#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৩২||
৬৩।
হেমন্তের অমত্ত সমীরণ বাতায়ন গলে ঘরে প্রবেশ করছে। ঘরের পর্দাগুলো সেই সমীরণের তালে দুলছে। মনে হচ্ছে ঘরে উপস্থিত মানুষটির অনুভূতির ঢেউ এদের নাড়িয়ে দিচ্ছে৷ উজ্জ্বল চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে। তার দৃষ্টি টেবিলের উপর রাখা স্থির চিত্রটির দিকে। ঠোঁটে তার মৃদু হাসি। চিত্রটির একটা নামকরণ প্রয়োজন। উজ্জ্বল তার চোখ দু’টি বন্ধ করে মনে মনে দু’টো শব্দ আওড়ালো। এরপর চোখ খুলে চিত্রটির দিকে ঝুঁকে বলল,
“হিয়ার পীড়ন।”
উজ্জ্বলের বন্ধু রইস সেই মুহূর্তে তার ঘরে এসে বলল,
“কি রে উজি, তোকে যখনই ফ্রি দেখি তোর সামনে এই ছবিটা থাকবেই। কি আছে এই ছবিতে?”
উজ্জ্বল মুচকি হেসে বলল,
“একটা মেয়ের অনভূতি। বেশ চমৎকার এই অনুভূতিটা! এমনই একজন মেয়েকে কে না চায়!”
“কি আবোল-তাবোল বকছিস? তোর মস্তিষ্কের বিরুদ্ধে মামলা করতে হবে৷ তুই তো আমাকেই পাগল করে দিচ্ছিস।”
উজ্জ্বল আবার হাসলো। রইস উজ্জ্বলের পাশে বসে বলল,
“কি হয়েছে বলবি?”
উজ্জ্বল ছবিটির দিকে তাকিয়ে বলল,
“পুষ্পের ফ্রেন্ড আহি, মনে আছে?”
“হুম।”
“এই ছবিটা সে এঁকেছিল।”
“তো!”
উজ্জ্বল ছবিটির দিকে ঝুঁকে বসে বলল,
“মেয়েটার মনে অনেক কষ্ট। আমি তাকে ছবি আঁকতে বলেছিলাম। আর সে এটাই এঁকেছে। কালো রঙ ব্যবহার করে এই ছবি এঁকেছে। বুঝা যাচ্ছে, তার মন অন্ধকারে ঢাকা পড়ে গেছে। ছবির মেয়েটির চোখ দু’টি কেমন ঘোলাটে, দেখ। মনে হচ্ছে কাঁদতে কাঁদতে চোখ শুকিয়ে গেছে। সেই চোখে এখন খরা। নৌকাটি দেখ, কেমন দুলছে। অথচ নদীতে তরঙ্গ, ঢেউ কিছুই নেই। আমি এর একটা অর্থ দাঁড় করিয়েছি।”
“কি অর্থ?”
“মেয়েটার জীবনে সবকিছুই ভাসা ভাসা। কোনোকিছুতেই সে স্থির হতে পারছে না। এরপর দেখ, তীরে দাঁড়ানো একটা অবয়ব। ভালোভাবে দেখলে বোঝা যাবে, এটা একটা ছেলের অবয়ব। এর অর্থ, আহির জীবনে একটা ছেলের বেশ প্রভাব আছে। এই ছবিতে ছেলেটি নদীর তীরে ভেসে থাকা একটা ফুল তুলছে।”
“এর অর্থ কি!”
“উহুম, বুঝতে পারছি না। হয়তো সে অন্য কাউকে ভালোবাসে। আহিকে না।”
রইস ভাবলেশহীন সুরে বলল, “তো!”
উজ্জ্বল হতাশ কন্ঠে বলল,
“মেয়েটা ভীষণ কষ্টে আছে।”
“এখন তুই করতে চাচ্ছিস?”
“আহির সাথে আবার দেখা করতে ইচ্ছে করছে। তাই এবারের ছুটিতে আমি ইন্ডিয়া যাচ্ছি না। চট্টগ্রাম যাবো ভাবছি।”
রইস চমকে উঠে বলল,
“সিরিয়াসলি! আমরা সব বন্ধুরা মিলে প্ল্যান করে ফেলেছি।”
“তোরা যা। এই মুহূর্তে আমার মন যেখানে আটকে আছে, আমার তো তারই সমাধান করতে হবে।”
“প্রেমে পড়ে যাস নি তো আবার!”
উজ্জ্বল হেসে বলল,
“আপতত তো না। তবে আরেকটু বেশি জেনে গেলে হয়তো সম্ভাবনা আছে।”
“এবার কিন্তু সোজা বিয়ের প্রস্তাব দিবি। নয়তো আগের বারের মতো প্রেম করতে করতে প্রেমিকা বিয়ে করে শ্বশুড় বাড়ি চলে যাবে।”
উজ্জ্বল মুচকি হাসলো। বলল,
“আফসোস থাকবে না। এমন প্রেমিকা হারিয়ে গেলেও ভালো লাগে।”
“কীভাবে?”
“কারণ এদের ঘৃণা করা যায় না। এদের ভেবে ভেবেই চমৎকার মুহূর্ত কাটানো যায়। এরা বাস্তবেও সুন্দর। কল্পনাতেও।”
রইস উজ্জ্বলের পিঠে চাপড় মেরে বলল,
“বেশ ভালোভাবেই আহির মায়ায় ডুবেছিস, বুঝা যাচ্ছে।”
(***)
সাইকেল নিয়ে ক্যাম্পাসে আসছে পুষ্প। লাবীব সেই মুহূর্তে ক্যাম্পাসের গেটের সামনে তার মোটরসাইকেল থামালো। হেলমেট খুলে ভ্রূ কুঁচকে সে পুষ্পের দিকে তাকিয়ে রইলো। পুষ্পও সামনে তাকাতে লাবীবকে দেখে তার দিকে তাকালো। লাবীবের চাহনি দেখে কিছুটা অবাক হলো সে। লাবীব তার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে আছে। পুষ্পের সম্পূর্ণ মনোযোগ লাবীবের দিকে তাকায়, সে খেয়াল করে নি তার সাইকেলের সামনের চাকাটি আঁকাবাঁকা ইটের রাস্তার গর্তে আটকে গেছে। আর মুহূর্তেই পুষ্প ভারসাম্য হারিয়ে উলটে পড়লো রাস্তায়। লাবীব তা দেখে অট্টহাসি দিয়ে উঠলো। আহি গেটের কাছেই দাঁড়ানো ছিল। পুষ্পের এই অবস্থা দেখে সে দৌঁড়ে তার কাছে এলো। এদিকে লাবীব হাসতে হাসতে পুষ্পের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
“যে কাজ পারো না, সেটা করো কেন?”
পুষ্প মুখ ফুলিয়ে লাবীবের দিকে তাকালো। আহি বিরক্তির সুরে বলল,
“দেখছিস না ও ব্যথা পেয়েছে?”
আহির হাত ধরে পুষ্প উঠে দাঁড়ালো। এরপর সে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নিলো। কয়েকজন এখনো ঘুরে ঘুরে তাকে দেখছে। লজ্জায় পুষ্পের চোখ ছলছল করে উঠলো। আহি তার সাইকেল উঠিয়ে বলল,
“কি রে, মন খারাপ করছিস কেন? এটা জাস্ট এক্সিডেন্ট।”
পুষ্প চুপ করে রইলো। লাবীব পুষ্পের কাছে এসে নরম সুরে বলল,
“কাঁদছো কেন?”
পুষ্প মুখ ভ্যাংচে বললো, “কাঁদছি না আমি।”
লাবীব পুষ্পের হাত ধরতেই পুষ্প চকিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো। আর পুষ্পের ভেজা চোখ দু’টি সাথে সাথেই লাবীবের বুকখানা দগ্ধ করে দিয়ে গেলো। লাবীব বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আহি পুষ্পের সাইকেল একপাশে রেখে তালা লাগিয়ে চাবিটা পুষ্পের হাতে দিয়ে বলল,
“ব্যথা পেয়েছিস তুই। চল, তোকে মেডিকেল রুমে নিয়ে যাই।”
লাবীব বলল,
“আহি তুই ক্লাসে যা। আমি নিয়ে যাচ্ছি।”
আহি ‘ঠিক আছে’ বলে চলে গেলো। এরপর লাবীব পুষ্পকে মেডিকেল রুমে নিয়ে গেলো। পুষ্পের কনুইয়ে নিজ হাতে ওষুধ লাগিয়ে দিলো। পুষ্প তা দেখে বলল,
“হেসেছো, আবার মলম লাগাচ্ছো!”
“সরি।”
পুষ্প জোরে শ্বাস ছাড়লো। লাবীব পুষ্পের দিকে ঝুঁকে বলল,
“আমি তো বলেছিই, আমার বাইক পার্টনার হও। রোজ তোমাকে নামিয়ে দেবো, নিয়ে আসবো।”
“প্রতিদিন এই দায়িত্ব নেওয়ার মতো কি তোমার অধিকার আছে?”
“যদি দাও, নিয়ে নেবো।”
“কিন্তু তুমি তো অন্য কাউকে ভালোবাসো।”
লাবীব ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“ভালোবাসলেই কি শুধু অধিকার দিতে হয়।”
পুষ্প অভিমানী সুরে বলল,
“লাগবে না আমার এসব আদিখ্যেতা।”
লাবীব পুষ্পের হাত ধরে বলল,
“মেয়েটা যদি তুমি হও, তাহলে কি এই আদিখ্যেতা তোমার ভালো লাগবে?”
পুষ্প লাবীবের দিকে তাকিয়ে বলল, “হুম।”
লাবীব বলল,
“তাহলে ভালো সময় আসুক। আমার আবার সবকিছু একটু ঝাঁকানাঁকা হতে হয়।”
“কখন ঝাঁকানাঁকা হবে?”
“বলে দিলে তো ঝাঁকুনি খেতে পারবে না।”
পুষ্প লাজুক হাসলো। লাবীব পুষ্পের চশমা নিয়ে নিজের শার্টের কোণায় তা মুছে পুষ্পের চোখে বসিয়ে দিয়ে বলল,
“চলো চশমিশ। ক্লাস শেষে আবার দেখা হবে।”
এদিকে পুষ্পের ফোনে উজ্জ্বলের কল এলো। সে রিসিভ করতেই উজ্জ্বল বলল,
“ছুটিতে তোদের বাসায় আসছি।”
পুষ্প উৎসুক কন্ঠে বলল, “ওয়াও, সত্যি!”
“মিথ্যা গল্প বলার জন্য তোকে কখনও ফোন দিয়েছিলাম?”
“হুম, যাক, ভালোই হবে। তোর অপেক্ষায় থাকলাম।”
“শোন, তোর ওই ফ্রেন্ডটার কি অবস্থা!”
“কার কথা বলছিস?”
“আহি!”
পুষ্প হেসে বলল,
“তুই তো আমার বান্ধবীকে বেশ ভালোভাবেই মনে রেখে দিয়েছিস।”
“এতো ন্যাকামি করছিস কেন? সোজাসুজি বল না।”
“আরেহ আছে তো ও। ভালো আছে।”
উজ্জ্বল হেসে বলল,
“আচ্ছা, রাখছি। ট্রেনে উঠবো রাতে।”
“আচ্ছা।”
(***)
সন্ধ্যায় ছবি আঁকা শেষ করলো আহি। এখন প্রায় প্রতিদিনই সে সন্ধ্যায় ছবি আঁকতে বসে। এক ঘন্টা এঁকে উঠে যায়। আজ এঁকেছে একটা বাড়ির করিডরের চিত্র। পুরো করিডোরটি বিভিন্ন রঙের সংমিশ্রণে আলোকিত করেছে। দেয়ালে মিষ্টি গোলাপী রঙ। মেঝের টাইলসটি সেঞ্চুরি পাতার। মাঝখানে একটি গোলাপী বর্ণের লাগেজ রাখা। ছবি আঁকা শেষে ক্যানভাসের নিচে একটা চিরকুট আঠা দিয়ে লাগিয়ে দিলো আহি। সেটিতে লেখা,
“লাগেজে ভরা স্বপ্নগুলো কি এই চাকচিক্যময় আবদ্ধ ক্ষেত্রফলেই আঁটকে থাকবে?”
এরপর আহি ক্যানভাসটি ইজেল থেকে নামিয়ে একপাশে রেখে দিলো। এরপর হাত ধুয়ে এসে ডায়েরির পাতা উল্টালো। লিখলো,
“সেদিনের পর কেটে গেছে দুই সপ্তাহ। ভীষণ জেদ উঠেছে আমার। ঘৃণা শব্দটা নিতে পারি নি আমি। তাই পদ্মকে ফোন করে জানা হলো না, কেমন আছো। কিন্তু দেখো, এতোকিছুর পরও প্রতিদিন তোমার স্মরণে ডায়েরীর পাতায় কিছু না কিছু লিখি। কি করবো, আমি যে তোমাকে ভুলতে পারি না। তুমি মানুষটা সূত্রের মতো মস্তিষ্কে গেঁথে গেছো। এই ব্রহ্মাণ্ডে একেক জনের ভালোবাসা একেক রকম। আর আমার কাছে ভালোবাসার অর্থ ভুলে যাওয়া নয়। ভালোবাসা মানে আরো নতুনভাবে ভালোবাসতে পারে। প্রকাশ্যে না হোক, আড়ালে কেন লুকিয়ে থাকবে আমার অনুভূতি? প্রিয় মানুষকে ভীষণভাবে ভালোবাসাতে পারার আসক্তিটা কখনোই ছাড়া যায় না। যে আসক্তি ছাড়তে পারে, যে ভালোবাসাকে গ্রহণ করেছে নিজের স্বার্থের জন্য। আর আমি তো নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসেছি। আমার জীবনে যেই আসুক। আমি তো নিয়তিকে আটকাতে পারবো না। কিন্তু তুমি আমার জীবনে আজীবন প্রদীপের মতো জ্বলবে। এই প্রদীপের তেজ এতো বেশি যে মৃত্যুর পর এই আলোয় আমি তোমাকে খুঁজে নেবো। তখন নিয়তির খেলা শেষ হবে। আমি হয়তো সেদিন তোমাকে আমার করে পাবো।”
৬৪।
আজ ক্যাম্পাসে চলছে কার্তিক উৎসব। এই উৎসবে পুরো ক্যাম্পাসের সব ডিপার্টমেন্ট মিলে মেলার আয়োজন করে। আজ আহি ক্যাম্পাসে এসেছে কমলা রঙের শাড়ি পরে। গলায় ঝুলিয়েছে কাঠের তৈরী মালা। খোঁপায় গেঁথে দিয়েছে ছোট ছোট কাঠগোলাপ। হাতে একগুচ্ছ হলুদ কাচের চুড়ি পরেছে, কপালে লাগিয়েছে হলুদ টিপ। আজ বেশ মানানসই লাগছে আহিকে।
এদিকে ক্যাম্পাসে ঢুকতেই রাদ আর আহির দেখা হলো। রাদ আহিকে দেখে সেকেন্ড খানিকের জন্য থমকে গিয়েছিল। এরপর আহি রাদের কাছে আসতেই রাদ নিজের বুকে হাত রেখে বলল,
“মেরে ফেলবি না-কি আমাকে!”
আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“আমি আবার কি করলাম!”
“বেশি সুন্দর লাগছে তোকে।”
আহি শাড়ি আঁচল নাড়িয়ে বলল,
“আমি তো সুন্দরী, সুন্দর তো লাগবেই।”
(***)
আজ আহি ব্যাগ ভর্তি টাকা এনেছে শুধু খাওয়া-দাওয়া করার জন্য। জিনিসপত্রের তুলনায় মেলায় খাবারের চড়া দাম। কারণ ক্যাম্পাসে বাইরেও অতিথি আসে। আর সবার আগ্রহ খাবারের প্রতিই বেশি। এদিকে আহি পিঠার স্টলে গিয়ে একটা প্লাস্টিকের প্লেট নিয়ে সেখানে দুইটা ভাপা পিঠা, একটা পাটিসাপটা, একটা পাকন পিঠা, তিনটা নারকেল নাড়ু, দুইটা সুজির চমচম, চারটা গাজরের হালুয়া নিয়ে পেছন ফিরতেই আফিফের মুখোমুখি হলো। আফিফ একনজর আহির প্লেটের দিকে তাকিয়ে, আবার আহির দিকে তাকালো। তারপর ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“বাতাসা আর শনপাপড়ি বাদ যাচ্ছে।”
আহি আফিফের কথা শুনে উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখলো, ঠিকই তো, সে তো এই দুইটা নিলোই না। এবার আহি চারটা বাতাসা আর সাতটা শন পাপড়ি নিয়ে নিলো প্লেটে।
আফিফ একটা বক্সে শন পাপড়ি নিতে নিতে বলল,
“এতোগুলো মিষ্টি তুমি একা খাবে?”
আহি সেকেন্ড খানিক আফিফের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বলল, “হুম।”
অনেকদিন পর আফিফের সাথে দেখা হয়েছে তার। তাই কিছুটা ইতস্ততবোধ করছিলো আহি।
এরপর আহি স্টল থেকে বের হয়ে একপাশে বসে ইচ্ছেমতো পিঠা খেতে লাগলো। আফিফ দূরে বসে আহিকে খেতে দেখে নিজের খাওয়া ভুলে গেলো। পদ্মের কাছে শুনেছিল, আহি না-কি মিষ্টি পিঠা বেশ পছন্দ করে। কিন্তু তার পছন্দ এমন ভয়ংকর, তা আফিফ জানতোই না। মেয়েটা কি হজম করতে পারবে এতোগুলো পিঠা? এই আগ্রহ নিয়ে বেশ মনোযোগ দিয়ে আহির খাওয়া দেখছে আফিফ। আহি খেতে খেতে তার আফিফের দিকে চোখ পড়লো। আফিফকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে খাওয়া বন্ধ করে দিলো আহি। আফিফ বুঝতে পেরে উলটো দিকে ঘুরে বসলো। আহি চোখ-মুখ ছোট করে রাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“মাশাল্লাহ বল তো, রাদ।”
রাদ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “কেন?”
“যদি পেট কামড়ায়।”
“তোকে রাক্ষসীর মতো খেতে দেখলো কারো লোভ জন্মাবে না। উলটো খাওয়ার শখই মিটে যাবে।”
আহি রাদের কথা শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
“যাক অন্তত আজ সব মিষ্টি পিঠা আমার জন্যই বেঁচে যাক।”
লাবীব এসে বলল,
“আরেহ মিষ্টি দই তো নিলিই না। ওটা খাবি না? এক কাজ করি, তোকে ডুবিয়ে দেই দইয়ের হাঁড়িতে। সাঁতরে সাঁতরে খাবি।”
আহি চোখ ছোট করে লাবীবের দিকে তাকালো। এরপর মুখ ফুলিয়ে মুখে শন পাপড়ি পুরে দিলো। যে যাই বলুক, আজ সে খাবেই খাবে।
(***)
মেলার একপাশে ভীড় জমিয়েছে মেহেদি আর্টিস্টরা। আহি আর পুষ্প দুই হাতে মেহেদি লাগিয়ে ধেই ধেই করে রাদ আর লাবীবের কাছে গেলো। রাদ আহির হাতে মেহেদি দেখে বলল,
“বাহ, মনে হচ্ছে তোর হাতে আণুবীক্ষণিক জোক কিলবিল করছে।”
আহি চোখ বড় বড় করে রাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“রাদ, বেশি কথা বললে তোর মুখে লাগিয়ে দেবো একদম।”
এদিকে পুষ্পের ফোন বাজছে, সে ঝুঁকে ব্যাগের দিকে তাকিয়ে আছে। লাবীব উঠে এসে পুষ্পের চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে বলল,
“আমি দেখছি।”
লাবীব পুষ্পের ব্যাগ থেকে ফোন বের করে তার কানের কাছে ধরলো। ওপাশ থেকে কিছু কথা ভেসে এলো। লাবীব তা শুনলো না। সে শুধু শুনলো পুষ্প ফোনের ওপাশে থাকা ব্যক্তিটিকে তাদের ভার্সিটির ঠিকানা বলছে। এরপর পুষ্প কথা শেষ করে লাবীবকে বলল, কল কেটে দিতে। লাবীব কল কেটে দিয়ে বলল,
“তোমার চুল বেঁধে দেবো?”
পুষ্প লাজুক হেসে বলল, “হুম।”
লাবীব দেরী না করে খুব যত্নের সাথে পুষ্পের চুল বেঁধে দিতে লাগলো। তা দেখে রাদ আর আহি অবাক হয়ে গেলো। রাদ বলল,
“এসব কখন থেকে চলছে!”
লাবীব হেসে বলল,
“এখনও শুরু হয় নি। তবে আজ শুরু হবে।”
এরপর লাবীব কয়েক পা পিছিয়ে যেতেই তাদের ক্লাসের কয়েকটা ছেলে এসে লাবীবের সামনে কয়েকটা ফুলের চারা রেখে চলে গেলো। পুষ্প হাঁ করে লাবীবের দিকে তাকিয়ে আছে। এরপর লাবীব মেলার পাশে দাঁড়ানো একজন চাচার কাছ থেকে তার সব বেলুন কিনে এনে ক্যাম্পাসের মাঝখানে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
“ভালোবেসে ফেলেছি তোমাকে। যদি গ্রহণ করো, তাহলে কাছে এসে হাতটি ধরো। তোমার মেহেদি রাঙা হাতটি না হয় আজ আমায় ছুঁয়ে দিক।”
রাদ আর আহি একে অপরের দিকে তাকালো৷ এদিকে পুষ্প লাজুক হেসে ধীর পায়ে লাবীবের দিকে এগিয়ে গেলো। লাবীব ইচ্ছে করে দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়েছিল। কারণ পুষ্পের সামনে এসে বসলে মেয়েটা ইতস্ততবোধ করে যদি পালিয়ে যায়, তখন দু’জনই লজ্জায় পড়বে। এখন না হয়, একজনই পড়ুক লজ্জায়। কিন্তু পুষ্প লাবীবকে লজ্জায় ফেলে নি। সে লাবীবের সামনে এসে দাঁড়ালো। লাবীব এবার প্রতিটি চারা থেকে একটি একটি ফুল ছিঁড়ে পুষ্পের দিকে এগিয়ে দিতে লাগলো। পুষ্প সব ক’টি নিলো। ফুলগুলো দেওয়া শেষে লাবীব বেলুনগুলো সব ছেড়ে দিলো। পুষ্প বলল,
“এতোটা চমৎকার হবে আমি আশা করি নি।”
লাবীব বলল,
“বলেছি না। আমার সবকিছুই ঝাঁকা নাঁকা। প্রেমের প্রস্তাবটা ঝাঁকানাঁকা হলো তো!”
পুষ্প হাসলো। কে বলেছে ভালোবাসা শেষ সময়ে আসে না। কিছু ভালোবাসা শেষ মুহূর্তে আসে, যখন প্রেম ঢাকা পড়ে যায় বিয়ে নামক সম্পর্কে। পুষ্পের পঁচিশ বছরের জীবনে তার প্রথম প্রেম এসেছে পঁচিশ বসন্ত পেরিয়ে যাওয়ার পর, এক হেমন্ত বেলায়।
আহি তাদের ছবি তুলতে ব্যস্ত। রাদ আহির দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল,
“এই হেমন্তের সকালটা যদি আমাদের হতো!”
চলবে-
#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৩৩||
৬৫।
উৎসব মুখর ক্যাম্পাসে অনেকেই ব্যস্ত রং খেলায়। আর তাই বাতাবরণে ছড়িয়ে পড়েছে রঙিন হাওয়া। সেই রঙিন হাওয়ায় প্রবেশ করলো একজন অতিথি। পুষ্পের দৃষ্টি সেই অতিথির দিকে পড়তেই সে লাবীবের হাত ধরে তাকে টেনে নিয়ে গেলো মানুষটির সামনে, আর বলল,
“ওয়েলকাম ব্রাদার।”
উজ্জ্বল তার চোখ থেকে সানগ্লাস নামিয়ে একনজর পুরো ক্যাম্পাসে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল,
“তোদের ক্যাম্পাসটা তো ভারী সুন্দর!”
পুষ্প বলল, “হ্যাঁ।”
এরপর সে লাবীবের দিকে তাকিয়ে বলল,
“লাবীব, এ হচ্ছে আমার কাজিন ব্রাদার।”
উজ্জ্বল লাবীবের দিকে হাত এগিয়ে দিয়ে বলল,
“হাই, আমি উজ্জ্বল।”
লাবীব উজ্জ্বলের সাথে হাত মিলিয়ে বলল,
“আমি লাবীব।”
উজ্জ্বল এবার লাবীবের বাকি পরিচয় জানার জন্য ভ্রূ কুঁচকে পুষ্পের দিকে তাকালো। পুষ্প বলল,
“লাবীব আমার ফ্রেন্ড। আমরা একই স্কুলে পড়েছি। আর এখন একই ভার্সিটিতে।”
“হুম, ভালো।”
উজ্জ্বল এবার এদিক-ওদিক তাকিয়ে কাউকে খুঁজতে লাগলো। হঠাৎ তার চোখ আটকে গেলো আহিকে দেখে। এতোক্ষণ সে আহিকেই খুঁজছিল। আহির স্নিগ্ধ অভিব্যক্তি ও প্রাকৃতিক ভূষণ ভীড়ের মধ্যে তাকে খুঁজে পেতে সাহায্য করেছে। পুষ্প উজ্জ্বলের চোখ অনুসরণ করে পেছন ফিরে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। এরপর গলা ছেড়ে আহিকে ডাকলো। আহি পুষ্পের কন্ঠ শুনে তাদের দিকেই এগিয়ে এলো। তার সাথে রাদও ছিল।
উজ্জ্বলকে দেখেই আহি সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“আরেহ আপনি? কেমন আছেন?”
উজ্জ্বল মুচকি হেসে বলল,
“ভালো আছি। তোমাকেও বেশ ভালোই মনে হচ্ছে। অনেক পরিবর্তন হয়েছে তোমার।”
“যেমন!”
“যেমন, এই মুহূর্তে তোমাকে বেশ প্রফুল্ল লাগছে। সিলেটের হাওয়ায় হয়তো বিষাদ ছিল।”
আহি হেসে রাদের দিকে তাকালো। এরপর বলল,
“তা না, তবে ভাবলাম এই চমৎকার দিনগুলো কি বিষন্নতার কারণে হারিয়ে ফেলবো?”
উজ্জ্বল এবার রাদের দিকে তাকালো। পুষ্প বলল,
“রাদ আহির বেস্টফ্রেন্ড।”
উজ্জ্বল হাত এগিয়ে দিয়ে বলল,
“নাইস টু মিট ইউ।”
রাদও হাত এগিয়ে দিলো। মোটামুটি পরিচয় পর্ব শেষে পুষ্প আর লাবীব উজ্জ্বলকে মেলা ঘুরিয়ে দেখানোর জন্য নিয়ে যেতে যাবে, তখনই উজ্জ্বল বলল,
“তুই যা। আমি নিজেই ঘুরে দেখি।”
পুষ্প লাবীবকে নিয়ে চলে যেতেই উজ্জ্বল আহির পাশে এসে দাঁড়ালো। আহি জিজ্ঞেস করলো,
“চট্টগ্রামে কখন এসেছেন?”
“কয়েকদিন হচ্ছে। এবার দেড় মাসের ছুটি নিয়ে এসেছি। একদম ইদের পর সিলেটে ফিরবো।”
“বেশ তো।”
“এবার কিন্তু আমাকে চট্টগ্রাম ঘুরে দেখানোর দায়িত্ব তোমার!”
আহি উজ্জ্বলের কথায় হালকা হাসলো। এদিকে রাদ একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। উজ্জ্বল আর আহির কথোপকথনে বেশ বোঝা যাচ্ছে, তাদের আগেও ভালো কথাবার্তা হয়েছে। কিন্তু আহি একবারও উজ্জ্বলের ব্যাপারে রাদকে কিছু জানায় নি। বেশ অভিমান হলো রাদের। সে হনহনিয়ে অন্যদিকে চলে গেলো। রাদকে চলে যেতে দেখে আহি ভ্রূ কুঁচকে সেদিকে তাকিয়ে রইলো। উজ্জ্বল তার মনোযোগ আকর্ষণ করতেই আহি আবার দৃষ্টি সরিয়ে উজ্জ্বলের দিকে তাকালো। এরপর টুকটাক কথা বলতে বলতেই আহি উজ্জ্বলকে তাদের ক্যাম্পাসটা ঘুরে দেখালো।
(***)
বাসায় ঢুকতেই মিসেস লাবণির মুখোমুখি হলো আহি। লাবণিকে সজ্জিত পোশাকে দেখে আহি ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
“কোথাও যাওয়া হচ্ছে?”
লাবণি হালকা হেসে বলল,
“তুমি এই প্রশ্ন আমাকে করছো?”
আহি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে লাবণির দিকে তাকালো। এরই মধ্যে রিজওয়ান কবির তৈরি হয়ে নিচে নামলেন। সাথে মোজাম্মেল চাচাও দু’টি লাগেজ নিয়ে দু’তলা থেকে নেমে বাইরে চলে গেলেন। রিজওয়ান কবির আহিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“ক্যাম্পাসে ভালোই তো মজা করেছো। যাও এবার ফ্রেশ হয়ে তৈরী হয়ে নাও। সন্ধ্যায় আমাদের ফ্লাইট।”
আহি অবাক কন্ঠে বলল,
“আমাদের ফ্লাইট? কোথায় যাচ্ছি আমরা?”
লাবণি বলল,
“আহি, তুমি কি অ্যামনেশিয়াতে ভুগছো? তোমার আর তাজওয়ারের এনগেজমেন্ট আমেরিকায় হবে। ভুলে গেছো না-কি? আজই আমরা রওনা দিচ্ছি।”
আহি বাবার কাছে এসে বলল,
“বাবা প্লিজ। আমি এখনো এসবের জন্য প্রস্তুত নই। আমাকে একটুবসময় দাও। আমি মাস্টার্সটা শেষ করি। এরপর আমি নিজের জন্য কিছু করতে চাই।”
রিজওয়ান কবির ভাবলেশহীন সুরে বললেন,
“তোমাকে মাস্টার্স শেষ করতে কেউ নিষেধ করে নি। আর নিজের জন্য তোমাকে কিছুই করতে হবে না। তোমার কাছে সব নিজে এসেই ধরা দিচ্ছে। তাজওয়ারকে বিয়ে করলে তুমি তোমার সব স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে।”
“স্বপ্ন পূরণের জন্য একটা রেপিস্টের সাথে তুমি আমার বিয়ে দেবে?”
“এসব মিথ্যে খবর তুমি কোথা থেকে পাও, আহি? আর এখন এসবের সময় নেই। যাও তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে এসো।”
কথাটি বলেই রিজওয়ান কবির বেরিয়ে পড়লেন। আহি লাবণির দিকে হতাশ চোখে তাকালো। লাবণি আহির হাতে হাত রেখে বলল,
“কাম অন বেবি গার্ল, তোমার এই সো কল্ড শাড়িটা খুলে, সুনেহরাহ তোমার জন্য যেই ড্রেস সিলেক্ট করে দিয়েছে, ওটা পরে ঝটপট চলে এসো। আর তোমার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও নিয়ে নিও। বাকি এনগেজমেন্টের শপিং তো তাজওয়ার করে ফেলেছে।”
আহি লাবণির হাত এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে হনহনিয়ে নিজের ঘরে চলে এলো। ঘরে এসেই খোঁপায় আটকানো মালাটা টেনে খুলে বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে দিলো আহি। কয়েক মিনিট ঘরে পায়চারি করে ফোন হাতে নিয়ে রাদকে কল করলো। কল যাচ্ছে, অথচ রাদ ধরছে না। আহি কল দিয়েই যাচ্ছে। হঠাৎ মিসেস লাবণি পেছন থেকে এসে আহির ফোনটা নিয়ে নিলেন। আহি ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“আমার ফোন কেন নিয়েছেন?”
লাবণি বাঁকা হেসে বলল,
“বাংলাদেশ না ফেরা পর্যন্ত এই ফোনটা তুমি আর পাবে না।”
“আপনি কিন্তু অতিরিক্ত করছেন। আমার লাইফে ইন্টা’রফেয়া’র করার আপনার কোনো অধিকার নেই। তবুও আপনি বারবার আমাকে বিরক্ত করছেন। আমি জানি, আপনিই বাবার মাথায় আমার আর তাজওয়ারের বিয়ের ভূত ঢুকিয়ে দিয়েছেন।”
লাবণি হাসলো। সেকেন্ড খানিক হেসে বলল,
“আহি, তোমার বাবাই তোমাকে নিলাম করছে, তুমি আমাকে এর মধ্যে কেন জড়াচ্ছো? ভুলে যেও না, তোমার আর তাজওয়ারের বিয়ে হলেই তোমার বাবা খানদের বিজনেসে নিজেকে যুক্ত করতে পারবে। তাছাড়া সামনে ইলেকশন। তোমার বাবাও এমপি পদে দাঁড়াচ্ছেন। এই মুহূর্তে খানদের সাহায্য খুব দরকার। ছোট খানকে খুশি করতে পারলেই তো তোমার বাবার উন্নতি। নিজের বাবার উন্নতি কি সহ্য হবে না তোমার?”
“আমি মানুষ। কোনো পণ্য নই। ওই বাড়িটা আমার জন্য নিরাপদ নয়। তাজওয়ারের বড় ভাই একটা দুষ্ট চরিত্রের লোক। ওদের বাসাটার একদম হ-য-ব-র-ল অবস্থা। দোয়েল ভাবির ব্যাপারে কি কিছু জানেন না? তার নিজের স্বামী তাকে বাধ্য করেছে তার বন্ধুদের সাথে থাকার জন্য৷ সেখানে আমার সেইফটির দায়িত্ব কে নেবে?”
“সরওয়ার খান আর তাজওয়ার খানের মধ্যে তুলনা করো না, আহি। আর দোয়েল তার যোগ্যতা অনুসারে যথেষ্ট পেয়েছে। ভিখারিনী এখন রাজরানীর মতো থাকছে। এতো কিছু পাওয়ার পর সে যদি স্বামীর কথায় একটু আধটু স্বামীর বন্ধুদের সন্তুষ্ট করে, সেখানে তো আমি ভুল কিছু দেখছি না।”
আহি কানে হাত দিয়ে চিৎকার করে বলল,
“ফর গড সেইক, লিভ মি এলৌন।”
লাবণি আহির ফোনটা বন্ধ করে দিয়ে রুমের বাইরে এসে বলল,
“পাঁচ মিনিটের মধ্যে তৈরী হয়ে নিচে নামবে। নয়তো তাজওয়ারকে ফোন করে এখানে আসতে বলবো। আর এরপর এয়ারপোর্টে তার সাথেই যেও। তার সাথে তো অন্তত শক্তির জোরে পারবে না।”
লাবণি চলে যেতেই আহি ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো। আর বুকে হাত রেখে বলল,
“আল্লাহ, তুমি আমার ভাগ্যে আর কতো ঝামেলা লিখে রেখেছো। আমি আর এসব মানসিক অত্যাচার নিতে পারছি না।”
(***)
বিমানবন্দরের সামনে গাড়ি থামলো। আহি মলিন মুখে নেমে এলো গাড়ি থেকে৷ এদিকে তাজওয়ার গ্লাসের বাইরে আহিকে দেখে মুচকি হাসলো। লাল রঙের ফ্রকে বেশ আকর্ষণীয় লাগছে আহিকে। কিন্তু মুখে কোনো সাজসজ্জা নেই। আর এই সাজ বিহীন মলিন মুখখানা তাজওয়ারকে মুহূর্তেই ঘায়েল করে ফেললো। আহি বিমান বন্দরে ঢুকতেই তাজওয়ার তার দিকে হাত এগিয়ে দিলো। আর আহি সেই হাতটি এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে আঙ্গুল তাক করে বলল,
“আমার থেকে দূরে থেকো।”
তাজওয়ার আহির গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলল,
“তুমি আমার সম্পদ। আমি যখন ইচ্ছে তোমার কাছে আসবো। এর জন্য আমার তোমার অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন নেই।”
“সম্পদের মালিকানা না পাওয়া অবধি অনুমতি নেওয়া শিখো। দেখা যাবে, যাকে তুমি এখন নিজের ভাবছো, তাকে স্পর্শ করার আগেই সে হারিয়ে গেছে।”
তাজওয়ার আহির পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলল,
“তাকে নিজের করে পাওয়ার জন্য আমি সব সীমালঙ্ঘন করতে প্রস্তুত৷ আর একবার যদি আমি সীমা ছাড়িয়ে যাই, তাহলে আমাকে আবদ্ধ ক্ষেত্রে আনা সহজ হবে না। আমার সম্পর্কে তোমার আরো বিস্তারিত জেনে নেওয়া উচিত।”
আহি দৃঢ় হাসি হেসে বলল,
“আত্মবিশ্বাস রাখা ভালো। কিন্তু অতিরিক্ত রাখাটা বিপদজনক।”
(***)
বিমানে আহি আর তাজওয়ার পাশাপাশি সিটে বসেছে। আর তাজওয়ার আহির হাত ধরে আছে। যতোক্ষণ তাজওয়ার তার পাশে বসেছিল, আহি নিজের হাতটি তাজওয়ারের হাতের মুঠো থেকে ছাড়াতে পারি নি। এমনকি ওয়াশরুমেও তাজওয়ার আহির পিছু পিছু গেলো। তাজওয়ারকে আসতে দেখে আহি দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“তোমাকে আমি আমার বডিগার্ড হিসেবে রাখি নি।”
তাজওয়ার বাঁকা হেসে বলল,
“তোমার দেহ পাহারা দেওয়ার জন্য আমি তোমার সাথে যাচ্ছি না। আমি জানি, তোমার দেহের পাহারা তুমি নিজেই করতে জানবে। আমি তো তোমার ওয়ার্নিংটা মাথায় রেখে তোমার সাথে সাথে আছি। মনে নেই, তুমি কি বলেছিলে? স্পর্শ করার আগেই হারিয়ে যাবে। আমিও দেখতে চাই, আমার চোখের সামনে থেকে তুমি কীভাবে হারাও।”
(***)
আমেরিকায় পৌঁছানোর দু’দিন পর আহি আর তাজওয়ারের এনগেজমেন্টের প্রস্তুতি শুরু হলো। এদিকে অভিমান করে বসে থাকা রাদ সেদিন ইচ্ছে করেই আহির কল ধরে নি। আর আজ দু’দিন আহির কোনো খোঁজ না পেয়ে সে অস্থির। আহির ফোন বন্ধ। সোশ্যাল একাউন্টগুলোতেও আহি এক্টিভ নেই। ক্লাসেও আসে না। এমনকি পুষ্প, লাবীব কারো সাথেই আহির যোগাযোগ হয় নি৷ চিন্তায় পাগলপ্রায় রাদ আহিকে খুঁজতে খুঁজতে তার বাসায় চলে গেলো। সেখানে গিয়ে দেখলো গেটে তালা ঝুলানো। বাইরে দারোয়ান দাঁড়ানো শুধু। তারা রাদের প্রশ্নের কোনো উত্তরই ঠিকভাবে দিচ্ছে না। এদিকে রাদের এই অবস্থা দেখে পুষ্প হতাশ হয়ে পদ্মকে সব জানালো। পদ্মের সাথে তো অনেক দিন কথা হয় নি আহির। সেও ঠিকভাবে কিছু জানাতে পারলো না।
পদ্ম বিকেলে বসে বসে আহির কথায় ভাবছিল, তখন আফিফ তার পাশে বসে জিজ্ঞেস করলো,
“এমন ব্যাকুল ভাবে কি ভাবছো?”
আফিফের প্রশ্নে পদ্ম চিন্তিত কন্ঠে বললো,
“দু’দিন ধরে আহির কোনো খোঁজ নেই৷ ওর বাসায় না-কি তালা দেওয়া।”
আফিফ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“তুমি জানো না আহি কোথায়?”
“না। আপনি এভাবে জিজ্ঞেস করলেন যে! আপনি জানেন ও কোথায়?”
“হুম, আমি তো তাজওয়ার খানের এসিস্ট্যান্ট। আমি তো জানবোই। ওরা আমেরিকায় গেছে। আহি আর তাজওয়ার খানের এনগেজমেন্ট।”
“আর আপনি এটা আমাকে জানালেন না?”
“তুমি জানো না, এটা তো আমি জানতাম না৷ আমি ভেবেছি, আহি তোমাদের জানিয়েছে।”
পদ্ম পুষ্পের নম্বরে ডায়াল করতে করতে বলল,
“মেয়েটা এতো চাপা স্বভাবের কেন? নিজের এনগেজমেন্টের ব্যাপারেও জানালো না।”
এরপর পদ্ম ফোন করে পুষ্পকে আহির খবর জানালো। পুষ্পও দেরী না করে রাদকে কল করে জানিয়ে দিলো। রাদ এই কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। সে জানতো এই মাসেই আহির এনগেজমেন্ট হওয়ার কথা। কিন্তু এভাবে হুট করে আহিকে নিয়ে যাবে, তা কল্পনা করে নি রাদ। এখন তারা যদি এনগেজমেন্টের পাশাপাশি আক্দও করিয়ে দেয়? এই মুহূর্তে নিজের উপর রাগ হচ্ছে রাদের। সে রাগে ফোনটা মেঝেতে ছুঁড়ে মারলো। আহিকে উজ্জ্বলের সাথে কথা বলতে দেখেই অভিমান করেছিল রাদ। যেই অভিমান সম্পর্কে আহি কিছুই বুঝতে পারে নি। বুঝতে না পারাটাই স্বাভাবিক। সে তো আর জানে না যে রাদ তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। আর তার এই ন্যাকামো অভিমান দেখাতে গিয়ে যে সে আহির গুরুত্বপূর্ণ কল মিস করে ফেলেছে, সেটার জন্যই এখন আফসোস হচ্ছে তার। এই মুহূর্তে আহির দেশে ফেরার অপেক্ষা করা ছাড়া আর উপায় নেই।
চলবে-
#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৩৪(১ম ভাগ)||
৬৬।
জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশে, শ-খানেক রঙ-বেরঙের বাতির ভীড়ে একখানা মলিন মুখ দাঁড়িয়ে আছে সবার দৃষ্টিকে কেন্দ্র করে। সাদা রঙের ভারী গাউনে নুইয়ে পড়ছে তার দুর্বল কায়া। তবুও শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। কারণ তার একটা সিদ্ধান্ত পালটে দিবে অনেকগুলো মানুষের ভবিষ্যৎ।
আহির হাতটি আলতোভাবে স্পর্শ করলো তাজওয়ার খান। তাজওয়ারের স্পর্শে আহি হতাশ চোখে তার দিকে তাকালো। দেখলো তাজওয়ারের ঠোঁটে বিজয়ের হাসি। শেষমেশ আহি আনুষ্ঠানিকভাবে তার বাগদত্তা হতে যাচ্ছে। যেই স্বপ্ন সে অনেক বছর ধরে দেখে আসছে, তার প্রথম ধাপ আজ সে পার করেছে। এখন আহির নামটিও শিরোনামের পাতায় লেখা হবে, ব্যবসায়ী মিস্টার তাজওয়ার খানের বাগদত্তা হিসেবে। কে না চায় এমন শান্তির নীড়? যেখানে টাকার অভাব নেই, বিলাসিতার অভাব নেই। কিন্তু যে এসবের ঊর্ধ্বে জীবনটাকে দেখতে চায়, একটু শান্তি চায়, তার জন্য শান্তির সেই নীড় কি আদৌ শান্তির? না-কি সমঝোতা মাত্র?
তাজওয়ার আর আহির আংটিবদল হতেই একজন ফটোগ্রাফার তাদের ছবি তুললো। লোকটা মিডিয়ায় কাজ করে। তাজওয়ার তাকে আমেরিকায় এনেছে, তাদের বিয়ের ছবি বিভিন্ন নিউজ চ্যানেলে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য। আহির ইচ্ছে করছিলো ফটোগ্রাফারের গালে কষে একটা চড় বসিয়ে দিতে। সে কিছুক্ষণ পর পর এসে ছবি তুলছে। আহি বিরক্ত হয়ে তাজওয়ারকে বলল,
“এই লোকটা একটা নিউজ বের করার জন্য এতোগুলো ছবি কেন তুলছে, পাগল না-কি?”
তাজওয়ার মুচকি হেসে বলল,
“আরেহ, খবরে আমাদের এনগেজমেন্ট এনাউন্স করা হবে, একটা ভালো ছবি তো রাখতেই হয়।”
“এক্সকিউজ মি, তুমি জাস্ট একজন ব্যবসায়ী। কোনো মন্ত্রী বা সেলেব্রিটি নও যে তোমাকে নিয়ে দশ মিনিটের খবর বের হবে।”
“শোনো, মন্ত্রীরাও আমার আগে-পিছে ঘুরে। আর সেলেব্রিটিরা আমার কারণেই সেলেব্রিটি হয়। আমি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে ইনভেস্ট করি। তুমি হয়তো জানো না, আমি অনেক মুভির প্রোডিউসার ছিলাম। জানবে কীভাবে? তোমার গন্ডি তো বেশিদূর ছিল না। তুমি শুধু রং নিয়ে খেলেই সময় পার করেছো।”
“আমার রং নিয়ে খেলা তোমার কাজের চেয়ে বহুগুণ ভালো। অন্তত সেই কাজে মানসিক তৃপ্তি আছে। তোমার টাকায় তুমি শুধু শারীরিক সুখ পেয়েছো। মানসিক সুখ পাও নি।”
“তুমি তো আমার জীবনে মানসিক শান্তি হয়েই এসেছো। আমার আর কোনো শান্তির প্রয়োজন নেই। দিনে শারীরিক সুখ, রাতে মানসিক সুখ। শীঘ্রই আমার চেয়ে সুখী আর কেউ হবে না।”
আহি চোখ-মুখ কুঁচকে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে রইলো। তখনই কয়েকজন ফিটফাট যুবক আহি আর তাজওয়ারের সামনে এসে দাঁড়ালো। তাজওয়ার তাদের দেখে এক গাল হাসলো। আহি মুখ বাঁকিয়ে তাজওয়ারের হাসি দেখছে। তাজওয়ার আহির হাত ধরে চাপা স্বরে বলল,
“এভাবে তাকিয়ে থেকো না। মনে হচ্ছে সাপ আর বেজির বিয়ে হচ্ছে।”
আহি মুখ বাঁকিয়ে চাপা স্বরে উত্তর দিলো,
“মনে হোক। তুমি আমার শখের পুরুষ নও। আমার দৃষ্টিতে তুমি তাইপানের চেয়েও বিষধর।”
তাজওয়ার আহির কথা শুনে সামনে দাঁড়ানো যুবকগুলোর দিকে তাকিয়ে সৌজন্যমূলক হাসি ফেরত দিয়ে বলল,
“আহি, মিট মাই ফ্রেন্ডস।”
আহি বাঁকা চোখে তাজওয়ারের বন্ধুদের দিকে তাকালো। তাদের মধ্যে একজন আহির দিকে হাত এগিয়ে দিয়ে বলল,
“হ্যালো, আই এম সজিব।”
আহি ঠোঁট বাঁকিয়ে চাপা স্বরে বলল, “আজিব।”
সজিব আহির ঠোঁটের নড়ন দেখে বলল,
“ইটস সজিব, নট আজিব।”
তাজওয়ার এবার আহির দিকে বাঁকা চোখে তাকালো। আর আহি সজিবের দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। এবার তাজওয়ার পাশের জনের দিকে ইঙ্গিত করে বলল,
“আহি, এ হচ্ছে জিলান শেখ। আমার বিজনেস পার্টনার আর আমার খুব কাছের বন্ধু।”
জিলান আহির দিকে হাত এগিয়ে দিয়ে বলল,
“হাই বেইব….”
তাজওয়ারের দিকে চোখ পড়তেই জিলান চুপ হয়ে গেলো। আহি জিলানের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। জিলান খচমচে ভাব নিয়ে হেসে বলল,
“আই মিন ভাবী। কেমন আছেন আপনি?”
আহি জিলানের প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলো না। এবার পাশের জন বলে উঠলো,
“হাই, আহি। আই এম হ্যারি।”
হ্যারি ভিনদেশী হওয়ায় আহি সৌজন্যমূলক হাসি ফেরত দিলো। তখনই হ্যারি আহির কাছে এসে হুট করে তার গালে চুমু খেয়ে বলল,
“নাইস টু মিট ইউ।”
আহি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাজওয়ার হালকা হেসে বলল,
“ইটস কালচার।”
আহি চোখ ছোট করে তাজওয়ারের দিকে তাকালো। এবার হ্যারির পাশের জন্য আপাদমস্তক আহিকে দেখে নিয়ে বলল,
“সো বিউটিফুল।”
আহি মুখ বাঁকিয়ে বলল, “এন্ড ইটস?”
অর্ণব হেসে বলল, “ইটস কমপ্লিমেন্ট।”
আহি তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে চাপা স্বরে বলল,
“তোমার বন্ধুগুলো কি নেশা করে এসেছে? তাদের চাহনি দেখেছো? দেখেই বোঝা যাচ্ছে এদের চিন্তাভাবনা কতোটা বাজে। এদের সরাও তো আমার সামনে থেকে। নয়তো আমি তোমাকে ধাক্কা দিয়ে এখান থেকে চলে যাবো। তারপর তোমার স্পেশাল ফটোগ্রাফারকে বলো, শিরোনামে লিখতে বিশিষ্ট ব্যবসায়ীকে ধাক্কা দিয়ে স্টেজ থেকে নেমে পড়লো তার বাগদত্তা।”
তাজওয়ার চাপা স্বরে বলল, “ভেরি ফানি।”
তখনই সজিব বলে উঠলো,
“তাজ, তুই সত্যিই ভাগ্যবান। সব ঘাট ঘুরে ভালো জায়গায় নৌকা বেঁধেছিস।”
আহি ভ্রূ কুঁচকে সজিবের দিকে তাকালো। সজিব হেসে বলল,
“মিস, রাগ করেছেন?”
আহি দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“নোংরা ডোবায় নৌকা ঠেকলে রাগ হওয়াটা স্বাভাবিক।”
তাজওয়ার আহির কথা শুনে তার দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। এবার জিলান বলল,
“আর যাই বল তাজ, আহি কিন্তু ভীষণ সুন্দরী।”
তাজওয়ার হেসে বলল,
“এজন্যই তো এতো ভালোবাসি।”
আহি ভ্রূ কুঁচকে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি এজন্য আমাকে ভালোবাসো? আমি সুন্দর তাই? সিরিয়াসলি, তাজওয়ার?”
তাজওয়ার হেসে আহির সামনে আসা চুলগুলো তার কানের পেছনে গুঁজে দিতে দিতে বলল,
“তোমাকে আমি ভালোবাসি, আহি। কেন ভালোবাসি এটা বিষয় না।”
আহি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,
“কাল যদি আমার চেয়ে সুন্দরী মেয়ে তোমার জীবনে আসে, তখন?”
“কাল তো এখনো আসে নি। আর যতোই সুন্দরী নারী আসুক, রাজার বড় রানীর অধিকার আর ভালোবাসা ছোট রানীরা নিতে পারবে না।”
আহি কথাটি শুনে তাজওয়ারকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। আর বিড়বিড় করতে করতে চলে গেলো। হোটেল রুমের সামনে এসে আহি মিনমিনিয়ে বলল,
“বিয়ের আগেই এসব শুনছি। বিয়ের পর আমি নিশ্চিত পাগল হয়ে যাবো। অসভ্য, খাটাশ তাজওয়ার খান। বিয়ের ভূত হজম করিয়ে দেবো তোকে।”
এদিকে লাবণি আহির কাছে আসতেই দেখলো আহি একা দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করছে। সে আহির কাছে এসে বলল,
“কি ব্যাপার? মন খারাপ?”
আহি মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“না ভীষণ ভালো লাগছে আমার। ইচ্ছে করছে থা থা থৈ থৈ করতে।”
লাবণি হাসলো। বলল,
“আমি তো ভেবেছি, তাজওয়ারের বন্ধুরা এসেছে তাই তোমার মন খারাপ। কারণ তোমার বন্ধুদের তো দাওয়াত দেওয়া হলো না। আজ তোমার গুরুত্বপূর্ণ দিনে রাদ, লাবীব, পুষ্প, পদ্ম কেউই তোমার পাশে নেই। কিন্তু আমরাও তো নিরুপায়। ওদের কীভাবে দাওয়াত করি, বলো? রাদ আর লাবীব তো তোমার অন্ধ ভক্ত। তুমি ওদের যা বলবে, ওরা তাই করবে। এখন ওরা এসে তোমার কথায় যদি এনগেজমেন্টে সিনক্রিয়েট করতো, তাহলে বিষয়টা সুন্দর দেখাতো না। এমনও হতে পারে, ওরা তোমাকে ভাগিয়ে নিয়ে গেলো। নাক কিন্তু তোমার বাবার কাটা যেতো, আর মাথা কাটা যেতো তোমার দুই বন্ধুর। তাজওয়ার দু’টোকে উপরে পাঠিয়ে দিতে একবারও ভাবতো না। আর তুমি তো এখনো অবুঝ। তোমার ভুলের জন্য কার ক্ষতি হচ্ছে, সেটা তো বুঝবে না। তাই আমি তাদের না জানিয়ে মনে হয় না ভুল কিছু করেছি। আর অন্যদিকে তোমার বান্ধবী পদ্ম। ও তো এখানে আসা এফোর্ড করবে না। এতো ভালো অবস্থা তো তার নেই যে আমেরিকায় এসে এনগেজমেন্ট এটেন্ড করবে। আর বাকিরা না এলে পুষ্প একা এসে কি করতো, বলো? এমনিতে তাজওয়ারের বন্ধুদের চোখ কিন্তু বেশ ধারালো। একবার যদি তাদের চোখে কোনো শিকার আটকে যায়, তারা সহজে সেই শিকারকে ছাড়ে না। শেষমেশ কি-না এতো বছরের দেহ রক্ষা বান্ধবীর এনগেজমেন্টে এসেই শেষ হয়ে যেতো!”
আহি চোখ বড় বড় করে লাবণির দিকে তাকালো। লাবণি আবার বলল,
“তবে লিনাশাকে আসতে বলেছি। সে কি আর আসবে বলো? এমনিতে বলার বলেছিলাম। আফটার অল তোমার একমাত্র খালা।”
আহি দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“অনেক বকবক করেছেন। এখন নিজের গতিহীন মুখ আর ধূর্ত মস্তিষ্ককে একটু বিশ্রাম দিন। আমার বন্ধুরা এসব সো ক্লল্ড এনগেজমেন্টে এটেন্ড হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে যাচ্ছে না। বরং এসব অসুস্থ মানুষের ভীড় থেকে তারা যতো দূরে থাকবে, তাদের মস্তিষ্ক ততো ভালো থাকবে।”
আহি কথাটি বলেই হোটেল রুমে ঢুকে লাবণির মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলো।
৬৭।
রুমের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনেই বিরক্তমুখে দরজা খুলে দিলো আহি। দেখলো তাজওয়ার দাঁড়িয়ে আছে। তাজওয়ারকে দেখে সে আরো কয়েক দফা বিরক্ত হলো। চেঁচিয়ে বলল, “কি চায়?”
তাজওয়ার দরজা ধরে আহির দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে বলল, “তোমাকে চাই।”
আহি তাজওয়ারের মুখের উপর দরজা বন্ধ করতে যাবে তখনই সে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়লো। আহি কিছু বলতে যাবে তার আগেই তাজওয়ার দরজা বন্ধ করে আহিকে দরজার সাথে চেপে ধরলো। আহি তাজওয়ারের মুখের সামনে তার হাত রেখে বলল,
“কাছে আসার চেষ্টা করবে না।”
তাজওয়ার নেশা জড়ানো কন্ঠে বলল,
“তুমি এখন আমার।”
“ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন আমাদের এখনো বিয়ে হয় নি।”
তাজওয়ার আহির কোমড় জড়িয়ে ধরে তাকে নিজের কাছে আনলো। আহি তাজওয়ারকে ছাড়ানোর জন্য তার শরীরের সব শক্তি দিয়ে তাজওয়ারের পিঠে ঘুষি মারতে লাগলো। কিন্তু তাজওয়ার এসবের তোয়াক্কা না করে আহিকে কোলে উঠিয়ে বিছানায় ফেলে দিলো। আহি তৎক্ষণাৎ তার দুই হাতে ভর দিয়ে উঠতে যাবে, তখনই তাজওয়ার তার উপরে ভর দিয়ে শুয়ে পড়লো। আহি চেঁচিয়ে বলল,
“আমি তোকে খুন করে ফেলবো। এসব অসভ্যতা আমার সাথে দেখাবি না।”
তাজওয়ার আহির মুখ চেপে ধরে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল,
“তুমি আমার সাথে এভাবে কথা বলতে পারো না। আমি তোমার ফিয়োন্সে। এখন তোমার উপর আমার সম্পূর্ণ অধিকার আছে। আর আমি কি তোমার সাথে শারীরিক সম্পর্কে যাচ্ছি? আমি তো জাস্ট তোমাকে একটু ভালোবাসার চেষ্টা করছি।”
“এটাকে ভালোবাসা বলে? ছি! আমাকে কি তুমি তোমার প্রেমিকাদের মতো ভেবেছো? আমার কাছে এসব নোংরামি। ভালোবাসা না।”
“দেখো আহি, আমি কিন্তু চাইলেই অনেক কিছু করতে পারি। আমাকে আটকানোর সাধ্য কারো নেই। কিন্তু তুমি বেশি বাড়াবাড়ি করছো। আমি আমার ফিয়োন্সেকে একটু আদর করতে পারবো না?”
তাজওয়ার কথাটি বলেই আহির গলায় মুখ ডুবিয়ে দিলো। আহির মেজাজটা আরো বিগড়ে গেলো। সে তাজওয়ারের চুল টেনে ধরে তার মুখটা উঠিয়ে কষে একটা চড় লাগিয়ে দিলো তাজওয়ারের গালে। তাজওয়ার গালে হাত দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। আহি উঠে বসলো আর রাগী স্বরে বলল,
“আমি তোর ভোগ্যপণ্য নই। নেক্সট টাইম আমার আগে-পিছেও যদি দাঁড়াস….”
আহি পুরো কথাটা শেষ করার আগেই তাজওয়ার আহির হাতটা শক্ত করে চেপে তাকে বসা থেকে দাঁড় করিয়ে তার গালে সশব্দে একটা চড় বসিয়ে দিলো। এতো জোরে সে চড় মেরেছে যে আহি সেই ধাক্কা সামলাতে না পেরে মেঝেতে বসে পড়লো। গালটা লাল হয়ে গেছে আহির। মনে হচ্ছে কেউ লোহা গরম করে মুখে চেপে ধরেছে। ভীষণ জ্বলছে আহির কোমল গালটি। যন্ত্রণায় তার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। তাজওয়ার এবার আরো ভয়ংকর হয়ে গেলো। সে আহিকে টেনে তুলে আবার ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলে দিলো। আহির শরীর একদম নিস্প্রভ হয়ে গেছে। সে বাকরুদ্ধ হয়ে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে আছে। তাজওয়ার এবার আহিকে জড়িয়ে ধরলো। আহির অনুমতি না নিয়ে ইচ্ছেমতো আহির গলায়, মুখে তার অধর ছুঁইয়ে দিলো। ধীরে ধীরে অস্বাভাবিক হয়ে উঠলো সে। আহি স্তম্ভিত ফিরে পেতেই আবার তাজওয়ারকে সরানোর জন্য ধাক্কা দিতে লাগলো। তাজওয়ার এবার আহির ওষ্ঠদ্বয়ে তার অধর ছোঁয়ালো। এদিকে আহির চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। তাজওয়ার বুঝতে পেরে আহিকে ছেড়ে দিলো। আহি ছাড়া পেয়ে নিজের হাত দিয়ে জোরে জোরে তার ঠোঁট ঘষতে লাগলো। নিঃশব্দে কাঁদছে সে, আর তার হাতটাও কাঁপছে। তাজওয়ার আহির লাল হয়ে যাওয়া গালটিতে তার অধর ছুঁইয়ে বলল,
“সরি। সরি। সরি। এন্ড আই লাভ ইউ, আহি।”
আহি কাঁদছে। তাজওয়ার এবার আহির চোখ মুছে তার চোখে অধর ছোঁয়ালো। আহি এবার উঠে বসলো৷ তাজওয়ারও উঠে বসে বলল,
“কাঁদছো কেন, আহি? আমিই তো তোমার সব। কেন এমন করছিলে বলো? আমার তো তোমার উপর অধিকার আছে। আজ নয়তো কাল আমি আদায় করে নিবোই। তাহলে আজ কেন নয়?”
আহি করুণ দৃষ্টিতে তাজওয়ারের দিকে তাকালো। আহি উত্তরে কি বলবে বুঝতে পারছে না। এই মানুষটা যে তার অনুভূতি কখনোই বুঝবে না, এটা আজ পুরোপুরি নিশ্চিত হয়েছে আহি। আহিকে চুপ দেখে তাজওয়ার আবার বলল,
“কিছু তো বলো?”
আহি কাঁপা কন্ঠে বলল, “আমার বমি আসছে।”
তাজওয়ার ভ্রূ কুঁচকে বললো, “হোয়াট?”
আহি উঠে দৌঁড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো। এরপর পানির কল ছেড়ে মুখে ইচ্ছেমতো পানির ঝাপটা দিলো। ভেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে আয়নায় নিজের চেহারা দেখেই আহির গা গুলিয়ে এলো। গলগল করে বমি করে দিলো সে। তাজওয়ার দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলল,
“আ’র ইউ ওকে? আহি, আই এম সরি। দরজাটা খোলো। আমাকে ভেতরে আসতে দাও।”
আহি দেয়ালে হেলান দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তাজওয়ার বলল,
“আমি কিন্তু দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকবো।”
আহি দরজাটা খুলে দিলো। তাজওয়ারকে কাঁপা হাতে সরিয়ে বিছানার দিকে পা এগুতেই চোখ ঝাপসা হয়ে এলো তার। শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে মেঝেতে পড়ার আগেই তাজওয়ার তাকে ধরে ফেললো। সে আহিকে ঝাঁকিয়ে বলল,
“আহি, কি হয়েছে তোমার?”
তাজওয়ার তড়িঘড়ি করে আহিকে কোলে উঠিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো। আহি জানালার দিকে তাকিয়ে বলল,
“এসি বন্ধ করে জানালাটা খুলে দাও। আমার দম বন্ধ আসছে।”
তাজওয়ার ব্যস্ত কন্ঠে বললো, “ওয়েট, ওয়েট।”
তাজওয়ার তাড়াতাড়ি এসি বন্ধ করে জানালা খুলে দিলো। এরপর আহির পাশে বসে তার হাতটা আলতোভাবে স্পর্শ করে বলল,
“সরি, আহি। তুমি এমন অসুস্থ হয়ে যাবে, আমি ভাবতেও পারি নি। তুমি আমাকে একটু ভালোবাসলে, সবকিছুই তোমার সহজ মনে হতো।”
আহি জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। তাজওয়ার ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“খারাপ লাগছে তোমার?”
আহি কাঁপা কন্ঠে বলল, “মরে যেতে ইচ্ছে করছে।”
তাজওয়ার চুপ হয়ে গেলো। মিনিট খানিক সে আহির দিকে তাকিয়ে রইলো। এরপর মুখ ঘুরিয়ে অন্যপাশে বসলো। এবার তাজওয়ারের হাত কাঁপছে। আহির এই অস্থিরতা দেখে সে নিজেকে স্থির রাখতে পারছে না। ইচ্ছে করছে দেয়ালে ঘুষি মেরে নিজের হাতটা থেঁতলে ফেলতে। তাজওয়ার অনেকক্ষণ পর আহির দিকে ঘুরে বসে বলল,
“আচ্ছা, সরি। আই এম রিয়েলি ভেরি সরি। এই মুহূর্তে শাস্তিস্বরূপ তুমি যা চাইবে আমি তোমাকে তাই দেবো। তবে শুধু এই মুহূর্তের জন্য। দশ মিনিট সময় আছে তোমার হাতে। যা চাওয়ার চেয়ে নাও। কিন্তু এই দশ মিনিটে নিজের প্রাণ আর তোমার প্রাণ নেওয়া ছাড়া সবকিছুই করতে পারবো আমি।”
আহি কাঁপা কন্ঠে বলল, “তোমার ফোনটা দাও।”
তাজওয়ার গম্ভীরমুখে বলল,
“কার সাথে কথা বলবে?”
আহি মলিন মুখে বললো, “মায়ের সাথে।”
তাজওয়ার দ্রুত ফোনটা পকেট থেকে বের করে আহির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“ওহ অফকোর্স। আমারও বলা উচিত। আফটার অল সি ইজ মাই ওয়ান এন্ড অনলি রিয়েল মাদার-ইন-ল।”
চলবে-
#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৩৪(২য় ভাগ)||
৬৮।
ফোন বেজে উঠতেই সালমা ফাওজিয়া হাত মুছতে মুছতে ফোনের কাছে এগিয়ে গেলেন। স্ক্রিনে অপরিচিত নম্বর ভেসে উঠতেই তিনি ভ্রূ কুঁচকে তাকালেন। খুব আশা নিয়েই ফোনের কাছে এসেছিলেন। ভেবেছিলেন আহির কল হবে৷ কিন্তু তিনি হতাশ হলেন৷ কলটা রিসিভ করে কানের কাছে আনতেই তিনি থমকে গেলেন। তার বুকটা কেঁপে উঠলো। ব্যস্ত কন্ঠে বললেন,
“আহি, মা আমার! কাঁদছো কেন?”
আহি ফোন কানের কাছ থেকে সরিয়ে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমাকে একটু স্পেইস দেবে? আমি একা কথা বলতে চাই। প্লিজ।”
তাজওয়ার সরে যেতেই আহি ফোনটা আবার কানের কাছে আনলো। বললো, “মা।”
“কাঁদছো কেন মা?”
“হয়তো তোমাকে আর ফিরে পাবো না। হয়তো আমার স্বপ্নগুলো শেষ হয়ে গেছে। কতো স্বপ্ন দেখেছি! একদিন মায়ের কাছে ফিরবো। আমাদের দু’জনের ছোট্ট একটা সংসার হবে। সেই সংসারে কোনো হিংসা থাকবে না। কোনো বিবাদ থাকবে না। শুধু শান্তি থাকবে। মা আর মেয়ের ভালোবাসা থাকবে। কিন্তু বাবা আমার সব স্বপ্ন আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিলো। লোকটার সাথে আমার এনগেজমেন্ট করিয়ে দিলো। মা, মানুষটা ভালো না। একদম ভালো না। আমি কি একটু ভালোবাসা ডিজার্ভ করি না? মানুষটা আমাকে ভালোবাসে না। তার জন্য ভালোবাসা মানে সুন্দর মুখ আর দেহ। আমি তো সাধারণ মানুষ চাই। একদম আফিফের মতো। সিম্পল, নব্বই দশকের ভালোবাসা চেয়েছি। যে আমার সাথে চাঁদ দেখবে, গান শুনবে, আমার ছবি আঁকা দেখবে, আমার সাথে সমুদ্র পাড়ে বসে সমুদ্র বিলাস করবে। আমি কি খুব কঠিন স্বপ্ন দেখে ফেলেছি? আমার সাথে ভাগ্য এমন বেইমানি কেন করলো, মা? আফিফকে পাই নি। ঠিক আছে। মেনে নিলাম সেটা। অন্তত একটা ভালো মানুষ তো পেতে পারতাম। মা, দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার। কেন সেদিন আমাকে মেরে ফেলো নি? কেন আমাকে পৃথিবীতে এনেছো? কেন আমাকে মিস্টার কবিরের কাছে ফেলে চলে গেছো?”
সালমা ফাওজিয়া কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললেন,
“আম্মু, এই আম্মু, এভাবে কাঁদছো কেন? চুপ করো। আমি আছি তো। আমি আমার মেয়েকে নিয়ে আসবো। আমি তোমার বাবার সাথে কথা বলবো।”
“এতোদিন কি পেরেছিলে? তাহলে এখন কীভাবে পারবে? একদিকে বাবা, অন্যদিকে তাজওয়ার খান। বাবার সাথে যুদ্ধ করতে পারো নি, তাহলে ডনের সাথে পারবে? মিস্টার কবির তো আমার বাবা। সে-ই আমার কথা ভাবে নি। আর এই মানুষটা তো আমার কেউ না। সে শুধু তার শখ পূরণের জন্য আমাকে কিনে নিয়ে যাচ্ছে। নিলাম হয়ে গেছি আমি।”
তাজওয়ার আহির রুমে ঢুকে শেষ কথাটি শুনে ফেললো। আহির সামনে বসে হুট করে ফোনটা টেনে নিলো। আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“আমার কথা শেষ হয় নি।”
তাজওয়ার বলল,
“নিলাম হওয়ার কথা কেন বলছো?”
তাজওয়ার ফোন কানের কাছে নিয়ে বলল,
“হ্যালো মাদার-ইন-ল, আপনি নিশ্চিন্তমনে ঘুমান। আহিকে আমি রানীর মতো রাখবো।”
সালমা ফাওজিয়া দৃঢ় কন্ঠে বললেন,
“ফেরাউনও রাজা ছিল। আসিয়া ছিল তার রানী। শোনা, আমার মেয়েকে রানীর মতো রাখার জন্য রাজার প্রয়োজন নেই। আর তোমার মতো রাজা কোনো নারীকেই রানী করে রাখতে পারবে না। আমার মেয়েকে সে-ই রানী করে রাখবে, যার যোগ্যতা আছে মনের রাজা হওয়ার। দেশের রাজা নয়।”
তাজওয়ার কল কেটে দিলো। এরপর আহির দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর বলল,
“মাদার-ইন-ল’কে আমার বিরুদ্ধে বেশ কিছু বুঝিয়ে ফেলেছো, দেখছি। এটা ঠিক করো নি, আহি।”
আহি করুণ দৃষ্টিতে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে রইলো। এদিকে সালমা ফাওজিয়া কল কেটে যাওয়ায় হতাশ হয়ে পড়লেন। ফোনটা বুকের সাথে চেপে ধরে কাঁদতে লাগলেন। তার কান্নার আওয়াজ পেয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলেন রোকেয়া আফজাল। মেয়েকে কাঁদতে দেখে রোকেয়া ব্যস্ত কন্ঠে বললেন,
“আরেহ, কাঁদছিস কেন সালমা?”
সালমা ফাওজিয়া মাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
“আমার মেয়ে ভালো নেই, মা। তোমরা তো কেউ চাও না আমি ওর সাথে যোগাযোগ রাখি। কিন্তু আমার মেয়েটার কি অপরাধ, বলো? ওই রিজওয়ান কবির আমার মেয়েটাকে শেষ করে দিচ্ছে। আমি কেমন অসহায় মা! আমার মেয়েকে সাহায্য করতে পারছি না। আমার ওই ফেরাউনকে জিজ্ঞেস করা উচিত, কেন এমন করছে।”
রোকেয়া আফজাল কাঁপা কন্ঠে বললেন,
“পাগল হয়ে গেছিস? তোর ভাইদের মেরে ফেলবে। তোকে মেরে ফেলবে। আমি স্বামী হারিয়েছি। সন্তান হারাতে পারবো না। কতো বছর হয়ে গেছে, তোর বাবার কোনো হদিসই পেলাম না।”
সালমা ফাওজিয়া চোখ মুছে বললেন,
“আমিও স্বামী হারিয়েছি। সন্তান হারাতে পারবো না।”
সালমা ফাওজিয়া রিজওয়ান কবিরের নম্বরে ডায়াল করলেন। তার ফোন বন্ধ। হঠাৎ তার মনে পড়লো, একটু আগে যেই নম্বর থেকে কল এসেছে ওটা বিদেশি নম্বর। সালমা ফাওজিয়া নম্বরটি দেখে বুঝলেন, আমেরিকান নম্বর। তার কাছে রিজওয়ান কবিরের সব দেশের সিম নম্বর আছে। সালমা ফাওজিয়া ফোন বুক ঘেঁটে সেই নম্বরগুলো বের করলেন। তিনটা নম্বর আছে। দ্বিতীয় নম্বরটিতে কল করতেই রিং হলো। এরপর কল কেটে ফোনে বেশি করে টাকা ঢুকালেন। তারপরও মনে হচ্ছে দুই মিনিটের বেশি কথা বলা যাবে না। যতোক্ষণ বলা যায়, তিনি ইচ্ছেমতো শুনিয়ে দেবেন।
সালমা ফাওজিয়া আবার কল করলেন। ওপাশ থেকে রিজওয়ান কবিরের কন্ঠ ভেসে এলো। সালমা ফাওজিয়া রাগী সুরে বললেন,
“কেন আমার মেয়েকে জোর করে বিয়ে দিচ্ছো? আর তুমি আমাকে না জানিয়ে এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারো না। আমি আহির মা।”
রিজওয়ান কবির খুব স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন,
“হাইপার হচ্ছো কেন? এখন তো জেনেছো। বাসায় আসো। মেয়েকে শুভ কামনা দিও। সাথে বিয়েটাও এটেন্ড করবে। আহির মাস্টার্স শেষ হলেই বিয়ে হবে। তোমার কাছে বিশেষভাবে বিয়ের কার্ড পৌঁছে যাবে। আর এনগেজমেন্টে বাইরের মানুষ আসে নি। আর তুমি তো বাইরের একজন। ভুলে যেও না, আহির কাস্টাডি আমি পেয়েছি।”
“পেয়েছো। কিন্তু এখন ও এডাল্ট। ও আমার সাথে থাকতে চাই। আর তুমি ওকে আমার কাছেই আসতে দাও না। এখন তো ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে দিচ্ছো। তুমি অনেক অন্যায় করেছো। আল্লাহ তোমাকে ছাড়বে না।”
“দেখা যাক, আল্লাহ আমার কি ক্ষতি করতে পারে?”
সালমা ফাওজিয়া কিছু বলার আগেই কল কেটে গেলো। কল কেটে যাওয়ায় তিনি রাগে ফোনটা দূরে ছুঁড়ে মারলেন। এরপর দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
“আমি আমার মেয়েকে বাঁচাবো। এর জন্য আমার যা যা করার আমি করবো।”
(***)
তাজওয়ার বন্ধুদের সাথে আড্ডায় ব্যস্ত। রিজওয়ান কবির তার কাছে গিয়ে বললেন,
“তাজওয়ার, একটু এদিকে এসো। তোমার সাথে কথা আছে।”
তাজওয়ার উঠে রিজওয়ান কবিরের সাথে একপাশে গিয়ে দাঁড়ালো। রিজওয়ান কবির বললেন,
“আহির কাছে ফোন নেই, তুমি কি ওকে ফোন দিয়েছিলে?”
“হ্যাঁ, কেন?”
“তুমি কি জানো, আহি তার মায়ের সাথে কথা বলেছে?”
“হ্যাঁ, জানি।”
“শোনো, তাজওয়ার। আহি যদি ওর মায়ের আশেপাশে থাকে তাহলে কিন্তু, তুমিই ওকে হারাবে।”
“কেন?”
“সালমা যদি আহিকে নিয়ে যেতে পারে, তাহলে আমাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে আহি। আমি তো আহিকে ভয় দেখিয়ে আটকে রেখেছি।”
তাজওয়ার হাসলো। রিজওয়ান কবির ভ্রূ কুঁচকে বললেন,
“হাসছো কেন?”
“আমি কিন্তু কাউকে ভয় পাই না। না আইন, না কারো শাসন। আমার রাজ্যে আমিই শাসক, আইনও আমার, দণ্ডও আমিই দেবো। সো ডোন্ট ওয়ারি। আহি এতো সহজে আমাকে ছেড়ে যেতে পারবে না। আর আমার প্রিয় মাদার-ইন-ল যা এতো বছর পারে নি, তা এখন আমার রাজ্যে এসে তো কখনোই পারবে না। সো আপনি এসব নিয়ে চিন্তা করবেন না। আমার সম্পদ আমি আগলে রাখতে জানি।”
৬৯।
আজই দেশে ফিরেছে আহি। দেশে ফিরতেই ফোন হাতে পেলো সে। ফোন পেতেই প্রথমে রাদকে কল করলো। রাদ এই কয়েকদিন ফোনের কাছ থেকে এক সেকেন্ডের জন্যও দূরে ছিল না। সবসময় ফোন সাথে রেখেছে। নামাজের সময় বোনের হাতে ফোন দিয়ে বলেছিল, আহির কল আসলেই যাতে রিসিভ করে কথা বলে। অস্থির লাগছিল রাদের। আজ ফোনের স্ক্রিনে আহির নম্বরটি দেখেই দেহে প্রাণ ফিরে পেলো রাদ৷ সাথে সাথেই কলটা রিসিভ করলো। আহি ওপাশ থেকে বলল,
“রাদ, দেখা করতে পারবি একটু?”
রাদ ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“হ্যাঁ, হ্যাঁ। বল কোথায় আসবো?”
“ক্যাম্পাসের পাশের পার্কটাতে।”
“আচ্ছা, আমি এক্ষুণি আসছি।”
(***)
রাদ আগে এসেই বসে ছিল পার্কে। আহি এই মাত্র রিকশা থেকে নামলো। ভাড়া মিটিয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে রাদকে দেখতে পেয়েই আপনা-আপনি চোখে পানি চলে এলো আহির। মনে হচ্ছে, জেল থেকে বেরিয়ে কোনো আপন মানুষ দেখেছে। আহি আশপাশ না দেখে দৌঁড়ে গেলো রাদের দিকে। দৌঁড়ে যেতে যেতেই কান্না করছে সে। এরপর রাদের কাছে এসে ঝাপ্টে জড়িয়ে ধরলো তাকে। ফুঁপিয়ে বলতে লাগলো,
“আমাকে বাঁচাবি রাদ? আমি সত্যিই এবার বাঁচতে চাই। আমার কিচ্ছু লাগবে না। প্রেম-ভালোবাসার প্রয়োজন নেই আমার। কাউকে চাই না আমি। শুধু আমার সম্মানটা বাঁচলেই হলো। আমার এই দেহটা বাঁচা। আমার মনটা তো ক্ষত হয়ে গেছে। দেহটাও ক্ষত হয়ে গেলে, আমার কোনো অস্তিত্বই থাকবে না।”
রাদ আহিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
“কি করেছে ও তোর সাথে? আমাকে বল, আহি। আমি মেরে ফেলবো শয়তানটাকে।”
আহি রাদকে ছেড়ে তার হাত ধরে বলল,
“যা করেছে তাতেই আমার দম বন্ধ হয়ে গেছে। যদি সত্যিই এর চেয়ে বেশি কিছু হয়, আই সওয়ার আমি নিজের প্রাণ নিতে বাধ্য হবো।”
এদিকে পুষ্প আর লাবীবও ঘুরতে বের হয়েছিল আজ। কাকতালীয় ভাবে হাঁটতে হাঁটতে তারা ক্যাম্পাসের পার্কেই ঢুকলো। রাদ এবং আহিকে একসাথে দেখে দু’জনই অবাক। আর আহিকে পা ধাপিয়ে কাঁদতে দেখে আরো অবাক হলো তারা৷ দৌঁড়ে গেলো তাদের দিকে। পুষ্প আর লাবীবকে দেখে আহি আর রাদ চুপ হয়ে গেলো। আহি চোখ মুছে অন্যদিকে মুখ ঘুরালো। পুষ্প তা দেখে আহির হাত ধরে তাকে একপাশে টেনে নিয়ে গেলো। আহি নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। পুষ্প বলল,
“আমাকে দেখে চোখ মুছে ফেলেছিস? কেন আহি? কি হয়েছে, আমাকেও জানা! আমি কি তোর বন্ধু না?”
আহি মলিন মুখে পুষ্পের দিকে তাকালো। কেন যেন কান্নাটা আটকে রাখা দায়। আহি পুষ্পকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। পুষ্প আহির পিঠে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। পুষ্প আহিকে একটা বেঞ্চে বসিয়ে বলল,
“বল, কি হয়েছে!?”
আহি কাঁপা কন্ঠে পুষ্পকে সবটা জানালো। যেই কথা রাদকে পরিষ্কার ভাবে বলতে পারে নি, তার সবটাই পুষ্পকে বললো। সব শুনে পুষ্পের চোখে অশ্রু ভীড় করলো। সে সান্ত্বনার সুরে বলল,
“কাঁদিস না। দেখিস পথ একটা বেরিয়ে আসবেই।”
“কখন আসবে?”
“এই মুহূর্তে একটাই পথ খোলা আছে, যদি তুই পারিস।”
“বল না।”
“কেইস করে দে।”
“বেশ তো। করতে সমস্যা নেই। উকিল কোথায় পাবো?”
“ভাইয়া।”
আহি ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। পুষ্প বলল,
“উজ্জ্বল ভাইয়া অবশ্যই এর সলিউশন বের করবে।”
“তাজওয়ার আর বাবার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মতো সাহস কারো নেই। আমি দেশের সনামধন্য উকিলের কাছে গিয়েছি। সে আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে।”
“দেখ আহি। এসব আমি বুঝি না। সবাই কিন্তু টাকার পেছনেই ছুটে। আমার ভাইটা আলাদা। ও তোর জন্য সব করবে। একবার এই ব্যাপারে জানিয়েই দেখ। আর উজ্জ্বল ভাইয়া অনেক বুদ্ধিমান। একটা কেইসও এখনো হারে নি। সিলেটের চেয়ারম্যানের ছেলের বিরুদ্ধে একটা মামলা হয়েছিল। ওটাতে ধরাশায়ী করে দিয়েছিল। পেপারে ছবিও ছাপিয়েছিল ভাইয়ার। ক্রেস্টও পেয়েছে। নিজের চেম্বার নিতে পেরেছিল। বেশ চলছে ওর। নিশ্চিত তোর কেইসটা জিতে যাবে।”
“যদি উনার কিছু হয়ে যায়? আমার জন্য কারো ক্ষতি হোক আমি চাই না।”
“ধুর গাধী। আইন আর বিচার বিভাগের সাথে যারা জড়িত তারা এসব চিন্তা করে না। এসব চিন্তা করলে সুখী ক্যারিয়ার বেছে নিতো। কে বলেছে তাকে উকিল হতে? সিলেটে ভাইয়ার শত্রু কি কম? ভাইয়া এসব পাত্তায় দেয় না। আর একবার কেইস জিতে গেলে তাজওয়ার আর তোর বাবা কিচ্ছু করতে পারবে না। এরপর সু্যোগ বুঝে তুই আন্টিকে নিয়ে দেশের বাইরে চলে যাবি। আর ভাইয়াও দেশে থাকবে না। উনি অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার প্ল্যান করছে। তোর কেইসটাই না হয় ভাইয়ার দেশের লাস্ট কেইস হবে।”
আহি পুষ্পকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“উনাকে আজই বলিস। আমি আর পারছি না, পুষ্প।”
এদিকে রাদও কাঁদছে। লাবীব তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
“দেখ ঠিক হয়ে যাবে সব।”
রাদ বলল,
“এই কথা আর বলিস না। কিচ্ছু নিজের ইচ্ছেমতো হচ্ছে না। আমার কোনো যোগ্যতায় নেই আহিকে বাঁচানোর? কেমন বন্ধু আমি? কোনো কাজের না। বুঝতে পারছি না কি করবো। মাথাটা হ্যাং হয়ে যাচ্ছে।”
“হুম, শত্রু যদি ক্ষমতাবান হয়, তখন দুর্বল মানুষদের করার মতো কিছুই থাকে না।”
চলবে-