উধয়রনী পর্ব-৩০+৩১

0
363

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৩০(১ম ভাগ)||

৬০।
চট্টগ্রামে ফিরেই রাদ আর আহি নায়ীবের সাথে দেখা করতে গেলো। নায়ীব তাদের দেখেই সৌজন্যমূলক হাসি ফেরত দিলো। আহি মুচকি হেসে বলল,
“আপনাকে ধন্যবাদ দিলেও কম হবে।”

নায়ীব আহির দিকে ভালোভাবে তাকিয়ে প্রেসক্রিপশনে কিছু লিখতে লাগলো। রাদ আহির হাত ধরে নায়ীবের উত্তরের অপেক্ষায় বসে আছে। নায়ীব রাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“মিস ওয়াসিকা কবির যার সাথে বেশি ভালো থাকে, তার সাথেই সময় কাটাবে।”

নায়ীব এবার আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপনি বলেছেন বাবা আপনাকে মায়ের সাথে দেখা করতে দেয় না। অথচ আপনি আমার থেরাপি ছাড়াই যতোদিন মায়ের সাথে ছিলেন, ভালো ছিলেন। আসল সমস্যা আপনার বাসায়। আমি আপনাকে শুরুতে জানায় নি, কারণ আপনি যদি এটা মস্তিষ্কে গেঁথে ফেলতেন, তাহলে এই এক্সপেরিমেন্টে কোনো কাজ হতো না।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো, “বাসায় সমস্যা বলতে?”

“আপনি নিশ্চয় সেই স্থানে ভালো নেই। এই মুহূর্তে আপনার জন্য আপনার মায়ের সাথে থাকা জরুরি। যখনই মনে হবে আপনি প্যানিক হচ্ছেন, ভালো লাগছে না। আমি সাজেস্ট করবো মিস্টার রাদ অথবা আপনার মা যাতে আপনার পাশে থাকে। কারণ এই দু’জনই আপনাকে ম্যান্টালি সাপোর্ট করে।”

নায়ীব প্রেসক্রিপশনটি আহির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আমার টিপস ফলো করবেন।”

আহি প্রেসক্রিপশন দেখে ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“মেডিসিন তো নেই!”

“আপনার মেডিসিন আপনি নিজেই। আর এই টিপসগুলো। সকালে উঠেই প্রয়োজনীয় কাজ সেরে মেডিটেশন করবেন। এটা প্রতিদিনই যাতে দিনলিপিতে যুক্ত হয়। নাস্তা খাওয়ার আগে বাইরে হেঁটে আসবেন। একদমই অলসতা দেখাবেন না। যদি ক্লাস থাকে, সেদিন আরো আগে উঠবেন। তাও এই দুইটা কাজ অবশ্যই করবেন। এরপর বাকি আপনার জরুরি কাজ থাকলে করবেন। কাজের ফাঁকে বাগানে সময় তো দিবেনই। সেই মুহূর্তে রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনতে পারেন বা আপনার প্রিয় গায়ক বা গায়িকার গান। তবে এই জায়গায় আপনি কোরআন তিলাওয়াত শুনতে পারেন। এটা আপনার মনকেও শান্ত করবে, সাথে সওয়াবও পাবেন। আপনার ইচ্ছা, আপনি যেটা করতে ইচ্ছুক। আর অবসরে ভালো কিছু মুভি দেখতে পারেন। প্রেম সম্পর্কিত মুভি না দেখায় আপতত আপনার জন্য ভালো হবে। আর অবশ্যই আপনার শখকে প্রাধান্য দিবেন। যেহেতু আপনি ছবি আঁকেন, তাহলে সেখানেই বেশি ফোকাস করবেন। যেই ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলে আপনি মানসিক শান্তি পান, তার সাথে প্রতিদিন কথা বলবেন। আর সে যদি মিস্টার রাদ হয়ে থাকে, তাহলে বলবো, প্রতিদিন একসাথে কোনো এক বেলা খাওয়া-দাওয়া করবেন। সুযোগ না হলে এক কাপ চা একসাথে খাবেন। ট্রাস্ট মি, এর চেয়ে চমৎকার মুহূর্ত আপনি আর পাবেন না। এরপর আসি ভয়ংকর সময়ে, রাত দশটার পর প্রায়ই মানুষ ডিপ্রেশনে চলে যায়। বা গভীর রাত জাগার অভ্যাস থাকলে আপনা-আপনি মন খারাপ হয়ে যায়। সাজেস্ট করবো, সেই সময় প্যারানরমাল বা থ্রিলার মুভি দেখবেন। অথবা কমিকস পড়বেন। আর যাই করবেন রাতে আপনি গান শুনবেন না, ছবিও আঁকবেন না। সেই মুহূর্তটা আপনাকে আরো বেশি ইমোশনাল করে ফেলবে। কারণ ছবি আঁকার সাথে আপনার অতীতের সম্পর্ক আছে। আর গান শুনলে স্বাভাবিক মনটা আরো ভারী হয়ে আসে। কিন্তু দিনের বেলায় এই কাজ করলে আপনার তেমন অনুভূত হবে না। কারণ আলোর প্রভাব। এবার আসি পরিবেশে। প্রথম কাজ দেয়ালের রং পরিবর্তন করবেন। মনের মতো ঘর সাজাবেন। জানালা খোলা রাখবেন। পর্দা চেঞ্জ করবেন। রাতে বেশি আলো জ্বালাবেন। যেমন দুইটা বাতি জ্বালিয়ে রাখবেন। রঙ-বেরঙের বাতি জ্বালিয়ে রাখতে পারেন। তবে নয়টার পর আলো কমিয়ে দেবেন। অনেকে সাজেস্ট করে বিড়াল পোষার জন্য বা পাখি কিনে আনার জন্য। আমি করবো না। আমার নিজের একটা বিড়াল আছে। ও অসুস্থ হলে, আমি নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়ি। তাই এই মুহূর্তে নিজেকে সময় দিবেন। অন্য কিছুতে না।”

আহি মুচকি হেসে বলল,
“ধন্যবাদ। আমি ফলো করবো এই টিপসগুলো।”

“এবার আপনি একটু বাইরে গিয়ে বসুন। আমি মিস্টার রাদের সাথে কিছু কথা বলবো।”

আহি বাইরে যেতেই নায়ীব রাদকে বলল,
“মিস ওয়াসিকা এখনো পুরোপুরি সুস্থ হোন নি। এমনকি আপনাকে দেখেও মনে হচ্ছে, মানসিক চাপে আছেন। চাপটা যে মিস ওয়াসিকাকে নিয়ে তা আমি বুঝতে পেরেছি। এবার দুইটা কথা বলবো, যতো শীঘ্রই সম্ভব তাকে তার বাবার বাসা থেকে নিয়ে আসা উচিত। মিস ওয়াসিকা সেই ছেলেটাকে এতো সহজে ভুলতে পারবে না। সে শুধু বাস্তবতা মেনে নিয়েছে। সহজে কাউকে ভুলে যাওয়া যায় না। একজন সুস্থ মানুষ সবকিছুর ভীড়ে ব্যস্ত থাকে। কিন্তু প্রাক্তনকে দিনের একটা সময় তার মনে পড়বেই। এটা একদম ন্যাচেরাল। আর সেখানে মিস ওয়াসিকার অনুভূতি অন্য পর্যায়ে চলে গেছে। সেটা এখন আধ্যাত্মিক অনুভূতি। এখান থেকে সহজে বের হওয়া যায় না। যদি একই অনুভূতি সে অন্য কারো জন্য অনুভব করে, তবেই এটা সম্ভব। কিন্তু ন্যাচেরালি মিস ওয়াসিকা অনেক লয়েল। এই দিক থেকে মেয়েটা লয়েল থাকবে৷ এখন বিয়ে বা নতুন কোনো সম্পর্ক এই দুইটা চাপ আপতত তার ঘাড়ে না চাপালেই হলো।”

রাদ নায়ীবের সাথে হাত মিলিয়ে বলল,
“ধন্যবাদ আপনাকে। অনেক বড় উপকার করেছেন। আমি অবশ্যই আহির খেয়াল রাখবো।”

নায়ীব মৃদু হাসলো। রাদ চেম্বার থেকে বের হয়েই আহির দিকে তাকালো। মনটা ভারী ভারী লাগছে তার। মনে মনে ভাবছে,
“সত্যিই কি আহি আমার প্রেমে পড়বে না? আমি কি এইটুকু স্বপ্ন দেখতে পারবো না? এখন তো বলতেও পারবো না, আমি ওকে ভালোবাসি। যদি বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যায়? যদি ও আবার মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে?”

৬১।

ভাদ্র বিদায় হলো চোখের পলকে। প্রকৃতি ছেয়ে গেলো উষ্ণ আবহাওয়ায়। আহি ঘেমে নেয়ে ক্যাম্পাস থেকে সবে মাত্র বাসায় ঢুকলো। তখনই চুনি এসে বলল,
“আফা দেহেন গিয়া কে আইছে।”

আহি ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে বলল,
“কে আর আসবে? অতিথি মানেই তো বাবা আর মিসেস লাবণির ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আমার আপন কেউই এই বাসায় আসে না।”

চুনি মুখ চেপে হেসে বলল,
“আপনের আপন মানুষ আইছে।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো, “মা এসেছে!”

“আরেহ না।”

“তাহলে কে?”

“গিয়া না হয় দেখি আসেন।”

আহি লিভিং রুমে উঁকি দিতেই দেখলো, তাজওয়ার, তার মা রেহানা খান, আর দোয়েল বসে আছে। আহি তাদের দেখে পেছন ফিরে দাঁতে দাঁত চেপে চুনির দিকে তাকালো। দোয়েল আহিকে দেখেই বলে উঠল,
“আহি চলে এসেছে।”

দোয়েলের ডাকে আহি চোখ-মুখ কুঁচকে লিভিং রুমে ঢুকলো। সৌজন্যমূলক হাসি ফেরত দিয়ে রেহানা খানকে সালাম দিলো। রেহানা খান আহির কাছে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
“রিজওয়ান ভাই, আপনার মেয়েটা বেশি লক্ষ্মী।”

আহি মুখ বাঁকিয়ে মনে মনে বলল,
“তাই তো তোমার শয়তান ছেলের জন্য আমাকে নিয়ে যেতে চাইছো!”

রেহানা খান আহিকে টেনে নিজের পাশে বসালেন। তাজওয়ার হুট করে রিজওয়ান কবিরের পাশ থেকে উঠে আহির গা ঘেঁষে বসে পড়লো। আহি চোখ বড় বড় করে তাজওয়ারের দিকে তাকালো। আহির তাকানো দেখে তাজওয়ার মুচকি হাসি ফেরত দিলো। আহি এবার রিজওয়ান কবিরের দিকে তাকালো। রিজওয়ান কবির ভাবলেশহীন ভাবে বসে আছেন। আহির রাগ উঠলো। এ কেমন বাবা তার? একটা ছেলে তার গা ঘেঁষে বসে আছে, আর তার বাবার কোনো প্রতিক্রিয়ায় নেই! আহি এবার বিরক্ত মুখে তাজওয়ারের দিকে তাকালো। মনে মনে বলল,
“বিন্দুমাত্র ভদ্রতা নেই এই ছেলের।”

এদিকে রেহানা খান হঠাৎ আহির হাতে একটি সোনার বালা পড়িয়ে দিয়ে বললেন,
“আগামী মাসের দ্বিতীয় শুক্রবার তাজওয়ার আর আহির এনগেজমেন্টটা হলে ভালো হয়।”

আহি রেহানার কথা শুনে ভ্রূ কুঁচকে তার দিকে তাকালো। লাবণি আহির চাহনি দেখে বলল,
“আহি এখন থেকেই ড্রেস সিলেক্ট করে ফেলো। তাজওয়ারকে নিয়ে যা যা লাগবে কিনে ফেলো। এনগেজমেন্ট আমেরিকায় হবে। সিরাজ ভাইয়া তো দেশে আসতে পারবেন না তাই।”

আহি মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“দেশে আসবে কিভাবে? আসলেই তো তার ঠিকানা সোজা জেলখানায়।”

আহির কথা শুনে রিজওয়ান কবির রাগী দৃষ্টিতে আহির দিকে তাকালেন। তাজওয়ার পরিস্থিতি সামলানোর জন্য বলল,
“আহি, আসলেই তুমি অনেক ফানি। তোমার হবু শ্বশুড় কিন্তু এমন মজা অনেক পছন্দ করেন। তুমি এক কাজ করো, আমেরিকায় গিয়ে বাবাকে এরেস্ট করে নিয়ে এসো।”

“যদি ক্ষমতা থাকতো ক্রসফায়ারে দিয়ে দিতাম। এরেস্ট করে সময় নষ্ট করতাম না।”

রিজওয়ান কবির ধমকের সুরে বললেন,
“আহি, এসব কেমন বেয়াদবি?”

আহি উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“তুমি অন্তত এমন অসভ্য লোকের সাথে আমাকে বিয়ে দেওয়ার চিন্তা করে, আমার কাছ থেকে সভ্য ব্যবহার আশা করবে না। এখন থেকে আমি এভাবেই কথা বলবো।”

রিজওয়ান কবির উঠে দাঁড়িয়ে আহিকে চড় মারতে যাবেন তার আগেই তাজওয়ার তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“প্লিজ আংকেল। রিল্যাক্স। আপনি তো এখন আহির দায়িত্ব আমাকে দিয়েছেন। ওকে শাসনটাও না হয় আমিই করি।”

আহি রাগী স্বরে বলল,
“তুমি আমাকে শাসন করার কে?”

তাজওয়ার সবার সামনে আহিকে পাঁজা কোলা করে নিয়ে লিভিং রুম থেকে বেরিয়ে এলো। এরপর আহিকে নিয়ে ছাদে চলে গেলো। ছাদে এসেই আহিকে রেলিঙের উপর বসিয়ে আহিকে আবদ্ধ করে রেলিঙের দুই পাশে হাত রেখে তাজওয়ার বলল,
“তুমি জানো, আমি কতোটা হিংস্র। কিন্তু তবুও আমি বড়দের সামনে ভদ্র আচরণ করি। আর তুমি আমার মায়ের সামনে এভাবে কথা বলছো! মা কি মনে করবে?”

“যা ইচ্ছে মনে করুক। যা ভাবার ভেবে এই বিয়েটা ভেঙে দিক।”

তাজওয়ার হাসলো। আহি ভ্রূ কুঁচকে তাজওয়ারের দিকে তাকালো। তাজওয়ার বলল,
“তুমি এতোটা বোকা হবে, তা আমি জানতাম না। বিয়েটা আমার ইচ্ছাতেই হচ্ছে। আমার ইচ্ছার উপর কথা বলার সাহস কারো নেই। কেউ মেনে নিক, না নিক। আমি তোমাকে যে-কোনো মূল্যে নিজের করেই ছাড়বো। কারো ক্ষমতা নেই আমাকে আটকানোর।”

আহি বুঁকে হাত গুঁজে বলল,
“ক্ষমতা আছে। ভাগ্যের লিখন না যায় খণ্ডন। এই কথা তো জানোই। আল্লাহ যদি আমার সাথে থাকে, তুমি আমাকে স্পর্শও কর‍তে পারবে না।”

তাজওয়ার আহির কোমর আঁকড়ে ধরে আহির গালে জোর করে নিজের ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে বলল,
“করলাম স্পর্শ। পেরেছো নিজেকে মুক্ত করতে?”

“তোমার মতো শয়তানরা একবার সফল হয়েই নিজেকে ক্ষমতাবান মনে করে। একবার আমাকে সফল হতে দাও। ওয়াদা করছি, তোমাকে তোমার জায়গা দেখিয়ে দিবো।”

তাজওয়ার বাঁকা হেসে বলল,
“এমন গালগল্প না শুনলে রাতে ঘুম আসে না। এমন গাজাখুরি গল্প শোনার জন্য হলেও আমার তোমাকে চাই।”

(***)

ফোনের স্ক্রিনে আহির নাম ভেসে উঠতেই রাদ তাড়াতাড়ি কলটা রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে আহির কান্না ভেজা কন্ঠ শুনে মুহূর্তেই রাদের বুকটা ভারী হয়ে হলো। উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“আহি, কাঁদছিস কেন?”

“ভাই আমার লাইফটাই অভিশপ্ত। যন্ত্রণা শব্দটা থেকে আমি এক সেকেন্ডের জন্যও মুক্তি পাই না।”

“হয়েছে কি বলবি?”

“আগামী মাসে তাজওয়ার আর আমার এনগেজমেন্ট।”

কথাটি শুনেই মুহূর্তের জন্য রাদের মুখটা অন্ধকারে ছেয়ে গেলো। পরক্ষণেই সে বলল,
“আরেহ ধুর, আগেও তো এনগেজমেন্ট ফিক্সড হবে বলেছিল, ওটা তো হয় নি।”

“আগের বার বাবা ওদের দাওয়াত দিয়েছিল। এবার ওরাই এসেছে।”

রাদ থমথমে কন্ঠে বলল, “কি করবি এখন?”

“চেয়েছিলাম মাস্টার্স শেষ করেই ইউকে তে শিফট হয়ে যাবো। ওখানে গেলে তাজওয়ার আমার কোনো ক্ষতি করতে পারতো না৷ এখন তো বাবা আমাকে ইচ্ছে করে দেশে এনেছে, যাতে আমি পালাতে না পারি। জানিস, আমার পাসপোর্টটাও আমার কাছে নেই।”

রাদ মলিন মুখে বললো,
“কি সাজেশন দিবো তোকে। আমার নিজেরই তো মাথা ঘোরাচ্ছে।”

“সিনেমাতে কতো দেখি বিয়ের দিন বর-কনে পালটে ফেলা যায়। যদি ওরকম সুযোগ থাকতো!”

“হুহ, তোকে উড়না গায়ে ঝুলাতে দেয় না, আর লম্বা ঘোমটা টেনে বিয়ে কর‍তে বসাবে? আর কবুল বলার সময় নামটা কি সাইলেন্টলি পড়বে না-কি?”

“সিনেমায় যে কীভাবে হয়! এখন কোনো আইডিয়া দে না। ওই অজগরের কাছ থেকে কীভাবে মুক্ত হবো আমি?”

“আমাকে একটু সময় দে ভাবার। তুই চিন্তা করিস না। একদম লাস্ট কোনো অপশন না থাকলে তোকে আমিই বিয়ে করে ফেলবো। মেয়েদের তো আর দ্বিতীয় বিয়ে দেওয়া যাবে না। তখন তাজওয়ার তোকে আর বিয়েই কর‍তে পারবে না।”

“হ্যাঁ, কতো সাহস তোর! তোকে ওই অজগর গিলে ফেলবে। তারপর আমাকে তুলে নিয়ে যাবে।”

“আমাকে বাঁচাতে তুইও ওই অজগরের মুখে ঢুকে যাবি আর কি। তারপর আমরা দু’জন ওই অজগরের পেটে ঢুকে তার পেট ফুঁটো করে বেরিয়ে আসবো।”

“বাহ কোন পুরাণকাহিনি বলছিস। এটা একবিংশ শতাব্দী।”

রাদ আহিকে আশ্বস্ত করে বলল,
“দেখ আহি, আমাকে একটু ভাবতে দে। আমি তোকে মুক্ত করবো। এটা আমার প্রমিজ।”

আহির সাথে কথা বলা শেষে রাদ বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। আজ আর তার ঘুম হবে না। আহি ঠিকই বলেছে, কাউকে ভালোবাসার মতো যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতি দ্বিতীয়টা নেই। আহি আফিফকে ভালোবেসে কষ্ট পাচ্ছে, আর রাদ অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। রাদের ভালোবাসা প্রকাশ করার মতো ভালো সময়, ঝঞ্জাটহীন পরিবেশ এখন আহির জীবনে নেই। আহি ব্যস্ত নিজেকে তাজওয়ার নামক বিষাক্ত মানুষটির কাছ থেকে মুক্ত করতে। আফিফকে ভালোবেসে আহি কম আঘাত পায় নি। এর মধ্যে রাদ তার ভালোবাসার কথা জানানোর সাহস পাচ্ছে না। ভীষণ অস্থির লাগছে তার। ভাগ্য তাকে কোন পরিস্থিতিতে এনে দাঁড় করিয়েছে! রাদ আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আহি, আমি না তোকে ভীষণ ভাবে চাই। আশ্বিনের শীতল হাওয়ায়, তোকে খুঁজে পেতে চাই। কুয়াশার ভীড়ে তোর হাতটা ধরতে চাই। বসন্তের ফুল তোকে বিলাতে চাই। জ্যোষ্ঠের রোদ থেকে তোকে বাঁচাতে তোর ঢাল হতে চাই। শ্রাবণ বেলায় তোর সাথে ভিজতে চাই। যতোই দূরত্বের পথ হোক, আমার মনের গন্তব্য তুই। আহি তুই কখন আমার হবি? কখন বাদলা দিনে তোর সিক্ত মুখখানা ছুঁয়ে দিবো? কখন তোকে বলতে পারবো, ভালোবাসি?”

(***)

সকালে ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে বের হলো পুষ্প। গাড়ির জন্য ফুটপাতের উপর দাঁড়িয়ে রইলো সে। হঠাৎ একটা মোটরসাইকেল তার সামনে থেমে তার হাত থেকে তার ব্যাগটা টেনে নিয়ে নিলো। জোরে টান পড়ায় পুষ্প ভারসাম্য হারিয়ে ফুটপাত থেকে ছিঁটকে পড়লো রাস্তায়। ভাগ্যিস রাস্তায় গাড়ি কম ছিল। নয়তো পুষ্পের জন্য এই দিনটায় শেষ দিন হতো। পুষ্প রাস্তার উপর শুয়ে চেঁচাতে লাগলো। সেই মুহূর্তেই লাবীব তার মোটরসাইকেল নিয়ে সেই পথ দিয়েই যাচ্ছিলো ভার্সিটির উদ্দেশ্যে। পুষ্পকে দেখে সে মোটরসাইকেল থেকে নেমে তাকে উঠিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“বাসায় কি ঘুমানোর জন্য বিছানা ছিল না?”

পুষ্প লাবীবের কথা শুনে তাকে ধাক্কা দিয়ে তার হাতে ঘুষি মেরে বলল,
“ওই অন্ধ খাটাশ, কেউ শখ করে রাস্তায় শুয়ে থাকে না-কি! আমাকে কি পাগল মনে হয়?”

লাবীব মিনমিনিয়ে বলল, “নয়তো কি!”

পুষ্প হুংকার দিয়ে বলল, “কি?”

“আরেহ, তো রাস্তায় কি মরতে এসেছিলে?”

“তোমার সম্প্রদায় আমার ব্যাগ নিয়ে পালিয়েছে।”

লাবীব ভ্রূ কুঁচকে বলল, “আমার সম্প্রদায় মানে?”

“একটা বাইকওয়ালা।”

“বাইকাওয়ালা আমার সম্প্রদায় কীভাবে হলো?”

“তোমারও তো বাইক আছে। তোমার সম্প্রদায় নয়তো কি!”

লাবীব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আচ্ছা বলো, ব্যাগে কি ছিল?”

“বই-খাতা আর একটা ক্যালকুলেটর।”

“ফোন কোথায়?”

“পকেটে। টাকাও ফোনের কাভারের পেছনে রেখেছি।”

“তো তুমি বই খাতা আর ক্যালকুলেটরের জন্য রাস্তায় শুয়ে চেঁচাচ্ছিলে?”

পুষ্প রাগী দৃষ্টিতে লাবীবের দিকে তাকালো। লাবীব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“বেচারা বাইকার, লস প্রজেক্ট ধরেছিল।”

পুষ্প চোখ-মুখ কুঁচকে সামনে হাঁটা ধরতেই লাবীব তার হাত ধরে বলল,
“কোথায় যাচ্ছো? চলো তোমাকে তোমার বাসায় নামিয়ে দেই।”

“বাসায় যাবো না আমি। ক্লাস টেস্ট আছে।”

“খাতা-কলম ছাড়া টেস্ট দিতে যাবে?”

“কলম কারো কাছ থেকে ধার নিলেও চলবে। আর খাতা তো ক্যাম্পাস থেকেই দিবে। টেস্ট দিয়েই চলে আসবো।”

“আচ্ছা, চলো তোমাকে ক্যাম্পাসেই নামিয়ে দিবো। আমিও তো যাচ্ছি।”

“না, তোমার সাহায্যের প্রয়োজন নেই।”

“কিন্তু আমার তো তোমাকেই প্রয়োজন।”

পুষ্প ভ্রূ কুঁচকে লাবীবের দিকে তাকালো। লাবীব চুলে হাত বুলাতে বুলাতে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
“অন্তত একদিনের জন্য আমার বাইকের পেছনে বসে আমাকে একটু ধন্য করো।”

“এতো ধন্য হতে চাওয়ার কারণ?”

“কখনো কোনো মেয়ে আমার বাইকের পেছনে বসে নি। এই শহরে খালি বাইক নিয়ে ঘুরে শান্তি পাই না। তুমি বসলে তোমারও লাভ, আমারও লাভ। আমিও একটু শান্তি পাবো। তুমিও তাড়াতাড়ি ক্যাম্পাসে পৌঁছে যাবে। এমনিতে রোডে লুটোপুটি খেয়ে অনেক সময় নষ্ট করেছো।”

পুষ্প চোখ ছোট করে বলল, “আবার?”

লাবীব মুখ ছোট করে তাকিয়ে থাকায় পুষ্প তার মোটরসাইকেলে উঠে বসলো। কিন্তু লাবীব ক্যাম্পাসে না গিয়ে একটা ফার্মেসির সামনে মোটরসাইকেল থামালো। এরপর পুষ্পকে কিছু বলতে না দিয়ে তার হাতে ব্যান্ডেজ করে দিলো। লাবীব বলল,
“সেই কখন থেকে ফটফট করেই যাচ্ছিলে। তোমরা মেয়েরা পারোও বটে। ব্যথা পেয়েছো, বলো নি কেন?”

পুষ্প বলল,
“রাস্তায় ছিঁটকে পড়েছি, ব্যথা তো পাবোই।”

“হুম। বেশি কাবিল তো।”

“আমি ব্যথা পেয়েছি, তুমি কীভাবে বুঝলে?”

“লুকিংগ্লাসে দেখলাম, তুমি ভ্রূ কুঁচকে রেখেছো। বার-বার হাতের দিকে তাকাচ্ছো। আমার সামনে তো বাঘিনী হয়ে থাকো। পেছনে তো বিড়াল ছানার মতো বসে ছিলে।”

লাবীব এবার পুষ্পের দিকে তাকালো। দেখলো পুষ্প হাসছে। এবার সে ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“আমার কথা শুনে হাসছো? আমি তো ভেবেছি মুখ উঠিয়ে দেখবো টমেটোর মতো ফুলে গেছে তোমার মুখটা।”

পুষ্প হেসে বলল,
“তুমি ওতোটাও খারাপ না। অনেক কিছু খেয়াল করো।”

লাবীব উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“চলো এবার। টেস্ট আছে তোমার।”

পুষ্প সৌজন্যমূলক হাসি ফেরত দিলো। এরপর লাবীব পুষ্পকে নিয়ে ক্যাম্পাসে নামলো। পুষ্প নামতেই লাবীব পুষ্পের হাতে দু’টো কলম ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“ধার নিতে হবে না।”

পুষ্প ভ্রূ কুঁচকে বলল, “দান করছো?”

লাবীব হেসে বলল, “গিফট করছি।”

“আচ্ছা, আমি ক্লাস শেষে তোমাকে বার্গার খাওয়াবো।”

“ট্রিট চাই না। অন্য কিছু চাইলে দিও।”

“কি চাও?”

“আমার বাইকের পেছনে যদি প্রতিদিন বসতে।”

পুষ্প চোখ বড় বড় করে বলল,
“প্রেমিকা বানাতে চাও আমাকে?”

লাবীব ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“তোমার মনে এসব ঘুরে? বন্ধুরা কি বসে না বাইকের পেছনে?”

পুষ্প মুখ ফুলিয়ে বলল, “ধুর।”

পুষ্প হনহনিয়ে চলে যেতে লাগলো। লাবীব উঁচু গলায় বলল,
“তুমি প্রেমিকা হতে চাইলেও কিন্তু আমার সমস্যা নেই।”

পুষ্প পেছন ফিরে মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“লাগবে না তোমার বন্ধুত্ব।”

লাবীব হাসলো। মনে মনে বলল,
“তুমি তো দেখছি আমার প্রেমে পড়ে গেছো চশমিশ। শেষমেশ তবে এই বসন্তেই আমার একটু গতি হতে যাচ্ছে।”

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৩০(২য় ভাগ)||

৬১।
লাবীব ক্লাসে ঢুকে দেখলো রাদ বিষণ্ণ মুখে একপাশে বসে আছে। লাবীব তার পাশে এসে বসলো। কিন্তু রাদের সেদিকে খেয়াল নেই। লাবীব এবার রাদের মুখের সামনে হাত নাড়াতেই রাদের ধ্যান ভাঙলো। এরপর সে লাবীবের দিকে তাকিয়ে বিরক্ত মুখে বলল,
“প্লিজ লাবীব, এসব ফাজলামো ভালো লাগছে না।”

“কেন?”

“কেন মানে? ভালো লাগছে না মানে লাগছে না।”

“তোর হয়েছে টা কি?”

“কিছুই হয় নি।”

লাবীব চোখটা এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে দাঁত বের করে হেসে বলল,
“প্রেমে পড়লে মানুষের এইটাই একটা কমন উত্তর। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করলে নাক-মুখ সিঁটকে বলবে, না, কিছু হয় নি।”

রাদ চোখ ছোট করে লাবীবের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভেঙাচ্ছিস আমাকে?”

“ভেঙাবো কেন? আমি ভাবছি, আহিকে থেরাপি দিতে গিয়ে তুই-ই দেবদাস হয়ে ফিরলি। কি রে এবার তোর জন্য এপয়েন্টমেন্ট নিতে হবে না-কি?”

রাদ বেঞ্চ থেকে উঠে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়তেই লাবীব তার পিছু আসতে লাগলো। রাদ লাবীবের দিকে তাকিয়ে গম্ভীরমুখে বলল,
“আমার পেছন পেছন এসে ঘ্যানঘ্যান করবি না।”

লাবীব রাদকে টেনে আবার বেঞ্চে বসিয়ে রাদের মুখোমুখি বসে বলল,
“আমি জানি তুই আহিকে ভালোবাসিস। এখন তো যথেষ্ট সময় হয়েছে, ভালোবাসার কথা জানানোর। সেই স্কুল থেকেই তুই ওকে পছন্দ করিস। তারপর একই ইউনিভার্সিটিতে অনার্স করেছিস। বন্ধুত্ব হয়েছে। অনেক বছর ধরে অপেক্ষা করছিস। এখন তো অন্তত বলা যায়।”

“ভয় পাচ্ছি আমি। ও আমাকে ভালোবাসে না। ও অন্য একজনকে ভালোবাসে।”

“পাগল তুই? সে মানুষটা কি আছে ওর জীবনে? তুই তো বলেছিস, ছেলেটা বিয়ে করে নিয়েছে। তাহলে বাঁধা কীসের?”

“তাজওয়ার খান তো আছে।”

“আরেহ, আহি তো আর তাজওয়ার খানকে ভালোবাসে না। তুই একবার বলেই দেখ। যদি রাজি হয়ে যায়!”

“তুই যেটা মুখে বলছিস, এটা এতো সহজ না। আমাদের বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে গেলে? পাগল হয়ে যাবো আমি।”

“এজন্যই বলি বন্ধুত্ব না করে একেবারে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে দেওয়া ভালো। একবার বন্ধুত্ব হয়ে গেলে, প্রেম গলার কাঁটা হয়ে যায়।”

“এখন এসব বাদ দে। আগামী মাসে আহির এনগেজমেন্ট। এখন ওর এনগেজমেন্ট কীভাবে আটকাবো?”

লাবীব ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“আরেহ, শুধু এনগেজমেন্ট হচ্ছে। বিয়ে তো আর হচ্ছে না। রিল্যাক্স। আহিকে বল আংকেলকে ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করতে।”

“আরেহ ওর বাবাই তো সব ঝামেলা বাঁধাচ্ছে। উনি আস্কারা দিয়েই তো তাজওয়ারকে মাথায় তুলেছে। উনার জন্যই ওই তাজওয়ার খান আহির উপর অধিকার দেখানোর সাহস পাচ্ছে।”

লাবীব চুপ করে রইলো। আসলেই তারা বুঝতে পারছে না আহিকে কীভাবে এই ঝামেলা থেকে বের করে আনবে। অন্তত রিজওয়ান কবির আহির ইচ্ছের প্রাধান্য দিলে আহির জীবনটা আরো সুন্দর হতে পারতো।

(***)

ডেস্ক থেকে উঠে ফাইল নিয়ে সামনে এগুতেই থমকে দাঁড়ালো আফিফ। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে খানস গ্রুপের এমডি তাজওয়ার খান। আফিফ তাজওয়ারকে দেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। তা দেখে তাজওয়ার উঁচু গলায় বলল,
“তোমার কি ম্যানার্স নেই? তোমার সামনে এমডি দাঁড়িয়ে আছে, আর তুমি সালাম করছো না? অদ্ভুত!”

আফিফ কাঁপা কন্ঠে বললো,
“সরি স্যার। আসসালামু আলাইকুম।”

তাজওয়ার আফিফের দিকে ঝুঁকে বলল,
“সরি, উত্তরে আমি তোমার শান্তি কামনা করবো না। আমার প্রিয় জিনিসের প্রতি নজর দেওয়া মানুষগুলোকে আমি সহজে ক্ষমা করি না। আর তুমি তো আমার হৃদয়টাই কেঁড়ে নিয়েছো।”

আফিফ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। তাজওয়ার বলল,
“আজকে থেকে তুমি আমার পিএ।”

আফিফ অবাক চোখে তাজওয়ারের দিকে তাকালো। তাজওয়ার সবার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“মিস্টার আফিফ রাফাত আজ থেকে আমার পিএ। বর্তমানে যিনি আছেন, তাকে অন্য পদে নিয়োগ দেওয়া হবে।”

আফিফ হতভম্ব হয়ে গেলো। সাধারণ কর্মচারী থেকে হুট করে এমন একটা পদ দিয়ে দেওয়া একমাত্র তাজওয়ারের পক্ষেই সম্ভব। তাজওয়ার সবাইকে আফিফের নতুন পরিচয় দিয়ে আফিফের দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসি দিয়ে চলে গেলো। এদিকে অফিসের সবাই আফিফকে শুভেচ্ছা দিচ্ছে। সবাই জানতে চায়ছে, কীভাবে সে স্যারকে সন্তুষ্ট করতে পেরেছে। কিন্তু আফিফের কাছে এই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। সে সোজা এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার সিদ্দিক আহমেদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“স্যার, এমডি স্যার আমাকে পিএ বানিয়ে দিলেন। আমার কাজটা কি?”

সিদ্দিক সাহেব ভ্রূ কুঁচকে আফিফের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“তাজওয়ার স্যারের পিএ তো দু’জন। একজন আমি নিজেই যে কোম্পানির কাজের তথ্য স্যারকে এনে দেই। আর সেক্টরের কাজগুলো দেখি। আমার পদ তো ঠিকই আছে। আরেকজন সোহাগ। ওকে হয়তো সরিয়েছে। ওর কাজ ছিল স্যারের সাথে থাকা। কাজের বাইরেও স্যারকে সময় দেওয়া। তার দ্বারা যে-কোনো কাজ করাতে পারতো স্যার। খুন কর‍তে বললেও ওটাও করতে বাধ্য ছিল। আর অফিসিয়াল কাজে আমার সাথে কথাবার্তা বলতে হতো। বলতে পারো অফিসে আসলে সে আমার এসিট্যান্ট। অফিসের বাইরে স্যারের বডিগার্ড।”

আফিফ চুপসে গেলো। চিন্তিত কন্ঠে বলল,
“আমি তো এসবে এক্সপেরিয়েন্সড নই।”

“ধীরে ধীরে শিখে ফেলবে। স্যালারি কতো শুনলে তোমার মাথা ঘুরে যাবো। তোমাকে বিশ হাজার টাকার জায়গায় মাসে সত্তর হাজার টাকা দেওয়া হবে। সোহাগ মাসে সত্তর হাজার টাকা পেতো। পাঁচ মাস পর স্যালারি বাড়িয়ে দেবে। আর এরপর তোমার কাজের উপর ডিপেন্ড করে স্যালারি বাড়াবে। স্যারকে সন্তুষ্ট করতে পারলে কোটি টাকার মালিক হতে পারবে। নয়তো স্যার পথে বসিয়ে দেবেন।”

আফিফ চুপ করে রইলো। সিদ্দিক সাহেব বললেন,
“এখন বাসায় যাও। তোমার সব কাগজপত্র রেডি করতেও সময় লাগবে। তোমার কেবিন কিন্তু পাশের রুমটা। আর তোমাকে গাড়ি আর একটা ফ্ল্যাট দেবে অফিস থেকে। আপতত বাসায় যাও। বাকীটা তোমাকে আমি ফোন করে জানাবো।”

আফিফ মাথা নেড়ে চলে গেলো। সে যে মারাত্মক বিপদে পড়েছে তা আর কেউ না বুঝলেও আফিফ ভালোভাবেই বুঝে গেছে। এই খবরটা কি খুশির না-কি দুঃখের সেটাই সে বুঝে উঠতে পারছে না।

(***)

ক্লান্ত শরীরে বাসায় ঢুকলো আফিফ। বাসায় ঢুকতেই পদ্মের চিন্তিত মুখ খানি দেখে ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“কিছু হয়েছে?”

পদ্ম আফিফের হাত ধরে বলল,
“বাসায় আসুন আগে। তারপর মায়ের রুমে যান।”

আফিফ তার অফিস ব্যাগ পদ্মের হাতে ধরিয়ে দিয়ে সোজা মায়ের রুমে চলে গেলো। সেখানে গিয়েই স্তব্ধ হয়ে গেলো আফিফ। আফিফা বেগম খাটে পা তুলে মাথায় হাত দিয়ে কাঁদছেন। তার পাশে শুয়ে আছে রেনু। রেনুর মুখে কালসিটে দাগ পড়ে আছে। আফিফ দৌঁড়ে বোনের কাছে আসতেই রেনু কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল,
“ভাইয়া উনি আমাকে খুব মেরেছেন। আমি আর ও বাড়িতে যাবো না। মাকে বলো, আমাকে যাতে জোর করে আর ও বাড়িতে না পাঠায়।”

আফিফ রেনুর হাত ধরে তাকে বসিয়ে দিয়ে বলল,
“তোকে যেতে হবে না ও বাড়িতে। আমিই তোকে যেতে দেবো না।”

কথাটি বলেই আফিফ রেনুর গালে হাত রাখতেই রেনু ব্যথায় চোখ-মুখ কুঁচকে বলল,
“ভাইয়া লোকটা নেশাখোর। সারাদিন মেয়ে নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আর কতো বছর সংসার করবো আমি? আমি কি তোমাদের কাছে বোঝা?”

আফিফ ব্যস্ত হয়ে বলল,
“কখনো না। তুই কেন বোঝা হবি? তুই আমার দায়িত্ব।”

“তাহলে আমাকে আর যেতে দিও না। মা আমাকে বার-বার জোর করে ওই বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়।”

আফিফ ভ্রূ কুঁচকে মায়ের দিকে তাকালো। আফিফা বেগম কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললেন,
“হ্যাঁ পাঠিয়ে দেই। আফিফের সংসার চালানোর মতো টাকা থাকতে হবে তো! তোর চারটা বাচ্চা পড়ালেখা করানোর মতো সামর্থ আছে তোর ভাইয়ের? তুই একা আসতে পারলে চলে আয়। আমি তো বলি নি মার খেতে।”

আফিফ মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তার মানে আগেও এমন হয়েছে? রেনুকে আগেও মেরেছিল?”

আফিফা বেগম মুখ ঘুরিয়ে বললেন,
“এতো বছরের সংসারের মাত্র সাত-আটবার।”

“কি বলছো মা এসব? সাত-আটবার! আর আমি এসব কিছুই জানি না?”

আফিফ পদ্মের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমিও তো আমাকে জানাও নি!”

আফিফা বেগম বললেন,
“আমি বারণ করেছিলাম জানাতে। তোকে বাড়তি চাপ দিতে চাই নি।”

আফিফ মাথায় হাত চেপে ধরলো। রেনু বলল,
“শুধু সাত-আটবার মার খেয়ে বাসায় এসেছি। আরো কতো বার মার খেয়ে সহ্য করেছি সেটা আমি ছাড়া কেউ জানে না। একটু উল্টো-পাল্টা হলেই তিনি চড়-থাপ্পড় মারেন। উনি গত সপ্তাহে উনার বন্ধুদের সামনে আমাকে লাথি মেরেছিলেন। আমি তো মাকে এটা জানায়ও নি। ছেলেটা আমার বড় হয়েছে। এসব দেখে দেখে ও বড় হচ্ছে।”

আফিফা বেগম বললেন,
“এতো কাঁদিস না তো। স্বামীরা বউকে মার‍তে পারে। মা-বাবার পরই তো তার স্থান। এসবে পুরুষ মানুষের অধিকার আছে।”

মায়ের কথা শুনে আফিফের এবার রাগ উঠে গেলো। সে রাগী স্বরে বলল,
“কি বুঝে বলছো এই কথা? এতো বছরের সংসারে আমি কি একবারো পদ্মের গায়ে হাত তুলেছি?”

আফিফ রেনুর হাত ধরে বলল,
“রেনু, তুই চিন্তা করিস না। আমি ওকে ছাড়বো না এবার। ওকে আমি জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়বো।”

আফিফা বেগম ব্যস্ত কন্ঠে বললেন,
“এ কথা বলিস না আফিফ। উনার সাথে ঝামেলা করে লাভ নেই। সুন্দরভাবে সমাধান করে ফেল। নিয়ে আয় রেনুকে। জামাই বাবার অনেক প্রভাব। উনার তো কিছুই হবে না। উলটো তোর ক্ষতি হবে। আমি আমার স্বামী হারিয়েছি। একটা মেয়ে হারিয়েছে। তোকে হারানোর মতো শক্তি নেই আমার।”

“তাহলে ওমন ছেলের সাথে রেনুর বিয়ে কেন দিয়েছিলে? আমার বোনটাকে পড়াশুনাটাও করতে দাও নি।”

“কি করবো আমি? চয়ন যেই কাজ করেছে এরপর তোর মনে হয় রেনুকে আর কেউ বিয়ে করতো? দুর্নাম রটিয়ে মরেছিল তোর বড় আপা। ছি! ছি! কতো মাস ভাত খেতে পারি নি আমি।”

আফিফের হাত মুঠো হয়ে গেলো। সে রেনুর দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“তুই আরাম কর। আমি তোকে আর ওই জাহান্নামে যেতে দেবো না। আমরা না খেয়ে থাকি। তাও তুই আমাদের সাথেই থাকবি। আমি তোকে যা খাওয়াতে পারি খাওয়াবো। আর বাচ্চাদের নিয়ে ভাবিস না। আমি ওদের নিয়ে আসবো। ওদের আমিই লেখাপড়া করবো।”

আফিফ এই কথা বলে বেরিয়ে এলো রুম থেকে। পদ্মও আফিফের পিছু পিছু রুম থেকে বের হলো। এরপর সে আফিফকে গেটের কাছে যেতে দেখে ব্যস্ত কন্ঠে বলল,
“এই মাত্রই তো এলেন। আবার কোথায় যাচ্ছেন?”

“রেনুর সাথে বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে এসব। এর বিহিত তো করতেই হবে।”

“ওরা আপনাকে মেরে ফেললে?”

“মারবে না। আর প্রয়োজনে হলে আমি থানায় যাবো। আমার বোনকে কি ওদের মানুষ মনে হয় না?”

আফিফ হনহনিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লো। পদ্ম চিন্তায় পড়ে গেলো। যদি আফিফের কোনো ক্ষতি হয়ে যায়? পদ্ম মনে মনে ভাবলো,
“আহির বাবা তো অনেক বড় মাপের মানুষ। আহি যদি উনাকে বলেন, তাহলে রেনুর সমস্যার সমাধান হয়ে যেতে পারে।”

পদ্ম এবার আহিকে কল করার জন্য ফোন হাতে নিলো।

এদিকে আহি সিঁড়ি বেয়ে নামতেই শুনতে পেলো মিসেস লাবণি ফোনে বলছে,
“তোর আগামী মাসে আক্দ, অথচ তুই একবারো তোর আপুকে জানালি না? আমার তো তোর সম্পর্কে এখন বাইরের মানুষ থেকে শুনতে হচ্ছে।”

আহিকে নিচে নামতে দেখে লাবণি এক গাল হেসে বলল,
“তোর প্রাক্তন বান্ধবীর সাথে কথা বলবি?”

লাবণি আবার হেসে বলল,
“জানিস ওরও এনগেজমেন্ট তাজওয়ার খানের সাথে।”

আহি শীতল দৃষ্টিতে মিসেস লাবণির দিকে তাকিয়ে রইলো। মিসেস লাবণি হুট করে উঠে আহির কানে ফোন দিয়ে বলল,
“যাও কথা বলো। শুভ কামনা দাও তোমার খালাকে।”

আহি কাঁপা কন্ঠে বললো,
“হাই, লিনু.. লিনাশা।”

ওপাশ থেকে কিছুই শোনা গেলো না। আহি ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলো লিনাশা এখনো কল কাটেনি। আহি এবার ফোন কানের কাছে নিয়ে বলল,
“শুভকামনা নতুন জীবনের জন্য।”

লিনাশা ক্ষীণ কন্ঠে উত্তর দিলো, “থ্যাংকস।”

এইটুকু বলেই কল কেটে দিলো লিনাশা। আহি মলিন মুখে মিসেস লাবণির দিকে তাকিয়ে রইলো। লাবণি বাঁকা হেসে বলল,
“কি হলো, বেস্টু ইনভাইটও করলো না?”

আহি ফোনটা টেবিলে রেখে আবার নিজের রুমে চলে গেলো। এদিকে লিনাশা ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে। তার ওয়ালপেপারে আহির আঁকা আহি আর তার ছবিটা এখনো আছে। চার বছর ধরে এই একটা ওয়ালপেপার সে কখনোই পরিবর্তন করে নি। লিনাশার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। কাঁপা কন্ঠে বলল,
“আমি হয়তো একটু বেশিই করে ফেলেছিলাম তোর সাথে, আহি। কতোগুলো বছর চলে গেছে জীবন থেকে। কিন্তু তুই ছাড়া আজ পর্যন্ত বেস্ট ফ্রেন্ড কেউ হয় নি। আই লাভ ইউ আহি। আই মিস ইউ সো মাচ।”

অন্যদিকে আহি ঘরে এসে আলমারির চাবিটা হাতে নিলো। তার আলমারির চাবিটির সাথে সবসময় লিনাশার দেওয়া শেষ ফ্রেন্ডশিপ বেল্টটি বাঁধা থাকে। সে কখনোই সেই বেল্টটি খুলে রাখে নি৷ আহি বেল্টটি আলতো হাতে স্পর্শ করে বলল,
“এই সুতার বেল্ট যতোই মলিন হয়ে যাক, তোর স্মৃতি আর তুই সবসময় আমার জীবনে অক্ষত থাকবি। এই অভিশপ্ত আমিটা তো বন্ধু ডিজার্ভ করি না। কিন্তু যাদের পেয়েছি, তারা আমাকে অনেক সুন্দর মুহূর্ত দিয়েছে। ভাগ্যিস, আল্লাহ আমাকে এতো চমৎকার বন্ধু দিয়েছিল, নয়তো আমার আর কোনো অস্তিত্বই থাকতো না। লিনু, আই মিস ইউ এন্ড আই লাভ ইউ সো মাচ।”

(***)

ফোন বেজে উঠতেই আহি কলটা রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে পদ্ম উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে উঠলো,
“একটা সাহায্য করবি?”

“হুম, বল!”

পদ্ম আহিকে রেনুর ব্যাপারে সবটাই জানালো। সব শুনে আহি বলল,
“রেনুর স্বামীর নাম কি? কি করে?”

“উনার নাম নিয়াজী তালুকদার। যখন বিয়ে হচ্ছিল, তখন রয়েল গ্রুপের ম্যানেজার ছিল। এখন নিজের বিজনেস দাঁড় করিয়েছে। কোম্পানির নামটা মনে নেই৷ কিন্তু ওই যে একটা রেস্টুরেন্ট আছে না, টুইস্ট প্যালেস। ওইটা উনার।”

আহি চমকে উঠে বলল,
“রিয়েলি? টুইস্ট প্যালেসের মালিকের সাথে তাজওয়ারের বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। বাবা তো প্রায়ই বিজনেস মিটিং ওখানেই করে।”

পদ্ম বলল,
“এই বিষয়ে কি আংকেল সাহায্য করতে পারবেন?”

আহি মিনমিনিয়ে বলল,
“সব বিজনেসম্যান একই গোয়ালের গরু।”

পদ্ম ভ্রূ কুঁচকে বললো, “কিছু বলেছিস!”

“হ্যাঁ, বললাম সব গুলো এমনই। আচ্ছা, আমি দেখছি। আমাকে একটু সময় দিস।”

পদ্ম বলল,
“তোর গলা ভারী হয়ে আছে, মনে হচ্ছে। মন খারাপ?”

“না।”

“মিথ্যে বলছিস কেন?”

“মিথ্যে বলছি না। ঠান্ডা লেগেছে, হয়তো এজন্য গলা ভারী লাগছে।”

“উহুম, আহি। তুই যতোই কথা ঘুরিয়ে ফেল, ধরা কিন্তু খাবিই। লিনাশা ছাড়া কি কখনো আমাদেরও বন্ধু ভেবেছিস!”

“ভাবি তো। তোরা সবাই আমার বন্ধু।”

“তাহলে বল, কি হয়েছে?”

“শুনলাম লিনাশার না-কি আক্দ। আসলে মিস করছিলাম ওকে। একটু আগে কথা হয়েছে ফোনে। কয়েক বছর পর ওর কন্ঠ শুনলাম। তাই একটু মন খারাপ ছিল।”

পদ্ম বলল,
‘লিনু তো আমাদের বলেই নি। অবশ্য এই কয়েক দিন আমিও ওকে মেসেজ দেই নি। মেয়েটাকে মেসেজ না দিলে, নিজ থেকে কথায় বলবে না।”

আহি মলিন হাসলো। আর মনে মনে বলল,
“আমার জন্যই তো এমন করছে। আমি যদি পুষ্প আর পদ্মের কমন ফ্রেন্ড না হতাম, তাহলে লিনাশা সবার সাথেই যোগাযোগ রাখতো। আমি তো ওর বন্ধুগুলোও কেঁড়ে নিয়েছি। শাপগ্রস্ত মানুষ আমি!”

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৩১||

৬২।
নিয়াজী তালুকদারের বাড়ির গেটের সামনে নামলো আফিফ। দারোয়ান তাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
“ভাইজান, কেমন আছেন?”

আফিফ বলল,
“জ্বি ভালো। নিয়াজের সাথে দেখা করতে এসেছি।”

দারোয়ান গেট খুলে দিতেই আফিফ সোজা ভেতরে ঢুকে পড়লো। বাড়ির ভেতরে ঢুকেই সে উঁচু গলায় ডাকতে লাগলো নিয়াজকে।
নিয়াজী তালুকদার আফিফের চেয়েও বয়সে বড়। তবুও আফিফের এমন সম্বোধনে বাড়ির কেউই অবাক হলো না। নিয়াজী দৃপ্ত পদে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলেন। আফিফকে দেখে অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসলেন। আফিফ নিয়াজীর সামনে এসে বলল,
“আমার বোনের গায়ে হাত তোলার সাহস তোকে কে দিয়েছে?”

নিয়াজী ভাবলেশহীন সুরে বলল,
“তোরাই তো দিয়েছিস। বিয়ে করা বউ আমার। আমার যা ইচ্ছে করবো, ভালো না লাগলে রেখে দে।”

“রেখে তো দিবোই। রেনু আর এ বাড়িতে আসবে না।”

নিয়াজী অট্টহাসি হেসে বললেন,
“তোর বোনের কোনো যোগ্যতাও নেই এই বাড়িতে আসার৷ কখনো ছিলও না। ভাগ্য ভালো তোর বোনের। আমি বিয়ে করেছি বলেই সংসার চোখে দেখেছে। তোর বড় বোন যেই কীর্তি করেছে, তোদের দশ বংশের মেয়েকেও কেউ ঘরের বউ করে ঘরে তুলবে না।”

আফিফের হাত মুঠো হয়ে এলো নিয়াজের কথা শুনে। সে দাঁতে দাঁত চেপে নিয়াজের দিকে তাকিয়ে আছে। নিয়াজী বললেন,
“কে জানে সব দোষ গোড়ায় আছে কি-না। তোর তো বাবা নেই। কে বলতে পারে মারা গেছে, না-কি ছিলও না কখনো!”

আফিফ আর সহ্য করতে পারলো না। নিয়াজের কলার ধরে তাকে শরীরের সব শক্তি দিয়ে মারতে লাগলো। নিয়াজকে বাঁচানোর জন্য বাড়ির কাজের লোকরা আফিফকে সরানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু আফিফের এই রূপ যেন প্রথম দেখেছে তারা। আফিফকে দেখে বোঝার উপায় নেই, সে কারো গায়ে হাত তুলতে পারে। এদিকে নিয়াজীর বোন পরিস্থিতি দেখে রেনুকে ফোন করে সব জানালো। রেনু সব শুনে চিন্তায় পড়ে গেলো। সে মাকে কিছু না জানিয়ে পদ্মকে গিয়েই সব বললো। আফিফ আর নিয়াজের মারামারি লেগেছে এই কথাটা শুনেই পদ্মের অস্থিরতা আরো বেড়ে গেলো। সে তাড়াতাড়ি বোরকা পরে রেনুকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো রেনুর শ্বশুড় বাড়ির উদ্দেশ্যে। পথে সে আবার আহিকে ফোন করলো। আহি তখন একটি বই হাতে নিয়ে বসেছিল মাত্র। বইটির নাম ইকিগাই। বইটিতে জাপানিজদের দীর্ঘজীবন লাভ এবং জীবনে সুখী হওয়ার বিষয় নিয়ে অনেক কথা বলা আছে। আহি পদ্মের কল দেখে বইটি একপাশে রেখে কলটা রিসিভ করে হ্যালো বলতেই পদ্মের কাঁদো কাঁদো কন্ঠ শুনে থমকে গেলো। পদ্ম কান্নাভেজা কন্ঠে বলল,
“আহি, প্লিজ আংকেলকে বল সাহায্য করতে।”

আহি ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“কাঁদছিস কেন? বাবা তো অফিসে। রাতে আসলেই বলতে পারবো।”

“আফিফ ওখানে গেছেন।”

“উনাকে ফোন করে বল চলে আসতে।”

“ফোন দিয়েছি। ধরছে না। রেনুর ননদ ফোন দিয়ে বললো, আফিফ আর নিয়াজের মারামারি লেগেছে। এখন উনার কিছু হয়ে গেলে?”

আহি ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“মারামারি লেগেছে মানে? ওয়েট কিচ্ছু হবে না আফিফের। আমি যাবো। এড্রেস দে আমাকে।”

“তুই যাবি আহি? তোর কথা শুনবে? তোকে চিনবে তো!”

আহি বুকে হাত দিয়ে বসে আছে। নিয়াজী তো তাকে চিনবেই না। কিন্তু তাজওয়ারকে চিনবে। এই মুহূর্তে তাজওয়ারই আহিকে সাহায্য করতে পারবে। আহি পদ্মকে বলল,
“আমি আসছি। তোর রেনুকে নিয়ে ওখানে যাওয়ার দরকার নেই। আমাকে শুধু এড্রেসটা দে। প্লিজ ওখানে যাবি না তোরা।”

আহি কল কেটে তাজওয়ারের নম্বরে ডায়াল করতে গিয়ে থেমে গেলো। এই নম্বরটা তাজওয়ারই জোর করে তার ফোনে সেইভ করিয়েছিল। আজ পর্যন্ত এই নম্বরে আহি নিজ থেকে কখনো কল দেয় নি। কিন্তু আজ তার প্রিয় মানুষটা বিপদে পড়েছে। আফিফের কিছু হয়ে গেলে আহি পাগল হয়ে যাবে। তাই সে বাধ্য হয়েই তাজওয়ারকে কল করলো।

(***)

স্ক্রিনে আহির নাম ভেসে উঠতেই তাজওয়ার রীতিমতো অবাক। সে ভ্রূ কুঁচকে কিছুক্ষণ নামটির দিকে তাকিয়ে রইলো। তার এসিস্ট্যান্ট সোহাগের দিকে ফোনটা তাক করে বলল,
“দেখ তো, কার কল এসেছে!”

সোহাগ মনোযোগ দিয়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“স্যার, আহি ম্যামের নাম দেখা যাচ্ছে।”

তাজওয়ার মৃদু হাসলো। ফোনের স্ক্রিনে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল,
“এখন যা, আমি একটু কথা বলি তোর ম্যামের সাথে।”

সোহাগ যেতে যেতেই কলটা কেটে গেলো। আহি কল কেটে যাওয়ায় বিরক্ত হয়ে একটা ওড়না গলায় ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়লো। গাড়ির কাছে আসতেই তাজওয়ার নিজেই কল করলো। আহি সাথে সাথেই কলটা রিসিভ করে বলল,
“তোমাকে একটা এড্রেস দিচ্ছি, তাড়াতাড়ি ওখানে আসো প্লিজ। এই মুহূর্তেই তোমাকে আসতে হবে। অনেক বড় বিপদে পড়েছি।”

তাজওয়ার আহিকে কিছু বলার আগেই আহি কল কেটে দিলো। এদিকে আহি গাড়িতে উঠেই তাজওয়ারকে সেই ঠিকানাটা পাঠিয়ে দিলো। তাজওয়ার ঠিকানা দেখে ভ্রূ কুঁচকে মনে মনে বলল,
“এই জায়গায় আহির কি কাজ!”

তাজওয়ার আবার আহিকে কল করলো। আহি রিসিভ করতেই তাজওয়ার বলল,
“নিয়াজীর বাড়ির এড্রেস কেন দিয়েছো আমাকে?”

“উনার সাথে বোঝাপড়া আছে আমার।”

“তুমি তাকে কীভাবে চিনো? তোমার সাথে তো তার বোঝাপড়া থাকার কথা না।”

“তুমি কি এখন আসবে?”

“আমি এখন দূরে আছি। আসবো তো অবশ্যই। তুমি বলেছো আর আমি আসবো না, সেটা তো হয় না। আমার আসতে প্রায় ঘন্টা খানেক লাগবে। যদি জ্যাম না পড়ে, তাহলে আধা ঘন্টায় পৌঁছে যাবো।”

আহি দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“এমনিতে তো অসময়ে মাথার উপর উঠে বসে মগজ খেয়ে ফেলো। এখন প্রয়োজনে তোমাকে পাওয়ায় যাচ্ছে না।”

আহি কল কেটে দিলো। মনে মনে একটাই প্রার্থনা করছে আফিফ যাতে সুস্থ থাকে। আহির গাড়ি দশ মিনিটের মধ্যে নিয়াজীর বাড়ির সামনে এসে থামলো। গাড়ি থেকে নেমেই আহি দারোয়ানকে বলল,
“প্লিজ, আমাকে ভেতরে যেতে দিন।”

“কাকে চান আপনি?”

“নিয়াজী তালুকদার আছেন না বাসায়?”

“জ্বি, স্যার তো আছেন।”

আহি অনেক দ্বিধা নিয়ে বলল,
“আমি রিজওয়ান কবিরের মেয়ে।”

আহি জানে না দারোয়ান তার বাবাকে চিনবে কি-না বা এতোটুকু তথ্যে তার জন্য গেট উন্মুক্ত করে দিবে কি-না। তাই সে চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে রইলো। এরপর দারোয়ান গেট খুলে নিজেই আহির সাথে ভেতরে ঢুকলো। নিচে থাকা একজন মহিলাকে বলল,
“নিয়াজী স্যারের সাথে দেখা কর‍তে এসেছে।”

মহিলাটি বলল, “স্যার রুমে আরাম করছেন।”

আহি ব্যস্ত কন্ঠে বললো, “আফিফ কোথায়?”

মহিলাটি ভ্রূ কুঁচকাতেই আহি বলল,
“রেনুর ভাইয়ার কথা বলছি।”

মহিলাটি বলল, “আপনি তার কে হোন?”

আহি ক্ষণিকের জন্য থমকে গেলো। কাঁপা কন্ঠে বললো,
“আমার ফ্রেন্ডের হাসবেন্ড। ওকে নিতে এসেছি।”

মহিলাটি বাগানের দিকে ইশারা করে বলল,
“তাকে তো পুলিশে ধরিয়ে দেবে। আপতত বাগানে ফেলে রেখেছে। সে স্যারের গায়ে হাত তুলেছে।”

“আচ্ছা, আপনি আমাকে অন্তত তার সাথে দেখা করতে দিন।”

মহিলাটি আহিকে বাগানে যেতে বলল। আহি দৌঁড়ে সেখানে গিয়ে দেখলো আফিফ মাটিতে পড়ে আছে। আর তার পাশে একটা লোক লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আহি আফিফের কাছে গিয়ে দেখলো আফিফের শার্টে রক্তের দাগ। আহি তার কাঁপা হাতটি আফিফের দিকে এগিয়ে দিতে গিয়েই থেমে গেলো। সে ক্ষীণ কন্ঠে ডাকলো, “আফিফ।”

আফিফ চোখ খুলে আহিকে দেখে কাঁপা কন্ঠে বলল,
“তুমি এখানে?”

আহি নরম সুরে বলল, “উঠো।”

আফিফ উঠতে যাবে তখনই দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি লাঠি দিয়ে সজোরে আফিফের পিঠে আঘাত করলো। আফিফ আবার ঢলে পড়লো। আহি ব্যস্ত হয়ে আফিফকে জড়িয়ে ধরে লোকটির দিকে ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“তুমি কি মানুষ না-কি পশু?”

লোকটি মাথা নিচু করে বলল,
“স্যারের আদেশ। আপনি আটকালে আপনার গায়ে হাত তুলতে বাধ্য হবো। যতোক্ষণ সে স্যারের কাছে ক্ষমা চায়বে না, ততক্ষণ তাকে এই শাস্তি দেওয়া হবে।”

আহি আফিফকে উঠিয়ে বসালে। এরপর লোকটির সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“তোমার স্যার কোথাওকার রাজা, যে তার কথায় সবাইকে উঠবস করতে হবে? ডাকো তোমার স্যারকে। আমিও তার গালে কয়েকটা লাগিয়ে দেই।”

আফিফ আহিকে থামানোর জন্য উঠতে গিয়ে ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলো। আহি আফিফের গোঙানোর শব্দ শুনে তার কাছে এসে বসলো। আফিফ বলল,
“কেন এসেছো এখানে? কে বলেছে আসতে?”

আহির চোখে অশ্রু ভীড় করলো। আফিফের কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছে। মুখে রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। আহি বলল,
“কথা বলো না তো। তোমার কষ্ট হচ্ছে। আর আমাকে পদ্ম বলেছিল আসতে। ও তোমার চিন্তায় অস্থির হয়ে যাচ্ছে। তোমাকে সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরতে হবে। আমি তোমাকে নিতে এসেছি।”

কথাগুলো বলতে বলতেই আহির চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। আফিফ দুর্বল দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো আর কাঁপা কন্ঠে বলল,
“তুমি কাঁদছো কেন? আমাকে তো নিঃস্ব করে দিয়েছো তুমি। তোমার ভালোবাসা আমাকে আর আমার পরিবারকে শেষ করে দিয়েছে।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে আফিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কি বলছো তুমি, আফিফ!”

আফিফ মলিন মুখে বললো,
“আহি প্লিজ, তুমি যা ইচ্ছে করো। অন্তত আমার থেকে দূরত্ব রাখো। প্লিজ।”

“আমি তোমার কাছে এসেছি কখন? দূরেই তো ছিলাম। আর তুমি বলতে চাইছো, এসব আমার কারণে হয়েছে? সিরিয়াসলি আফিফ?”

আফিফ সেকেন্ড খানিক চুপ থেকে ম্রিয়মান কন্ঠে বলল,
“খুনী যখন নিজেই জানে না সে খুনী তাহলে কি তার উপর আরোপ লাগানো যায়? আমার অবস্থাটাও এমন। সব তোমার কারণেই হয়েছে, আহি। তুমিই আমার জীবনটা এলোমেলো করে দিয়েছো। অথচ আমি তোমাকে ঘৃণা করতে পারছি না। তোমার উপর রাগ দেখাতে পারছি না। কিন্তু আমার উচিত তোমাকে ঘৃণা করা।”

আহি আফিফের হাত ধরে বলল,
“আমি তোমার কাছে কোনো আবদার রাখি নি। তাহলে আমার অপরাধটা কোথায়?”

“আবদার করো নি, এতেই এই অবস্থা। আবদার করলে তো আমার অস্তিত্বই থাকতো না।”

“ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে কথা বলছো কেন? সোজাসুজি বলো কি হয়েছে?”

“এখন এসব বলে লাভ নেই। শুধু এতোটুকু জেনে রেখো, তোমার ভালোবাসা আমাকে ডুবিয়ে দিয়েছে। আমার আপার মৃত্যু, আমার ছোট বোনের সাথে যা হয়েছে সবকিছুর জন্য তুমি অনেকাংশে দায়ী। তোমার জন্য হয়েছে সব, আহি। আমি আর পারছি না এসব যন্ত্রণা নিতে। কেউ হয়তো আমার কষ্টটা বুঝবে না। তখন বুঝতো যখন তার প্রিয় মানুষটা তার চোখের সামনে মারা যেতো। তখন বুঝতো, যখন সে জানতে পারতো, সেই মৃত্যুটা তারই কোনো এক ভুলের কারণে হয়েছে। এরপর তো তার জন্য বেঁচে থাকাটায় কষ্টকর হয়ে যাবে, তাও না? কিন্তু তবুও তাকে বাঁচতে হবে। তার ক্ষমতা থাকবে না সেই অন্যায়ের শাস্তি দেওয়ার, অথচ সে রাত-দিন নিজের অক্ষমতায় ধুঁকে ধুঁকে মরবে। আর তখনই সে আমার কষ্টটা বুঝতে পারবে।”

আফিফ কথাগুলো বলেই ফুঁপিয়ে উঠলো। এদিকে তাজওয়ার গাড়ি থেকে নামতেই দেখলো আহির গাড়ি গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। ততক্ষণে তাজওয়ারকে দেখে দারোয়ান গেট খুলে দিয়েছে। সে দৌঁড়ে ভেতরে ঢুকে বলল,
“নিয়াজ কোথায়!”

তাজওয়ারকে দেখে একজন নিয়াজীকে ডাকতে গেলো। আর তাজওয়ার এদিক-ওদিক আহিকে খুঁজতে লাগলো। নিয়াজ কয়েক মিনিটের মধ্যে নিচে নামতেই তাজওয়ার ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“আহি কোথায়?”

নিয়াজ বললেন,
“তাজওয়ার ভাই, আপনি হঠাৎ! আর আপনি কার কথা বলছেন?”

“তোমার সাথে দেখা করতে কোনো মেয়ে আসে নি?”

পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একজন মহিলা কর্মচারী তাজওয়ারকে বলল,
“সে বাগানের দিকে গেছে।”

তাজওয়ার দ্রুত পায়ে সেদিকে গিয়ে দেখলো আহি একটা ছেলের পাশে বসে আছে। তাজওয়ার সেখানে গিয়ে দেখলো, ছেলেটা আফিফ। আফিফ তাজওয়ারকে দেখে উঠে দাঁড়াতেই ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যেতে নেবে তখনই আহি তাকে ধরে ফেলল। আফিফ একনজর আহির দিকে তাকিয়ে আবার তাজওয়ারের দিকে তাকালো। তাজওয়ারের মুখটা রাগে লাল হয়ে আছে। আফিফ তা দেখে আহির কাছ থেকে সরে দাঁড়ালো। তাজওয়ার আহির হাত ধরে তাকে টেনে নিজের কাছে এনে বলল,
“তুমি এসবের জন্য আমাকে ডেকেছো?”

“হ্যাঁ, নিয়াজী তালুকদার তোমার পরিচিত৷ তাই তোমাকে আসতে বলেছিলাম।”

তাজওয়ার চেঁচিয়ে বলল,
“তোমার জন্য আমি শহরের এক প্রান্ত থেকে দৌঁড়ে এসেছি, আর এসে দেখলাম তুমি এই ভিখারির বাচ্চার জন্য আমাকে ডেকেছো!”

আহি রাগী দৃষ্টিতে তাজওয়ারের দিকে তাকালো। আফিফ মলিন মুখে অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়ালো। তার চোখে অশ্রু টলমল করছে। ক্ষমতার অভাবে আজ সে কতো কথা শুনছে। তার মায়ের চরিত্রে আঙ্গুল তুলেছে, তার বোনকে পেটানো হয়েছে, আর সে প্রতিবাদ করতে এসে নিজেই মার খেয়ে বসে আছে। এবার আহি বুকে হাত গুঁজে তাজওয়ারকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আমি আমার ফ্রেন্ডের জন্য এখানে এসেছি। আফিফ পদ্মের হাসবেন্ড। তোমাকে এর বিহিত করতেই হবে৷ আফিফের বোনকে মেরেছে ওই নিয়াজী তালুকদার। একটা নারীর সাথে অন্যায় হয়েছে। আমি এখানে একটা মেয়ের জন্য এসেছি।”

তাজওয়ার আফিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“সিরিয়াসলি! সমাজে হতভাগা নারীর অভাব নেই। তুমি বললে, আমি তোমাকে খুঁজে এনে দেবো। ওদের জন্য তোমার যা করার করো। আমি পাশে থাকবো। অন্তত এই কথা বলো না যে তুমি এর বোনের জন্য এসেছো। কারণ আমি ভালো করেই জানি, তুমি ঠিক কার জন্য এসেছো।”

আফিফ দুর্বল দৃষ্টিতে তাজওয়ারের দিকে তাকালো। আহি আফিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, আমি আফিফের জন্যই এসেছি।”

আহি এবার তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তো এখন কি করবে তুমি? আমার যার জন্য ইচ্ছে হয় আমি আসবো। তোমার কি? তুমি বরং চলে যাও। এন্ড সরি, তোমাকে টেনে শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে এনেছি।”

আহি কথাটি বলেই সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটির হাত থেকে লাঠি টেনে নিয়ে বলল,
“ঠিক যতোটা দাগ রেনুর শরীরে পড়েছে, ঠিক যতোটা আঘাত আফিফকে দেওয়া হয়েছে, সুদেআসলে মিটিয়ে দেবো আমি। এটা আমি করবো তাজওয়ার খান। তোমার যদি জ্বলে, পুড়ে, ছাই হয়ে যেতে ইচ্ছে হয়, তাহলে শুভকামনা রইলো।”

আহি এই কথা বলে হনহনিয়ে নিয়াজের বাড়ির দিকে গেলো। নিয়াজ তাজওয়ারের অপেক্ষায় বারান্দার সোফায় বসেছিল। আহি নিয়াজকে দেখেই বলল,
“তুমি নিয়াজী তালুকদার, রাইট?”

নিয়াজী তালুকদার চমকে বলে উঠলেন, “হ্যাঁ।”

আহি ঠাস করে নিয়াজীর গালে চড় মেরে বলল,
“জ্বলছে খুব? একটা মেয়ের চামড়ায়ও একই পীড়া হয়। তোমার শক্তি তো আরো বেশি হওয়ার কথা। ধরে নাও এর চেয়ে দ্বিগুণ হয়েছে।”

নিয়াজী সোজা হয়ে দাঁড়ানোর আগে আহি তার পেটে লাথি মেরে তাকে মেঝেতে ফেলে দিলো আর বলল,
“খেয়ে খেয়ে শরীরে চর্বি বাড়িয়ে একটা মেয়ের গায়ে হাত তুলতে লজ্জা করে না? কাপুরুষ লোক।”

আহি লাঠি দিয়ে আঘাত করতে যাবে তার আগেই নিয়াজের লোক এসে আহিকে ধরে ফেললো। আহি একনজর তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
“ডোন্ট টাচ মি।”

তাজওয়ার রেগেমেগে তেড়ে এসে লোকটাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো আর বলল,
“ডোন্ট টাচ হা’র। সি ইজ মা’ই লেডি।”

আহি এবার নিয়াজীর বুকের উপর পা রেখে বলল,
“পুরুষত্ব দেখাতে ইচ্ছে করলে উঠে আমার গায়ে হাত তোল।”

তাজওয়ার আহিকে সরিয়ে দিয়ে বলল,
“পাগলামো করছো কেন আহি?”

“তাহলে তুমি আমার হয়ে এই বদমাশ লোকের মুখটা লাল-নীল করে দাও। নয়তো আমিই এই কাজ করবো। আর যদি আমাকেই এই কাজ করতে হয় ভবিষ্যতে তোমাকে তো আমার বিশ্বাসই হবে না।”

তাজওয়ারের মাথায় রক্ত উঠে গেলো। সে আহির হাত থেকে লাঠি নিয়ে ইচ্ছেমতো নিয়াজকে পেটাতে লাগলো। আর আহি একপাশে দাঁড়িয়ে মনে মনে হাসছে। তাজওয়ারের মার খেলে রেনুর গায়ে ভবিষতে যে আর এই বাড়ির কেউ হাত তুলবে না, এই ব্যাপারে নিশ্চিত আহি।
এদিকে আফিফ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আহি একনজর আফিফের দিকে তাকালো। শরীর কাঁপছে আফিফের। সে পদ্মকে মেসেজ করে বলল,
“আফিফ ঠিক আছে, কিন্তু হাসপাতালে নিয়ে যাবো ওকে। একটু ব্যথা পেয়েছে। তুই চলে আসিস ওখানে। আমি তোকে এড্রেস লিখে দিবো একটু পর। আর চিন্তা করিস না। নিয়াজকে উচিত শিক্ষা দিয়েছি। এই জন্মে তো রেনুকে রানী হওয়া থেকে কেউ আটকাতে পারবে না। চট্টগ্রামের জুনিয়র ডন এসেই শায়েস্তা করছে বেটাকে।”

(***)

তাজওয়ার ঘেমে নেয়ে শেষ। নিয়াজকে ইচ্ছেমতো পিটিয়ে লাঠিটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো সে। আহি নিয়াজের কাছে এসে তার মুখের উপর ঝুঁকে বলল,
“নেক্সট টাইম বউ পেটালে হাসপাতালের আইসিউতে পৌঁছে যাবে। আর যদি এই ব্যাপারে বাইরের কেউ জানে তোমাকে গুম করিয়ে দেবো।”

আহি এবার তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোমার বাবা তো আবার মানুষ গুম করতে পারদর্শী। তিনি নিজের হবু পুত্রবধূর নানাকে গুম করিয়ে ফেলেছেন। এই সামান্য মানুষটাকে পারবে না?”

তাজওয়ার ক্ষীণ কন্ঠে বললো, “আহি প্লিজ।”

“যদি আমার সাথে করা অন্যায়গুলোর এতো ভারী না হতো, আজ সত্যিই আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিতাম। কিন্তু তোমার বাবা তো আমার ছোটবেলা কেঁড়ে নিয়েছে। আজ আমার মা যদি আমার থেকে দূরে থাকে, তাহলে তোমার বাবার কারণে। আর তুমি সেই বাবার আদর্শ ছেলে।”

তাজওয়ার আর কিছু বললো না। আহি আফিফের কাছে এসে বলল,
“জানি না আমি তোমার এই অবস্থার জন্য কীভাবে দায়ী। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি কাউকে কষ্ট দিতে চাই না। তবুও মানুষ আমার কারণেই কষ্ট পাই। আমি নিজেও খুব একটা সুখী নই। অন্তত আমাকে ঘৃণা করো না। আমার ভালোবাসা গ্রহণ করার মতো ক্ষমতা তোমার ছিল না। ঘৃণা করার মতো মনও রেখো না৷ তোমার কাছ থেকে এর চেয়ে বেশি কিছু চাইবো না আমি।”

আহি নিয়াজের বাড়ি থেকে বের হয়ে ড্রাইভারকে কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“আংকেল, আপনি প্লিজ উনাকে হাসপাতালে দিয়ে যান। যা খরচ হয়, এখান থেকেই করবেন।”

তাজওয়ার বের হয়ে আহির কাছে আসতেই আহি বলল,
“আমাকে নাসিরাবাদ নামিয়ে দিতে পারবে? আমার একটা কাজ আছে।”

তাজওয়ার আফিফের দিকে তাকালো। আহি বলল,
“ড্রাইভার আংকেল উনাকে হস্পিটালে নিয়ে যাবেন। আমি আমার ফ্রেন্ডকে মেসেজ দিয়ে জানিয়ে দিচ্ছি।”

তাজওয়ার আহির কথায় বেশ খুশি হলো। আহি যে আফিফের সাথে যাচ্ছে না, তার সাথে যাচ্ছে, এটাই তাজওয়ারের জন্য অনেক বেশি। যদিও আফিফ যেতে চাইছিলো না, কিন্তু আহি জোর করে আফিফকে গাড়িতে উঠালো। এরপর গাড়ির দরজা বন্ধ করে জানালার হাত রেখে বলল,
“পদ্ম আমাকে বলেছিল আপনার সাহায্য করার জন্য, তাই আপনাকে হস্পিটালে পৌঁছে দেওয়া আমার দায়িত্ব।”

আফিফ আহির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। জীবনটা আফিফকে এমন পর্যায়ে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, সে বুঝতেই পারছে না কি করবে। আহিকে কষ্ট দেওয়ার ইচ্ছে তার ছিল না। কিন্তু পরিস্থিতি তাকে বলতে বাধ্য করেছে।

(***)

আহি তাজওয়ারের গাড়িতে উঠে বসলো। নিজেই গাড়ির জানালা খুলে দিয়ে বলল,
“আমার দম বন্ধ লাগছে।”

তাজওয়ার আহির উড়ন্ত চুলগুলো ছুঁয়ে দিতে যাবে আহি তার হাত আটকে দিয়ে বলল,
“এই মুহূর্তে আমার এসব ভালো লাগছে না।”

তাজওয়ার আর কিছু বললো না। আহিকে ড্রাইভার নাসিরাবাদ নামিয়ে দিয়ে চলে গেলো। আহি রাস্তার মোড়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। এই রাস্তা ধরে সে কতোবার যে আফিফের পিছু নিয়েছিলো, তার হিসেব নেই। তার সব অনুভূতি তো মিথ্যে হয়ে গিয়েছিল, এখন নতুন করে কেন সে জানলো আফিফ তাকে ঘৃণা করতে চায়ছে।

আহি হাঁটতে লাগলো সেই রাস্তা ধরে। আজ সেই রাস্তা ধরে হাঁটছে না সেই কিশোরী। আজ হাঁটছে একটি ভাঙা হৃদয়ের তরুণী। আজ নেই তার সামনে আঠারো বছরের সেই ছেলেটি। সে তো ধুলোয় মিশে গেছে।

(***)

আহি হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলো চারুশিল্পের সামনে। গেটটির মুখোমুখি চায়ের দোকানটিতে গিয়ে বসলো সে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো গেটটির দিকে আর মনে মনে বলল,
“ঘৃণা আছে। থাকুক না হয়। কিন্তু আমার ভালোবাসার মৃত্যু কখনো হবে না। প্রিয় মানুষ পৃথিবী থেকে মুছে গেলেও তাদের ভালোবাসা বেঁচে থাকে। তাহলে আমি তোমার ঘৃণা নিয়ে কেন তোমাকে ভালোবাসতে পারবো না, এআর? পাওয়ার আশায় তো সবাই ভালোবাসে না। কিছু ভালোবাসা অপ্রকাশ্যেও হয়। আমার ভালোবাসা অধরা থাকুক। জানি না আমি তোমার জীবনটা কীভাবে এলোমেলো করে দিয়েছি। হয়তো করেছি। কিন্তু আমার মন ভাঙার অপরাধে আমি তোমাকে কোনো শাস্তি দেবো না। তোমাকে কখনো ঘৃণা করবো না। কারণ ভালোবাসার মানুষকে ঘৃণা করা যায় না।”

চলবে-

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে