুধু রং ছড়িয়েছে। কিন্তু ধীরে ধীরে খুঁজে পাওয়া যাবে একটা স্যাঁতসেঁতে ডোবায় একটি মেয়ে চিত হয়ে ভাসছে। তার চুলগুলোও ভাসছে। চুলের ফাঁকে ফাঁকে সাদা রঙের ফুল। আহি কালো কালি দিয়ে পাশে নিজের স্বাক্ষর করলো। তারপর হাত-মুখ ধুয়ে বেরিয়ে এলো। হঠাৎ তার চোখ আটকে গেলো কাচের আলমারির তাকে। খটকা লাগলো তার। তড়িৎ গতিতে আলমারি খুলে আশেপাশে ঘাঁটতে লাগলো। বিড়বিড় করে বলল,
“ডায়েরীটা তো এখানেই রেখেছি।”

আহির স্পষ্ট মনে আছে, কাল ওয়াসিফের কাছ থেকে নিয়ে ডায়েরীটা সে এখানেই রেখেছিল। আহি এবার পাশ ফিরে খেয়াল করলো তার ড্রেসিংয়ের টুলটা বাঁকানো। কাল আর আজ একবারো সে সেই টুলে বসে নি। তাহলে কি ওয়াসিফ নিজের সাথে তার ডায়েরীটাও নিয়ে গেছে? এমন সাংঘাতিক কাজ করবে ছেলেটা? আহি বিশ্বাস করতে পারছে না। সে পাগলের মতো খুঁজতে লাগলো তার ডায়েরী। রুমের বাইরে এসেও খুঁজলো। আহির নিজের নিরাপত্তার জন্য পুরো ঘরে সিসি ক্যামেরা লাগিয়েছিলো। সাথে নিজের রুমেও লাগিয়েছিল। আহি ল্যাপটপ চালু করে গতদিনের ফুটেজ দেখলো। সত্যিই গতকাল আহি রুম থেকে বেরুতেই ড্রেসিংয়ের সেই টুল টেনে কাচের আলমারি খুলে সেই ডায়েরীটা ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলেছিল ওয়াসিফ। আহি ল্যাপটপ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। অবশ্য এখানে বাচ্চাটারও দোষ নেই। হয়তো আহির ডায়েরী খুলে স্কেচগুলো দেখে তার আগ্রহ জন্মেছিল, তাই নিয়ে গেছে। আহির অস্থির লাগছে। এই ডায়েরীটা দেখেই সে অনুভব করে আফিফ তার আশেপাশে আছে। আহি এবার দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালো। সাড়ে ছয়টা বাজছে। এতো সকাল সকাল কাউকে ফোন দেওয়াটা অভদ্রতা। আহি অপেক্ষা করলো। বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলো বেশ কিছুক্ষণ। সময়টা যাচ্ছেই না। এরপর রুমে এসে ঘড়িতে দেখলো সকাল সাতটা মাত্র। এই মুহূর্তে কান্না পাচ্ছে তার। ওয়াসিফের মায়ের নম্বর ফোনের ডায়াল লিস্টে আছে। ইচ্ছে করছে এক্ষুণি ফোন করতে। কিন্তু আটটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চায়ছে সে।

(***)

আহির ডায়েরীর অনেকাংশ জুড়ে লেখা আফিফের ভাস্কর্য আর আহির নিরব কথোপকথন। আহি প্রায়ই ভাস্কর্যটির সামনে বসে ডায়েরী লিখতো। এটাই শেষ সম্বল ছিল তার। কিন্তু একদিন সেটাও ভেঙে ফেললো আহির বাবা। পাগল প্রায় আহি ডায়েরীর পাতা উলটে আফিফকে বের করে আনতে চাচ্ছিলো। কিন্তু সে নিরুপায়। ভাস্কর্যের ভাঙা অংশগুলো হাতড়ে হাতড়ে কেঁদেছিল বেশ কয়েক ঘন্টা। লিনাশা এসে শান্ত করেছিল তাকে আর বলেছিল, সে না-কি বেহায়া হয়ে যাচ্ছে। আফিফ এখন আর তার নেই। আহি সেদিনই চোখ মুছলো। দৃঢ় সংকল্প করল। কাঁদবে, তবে নিরবে। মানুষ যেহেতু তার ভালোবাসা, তার পাগলামো, এতোদিনের অপেক্ষাকে বেহায়াপনা বলছে, তাহলে কি দরকার তাদের এসব দেখানোর? আহি কাঁদলো না। বেশ মানসিক চাপ পড়লো তার মস্তিষ্কে। ফলাফলস্বরূপ আহির হ্যালুসিনেশন হতে লাগলো। ইউকে গিয়েও প্রায়ই আফিফের সাথে কথাবার্তা বলা। তাকে অনুভব করা। একা একা হাসা। সবটাই ডায়েরীতে লিখেছে আহি। আর আফিফ শক্ত হয়ে বসে শুধু পড়ছে সেই লেখাগুলো।

(***)

আহির দৃষ্টি ঘড়ির দিকে। ভদ্রতার মানদণ্ডে অপরিচিত কাউকে ফোন করার সময় সকাল ন’টা থেকে রাত ন’টা হওয়া উচিত। কিন্তু আহির জন্য দুই ঘন্টা অপেক্ষা করাই অনেক কষ্টকর ছিল। ঘড়িতে আটটা ছুঁইছুঁই হতেই সে ফোন হাতে নিয়ে ডায়াল করলো নাওফা রেনুকার নম্বরে। প্রথম বার কল করলো, দ্বিতীয় বার করলো, তৃতীয় বার করলো, কিন্তু রিসিভ হলো না। পাগল পাগল লাগছে আহির। এবার তো সহ্যই হচ্ছে না তার। হাত কাঁপছে ভীষণ৷ ব্যস্ত পায়ে সে বেরিয়ে পড়লো বাসা থেকে। সালমা ফাওজিয়া আহিকে সকাল সকাল বের হতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন,
“কোথায় যাচ্ছো, আহি?”

আহি ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“আমার ডায়েরী! আমি তোমাকে এসে বলছি, মা।”

আহি বেরুতে বেরুতে আবার কল করলো সেই নম্বরে। এবার কলটা রিসিভ হলো। আহি কথা বলতে বলতেই গাড়িতে উঠলো।

(***)

“প্রিয়, বৃষ্টিস্নাত ফুল দেখেছো কখনো? ভীষণ স্নিগ্ধ লাগে দেখতে, তাই না? আজ না হয় আমার দিকেই তাকিয়ে দেখো। তোমার জন্য হলুদ শাড়ি পরে অলকানন্দা সেজে দাঁড়িয়ে আছি রাস্তার মোড়ে। বৃষ্টিতে ভেজা আমাকে দেখে তোমার নিশ্চয় অলকানন্দার কথায় মনে পড়বে। আর তুমি নিশ্চিত আমার প্রেমে পড়বে। যেদিন তুমি আমার প্রেমে পড়বে, সেদিন থেকে আমিই হবো তোমার অলকানন্দা। আর এরপর যখন বৃষ্টি নামবে তুমি আমার হাত ধরে বৃষ্টি বিলাস করবে। করবে না বলো?”

আফিফ ডায়েরী বন্ধ করে ফোনটা হাতে নিলো। বসকে কল দিয়ে জানালো, আজ তার শরীর খারাপ আসতে পারবে না। অফিসে যাওয়ার মতো মানসিক অবস্থা নেই তার। আফিফা বেগম নাস্তা খাওয়ার জন্য দরজায় ঠোকা দিচ্ছেন। আফিফ এক বাক্যেই বলল,
“মা, এখন খেতে পারবো না।”

এরপর আফিফ ডায়েরী খুললো। ইউকে থেকে ফিরে আহির চার বছর পর আফিফকে দেখা, বার-বার আফিফের মুখোমুখিতে আহির মানসিক অবনতি, মানসিক অস্থিরতা কাটানোর জন্য নায়ীবকে দেখানো, এরপর কক্সবাজারের পরিকল্পনা, আর আফিফ আর পদ্মকে একসাথে দেখে আরো বেশি আঘাত পাওয়া আর তাদের নিয়ে মধুচন্দ্রিমার আয়োজন করাটাও ডায়েরীতে লিখেছে আহি।

“এআর, তুমি হয়তো কখনোই আমার কল্পনায় আসবে না। তারা হয়ে গেলে যে। আজ থেকে আবার আমার অনুভূতিগুলো এই ডায়েরীতে স্থান পাবে। শোনো এআর, তোমার জায়গাটা আমি কাউকে দিতে পারবো না। হয়তো এজন্য আমার তোমাকে নিয়ে দেখা অনেক স্বপ্ন অপূর্ণ রয়ে যাবে। কিন্তু আমি তো আহি। স্বপ্ন পূরণের চেষ্টা করবো না, তা তো হয় না। তোমাকে নিয়ে দেখা স্বপ্নগুলো পূরণ হবে, এআর। আমি সেই স্বপ্ন পূরণ করবো আজই। একটা স্বপ্ন ছিল আমার। সাগর পাড়ে তোমার সাথে সমুদ্র বিলাস করবো। এক রাতের জন্য একটা ছোট্ট সাজানো ঘর বাঁধবো সমুদ্র পাড়ে। আজ এই স্বপ্ন পূরণ হবে। আমার কল্পনায় দেখা তুমিটা এবার বাস্তবে হাসবে। তোমার ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে তুমি সমুদ্র দেখবে। শুনবে সাগরের আর্তনাদ। তোমার চোখে আটকে থাকবে তোমার ভালোবাসার মানুষটির মিষ্টি হাসি। তোমার বুকে ঝাপটে পড়বে সে। সেই মানুষটা আসবে আজ। তোমার মনের মানুষ আজ তোমার মনের মতো করে সাজবে।”

এরপর চারটা পৃষ্ঠায় শুধু কলমের দাগ পড়েছে। চারটা পৃষ্ঠার প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা,
“আমার গায়ের গন্ধ লেগেছে বলে ফেলে দেবে তোমার টি-শার্টটা? আমি তো পরতে চাই নি। পদ্ম দিয়েছিল, তাই পরেছি। জানি, কোনো অধিকার নেই। কিন্তু যতোক্ষণ তোমার টি-শার্ট গায়ে ছিল, মনে হয়েছিল তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছো। তোমার আর পদ্মের সংসার দেখেছি আজ। ভীষণ সুন্দর সংসার। আমি এই সংসারে নজর দেবো না। চিন্তা করো না।”

দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় লেখা,
“তোমার স্পর্শ পাওয়ার অনুভূতিটা আমাকে আজীবনের জন্য তোমার করে দিয়েছে, আফিফ। কাপ্তাইয়ে ঘটা আজকের প্রতিটি মুহূর্ত আমি মনে রাখবো। কারণ সেই মুহূর্তে তুমি আমার পাশে ছিলে।”

তৃতীয় পৃষ্ঠায় লেখা,
“সত্যিই কি তুমিও আমায় ভালোবাসতে, এআর? তাজওয়ার কেন বললো এ কথা?”

চতুর্থ পৃষ্ঠায় লেখা,
“এতোটা ঘৃণিত আমি? আমার চেহারাটাও দেখতে চাও না? আর তোমার চেহারা না দেখে যে আমি অস্থির হয়ে যায়? বেশ তো। আসবো না তোমার সামনে। আর কখনো লিখবোও না তোমাকে নিয়ে। তুমি তো চলে যাচ্ছো অন্য জায়গায়। এই শহরটা রেখে যাচ্ছো আমার জন্য। যেই শহরে তোমার সাথে প্রথম দেখা। আমার এক তরফা ভালোবাসার গল্প লেখা। আমার স্বপ্ন ভাঙা। আমার তোমাকে বার-বার হারিয়ে ফেলা।”

এরপরের সব পৃষ্ঠা খালি। অর্থাৎ আহি গত পাঁচ বছরে ডায়েরিতে আফিফকে নিয়ে কিছুই লিখে নি। আফিফ ডায়েরী বন্ধ করলো। আয়নার সামনে দাঁড়ালো। লাল হয়ে আছে তার চোখ দু’টি। তখনই বেল বেজে উঠলো। দু’বার বেল পড়তেই আফিফ মুখ ধুয়ে রুম থেকে বের হলো। এদিক-ওদিক তাকালো। বাসায় কি কেউ নেই না-কি? আফিফা বেগমও তখন বেরিয়েছেন। ছেলেকে দেখে বললেন,
“খুলছিস না কেন? আদ্য এখনো ঘুম। রেনু নাস্তা করে আবার শুয়েছে। আমিও শুয়েছিলাম।”

আফিফ বলল,
“আচ্ছা, আমি দেখছি কে এসেছে!”

আফিফ দরজা খুললো। সামনে তাকাতেই থমকে গেলো সে। আফিফের মুখোমুখি এলোমেলো দৃষ্টি জোড়াও যেন থমকে গেলো সামনের মানুষটিকে দেখে। কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলো উভয়েই। আফিফ অস্ফুটস্বরে বলল, “আহি!’

আহি কিছু বলতে পারলো না। অশ্রু ভীড় করলো তার চোখে। আবার কেন দেখা হলো মানুষটার সাথে? এখন কি আবার হারিয়ে ফেলবে তাকে?

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৫৮ (২য় ভাগ)||

১২১।
থমকে আছে মুহূর্ত। নিস্তব্ধ চারপাশ। কারো মুখে কথা নেই। আফিফকে থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আফিফা বেগম দরজার কাছে এসে দাঁড়ালেন। আহি আফিফা বেগমকে দেখে সালাম করলো। তিনি সালাম নিয়ে আহিকে জিজ্ঞেস করলেন,
“তুমি কে? তোমাকে আগে কোথাও দেখেছি!”

আহি আফিফের দিকে তাকালো। আফিফ ভেতরে ঢুকে গেলো। হাত কাঁপছে তার। অকারণেই ঘামছে সে। কপাল মুছে নিজের রুমের দিকে যেতেই রেনু বেরিয়ে এলো। সে আফিফকে জিজ্ঞেস করলো,
“কে এসেছে?”

আফিফের গলা দিয়ে কোনো শব্দ বেরুচ্ছে না। রেনু ভাইয়ের চোখের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। বাইরে থেকে আহি বলল,
“ওয়াসিফের আম্মুর সাথে কথা বলা যাবে?”

রেনু আহির কন্ঠ শুনে দরজার কাছে যেতেই চমকে উঠলো। আহি রেনুকে দেখে ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“ওয়াসিফ ভুলে হয়তো আমার একটা ডায়েরী নিয়ে এসেছে। একটু এনে দিন। আমি চলে যাচ্ছি।”

আফিফ ওপাশে দাঁড়িয়ে আহির কথাগুলো শুনলো। এরপর রুমে ঢুকে ওয়াসিফের ব্যাগে আহির ডায়েরীটা ঢুকিয়ে দিলো। রেনু আফিফের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আহির হাত ধরে তাকে ভেতরে ঢুকালো। আহিকে কিছু বলার সুযোগটাও দিলো না। আহি ইতস্তত ভাব নিয়ে বলল,
“আমাকে ডায়েরীটা দিয়ে দিলেই আমি চলে যাবো।”

রেনু আহির কথার তোয়াক্কা না করে তাকে বসার ঘরে নিয়ে সোফায় বসালো। আফিফা বেগম রেনুর কান্ড দেখে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। রেনু এবার আহির পাশে বসে বলল,
“এতো ফর্মালিটি কেন, আহি?”

আহি নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। আফিফের মুখোমুখি হতে চায় নি সে। তবুও আজ তাকে আফিফের সামনে এসে দাঁড়াতে হলো। নিশ্চয় আফিফ বিরক্ত হয়েছে। মনটা খচখচ করছে আহির। রেনু আহির মনোযোগ আকর্ষণ করে বলল,
“তোমার খোঁজ নিতে চেয়েছি। ভাইয়াকে কতোবার বললাম, তোমার সাথে যোগাযোগ করতে। কিন্তু করলো না।”

আহি রেনুর দিকে তাকালো। মলিন হেসে বলল,
“আমার খোঁজ কেন নেবে? আমার জন্য তোমাদের জীবনে এতো ঝামেলা হয়েছে।”

আফিফা বেগম বলে উঠলেন,
“তুমিই সেই আহি? আমার এজন্যই তো তোমাকে চেনা চেনা লাগছিল, মা। তুমিই ওই মেয়ে যে মেয়েটা আমাকে ফোন করতো, আমার ছেলের খোঁজ নেওয়ার জন্য।”

আহি চকিত দৃষ্টিতে তাকালো আফিফা বেগমের দিকে। ওই মুহূর্তেই আফিফ ভেতর থেকে রেনুকে ডাকলো। রেনু উঠে চলে গেলো। আফিফা বেগম আহির পাশে এসে বসলেন। আহির হাত ধরলেন আলতো করে। চোখ চিকচিক করে উঠলো তার। কাঁদো কাঁদো মুখ। কাঁপা কন্ঠে বললেন,
“আমি কতো চেয়েছি তুমি আমার ছেলের বউ হও। এতো মিষ্টি লাগতো তোমার কন্ঠ। বয়স হয়েছে, তাও আধো আধো মনে পড়ে।”

আহি হালকা হাসি ফেরত দিলো। আফিফা বেগমের কথাগুলো বুঝতে একটু কষ্ট হচ্ছে তার। ওদিকে রেনু আফিফের সামনে এসে দাঁড়ালো। আফিফ রেনুর হাতে ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“এখানে আছে হয়তো!”

রেনু ব্যাগটা একপাশে রেখে বলল,
“ভাইয়া, চলো। সত্যটা জানাও।”

“কি জানাবো?”

“তুমিও ভালোবাসতে আহিকে।”

“না। কখনো না।”

“ভাইয়া, আহি তোমাকে এখনো ভালোবাসে।”

“তোকে কে বলেছে?”

“তুমি ওর চোখের দিকে তাকাও নি? যদি সত্যিই ভালোবাসা না থাকতো, তাহলে কেন এতো লুকোচুরি? তোমাকে আবার হারিয়ে ফেলার ভয় কেন ওর চোখে?”

“তুই জানিস না, আহি কি করে। ও অনেক ভালো ছেলে ডিজার্ভ করে। আমি ওর যোগ্য না।”

আফিফের চোখে অশ্রু টলমল করছে। সে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল,
“আমি আহিকে কোনো মানসিক চাপ দিতে চাচ্ছি না। এই মুহূর্তে আহি যদি জানে আমি ওকে ভালোবাসি, খুব স্বার্থপর শুনাবে কথাটা। যখন ওর আমাকে প্রয়োজন ছিল, তখন আমি কোথাও ছিলাম না। আর এখন ওর সব আছে। আমার এই মুহূর্তে ওর সামনে দাঁড়ানোরও যোগ্যতা নেই।”

“ভালোবাসায় যোগ্যতা দেখে না, ভাইয়া। তুমি যদি আহির ভালোবাসা বুঝতে এই কথা বলতে না। সব মেয়ের ভালোবাসা পদ্মের মতো না। কিছু মেয়ে স্বার্থহীন ভাবেও ভালোবাসে। যেমন আহি। এখন মনে হচ্ছে, আসলেই আহিকে বোঝার সেই যোগ্যতা তোমার নেই।”

আফিফ রেনুকে বের করে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। এরপর দেয়ালে হেলান দিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
“তুই বুঝবি না, রেনু। বুঝবি না আমার মধ্যে কি যাচ্ছে। আমি কতো বড় অপরাধী। আমি ওর পাশে ছিলাম না, যখন ওর একমাত্র আশ্রয় আমি মানুষটা হওয়া উচিত ছিলাম। শুধুমাত্র আমার জন্য, আমাকে পাওয়ার স্বপ্ন দেখে মেয়েটা এতো কষ্ট পেয়েছে। আমিই তো সব সমস্যার মূল। এখন তো আহি লিনাশাকেও পেয়েছে, ওর মা আছে। ক্ষমতা আছে ওর। যা ওর কাছে সেই সময় ছিল না। এই মুহূর্তে আমি ওর সামনে এসে যদি বলি, ভালোবাসতাম। স্বার্থপর শুনাবে কথাটা। অবশ্যই আমাকে বলবে, তখন কোথায় ছিল সেই ভালোবাসা? তখন কেন একলা ফেলে চলে গিয়েছিলাম? কেন পদ্মকে বিয়ে করে সংসার বেঁধেছিলাম? আহি কি বিশ্বাস করবে আমি সেই মুহূর্তে কতোটা অসহায় ছিলাম? যদি মনে করে মিথ্যে বলছি। আমার কাছে কোনো প্রমাণ নেই। আর পদ্ম কি কখনো আহিকে বলবে, সে কতো বড় অন্যায় করেছে? পদ্ম না বলা পর্যন্ত আহি কি শুধু আমার কথায় বিশ্বাস করবে, আমি সেই মুহূর্তে কোন অবস্থায় গিয়ে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম?”

(***)

রেনু আহির সামনে এসে ব্যাগ থেকে ডায়েরীটা বের করতেই আহি সেটা নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। রেনু বলল,
“একটু বসো।”

আহি ভেতরের দরজার দিকে তাকিয়ে বলল,
“না, আমি কাউকে বিরক্ত করতে আসি নি। আমি তো জানতামও না, এটা পদ্মের স্বামীর বাড়ি। ভালো থাকবেন আপনারা।”

রেনু আহির পথ আটকে দৃঢ় স্বরে বলল,
“এটা পদ্মের স্বামীর বাড়ি না।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো, “মানে?”

“তুমি জানো না, পদ্ম আর ভাইয়ার পাঁচ বছর আগে তালাক হয়ে গেছে?”

কথাটা শুনে আহি ভীষণ অবাক হলো। বিষ্ময়ভরা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “কেন?”

রেনু তার গলার উড়না সরিয়ে দিলো। আহি রেনুর ঝলসে যাওয়ার বুকের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কীভাবে হলো এটা?”

“তুমি কি বিশ্বাস করবে আমার কথা?”

“কেন বিশ্বাস করবো না?”

“তোমার বান্ধবী পদ্ম আমাদের জীবনটা শেষ করে দিয়েছে।”

পদ্ম কীভাবে ছল করে আফিফকে বিয়ে করেছে। কীভাবে রেনুকে নিয়াজীর সংসারে আটকে রেখেছিল। কীভাবে তাজওয়ারের সাথে মিলে আফিফ আর আহিকে আলাদা করেছে, সবটাই জানালো রেনু। আহি সব শুনে ধপ করে সোফায় বসে পড়লো। রেনু আহির পায়ের কাছে বসে বলল,
“আমার ভাইয়া আমার সামনে কাঁদে নি। মানুষটা এতোটা চাপা স্বভাবের। সব চুপচাপ সহ্য করে গেছে। আমাকে, মাকে কিছু জানায় নি। তোমার বিশ্বাস হবে না হয়তো আমার কথা। পদ্ম তোমার ছোটবেলার বান্ধবী। তাই ভাইয়া ভয় পায়। তুমি বিশ্বাস করবে না। তাই তোমার সামনে যায় নি। কতোবার বলেছি চট্টগ্রাম গিয়ে তোমার সাথে যোগাযোগ করতে। আমি অসুস্থ, নয়তো আমিই যেতাম। তোমার ফোন নম্বর ভাইয়ার কাছে আছে। তোমার কলের অপেক্ষায় ছিল। তুমি হয়তো ফোন দেবে। গত পাঁচ বছরে সিমটা চেঞ্জ করে নি ভাইয়া।”

আহি চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালো। রেনু বলল,
“আমার ভাইয়া তোমাকে ভালোবাসে, আহি।”

আহি দ্রুত পায়ে বাসার বাইরে বেরিয়ে এলো। আহি চলে যেতেই রেনু দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। মিনমিনিয়ে বলল,
“হয়তো আমিই ভুল ছিলাম।”

(***)

আহি সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো। ঘোরের মধ্যে হাঁটছে সে। বুকের সাথে শক্ত করে চেপে ধরলো ডায়েরীটা। নিচে নেমে গাড়ির কাছে এসে দাঁড়ালো। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে আফিফ। আহি হুট করে চার তলার বারান্দার দিকে তাকালো। আফিফ সরে গেলো সাথে সাথেই। আহি বারান্দার দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোমাকে বিশ্বাস করবো না আফিফ? কীভাবে ভাবলে তোমাকে বিশ্বাস করবো না? যখনই ভালোবাসার সংজ্ঞা জেনেছি, তোমাকেই ভালোবেসেছি। আর ভালোবাসার মানুষকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করেছি। তোমাকে জেনেই তো তোমার প্রেমে পড়েছি। কীভাবে অবিশ্বাস করবো তোমাকে? আমি পদ্মকে জিজ্ঞেস করবো, কেন কেঁড়ে নিয়েছে আমার কাছ থেকে আমার প্রিয় অলকানন্দকে। আমি জিজ্ঞেস করবো। ওকে আমার অপ্রিয় বর্ষার রাতের প্রতিটা প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। যেই পদ্ম আফিফের অপ্রিয়, সে আমার প্রিয় কখনোই না।”

১২২।

আহি বাসায় ফিরতেই পুষ্পকে দেখে অবাক। পুষ্প আহির গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
“আন্টি আর নানু কক্সবাজার এসেছে ভাবলাম দেখা করতে আসি।”

“হুম। ভালো করেছিস।”

“আমি একা আসি নি। উজ্জ্বল ভাইয়া আর চাচীও এসেছে।”

আহি থতমত খেয়ে গেলো বেশ। ভেতরে ঢুকেই উজ্জ্বলকে দেখে মুচকি হাসলো। এরপর সে মায়ের দিকে তাকালো। সালমা ফাওজিয়ার ঠোঁটে রাজ্য জয়ের হাসি। নিশ্চয় মা বিয়ের জন্য আজ তাকে পীড়াপীড়ি করবে। আহি এসব পরিস্থিতিতে পড়তে চায় না। সে সোজা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলো। ব্যাগ বের করে গুছিয়ে নিলো। তিন দিনের যাত্রা। উদ্দেশ্য, পদ্মের বাড়ি যাওয়া। লিনাশাকেও মেসেজ করে দিলো। লিখলো,
“পদ্মের সাথে অনেক বোঝাপড়া বাকি। পাশে থাকলে তুই পুষ্পকে নিয়ে চলে আসিস। আমি ঠিকানা বলে দেবো।”

আহি উজ্জ্বলের সামনেই বেরিয়ে এলো। উজ্জ্বলের বেশ খারাপ লাগলো। একটু কথাও বললো না? গাড়িতে উঠতেই পুষ্পের কল। আহি রিসিভ করতেই বলল,
“আমাকে অপমান করলি তুই।”

“তুই আর তোর জামাই আমার বাসায় ওয়েলকাম। উজ্জ্বল সাহেবও ওয়েলকাম। কিন্তু ঘটক আর পাত্রদের আমি ওয়েলকাম করি না। আমার পথের কাঁটা এরা।”

কথাটা বলেই আহি কল কেটে দিলো। ড্রাইভারকে বললো ঠিকানা। কয়েক ঘন্টার পথ। আহি ফোনের স্ক্রিনে আফিফের নম্বরটির দিকে তাকিয়ে আছে। মনে মনে ভাবছে,
“এতো অপেক্ষা কেন করেছো, এআর? আমার মতো একবার না হয় বেহায়া হয়ে দেখতে। আমি কিন্তু তোমাকে ফিরিয়ে দিতাম না।”

এদিকে আফিফ থম মেরে বসে আছে মেঝেতে। রেনু ধীর পায়ে ভাইয়ের রুমে এসে তার পাশে বসলো। আফিফ মলিন হেসে বলল,
“আমি বলেছি না, ও আমাদের কথা বিশ্বাস করবে না। আর পদ্ম ওকে সত্যটা বলবে না।”

রেনু ভাইয়ের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“মন মানছে না ভাইয়া। আহির চোখে তোমার প্রতি সেই ভালোবাসা এখনো কীভাবে আছে?”

“ভালোবাসা হয়তো পাঁচ বছর আগেই আমি হারিয়ে ফেলেছি। এরপর হয়তো আমাকে নিয়ে সে ভাবেই নি।”

পরক্ষণেই আফিফের মনে প্রশ্ন জাগলো, তাহলে ডায়েরীটা এখনো কেন যত্নের সাথে রেখে দিয়েছে আহি?

(***)

পদ্মের বাড়িতে এসে অবাক হলো আহি। বাড়িতে তোড়জোড় চলছে। সবাই ব্যস্ত। আহি উঠানে এসে দাঁড়াতেই পদ্মের আপাকে দেখলো। আহিকে দেখে বেশ অবাক হলেন তিনি। ছুটে এসে বললেন,
“আহি, তুমি?”

আহি আশেপাশে তাকিয়ে বলল,
“এতো আয়োজন? কোনো প্রোগ্রাম হচ্ছে?”

“তোমাদের সাথে তো কোনো যোগাযোগ রাখে নি পদ্ম। তাই হয়তো জানো না। পদ্মের আগের সংসার ভেঙে গেছে। আজ ওর দ্বিতীয় বিয়ে।”

আহি চমকে উঠলো। আপা বললেন,
“আজ সকালেই হ্যাঁ বললো। এরপর বাবা তাড়াতাড়ি আয়োজন করে ফেললেন। একটু পর আক্দ। তারপরই রাতে উঠিয়ে দেবে।”

আহি কিছু বলার আগেই পদ্মের আপা আফসোসের সুরে বললেন,
“মা হতে পারবে না, তাই আমার বোনটাকে ছেড়ে দিয়েছে।”

আহি ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “শুধুই কি মা হতে না পারা?”

“আর নয়তো কি!”

“পদ্মকে জিজ্ঞেস করেন নি?”

পদ্মের আপা থমকে গেলেন। তিনি হয়তো জানতেন না, আহি সব সত্য জেনেই এসেছে। মাথা নিচু করে বললেন,
“তোমরা ওর ছোটবেলার বান্ধবী। তোমরা ওকে ভালো করেই চেনো। তোমার কি মনে হয়, পদ্ম কোনো খুনীর সাথে যোগাযোগ করবে? আমার বোনটা না-কি নিজেই নিজের ধ্বংস ডেকে এনেছে।”

“আপু, আপনি কিছু জানেন না হয়তো। আমি আক্দ শেষে পদ্মের সাথে দেখা করবো। আমি চাই না, ওর অতীত ওর সুন্দর মুহূর্তে এসে বাঁধা হয়ে দাঁড়াক।”

পদ্মের আক্দ শেষেই আহি তার সামনে এসে বসলো। পদ্ম আহিকে দেখে চমকে গেলো। আহি সরাসরি জিজ্ঞেস করলো,
“আফিফকে কেন আমার কাছ থেকে কেঁড়ে নিয়েছিলি?”

পদ্ম চুপ করে রইলো। আহি আবার জিজ্ঞেস করলো,
“ছোটবেলার বান্ধবী আমরা। অনেক ভালোবাসতাম তোদের। তাহলে আমার ভালোবাসা কেঁড়ে নিয়েছিলি কেন?”

পদ্ম কাঁপা কন্ঠে বললো,
“মিথ্যে কথা। আমি কেন কেঁড়ে নেবো? আফিফ তো আমাকে ভালোবাসতেন। আমাকে ভালোবেসেই বিয়ে করেছেন।”

“তাহলে তোকে ছেড়ে দিলো কেন?”

“তুই কি জানিস না উনার মা কেমন মহিলা? যখন জেনেছেন, আমি ধর্ষিতা তখন আমাকে মেনে নিতে চাচ্ছিলেন না। আফিফকে আত্মহত্যার হুমকি দিয়েছেন। আফিফ বাধ্য হয়ে আমাকে ছেড়েছেন।”

“তোর কি মনে হয়, আমি সত্য না জেনে এসেছি?”

“তোর কাছে কোনো প্রমাণ আছে?”

“তাজওয়ার আমাকে বলেছিল।”

পদ্ম থতমত খেয়ে বলল,
“কখন? কখন বলেছে? ও তো মারা গেছে।”

“একটা রেকর্ড করেছিলো আমার জন্য। দু’দিন আগে পেয়েছি।”

পদ্ম থমকে গেলো। আহি পদ্মের বিমর্ষ মুখখানা দেখেই হাসলো। তার বানোয়াট কথা বিশ্বাস করে ফেলেছে পদ্ম। মেয়েটা আসলেই বোকা। বোকা প্রেমিকা যখন প্রেমে ভুলভাল কাজ করে, তখন তার জীবনের পরিণতি হাস্যকর হওয়ায় স্বাভাবিক। আহি বলল,
“এমনটা আমার সাথে না করলেও পারতি।”

পদ্ম ক্ষীণ কন্ঠে বলল,
“হ্যাঁ, আমি ভুল করেছি। কিন্তু আমিও ভালোবেসেছি। আমার জায়গায় তুই হলে, এমনটাই করতি।”

“যদি আমি তোর মতো হতাম, আফিফ অনেক আগেই আমার হতো।”

“কখনোই হতো না, কারণ আমার সাথে উনি রেনুর জন্য আটকে ছিলেন।”

“আমার ক্ষমতা ছিল, রেনুকে বের করে আনার।”

“আফিফ ভিতু। উনি ভেবেছেন, তোকে পেতে চাইলে, তোর জীবনটা এলোমেলো করে দেবে তাজওয়ার। কারণ তাজওয়ার আফিফকে হুমকি দিয়েছে, সে যদি সরে না যায়, তাহলে তাজওয়ার তোর সাথে ঠিক তেমনই করবে, যেমনটা আফিফের বড় আপুর সাথে করেছে।”

“আমি আহি। আমি হেরে যাই না। হারিয়ে দেই। হারিয়ে প্রমাণ করেছি। শেষ জয়টাও আমারই হবে। আফিফকে পাওয়ার একমাত্র কাঁটা আমাকে সরাতে হয় নি, আল্লাহ নিজেই সরিয়ে দিয়েছেন। দেখ, কে কেঁড়ে নিয়েছে, আর কার ভাগ্যেই লেখা ছিল। তুই তো চুরি করেছিস। চুরির কোনো কিছুই হজম হয় না।”

পদ্ম আহির সামনে হাত জোড় করে বলল,
“ক্ষমা করে দিস। তোর এখন কোনো কিছুর অভাব নেই। আর আমার তো অভাবের শেষ নেই। আমার জন্য আফিফকে ছেড়ে দে।”

“যখন আমার জীবনে সবকিছুর অভাব ছিল৷ আমি নিঃস্ব ছিলাম। তখন কি তুই আফিফকে আমার হাতে তুলে দিয়েছিলি?”

“তখন আমি ওর স্ত্রী ছিলাম।”

“আর এখন তুই অন্য কারো স্ত্রী। আফিফ একা, আমার মতোই। আর দু’জন নিঃসঙ্গ মানুষ একে অপরের জন্য পারফেক্ট।”

“আমি ওই লোকটাকে ছেড়ে দেবো।”

“ছেড়ে দিস। ডিভোর্স হতেও তিন মাস সময় লাগে। মাত্র তো বিয়েই হলো। আর আমাদের এক হতে সময়ও লাগবে না।”

“আহি, প্লিজ। এমন করিস না।”

“কেন?”

“আমি ভালোবাসি আফিফকে।”

“আমার চেয়ে বেশি ভালোবাসলে, আজ আফিফ তোরই থাকতো। খাদ ছিল, তাই হারিয়েছিস।”

চলবে-

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে