উধয়রনী পর্ব-৩৭+৩৮+৩৯

0
366

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৩৭||

৭৪।
আহি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আফিফের দিকে। আফিফের হাতে টিস্যু। সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবার দৃষ্টি আফিফ আর আহির দিকে। আহি কিছু বলতে যাবে তখনই তাজওয়ার আফিফকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“কি হলো, দাঁড়িয়ে আছো কেন? তুমি আমার ফিয়োন্সের শাড়িটাই নষ্ট করে দিয়েছো। শাড়িটা তো এই মুহূর্তে পরিস্কার করে লাভ নেই। অন্তত জুতো জোড়া তো মুছে দাও।”

আফিফ হাঁটু গেড়ে বসতেই আহি সরে দাঁড়ালো। তাজওয়ারের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“বেশি বাড়াবাড়ি করছো তুমি!”

“তোমার কেন এতো সমস্যা হচ্ছে!”

“তুমি জানো কেন সমস্যা হচ্ছে। তোমাকে বলেছি আফিফ পদ্মের…”

তাজওয়ার আহির ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে তাকে চুপ করিয়ে দিলো। এরপর আহির ঠোঁটে আঙ্গুল বুলিয়ে বলল,
“অন্যের স্বামীর প্রতি তোমার এতো মায়া থাকা উচিত না।”

আহি তাজওয়ারের দিকে তাকালো। তার চোখ দু’টিতে স্পষ্টভাবে অশ্রু ভীড় করেছে। তাজওয়ার তা দেখে বাঁকা হাসলো। আহি তাজওয়ারের হাসি দেখে বলল,
“ভেবেছি, তোমার মধ্যে পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু না। আমার বাসায় মুনিয়া খালা আর চুনি আছে, ওরা কখনো আমার পায়ে থাকা অবস্থায় আমার জুতোয় হাত দিতে পারে নি। আর তুমি এতোগুলো মানুষের সামনে আমার চেয়ে বয়সে আর সম্মানে বড় একটা মানুষকে বলছো আমার জুতো পরিস্কার করে দিতে? অন্যের স্বামী হোক, আর যাই হোক, আফিফের একটা সম্মান আছে। ও শিক্ষিত ছেলে। ও তোমার অফিসে যোগ্যতা নিয়ে এসেছে। এসব কাজ করতে আসে নি।”

তাজওয়ার জোর গলায় আফিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোমাকে কি কাজ দিয়েছি ভুলে গেছ? তাড়াতাড়ি আহির জুতো জোড়া মুছে দাও।”

আফিফ এবার আহির পায়ে হাত দিলো। তাজওয়ার সরে অন্য পাশে গিয়ে বসলো। তাজওয়ারের বন্ধুরাও বেশ আয়েশ করে বসেছে, যেন তারা কোনো নাটক দেখতে বসেছে।
আহি ইতস্ততবোধ করছিল। আফিফ ক্ষীণ কন্ঠে বলল,
“অন্য কেউ হলে অপমানিত হতাম। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার মোটেও খারাপ লাগছে না।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো, “কি!”

আফিফ তার হাঁটুর উপর আহির ডান পা’টা উঠালো। ধীরে ধীরে আহির পা মুছে দিতে দিতে বলল,
“তাজওয়ার খান সেদিনের প্রতিশোধ ভালোভাবেই নিচ্ছে।”

আহি আফিফের কথা শুনে তাজওয়ারের দিকে তাকালো। তাজওয়ার দূরে বসে আছে। সে আফিফের কথা শুনছে না। আফিফ আবার বলল,
“আমার জন্য তুমি তাকে নিয়াজীর বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলে। আমার জন্য তুমি তাকে এমন একটা কাজ করতে বাধ্য করেছিলে, যেটা সে করতেই চায় নি। আমার জন্য তুমি কিছু করলেই, সে তার দ্বিগুণ আমাকে ফিরিয়ে দেবে। তাহলে কেন করছো আমার জন্য এসব?”

আহি পা সরিয়ে ফেলতেই আফিফ উঠে দাঁড়ালো। আহির চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমাকে আর পদ্মকে একা ছেড়ে দাও।”

আহির ভীষণ রাগ উঠলো। সে হনহনিয়ে সেখান থেকে চলে গেলো। আফিফ একনজর তাজওয়ারের দিকে তাকাতেই দেখলো তাজওয়ার বেশ উৎসুক দৃষ্টিতে আফিফের দিকে তাকিয়ে আছে। এদিকে আহি একপাশে এসে দাঁড়ালো। হাতে থাকা ব্যাগটা ছুঁড়ে মারলো মেঝেতে। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো সে। মিনমিনিয়ে বলল,
“কি ভেবেছো আফিফ? আমি তোমাকে ভালোবাসি তাই আমাকে যা ইচ্ছে শোনাবে? আমি তোমাকে আর কখনোই ইম্পোরটেন্স দেবো না। আমাকে পদ্ম বলেছিল, তাই আমি নিয়াজীর বাড়িতে গিয়েছিলাম। আর যদি তোমার জায়গায় অন্য কেউ থাকতো, তবুও আমি একটা না একটা স্টেপ নিতাম। আফটার অল আমার ফ্রেন্ডের হাসবেন্ড বিপদে পড়েছিল! কিন্তু তুমি ভাবছো, তোমাকে ভালোবাসি বলেই তোমার কাছে ছুটে গিয়েছিলাম। তোমার জন্য কি এখন আমি পদ্মের সাথেও যোগাযোগ ছিন্ন করে ফেলবো?”

আহি চোখ মুছে বলল,
“ঠিক আছে। তোমাদের ভালোর জন্য আমি এখন সেটাই করবো। তোমাদের জীবনে ঝড় আসলেও আমি ফিরে তাকাবো না। এখন তোমার বউকে কোলে নিয়ে বসে থাকো তুমি। ইডিয়ট ম্যান।”

আহি পেছন ফিরতেই দেখলো আফিফ তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। আহি আফিফকে দেখে চেঁচিয়ে বলল,
“যাও এখান থেকে। এখানে কি করছো?”

আফিফ ক্ষীণ কন্ঠে বললো, “সরি।”

“তোমার সরি আমার লাগবে না। নিজেকে কি ভাবো তুমি, হ্যাঁ? একমাত্র তুমি ছাড়া কি আমার জীবনে কি কোনো পুরুষ নেই? এখন আর আমার সামনেও এসো না। পদ্মের সাথেও আমি আর যোগাযোগ রাখবো না। তোমরা বউ জামাই মিলে বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে যাও।”

আফিফ হাসলো। আহি চোখ বড় বড় করে আফিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি হাসছো?”

“তোমার কথা শুনে হাসি পেয়ে গেলো।”

“তুমি আসলেই একটা ইডিয়ট। আজ যা হয়েছে, ভালোই হয়েছে। এখন থেকে প্রতিদিন তাজওয়ার তোমার সাথে এমনই করুক। খুশি হবো আমি।”

আফিফ এবারও মুখ চেপে হাসলো। তা দেখে আহি হনহনিয়ে চলে গেলো।

(***)

হেমন্তের রাত। খোলা আকাশের নিচে মত্ত হয়ে আছে কিছু কপোত-কপোতী। আহি অবাক দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। এমন পবিত্র মাসেও তাদের মধ্যে কোনো শৃঙ্খলা নেই। এমন একটা অসুস্থ পরিবেশে কীভাবে সে তার বাকী জীবন কাটাবে, ভাবতেই তার শরীরটা অসার হয়ে আসছে। আহি তার সামনে থাকা ঝুলন্ত রঙ-বেরঙের বাতিগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ তার কোমড়ে কারো স্পর্শ পেতেই আহি চোখ-মুখ কুঁচকে বলল,
“তাজওয়ার প্লিজ, ভালো লাগছে না এসব।”

কথাটি বলতে বলতেই আহি পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো, তাজওয়ারের বন্ধু অর্ণব দাঁড়িয়ে আছে। আহি অর্ণবকে দেখে রীতিমতো অবাক হলো। ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“তুমি এখানে?”

অর্ণব বাঁকা হেসে বলল,
“কেন? অন্য কাউকে আশা করেছিলে বুঝি!”

আহি অর্ণবের পাশ কেটে চলে আসতে যাবে তখনই অর্ণব তার হাত ধরে আটকালো। আহি এক ঝটকায় অর্ণবের হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,
“আমার সাথে এমন নোংরামি করবে না।”

অর্ণব হেসে বলল,
“নোংরামির কি দেখলে, আহি!”

অর্ণব এরপর চোখ বন্ধ করে বুকে হাত রেখে বলল,
“আহ, নামটা উচ্চারণেই এতো শান্তি পাচ্ছি! না জানি তোমার মাঝে ডুব দিলে কতো শান্তি পাবো।”

আহি কথাটি শুনেই সশব্দে অর্ণবের গালে চড় বসিয়ে দিলো। অর্ণব গালে হাত দিয়ে কুৎসিত হাসি হেসে বলল,
“সবাই ড্রাংক। এই মুহূর্তে আমি ছাড়া কেউ তোমাকে বাঁচাতে আসবে না।”

অর্ণব আহির হাত চেপে ধরে তাকে নিজের কাছে টেনে এনে বলল,
“শাড়িতে কোনো মেয়েকে এতো চমৎকার লাগতে পারে, আমি কখনো ভাবতেই পারি নি।”

আহি এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলল,
“তাজওয়ার কোথায়!”

অর্ণব হেসে বলল,
“তাজ ব্যস্ত আছে। হয়তো আজ সারারাত সে ব্যস্ত থাকবে। তুমি তো ওকে ভালো রাখতে পারছো না। তাই ভালো থাকার জন্য তাকে অন্য জায়গায় ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে।”

আহি অর্ণবকে সরিয়ে দিয়ে বলল,
“তোমাদের মতো অসভ্য ছেলেদের জায়গা নরকে।”

অর্ণব হাসলো আর বলল,
“মনে হচ্ছে তাজকে ইদানীং এসব জ্ঞান একটু বেশিই দিচ্ছো। কিন্তু আমাদের তাজকে এতো সহজে তুমি পরিবর্তন করতে পারবে না।”

আহি উল্টো পায়ে পিছিয়ে যেতেই অর্ণব আহির কোমড় ধরে তাকে নিজের কাছে টেনে আনলো। আহি নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। অর্ণব তা দেখে বলল,
“তুমি অন্তত একদিন আমাকে সময় দাও। এরপর তুমি যা চাইবে আমি তোমাকে তাই এনে দেবো।”

আহির চোখে অশ্রু ভীড় করতে লাগলো। সে ভেজা কন্ঠে বলল,
“তুমি আমাকে যেমন ভাবছো, আমি তেমন মেয়ে নই। আমাকে ছাড়ো বলছি। আমি এসবে ইন্টারেস্টড নই, প্লিজ।”

অর্ণব আহিকে আরো জোরে চেপে ধরলো। আহি অর্ণবের শক্তির সাথে পেরে উঠছে না। হঠাৎ পেছন থেকে অর্ণবের পিঠে সজোরে কেউ ঘুষি মারলো। অর্ণব ভারসাম্য হারিয়ে মুখ থুবড়ে পড়তেই আহিও ভারসাম্য হারিয়ে ফেললো। কারণ সে আহিকেই ধরে রেখেছিল। কিন্তু আহির পিঠ মাটি স্পর্শ করার আগেই সেই মুষ্টিবদ্ধ হাতটি উন্মুক্ত হলো। মানুষটি শক্ত করে আহির হাতটা আঁকড়ে ধরলো। এরপর আহিকে নিজের দিকে টেনে এনে বলল,
“তুমি ঠিক আছো!”

আহি কাঁপা কন্ঠে বললো, “আফিফ, তুমি এখনো যাও নি?”

“যাই নি। ভালোই তো হয়েছে যাই নি। আমি যদি এখন চলে যেতাম, কি হতো?”

আহি চুপ করে রইলো। আফিফ গম্ভীরমুখে বলল,
“তোমাকে কে বলেছে এখানে আসতে? আহি, এই জায়গা তোমার জন্য না।”

“তাজওয়ার নিয়ে এসেছে আমাকে।”

“আমার চেয়ে তুমি ওকে ভালো করেই চেনো। ও তোমাকে নিয়ে আসতে চাইলে, তুমি আসবে কেন? আর এই কয়েক মাসে আমার ওকে আরো ভালো করেই চেনা হয়ে গেছে।”

এদিকে অর্ণব মাটি থেকে উঠে হাত ঝাড়তে ঝাড়তে বলল,
“এই ফকিরের বাচ্চা, তোর সাহস কি করে হয়, আমার গায়ে হাত তোলার?”

আফিফ আহিকে আড়াল করে দাঁড়ালো। অর্ণব আফিফের গায়ে হাত উঠাতে যাবে তার আগেই আফিফ হাত ধরে বলল,
“তোমরা আমাকে অনেক অপমান করেছো, আমি সহ্য করেছি। কিন্তু আমার সামনে কোনো মেয়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করতে পারবে না। আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবো, এটা আশা করো না।”

অর্ণব হাসলো। শব্দ করেই হাসলো। এরপর আফিফকে হালকা ধাক্কা দিলো। আহি আফিফের শার্ট খামচে ধরে বলল,
“আফিফ, চলো এখান থেকে চলে যাই। আমি চাই না, আমার কারণে তোমার কোনো সমস্যা হোক।”

(***)

এদিকে অর্ণব জোরে জোরে তাজওয়ারের নাম ধরে ডাকলো। তাজওয়ার একটু পর বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো। তাজওয়ারের সাথে বেরিয়ে এলো একটি মেয়ে। মেয়েটার পরণের জামা-কাপড় এলোমেলো। মেয়েটাকে দেখে আহির চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল। যেই মানুষটার সাথে তার সংসার করতে হবে, সেই মানুষটা যদি এমন হয়, তখন কষ্ট পাওয়াটা স্বাভাবিক। এরই মধ্যে তাজওয়ারের বাকি বন্ধুরাও বেরিয়ে এলো। তাদের মধ্যে সজিব ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“এভাবে চেঁচাচ্ছিস কেন, অর্ণব?”

অর্ণব সজিবের কথা উত্তর না দিয়ে তাজওয়ারকে উদ্দেশ্যে করে বলল,
“তাজ, তুই কোথায় ছিলি এতোক্ষণ?”

তাজওয়ার তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির দিকে আঁড়চোখে তাকিয়ে আমতা-আমতা করে বলল,
“সজিবের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম।”

আহি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে মিনমিনিয়ে বলল,
“আড্ডা দিচ্ছে!”

অর্ণব বলল,
“তুই আড্ডা দিচ্ছিস, আর তোর ফিয়োন্সে ব্যস্ত তোর পারসোনাল এসিস্ট্যান্টের সাথে।”

আফিফ আর আহি অবাক দৃষ্টিতে অর্ণবের দিকে তাকালো। অর্ণব রুক্ষ দৃষ্টিতে আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুই যাকে বিয়ে করতে যাচ্ছিস, সে একটা ক্যারেক্টার লেস।”

আফিফের এবার রাগ উঠে গেলো। সে অর্ণবের কলার ধরে তাকে ঘুরিয়ে নাক বরাবর ঘুষি মেরে বলল,
“আরেকবার আহিকে নিয়ে বাজে কথা বললে, আমি তোকে মেরে ফেলবো।”

তাজওয়ার এসে আফিফের কলার ধরতেই আহি তাজওয়ারের হাত ধরে বলল,
“তুমি তোমার বন্ধুর কথা বিশ্বাস করো না। তোমার বন্ধু মিথ্যে কথা বলছে। ও নিজে আমার সাথে বাজে ব্যবহার করেছে। আফিফ তো আমাকে ওর কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়েছে।”

অর্ণব বলল,
“তাজ, তুই তো আমাকে চিনিস। আমি কি তোর ফিয়োন্সের সাথে এমন কিছু করতে পারি?”

তাজওয়ার আহির দিকে তাকালো। আহির চোখে জল। আর তার দৃষ্টি তাজওয়ারের হাতের দিকে, যেই হাত দিয়ে সে আফিফের কলার ধরে রেখেছে। তাজওয়ার এবার চোখ-মুখ কুঁচকে তার এক হাত দিয়ে আফিফের গলা চেপে ধরে অন্য হাত মুঠো করে আফিফের মুখে ঘুষি মারতে লাগলো। আহি তাজওয়ারকে সরানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু আহির এই অস্থিরতা তাজওয়ারকে আরো হিংস্র করে তুলছে। সে আফিফকে মাটিতে ফেলে তার পেটে লাথি মারতে লাগলো। এসব দেখে আহি মাটিতে ধপ করে বসে পড়লো। আফিফকে মার খেতে দেখে আহির চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। নিঃশ্বাস ফেলতে কষ্ট হচ্ছিলো তার। জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো আহি। অস্থির লাগছিলো তার। হাত-পাও অস্বাভাবিকভাবে কাঁপছে। হাত দিয়ে শক্ত করে মাটি আঁকড়ে ধরে আছে আহি। তাজওয়ারের চোখ আহির দিকে পড়তেই সে থেমে গেলো। আহির দিকে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে তাকিয়ে, দ্রুত তার কাছে এসে বসলো। আহি অস্থিরভাবে ছটফট করছে। আফিফ মাথা তুলে আহিকে দেখে উঠে বসার চেষ্টা করতেই অর্ণব এসে আফিফের পিঠে আরেকটা লাথি মারলো।

এদিকে তাজওয়ার আহির হাত ধরে বলল,
“কি হয়েছে তোমার?”

আহি নিভু নিভু চোখে তাজওয়ারের দিকে তাকালো। আর শরীরের যতোটুকু শক্তি ছিল সেই শক্তি দিয়েই সে তাজওয়ারের চুলগুলো টেনে ধরলো। তাজওয়ার সজিবকে বলল,
“পানি নিয়ে আয়।”

সজিব পানি আনতেই তাজওয়ার সেই পানি হাতে নিয়ে আহির মুখে ছিটিয়ে দিলো। একটু পর আহি স্বাভাবিক হতেই তাজওয়ারকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। এরপর তার কাঁপা শরীর নিয়ে আফিফের কাছে এসে বসলো। আফিফের মাথাটা উঠিয়ে নিজের কোলের উপর রাখলো, অস্ফুটস্বরে ডাকলো, “আফিফ!”

আফিফ চোখ খুলে কাঁপা কন্ঠে বলল,
“এবার খুশি হয়েছো?”

আহি মলিন মুখে আফিফের দিকে তাকিয়ে আছে। তখনই তাজওয়ার আহির কাছে এসে তাকে টেনে উঠালো। আহি তাজওয়ারকে আবার ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। কাঁপা কন্ঠে বলল,
“যেই ছেলেটা আমাকে বাঁচিয়েছি, তুমি তাকে মেরেছো? তুমি আমাকে কেন এনেছো এখানে? নিলাম করতে এনেছো? আমার বাবা তো আমাকে তোমার কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে। তুমিও এখানে তোমার বন্ধুদের কাছে আমাকে বিক্রি করতে এনেছো, তাই না?”

(***)

আফিফের নাক ফেটে গেছে। নাক বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। মাথাটাও ভোঁ ভোঁ করছে তার। সে কোনোভাবে উঠে দাঁড়িয়ে আহির হাত ধরলো। তাজওয়ার কিছু বলার আগেই আফিফ বলল,
“যদি আমার স্ত্রী বা আমার বোনের সাথে বাইরের কোনো ছেলে খারাপ ব্যবহার করতো, তাহলে আমি আপনার মতো নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকতাম না। আর আপনি যাকে ভালোবাসেন, তাকে আপনার বন্ধুদের সাথে একা ছেড়ে অন্য জায়গায় ব্যস্ত হয়ে গেছেন? সরি স্যার, আমি আপনার এসিস্ট্যান্ট মাত্র। কিন্তু এমন অসম্মান আমি দেখে থাকতে পারবো না। আমাকে তো বেশ মারলেন। জানি, আপনার আমার প্রতি কেন এতো রাগ। কিন্তু একবার ওই দিকের সিসি ক্যামেরাটা দেখে আসবেন।”

আফিফের কথা শুনে অর্ণব অবাক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকালো। বাসাটা জিলানের। কিন্তু এই বাসার প্রতিটা স্থান অর্ণবের মুখস্থ। গাছের সাথে লাগানো সিসি ক্যামেরাটা কখনোই অর্ণব খেয়াল করে নি। সে ভ্রূ কুঁচকে আফিফকে বলল,
“কি বলতে চাইছো তুমি?”

আফিফ তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে বলল,
“সত্যটা আগে আপনি জেনে নিবেন, তারপর বিচার করবেন। আর বিচার শেষে আহির সাথে দেখা করবেন৷”

আফিফ আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“মানুষ খারাপ হতে পারে। তার পরিস্থিতি প্রতিকূলে থাকতে পারে। কিন্তু যাকে আমরা একবার বা এক সেকেন্ডের জন্যও ভালোবেসেছি, তাকে অসম্মান করা যায় না। তাকে বিশ্বাস করতে হয়। তাকে আগলে রাখতে জানতে হয়।”

আফিফ এবার তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভালোবাসা মানে শুধু তার প্রতিই যত্ন নেওয়া, যে আপনার পাশে আছে। ভালোবাসা তো একজন অসৎ মানুষকেও সৎ বানিয়ে ফেলতে পারে। যদি না পারে, তাহলে সেটা ভালোবাসা না। সেটা জেদ আর অহংকার মাত্র।”

তাজওয়ার আহির হাত ধরতে যাবে তার আগেই আফিফ তাকে আটকে দিয়ে বলল,
“আমি আহিকে আপনার সাথে এই মুহূর্তে একা ছেড়ে যেতে পারবো না। আপনি সজ্ঞানে ফিরেই আহির সাথে দেখা করবেন, এর আগে নয়।”

আফিফ আহির হাত ধরে তাকে টেনে নিয়ে গেলো। আহি ভীত চোখে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে আছে। তাজওয়ার যে তাকে আটকাচ্ছে না, এতেই বেশ অবাক হয়েছে আহি।

৭৫।

গাড়িতে উঠেই আফিফের দিকে তাকালো আহি। ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“থ্যাংক ইউ।”

আফিফ আহির দিকে তাকালো। আহি বলল,
“আমি কিন্তু এবার তোমাকে এসবে জড়াতে বলি নি।”

আফিফ হাসলো। আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“হাসার মতো কিছু বলি নি।”

আফিফ বলল,
“তখন যা বলেছিলাম, বলে ফেলেছি। মাঝে মাঝে আমি অনেক কথা ভেবে বলি না। রাগ থেকেও এমন কথা বলে ফেলি, যেটার কোনো ভিত্তিই নেই। তাই সরিও বলেছি।”

“সরি বলে মার খেয়ে একদম সব ভুলিয়ে দিয়েছো। সত্যিই আমি অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তাজওয়ার কাউকে খুন করতে দ্বিতীয় বারও ভাববে না।”

“সে তোমার সামনে এই কাজ করতো না।”

“তুমি কীভাবে শিউর হলে?”

“সেটা তোমার জানতে হবে না।”

“সাসপেন্স রেখে কথা বলছো কেন?”

আফিফ হাসলো। আহি ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। এরপর দু’জনই নিরব। আহি বলল,
“পদ্মকে কি বলবে?”

আফিফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “সেটাই ভাবছি!”

“ও খুব চিন্তা করবে। আমার জন্য মারামারি লেগেছে শুনলে আমাকে নিয়েও চিন্তা করবে। মেয়েটা তোমাকে ভীষণ ভালোবাসে। সেদিন তুমি নিয়াজীর বাড়িতে যাওয়ার পর, ও খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলো।”

আফিফ আহির দিকে তাকিয়ে আছে। আহি পাশ ফিরতেই সে চোখ সরিয়ে নিলো। আহি বলল,
“সরি।”

আফিফ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “সরি কেন?”

“বেশি মেরেছে তাজওয়ার, তাই না?”

“হুম।”

আহি ড্রাইভারকে বলল, হাসপাতালের দিকে ঘুরিয়ে নিতে। আফিফ বাঁধা দিলো না। এই মুহূর্তে প্রাথমিক চিকিৎসা প্রয়োজন। শরীরটা বেশ ব্যথা করছে তার।

হাসপাতালে পৌঁছে আফিফকে মুখের এক্স-রে করতে বলা হলো। ব্যথার ওষুধও লিখে দেওয়া হলো। আহি ওষুধগুলো কিনে আফিফের হাতে দিয়ে বলল,
“এক্স-রে কাল করতে হবে। চলো, তোমাকে তোমার বাসায় নামিয়ে দিয়ে আসি।”

“তুমি আমাকে নামিয়ে দিয়ে আসবে? তোমাকেই তো বাসায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য একজন প্রয়োজন।”

আহি চুপ করে রইলো। আফিফ বলল,
“আহি, আমার একটা হ্যাল্প করতে পারবে?”

“হ্যাঁ, বলো!”

“আজ রাতের জন্য আমাকে বাইরে থাকার ব্যবস্থা করে দেবে? আসলে আমার তেমন একটা বন্ধু নেই। যে আছে সে এখানে থাকে না। বাসায় মা খুব অসুস্থ। এই অবস্থায় আমাকে দেখলে বেশ চিন্তায় পড়ে যাবে। পদ্মকে তো বুঝিয়ে ফেলতে পারবো। মায়ের তো বয়স হয়েছে। বোঝাতে গেলেও বুঝবে না। তাই আমি এই অবস্থায় বাসায় যেতে চাচ্ছি না। বাসায় বলবো, কাজের জন্য বাইরে আছি।”

আহি কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
“রাদ তো ফ্যামিলি নিয়ে থাকে। ওখানে সম্ভব না। লাবীব হোস্টেলে থাকে। ওকে ফোন করবো?”

“হুম, করে দেখো।”

আহি লাবীবকে ফোন করলো। কিন্তু লাবীব রিসিভ করে বলল, সে এখন কক্সবাজার। আফিফ হতাশ হলো। এবার আহি কিছু একটা ভেবে বলল,
“আচ্ছা, আমার সাথেই চলো।”

“তোমার বাসায় সম্ভব না।”

আহি হেসে বলল,
“জানি। আমার বাসায় একদমই সম্ভব না। কিন্তু মায়ের বাসায় সম্ভব।”

এরপর আহি আফিফের ফোন থেকেই সালমা ফাওজিয়াকে কল করলো। তারপর সে আফিফের ব্যাপারে বলতেই তিনি আফিফকে নিয়ে আসতে বললেন। এরপর আহি আফিফকে নিয়ে তার মায়ের বাসায় এসে পৌঁছালো। আফিফ বলল,
“আন্টি কিছু মনে করবেন না তো!”

“আন্টির রাজকুমারীর জন্য তোমার এই অবস্থা হয়েছে। তোমাকে তো রাজা বানিয়ে রাখবে।”

আফিফ কিছু বললো না। এদিকে সালমা ফাওজিয়া আফিফকে দেখে অস্থির হয়ে পড়লেন। সোফা গুছিয়ে দু’টো বালিশ দিয়ে বসালেন। ফল কেটে আনলেন। পানি এগিয়ে দিলেন।
এদিকে টুংটাং শব্দ শুনে রোকেয়া ফাওজিয়া ঘুম থেকে উঠে পড়লেন। সালমা ফাওজিয়া মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“মা, আহি এসেছে!”

রোকেয়া আহির উপর বিরক্ত হলেও আজ আহিকে সামনা-সামনি দেখে কেঁদেই ফেললেন। নাতনিকে জড়িয়ে ধরে কপালে, গালে চুমু খেলেন। অতি স্নেহে আহির হাত জড়িয়ে সোফায় বসলেন। এরপর আফিফের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ আফসোস করলেন। আফিফ মোটামুটি লজ্জায় পড়ে গেলো। এখানে এসে যে মারাত্মক ভুল করেছে সে। এমন ভাবে তারা আফিফের দেখাশুনা করছে, মনে হচ্ছে সে শ্বশুড় বাড়িতে এসেছে। আহি আফিফের পাশে বসে বলল,
“বলেছি না, রাজার হালে থাকবে।”

“ওরা কিছু মনে করবে না তো!”

“একদমই না। আমি বলে দিয়েছি আমার কারণেই তোমার এই অবস্থা হয়েছে। আর তোমার মা আর বউ তোমাকে এই অবস্থায় দেখলে চিন্তা করবে তাই বাসায় যাচ্ছো না।”

আফিফ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আহি হেসে বলল,
“তুমি পদ্মের হাসবেন্ড মা জানে। নানুকে এই মাত্র জানিয়েছি। চিন্তা করো না, নেগেটিভ কিছু ভাববে না।”

আফিফ আহির দিকে তাকালো। আহি উঠে দাঁড়ালো। আফিফ জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি কোথায় যাচ্ছো?”

“বাসায়!”

“তুমি এখানে থাকবে না?”

“না।”

আফিফ ইতস্ততবোধ করতেই আহি বলল,
“আরেহ, চিন্তা করো না। মনে করবে এটা তোমার নিজের বাড়ি। আমার বাড়ি মানেই পদ্মের বাড়ি। আর পদ্মের বাড়ি মানেই তোমার বাড়ি। হয়ে গেলো তো সলিউশন?”

“তুমি থাকলে হয়তো ভালো হতো। আই মিন, আন্টি আর নানুর সাথে তো আমার তেমন পরিচয় নেই। তাই বলছি।”

আহি মুচকি হেসে বলল,
“মা অনেক ফ্রেন্ডলি। আর আমার এখানে থাকা সম্ভব না। বাবা জানলে সমস্যা হবে। আমি যাই।”

“তুমি একা যাবে?”

“না, রাত বারোটা বেজে গেছে। বাসা থেকে গাড়ি পাঠানো হয়েছে।”

এরপর আহি সালমা ফাওজিয়া আর রোকেয়া ফাওজিয়ার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো। আহি চলে যেতেই আফিফকে একটা রুম দেওয়া হলো। আফিফ সেখানে ঢুকতেই দেখলো আহির আঁকা একটা ছবি দেয়ালে ঝুলছে। আফিফ ছবিটির দিকে তাকিয়ে রইলো। অজানা কারণেই মনটা ভারী হয়ে আসছে তার৷

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৩৮||

৭৬।
একে একে তিনটা গাড়ি ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতেই সবার দৃষ্টি সেদিকে আটকে গেলো। ক্যাম্পাসের মাঠে হট্টগোলের শব্দ শুনে রাদ নিচে নেমে দেখলো তাজওয়ার খান দাঁড়িয়ে আছে। তাজওয়ারকে দেখে রাদ দ্রুত পায়ে আহির ডিপার্টমেন্টের সামনে চলে এলো। এদিকে তাজওয়ার হাতে একটা মাইক নিয়ে বলল,
“আহি কাল যা হয়েছে তার জন্য সরি। তুমি একবার আমার সামনে এসে দাঁড়াও, প্লিজ।”

আহি ক্লাস থেকে বেরিয়ে চার তলা থেকে নিচে তাকিয়ে দেখলো তাজওয়ার নিচে দাঁড়িয়ে আছে। তাজওয়ারকে দেখে আহি রেগে গেলো। দ্রুত পায়ে নিচে নেমে তাজওয়ারের সামনে এসে দাঁড়ালো। তাজওয়ার মাইক রেখে আহির সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
“আই এম সরি, আহি। আমার জন্য কাল রাতে তোমার অনেক সমস্যা হয়েছে।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে রইলো। সে বুঝতে পারছে না, তাজওয়ার এতোগুলো মানুষের সামনে কীভাবে তার কাছে ক্ষমা চায়ছে! যার কাছে নিজের আত্মসম্মানবোধ সবার উপরে, তার কাছ থেকে এমন ব্যবহার আশা করাও অকল্পনীয়। আহি তাজওয়ারের হাত ধরে উঠিয়ে বলল,
“আমার ক্যাম্পাসে এসেই তোমাকে এই তামাশা কর‍তে হলো!”

“কি করবো বলো? তুমি কাল পার্টি থেকে চলে যাওয়ার পর আমি বুঝতে পেরেছি, আমার কতো বড় ভুল হয়েছিল।”

(***)

গতকাল রাতে আফিফ আহিকে নিয়ে চলে যাওয়ার পর তাজওয়ার রাগী দৃষ্টিতে অর্ণবের দিকে তাকালো। অর্ণব কাঁপা কন্ঠে বললো,
“তোর কি মনে হয় আমি আহির সাথে বাজে ব্যবহার করবো?”

তাজওয়ার ধীর পায়ে অর্ণবের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। আর অর্ণব পেছাতে লাগলো। সজিব আর জিলান তাজওয়ারকে থামানোর জন্য বলল,
“তাজ, তোর হয়তো ভুল হচ্ছে, অর্ণব এই কাজ করবে না। এক কাজ করি, আমরা ফুটেজ দেখে আসি।”

তাজওয়ার গম্ভীরমুখে বলল,
“তার কোনো প্রয়োজন নেই। অর্ণব কি কি করতে পারে, তা তো তোরা ভালো করেই জানিস। আর আহি কেমন মেয়ে তা আমি ভালো করে জানি।”

কথাটি বলেই তাজওয়ার অর্ণবের নাক বরাবর একটা ঘুষি মারলো। অর্ণব তাজওয়ারের পা ধরে বসে পড়লো। ভীত কন্ঠে বললো,
“আমাকে ক্ষমা করে দে, দোস্ত। আমি নেশা করে ফেলেছিলাম। আমার হুঁশ ছিলো না।”

তাজওয়ার অর্ণবের কলার ধরে তাকে উঠিয়ে বলল,
“এটা তো জাস্ট ট্রেলার, মুভি তো আগামীকাল রিলিজ হবে। আর এরপর বোঝা যাবে আমার মুভি হিট হয়েছে, না-কি ফ্লপ।”

(***)

তাজওয়ার আহির হাত ধরে বলল,
“আহি, সত্যিই আমি তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম, কিন্তু অর্ণব আমার অনেক কাছের বন্ধু। ও যখন বলেছে আফিফ তোমার সাথে বাজে ব্যবহার করতে চেয়েছে, আমি না হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছিলাম। তারপর যখন মাথা ঠান্ডা করে ভাবলাম, তখনই বুঝলাম আহি তো আফিফকে বাঁচাতে এসেছিল। কারণ আহি সবসময় তার পক্ষেই থাকে, যা সত্য। অর্ণব যদি সত্য বলতো, তাহলে তো তুমি অর্ণবের পক্ষে দাঁড়াতে।”

আহি চোখ ছোট করে বলল,
“ব্রেনওয়াশ করছো আমার? তুমি ভালো করেই জানো, তোমার বন্ধু কেমন।”

“এজন্যই তো শাস্তি দিয়েছি।”

তাজওয়ার এবার গাড়ির কাছে গেলো। গাড়ির দরজা খুলে অর্ণবকে টেনে বের করলো। আহি অর্ণবকে দেখে অবাক হলো। অর্ণবের চেহারা পালটে গেছে। নাক-মুখ রক্তে মাখামাখি। ক্যাম্পাসে উপস্থিত শিক্ষার্থীরা ভয়ে পিছিয়ে গেলো। কারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমন দৃশ্য দেখা ভয়ংকর।

এদিকে তাজওয়ার অর্ণবের ঘাড় ধরে টেনে এনে তাকে আহির পায়ের কাছে ফেললো। সবাই অবাক হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। রাদ এবার আহির পাশে এসে দাঁড়ালো। চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে, আহি?”

“পরে বলছি।”

(***)

অর্ণব আহির পা ধরে কান্নাকাটি করতে লাগলো। আহি ভ্রূ কুঁচকে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে আছে। তাজওয়ার কয়েক পা পিছিয়ে গেলো। গাড়ির উপর থেকে মাইকটা আবার হাতে নিলো। মলিন মুখে বললো,
“আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি, আহি। সেই প্রথম দেখাতেই তোমার প্রেমে পড়েছিলাম আমি। এরপর আমার স্বপ্ন সত্যি হলো তোমার আর আমার এনগেজমেন্টের পর। মনে হতে লাগলো তোমাকে পাওয়ার পথ খুলে গেছে। কিন্তু তখনই আমার প্রিয় বন্ধু, যাকে আমি এতো বিশ্বাস করি, সে-ই আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলো। তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করলো, তোমার চরিত্রে আঙ্গুল তুলে কথা বললো। কিন্তু আমি সেই মুহূর্তে তোমাকে বিশ্বাস করলেও চুপ ছিলাম। তার জন্য সরি। কিন্তু এখন আমি অপরাধীকে শাস্তি দিয়েছি। এবার আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি জানি তুমিও আমাকে ভালোবাসো। একটাবার আমার হাত ধরে বলো, ভালোবাসি।”

আহি অবাক চোখে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে আছে। রাদ বলল,
“আহি, কি বলছেন উনি? তুই ভালোবাসিস উনাকে? আর তোর সাথে খারাপ ব্যবহার কখন করলো? তুই আমাকে এসব বলিস নি কেন?”

“রাদ, আমি তোকে সবটা জানাবো। প্লিজ এখন একটু চুপ কর।”

রাদের এই মুহূর্তে ভীষণ অস্থির লাগছে। তাজওয়ার কেন বললো, আহি তাকে ভালোবাসে? আহি কি তবে তাজওয়ারকে ভালোবেসে ফেলেছে? না, এটা অসম্ভব। আহি যেখানে আফিফকেই ভুলতে পারে নি, সেখানে এতো তাড়াতাড়ি যাকে ঘৃণা করে, তাকে ভালোবেসে ফেলবে, এটা কখনোই হতে পারে না।

এদিকে এখনো আহি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। আর তাজওয়ার হতাশ চোখে আহির দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ ক্যাম্পাসে উপস্থিত একটা ছেলে জোরে বলে উঠল,
“আহি, ভাইয়াকে ক্ষমা করে দাও। আর ভালোবাসি বলে দাও।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে ছেলেটির দিকে তাকালো। এই ছেলেকে আহি চেনেও না, অথচ ছেলেটা তার নাম ধরে ডেকে তাকে এমন কথা বললো! ছেলেটা যেন শুরুটাই করে দিলো, সাথে সাথেই ক্যাম্পাসে উপস্থিত সবাই জোরে জোরে একই কথা বলতে লাগল। আহি ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। এবার সে বুঝতে পারলো, তাজওয়ার কেন এমন করেছে। আহি বাধ্য হয়ে তাজওয়ারের সামনে এসে বলল,
“ক্ষমা করলাম। এখন যাও।”

তাজওয়ার মৃদু হেসে বলল,
“ভালোবাসি বলে দাও না!”

“ভালোবাসি।”

তাজওয়ার মাইকটা রেখে আহিকে জড়িয়ে ধরলো। আহিও তাজওয়ারকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“এই কাজটা না করলেও পারতে।”

তাজওয়ার বাঁকা হেসে বলল,
“তোমার মুখ থেকে ভালোবাসি শব্দটা শোনার চান্স মিস করলাম না। আর এখন সবাই জেনে গেছে, তাজওয়ার খান কতোটা রোমান্টিক আর অনেস্ট লাইফ পার্টনার। আর সে আহিকে কতোটা ভালোবাসে।”

আহি বলল,
“আর সেই সুযোগে তুমি মেয়েদের সাথে নোংরামি করবে, আর এই কথা কেউ বিশ্বাসই করবে না। কারণ তুমি তো দেখিয়ে দিয়েছো, তোমার আত্মসম্মানবোধ ভালোবাসার কাছে কিছুই না। তুমি আহির জন্য সব কর‍তে পারো, সেখানে একটা মেয়ের সাথে নোংরামি করা তো অসম্ভব।”

“ইউ আ’র টু ইন্টেলিজেন্ট।”

তাজওয়ার এবার অর্ণবকে ইশারায় গাড়িতে বসতে বলল। অর্ণবও ধীর পায়ে গাড়িতে উঠে গেলো। এরপর তাজওয়ার আহির কপালে চুমু খেয়ে ক্যাম্পাসে ভীড় জমানো ছাত্র-ছাত্রীদের হাত দেখিয়ে বিদায় দিয়ে গাড়িতে উঠে গেলো। গাড়ি বেরিয়ে গেলো ক্যাম্পাসের বাইরে। কিন্তু তাজওয়ারের গাড়িটা থেমে গেলো কিছুদূর গিয়েই। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো সেই গাড়ি। হঠাৎ কাঁধে ব্যাগ ঝুলানো একটি ছেলে হাঁপাতে হাঁপাতে তাজওয়রের গাড়ির কাছে এসে দাঁড়ালো। তাজওয়ার গাড়ির গ্লাস নামিয়ে তার হাতে এক হাজার টাকার দুইটা বান্ডেল ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“থ্যাংকস।”

ছেলেটা হাসলো। এটা সেই ছেলে, যে সবার প্রথমে চেঁচিয়ে আহিকে বলেছিলো তাজওয়ারকে ক্ষমা করে দিয়ে ভালোবাসি কথাটা বলতে। ছেলেটা চলে যেতেই তাজওয়ার গাড়ির গ্লাস উঠিয়ে শিস বাজাতে লাগলো। অর্ণব মলিন মুখে বলল,
“আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছিস?”

তাজওয়ার বাঁকা হেসে বলল,
“আহি শুধু আমার। আহিকে স্পর্শ করার অধিকারও আমার। কেউ যদি ভুলেও আহিকে স্পর্শ করতে চায়, আমি তাকে ক্ষমা করি না।”

কথাটি বলেই তাজওয়ার পকেট থেকে তার রিভলবারটা বের করে অর্ণবের মাথায় ঠেকালো। তাজওয়ার বলল,
“আমাকে ক্ষমা করে দিস বন্ধু। তোকে ক্ষমা করার মতো উদার মন আমার নেই।”

(***)

গুলির শব্দ গুঞ্জন করে উঠল শূন্য রাস্তায়। গাড়ির সিটে অর্ণবের মৃত শরীরটা পড়ে আছে। গুলি মাথায় আঘাত করতেই সেকেন্ডের মধ্যে অর্ণবের প্রাণটা উড়ে গেলো। তাজওয়ার গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
“বিদায় বন্ধু। পরকালে আবার দেখা হবে।”

তাজওয়ারের বডিগার্ড সিগারেট ধরিয়ে তাজওয়ারের ঠোঁটে পুরে দিলো। তাজওয়ার ফুঁ দিয়ে ধোঁয়া উড়াতে উড়াতে হাতটা ভালোভাবে ধুয়ে নিলো। পেছন ফিরে একনজর অর্ণবের মৃতদেহটার দিকে তাকিয়ে বলল,
“পাঁচ মিনিটের অপেক্ষা। এরপর একটা ট্রাক এসে সজোরে ধাক্কা দেবে গাড়িটিকে। সেই ধাক্কায় গাড়িটা গিয়ে পড়বে পাশের খাদে। এরপর তোমরা নিচে গিয়ে গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেবে। এরপর আসবে ব্রেকিং নিউজ, নিয়ন্ত্রণহীন ট্রাকের ধাক্কায় তাজওয়ার খানের গাড়ি ছিঁটকে পড়লো খাদে। দুর্ভাগ্যক্রমে গাড়িতে থাকা তাজওয়ার খানের প্রিয় বন্ধু অর্ণব ইন্তেকাল করেছে। ইন্না-লিল্লাহি ওয়া ইন্না-ইলিহির রাজিউন। টগবগ যুবক অর্ণব সবে একটা কোম্পানি চালু করেছিল। বেশ লাভ হচ্ছিলো, কিন্তু সবটাই শেষ হয়ে গেলো। ভাগ্যক্রমে খানস গ্রুপের এমডি তাজওয়ার খান বেঁচে ফিরেছেন। তিনি এই মুহূর্তে আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি। তার জ্ঞান ফিরলে পুলিশ তাকে দুর্ঘটনার ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। অন্যদিকে ট্রাক ড্রাইভার পলাতক।”

কথাটি বলেই তাজওয়ার হাসলো। তার বিদঘুটে হাসির শব্দ থামলো পাঁচ মিনিট পর তারই পূর্ব পরিকল্পিত পরিকল্পনা সমাপ্ত হতেই। তাজওয়ার অন্য গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে বলল,
“আমাকে একটু মেকাপ করতে হবে। আফটার অল অনেক বড় অভিনয়ের জন্য আমি সিলেক্ট হয়েছি। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগে আমাকে আমার সিক্রেট বাড়িতে নিয়ে চলো।”

৭৭।

রাদ আহির হাত ধরে তাকে টেনে নিয়ে গেলো ক্যান্টিনে। আহি মলিন মুখে বসে আছে। রাদ ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
“কাহিনী কি!”

আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রথমেই উজ্জ্বলের পরিকল্পনার ব্যাপারে জানালো। এরপর গত কয়েকদিনে ঘটা সব ঘটনা রাদকে খুলে বললো। রাদ সব শুনে বলল,
“আহি, তোর সাহস কেমন, তুই ওই পার্টিতে চলে গেলি!”

আহি মুখ ছোট করে বসে রইলো। রাদ আবার বলল,
“আফিফ কি এখনো আন্টির বাসায়?”

“হুম, মা ফোন করে বললো, আফিফের না-কি খুব জ্বর এসেছে। পদ্মকে এখনো জানানো হয় নি। মেয়েটা জানলে এখন আমাকেই বকবে। সব আফিফের দোষ! পদ্মকে সব জানিয়ে দিলেই হতো।”

“আফিফ পদ্মকে কি বলেছে?”

“বলেছে কাজের কারণে কক্সবাজার গেছে। আসতে সময় লাগবে।”

“এতো বড় মিথ্যে কথা!”

“সেটাই তো। আফিফ মিথ্যা না বলে অন্তত পদ্মকে জানিয়ে দিতো, ও এসে দেখাশুনা করতো। মা তো এখন অফিসে চলে গেছে। নানুর বয়স হয়েছে। আফিফকে এখন কে দেখবে? ওর তো জ্বর।”

আহি রাদের দিকে তাকালো। রাদ বলল,
“আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?”

“চল না একটু। বেস্টু না তুই আমার!”

“এখন আমি বেস্টু আর রইলাম কোথায়? আপনার প্রাণের বান্ধবী লিনাশা এসে আমার জায়গা কেঁড়ে নিয়েছে।”

“ভাই, ও আর তুই আলাদা।”

“তাই, আলাদাটা কেমন!”

“আরেহ, তুই ছেলে, আর ও মেয়ে।”

কথাটি বলেই আহি মুখ চেপে হাসলো। রাদ আহির হাতে হালকা ঘুষি মেরে বলল,
“চল, দেখে আসি ওই তেলাপোকাটাকে। আর একটা লাল হিট নিয়ে যাই সাথে করে। মুখের সামনে স্প্রে করে দেবো।”

“চুপ কর তো!”

(***)

দুপুরে আহি আর রাদ সালমা ফাওজিয়ার বাসায় এলো। আহি বাসায় ঢুকতেই রোকেয়া ফাওজিয়া বললেন,
“আহি, ছেলেটার তো খুব জ্বর। সালমা তো অফিসে চলে গেছে। আমি ছেলেটাকে একবার দেখে এসেছি। বেচারা জ্বরে কাঁপছে! সালমা কাকে যেন ফোন করে বলেছিল ওষুধ নিয়ে আসতে, কেউ তো এলোই না।”

আহি বলল,
“নানু, তুমি চিন্তা করো না। আমরা দেখছি।”

রাদ রোকেয়া ফাওজিয়াকে সালাম দিলো। রোকেয়া ফাওজিয়া রাদের থুতনি ধরে বললেন,
“রাদ, তোমাকে আমি প্রথমে চিনতেই পারি নি। তুমি এখানে বসো। আহি যাক। তুমি আমার সাথে কথা বলো, নানু। তোমার মা-বাবা, চাচারা কেমন আছে?”

“জ্বি ভালো।”

রাদ রোকেয়া ফাওজিয়ার প্রশ্নের উত্তর দিতে ব্যস্ত। অন্যদিকে আহি আফিফের ঘরে গিয়ে দেখলো আফিফ কাঁথা মুড়িয়ে শুয়ে আছে। আহি আফিফের পাশে বসে বলল,
“আফিফ, জেগে আছো?”

আফিফ ক্ষীণ কন্ঠে বললো, “হুম, পদ্ম!’

আহি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর বলল,
“আফিফ, তোমার কি বেশি খারাপ লাগছে? ব্যথা আছে এখনো?”

আফিফ বিড়বিড় করে কি যেন বললো। আহি বুঝলো না। সে আফিফের দিকে ঝুঁকে তার মুখ দেখার চেষ্টা করলো। দেখলো আফিফের নিভু নিভু চোখ দু’টিও কাঁপছে। আহি কাঁপা হাতে আফিফের কপাল স্পর্শ করতেই চমকে উঠল। সে চকিত দৃষ্টিতে আফিফের দিকে তাকালো। ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“তোমার তো ভীষণ জ্বর।”

আশেপাশে থার্মোমিটার খুঁজতে লাগলো আহি। এরপর ড্রয়ার খুলতেই পেয়ে গেলো। থার্মোমিটারটি ধুয়ে আফিফের মুখে ঢুকিয়ে দিলো। আফিফ আহির হাতটা শক্ত করে ধরলো, আর মিনমিনিয়ে বলতে লাগলো,
“পদ্ম! কাঁদছো কেন? কাঁদে না পদ্ম!”

আহি ভ্রূ কুঁচকে আফিফের দিকে তাকিয়ে আছে। এক মিনিট হতেই থার্মোমিটার বের করে এনে দেখলো ১০৩ ডিগ্রী জ্বর। আহি ব্যস্ত হয়ে রাদকে ডাকলো। রাদ আহির ডাকে রুমে ঢুকে বলল,
“কি হয়েছে, আহি?”

“আফিফের তো অনেক জ্বর! আমার মনে হয় ওকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া উচিত।”

“উনার বাসার কাউকে বলবি না?”

“আমি তো পদ্মকে জানাতে চেয়েছিলাম, কিন্তু উনি বারণ করেছিল। এখন হয়তো জানাতেই হবে।”

আহি ফোন হাতে নিয়ে আফিফের পাশে এসে বসলো। পদ্মের নম্বরে ডায়াল করতে যাবে তখনই কলিংবেলের শব্দ হলো। রোকেয়া ফাওজিয়া আহিকে ডেকে বললেন,
“আহি, সালমা ওষুধ নিয়ে যাকে আসতে বলেছিল, সে হয়তো এসে গেছে।”

আহি ফোনটা টেবিলের উপর রেখে দরজা খুলে দিলো। প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী রাদের সাহায্য নিয়ে আফিফকে ওষুধ খাইয়ে দিলো। সালমা ফাওজিয়া’র পাশের ফ্ল্যাটেই একজন মেডিসিনের ডাক্তার থাকেন। নাম রোকন আহমেদ। তিনিই সেই প্রেসক্রিপশন লিখে দিয়েছিলেন।

……..

সকালে ঘুম ভেঙেই সালমা ফাওজিয়া যখন আফিফকে ডাকলেন তখন সাড়াশব্দ না পেয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে দেখলেন, আফিফ বেঘোরে ঘুমাচ্ছে, আর ঠান্ডায় জড়োসড়ো হয়ে আছে। এরপর সালমা ফাওজিয়া আফিফকে কয়েকবার ডেকেও যখন সাড়া পেলেন না, তখন পাশ থেকে কাঁথাটা উঠিয়ে নিজেই আফিফের গায়ে জড়িয়ে দিলেন। আর তখনই তিনি অনুভব করলেন আফিফের শরীরের তাপমাত্রা বেশি। তিনি যখন জ্বর মেপেছিলেন, তখন ১০১ ডিগ্রী জ্বর ছিল। সালমা ফাওজিয়া দেরী না করে তখনই পাশের ফ্ল্যাটে গিয়ে রোকন আহমেদকে আফিফের ব্যাপারে জানালেন। রোকন আহমেদ সেই মুহূর্তে নিজের চেম্বারের উদ্দেশ্যেই বেরুচ্ছিলেন। তিনি তবুও আফিফকে এসে দেখে গেলেন। সেই অনুযায়ী ওষুধও লিখে দিলেন। গতদিনের প্রেসক্রিপশনও দেখলেন, যেখানে আফিফকে এক্স-রে করার জন্য বলা হয়েছিল। তিনি আফিফকে ভালোভাবে দেখে বললেন, যাতে আজই এক্স-রে করিয়ে ফেলে। এরপর তিনি যাওয়ার পর সালমা ফাওজিয়া একজনকে ফোন করে ওষুধগুলো বাসায় এনে দিতে বললেন, কারণ তাকেও অফিসে যেতে হবে। আর আহিও সেই মুহূর্তে ক্যাম্পাসে ছিল।

…………

আফিফকে ওষুধ খাইয়ে দিয়ে আহি তার পাশে এসে বসলো। এক গামলা পানি নিয়ে সে আফিফের মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে। রাদ আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“তাজওয়ার মানুষটা যে কতোটা ভয়ংকর, আফিফের এই অবস্থা দেখেই বোঝা যাচ্ছে!”

আহি ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“এজন্যই তো ভয় পাই আমি।”

“মনে হয় না আফিফের এই জবটা থাকবে।”

“না থাকলেই ভালো। যখন ওর কোম্পানিতে কাজ নিয়েছিল, তখনই আমি ভাবছিলাম, আফিফের ওখানে কীভাবে চাকরি হলো! তাজওয়ার নিজেও ওমেনাইজার। তার আন্ডারে কাজ করে ওরাও ওমেনাইজার। হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া। সোহাগ নামের যেই ছেলেটা তাজওয়ারের এসিস্ট্যান্ট ছিল, আমি সেই ছেলেকে দুইবার রাস্তায় দেখেছি। তাও আবার আলাদা আলাদা মেয়ের সাথে। কেমন চিপকু কিসিমের! রিকশায় বসে….”

আহি মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“ইয়ু বলতেও চাচ্ছি না।”

“আমার মনে হয় ও জেনে-বুঝে আফিফকে পারসোনাল এসিস্ট্যান্ট বানিয়েছে। ও যখন জানতে পারলো, আফিফ পদ্মের হাসবেন্ড তখন তোকে অন্যদিকে কোণঠাসা করে রাখার জন্য এই কাজ করেছে।”

“ঠিক বলেছিস।”

আহির হঠাৎ মনে পড়লো সে পদ্মকে কল করবে ভেবেছিল। বেল বাজায় সেটা ভুলেই গিয়েছিলো। আহি রাদকে বলল,
“ওপাশ থেকে আমার ফোনটা দে তো! পদ্মকে জানিয়ে দেই।”

পদ্মের নাম শুনে আফিফ ঘুম ঘুম চোখে আহির দিকে তাকালো। বিড়বিড় করে কিছু একটা বলতে লাগলো। আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“কিছু বলবে?”

“হুম।”

“আমি পদ্মকে ফোন করছি।”

“উহুম।”

“কি উহুম!”

রাদ ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“জ্বরের ঘোরে উনি তোকে কি আর বলবে! কিছু জিজ্ঞেস করিস না তো!”

আহি এবার পদ্মের নম্বরে ডায়াল করতে যাবে, তখনই আফিফ কাঁপা কন্ঠে বললো,
“পদ্মকে বলো না প্লিজ।”

আহি কল কেটে দিয়ে বলল, “কেন?”

আফিফ চোখ বন্ধ করে রাখলো। রাদ আহির দিকে তাকিয়ে আছে। আফিফ কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে বলল,
“তোমাকে আমি ঝামেলায় ফেলে দিয়েছি!”

“আরেহ না। আমার জন্যই তো তোমার এই অবস্থা হলো। আর পদ্মকে জানানো আমার দায়িত্ব। ও তোমার ওয়াইফ। পরে কখনো জানলে উলটো বুঝে বসে থাকবে। আমি চাই না পদ্ম আমাকে ভুল বুঝুক।”

আফিফ চুপ করে রইলো। কিছুক্ষণ পর কাঁপা কন্ঠে বলল,
“আমি এই মুহূর্তে এক্সপ্লেইন করতে চাচ্ছি না। একটা রিকুয়েস্ট। পদ্মকে কিছু বলো না।”

রাদ আহিকে ইশারায় ফোনটা রেখে দিতে বললো। আহি ফোন রেখে আফিফের দিকে তাকিয়ে আছে। রাদ বলল,
“এক্স-রে কয়টাই?”

“চারটায় সময় দিয়েছিল। ভাবছি আজ এখানেই থাকি। বাসায় কি বলবো বুঝতে পারছি না। মিসেস লাবণি তো সারাক্ষণ ফণা তোলে বসে থাকে।”

রাদ হেসে বলল,
“তোর লাইফের ট্রাজেডি দেখে একটা ফিল্ম বানাতে ইচ্ছে করছে।”

“বানিয়ে ফেল, দেখবি ফ্লপ হবে। এতো প্যারা নিয়ে কে বাঁচে ভাই? যারা মুভিটা দেখতে আসবে তাদের নাকের পানি, চোখের পানি মোছা টিস্যু পেপারে সিনেমা হল ভর্তি হয়ে যাবে।”

“তোর আজ পর্যন্ত ক’টা টিস্যু বক্স শেষ হয়েছে?”

“ধুর এতো ঢং করে কাঁদি না আমি। ওড়না আর হাত দিয়ে কাজ চালিয়ে ফেলি।”

রাদ হাসলো। হাসতে হাসতে মেঝেতে বসে পড়লো। আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“তুই কাউকে বলিস না আবার।”

“তেলাপোকাটা… আই মিন আফিফ শুনছে না।”

আহি আফিফের দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে বলল,
“না, ঘুমিয়ে গেছে হয়তো।”

রাদ হেসে বলল,
“পুষ্পকে বলবো অন্তত তোর কাছ থেকে যাতে ওড়না ধার না নেয়। আর তোর হাতে বানানো কিছুই খাওয়া যাবে না।”

আহি মুখ ফুলিয়ে রাদের দিকে বালিশ ছুঁড়ে দিয়ে বলল,
“হ্যান্ডওয়াশ বলেও কিছু একটা আছে। আর শোন, মানুষ ইমোশনাল হলে টিস্যু হাতে নিয়ে বসে থাকে না। আমার প্যারাগুলো খেয়ে দেখিস, টিস্যু কোথায় সেটা দেখার সময় পাবি না, তখন পৃথিবীটাই অন্ধকার লাগবে।”

রাদ চুপ করে রইল। আহির চোখে অশ্রু টলমল করছে। রাদ আহির পাশে বসে বলল,
“সরি, মজা করছিলাম।”

“রাদ প্লিজ, আমি অনেক ঝামেলায় আছি। আমার ফিউচার এমন এক জায়গায় এসে আটকে গেছে, যেখানে আমি কোনো কূল-কিনারা পাচ্ছি না। সেখানে এসব পরিহাস, আমার জন্য অনেক কষ্টের।”

রাদ মাথা নিচু করে বসে রইলো। আহি রাদকে হালকা ধাক্কা দিতেই রাদ উঠে চলে গেলো। আহি অবাক দৃষ্টিতে রাদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো।

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৩৯||

৭৮।
শূণ্য দৃষ্টিতে নভোমণ্ডলের কোমলরূপ দেখছে রাদ। আহি বারান্দায় এসেই রাদের পাশে এসে দাঁড়ালো। রাদ আহির দিকে না তাকিয়েই বলল,
“তোর কষ্ট হলে আমারও কষ্ট হয়।”

আহি রাদের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“তোর কথায় আমি কষ্ট পাই নি, রাদ। তুই আমার মেডিসিন। মেডিসিন রোগ সারায়, রোগ বাড়ায় না।”

“একটা কথা বলি তোকে?”

“বল না। ”

“যখন তোর বিয়ে হয়ে যাবে, তখন কি আমার আর প্রয়োজন হবে না?”

আহি রাদের চোখের দিকে তাকালো। রাদ বলল,
“এখন আমারই মনে হচ্ছে, তুই আমার ভালো থাকার মেডিসিন।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। রাদের হাত ধরে বলল,
“কি হয়েছে তোর?”

রাদ বিরক্তির সুরে বলল,
“তোকে আমি তাজওয়ারের সাথে সহ্য করতে পারি না, আহি।”

“জানি আমি।”

“আহি, তুই যেভাবে বুঝেছিস ওটা না।”

“তাহলে কি? আচ্ছা, বস তুই। আমাকে খুলে বল, কি হয়েছে।”

“আমি তোকে হারাতে চাই না, ব্যস।”

“আমি তোকে ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি না।”

“আহি, আমি ওটা মিন করি নি।”

“তো!”

রাদ আহির চোখের দিকে তাকালো। আহি কিছুক্ষণ রাদের দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল,
“আচ্ছা, তোকে এখন কিছু বলতে হবে না। তুই এই মুহূর্তে টায়ার্ড। বিশ্রাম কর। ইফতারের পর ঠান্ডা মেজাজে কথা বলবো। এখন ভেতরে চল।”

“তুই যা, আমি আসছি।”

আহি চলে যেতেই রাদ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। বুকে হাত রেখে চোখ বন্ধ করে বলল,
“আজ যা হওয়ার হোক, আমি তোকে আমার মনের কথা জানিয়ে দেবোই। সহ্য হচ্ছে না আর আহি। আমি কখনোই এতো চাপা স্বভাবের ছিলাম না। কিন্তু তোর ভালোর জন্য আমার মনের কথা এতোদিন আড়াল করে রেখেছি। এখন আর পারছি না আমি।”

এদিকে আহি রাদের অদ্ভুত আচরণের কারণ খোঁজার চেষ্টা করছে। আহির মনে হাজারও প্রশ্ন!
“রাদ কি আমার জন্য বিরক্তবোধ করছে? বার-বার আমার সব সমস্যার সমাধানে ওকে জড়াচ্ছি, তাই? না-কি তাজওয়ারের সাথে বিয়ে হবে ভেবে উদ্বিগ্ন? না-কি রাদ আমাকে অন্য দৃষ্টিতে দেখছে! না, না, না। কি ভাবছি আমি?”

আহি নিজের মাথায় ঠোকা মেরে বিড়বিড় করে বলল,
“এভাবে কেন ভাবছি আমি? রাদ শুনলে আমার উপরই কৌতূক করবে।”

আহি আফিফের পাশে বসে তার কপালে হাত রাখলো। আফিফ নিভু নিভু দৃষ্টিতে আহির দিকে তাকালো। আহি হাত সরিয়ে নিতেই আফিফ তার হাত ধরলো। আহি কিছুটা অবাক হলো। আফিফ কাঁপা কন্ঠে বললো,
“পদ্মফুল, তুমি অনেক ভালো। কে বলেছে তুমি অলুক্ষণে? তোমার কোনো দোষ নেই। সব আমার দোষ। আমি অপরাধী। আমি সবাইকে কষ্ট দিয়েছি। তুমি, আপা, রেনু, মা আর আহি….”

রাদ রুমে ঢুকেই দেখলো আফিফ আহির হাত ধরে রেখেছে। রাদকে দেখে আহি বলল,
“আফিফ জ্বরের ঘোরে আমাকে পদ্ম ভাবছে।”

আফিফ মিনমিনিয়ে বলল, “পদ্ম, সরি।”

রাদ আহিকে সরিয়ে আফিফের পাশে বসে বলল,
“তুই যা। রেস্ট কর। নানুকে দেখছি রান্নাঘরে কি যেন করছে। গিয়ে হ্যাল্প কর। আমি উনার খেয়াল রাখবো, সমস্যা হবে না আমার।”

আহি মাথা নেড়ে চলে গেলো। আফিফ এখনো প্রলাপ বকছে। রাদ ভ্রূ কুঁচকে আফিফের দিকে তাকিয়ে আছে। আফিফ বলতে লাগলো,
“আমি কি ছিলাম! আমাকে কি বানিয়ে দিয়েছে।”

রাদ এবার ভ্রূ কুঁচকে আফিফের দিকে তাকালো। সে আফিফের কাছাকাছি গিয়ে তার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করছে। আফিফ বলতে লাগলো,
“পদ্ম, তুমি আমার সাথে রাগ করোনা। সব দোষ আমার। আমি যদি একবার জানতাম আমার খেয়াল, আমার কল্পনা আমার বর্তমানে আসবে, আমি কখনোই তোমার হাত ধরতাম না। আমি তোমার অজান্তে তোমাকে কষ্ট দিচ্ছি, আমি আহিকে কষ্ট দিচ্ছি।”

রাদ সোজা হয়ে বসলো। কিছুক্ষণ স্থির হয়ে আফিফের দিকে তাকিয়ে উঠে রুমের দরজা লাগিয়ে দিলো। দরজা লাগিয়ে আবার আফিফের পাশে বসে বলল,
“পদ্মের সাথে কি করেছেন? কীভাবে কষ্ট দিলেন ওকে? আপনি সবচেয়ে বেশি আহিকে কষ্ট দিয়েছেন। আপনার জন্য আহি রাত-দিন কেঁদেছে। আর আপনার মনে এতো সহজে পদ্ম জায়গা করে নিলো।”

আফিফ চুপ করে রইলো। রাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কে তুমি? পদ্ম কোথায়?”

“পদ্ম আমার পাশেই আছে। বলুন না কি করেছেন আপনি? আহিকে কেন কষ্ট দিয়েছিলেন?”

আফিফ ভেজা কন্ঠে বলল,
“ইচ্ছে করে দেই নি আমি। আমারই তো অনেক কষ্ট হয়েছে। ভীষণ কষ্ট পেয়েছি আমি।”

রাদ তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“আপনি কষ্ট পেয়েছেন!”

“তাজওয়ার খান… আমার সব কেঁড়ে নিয়েছে। আহিকে বাঁচাতে হবে। আমি তো পারবো না। আমি একদম অসহায়? আমি অপদার্থ। আমি আমার আপাকেই বাঁচাতে পারি নি।”

“কি হয়েছে আপার সাথে?”

“আপা…!”

“হ্যাঁ বলুন না।”

“তাজওয়ার খান আমার আপাকে খুন করেছে। আমার আপাকে মেরে ফেলেছে ওরা। ওরা রেনুকেও মেরে ফেলবে। তখন আমি কি করবো?”

রাদ স্তব্ধ হয়ে গেলো আফিফের কথা শুনে। আফিফ বার-বার সেই একটি বাক্যই আওড়াতে লাগলো। তার চোখ বেয়েও অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। রাদ টিস্যু দিয়ে তার চোখ মুছে দিয়ে বলল,
“কেন খুন করেছে তাজওয়ার!”

“জানি না, আমার কি দোষ ছিল! আমার কিছু করতে পারি নি। আপাকে বাঁচাতে পারি নি আমি।”

আফিফ বিড়বিড় করতে করতে ঘুমিয়ে গেলো। রাদ থম মেরে বসে আছে। তার মনে হাজারও প্রশ্ন। আর এই প্রশ্নগুলোর উত্তর একমাত্র আফিফই দিতে পারবে।

(***)

ইফতারির পর আহি লাবণিকে ফোন করে জানালো, সে পুষ্পের বাসায় থাকবে। পুষ্পকে আগে থেকেই শিখিয়ে দিয়েছে সব। এরপর আহি লাবণির সাথে কথা বলে একবার আফিফকে দেখে এলো। আফিফের এখন জ্বর নেই। সে ঘুমাচ্ছে। রাদ তার পাশেই শুয়ে আছে। রাদ বলেছিল আহির সাথে কথা বলবে। তাই আহি রাদের পাশে বসে তাকে ডাকলো। রাদ সাড়া দেয় নি। আহি ভাবলো, রাদ ঘুমিয়ে গেছে। তাই আর বিরক্ত না করে বাতি নিভিয়ে দিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো। এরপর সে সালমা ফাওজিয়ার রুমে এসে শুয়ে পড়লো।

এদিকে আহি চলে যেতেই রাদ উঠে বসলো। এই অস্থিরতা নিয়ে ঘুম হবে না তার। সে এতো বছর আহির অংশটাই শুনে এসেছে। আজ তাকে জানতেই হবে আফিফের অংশটা। কেন আফিফ আহিকে ছেড়ে এসেছিল? রাদ বাতি জ্বালিয়ে আফিফের সামনে এসে বসলো। আফিফ ঘুম। তার ইচ্ছে করছে আফিফকে উঠিয়ে দিতে। কিন্তু অসুস্থ মানুষকে এভাবে ডেকে উঠানো ভালো হবে না। তাই রাদ আফিফের ঘুম ভাঙার অপেক্ষায় আছে।

(***)

রাদকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। আফিফ নড়েচড়ে উঠতেই রাদ বলল,
“এখন কেমন লাগছে আপনার?”

আফিফ পুরুষালি কন্ঠ শুনে চোখ খুললো। রাদকে দেখে একনজর আশেপাশে চোখ বোলালো। রাদ বলল,
“আপনি আহির মায়ের বাসায়। আমি আপনাকে দেখতে এসেছি।”

আফিফ উঠে বসলো। রাদ বলল,
“আপনার জ্বর বেশি ছিল, তাই এক্স-রে করাতে পারি নি। এখন কেমন লাগছে?”

“ভালো।”

“সরি, কিন্তু আপনাকে এই মুহূর্তে আমি অদ্ভুত একটা প্রশ্ন করবো। যদিও এই প্রশ্নটা এই সময়ে করা উপযুক্ত না। কিন্তু আমার কৌতূহল আমি আটকে রাখতে পারছি না।”

আফিফ ভ্রূ কুঁচকে রাদের দিকে তাকালো। রাদ বলল,
“তাজওয়ার খান আপনার আপাকে কেন খুন করেছিল? আহিকে আপনি কেন কষ্ট দিয়েছিলেন?”

আফিফ অবাক হয়ে রাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোমাকে এসব কে বলেছে?”

“আপনি নিজেই জ্বরের ঘোরে এসব বলেছেন।”

আফিফ চুপ করে রইলো। চিন্তায় কপালে ভাঁজ পড়লো তার। রাদ বলল,
“প্লিজ, কি হয়েছিল বলুন!”

“এসব জেনে লাভ নেই। আমি এসব বলতে চাচ্ছি না।”

“প্লিজ, আমি কাউকে এই বিষয়ে জানাবো না। অন্তত আমাকে বলবেন প্লিজ। আহির সাথে সংশ্লিষ্ট সবকিছু আমার জানতে হবে। কারণ….”

আফিফ রাদকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“জানি, তুমি আহিকে ভালোবাসো।”

রাদ চুপ হয়ে গেলো। আফিফ বলল,
“ভালোবাসা সুন্দর। কিন্তু ত্যাগ মানেই যন্ত্রণা আর জেদ তেমনিই ভয়ংকর। আমার জীবনে এই কয়েকটা শব্দ আমার অগোচরেই এসেছে। আর আমাকে না জানিয়ে আমার সব কেঁড়ে নিয়ে গেছে।”

(***)

আফিফ থেমে রাদের দিকে তাকালো। ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“আহি জানেই না, ওর ভালোবাসা আমাকে কি দিয়ে গেছে। আমি যদি ওকে জানিয়ে দেই, ও অনেক কষ্ট পাবে। আর আমি ওকে কষ্ট দিতে চাই না।”

রাদ বলল, “কি হয়েছিল?”

আফিফ আজ আবার অতীতের ফেলে আসা অংশটা পুনরায় স্মরণ করলো।

“গ্রামেই বড় হয়েছি আমি। স্কুল-কলেজ ওখানেই শেষ করেছি। পড়াশুনায় ওতো আগ্রহ ছিলো না। ইচ্ছে ছিলো চিত্রশিল্পী হবো। আমার যোগ্যতাও ছিল। বাবা এসব পছন্দ করতেন না। কিন্তু আপা আমাকে খুব সাপোর্ট করতো। সচ্ছল পরিবারেই ছিলাম আমরা। কিন্তু একদিন রোড এক্সিডেন্টে বাবা মারা গেলো। আর এরপর আমার পুরো পৃথিবীটাই উলটপালট গেলো। আমি ছোট ছিলাম। মাকে অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তাই আমার মাও বেশিদূর পড়াশুনা করেন নি। বাবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতো, তাই কোনো পেনশেন ছিল না। ব্যাংকে যে ক’টা টাকা ছিল, সেই টাকায় আমরা শুধু খেতে পারবো। আমার স্কুল বন্ধ। আপা ভাগ্যিস কলেজ পাশ করে ফেলেছিল। এরপর এক চাচার সাহায্যে শহরের মার্কেটে সেলস গার্লের চাকরি নেয়। এরপর আপা আমাকে পড়াশুনা করাবে সিদ্ধান্ত নেয়। এমনও দিন গিয়েছিল আমরা দু’বেলা ভাত খেতে পারিনি। আমরা মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির ছিলাম তাই কারো কাছে হাত পাততে পারি নি। আর আপা সব ঠিক করে দিয়েছিল। গ্রামের সবাই মাকে প্রশ্ন করতো, শহরে গিয়ে আপা কি কাজ করে? মা বলতো দোকানে কাজ করে। আমিও তাই বলতাম। কিন্তু মানুষের চিন্তা-ভাবনা এতো নোংরা ছিল, তারা আমাদের আড়ালেই ফিসফিস করতো। আমি বুঝতাম না। বয়স কম ছিল তাই। কিন্তু মা বুঝতো। আপার উপরই রাগ ঝাড়তো। কাজ ছেড়ে ভিক্ষা করতে বলতো। আপা কাঁদতো। কিন্তু কাজ ছাড়ে নি। এরপর একদিন আপা আমাকে গ্রামের কলেজে ভর্তি করিয়ে শহরে নিয়ে এলো। এখানে এসে চারুশিল্পে ভর্তি করিয়ে দিলো। কারণ আপার স্বপ্ন ছিল, আমার স্বপ্ন পূরণ করা। আমি কলেজে ক্লাস করতাম না। শুধু পরীক্ষা দেওয়ার জন্যই গ্রামে যেতাম। কিন্তু ওখানে মা আর রেনু ভালো ছিল না। গ্রামের মানুষগুলো বাবা জীবিত থাকাবস্থায় যতোটা ভদ্র আচরণ করেছিল, বাবার মৃত্যুর পর ততোটাই খারাপ হয়ে পড়লো। আপা বাধ্য হয়ে আমাদের শহরে নিয়ে আসে। এরপর খরচ আরো বেড়ে যায়। দিন-রাত আপা বাইরে কাজ করতো। দোকানে বসতো, এরপর স্কুলের আয়া হিসেবে কাজ নিয়েছিল। সব করেছে আপা, শুধু আমাদের জন্য। আর একদিন সেই আপাকেই নিজের সম্মান বিক্রি করে দিতে হলো, আমার জন্য।”

আফিফ এতোটুকু বলেই শার্টের হাতায় চোখ মুছলো। রাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আহি আমাকে কখন ভালোবেসেছে আমি জানি না। কেন ভালোবেসেছে আমি জানি না। কি দেখেছে আমার মধ্যে আমি সেটাও জানি না। কিন্তু যখন ও আমাকে চিঠি লিখে জানিয়েছিল, আমি ওকে ফিরিয়ে দেই নি। কারণ আমি ওর প্রতি কখনোই বিরক্ত ছিলাম না। আমি জানতামও না, আহি কে? আমি তো ওকে দেখিই নি। আমি শুধু অনুভব করেছি।”

রাদ ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“আপনি আহিকে ভালোবাসতেন?”

“ভালোবাসতাম কি-না জানি না। ও আমার আঠারো বছর বয়সের অনুভূতি ছিল। আমি তখন কিশোর মাত্র। কিন্তু ভালো লাগতো সেই চিঠিগুলো। আমি সবগুলো চিঠি যত্ন করে রেখে দিতাম। হয়তো ভালোবাসতাম। আমি জানি না, অনুভূতিটা কেমন ছিল। কিন্তু কখনো আহির মতো করে আহিকে ভালোবাসি নি।”

“আহিকে পছন্দ করলে, ওকে ফিরিয়ে দেওয়ার কারণ!”

“অনেক বড় কারণ। ছোটখাটো বিষয় না। আহির ভালোবাসা আমার পুরো জীবনটাই এলোমেলো করে দিয়েছিল। তাজওয়ার আহিকে অনেক আগে থেকেই পছন্দ করতো। ও আহিকে ফলো করতো। আমি জানি না, ও কি দেখেছিল। কিন্তু ও আপাকে বলেছিল, আহি যেই পরিমাণ আমাকে ভালোবাসে, সেই পরিমাণ ঘৃণা আমার কাছ থেকে পাবে।”

“মানে?”

“একদিন আপা কাজ থেকে ফিরে এসে আমাকে বলেছিল-”

-আফিফ, তোর সাথে আমার জরুরি কথা আছে।

-হ্যাঁ বলো আপা।

-চারুশিল্পে কি কোনো মেয়ে আছে, যে তোকে পছন্দ করে?

আফিফ রাদকে বলল,
“আমি আপাকে চিঠিগুলোর কথা বলতে চাই নি। তাই মিথ্যে বলেছিলাম সেদিন। বলেছিলাম-”

-না আপা।

-দেখ, মেয়েটার কাছ থেকে দূরত্ব রাখবি। যে মেয়েটা তোকে চিঠি দেয়, সেই মেয়েটাকে এখানকার প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর ছেলে পছন্দ করে। ছেলেটা না-কি প্রতিদিন মেয়েটাকে ফলো করে। তোকেও দেখেছে। কি দেখেছে আমি জানি না। আমার মালিক বললো আমাকে। ওই ব্যবসায়ীর ছেলে হুমকি দিয়েছে, যেই মেয়েটা তোকে পছন্দ করে, তার পছন্দের মাত্রা যতো বেশি হবে, সে তোর কাছ থেকে ততোটুকু ঘৃণা ফের‍ত পাবে।

-মানে?

-মানে আমি জানি না। তুই শুধু মেয়েটার সাথে কথা বলিস না।

আফিফ আবার রাদের দিকে তাকালো আর বলল,
“এর মানে কি ছিল, তা আমি সেদিন একটুও বুঝি নি। আবেগের বয়স ছিল। তখনও না করি নি আহিকে। উলটো তাকে আমার দেখার আগ্রহ জন্মালো। আমি জানতে চাইছিলাম চিঠির মেয়েটা আসলে কে? আহিকে আমি দেখেছি, কিন্তু জানতেই পারি নি, আহি আসলে সেই মেয়েটা। মা ভীষণ পছন্দ করতো আহিকে। মায়ের হয়তো আহির চেহারা এখন আর মনেই নেই। আমার একবার এক্সিডেন্ট হয়েছিল। আহির মা আমার চিকিৎসা বাবদ খরচ দিয়েছিলেন। তখন আহি রোজ মাকে ফোন করতো। আমার খোঁজ নিতো। মায়ের কাছেই শুনেছিলাম এসব। এজন্য আমার আর পদ্মের বিয়েতে মা তেমন একটা খুশি ছিল না। মায়ের মনে হয়েছিল, সেই ফোনে কথা বলা মেয়েটিই আমার জন্য বেস্ট হবে। পদ্ম এখনও এসব জানে না। সে জানে না, মা আমাদের বিয়েতে রাজি ছিল না। আমার যখন এক্সিডেন্ট হয়েছিল তখন আপা বেঁচে ছিল না। আমি তখনও জানতাম না আপা কেন এতো বড় স্টেপ নিয়েছিল।”

রাদ জিজ্ঞেস করলো,
“উনি আত্মহত্যা করেছিলেন?”

“হুম।”

“তাহলে খুন করেছে কেন বললেন?”

“কারণ জানতাম না আত্মহত্যার মূল কারণ কে!”

“কে!”

“আপা একজনকে ভালোবাসতো। জানি না ছেলেটা কে। শুনেছি দোকানের মালিক। অনেকে বলে আপার সাথেই দোকানে বসতো। অনেকে বলে গ্রামে আপার এক প্রেমিক ছিল সে। আসলে আপা একজনকে ভালোবাসতো এটা সত্য। ফোনে কথা বলতো। এমন অনেক কিছুই খেয়াল করেছিলাম আমি। আমি এখনো জানি না সে কে। এতোটুকু জেনেছি, সে আমার আপার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল।”

আফিফ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“আপার সাথে দেখা করার বাহানায় কিছু ব্যক্তিগত ভিডিও ধারণ করেছিল। আমি ভিডিও দেখি নি। মা দেখেছিল। আমি তখন জানতাম না, আপার কোনো অপরাধ ছিল কি-না। এদিকে ভিডিওটা সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ার পর মা অনেক ভেঙে পড়েছিল। আমি এসব জানার আগেই আপাকে দেখেছিলাম। আপা আমার মুখোমুখি দাঁড়াতে চায় নি। সেদিন রাতেই আত্মহত্যা করে ফেললো। আমি আবার এতিম হয়ে গেলাম। আপার মৃত্যুর পর বুঝলাম, আসলে কি হয়েছিল। যেই নম্বর থেকে এসব ভিডিও ছাড়া হয়েছিল, তাকে খুঁজে বের করার জন্য টাকা জোগাড় করতে ব্যস্ত ছিলাম আমি। যাতে অন্তত ভিডিওগুলা ডিলিট করে দেয়। এরপর অনেকদিন কেটে গেলো। একদিন সেই মানুষটা আমার সামনে এলো, যে আমার জীবনটা এলোমেলো করে দিয়েছিলো।”

“তাজওয়ার খান?”

“হুম। তাজওয়ার নিজেই সব স্বীকার করেছে। বললো, আহিকে পাওয়ার জন্যই এমন করেছে। আহি আমাকে ভালোবাসে এটাই আমার অপরাধ ছিল। এরপর আমাকে হুমকি দিয়ে বলল, আমি যদি এখনই আহিকে নিয়ে ভাবা বন্ধ না করি, আহিকে সুযোগ দেই, একই কাজ সে রেনুর সাথে ঘটাবে। আমি দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম। এসব পরিস্থিতি সামলানোর জন্য আমার বয়স খুব কম ছিল। নিজেকে বোকা মনে হচ্ছিলো তখন। ভাবছিলাম, কি করলাম আমি? একটা কল্পনার জন্য আমার আপাকে মরে যেতে হলো? আমি রেনুর বড় ভাই। ওর দায়িত্ব আমার। কিন্তু তাজওয়ার বেশ চালাক। সে নিয়াজীর জন্য প্রস্তাব নিয়ে বাড়ি চলে গেলো। মাও রাজি হয়ে গেলো। আমাকে সারাজীবনের জন্য নিজের হাতের মুঠোয় আবদ্ধ করার তার এই একটাই পথ খোলা ছিল, রেনু আর নিয়াজীর বিয়ে। বিয়েটা হয়েও গেলো। এটাও আমি পরে জানতে পারলাম যে তাজওয়ারই নিয়াজীকে বলেছিল রেনুকে বিয়ে করার জন্য। আর এরপর আহিকে না করা ছাড়া আমার কোনো উপায় ছিল না। আমি ভেবেছি ও আমাকে ভুলে যাবে। কিন্তু ভুলে নি। এরপর যেদিন আহিকে সামনা-সামনি দেখলাম, সেদিন পদ্ম আর আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। আমি যদি জানতাম তারা দু’জন বান্ধবী, আমি পদ্মকে বিয়ে করতাম না। পদ্ম অনেক ভালো একটা মেয়ে। আমি ওকে কষ্ট দিতে চাই না। আমি পদ্মকে ভীষণ ভালোবাসি। অতীত সবার জীবনে থাকে। আহি আমার ফেলে আসা অতীত। পদ্ম আমার বর্তমান। দু’জনই ভালো। হয়তো তাদের ভাগ্য খারাপ। কারণ আমি তাদের জীবনে এসেছিলাম।”

রাদ আফিফের দিকে তাকিয়ে আছে। কি বলবে সে বুঝতে পারছে না। এতোদিন সে আফিফের প্রতি ক্ষুব্ধ ছিল। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে, এই মানুষটাই সবচেয়ে বেশি অসহায়।

চলবে-

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে