#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৫৪||
১১২।
রক্তাক্ত প্যাকেটের ভেতর থেকে রাদের দেওয়া শাড়িটা বের করলো আহি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শাড়িটা খুলে গায়ে জড়ালো সে। শেষ মুহূর্তে রাদের বলা কথাটি মনে পড়লো তার।
“সব শাড়ি আর এই শাড়ি এক না। এই শাড়িটা আমার স্মৃতি হয়ে থাকবে। অনেক বছর পর যখন তুই এই শাড়ি পরে আমার সামনে এসে দাঁড়াবি, আমার মনে পড়বে আমার স্বপ্ন পূরণের প্রথম ধাপের কথা। মনে পড়বে নিজের টাকায় তোর জন্য আমার প্রথম গিফট কেনার মুহূর্তটি। তোর হাসি দেখতে দেখতে আমি মরেই যাবো বোধহয়। এতো মিষ্টি হাসি তোর! আমার হৃদয়টাই কাঁপিয়ে দেয়।”
আহি শাড়িটা ভাঁজ করে নতুন প্যাকেটে ঢুকিয়ে রাখলো। এরপর আলমারি খুলে প্যাকেটটা ড্রয়ারে রেখে তার উপর আলতোভাবে হাত রাখলো আর বলল,
“আমি জানতে চাই না তুই কোথায় আছিস। আমি সবসময় মনে করবো, তুই আছিস আমার আশেপাশে। তোকে কখনো দেখতে চাইবো না আর। কারণ সত্যটা মেনে নেওয়ার ক্ষমতা নেই আমার। লোকে বলে, তুই নেই। আমার জন্য তুই বেঁচে আছিস। বেঁচে থাকবি আমার মেডিসিন হয়ে। আমি তোকে ভালোবাসতে পারি নি। তার মানে এই না যে আমি তোকে হারিয়ে ফেলতে চেয়েছি। তোর মতো বন্ধু পাওয়ার জন্য ভাগ্য লাগে। আমি সব হারিয়েছিলাম, রাদ। লিনাশা ছিল না, আমার ভালোবাসা ছিল না, মা ছিল না, শান্তি ছিল না। শুধু তুই ছিলি। এখন মা আছে, লিনাশাও আছে। কিন্তু তুই নেই। সৃষ্টিকর্তা সবসময় কাউকে পূর্ণতা দেয় না। কিছু না কিছু রেখেই দেয়। তোকে কেন রেখে দিলো রে? আমাকে তো ফেলেই চলে গেলি, রাদ। একবার কথা বলার সুযোগ হতো। বলতাম, সব ভালোবাসায় প্রণয় থাকে না। কিছু ভালোবাসা আত্মার সাথে আত্মার হয়। সব ভালোবাসায় চাওয়া-পাওয়া থাকে না। পাশে থাকলেই শান্তি লাগে। সব ভালোবাসায় স্পর্শ থাকে না। কিছু ভালোবাসা কথার ভীড়েই থাকে। তুই আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু। তোর পাশে আমি শান্তি পাই। তোর সাথে কতো কথা বলি। শুধু একটা কমতি ছিল। আমি তোর স্পর্শ নিতে চাই নি। আমি তোকে ওভাবে চাই নি, রাদ। তাই বলে এভাবে ফেলে চলে যাবি? সেদিন আমার ব্লেড দিয়ে নিজের হাত না কেটে তাজওয়ারের গলা কাটা উচিত ছিল। যাই হতো, এট লিস্ট তুই তো বেঁচে থাকতি। আমার না, ইউকে যাওয়ায় উচিত হয় নি। ইউকে না গেলে তোর সাথে বন্ধুত্ব এতো গাঢ় হতো না। তোকে আর ফিরে এই দেশে আসতেও হতো না। সব হয়তো আমার জন্যই হয়েছে। আমি তোর জীবনে না আসলে কি এমন হতো? রাদ, প্লিজ দোস্ত। আমাকে ক্ষমা করে দিস। আমি তোকে তোর মতো করে ভালোবাসতে পারি নি। কিন্তু যতোদিন বেঁচে থাকবো, তুই আমার স্মৃতিতে বেঁচে থাকবি। আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু হয়ে, আমার পাশে থাকবি। মানুষ মরে যায়, কিন্তু তার কাজ তাকে বাঁচিয়ে রাখে। তোর মূল্য কার কাছে কেমন, আমি জানি না। আমার কাছে তুই অমূল্য। তুই কার জীবনে কতোদিনের স্থায়ীত্ব ধরে রেখেছিস, জানি না। আমার মৃত্যু অব্ধি তুই আমার মনে সবচেয়ে ভালো মানুষ হয়ে বেঁচে থাকবি। তোকে কখনো ভালোবাসি বলা হয় নি। এটাই শুনতে চেয়েছিলি, তাই না? আমি মিথ্যে আশা দিতে পারি না। একজনকে খুব ভালোবেসেছি। তার ঠোঁটে হাসি দেখে আশা নিয়ে ছিলাম, সেও আমায় ভালোবাসে। হয়তো বাসতো, কিন্তু এখন আমার স্থান তার হৃদয়ে কোথাও নেই। তবে যেই আশাটা ছিল, আর সেটাই আমাকে অনেক কাঁদিয়েছে। আমি তাই তোকে মিথ্যে আশা দেই নি। তবে পাশে থাকার আশা দিয়েছিলাম। যেই আশা ভাগ্য পূরণ করতে দেয় নি। আমি তোকে ভালোবাসি, রাদ। বন্ধুর মতো ভালোবাসি। যেই ভালোবাসায় আত্মার সম্পর্ক থাকে, প্রণয়ের নয়। আর বন্ধু তো প্রিয় পুরুষের চেয়েও আপন হয়। আর কারো আপন মানুষ হওয়াটাই চমৎকার ব্যাপার। পৃথিবীতে প্রেমিক পুরুষ সবারই থাকে, আপন মানুষ সবার থাকে না৷ আমি হেরে যাওয়া একজন আহি, যার জীবনে তুই রাদ হয়ে আসা এক আশীর্বাদ।”
(***)
আহির কাছে বাঁধাই করা ক্যালিগ্রাফি পাঠিয়ে দিলো পদ্ম। সে আজ বেশ খুশি। সে জানে আহি চিঠি পড়ার পর কোনোদিন আফিফের সাথে দেখা করতে আসবে না। দু’দিন পর আফিফ চাকরির জয়েনিং লেটার পেলো। অনলাইনে এসেছে। রাজশাহীতে তার পোস্টিং। এক সপ্তাহের মধ্যেই জয়েন করতে হবে আফিফকে। পদ্ম বেশ খুশি। সবকিছুই তার ইচ্ছেমতো হচ্ছে। জিনিসপত্র গোছানো শুরু করে দিয়েছে পদ্ম। আফিফা বেগমও টুকটাক ব্যাগে ঢুকাচ্ছেন। রেনু মায়ের পাশে বসে আছে থম মেরে। আফিফা বেগম মেয়ের দিকে তাকিয়ে আফসোসের সুরে বললেন,
“জানি তোর কেন এতো খারাপ লাগছে। ছেলে দুইটাকে দেখতে পারবি না, তাই! নিয়াজী থেকে দূরে থাকায় ভালো। তোর অনাগত সন্তানটা তোর সাথেই তো থাকবে। নিয়াজী তো বললো, এই সন্তান তোর কাছেই রাখবে।”
রেনু ধরা কন্ঠে বলল,
“নিয়াজীর কাছ থেকে দূরে থেকে কি হবে, জীবন ধ্বংসকারী যদি আশেপাশেই থাকে?”
“কি বলছিস এসব?”
রেনু উঠে দাঁড়ালো। ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“কিছু না। অনেক হিসেব বাকী আছে। সব তুলতে হবে আমার। রাত-দিন শরীরের আঘাত নিয়ে বিছানায় পড়ে থাকার শোধ তুলতে হবে। বছরের পর বছর চোখের পানি ফেলার শোধ তুলতে হবে।”
রেনু কথাগুলো বলে রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো। আফিফা বেগম দাঁড়িয়ে আছেন হতভম্বের মতো। রেনুর বলা কথাগুলো কিছুই বুঝলেন না তিনি।
১১৩।
কয়েক প্যাকেট মিষ্টি নিয়ে পদ্মকে দেখতে এলো আহি। আহিকে বারান্দা থেকে দেখে রীতিমতো আকাশ থেকে পড়লো পদ্ম। চিঠি পাঠানোর পরও আহি কেন এলো এখানে? আহির মুখোমুখি হওয়ার সাহস ছিল না তার। পদ্ম আফিফের কাছে এসে বলল,
“আহি কেন এসেছে, বলুন তো!”
আফিফ অবাক হয়ে পদ্মের দিকে তাকালো। পদ্ম আফিফের পায়ের কাছে বসে বলল,
“আমি আহিকে সব বলে দিয়েছি। আপনি কসম করেছেন, আমি সব জানিয়ে দিলে, আপনি আহির কাছে ফিরে যাবেন না। এখন যান, ওকে আপনি তাড়িয়ে দিন। আপনি এখন যদি আহিকে বের না করেন, আমি নিজের প্রাণ নিয়ে নিবো।”
আফিফ পদ্মকে সরিয়ে দিয়ে বলল,
“আমাকে ব্ল্যাকমেইল করছো তুমি?”
“আমি সত্যি এই কাজ করবো। কারণ আপনি ছাড়া আমার আর কিচ্ছু লাগবে না।”
“তুমি আমাকে পাগল করে দিচ্ছো, পদ্ম। আমাকে একটু শান্তিতে বাঁচতে দাও।”
“শান্তিই তো হবে। এরপর সব শান্তি হবে। আহিকে তাড়িয়ে দিন। এটাতো ওর আর আপনার জন্যই ভালো। আহি বুঝবে, আপনি ওকে এখন আর পছন্দ করেন না। এরপর আহি মুভ অন করতে পারবে। আর আপনাকে তো বলেছিই, আপনি ওর যোগ্য নন।”
আফিফের বুকটা ভারী হয়ে এলো। পদ্ম আফিফকে ধাক্কা দিয়ে বলল,
“যাবেন আপনি? আমি যদি সুইসাইড করি, আপনার জেল হবে। চাকরিটাও যাবে আপনার। রেনু আর মায়ের কি হবে তখন? একবার জেল হলে নতুন চাকরি পেতেও সমস্যা হবে। কেউ কি জানতে চাইবে কে অপরাধী? পেছনের কারণটা কি? সবাই জানবে, আপনি আমাকে মানসিক অশান্তিতে রেখেছেন, তাই আমি সুইসাইড করেছি। বেশিদিন জেল না হোক, অন্তত একদিনের জেলই তো আপনার ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দেবে।”
আফিফ পদ্মের কথা শুনে ধপ করে বিছানায় বসে বলল,
“তুমি আমাকে কখনোই ভালোবাসো নি। তোমার এই আচরণ দেখে আমার তো মনে হচ্ছে না তুমি আমাকে ভালোবেসেছো। সবটাই তোমার জেদ। আহির সাথে জেদ ধরেছো তুমি। আমি কোনো খেলনা নই পদ্ম যে তোমরা দুইজন আমাকে নিয়ে টানাহেঁচড়া করবে।”
পদ্ম শীতল দৃষ্টিতে আফিফের দিকে তাকিয়ে ড্রয়ার ঘেঁটে একটা ব্লেড বের করলো। আফিফ ভীত চোখে সেদিকে তাকিয়ে বলল,
“পাগলামো করছো?”
“আমি সবাইকে বলে যাবো, আমার মৃত্যুর জন্য আপনি দায়ী। আমার রেইপ হয়েছে, তাই আপনি আমাকে স্পর্শ করছেন না। আপনার মা আমাকে মানসিক অত্যাচার করেছে, কারণ আমি সন্তান দিতে পারবো না।”
আফিফ হাতজোড় করে বলল,
“মাফ চাই, আল্লাহর ওয়াস্তে এসব করো না।”
“তাহলে যান। আহিকে বের করে দিন। অপমান করে বের করবেন, যাতে দ্বিতীয় বার আপনার দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস না থাকে।”
আফিফ ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে। পদ্ম চেঁচিয়ে বলল, “যাবেন?”
আফিফের পা চলছে না। ধীর পায়ে সে রুমের বাইরে বেরিয়ে এলো। বুকটা ভারী হয়ে আসছে তার। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু পারছে না। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। মনে হচ্ছে কোনো গোলকধাঁধায় ফেঁসে গেছে, যেখান থেকে বেরুনোর কোনো পথ নেই। আহি বসার ঘরে ছিল। রেনু দরজা খুলে দিয়েছে। আফিফকে দেখে আহি উঠে দাঁড়ালো। রেনু ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে অন্য রুমে চলে গেলো। রেনু যেতেই আহি একটা মিষ্টির প্যাকেট আফিফের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আজ আমি কোম্পানির সিইও হিসেবে জয়েন করেছি। তাই মিষ্টি নিয়ে এলাম। পুষ্প বলল, তোমার না-কি রাজশাহীতে চাকরি হয়েছে। কংগ্রাচুলেশন। পদ্ম তো চাকরির ব্যাপারে আমাকে কিছু বললোই না। আমার সাথে রাগ করেছে হয়তো। যাই হোক, মিস করবো।”
আহি আফিফের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“পদ্মকে।”
আফিফের বুকটা খালি হয়ে গেলো। নিজেকে শক্ত করে মিষ্টির প্যাকেটের দিকে এক নজর তাকিয়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো প্যাকেটটি। আহি আফিফের এমন কাজে অবাক হলো খুব। আফিফের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকাতেই আফিফ আহির বাহু চেপে ধরে বলল,
“প্লিজ, যাও আমার জীবন থেকে। বের হয়ে যাও। আর কতো বার তোমার মুখটা দেখতে হবে? তোমাকে দেখলে দমবন্ধ হয়ে আসে আমার। আমার আপার মৃত চেহারাটা ভেসে আসে চোখের সামনে। কখন ছাড়বে আমার পিছু?”
আহি আফিফকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। তার চোখে অশ্রু টলমল করছে। আহির চোখের দিকে তাকানোর সাহস পেলো না আফিফ। সে মুখ ঘুরিয়ে নিতেই রেনুর মুখোমুখি হলো। রেনু কিছু বলার আগেই আহি দ্রুত পায়ে বেরিয়ে পড়লো। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আহিকে বেরিয়ে যেতে দেখেই পদ্ম স্বস্তির শ্বাস ছাড়লো। আর আফিফ সেখানেই বিধ্বস্ত মুখে দাঁড়িয়ে রইল। রেনু ভাইয়ের কাছে এসে বলল,
“কি বলেছো, ভাইয়া? আহিকে কি বলেছো তুমি? মিষ্টিগুলো এভাবে ফেলে দিলে কেন?”
আফিফ মেঝেতে বসে পড়লো। চুল খামচে ধরে বলল,
“আমি ক্লান্ত। আমি খুব ক্লান্ত।”
রেনু আফিফের গালে হাত রেখে বলল,
“ভাইয়া, ওই মহিলাকে ছেড়ে দাও তুমি।”
আফিফ রেনুর দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকালো। রেনু কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো,
“এতো বড় পাপ করেছে, আর তুমি তাকে সহ্য করছো? আমি পারবো না ওই মহিলাকে দেখতে। আমার গায়ে এখনো বেল্টের দাগ। তুমি তাকে মেরেছো কখনো? অথচ তার জন্যই দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর আমি একটা জানোয়ারের সাথে সংসার করে গেছি। বাধ্য করেছে আমাকে ওই মহিলা।”
আফিফ রেনুর মাথায় হাত রেখে বলল,
“আর কষ্ট করতে হবে না তোকে। আমি আমার বোনকে নিয়ে এসেছি তো।”
“তো? আমার স্বপ্ন তো শেষ। আপাকে তো হারিয়ে ফেলেছো। আমি বেঁচে আছি, কার ভরসায়? আমার জীবনে কি আছে? সংসারটাও ঠিকিয়ে রাখতে পারি নি। গ্রামে গেলে মানুষ কি ভাববে আমাকে? তোমার বউ আমার কপাল থেকে স্বামীর সুখ কেঁড়ে নিয়েছে। তার জন্য আমি একটা অমানুষের স্ত্রী হয়ে পড়ে ছিলাম, আর সে সুখের সংসার করবে? আর আমি বসে বসে দেখবো?”
আফিফ অবাক হয়ে বলল, “তুই কীভাবে জানলি এসব?”
“চিঠি পড়ে জেনেছি।”
রেনু উঠে তার রুমে গিয়ে সেই চিঠিটা নিয়ে এলো যেটা পদ্ম আহিকে লিখেছিল। সেদিন পদ্ম চিঠি লিখে প্যাকেটে ঢুকানোর পর রেনু সেই রুমে গিয়ে প্যাকেটে কি আছে দেখতে গিয়েই চিঠিটা পেলো। সে চিঠিটা সরিয়ে একটা সাদা কাগজ ভাঁজ করে প্যাকেটে ঢুকিয়ে রাখলো। পদ্ম শেষবার প্যাকেটটি স্টেপল করার আগে সেই সাদা কাগজটাকে চিঠি ভেবে আহির কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিল। রেনু চিঠিটা এনে আফিফকে দিলো। আফিফ চিঠিটা পড়তে পড়তেই পদ্ম রুম থেকে বেরিয়ে এলো। আফিফ চিঠি পড়া শেষে পদ্মের সামনে চিঠিটা মুচড়ে ফেলে বলল,
“আর কতোটা নিচে নামবে, পদ্ম?”
পদ্ম ভ্রূ কুঁচকে রেনুর দিকে তাকিয়ে বলল,
“কি হয়েছে? কি বলেছো তুমি আমার বিরুদ্ধে?”
রেনু বলল,
“তোমার বিরুদ্ধে কিছুই বলার নেই। তুমি নিজেই তোমার বিরুদ্ধে যাওয়ার মতো কাজ করেছো। তুমি একটা কালসাপিনী।”
“রেনু! আমি তোমার ভাবী।”
“আমি তোমাকে ভাবী মানি না।”
আফিফ রেনুকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“রেনু, আমি আমার সিচুয়েশন হ্যান্ডল করে নেবো। তুই প্লিজ, আমার জন্য নিজের ক্ষতি করিস না। তোর এই মুহূর্তে রেস্ট নিতে হবে।”
রেনু কিছু বলতে যাবে তার আগেই আফিফ তাকে থামিয়ে দিলো। রেনু চলে যেতেই আফিফ পদ্মকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“তোমার সাথে সংসার করা আমার পক্ষে আর সম্ভব না।”
পদ্ম আফিফের পা ধরে বলল, “মরে যাবো আমি।”
“তোমার সাথে থাকলে আমি মরে যাবো, পদ্ম।”
(***)
আহি গাড়ি থামালো জনমানবহীন খোলা মাঠে। গাড়ি থেকে নামতেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। আহি দৌঁড়ে গেলো সামনে। মাঠের মাঝখানে এসে দুই হাঁটুতে ভর দিয়ে বসে পড়লো মাটিতে। বুকে হাত দিয়ে শব্দ করে কাঁদতে লাগলো সে। আহির কান্নার শব্দ আর বৃষ্টির রিমঝিম ধ্বনি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। আফিফ ছাদের মেঝেতে শুয়ে আছে। বৃষ্টির তেজ তার শরীরে কাঁটার মতো বিঁধছে। আর তার হৃদয়ের হাহাকার ক্রমাগত বাড়ছে। সে কাঁদতে পারছে না। কিন্তু ইচ্ছে করছে চিৎকার দিয়ে ভেতরের সব রাগ, কষ্ট বের করে দিতে। দু’জনের বুক চিরেই বেরিয়ে আসছে একটা প্রশ্ন।
“তোমাকে কি আর জীবনেও দেখার সৌভাগ্য হবে না আমার?”
আফিফা বেগমের চিৎকারে আফিফের হুঁশ ফিরলো। সে ভেজা কাপড়ে ছাদ থেকে নেমে পড়লো। রান্নাঘরের মেঝেতে ছটফট করছে রেনু। পাশে গড়াগড়ি খাচ্ছে গরম তেলের কড়াই। রেনু চিৎকার করে যাচ্ছে। আফিফ বোনকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো বাসা থেকে। উদ্দেশ্য হাসপাতাল। পদ্ম দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইলো। ভয়ে তার শরীর নেতিয়ে পড়ছে। আফিফা বেগম আফিফের পিছু পিছু বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে পড়লেন। আজকের এই বর্ষণ মুখর দিনটি কখনোই ভুলবে না তারা।
১১৪।
রেনুর ছেলে হয়েছে। আফিফ রেনুর ছেলেকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে হাসপাতালের বারান্দায়। ডেলিভারির সময়ের আগেই হয়ে গেছে বাচ্চাটা। ছোট ছোট আঙ্গুলগুলো আলতো ভাবে ছুঁয়ে দিলো আফিফ। আফিফা বেগম তা দেখে বললেন,
“কি মিষ্টি ছেলেটা! নানুভাইয়ের নাম কি হবে?”
আফিফ শুকনো হাসি ফুটিয়ে বলল, “আদ্য।”
“আদ্য কেন?”
“নতুন সূচনা। আদ্য মানেই শুরু। আদ্য আমাদের জীবনের এক নতুন অধ্যায়। রেনুর জীবনের নতুন সূচনা হবে আদ্য।”
আহি বৃষ্টি ভেজা শরীর নিয়ে বাসায় ঢুকলো মাত্র। আর সাথে সাথেই তার ফোন বেজে উঠলো। স্ক্রিনে ভেসে উঠলো মোজাম্মেল চাচার নাম৷ কল ধরতেই মোজাম্মেল চাচা যা বললেন, তা শুনেই আহির পুরো পৃথিবী থমকে গেলো।
এদিকে ডাক্তার বেরিয়ে আসতেই আফিফ ব্যস্ত হয়ে তার কাছে ছুটে গেলো। ডাক্তার রেনুর বর্তমান অবস্থা জানালো। মেয়েটার শরীরটা জ্বলে গেছে অনেকখানি। জ্ঞান ফিরতে সময় লাগবে। এদিকে আফিফকে কাল রাজশাহী যেতেই হবে। এই মুহূর্তে চাকরিটা আরো বেশি প্রয়োজন। রেনুর চিকিৎসার খরচ জোগাড়ের জন্য অন্তত চাকরিটা লাগবে। ডাক্তারের সাথে কথা বলে রেনুকে রাজশাহী মেডিকেলে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ হলো। পুরো সময়টাতে নিলয় সাহায্য করলো তাকে।
(***)
গাড়ির গতি বাড়ালো আহি। ভেজা কাপড়েই পৌঁছে গেলো সুবর্ণ মঞ্জিল। সে গাড়ি থেকে নামতেই দৌঁড়ে এলো মোজাম্মেল চাচা। আক্ষেপের সুরে বললেন,
“স্যার এইডা কি করলো মা?”
আহি স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে জ্বলন্ত বাড়িটির দিকে। সুবর্ণ মঞ্জিল, যেখানে তার বেড়ে উঠার গল্প, যার ইট-পাথরের ফাঁকে বাঁধা পড়ে আছে আহির শৈশব। সেই ঘর, যেখানে তার অনুভূতিরা আটকে আছে। আজ সব জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। আগুন নেভানোর জন্য ফায়ারসার্ভিসের গাড়ি এসেছে। ভেতর থেকে রিজওয়ান কবিরের চিৎকার ভেসে আসছে। আহি কানে হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়ল। যারা বাড়ির আশেপাশে ভীড় জমিয়েছে, তারাই বলছে রিজওয়ান কবির নিজেই ঘরে আগুন ধরিয়েছেন। সালমা ফাওজিয়া আহির পিছু পিছু এসেছেন। মেয়েকে এমন অবস্থায় দেখে তিনি দৌঁড়ে এলেন। মায়ের স্পর্শ পেয়ে আহি নেতিয়ে পড়লো। কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো,
“তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না, মা। সবাই শুধু আমাকে একা রেখেই চলে যাচ্ছে।”
সালমা ফাওজিয়া শক্ত কন্ঠে বললেন,
“তোমার বাবা তার অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত করছে। তোমার কষ্ট পেতে হবে না, মা। তুমি তো তার ক্ষতি করো নি। সে হয়তো বুঝে গেছে, তার অন্যায়টা কতো বেশি ছিল।”
সালমা ফাওজিয়া কাঁদছেন না। শান্তি লাগছে তার। এতো বছর পর তার বাবার সাথে হওয়া অন্যায়ের শোধ উঠেছে। তার আর আহির জীবনে আসা সব কষ্টের শোধ উঠেছে। রিজওয়ান কবির নিজেই নিজেকে শেষ করে দিয়েছেন। তিনি একা মরেন নি, সাথে নিয়ে গেছেন তার কোটি টাকার বাড়ি। যদিও এই জায়গাটাও আহির নামে। কিন্তু বাড়িটা রিজওয়ান কবির শখ করেই বানিয়েছিলেন।
এদিকে ব্যাগপত্র নিয়ে গাড়িতে উঠে বসেছে আফিফ। পেছনে পদ্ম আর আফিফা বেগম বসে আছেন। গাড়ি চলতে শুরু করলো। আর পেছনে পড়ে যাচ্ছে সেই চিরচেনা শহর। আফিফের মনটা ভারী হয়ে আছে খুব। এলোমেলো ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে মনে। জানালার বাইরে তাকালো সে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আনমনে বলল,
“ভালো থেকো, খেয়ালী।”
আহি এখনো সেই পোড়া বাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। লিনাশা আহির পাশে বসে বলল,
“যা হয়েছে ভুলে যা। এখান থেকে জীবনের নতুন সূচনা কর।”
আহির দৃষ্টি তার দু’তলা জানালার দিকে। যেই জানালার বাইরে চুল ছড়িয়ে ঘুমাতো সে। আর সেই ঘরে বসেই সে তার এআরের ছবি আঁকতো। আহি সেদিকে তাকিয়ে আনমনে বলল,
“সুখী হও, প্রিয় অলকানন্দ। তোমার জীবনের নতুন সূচনায় আমার সূচনা হবে। ভালো থেকো, এআর। তোমাকে ভালোবাসার মতো দুঃসাহস করেছি। আর তুমি আমার জীবনে আসা দুঃস্বপ্ন হয়েই রয়ে গেলে। যেই স্বপ্ন কখনোই পূরণ হয় নি। অন্তত তোমাকে দেখার মতো ক্ষমতা দিতে। এখন তো তোমার সামনেও আর দাঁড়াতে পারবো না। এই এক আকাশের নিচে তুমি আর আমি। অথচ কতো দূর আমাদের চলার পথ। তোমাকে ভালোবাসার মতো দুঃসাহস করেছি আমি। ভুলে যাওয়াটা যদি দুঃসাধ্য না হতো!”
পাঁচ বছর পর……….
চলবে-
#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৫৫||
১১৪।
এ আর টি গ্যালারির সামনে ভীড় জমিয়েছে নন্দনকানন কিন্ডারগার্টেন স্কুলের ছোট ছোট বাচ্চারা। নার্সারির ড্রয়িং ক্লাস হচ্ছে এ আর টি গ্যালারির সামনের ছোট বাগানে। স্কুলটি এ আর টি গ্যালারির পাশেই। প্রশান্তিময় একটা জায়গা। এ আর টি গ্যালারির পেছনে খোলা অরণ্য। বিভিন্ন গাছগাছালির ভীড়ে তৈরী হয়েছে বাচ্চাদের জন্য পার্ক। অশ্বত্থ গাছের সাথে ঝুলন্ত কাঠের দোলনা। একপাশে বাচ্চাদের খেলার সামগ্রী৷ অন্যপাশে সারি সারি নারকেল গাছ। শান বাঁধানো ঘাট। আর পুকুরে শাপলাপাতা ছড়িয়ে আছে। একটা দু’টো শাপলাও উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। এ আর টি গ্যালারির বাম পাশেই নন্দন কানন স্কুল। আর ডানপাশে দেয়াল দিয়ে ঘেরা বাগান। বাগানে নানা পদের ফুলের মধ্যে বিরাট অংশ জুড়ে আছে, সূর্যমুখী আর অলকানন্দা ফুলের বাগান। একপাশে কাঠগোলাপ আর বেলীফুলের বাগান। বাগানের সামনের অংশটা খালি। সেখানেই ছাউনি দিয়ে বেঞ্চ বসানো। এই জায়গায় নন্দন কাননের ছোট ছোট বাচ্চাদের অংকন শেখানো হয়।
দপ্তরি ঘন্টা বাজাতেই স্কুলের ছোট ছোট বাচ্চাগুলো এ আর টি গ্যালারির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। ভেতরে প্রদর্শনী হচ্ছে। কাচের দেয়াল ধরে যতোটুকু প্রদর্শনী দেখা যায়, তা দেখার চেষ্টা করছে বাচ্চারা। ভেতরে উপস্থিত চারুকলা অনুষদের কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী। আজ এ আর টি গ্যালারির প্রতিষ্ঠাতা এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসবেন। ছয়মাসে একবার এই আর্ট গ্যালারিতে প্রদর্শনী হয়। আর মাসে একবার চড়া দামে ছবি বিক্রি হয়। বাকি দিনে সাধারণ মানুষের জন্য এই গ্যালারি খোলা থাকে। তারা এসে ঘুরে যায়। পছন্দ হলে আগে থেকেই ছবি বুকিং দিয়ে রাখতে হয়। মাসের কাঙ্ক্ষিত সেই দিনটিতেই ছবিটা বিক্রি হয়।
গাড়ির হর্ণ শোনা গেলো। সাদা রঙের দামী গাড়ি এসে থামলো এ আর টি গ্যালারির সামনে। প্রহরীরা ব্যস্ত বাচ্চাদের সরানোর জন্য। মোটামুটি জটলা বেঁধে গেছে প্রবেশমুখে। গাড়ির দরজা খুলে দিলো ড্রাইভার। গাড়ির বাইরে নেমে এলো সাদা স্নিকার্স পরিহিত দু’টি পা। এ আর টি গ্যালারির প্রবেশপথ থেকে বাচ্চাদের সরালো স্কুলের ড্রয়িং শিক্ষিকা রেহেনা পারভিন। শিক্ষিকার রাগী দৃষ্টি দেখে বাচ্চারা দৌঁড়ে স্কুলের দিকে চলে গেলো। শুধু গেলো না একজন। তার দৃষ্টি আটকে আছে সাদা গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা স্নিকার্স জোড়ার দিকে। সে কৌতুহলি দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। গাড়ির বাইরে বেরিয়ে এলো একটি মেয়ে। বয়স ত্রিশ, অথচ বেশভূষায় মনে হবে তার বয়স একুশ কি বাইশ। পরণে সাদা টি-শার্ট আর জিন্স। গলায় ঝুলছে লাল উড়না। গাড়ি থেকে নেমেই সে চোখে পরলো ধূসর বর্ণের সানগ্লাস। মেয়েটি এগিয়ে আসতে লাগলো এ আর টি গ্যালারির দিকে। এদিকে রেহানা পারভীন দাঁড়িয়ে থাকা বাচ্চাটির হাত ধরে টান দিয়ে বললেন,
“ওয়াসিফ, ক্লাসে চলো।”
তখনই মেয়েটি ওয়াসিফের সামনে এসে দাঁড়ালো। ওয়াসিফকে দেখে সানগ্লাস খুললো সে। হাত এগিয়ে দিলো ওয়াসিফের থুতনিতে। আলতো আদর দিয়ে বলল,
“বাবু, কেমন আছো?”
ওয়াসিফ এক গাল হাসলো। বলল,
“আন্টি এই শু’স আমার খুব পছন্দ হয়েছে। আমি মাকে বলেছি এমন হোয়াইট হোয়াইট শু’স কিনে দিতে। মা তো আমাকে নিয়েই যায় না।”
মেয়েটি ওয়াসিফের সামনে হালকা ঝুঁকে বলল,
“তোমার মায়ের নম্বর দিও, আমি বলে দেবো কিউট বাবুকে হোয়াইট হোয়াইট শু’স কিনে দিতে।”
ওয়াসিফ মাথা নাড়লো। মেয়েটি ওয়াসিফের মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কি নাম কিউট বাবুটার?”
“মাই নেইম ইজ নাওফাত ওয়াসিফ আদ্য।”
“ওয়াও, কি সুন্দর নাম!”
“আমার নামটা খুব বড় তাই না?”
মেয়েটি গালে হাত দিয়ে অবাক হওয়ার ভান ধরে বলল, “হ্যাঁ, তাই তো।”
“সবাই বলে আমার নাম অনে-ক বড়। আমার মতো বড় নাম কারো নেই।”
রেহানা পারভীনকে দেখিয়ে দিয়ে ওয়াসিফ বলল,
“মিসরাও বলে।”
মেয়েটি তা শুনে মুচকি হেসে বলল,
“তাই না-কি? আমার নামটাও তো অনে-ক বড়। তোমার মতো।”
“তাই? তোমার নাম কি?”
“আমার নাম ওয়াসিকা কবির আহি।”
“তোমার নামটাও তো অনেক সুন্দর। আচ্ছা, তোমার নামটাও কি তোমার মামা রেখেছে?”
ওয়াসিফের প্রশ্নে আহির মুখে বিষণ্নতা ছেয়ে গেলে। পরক্ষণেই সে মুচকি হেসে বলল,
“না, আমার নামটা আমার বাবা রেখেছে।”
“তোমার বাবা আছে?”
“হ্যাঁ আছে।”
“কোথায়?”
“ওই দূর আকাশে তারাদের ভীড়ে লুকিয়ে আছে।”
ওয়াসিফ আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
“এখন তো তারা দেখা যাচ্ছে না। তুমি কি রাতেই তোমার বাবাকে দেখতে পাও?”
“না। রাতে-দিনে কখনো দেখতে পাই না। সে তো লুকিয়ে আছে। আর তারা তো দিনেও থাকে। কিন্তু সূর্য্যি মামার জন্য দেখা যায় না।”
“ওহ, আমার বাবা নেই। কিন্তু আমার মামা আছে। আমার মামা অনেক ভালো। হি ইজ দা বেস্ট।”
ওয়াসিফের আদুরে কথাবার্তা আহির বেশ ভালো লাগছিল। কিন্তু তার হাতে সময় কম। আজ তার আর্ট গ্যালারিতে প্রদর্শনী হচ্ছে। তার জন্য বসে আছে সবাই। আর কাল তার ছবি বিক্রি হবে। প্রতি মাসে সব কাজ ফেলে সে কক্সবাজার চলে আসে তার আর্ট গ্যালারিতে সময় দিতে। নিজের আঁকা ছবিগুলো সাথে নিয়ে আসে। বিক্রি হয় চড়া দামে। দেশে-বিদেশে আহির আঁকা ছবির বেশ সুনাম। ইন্টারন্যাশনাল এওয়ার্ডও পেয়েছে সে গত বছর। তিন বছর আগেই সে কক্সবাজারে এই আর্ট গ্যালারিটি স্থাপন করেছিল। আর সে বছরই নন্দনকানন স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য মোটা অংকের টাকা দিয়েছে সে। যদিও এই স্কুলে আরো দু’জনের ভাগ আছে। স্কুলের চেয়ারম্যান আহির বড় মামা। আহি শুধু চেয়েছে স্কুলের ড্রয়িং ক্লাসটা যাতে তার বাগানে হয়। তার ধারণা বাচ্চারা বাগানে বসে ছবি আঁকলে, তাদের শিল্পীমন গভীর হবে।
কিছুক্ষণ পর এ আর টি গ্যালারি থেকে বেরিয়ে এলো আহির এসিস্ট্যান্ট রুবি। সে আহির সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
“ম্যাম, আপনাকে ভেতরে আসতে হবে। সবাই অপেক্ষা করছে।”
এসিস্ট্যান্টটির কথা শুনে রেহানা পারভীন ওয়াসিফের হাত ধরে বলল,
“এবার ক্লাসে যাও, ওয়াসিফ। ম্যামকে যেতে হবে।”
আহি ইশারায় রেহানা পারভীনকে বলল ওয়াসিফের হাতটা ছেড়ে দিতে। রেহানা পারভীন হাত ছেড়ে দিতেই আহি বলল,
“বাবু, আমি যাই। পরে কথা হবে।”
ওয়াসিফ গ্যালারির প্রবেশমুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আন্টি, আন্টি।”
“হ্যাঁ, বলো।”
“আমাকে ভেতরে যেতে দেবে?”
রেহানা পারভীন গলা উঁচু করে বললেন,
“ওয়াসিফ, বললাম না বাচ্চারা ভেতরে যায় না।”
আহি তাকে ইশারায় আবার থামিয়ে দিয়ে ওয়াসিফের হাত ধরে বলল,
“আমি তোমাকে নিয়ে যাবো, কিন্তু আমাকে প্রমিজ করতে হবে তুমি ভেতরে গিয়ে কোথাও হাত দেবে না।”
ওয়াসিফ ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
“হাত দিলে কি হবে?”
“হাত দিল ছবি নষ্ট হয়ে যাবে, অথবা নিচে পড়ে ভেঙে যাবে। তখন আন্টি খুব কষ্ট পাবো। তুমি কি আন্টিকে কষ্ট দেবে?”
“না, একদম না। আমি লক্ষী বাচ্চাদের মতো তোমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকবো। আমাকে শুধু ভেতরে যেতে দিলেই হবে। আমার খুব ইচ্ছে ওখানে কি আছে দেখার। ওই যে টিভিতে ছবি দেখাচ্ছে, ওগুলো চুপচাপ বসে বসে দেখবো।”
আহি ওয়াসিফের চুলগুলো নাড়িয়ে দিয়ে তার হাত ধরে ভেতরে চলে গেলো।
(***)
আহি চারুকলা অনুষদের ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে অনেকক্ষণ কথাবার্তা বললো। অংকন নিয়ে চললো গুরুত্বপূর্ণ আলাপ। কথাবার্তা শেষে আহি বেরিয়ে প্রদর্শনী রুমে এলো। দেখলো চেয়ারে বসে প্রজেক্টের পর্দার দিকে তাকিয়ে আছে ওয়াসিফ। ওয়াসিফকে পাহারা দিচ্ছে রুবি। আহিকে দেখে সে উঠে দাঁড়ালো। আহি ওয়াসিফের পাশে বসে বলল,
“বাবু, তোমার স্কুল তো অনেক আগেই ছুটি হয়ে গেছে। তোমাকে কেউ নিতে আসবে না?”
ওয়াসিফ দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,
“মামা বলেছে, লম্বা কাঁটাটা সিক্সে এসে দাঁড়ালে আসবে।”
আহি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,
“আচ্ছা। এখনো তো লম্বা কাঁটাটা থ্রিতে বসে আছে। মামার আসতে তো অনেক সময় লাগবে। তুমি একা একা কি করবে?”
“আমি খেলবো পার্কে গিয়ে।”
“আচ্ছা। তোমার মামা এতো দেরী করে আসে?”
“না। কিন্তু আজ দেরীতে আসবে বললো। মামার অফিসে অনেক কাজ থাকে। আমাকে বাসায় দিয়ে আবার অফিসে চলে যায়।”
“আচ্ছা। চলো তোমাকে পার্কে দিয়ে আসি। তোমার সাথে কিছুক্ষণ খেলবো।”
আহি ওয়াসিফকে নিয়ে পেছনের পার্কে গেলো। দু’জনেই বেশ কিছুক্ষণ মজা করলো। হঠাৎ আহির ফোন বেজে উঠলো। স্ক্রিনে ভেসে উঠলো পুষ্পের নাম। আহি কল ধরতেই পুষ্প বলল,
“আহি, লাঞ্চ এখানে এসে করবি কিন্তু।”
আহি বলল, “আজকে আমার কাজ বেশি।”
“কোনো এক্সকিউজ দিবি না। ফাজিল মেয়ে একটা। লাবীব আমাকে বলে গেছে। আর তোকে এখানেই থাকতে হবে যতোদিন থাকবি।”
“মাত্র দু’দিন।”
“তো দু’দিন তুই ওই ভূতের বাড়িতে থাকবি?”
“পুষ্প!”
“তোর ওই বাংলো বাড়িটা ভূতের বাড়ির মতো দেখতে। রাতে একা কীভাবে থাকিস? লাবীবের অফিসে যাওয়ার পথেই তোর বাংলো বাড়িটা পরে। আমাকে তো প্রায়ই বলে এভাবে সুনসান রাস্তার উপর জঙ্গলের মাঝখানে কেউ বাড়ি করে? বসতিস্থল থেকে কতো দূর তোর বাংলো বাড়িটা।”
“আরেহ, রিল্যাক্স। গার্ডস আছে, মেইডরা আছে। আমি তো একা থাকি না। আর যখনই কক্সবাজার আসি, মা তো সাথেই আসেন। এবার বাড়িতে গেছে মা। নানার বার্ষিকী করছে। নানু খুব অসুস্থ। জানিস তো ডাক্তার বলেছে হাতে বেশিদিন সময় নেই। শেষ মুহূর্তগুলো বাড়িতে থাকতে চাচ্ছেন। মাও তাই ওখানেই থাকবে।”
“তার মানে তুই চট্টগ্রাম একা থাকবি?”
“হ্যাঁ। আপতত।”
“পাগল তুই? এখানেই থাক। আমাদের সাথে থাকবি। ব্যাগপত্র নিয়ে চলে আয় আমার বাসায়।”
“কি যে বলিস তোর শ্বশুড়-শাশুড়ি আছে। দেবর আছে। এভাবে থাকলে সুন্দর দেখাবে না।”
“লাবীবকে বলবো?”
“আরেহ না। এসব বাদ দে, তোর টুনি কেমন আছে রে?”
“পিয়ালী? খুব অসুস্থ রে আমার মেয়েটা। ঠান্ডা লেগেছে। অফিস থেকে ছুটি নিয়েছি ওর জন্য।”
“ডাক্তার দেখাস নি?”
“দেখালাম তো। সিজনাল প্রবলেম। ঠিক হয়ে যাবে। আচ্ছা, বাসায় আয় তো। অনেক কথা হবে।”
“আচ্ছা, আসবো। কিন্তু আজকে পারবো না। কাল আসবো।”
“আজ কি সমস্যা?”
“আমার মিটিং আছে একটা। ওখানেই লাঞ্চ করবো। বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়েই বেরুতে হবে।”
“বুঝলাম, খুব ব্যস্ত মানুষ তুই। কিন্তু নিজেকে একটু সময় দে। বিয়ে-টিয়েও করছিস না। কখন করবি বিয়ে? উজ্জ্বল ভাইয়া অস্ট্রেলিয়া থেকে আসবে আগামী সপ্তাহে। চাচা-চাচী এবার ভাইয়াকে বিয়ে দিয়েই ছাড়বেন। তোর জন্য অনেক অপেক্ষা করেছে বেচারা। তোকে বলার সাহস পায় নি। আমি সিউর এবারও পাবে না। চাচী তো আন্টিকে বলেছিল। আন্টি কোনো সাড়া দেয় নি দেখে তারাও চুপ হয়ে গেছে।”
আহি হেসে বলল,
“তোর ভাইয়া তো বুড়ো হয়ে যাচ্ছে। আমার জন্য বসে থাকার কোনো দরকার ছিল?”
“বিয়ে যখন করতেই হবে করে ফেল না।”
আহি দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মায়ের হতাশ চেহারাটা ভেসে উঠলো তার চোখের সামনে। এখন আর কোনো কিছুর অভাব নেই আহির। অনেক টাকার মালিক সে। দাদা ও বাবার সম্পত্তির পাশাপাশি নিজেও অনেক কিছু করেছে। বাংলাদেশের ধনী নারীদের তালিকায় এখন আহির নামও যুক্ত। যেই প্রভাব প্রতিপত্তির জন্য কয়েক বছর আগেও তাকে কোনঠাসা হয়ে থাকতে হয়েছিল, আজ আহির হাতে সেই ক্ষমতা আছে। সে এখন রানী। তার রাজ্যের একমাত্র রানী আহি একাই। এতো কিছুর ভীড়ে যদি কোনো কমতি থাকে, তাহলে তা একজন ভালোবাসার মানুষের। গত পাঁচ বছরে অহরহ বিয়ের প্রস্তাব এসেছে আহির জন্য। সালমা ফাওজিয়া সেসব আহির সামনে রাখার সাহস পান নি। অনেক প্রস্তাব এতোটা যোগ্যতা সম্পন্ন ছিল যে সালমা ফাওজিয়া নাকচ করতে চান নি। কিন্তু আহির জন্য বাধ্য হয়েছিলেন।
(***)
পুষ্পের সাথে কথা বলা শেষ হতেই আহি পেছন ফিরে দেখলো পার্কে বাচ্চাটি নেই। আহি এদিক-ওদিক তাকিয়ে দারোয়ানের কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো,
“বাচ্চাটা কোথায় গেলো?”
দারোয়ান বলল,
“ম্যাম, এই মাত্র ওর মামা এসে নিয়ে গেছে।”
“ওহ আচ্ছা।”
আহি বেরিয়ে এলো পার্ক থেকে। সামনে হেঁটে তার গাড়ির কাছে আসতেই দেখলো ওয়াসিফ একটা মোটর সাইকেলের পেছনে বসা। মাথায় ছোট হেলমেট। ঝাঁকড়ে ধরে আছে সামনের মানুষটিকে। মুহূর্তেই আহির শিরদাঁড়া বেয়ে বিদ্যুৎ খেলে গেলো। হাত-পা অসার লাগছে যেন। বুকটাও কাঁপছে বেশ। পেছন দিক থেকে কি মানুষ চিনতে ভুল হয়? তাহলে কেন চেনা চেনা লাগছে এই মানুষটাকে? আহির ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে একবার মানুষটির চেহারা দেখতে। যদি সে হয়? না, সে হলে আহির কোনো অধিকার নেই সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর। শেষবার তো খুব কড়া ভাবেই মানুষটা বলেছিল, তার সামনে না যেতে। তাহলে কেন যাবে আহি?
মোটর সাইকেলটি চলে গেলো। আহিও গাড়িতে উঠে গেলো। এখন আর অশ্রুসিক্ত হয় না চোখ জোড়া। বেশ শক্ত হয়েছে সে। কিন্তু অস্থিরতা এখনো কাটে নি। মানুষটা ভাবনায় এলেই তার হৃদ স্পন্দন বেড়ে যায়। এজন্যই বিয়ে করছে না সে। কাউকে ঠকানোর ইচ্ছে নেই তার। মনে একজনকে রেখে, অন্য একজনকে জীবনে এনে সে অন্যায় করতে চায় না। তার চেয়ে একাই ভালো আছে। সুখে আছে।
(***)
ওয়াসিফ তার মামার পিঠে হেলান দিয়ে বসে আছে। দশ মিনিট পর মোটর সাইকেলটি ঢুকলো একটি ছ’তলা ভবনে। নিচ তলায় গ্যারেজ। গ্যারেজে মোটর সাইকেল থামিয়ে ওয়াসিফকে নামালো সে। ওয়াসিফ মামার কোমড় জড়িয়ে ধরে বলল,
“মামা, আমি আজকে অনেক অনেক ছবি দেখেছি। আমাকে ওই সুন্দর জায়গাটায় নিয়ে গিয়েছিল আন্টিটা। আন্টিটা একদম হোয়াইট হোয়াইট ছিল।”
ওয়াসিফের মামা তার হেলমেট খুলে দিতে দিতে বলল,
“এ নিয়ে দশ বার বলেছো এই একটা কথা।”
ওয়াসিফ আঙ্গুলে গুণতে লাগলো, আর বলল,
“দশ বার বলেছি?”
ওয়াসিফের মামা তাকে কোলে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো। চার তলায় ভাড়া থাকে তারা। চার তলার দরজার সামনে এসেই মামার কোলে বসে বেল বাজালো ওয়াসিফ। দরজা খুলে দিলো তার নানী। ওয়াসিফকে দেখেই তিনি বললেন,
“আমার নানু ভাই এসে গেছে।”
ওয়াসিফ কোল থেকে নেমে দৌঁড়ে ঢুকে গেলো বাসায়। ছুটে গেলো তার মায়ের কাছে। এসেই মাকে জড়িয়ে ধরলো সে। ওয়াসিফ মায়ের গালে চুমু খেতেই, তার মা এগিয়ে এসে ছেলের কপালে চুমু খেলো। তা দেখে ওয়াসিফের নানু, আফিফা বেগম আফসোসের সুরে তার ছেলেকে বললেন,
“আজ আমার রেনুর এই অবস্থা হয়েছে শুধু ওই ডাইনির জন্য। যতোবার রেনুকে দেখি ততোবারই মনে পড়ে ওই ডাইনি রাক্ষসীটা কিভাবে আমার সংসারটা এলোমেলো করে দিয়ে গেছে।”
পাশে দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো রেনুর ভাই। বলল,
“শুধু শুধু তার কথা কেন তুলছো, মা? সে তো আর আমাদের জীবনে নেই।”
“আফিফ! সে নেই। কিন্তু এখনো পিছু তো ছাড়ছে না। তালাক হওয়ার পরও তোকে ফোন দিচ্ছে। বিয়ে করে ফেল, বাবা। ওই ডাইনির আর সাহস হবে না ফোন দেওয়ার।”
আফিফ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। হতাশ দৃষ্টিতে রেনুর দিকে তাকালো। পাঁচ বছর আগের এক দুর্ঘটনায় রেনুর এই অবস্থা। গরম তেল ছিটকে পড়েছিল রেনুর শরীরে। জ্বলে গেছে শরীরের অনেকাংশ। গলা থেকে পেট পর্যন্ত চামড়া কুঁচকে গেছে তার। মুখেও ছিঁটেফোঁটা পড়েছিল। এখন প্রায়ই অসুস্থ থাকে রেনু। বাসার বাইরে যেতে চায় না। বোনের এই অবস্থার জন্য নিজেকে দায়ী করছে সে। যদি পদ্মকে বিয়ে না করতো, তাহলে আজ তার বোনের এই পরিণতি হতো না।
পাঁচ বছর আগে, রেনু যখন জানতে পারলো তার জীবন ধ্বংসের মূলে আছে তার ভাবী পদ্ম। সে চুপ থাকে নি। সে প্রতিবাদ করেছে। সেদিন পদ্মের সাথে খুব বাগবিতণ্ডা হচ্ছিলো রেনুর। রাগের মাথায় পদ্ম চুলায় থাকা গরম তেলের কড়াইটি রেনুর দিকে ছুঁড়ে দিলো। আর সাথে সাথেই চামড়া গলে গেলো তার। পদ্ম কড়াই ছুঁড়ে দিয়েই দৌঁড়ে নিজের ঘরে চলে গেলো। সে ভেবেছে, রেনু আর বাঁচবে না। ভয়ে প্রাণ যায় যায় অবস্থা তার। রাজশাহী মেডিকেলে অনেক যুদ্ধের পর বেঁচে ফিরলো রেনু। জ্ঞান ফিরতেই তার এই অবস্থার জন্য দায়ী পদ্মকে দেখিয়ে দিলো। আফিফ মামলা করলো নিজের স্ত্রীর বিরুদ্ধে। পুলিশ এসে পদ্মকে ধরে নিয়ে গেলো। আফিফ তালাকের সিদ্ধান্ত নিলো। পদ্ম কারাগারে থাকা অবস্থায় আফিফ আর তার তালাক হয়ে গিয়েছিল। পদ্ম ছাড়া পাওয়ার পর তার বাবা তাকে নিয়ে গেছেন গ্রামে। পড়াশুনা শেষ করে নি, তাই চাকরি পাচ্ছে না সে। বাবার সংসারেও বোঝা। তার কুকর্মের ব্যাপারে জেনে তার পরিবারের সবাই ক্ষিপ্ত। শেষমেশ সে গার্মেন্টসে কাজ নিয়েছে। প্রায়ই আফিফকে ফোন দেয়। এরই মধ্যে বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে তার জন্য। পাত্র দুই সন্তানের বাবা। স্ত্রীর মৃত্যুতে সন্তান লালন-পালনের জন্য বিয়ে করতে চাইছে। পাত্র কাঠের ব্যবসা করে। অবস্থা ওতো ভালো না। কিন্তু পদ্মের বাবা-মা মেয়েকে রাখতেই চাচ্ছেন না। পদ্ম তাই আফিফকে ফোন দিয়ে তাকে সাহায্য করতে বলছে। এ নিয়ে ছয়টা নম্বর ব্লক করেছে আফিফ। এবার হয়তো সিমটা পরিবর্তন করতে হবে তার। নম্বরটা খোলা রাখার কারণ একটাই, একটা কাঙ্ক্ষিত নম্বর থেকে ফোন আসা। প্রতিবারই অপরিচিত নম্বর দেখলে তার মনে হয়, সেই কাঙ্ক্ষিত মানুষটি কল করেছে। কিন্তু না। কল আসে না তার। তবে আফিফ প্রায়ই তাকে দেখে। দূর থেকে দেখে। বেশ নাম-ডাক তার। আফিফের যোগ্যতা নেই তার সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর। দূর থেকে দেখেই চলে আসে। আগের চেয়ে বেশ সুন্দর হয়েছে সে। মলিন ভাবটা আর নেই। শুধু এখনো বিয়ে করে নি। কেন বিয়ে করে নি জানে না আফিফ। কিন্তু সে চায়, মেয়েটা সুখী হোক। নতুন সংসার হোক তার। জীবনে যেই কষ্ট পেয়েছে সে কষ্টটা ভুলিয়ে দেওয়ার জন্য যাতে কেউ আসে তার জীবনে।
রুমে এসে গা এলিয়ে দিলো আফিফ। আজ আর অফিসের কাজ নেই। হালকা ঘুমিয়ে নেবে সে। উঠেই আবার বেরুতে হবে বাজারের জন্য। আফিফ বিছানায় শুয়ে চলন্ত ফ্যানের দিকে তাকিয়ে রইলো। মনে মনে ভাবতে লাগলো, আজকে বেশ সুন্দর লাগছিলো তাকে। প্রতি মাসে সে কাঙ্ক্ষিত এই দিনটির অপেক্ষায় থাকে। কবে আহি কক্সবাজারে এসে এ আর টি গ্যালারিতে আসবে। আর সে দূর থেকে আহিকে দেখবে।
সময়টা ঘুরে গেছে। পনেরো বছর আগে আহি যেই জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল, আজ আফিফ সেখানে এসে দাঁড়ানো। পার্থক্য শুধু এতোটুকুই, আহি সেই সময় ধরে নিয়েছে আফিফ তার হবেই। কিন্তু এখন আফিফ জানে, আহি তার কখনোই হবে না। কারণ তার সেই যোগ্যতা নেই।
চলবে-