উধয়রনী পর্ব-২৩+২৪

0
348

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-২৩||

৪০।
ভারী পুরুষালী স্বর কর্ণগোচর হতেই আহির ঘুম ভেঙে গেলো। সে গায়ে জড়ানো কাঁথাটা হালকা সরিয়েই ভ্রূ কুঁচকালো। এরপর রুমের দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলো, দরজা খোলা। আহি বার কয়েক পুষ্পকে ডাকলো। কিন্তু পুষ্পের সাড়াশব্দ নেই। আহি এবার কোমরে কাঁথাটা পেঁচিয়ে দরজার কাছে আসতে যাবে তখনই একজন অপরিচিত ছেলের মুখোমুখি হলো। আহি তার দিকে তাকিয়ে জোরপূর্বক হাসলো। আগন্তুক ছেলেটি ফোনে কারো সাথে কথা বলছিলো। সে আহির হাসির কারণ বুঝতে না পেরে ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। আহি নিজের হাসি গিলে এক পা এক পা করে সামনে এগিয়ে ছেলেটির মুখের উপর দরজাটা বন্ধ করে দিলো। দরজা বন্ধ করেই কাঁথাটা বিছানার উপর ছুঁড়ে মারলো আহি। দাঁতে দাঁত চেপে মনে মনে পুষ্পকে কিছুক্ষণ বকলো। তার এক বদভ্যাস, রাতে ঘুমানোর সময় হাঁটু অব্ধি প্যান্ট পরেই সে ঘুমায়। এখানে এসেও আহি এমনই করেছে। গতকালই পুষ্পের আপুর বাসায় উঠেছে আহি। তৃষা আপু বাসায় একা থাকেন। তার স্বামী মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। তিনি বাসায় খুব একটা আসতে পারেন না। কয়েক মাস পর পরই আসেন। তাই আহি নিজের বাসায় যেভাবে ঘুমায়, এখানেও ওভাবেই ঘুমিয়েছিলো।

জামা-কাপড় পালটে বিছানায় শান্ত হয়ে বসলো আহি। নিজের কপালে নিজেই চাপড় মারলো সে। মায়ের কথাগুলো মনে পড়তেই সে ভাবলো, অন্তত বাইরে তাকে একটু শালীন ভাবে চলতে হবে। আজ যদি এই অপরিচিত ছেলেটা তাকে এই অবস্থায় দেখে ফেলতো, তাহলে ভীষণ লজ্জায় পড়তে হতো আহিকে।

(***)

দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হতেই আহি দরজা খুলে দিলো। পুষ্প রুমে ঢুকে বলল,
“উঠেছিস তাহলে?”

আহি রাগী স্বরে বলল,
“দরজা খোলা রেখে গিয়েছিলি কেন? তুই জানিস না আমি ঘুমাচ্ছিলাম? ছেলে একটা কোথা থেকে চলে এসেছে!”

পুষ্প মুখ ছোট করে বলল,
“সরি আহি। হুড়োহুড়ি করে ছাদে গিয়েছিলাম। আমার জামাগুলো ওখানে শুকানোর জন্য দিয়ে এসেছি। আপুর বারান্দা তো অনেক ছোট। আর আপু অফিসে চলে যাচ্ছিল। ছাদের চাবিটা না-কি বাড়ির মালিককে দিয়ে দিতে হয়। আমি তো মালিককে চিনি না। আপুই দিয়ে যাবে।”

“আচ্ছা, কিন্তু ছেলেটা কে?”

“আরেহ, উনি উজ্জ্বল ভাইয়া।”

“এখানে কেন এসেছে?”

“আমি আসতে বলেছি তাই।”

“কেন আসতে বলেছিস? আমরা তো বাসায় পরশু যাচ্ছি।”

“তো আমরা এখানে এসেছি, একটু ঘুরবো না?”

“তো!”

“আরেহ ভাইয়ায় আমাদের ঘুরাবে। আমি তো এখানকার পথঘাট চিনি না। আর তুইও চিনিস না।”

উজ্জ্বলের কন্ঠে পুষ্প বেরিয়ে পড়লো। আহি মায়ের দেওয়া সেলোয়ার-কামিজ পরেই রুম থেকে বের হলো। উজ্জ্বল আহিকে দেখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। আহি উজ্জ্বলের তাকানো দেখে হালকা হাসলো। আহিকে হাসতে দেখে সেও হাসি ফেরত দিলো। এদিকে পুষ্প রান্নাঘর থেকে নাস্তা এনে ডায়নিংয়ে রেখে আহির দিকে কিছুক্ষণ ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। আহি ইশারায় জিজ্ঞেস করলো, কি?

পুষ্প জোরেই বলল,
“আহি তুই উলটো জামা পরেছিস?”

আহি চোখ বড় বড় করে পুষ্পের দিকে তাকালো। তারপর মুখ ছোট করে উজ্জ্বলের দিকে তাকালো। দেখলো উজ্জ্বল মুখ চেপে হাসছে। আহি তা দেখে দ্রুত পায়ে হেঁটে আবার রুমে ঢুকে পড়লো। আহি রুমে ঢুকতেই উজ্জ্বল হাসতে লাগলো। পুষ্প তা দেখে বলল,
“ভাইয়া, তুই হাসিস না তো। তখন মেয়েটা আর ঘুরতেই বের হবে না।”

উজ্জ্বল হাসি আটকে বলল,
“তোর বান্ধবীর মাথা নষ্ট!”

“চুপ কর, আমার বান্ধবীকে নিয়ে উল্টোপাল্টা কথা বলবি না।”

এদিকে আহি জামাটা ঠিকভাবে পরে রুমের দরজা হালকা খুলে পুষ্পকে ডাকলো। পুষ্প আসতেই সে বলল,
“ভাই, আমার নাস্তাটা এদিকে পাঠিয়ে দে। আমি তোর ওই ভাইয়ার সামনে আর যেতে পারবো না।”

পুষ্প ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“আহি, রিল্যাক্স। এটা স্বাভাবিক।”

পুষ্প টেনে আহিকে রুম থেকে বের করে ডায়নিংয়ে নিয়ে এলো। আহি চেয়ার টেনে বসতেই উজ্জ্বলও তার মুখোমুখি চেয়ার টেনে বসলো। আহি উজ্জ্বলের দিকে তাকিয়ে খাবার খাওয়ায় মনোযোগ দিলো।
পুষ্প ডায়নিংয়ে নীরবতা দেখে একনজর আহির দিকে তাকালো, আরেক নজর উজ্জ্বলের দিকে। সে বুঝতে পারলো আহি ইতস্ততবোধ করছে। তাই আহিকে স্বাভাবিক করার জন্য সে বলল,
“আহি, তোকে একটা মজার গল্প বলি, শোন।”

উজ্জ্বল খাওয়া বাদ দিয়ে ভ্রূ কুঁচকে পুষ্পের দিকে তাকালো। পুষ্প বলল,
“তখন আমি স্কুলে পড়তাম। ইদের ছুটিতে বাড়ি গিয়েছিলাম। উজ্জ্বল ভাইয়াও গিয়েছিল। ভাইয়া তখন ভার্সিটিতে পড়তো। আমাদের গ্রামের বাড়িতে গোসলঘরটা বাড়ি থেকে একটু দূরে। ওখানে আবার কাপড় রাখার হ্যান্ডেল থাকে না। জামা-কাপড় দরজায় ঝুলিয়ে রাখতে হয়…..”

উজ্জ্বল গম্ভীরমুখে বলল,
“পুষ্প, খেয়ে নে। খাওয়ার সময় কথা বলিস না।”

পুষ্প বিরক্তির সুরে বলল, “তুই চুপ কর।”

পুষ্প এবার খোশমেজাজে বলল,
“এরপর শোন না আহি। ভাইয়াও গোসল করার জন্য জামা-কাপড় নিয়ে গোসলঘরে চলে গেলো।”

উজ্জ্বল পুষ্পের কথা আটকে দেওয়ার জন্য চেয়ার ছেড়ে উঠে পুষ্পের মুখ চেপে ধরলো। পুষ্প উজ্জ্বলের হাত সরিয়ে দিয়ে গলা উঁচু করে বলল,
“তারপর আমাদের গ্রামের এক চাচা, ভাইয়ার জামা আর প্যান্ট দরজার উপর থেকে নিয়ে পালিয়ে গেলো।”

উজ্জ্বল চোখ রাঙিয়ে পুষ্পের দিকে তাকালো। আর তাকে ধরার জন্য ডায়নিংয়ের চারপাশে ঘুরতে লাগলো। পুষ্পও ডায়নিংয়ের চারদিকে ঘুরছে আর উজ্জ্বলের হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। আহি উৎসুক দৃষ্টিতে দুই ভাই-বোনের খুঁনসুঁটি দেখছে। পুষ্প দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে বলল,
“তারপর ভাইয়া তো পড়লো এক বিপদে। সেখানে দাঁড়িয়েই সে সবার নাম ধরে ডাকছিল। কিন্তু কেউই সাড়া দিলো না। শেষমেশ কি হলো জানিস?”

পুষ্প কিছুক্ষণ হাসলো। তারপর বলল,
“গোসলঘরের উপরে একটা কলা গাছ ছিল। ভাইয়া ওখান থেকে কলাপাতার ডাল ছিঁড়ে কিভাবে যেন কোমরে পেঁচিয়ে, সেখান থেকে বের হয়েছিল।”

উজ্জ্বল এবার থেমে গেলো। সে আহির দিকে তাকালো। দেখলো আহি শব্দ করে হাসছে। সে এবার পুষ্পের দিকে চোখ ছোট করে তাকালো। এদিকে আহি উজ্জ্বলকে অবাক করে দিয়ে উৎসুক কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“কলাপাতা কেন লাগিয়েছে? যেই কাপড় পরে গোসলঘরে গিয়েছিলো, ওটাই পরে বের হয়ে আসতে পারতো।”

উজ্জ্বল আহির আগ্রহ দেখে সেখানে আর দাঁড়ালো না। সে অন্য রুমে চলে গেলো। পুষ্প উজ্জ্বলকে চলে যেতে দেখে গলার স্বর উঁচু করে বলল,
“ওটাও দরজায় ঝুলিয়ে রেখেছিল। তাই কলাপাতায় তার একমাত্র আশ্রয়স্থল ছিল।”

আহি উজ্জ্বলের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে এবার পুষ্পের হাত ধরে চাপা স্বরে বলল,
“পুষ্প, থাম। তোর ভাইয়া হয়তো রাগ করেছে। তোর এভাবে বলা উচিত হয় নি। আমি তো অপরিচিত একজন। এসব কথা বাইরের কাউকে বলে না।”

“আরেহ, রিল্যাক্স।”

“না, কীসের রিল্যাক্স? সরি বলে আয়।”

পুষ্প চোখ ছোট করে বলল,
“মায়ের চেয়ে দেখছি মাসির দরদ বেশি।”

উজ্জ্বল যেই রুমে গিয়েছে আহি পুষ্পকে সেদিকে ঠেলে পাঠিয়ে বলল, “যা না।”

পুষ্প বাধ্য হয়ে উজ্জ্বলের কাছে গেলো। এদিকে উজ্জ্বল পুষ্পকে দেখে বলল,
“কেন এসেছিস? তোকে নিয়ে আমি আর কোথাও যাচ্ছি না। আমি এখন নিজের কাজেই বের হবো।”

পুষ্প ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“সরি, সরি, সরি। ভাইয়া, তুই না আমার লক্ষী ভাইয়া। প্লিজ রাগ করিস না। আহি খুব ইতস্ততবোধ করছিল। আর তুইও ওর উপর হেসেছিস। তাই তোর সিক্রেট বলে কাটাকাটি করে ফেললাম।”

“এভাবে কেউ কাটাকাটি করে? ওর কিছুই কাটে নি, উলটো আমার পুরো নাকটাই কেটে দিয়েছিস।”

পুষ্প ভ্রূ কুঁচকে উজ্জ্বলের নাকের দিকে তাকিয়ে রইলো। উজ্জ্বল বিরক্তির সুরে বলল,
“কি দেখছিস?”

“দেখছি, নাকটা তো আগের জায়গায় আছে।”

উজ্জ্বল বলল,
“যা এখন, বিরক্ত করিস না। আমি এখন আর বের হবো না মানে, হবো না।”

হঠাৎ আহি দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে উজ্জ্বলকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“পুষ্পের সেই স্কুল থেকেই তার ছেঁড়া। কোথায় কি বলতে হয়, ও জানেই না। আপনি ওর কথায় কিছু মনে করবেন না। আর এসব ছোটখাটো ঘটনা সবার সাথেই ঘটে। আসলে আমার হাতে বেশিদিন সময় নেই। সিলেট অনেক বড় শহর। এটা তো দু’দিনে ঘুরে দেখা সম্ভব না। তাই দু’দিনে যতোটুকু ঘুরে দেখা যায়। আর আপনি যদি আমাদের নিয়ে না যান, তাহলে আমরা যদি পথে হারিয়ে যাই?”

উজ্জ্বল আহির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। আহি ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
“ভাইয়া প্লিজ।”

উজ্জ্বল আহির মুখের ভাব দেখে মৃদু হেসে বলল,
“আচ্ছা, তোমরা তৈরী হয়ে নাও।”

পুষ্প আহির কাছে এসে তাকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলল,
“ভাইয়া প্লিজ! বাহ, বাহ, বাহ! বেশ তো পটিয়ে ফেলেছিস আমার ভাইকে।”

আহি মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“আহির কথা কেউ সহজে ফেলতে পারে না।”

হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়তেই আহির মুখটা মলিন হয়ে গেলো। পুষ্প তা দেখে বলল,
“আবার মুখটাকে অন্ধকার করে ফেলেছিস কেন?”

আহি পুষ্পের দিকে তাকিয়ে না সূচক মাথা নেড়ে মৃদু হাসলো। আর মনে মনে বলল,
“শুধু তারাই আমার কথা রাখে নি, যাদের আমি খুব বেশিই গুরুত্ব দিয়েছিলাম।”

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-২৪(১ম ভাগ)||

৪১।
সবুজবিথীর ভীড়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি সাদা পরী। উজ্জ্বল স্তব্ধ হয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটির সাদা ওড়নাটি হালকা হাওয়ায় উড়ছে। হঠাৎ পুষ্প তার চোখের সামনে হাত নাড়িয়ে বলল,
“প্রেমে-টেমে পড়ে যাচ্ছিস না-কি ভাই?”

উজ্জ্বল ভ্রূ কুঁচকে পুষ্পের দিকে তাকালো। পুষ্প এক গাল হেসে বলল,
“আহির প্রেমে পড়বে না এমন ছেলে নেই। মেয়েটা আসলেই ভীষণ মিষ্টি।”

উজ্জ্বল মুচকি হেসে বলল,
“আর আমি মিষ্টি মেয়েদের ভীষণ ভয় পাই।”

“ভাইয়া, সব মেয়ে কিন্তু রীতিকা হয় না।”

“এসব কথা তুলিস না তো।”

“কেন তুলবো না? এতোদিন পর তোর সাথে দেখা হয়েছে। আর আমি এখনো সেই দেবদাসটাকেই দেখছি।”

“ব্রেকাপের পর নতুন সম্পর্কে না যাওয়ার অর্থ এই নয় যে আমি এখনো মুভ অন করতে পারি নি। নিজেকেও সময় দিতে হয়, বুঝলি?”

“বাই দা ওয়ে, রীতিকার কি অবস্থা?”

“বিয়ে করে বরের সাথে সংসার করছে। ওর খবর নেওয়ার সময় আছে না-কি আমার!”

“তৃষা আপু বললো শীঘ্রই তুই মামা হতে যাচ্ছিস।”

উজ্জ্বল বাঁকা চোখে পুষ্পের দিকে তাকালো। পুষ্প হেসে বলল,
“রীতিকার বাচ্চা তো তোকে মামা বলেই ডাকবে। আর যাই বলিস, তোকে বিয়ে করলে সত্যিই কপাল খুলতো ওর।”

উজ্জ্বল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“তখন বেকার ছিলাম, তাই চুটিয়ে প্রেম করার সময় পেয়েছি। এখন কাজে ব্যস্ত থাকি, তাই এসব ফাউল কাজে সময় দিতে পারছি না। আর রীতিকার কথা আমাকে বলিস না। ও নিজের সংসারে ভালোই আছে।”

পুষ্প এবার আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“আহি কিন্তু সত্যিই মিষ্টি। তুই ট্রাই করতে পারিস।”

“বেশি মিষ্টি মেয়েরা বাবা-মার বাধ্য সন্তান হয়। এমন বাধ্য সন্তানদের প্রেমে পড়ে দ্বিতীয়বার দেবদাস হতে চাই না।”

পুষ্প দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“যদি আহির ভাগ্য রীতিকার মতো হতো!”

“মানে?”

“ওকে দেখ, চা-বাগানে এসেই কেমন হাসছে! ওকে এভাবে হাসতে দেখি না কতো বছর!”

“কি হয়েছে ওর?”

“অনেক কিছুই হয়েছে। কিছু জানি, কিছু এখনো অজানা। মেয়েটা ভীষণ চাপা স্বভাবের। স্কুলে ওকে যেই রূপে দেখেছি, তখন আর এখনের আহির মধ্যে বিস্তর পার্থক্য।”

“কেমন পার্থক্য!”

“মিস্টার রিজওয়ান কবিরকে চিনিস?”

উজ্জ্বল কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
“বিজনেসম্যান রিজওয়ান কবিরের কথা বলছিস?”

“হুম।”

“হুম, চিনি তো। তাকে কে না চেনে!”

“উনি আহির বাবা।”

উজ্জ্বল চোখ বড় বড় করে পুষ্পের দিকে তাকালো। পুষ্প বলল,
“ভীষণ চাপে রেখেছে ওকে। ওর বাবা-মার ডিভোর্স হয়ে গেছে। মায়ের সাথে দেখা করার সুযোগই পায় না। লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা করে। এখন খানস গ্রুপের এমডির সাথে তার বিয়ে ঠিক করেছে।”

উজ্জ্বল অবাক কন্ঠে বলল, “তাজওয়ার খান!”

“চিনিস না-কি!”

“হ্যাঁ, ক্রিমিনাল একটা! কতোগুলো কেইস জমেছে জানিস? ভীষণ ডেঞ্জারাস লোক।”

পুষ্প উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,
“ওই ছেলেটার সাথেই আহির বিয়ে দেবে।”

উজ্জ্বল অবাক দৃষ্টিতে আহির দিকে তাকালো। এমন হাস্যোজ্জ্বল একটা মেয়ের জীবনে এতো ঝামেলা!

(***)

লাক্কাতুরা চা-বাগান ঘুরে মালনীছড়া চা-বাগান চলে গেলো তারা। আহি ছোট একটা বেঞ্চে একা একা বসে আছে। পুষ্প ছবি তুলতে ব্যস্ত। উজ্জ্বল খেয়াল করলো আহি একা বসে আছে। সে পুষ্পের হাতে ক্যামেরা ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“তুই ছবি উঠাচ্ছিস, আর তোর ফ্রেন্ড একা বসে আছে। ওকে ডাক। ওসহ ছবি উঠাক।”

“ডেকেছি। বললো ভালো লাগছে না।”

“তাহলে তুই নিজের ছবি নিজে উঠা। আমি আর তোর ক্যামেরাম্যান হতে পারবো না।”

উজ্জ্বল কিছুক্ষণ পর আহির পাশে এসে বসলো। আহি একনজর উজ্জ্বলের দিকে তাকিয়েই পুষ্পের দিকে তাকালো। উজ্জ্বল নীরবতা ভেঙে বলল,
“তুমি ছবি তুলবে না?”

“না, ভালো লাগছে না।”

“কেন? জায়গাটা পছন্দ হয় নি?”

“হয়েছে। অনেক সুন্দর।”

আহি কথাটি বলেই মলিন হাসলো। আর মনে মনে বলল,
“মনে আনন্দ না থাকলে, পৃথিবীর কোনো সৌন্দর্যই মানুষকে আকর্ষণ করতে পারে না।”

উজ্জ্বল কৌতূহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“বন, পাহাড় আর সমুদ্র এই তিনটির মধ্যে তোমার প্রিয় স্থান কোনটি?”

আহি মুচকি হেসে বলল, “বন।”

“কেন?”

“কারণ বন-বনানীর ভীড়ে অনেক রহস্য লুকিয়ে থাকে।”

“সমুদ্রে বুঝি রহস্য নেই?”

“সমুদ্রের রহস্য ভেদ করা সহজ নয়। কোনো না কোনো অজানা তথ্য থেকেই যায়। আর যেই রহস্য ভেদ করা যায় না, তাকে রহস্য বলা যায় না। তাকে বলতে হয় মায়াজাল। আপনি যতোই সেই জালে নিজেকে জড়াবেন, ততোই হারিয়ে যাবেন। কিন্তু বনভূমির রহস্যগুলো সহজেই খুঁজে বের করা যায়। দরকার শুধু ইচ্ছে শক্তি আর সুযোগ। কিন্তু অনেকেই সেই সুযোগ পায় না বা ইচ্ছেশক্তিই থাকে না।”

উজ্জ্বল ভ্রূ জোড়া কুঁচকে বলল,
“অনেক জটিল কথা। তুমি কি নিয়ে পড়ছো?”

“সাহিত্য নিয়ে।”

“তাই বলি। কথার মধ্যেই আলাদা গভীরতা আছে। সহজ-সরল মানুষ এসব বুঝবে না।”

আহি হাসলো। পরক্ষণেই জিজ্ঞেস করলো,
“আপনার পড়াশুনা?”

“আমার পড়াশুনা অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। বর্তমানে আমি একজন লয়ার।”

আহি অবাক হয়ে বলল, “আপনি লয়ার?”

উজ্জ্বল হালকা হেসে বলল,
“হ্যাঁ, অবাক হওয়ার মতো কিছু না।”

আহি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর বলল,
“এমন কোনো কেইস পেয়েছেন, যেখানে প্রাপ্ত বয়ষ্ক মেয়ে অভিভাবকের হাতে জিম্মি?”

উজ্জ্বল আহির দিকে তাকালো। সেকেন্ড খানিক পর বলল,
“তোমাকে কেউ জিম্মি করে রেখেছে?”

আহি উজ্জ্বলের প্রশ্ন শুনে মলিন মুখে তার দিকে তাকালো। উজ্জ্বল বলল,
“আমি এমন কেইস পাই নি। তবে এমনটা হওয়া অস্বাভাবিক নয়।”

আহি উজ্জ্বলকে কিছু বলতে গিয়েও বললো না। উজ্জ্বল আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“অভিভাবক যদি জিম্মি করে রাখে, তাহলে কেইস করার নিয়ম আছে। এমন কোনো আইন নেই, যেখানে অভিভাবক হলেই তার পক্ষে রায় যাবে। সত্যটাও বিচার করে দেখা হয়। আর অনেক বাবা-মা আছেন, যারা তাদের সন্তানদের জন্য ফেরেশতা হয় না, কিছু জালিমও আছে। তাদের জন্যও আইনগত ব্যবস্থা আছে।”

“প্রভাবশালী কারো জন্য আলাদা আইন আছে?”

আহির কথায় উজ্জ্বল চুপ হয়ে গেলো। এই দেশে প্রভাবশালীরা পার পেয়ে যায়, এটাই নিয়ম। আহি উজ্জ্বলকে চুপ থাকতে দেখে মলিন হাসলো আর বলল,
“দেখেছেন, আপনি উত্তর দিতে পারলেন না। সত্যটা কি জানেন? আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান নয়। আসামী যদি প্রভাবশালী হয়, তাহলে কোনো ধারায় আপনি তাকে দন্ডিত করতে পারবেন না।”

উজ্জ্বল বলল,
“আধুনিক সমাজে একটা শব্দ খুবই প্রচলিত।”

“কি!”

“ভাইরাল।”

আহি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে উজ্জ্বলের দিকে তাকালো। উজ্জ্বল বলল,
“মিডিয়া অনেক বড় শক্তি। কেউ যদি ভিক্টিম হয়, আর আইনের দৃষ্টিতে সে যদি সুষ্ঠু বিচার না পায়, তাহলে তার জীবনের একমাত্র শক্তি মিডিয়া আর পাব্লিক। মিডিয়ার দরকার নিউজ, পাব্লিকের দরকার বিনোদন, বিষয় আর হৈ হৈ করার একটা সোর্স। মাঝখানে লাভ হবে সেই ভিক্টিমের। অন্তত কয়েক মাসের জন্য হলেও প্রভাবশালীদের হাতের মুঠোয় আবদ্ধ করা যাবে। আর যদি এর লেজ বের করা যায়, যেমন একটা সূত্র ধরে অন্য একটা তথ্য ফাঁস করার ট্রেন্ড চালু করা যায়। তাহলে অপরাধীর সাহায্যকারীরা তার কাছ থেকে দূরে সরে যাবে। আর তখন সে টাকা দিয়েও কোনো মানুষকে কিনতে পারবে না।”

আহি উজ্জ্বলের দিকে ঘুরে বসে বলল,
“কীভাবে মিডিয়ার কাছে এমন তথ্য পৌঁছানো যাবে?”

“ভাইরাল হতে হবে। তবে এতোটাও সহজ নয়। অনেক শক্ত প্রমাণ, দৃঢ় মনোবল আর মানসিক শক্তি লাগবে। মিডিয়া নয়তো ভিক্টিমকেই রোস্ট করে ছেড়ে দেবে।”

আহি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। এতো শক্তি নেই তার। নিজের জন্য একমাত্র সে-ই জীবিত। কাউকে তার জীবনের ঝামেলায় জড়িয়ে সংকটে ফেলতে চায় না আহি।

৪২।

বিকেলে উজ্জ্বল আহি আর পুষ্পকে নিয়ে গেলো ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর পর্যটন কেন্দ্রে। সেখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতেই আকাশ মেঘলা হয়ে গেলো। পুষ্প নিজের ক্যামেরা উজ্জ্বলকে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“ভাইয়া, তাড়াতাড়ি কয়েকটা ছবি উঠিয়ে দে। বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলে, আমার সিলেট আসাটাই বৃথা হয়ে যাবে।”

উজ্জ্বল একনজর আহির দিকে তাকালো। দেখলো আহি একটা পাথরের উপর বসে স্বচ্ছ পানিতে তার পা দু’টি ডুবিয়ে রেখেছে। আর একটু পর পর সে পা দু’টি ঝাঁকিয়ে পানির সাথে খেলছে। উজ্জ্বল পুষ্পকে কয়েকটা ছবি উঠিয়ে দিয়ে বলল,
“তুই ভীষণ অস্থির। তোর ছবি তুলে দিতে দিতে আমার হাত ব্যথা হয়ে যাচ্ছে।”

পুষ্প ঠোঁট ফুলিয়ে উজ্জ্বলের দিকে তাকালো। আর টান দিয়ে নিজের ক্যামেরাটা নিয়ে নিলো। উজ্জ্বল ক্যামেরাম্যানের পদ থেকে মুক্তি পেয়েই ধীর পায়ে আহির কাছে এসে দাঁড়ালো। আহি উজ্জ্বলের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
“ছবি তুলে দিচ্ছেন না যে পুষ্পকে!”

উজ্জ্বল বলল,
“অনেক তো উঠিয়ে দিয়েছি। এখন একটু আশেপাশে ঘুরে দেখুক। এতো ছবি দিয়ে যে কি করবে মেয়েটা!”

আহি নিঃশব্দে হাসলো। উজ্জ্বল বলল,
“তুমি কি ছবি কম উঠাও?”

“হুম, খুব একটা তুলি না। আমার স্ক্যান করতে ভালো লাগে।”

“বেশ তো! স্ক্যান করলে স্মৃতিতে অনেকদিন গেঁথে থাকবে। তবে ছবি একটা তুলে রাখতে হয়।”

আহি হাঁটুতে মাথা রেখে বলল,
“শিল্পীদের ছবি তুলতে হয় না। তারা ছবি বানিয়ে ফেলে।”

উজ্জ্বল আহির পাশে বসে বলল, “তুমি শিল্পী?”

আহি উজ্জ্বলের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। বলল,
“অনেক দিন ছবি আঁকি নি। তবে একটা সময় অনেক ছবি এঁকেছিলাম। ছবি আঁকা আমার স্বপ্ন ছিল, আমার ভালোবাসা ছিল, আমার বেঁচে থাকার শক্তি ছিল।”

“এখন?”

“হারিয়ে ফেলেছি। স্বপ্ন, ভালোবাসা, শক্তি কিছুই আর নেই। আছি শুধু আমি আর আমার অতীত।”

“একটা ছবি এঁকেই না হয় দেখো। দেখবে আবার সব ফিরে পাবে।”

উজ্জ্বলের কথা শুনে আহি চকিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো। উজ্জ্বল আহির চাহনি দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লো। গভীর আর অস্থির নয়ন জোড়া কিছু একটা তো বলতে চায়ছে। ভাসা ভাসা জল জমেছে সেই নয়ন জোড়ায়। উজ্জ্বল চোখ সরিয়ে নিলো। আরো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে নিশ্চিত প্রেমে পড়ে যেতো। আহি তার হাঁটু আঁকড়ে ধরে বলল,
“আমি শত ছবি আঁকলেও কিছুই ফিরে পাবো না। যেটা হারিয়ে যায়, সেটা ফিরে আসে না। যদি আসে, তাহলে হারিয়ে যাওয়াটা বেমানান।”

উজ্জ্বল ভাবুক মনে বলল, “যদি আসে?”

“কি আসবে?”

“যেটা হারিয়ে গেছে!”

আহি মলিন হাসলো। বলল,
“আমার হয়ে আসলে, আমি হারিয়ে যেতেই দেবো না।যদি আমার না হয়, তাহলে সেটা আমি ছুঁয়েও দেখবো না। সব জিনিসই আমার একার চাই। কারো স্পর্শ থাকুক, সেটা আমার সহ্য হয় না। যেমন আমি আমার বাবা-মার একমাত্র মেয়ে। মা-ও আমার একার, বাবাও একদিক দিয়ে আমারই। ভাগ করে নেওয়া আমি শিখি নি। আমার জিনিসের ভাগ আমি কাউকে দেই না। যেহেতু হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন আমার ভাগের ছিল না, তাই আমি যেতে দিয়েছি।”

উজ্জ্বল ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“স্বপ্নটা কি কোনো মানুষকে ঘিরে?”

আহি ভাবুক কন্ঠে বলল,
“স্বপ্নটাই একটা রহস্য। সেটা অজানা থাকাই ভালো!”

“তোমার ফিলোসোফি আমাকে পাগল করে দিচ্ছে।”

“লয়ার হয়ে এটুকু নিতে পারছেন না, আসামীদের তালগোল পাকানো কথায় তো পেঁচিয়ে যাবেন।”

“ভাগ্যিস আসামীরা তোমার মতো ফিলোসোফি নিয়ে চলে না। তবে আমি তোমার ফিলোসোফি বুঝে নিয়েছি। কিন্তু প্রকাশ করতে চাচ্ছি না। যেটা তুমি জানাতে চাও না, সেটা জেনে যাওয়ার অহংকার আমি রাখবো না।”

আহি শব্দ করে হাসলো। পুষ্প আহির হাসির শব্দ শুনে পেছন ফিরে উজ্জ্বলের দিকে বাঁকা চোখে তাকালো। উজ্জ্বল পুষ্পের চাহনি দেখে আহির পাশ থেকে একটু সরে বসলো। পুষ্প মনে মনে বলল,
“দেবদাস বাবু দেখছি এবার জুলিয়েট খুঁজে নিয়েছে।”

(***)

সন্ধ্যার পর উজ্জ্বল আহি আর পুষ্পকে তৃষার বাসার সামনে নামিয়ে দিলো। যাওয়ার আগে উজ্জ্বল গাড়ির কাচ নামিয়ে আহিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“কাল কোথায় যাবে?”

আহি পেছন ফিরে উজ্জ্বলের দিকে তাকিয়ে সৌজন্যমূলক হাসি ফেরত দিয়ে বলল,
“আপনি যেখানে নিয়ে যান।”

পুষ্প গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“ব্যস, ব্যস। অনেক হয়েছে। কাল না হয় দেখা যাবে।”

উজ্জ্বল কপাল কুঁচকে পুষ্পের দিকে তাকালো। পুষ্প গাড়ির কাছে এসে বলল,
“একদিনে রোমিও হওয়া যায় না। একটু সময় নিলে ভালো।”

উজ্জ্বল মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“তোর মাথায় গোবর ছাড়া কিছুই নেই। আমি জাস্ট ফরমালিটি মেইনটেইন করছি।”

“খুব ভালো। তোর ফরমালিন যুক্ত ফরমালিটি দেখাতে হবে না।”

“তোর এতো কেন জ্বলছে? ছবি তুলে দেই নি তাই? না-কি দেবদাস থেকে প্রমোশন পেয়ে রোমিও হয়ে যাচ্ছি, আর তুই রীতিকার নাম ধরে আর জ্বালাতে পারবি না তাই! কোনটা?”

“দু’টোই। একটা ছবিও তুই সুন্দর করে তুলে দিস নি। ইচ্ছে করে করেছিস সব।”

“ভালো করেছি। এবার আমাকে ভবিষ্যতে আর ক্যামেরাম্যান বানাবি না।”

পুষ্প মুখ ছোট করে উপরে চলে এলো। এদিকে আহি ফ্রেশ হয়ে মাত্রই বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়েছে তখনই তাজওয়ারের কল এলো। তাজওয়ারের নম্বর দেখেই আহির মেজাজ বিগড়ে গেলো। সে কলটা কেটে রাদের নম্বরে ডায়াল করলো। ওপাশ থেকে সাথে সাথেই কলটা রিসিভ হলো। আহি বলল,
“ফোন হাতে নিয়ে বসে ছিলি না-কি?”

রাদ গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“বান্ধবীকে পেয়ে বন্ধুর কথা মনেই রাখিস নি!”

“সরি, সকাল থেকেই বাইরে ছিলাম।”

“কোথায় কোথায় গেলি?”

“চা বাগান, সাদা পাথর এই দুই জায়গায় গেলাম।”

“ভালো তো। এখন, কেমন আছিস বল?”

“ভালো আছি। তবে মাকে মিস করছি।”

“কথা হয়েছে?”

“হ্যাঁ।”

রাদ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। আহিও নীরব। রাদ এবার নীরবতা কাটিয়ে বলল,
“আহি, তোকে অনেক দিন দেখি নি তাই কেমন যেন অস্থির লাগছে।”

“কেন?”

“জানি না।”

“মন খারাপ তোর?”

রাদ মলিন মুখে বললো, “না।”

“তোর এই না মানেই তো হ্যাঁ। বল না রাদ। কি হয়েছে?”

রাদ প্রসঙ্গ পালটে বলল,”তুই কখন আসবি?”

“আসবো তো আগামীকাল।”

“কয়টায় আসবি?”

“রাত হবে।”

“পুষ্পের সাথে আসবি?”

“আসার তো ইচ্ছে আছে। এখন সিচুয়েশনের উপর নির্ভর করছে। বাবা যদি তাজওয়ারকে পাঠায়, তাহলে ওর সাথেই আসতে হবে।”

“রাতে ওই ছেলের সাথে আসবি? ভালো লাগছে না আহি। আসিস না এভাবে।”

“তুই ভয় পাচ্ছিস?”

“অবশ্যই পাচ্ছি।”

আহি নিঃশব্দে হাসলো। বলল,
“কিছু হবে না আমার। ও আমার সাথে খারাপ কিছু করবে না।”

“ওভার কনফিডেন্স রাখা ভালো না। বাসে করে আসিস। ট্রেনে আসলে ক্যাবিন ভাড়া করিস না। ওই ছেলের সাথে একা এক সেকেন্ডও থাকবি না।”

আহি মিষ্টি হেসে বলল,
“তুই যদি আমার বাবা হতি।”

রাদ শব্দ করে হাসলো। আহি বলল, “হাসছিস কেন?”

“তুই যখন পৃথিবীর আলো দেখেছিস, তখন আমি ঠিকভাবে দাঁড়াতেও পারতাম না।”

“ইশ! যদি তুই আমার বাবা হতি।”

“চুপ কর। তুই যদি আমার মেয়ে হতি কয়েশ বার তোর কান মলে দিতাম।”

“সাহস থাকলে দে। আমিও তোর কান মলে, টেনে, ছিঁড়ে কান ছাড়া করে ছাড়তাম।”

“বাবার সাথে বেয়াদবি! কি দিন দেখতে হচ্ছে!”

“মেয়েকে বেশি শাসন করলে এমনই হয়।”

“ছি! ছি! এমন ব্যবহার দেখার আগে আমি মরে কেন গেলাম না। সন্তানের কাছে এমন ব্যবহার মোটেও কাম্য নয়।”

আহি রাদের কথা শুনে হাসতে লাগলো। রাদ মুচকি হেসে বলল,
“আচ্ছা রেস্ট নে। পরে কথা হবে।”

আহি কল কেটে দিতেই রাদ ফোনটা বুকের উপর রেখে মুচকি হাসলো। আর মনে মনে বলল,
“তোর এই মিষ্টি হাসিটাই আমার মন ভালো করার ওষুধ। মিস ইউ আহি।”

রাদের কল কাটতেই আহির ফোনে আবার তাজওয়ারের কল এলো। এবার আহি ফোন সাইলেন্ট করে দিয়ে মনে মনে বলল,
“শ’খানেক কল দেওয়ার পরই আমি তোমার কল রিসিভ করবো, মিস্টার তাজওয়ার খান। তোমাকে বুঝতে হবে, আহির অ্যাপয়েনমেন্ট পাওয়াও এতো সহজ নয়।”

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-২৪(২য় ভাগ)||

৪৩।
আহি সিঁড়ি বেয়ে নেমে দেখলো উজ্জ্বল একটা ছেলের সাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছে। আহিকে দেখে উজ্জ্বল মৃদু হাসলো। উজ্জ্বল তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটিকে দেখিয়ে দিয়ে বলল,
“আমার বন্ধু রইস।”

আহি রইসের দিকে তাকিয়ে সৌজন্যমূলক হাসি ফেরত দিলো। রইসও হালকা হেসে উজ্জ্বলের দিকে তাকালো। রইসের কৌতূকময় চাহনি দেখে উজ্জ্বল চোখ ছোট করে তার দিকে তাকালো। রইস তা দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। এদিকে পুষ্প নিচে নেমে রইসকে দেখে বলল,
“ভাইয়া আপনিও যাচ্ছেন?”

রইস হেসে বলল, “হ্যাঁ।”

পুষ্প এক গাল হেসে মনে মনে বলল,
“ভালোই হয়েছে। রইস ভাইয়াকে বললে উনি নিশ্চিত আমার ছবি উঠিয়ে দেবেন।”

(***)

রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট পৌঁছাতেই আহির ফোন বেজে উঠলো। আহি ব্যাগ থেকে ফোন বের করে দেখলো তাজওয়ারের পঁচাত্তরতম কল। কাল সারারাত ফোন দিয়েছে সে। আহি ফোন সাইলেন্ট করেই ঘুমিয়ে পড়েছিলো। সকাল থেকেই অনবরত কল দিচ্ছে তাজওয়ার। একটুও বিরতি দিচ্ছে না। আহি বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে তার কল দেখে। এরই মধ্যে মিসেস লাবণিও কয়েক বার ফোন করেছেন। আহি ফোনের দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তখনই উজ্জ্বল বলে উঠলো,
“নৌকা ভাড়া করে ফেলেছি। চলো।”

আহি নৌকায় উঠেই একপাশে গিয়ে বসলো। তখনই আবার ফোন বেজে উঠলো। পুষ্প বলল,
“বার বার তোকে কে কল করছে?”

আহি ফোনটা বের করে কাটতে যাবে, দেখলো রিজওয়ান কবির কল দিয়েছেন। বাবার কল দেখেই আহি পুষ্পের দিকে তাকিয়ে হাতের ইশারায় চুপ থাকতে বলল। এদিকে উজ্জ্বল আহির ভীত আঁখি জোড়ার দিকে তাকিয়ে আছে। আহি কল রিসিভ করতেই রিজওয়ান কবির বাজখাঁই সুরে বললেন,
“তাজওয়ার তোমাকে কল দিচ্ছে তুমি ধরছো না কেন?”

আহি মলিন মুখে বললো,
“এই মাত্র ফোন হাতে নিয়েছি। ফোনটা ব্যাগে ছিল। বিয়ে বাড়ি বলে কথা।”

উজ্জ্বল আর রইস ভ্রূ কুঁচকে আহির দিকে তাকালো। আহি চোখ-মুখ কুঁচকে রেখেছে। রিজওয়ান কবির বললেন,
“তাজওয়ার সিলেট পৌঁছে গেছে। তুমি ওকে এড্রেস দাও, তোমাকে নিতে যাবে।”

“এখন?”

“হ্যাঁ।”

“বাবা, আমি পুষ্পের সাথে ঘুরতে বের হয়েছি। বাসায় ফিরে দেই?”

“কার বাসায়?”

“আই মিন বাড়িতে। পুষ্পের বাড়িতে গিয়েই দেবো।”

“এখন অন্তত তাজওয়ারকে জানিয়ে দাও। ও অস্থির হয়ে যাচ্ছে।”

আহি দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “অস্থির হলে হোক!”

“কি?”

“আচ্ছা, আমি কল ব্যাক করছি ওকে।”

আহি বাবার কল কাটতেই পুষ্প জিজ্ঞেস করলো,
“কি বলেছে আংকেল?”

আহি বিরক্তির সুরে বলল,
“তাজওয়ার আমাকে নিতে সিলেট চলে এসেছে।”

তখনই আবার আহির ফোনে কল এলো। আহি এবার কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ঝাঁঝালো কণ্ঠে তাজওয়ার বলল,
“তোমার এই এ্যাটিটিউড তোমাকে নিয়েই ডুববে।”

আহি শান্ত কন্ঠে বললো,
“আমি ফোনের কাছে ছিলাম না।”

তাজওয়ার আহির কন্ঠ শুনেই চুপ হয়ে গেলো। আহি কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে বলল, “মরে গেছো?”

তাজওয়ার হালকা হেসে বলল,
“কাইন্ড অব। তোমার মিষ্টি কন্ঠটা শুনলে আমার হৃদ স্পন্দন বেড়ে যায়।”

“তাহলে তোমার ডাক্তার দেখানো উচিত।”

“তুমিই তো আমার ডাক্তার।”

“সো স্টুপিড।”

তাজওয়ার গম্ভীরমুখে বলল,
“আহি, বাইরে আছো মনে হচ্ছে।”

“হ্যাঁ।”

“বাইরে আমার সাথে এমন ভাষায় কথা বলবে না। আই ডোন্ট লাইক ইট।”

আহি তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“এন্ড আই ডোন্ট কেয়া’র।”

আহি কল কেটে দিয়েই ফোনটা বন্ধ করে দিলো। পুষ্প আহির হাত ধরে বলল,
“রিল্যাক্স আহি। এখন এসব না ভেবে সময়টা উপভোগ কর।”

আহি নৌকার পাঠাতনের উপর উঠে বসলো। সরু খাল বেয়ে নৌকাটি জলাবনে ঢুকে পড়লো। বৃষ্টি পড়ায় পানির পরিমাণ বেড়ে গেছে। ভেজা গাছের গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে বাতাসে। হালকা সমীরণ বয়ে যাচ্ছে। সকালে বৃষ্টি পড়েছিল তাই স্যাঁতসেঁতে ভাবটা এখনো কাটেনি। উজ্জ্বল এবার আহির সামনে এসে বসলো। আহি উজ্জ্বলের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
“জায়গাটা সুন্দর।”

উজ্জ্বল বলল,
“কিন্তু তোমার মুখভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে এর চেয়ে বিরক্তিকর জায়গা দ্বিতীয়টা নেই।”

“আমার বন ভালো লাগে। আর এখানে তো বন আর জলের স্বাদ এক সাথেই পাওয়া যাচ্ছে।”

উজ্জ্বল মুচকি হাসলো। পুষ্প বলল,
“আহি একটা গান কর না। অনেক দিন তোর কন্ঠে গান শুনি না।”

উজ্জ্বল অবাক কন্ঠে বলল, “গানও পারো তাহলে?”

আহি বলল, “না। স্কুলে হালকা-পাতলা গেয়েছি।”

“হালকা-পাতলা গান গাওয়া যায় না-কি!”

পুষ্প শব্দ করে হাসলো আর বলল,
“আহি ভালোই গান করতো। চর্চায় থাকলে সংগীত শিল্পীদের হার মানতে হতো।”

এবার রইস বলল,
“তাহলে শুনিয়ে দাও, বনভূমির মাঝখানে জল। সেই জলে ভেসে যাচ্ছে নৌকা। নৌকায় বসে আছে এক তরুণী। তার কন্ঠে মিষ্টি মধুর গান।”

উজ্জ্বল বলল, “আর তার হাত আঁকছে অজানা গল্প।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে উজ্জ্বলের দিকে তাকালো। উজ্জ্বল তার ব্যাগ থেকে ছোট একটা ক্যানভাস আর কিছু রং ও তুলি বের করলো। পুষ্প মুখে হাত দিয়ে বলল,
“ভাইয়া তুই তো সে-ই কাজ করেছিস।”

আহি ক্ষীণ কন্ঠে বলল,
“আমি অনেকদিন ছবি আঁকি নি।”

উজ্জ্বল বলল,
“আজ আঁকবে। শিল্পীদের মন হালকা হয় ছবি এঁকে।”

উজ্জ্বলের জোরাজোরিতে আহি ক্যানভাসটি হাতে নিলো। গাছপালার শাখা-প্রশাখায় ঢেকে আছে শূন্য আকাশের অনেকাংশ। আহি সেই ডাল-পাতার ফাঁক দিয়ে আকাশটা দেখার চেষ্টা করছে। রইস বলল,
“আহি পাশাপাশি গানও গেয়ো।”

আহি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। সে এবার পাঠাতনের উল্টোদিকে ঘুরে পা দু’টি ঝুলিয়ে বসলো। সবাই আহির দিকে তাকিয়ে আছে। আহি চোখ বন্ধ করলো।
চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেই এক্সিভিশনের দিন, যেদিন আফিফ তার ছবি এঁকেছিল।

আহি এবার কন্ঠে গান ধরলো।

“সবকিছু বদলে গেলো এক রাতের নিমিষে,
তুমি হারিয়ে যাবে বলেছিলে কবে?
আজ তোমায় হারিয়ে আমি একা এই রাতে,
ভাবনাতে তোমাকে খুজেছি কি তবে?
ভাবি তুমি আসবে ফিরে,
ধরবে হাতগুলো,
বলবে তুমি কেঁদো না,
ফিরে এসেছি এই দেখো।
আর বলবে কেঁদো না তুমি,
এবারই তো শেষ কান্না,
বসে আছি আমি তোমার জন্যে…
আসোবনা, ফিরে আসো না,
আসো না, ফিরে আসো না।”

(***)

আফিফ ক্যাম্পাসের বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। অনেক দিন আহি ক্লাসে আসে নি। মেয়েটা হঠাৎ কোথায় হারিয়ে গেছে, আফিফ বুঝতে পারছে না। বার-বার তার মনে একটা প্রশ্নই হানা দিচ্ছে,
“আহি কি ভালো আছে?”

আজ চট্টগ্রামের আকাশ মেঘলা। ভোর থেকেই মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। আফিফ সেই বৃষ্টির ধারার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে আহির সেই কান্না ভেজা চোখ দু’টি। মনে হচ্ছে আকাশটাই আহি, মেঘগুলো তার চোখ আর বৃষ্টির ধারা তার অশ্রুকণা।

এদিকে রাদ আজ ক্যাম্পাসে যায় নি। সেও বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছে। আর তার কানে বাজছে সে একই গান।

“ফিরে এসেছি, ভালোবেসে,
তোমায় আমি প্রতিটিবার,
সব ব্যথা ভুলে, সব কষ্ট ফেলে,
এসেছি আজি আমি তোমার কাছে,
তবু তুমি নেই আজ আমার পাশে,
হারিয়ে গেছো তুমি বহুদুরে।
.
ভাবি তুমি আসবে ফিরে,
ধরবে হাতগুলো,
বলবে তুমি কেঁদো না,
ফিরে এসেছি এই দেখো।
আর বলবে কেঁদো না তুমি,
এবারই তো শেষ কান্না,
বসে আছি আমি তোমার জন্যে…
আসোনা, ফিরে আসোনা,
আসোনা, ফিরে আসোনা।”

তিন জোড়া চোখ, বিষন্ন মন, এক আকাশের নীচে।

রাদ বৃষ্টি স্পর্শ করে বলল,
“আহি, তুই কি কখনো আমার হয়ে ফিরবি?”

এদিকে আহি রং মেখে তুলিটা রাঙিয়ে নিলো আর মনে মনে বলল,
“জানি, তুমি কখনোই ফিরে আসবে না।”

অন্যদিকে আফিফ কয়েক পা পিছিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে আনমনে বলল,
“তোমাকে নিয়ে ভাবার অধিকার নেই। তবুও ভাবছি। কারণ সেই দিনগুলোতে আর ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়।”

৪৪।

আহি হাত ধুয়ে ক্যানভাসটি নৌকায় রেখেই নেমে পড়লো। উজ্জ্বল ক্যানভাসটি হাতে নিয়ে বলল,
“রেখে যাচ্ছো!”

আহি পেছন ফিরে ক্যানভাসটির দিকে তাকিয়ে বলল,
“এই স্মৃতি ক্ষণিকের। আমি এটা এখানেই রেখে যেতে চাই।”

আহি কথাটি বলেই চলে গেলো। উজ্জ্বল আহির আঁকা ছবিটির দিকে তাকালো। খুব এলোমেলো একটা ছবি৷ হিজিবিজি রং মাখানো। উজ্জ্বলের কাছে কেন যেন মনে হলো এই ছবির কোনো বিশেষ অর্থ আছে। আরো গভীরভাবে ছবিটি দেখলে এর অর্থ বোঝা যাবে। উজ্জ্বল ক্যানভাসটি একটা পলিথিন দিয়ে মুড়িয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলো।

(***)

সন্ধ্যায় ব্যাগপত্র গুছিয়ে তৃষা আপুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিচে নামলো আহি আর পুষ্প। আহির চোখেমুখে বিরক্তি রেখা ফুটে উঠেছে। উজ্জ্বল ভ্রূ কুঁচকে পুষ্পকে জিজ্ঞেস করলো,
“আহির কি হয়েছে?”

পুষ্প মুখ ছোট করে বলল,
“তাজওয়ার খান নিতে আসবে না-কি!”

“তোর সাথেই তো ফিরতে পারতো।”

“সেটাই তো ভাই। কেউ যদি আংকেলকে এই সহজ কথাটা বোঝাতে পারতো!”

আহি গাড়িতে বসেই চুপ করে রইলো। গন্তব্য রেল স্টেশন। নীরবতা বিরাজ করছে সবার মাঝে। উজ্জ্বল ড্রাইভারের পাশে বসে আছে। পুষ্প আর আহি পেছনে বসে আছে। আহি শক্ত করে পুষ্পের হাত ধরে রেখেছে। পুষ্প ঠিক বুঝতে পারছে, আহি তাজওয়ারের সাথে যেতে চায়ছে না।
হঠাৎ আহির ফোনটা বেজে উঠলো। আহি ফোন হাতে নিয়ে দেখলো তাজওয়ারই কল দিয়েছে। কলটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে তাজওয়ার বলল,
“কোথায় তুমি?”

আহি ক্ষীণ কন্ঠে বললো, “স্টেশনে যাচ্ছি।”

“আমিও এখানে আছি। টিকেট করে ফেলেছি।”

আহি ‘হুম’ বলেই কলটা কেটে দিয়ে পুষ্পের কোলে মাথা রাখলো। পুষ্প আহির চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। আজ আবার আহির দম বন্ধ লাগছে। তার মনে হচ্ছে তাকে জেলখানায় আটকে রাখার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এই কয়েকদিন তার ভালোই সময় কেটেছিল। কিন্তু ফিরে গিয়ে আবার সেই আবদ্ধ রুম, আফিফের স্মৃতি ঘেরা শহর, স্বয়ং আফিফই তার সামনে থাকবে। পাশাপাশি তার জীবনকে আরো বিভীষিকাময় করে তোলার জন্য তাজওয়ার খান আর লাবণি মেহেরার প্রভাবটাও ভুলে যাওয়া যায় না।

(***)

গাড়ি স্টেশনে এসে থামতেই আহি ধীর পায়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়লো। ড্রাইভার ব্যাগপত্র নামিয়ে রাখতেই একটা আগন্তুক লোক তাদের দিকে এগিয়ে এলো। আহি লোকটির দিকে তাকিয়ে ভ্রূ কুঁচকে বললো, “আপনি কে?”

লোকটি বলল,
“স্যার আপনার ব্যাগ ট্রেনে উঠিয়ে দিতে বলেছেন!”

আহি তার ব্যাগটা শক্ত হাতে ধরে রাখলো আর বলল,
“আমার কাজ আমিই করতে পারবো।”

এরপর আহি উজ্জ্বলের সামনে এসে দাঁড়ালো আর মুচকি হেসে বলল,
“ধন্যবাদ আমাদের সিলেট ঘুরে দেখিয়েছেন।”

উজ্জ্বলও মুচকি হাসি ফেরত দিলো। হঠাৎ একটা হাত আহির কাঁধ শক্ত করে স্পর্শ করতেই আহি পেছন ফিরে দেখলো তাজওয়ার দাঁড়িয়ে আছে। তাজওয়ার উজ্জ্বল আর পুষ্পের সামনেই আহিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে হুট করে তার গালে অধর জোড়া ছুঁইয়ে দিলো।আহি চোখ বড় বড় করে তাজওয়ারের দিকে তাকালো। তাজওয়ার পুষ্পের দিকে তাকিয়ে বলল,
“হাই।”

পুষ্প হাঁ করে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে আছে। উজ্জ্বল পুষ্পের দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। এবার তাজওয়ার আহিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আহি, তোমার ফ্রেন্ডের হয়তো আমাকে পছন্দ হয়েছে।”

আহি এবার ভ্রূ কুঁচকে পুষ্পের দিকে তাকালো। পুষ্প একবার না সূচক, আরেকবার হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। তাজওয়ার তা দেখে শব্দ করে হাসলো। এবার উজ্জ্বল বলল,
“পুষ্প ট্রেন ছেড়ে দেবে। উঠে যা।”

তাজওয়ার উজ্জ্বলের দিকে তাকিয়ে বলল, “ইউ!”

“আমি পুষ্পের কাজিন।”

“তোমার বিয়ে ছিল?”

পুষ্প আর আহি চোখ বড় বড় করে উজ্জ্বলের দিকে তাকালো। উজ্জ্বল আহির চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝলো এখানে কোনো একটা ঘাপলা আছে। সে ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“না, আমার বিয়ে ছিল না। অন্য কাজিনের বিয়ে ছিল।”

আহি উজ্জ্বলের উত্তরে আরো অবাক হলো। সে কী সুন্দর করে গুছিয়ে মিথ্যেটা বললো? উজ্জ্বল তো জানেই না আহি এখানে পুষ্পের কাজিনের বিয়ে বলে ঘুরতে এসেছে। তারপরও উজ্জ্বলের উপস্থিত বুদ্ধির প্রশংসা করতে মন চায়ছে তার। কিন্তু তাজওয়ারের উপস্থিতিতে সেটাও করতে পারছে না।

(***)

তাজওয়ার আহিকে নিয়ে ট্রেনে উঠলো। আহি কেবিন দেখে ভ্রূ কুঁচকে বলল, “আলাদা কেবিন?”

তাজওয়ার আহির কাছে এসে বলল,
“আমি তোমাকে আলাদা কেবিনে রাখবো? তুমি আর আমি একসাথেই থাকবো।”

আহি রাগী দৃষ্টিতে তাজওয়ারের দিকে তাকালো। তারপর হনহন করে কেবিনে ঢুকে পড়লো। ঢুকেই দেখলো পাশাপাশি দু’টো বার্থ। আহি তার ব্যাগ উপরে উঠাতে যাবে তখনই তাজওয়ার তার পেছনে এসে দাঁড়িয়ে তার ব্যাগটা উপরে তুলে দিলো। আহি সরে দাঁড়াতে যাবে তখনই তাজওয়ার তার কোমড় জড়িয়ে ধরলো। আহি তাজওয়ারকে সরানোর চেষ্টা কর‍তে লাগলো। কিন্তু সে তো আহিকে ছাড়ছেই না। আহি জোরে জোরে তাজওয়ারকে ধাক্কা দিতে লাগলো। আহির চোখেমুখে রাগ। চোখ দু’টিও ছলছল করছে। আহিকে এভাবে দেখে তাজওয়ারের মুখ রাগে লাল হয়ে গেলো। সে এবার কেবিনের দরজা লক করে আহিকে দরজায় ঠেকালো। আহি সরে যেতে নিবে তার আগেই তাজওয়ার তার দিকে ঝুঁকে দাঁড়ালো। আহি এবার দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“তুমি যদি আমার কাছে আসার চেষ্টা করো, তাহলে অনেক খারাপ হবে।”

তাজওয়ার আহির কথার তোয়াক্কা করলো না। সে আহির অধর ছুঁইছুঁই দূরত্বে এসে থামলো। আহির চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। আর তাজওয়ার সেই অশ্রুসিক্ত চোখের দিকে তাকিয়ে নেশা জড়ানো কন্ঠে বলল,
“আই লাভ ইউ, আহি।”

তাজওয়ার হুট করেই আহির ঘাড়ে তার অধর ছুঁয়ে দিলো। আহি সাথে সাথেই তাজওয়ারের চুলগুলো খুব জোরে টেনে ধরতেই তাজওয়ার বিরক্ত মুখে বলল,
“আমার চুল ধরার সাহস করবে না, আহি।”

“তুমিও আমাকে স্পর্শ করার সাহস দেখাবে না।”

তাজওয়ার আহির কোমড় জড়িয়ে ধরে বলল,
“দেখাবো সাহস। কি করবে তুমি?”

আহির উত্তরের অপেক্ষা না করে তাজওয়ার আহির হাত ধরে তাকে বার্থে বসিয়ে আহির কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। আহি এবার রাগী স্বরে বলল,
“দেখো, আমাদের এখনো বিয়ে হয় নি।”

তাজওয়ার আহির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
“তাহলে চলো, এখনই বিয়ে করে ফেলি।”

“আমি তোমাকে কখনোই বিয়ে করবো না।”

“আমার মধ্যে তো কোনো সমস্যা নেই। আমি যথেষ্ট কুল এন্ড হ্যান্ডসাম।”

আহি তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“তুমি একটা অসভ্য লোক। মেয়েদের সাথে নষ্টামি করা বেড়াও। কোন মেয়ে অন্তত তোমার মতো ক্যারেক্টারলেস ছেলেকে জীবনসঙ্গী হিসেবে চাইবে না।”

তাজওয়ারের এবার রাগ উঠে গেলো। সে আহির কোল থেকে মাথা তুলে আহির চুল টেনে ধরলো। আহি তাজওয়ারের হাতের মুঠো শক্ত করে ধরে বলল,
“তাজওয়ার, চুল ছাড়ো আমার।”

“কেন, বেশি ব্যথা লাগছে?”

আহির চোখ ছলছল করে উঠলো। তাজওয়ার বাঁকা হেসে বলল,
“আমারও লেগেছিল। কিন্তু আমি সহ্য করেছি। কারণ প্রেমিকার দেওয়া আঘাতও মিষ্টি হয়। আমারটা কি মিষ্টি লাগছে না?”

আহি দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “বিষধর লাগছে।”

তাজওয়ার আহির চুল ছেড়ে দিয়ে বলল,
“ভালোবাসতে পারো নি তাই। কিন্তু তোমার ভালোবাসার প্রয়োজন নেই আমার। আমিই তোমাকে ভালোবাসবো। আমার ভালোবাসায় সব ব্যালেন্স হয়ে যাবে।”

আহি চেঁচিয়ে বলল,
“আমারও তোমার ভালোবাসার প্রয়োজন নেই। তোমার মতো অসভ্য লোকের ভালোবাসা চাই না আমি। ছাড়ো আমাকে। তুমি একটা রেপিস্ট।”

তাজওয়ার আহিকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। আর শান্ত ভঙ্গিতে নিজের বার্থে এসে বসলো। আহি ভ্রূ কুঁচকে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে রইলো। তাজওয়ার শান্ত কন্ঠে বললো,
“তুমি তো জানোই আহি, রাজার অনেক রানী থাকে। আবার অনেক দাসীও থাকে। আর রানীদের এতে কোনো আপত্তিও থাকে না। কিন্তু তোমার আপত্তির শেষ নেই। জেলাস না-কি তুমি?”

আহি অবাক হয়ে তাজওয়ারের দিকে তাকালো। তাজওয়ার আবার বলল,
“আর রাজার যতো রানীই থাকুক, রাজা কিন্তু এক রানীতেই আসক্ত। যেমন সম্রাট আকবর শুধু তার যোধা বেগমকেই ভালোবেসেছিল।”

আহি শীতল কণ্ঠে বলল,
“কীসের সাথে কীসের তুলনা করছো? তারা অন্তত নারীদের সম্মান করতো। যারা দাসী ছিল, তারা স্বেচ্ছায় দাসী হয়েছিলো। আর তুমি হিংস্র পশু, যে বিনা অনুমতিতেই মেয়েদের সাথে অনৈতিক সম্পর্ক করো।”

তাজওয়ার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আহির দিকে আঙ্গুল তাক করে বলল,
“চাইলে এখনই আমি তোমার এই অহংকর গুঁড়িয়ে দিতে পারি। এই চলন্ত ট্রেন থেকে তোমার লাফিয়ে পড়ারও সুযোগ নেই। আর আমার শক্তির সাথে তোমার এই কোমলপ্রাণ শরীর জিতবেও না। কিন্তু আমি ধৈর্য ধরছি। তোমাকে গভীরভাবে স্পর্শ করার জন্য আমার একটা গভীর সম্পর্ক দরকার, যেখানে কোনো চেঁচামেচি, জোরাজোরি থাকবে না। তুমি স্বেচ্ছায় আমার কাছে আত্মসমর্পণ কর‍তে বাধ্য হবে। আমি সেই সম্পর্কের অপেক্ষায় আছি, আহি। তবুও তুমি আমার উপর দোষ দিয়ে যাচ্ছো।”

তাজওয়ার এবার শান্ত ভঙ্গিতে বসে বলল,
“আমি রেপিস্ট নই। যা করেছে আমার বন্ধুরা করেছে। আমি কাউকে জোর করি নি। যারা আমার জীবন এসেছিল, দাসীর মতো স্বেচ্ছায় এসেছিল। কিন্তু তুমি তো আমার রানী। আমার প্রিয় রানী।”

আহি অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। আহির গা ছাড়া হাবভাব তাজওয়ারের পছন্দ হলো না। সে হুট করে রেগে গেলো। আহির কাছে এসে তার দুই বাহু শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
“চাইলে আমি এখনি তোমাকে বিবস্ত্র করে এই ট্রেন থেকে নামিয়ে দিতে পারি, আমার কিচ্ছু হবে না। কিন্তু তুমি পুরো সমাজের চোখে কলংকিত হয়ে যাবে। তোমার এই সভ্য সমাজের মানুষগুলো যতোই বলুক, আমি, তাজওয়ার খান, অসভ্য লোক। তাদের বিন্দুমাত্র সাহস নেই আমার চরিত্রে আঙ্গুল তোলার। কিন্তু তারাই তোমাকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেবে। সভ্য লোকেদের কটাক্ষ শুনতে শুনতে তুমি শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু তোমার সামনে থাকা এই অসভ্য লোকটা এমন করবে না। আহি, আমি অন্য কারো সাথে যেমনই করি, তোমার সাথে কিছুই করবো না। কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি। ভীষণ ভালোবাসি। তোমাকে পাওয়ার জন্য আমি করতে পারবো না এমন কিছুই নেই। যেই আমাদের মাঝখানে আসবে, আমি তার জীবনটাই ধ্বংস করে দেবো। আমি এমন করতে পারি, আহি।”

তাজওয়ার আহির দুই বাহু খুব শক্ত করেই ধরে রেখেছিল। যার দরুন ব্যথায় আহি চোখ-মুখ কুঁচকে রেখেছে। তাজওয়ার বুঝতে পেরে আহিকে ছেড়ে দিয়ে আহির কোলে মাথা রেখে বলল,
“সরি, আহি। এন্ড আই লাভ ইউ সো মাচ।”

আহি দৃঢ় কন্ঠে বলল,
“এন্ড আই হেইট ইউ সো মাচ। তুমি নিজেকে যতোই রাজা দাবী করো, আমার রাজ্যে তুমি ভিখেরী মাত্র। আর যদি আমি রানী হয়েই থাকি, তাহলে এই রানী তোমাকে চ্যালেঞ্জ করছে, সে তার সম্মান, তার অভিমান কারো সামনে নত হতে দেবে না। শুধু সময়ের অপেক্ষা, মিস্টার তাজওয়ার খান। আমি তোমাকে হারিয়ে তোমার উপর জয় লাভ করবো।”

তাজওয়ার আহির কথা শুনে হাসলো। বিদঘুটে সেই হাসি। আহি শক্ত হয়ে বসে আছে। তার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। তাজওয়ার তা দেখে পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরালো। এরপর আহির কোলে মাথা রেখেই তার ফোন বের করে একটা মেয়েকে কল করলো। ওপাশ থেকে হ্যালো বলতেই তাজওয়ার বলল,
“কাল রাতে তোমার ফ্ল্যাটে আসবো আমি। ভীষণ রাগ উঠেছে আমার। কাল সারারাত রাগ ঝাড়বো তোমার উপর।”

কল কেটে আহির মুখের উপর ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল,
“চাইলেই তো আর ফুল স্পর্শ করা যায় না। একদিন ঠিকই ভ্রমর হয়ে ফুল ছুঁয়ে দেবো।”

আহি মুখ চেপে রেখেছে। তাজওয়ার আহির হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,
“এই ধোঁয়া সহ্য কর‍তে না পারলে তাজওয়ার খানকে চ্যালেঞ্জ করো না। বাই দা ওয়ে, আই লাইক ইট। ভেরি ইন্টারেস্টিং চ্যালেঞ্জ। আর একটা কথা মনে রেখো, বাঘ শিকার শেষে বাঘিনীর কাছেই ফিরে আসে। আর বাঘিনীদের শুধু বাঘের সাথেই মানায়। তোমার এই স্টেটমেন্ট শুনে মনে হচ্ছে আমরাই পারফেক্ট ম্যাচ।”

চলবে-

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে