উধয়রনী পর্ব-২০+২১+২২

0
362

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-২০||

৩৬।
নগরী আজ বাদল ধারায় সিক্ত। যাত্রী ছাউনি আর দোকানের বাইরে ছোটখাটো জটলা। যে যেভাবে পারছে নিজেদের বৃষ্টির ছাঁট থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। কেউ কেউ ছাতা হাতে নিয়ে দম্ভভরে হেঁটে চলে যাচ্ছে যার যার কাজে। আহি তাদের বিপরীত। টানা এক সপ্তাহ ক্লাসে না গিয়ে আজ সে বাধ্য হয়েই বের হয়েছে ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে। অর্ধেক যেতেই গাড়ি বন্ধ হয়ে গেলো। তারপর সে গাড়ি থেকে নেমে ড্রাইভার চাচার হাতে ছাতা ধরিয়ে দিয়ে গাড়ি ঠিক করে বাসায় চলে যেতে বলল। ড্রাইভার চাচা রিকশা ঠিক করে দিতে চাইলে আহি না সূচক মাথা নেড়ে চলে এলো। ভারী বর্ষণে ভিজে নুইয়ে পড়েছে আহি। আজও তার ক্যাম্পাসের যাওয়ার ইচ্ছে নেই। আফিফকে দেখলে যদি দুর্বল হয়ে পড়ে? কিন্তু কেন যে সে বাসা থেকে বের হয়েছে তা আহি নিজেও জানে না। তাকে দেখে মনে হচ্ছে উদ্দেশ্যহীন যাত্রায় নেমেছে। বৃষ্টিতে তার পরণের জামাটা আঁটসাঁট হয়ে গায়ের সাথে লেপ্টে গেছে। আহি সজ্ঞানে নেই। তার মনে হচ্ছে সে আফিফের পিছু পিছু হাঁটছে। কেমন যেন শরীরটা ভারী ভারী লাগছে তার৷ মাথাটাও ভন ভন করছে। আহির মনে হচ্ছে সে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে। সে কয়েক পা পিছিয়ে যেতেই তার পিঠটা কারো শরীরের সাথে ঠেকলো। আহি দুর্বল কন্ঠে বললো, “সরি।”

আহি পেছন ফিরে দেখলো তার পেছনে রেইনকোট আর হেলমেট পরা একজন যুবক দাঁড়িয়ে আছে। আহি তার দিকে তাকিয়ে কাঁপা কন্ঠে বললো,
“বৃষ্টির প্রতিটি বিন্দু সাক্ষী, আমি শুধু তোমাকে ভালোবেসেছি।”

আফিফ আহির হাত ধরে ঝাঁকুনি দিতেই আহির জ্ঞান ফিরলো। আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“কে আপনি? আর এভাবে আমার হাত ধরে আছেন কেন?”

আফিফের হাত থেকে আহি নিজের হাত ছাড়িয়ে নিতেই আফিফ তার হেলমেটটি আংশিক খুলে বলল,
“এখন চিনতে পেরেছো?”

আহি মনে মনে বলল,
“আমি তো তোমাকে আগেই চিনে ফেলেছিলাম। কিন্তু ভেবেছি আমার হ্যালুসিনেশন হচ্ছিলো। হায় আল্লাহ! কি লজ্জায় পড়তে হচ্ছে আমাকে। আল্লাহ, মানুষটা না বুঝুক কিছু।”

আফিফ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “তুমি এভাবে হাঁটছো কেন?”

আহি বিরক্তির সুরে বলল, “কীভাবে হাঁটছি আমি!”

আফিফ শান্ত কন্ঠে বললো, “বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছো।”

“তো!”

আফিফ আহির পালটা উত্তরে দমে গেলো। সে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“ছাতা নিয়ে বের হও নি?”

“ছাতা থাকলে কি এভাবে ভিজতে হতো?”

আফিফ এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলল,
“ক্যাম্পাসে যাচ্ছো?”

“হ্যাঁ, এতো সকাল সকাল এই ঝড়-বৃষ্টির দিনে কেউ ঘুরতে তো অবশ্যই বের হবে না।”

আফিফ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “বাইকে উঠো।”

“কেন?”

“আমিও ক্যাম্পাসে যাচ্ছি তাই।”

“রিকশা নিয়েই যাবো আমি। বাইকের পেছনে বসলে আমার সমস্যা হয়।”

আফিফ আহির কথা শুনে মিনিটের মধ্যেই একটা রিকশা ঠিক করে আহিকে উঠতে বলল। আহি তাড়াতাড়ি রিকশায় উঠে জোরে শ্বাস নিয়ে আস্তে করে ছাড়লো।

(***)

ক্যাম্পাসের সামনে নেমেই এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলো আহি। এমন ভেজা কাপড়ে কোনো মেয়ে কোনো কালে ক্লাস কর‍তে এসেছে কি-না সন্দেহ। রিকশায় রাদকে ফোন করে পুরো ঘটনাটা জানিয়েছিলো সে। রাদ ততোক্ষণে বাসা থেকে বের হয়ে গিয়েছিল। সে আবার বাসায় ফেরত গিয়ে তার বোনের এক সেট জামা ব্যাগে ঢুকিয়ে নিয়ে চলে এলো। আহি রিকশা থেকে নামতেই রাদ ছাতা নিয়ে তার দিকে এগিয়ে এলো। আফিফও তখন ক্যাম্পাসে তার মোটরসাইকেল নিয়ে ঢুকলো। তাকে মাত্র পৌঁছাতে দেখে আহি ভ্রূ কুঁচকে আফিফের দিকে তাকালো। মোটরসাইকেলে চড়ে আফিফের পৌঁছাতে এতো সময় লাগলো কেন? সে কি তাহলে আহির রিকশার পিছু পিছু এসেছিল? এদিকে রাদ ব্যাগ থেকে তার বোনের জামাটি বের করে দিয়ে বলল,
“তোর মতো ছাগলী আমি জীবনে একটাও দেখি নি।”

আহি মুখ ছোট করে বলল,
“আমার মাথা ঠিক ছিল না, রাদ। তুই তো জানিস আমি পাগল!”

“তুই পাগল না, তুই হচ্ছিস মাথামোটা। পাগল কখনো নিজেকে পাগল বলে না। এখন তুই নিজের বোকামি ঢাকার জন্য পাগলের আশ্রয় নিচ্ছিস।”

“দোস্ত, তুই এভাবে বকিস না। ঠান্ডা লাগছে আমার।”

“তো যা না। কুম্ভকর্ণের মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? জামা দিলাম তো। গিয়ে চেঞ্জ করে আয়। না-কি এখন কোলে করে নিয়ে যেতে হবে।”

আহি মুখ বাঁকিয়ে ক্যাম্পাসে ঢুকে পড়লো।

(***)

প্রথম টাইম স্লট শেষ হতেই আহি ক্লাসে ঢুকলো। ক্লাসে ঢুকতেই আহির চোখ পড়লো মাঝখানের সারির প্রথম বেঞ্চে। আফিফ মনোযোগ দিয়ে কি যেন লিখছে। আহি তার দিকে সেকেন্ড খানিক তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো। আহির জন্য প্রথম বেঞ্চটা খালি রেখে দিয়েছে তার সহপাঠীগণ। প্রতিদিনই দ্বিতীয় বেঞ্চ থেকে বসা শুরু করে সবাই। প্রথম বেঞ্চ মানেই অতি মনোযোগী শিক্ষার্থী। এতো মনোযোগী ক্লাসের কেউই হতে চায় না। আর ভাগ্যক্রমে সেই মনোযোগী শিক্ষার্থীদের কাতারে পড়েছে আহি আর আফিফ। দু’জনেই দেরীতে ক্লাসে আসে বিধায় প্রথম বেঞ্চেই সিট খালি পায়৷

আহি আফিফের পাশের সারিতেই বসেছে। আহির উপস্থিতি টের পেয়ে আফিফ তার দিকে ফিরে তাকালো। আহিও আঁড়চোখে আফিফকে খেয়াল করলো। তার মন এখনো কচকচ করছে। ঘোরের মধ্যে সে আফিফকে যা বলেছিল, তা আফিফ না শুনলেই হলো।

কিছুক্ষণ পর ক্লাসে স্যার চলে এলো। দ্বিতীয় স্লটের ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। আহি চুপচাপ বইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। স্যার পৃষ্ঠা উলটে শেকসপিয়ারের সনেট ১৪৭ পড়তে লাগলেন।

“𝙈𝙮 𝙇𝙤𝙫𝙚 𝙄𝙨 𝘼𝙨 𝙖 𝙁𝙚𝙫𝙚𝙧, 𝙇𝙤𝙣𝙜𝙞𝙣𝙜 𝙎𝙩𝙞𝙡𝙡”
𝑴𝒚 𝒍𝒐𝒗𝒆 𝒊𝒔 𝒂𝒔 𝒂 𝒇𝒆𝒗𝒆𝒓, 𝒍𝒐𝒏𝒈𝒊𝒏𝒈 𝒔𝒕𝒊𝒍𝒍
𝑭𝒐𝒓 𝒕𝒉𝒂𝒕 𝒘𝒉𝒊𝒄𝒉 𝒍𝒐𝒏𝒈𝒆𝒓 𝒏𝒖𝒓𝒔𝒆𝒕𝒉 𝒕𝒉𝒆 𝒅𝒊𝒔𝒆𝒂𝒔𝒆;
𝑭𝒆𝒆𝒅𝒊𝒏𝒈 𝒐𝒏 𝒕𝒉𝒂𝒕 𝒘𝒉𝒊𝒄𝒉 𝒅𝒐𝒕𝒉 𝒑𝒓𝒆𝒔𝒆𝒓𝒗𝒆 𝒕𝒉𝒆 𝒔𝒊𝒍𝒍,
𝑻𝒉𝒆 𝒖𝒏𝒄𝒆𝒓𝒕𝒂𝒊𝒏 𝒔𝒊𝒄𝒌𝒍𝒚 𝒂𝒑𝒑𝒆𝒕𝒊𝒕𝒆 𝒕𝒐 𝒑𝒍𝒆𝒂𝒔𝒆.
𝑴𝒚 𝒓𝒆𝒂𝒔𝒐𝒏, 𝒕𝒉𝒆 𝒑𝒉𝒚𝒔𝒊𝒄𝒊𝒂𝒏 𝒕𝒐 𝒎𝒚 𝒍𝒐𝒗𝒆,
𝑨𝒏𝒈𝒓𝒚 𝒕𝒉𝒂𝒕 𝒉𝒊𝒔 𝒑𝒓𝒆𝒔𝒄𝒓𝒊𝒑𝒕𝒊𝒐𝒏𝒔 𝒂𝒓𝒆 𝒏𝒐𝒕 𝒌𝒆𝒑𝒕,
𝑯𝒂𝒕𝒉 𝒍𝒆𝒇𝒕 𝒎𝒆, 𝒂𝒏𝒅 𝑰 𝒅𝒆𝒔𝒑𝒆𝒓𝒂𝒕𝒆 𝒏𝒐𝒘 𝒂𝒑𝒑𝒓𝒐𝒗𝒆
𝑫𝒆𝒔𝒊𝒓𝒆 𝒊𝒔 𝒅𝒆𝒂𝒕𝒉, 𝒘𝒉𝒊𝒄𝒉 𝒑𝒉𝒚𝒔𝒊𝒄 𝒅𝒊𝒅 𝒆𝒙𝒄𝒆𝒑𝒕.
𝑷𝒂𝒔𝒕 𝒄𝒖𝒓𝒆 𝑰 𝒂𝒎, 𝒏𝒐𝒘 𝒓𝒆𝒂𝒔𝒐𝒏 𝒊𝒔 𝒑𝒂𝒔𝒕 𝒄𝒂𝒓𝒆,
𝑨𝒏𝒅 𝒇𝒓𝒂𝒏𝒕𝒊𝒄-𝒎𝒂𝒅 𝒘𝒊𝒕𝒉 𝒆𝒗𝒆𝒓𝒎𝒐𝒓𝒆 𝒖𝒏𝒓𝒆𝒔𝒕;
𝑴𝒚 𝒕𝒉𝒐𝒖𝒈𝒉𝒕𝒔 𝒂𝒏𝒅 𝒎𝒚 𝒅𝒊𝒔𝒄𝒐𝒖𝒓𝒔𝒆 𝒂𝒔 𝒎𝒂𝒅𝒎𝒆𝒏’𝒔 𝒂𝒓𝒆,
𝑨𝒕 𝒓𝒂𝒏𝒅𝒐𝒎 𝒇𝒓𝒐𝒎 𝒕𝒉𝒆 𝒕𝒓𝒖𝒕𝒉 𝒗𝒂𝒊𝒏𝒍𝒚 𝒆𝒙𝒑𝒓𝒆𝒔𝒔’𝒅;
𝑭𝒐𝒓 𝑰 𝒉𝒂𝒗𝒆 𝒔𝒘𝒐𝒓𝒏 𝒕𝒉𝒆𝒆 𝒇𝒂𝒊𝒓 𝒂𝒏𝒅 𝒕𝒉𝒐𝒖𝒈𝒉𝒕 𝒕𝒉𝒆𝒆 𝒃𝒓𝒊𝒈𝒉𝒕,
𝑾𝒉𝒐 𝒂𝒓𝒕 𝒂𝒔 𝒃𝒍𝒂𝒄𝒌 𝒂𝒔 𝒉𝒆𝒍𝒍, 𝒂𝒔 𝒅𝒂𝒓𝒌 𝒂𝒔 𝒏𝒊𝒈𝒉𝒕.

কবিতাটি শুনে আহির ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে উঠলো। সে একনজর আফিফের দিকে তাকালো। মনে মনে বলল,
“তোমার প্রতি ভালোবাসাও হয়তো আমার রোগ। যেই রোগ আমাকে কষ্ট দিচ্ছে। তবুও সেই রোগ থেকে আমি নিজেকে মুক্ত কর‍তে চাই না। সবাই বলেছে ভুলে যেতে, কিন্তু আমার জন্য তোমাকে ভুলে যাওয়া এতো সহজ নয়। কিছু ভালোবাসা রক্তের সাথে মিশে যায়। আমার মৃত্যুতেই হয়তো এই ভালোবাসার সমাপ্তি ঘটবে। আমি না হয় মানসিক রোগী হয়েই থাকি। কতো কবি তার প্রেমিকাদের ভুলতে পারেন নি। বিচ্ছেদের পরও শেকসপিয়ার তার প্রেমিকাকে নিয়েই কবিতা লিখেছিলেন। সেই হিসেবে আমি তো কিছুই না। তার মতো সৎ সাহস নেই আমার। সবার সামনে গলা ফাঁটিয়ে চিৎকার করে বলতে পারবো না আমি আমার এআরকে এখনো ভালোবাসি। তারা তো প্রেমের কবিতা লিখে নিজের প্রেম প্রকাশ করেছেন। তাদের তো প্রকাশের ভাষা ছিল, মাধ্যম ছিল। তাদের কষ্ট তারা ভাগ করে নিয়েছেন। কিন্তু আমার আশেপাশের কেউই সেই ভাষা বুঝবে না। কারণ এই সমাজে কষ্টের ভাগ নিতে কেউ জানে না। সবাই শুধু উপহাস করতে জানে। সবাই শুধু সমালোচনা করতে জানে। আমার চরিত্রে আঙ্গুল তুলতে তাদের দু’মিনিটও লাগবে না। আমার মতো প্রেমে পরুক না হয় একবার। কতোটা কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছি অনুভব করে দেখুক। দু’দিনও বাঁচতে ইচ্ছে করবে না। আফিফ, আমি তো তোমার প্রেমে উন্মাদ প্রেমিকা হয়ে গেছি। যেখানে আমার কিছুই নেই। সবই তোমার অভ্যাসের দাস।”

(***)

ক্লাস শেষ হতেই সবাই একে একে বেরিয়ে পড়লো। আহি এখনো চুপচাপ তার বেঞ্চে বসে আছে। আফিফও বেরিয়ে পড়েছে। এদিকে দশ মিনিট আহি নিজের জায়গায় স্থির হয়ে বসে ছিল। সে আফিফকে চলে যাওয়ার সময় দিচ্ছিলো। এতোক্ষণে হয়তো সে চলেও গেছে। সিঁড়িতে তার মুখোমুখি হতে চায় না আহি। তাই এতোক্ষণ ক্লাসে বসে ছিল।

ক্লাস এই মুহূর্তে একদম খালি। আহি তার জিনিসপত্র গুছিয়ে আফিফের বসা বেঞ্চটির কাছে গেলো। আলতো করে বেঞ্চটি স্পর্শ করে বলল,
“তোমাকে স্পর্শ করতে পারি না। কিন্তু এভাবে পরোক্ষভাবে তোমাকে ছুঁয়ে দেওয়াটাও মিস করতে পারি না।”

আহি আফিফের বসা বেঞ্চটিতে বসলো। মাথাটা ডেস্কের উপর রাখলো। হঠাৎ সেই ভাস্কর্যের কথাটা মনে পড়ে গেলো তার। মিসেস লাবণি কি নির্মম ভাবে ভেঙে দিয়েছিলো সেই ভাস্কর্যটি! আহি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। মিনমিনিয়ে বলল,
“এভাবে আর পারছি না আমি। আমার জীবনে তোমার উপস্থিতি, তোমার অধিকার আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হবে। কিন্তু মানুষ নিজের লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য পাগলের মতো ছুটতে থাকে, আর আমার এমন এক লক্ষ্য যার জন্য আমি ছুটা তো বহুদূর, চিন্তাও করতে পারি না।”

(***)

আফিফ মোটরসাইকেলে উঠেই চাবি ঘুরাতে যাবে তখনই খেয়াল করলো তার হাত ঘড়িটা নেই। বৃষ্টির ছাঁট না লাগার জন্য ঘড়িটা পলিথিনে মুড়িয়ে পকেটে রেখেছিল। পকেটে হাত দিতেই তার মনে পড়লো, ক্লাসের ডেস্কের নিচে রেখেছিল ঘড়িটা। সে মোটরসাইকেল থেকে নেমে আবার ডিপার্টমেন্টের দিকে চলে গেলো।

ক্লাস রুমে ঢুকতে গিয়েই থমকে দাঁড়ালো আফিফ। তার বেঞ্চে একটা মেয়ে মাথা এলিয়ে দিয়ে বসে আছে। মেয়েটা যে আহি তা জামা দেখেই চিনে ফেলেছে আফিফ। সে আর সামনে আগালো না। ধীর পায়ে পিছিয়ে ক্লাসের বাইরের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ালো। সকালে আহির বলা কথাটি সে শুনে ফেলেছিল। কিন্তু কথাটা যে তাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিল, সেটা বুঝতে পারে নি আফিফ। তাহলে কি আহি এখনো তাকে ভালোবাসে?

ধীরে ধীরে আফিফের চোখ দু’টি ছলছল করে উঠল। তার চোখের সামনে ভেসে এলো তার ছোট বোনের ক্রন্দনরত মুখ, তার বড় বোনের ফ্যানে ঝুলে থাকা নিথর দেহ আর তার মায়ের আহাজারি। আফিফ দেয়ালে মাথা ঠুকালো বার কয়েক। তার হাত মুঠো হয়ে এলো। শার্টের হাতায় চোখ মুছলো সে। এরপর ক্লাসের বাইরে থাকা ফুলদানিটি হালকা ধাক্কা দিলো। সেটা গড়িয়ে নিচে পড়তেই আফিফ সরে দাঁড়ালো। এদিকে শব্দ শুনে আহি বেঞ্চ থেকে মাথা তুললো। সে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালো। নিজের ব্যাগ নিয়ে কৌতূহলী মনে ক্লাসের বাইরে এসে দেখলো টুলের উপর রাখা ফুলদানিটি নিচে পড়ে আছে। আহি ভীত দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকালো। লাবীব দু’দিন আগে বলেছিল খালি ক্যাম্পাসে অস্বাভাবিক সব ঘটনা ঘটে। আহির এই কথা মনে পড়তেই সে দ্রুতপায়ে নিচে নেমে পড়লো।
আহিকে চলে যেতে দেখে আফিফ ক্লাসে ঢুকলো। নিজের বেঞ্চের ডেস্কে হাত রাখতেই দেখলো পানির মতো কিছু তার হাতে লেগেছে। সে বুঝতে পারলো আহি এতোক্ষণ কান্না করেছিল। আফিফ পকেট থেকে রুমাল বের করে ডেস্কের উপরে স্থান করে নেওয়া আহির অশ্রুকণাগুলো মুছে নিলো। তারপর নিচের ডেস্ক থেকে তার ঘড়িটি বের করে রুমালটির সাথে ঘড়িটিও পকেটে ঢুকিয়ে নিলো।

৩৭।

আজকের দিনটি আহির জন্য চমৎকার একটি দিন। কারণ আজ সে অনেক বছর পর তার মায়ের সাথে দেখা করতে যাচ্ছে। রিজওয়ান কবির এবং মিসেস লাবণি দু’জনই এক সপ্তাহের জন্য দেশের বাইরে গেছেন। আর এই সুযোগটা আহি কোনো ভাবেই হাতছাড়া করতে চায় না। সে প্রথমদিনই মায়ের সাথে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিলো।

এই মুহূর্তে শহরের কম দামী রেস্টুরেন্টে বসে আছে আহি। খোলা পরিবেশটা ভালোই লাগছে তার। তাজওয়ার তার বন্ধুদের নিয়ে প্রায়ই বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে খেতে চলে যায়। তাই সে এমন রেস্টুরেন্টে এসেছে, যেখানে তাজওয়ার কখনোই আসবে না। প্রায় দশ মিনিট অপেক্ষা করার পর কাঙ্ক্ষিত মানুষটির আগমন ঘটলো। আহি সালমা ফাওজিয়াকে দেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।

(***)

পরণে কালো সুতির শাড়ি, গায়ে গাঢ় বাদামি বর্ণের চাদর, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, মাথায় কালো হিজাব, হাতে একটা ছোট ব্যাগ, ঠোঁটের ফাঁকে প্রশস্ত হাসি। সালমা ফাওজিয়া মেয়ের দিকে এগিয়ে আসতেই আহি মায়ের সামনে এসে দাঁড়ালো। তিনি কিছুক্ষণ মেয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে আলতো করে তার হাত ধরলেন। আহি মায়ের স্পর্শ পেয়ে কাঁপা কন্ঠে বললো,
“আমি তোমাকে একটু জড়িয়ে ধরতে পারবো?”

সালমা ফাওজিয়া তার হাতের ব্যাগটি টেবিলের উপর রেখে নিজেই আহিকে জড়িয়ে ধরলেন। আহি মায়ের বুকে মাথা রাখতেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। মিনিট খানিক পর সালমা ফাওজিয়া আহিকে ছেড়ে দিয়ে তার কপালে চুমু খেলেন। আহি মায়ের হাত ধরে বলল,
“অনেকদিন পর মনে হচ্ছে, আমি মন থেকে খুশি। মনে হচ্ছে আজ এই মুহূর্তে আমার চেয়ে সুখী কেউ নেই।”

সালমা ফাওজিয়া এবার চেয়ার টেনে আহিকে বসালেন। নিজেও আহির পাশে এসে বসলেন। এরপর আহির গালে হাত রেখে বললেন,
“মা, শুকিয়ে যাচ্ছো তুমি। খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো করো না?”

আহি মাথা নেড়ে বলল,
“হুম ঠিকভাবেই খাই আমি। মুনিয়া খালাকে তো আমার জন্য রেখে গিয়েছিলে। খালা আমার অনেক খেয়াল রাখেন।”

“আচ্ছা! মুনিয়ার মেয়েটা আছে?”

“হ্যাঁ, চুনি আছে তো। এখন অনেক বড় হয়ে গেছে।”

“আচ্ছা, ভালো। আর মোজাম্মেল? সে কি এখনো ও বাড়িতে কাজ করে?”

“হ্যাঁ চাচা তো বলে দিয়েছেন, যতোদিন আমি শ্বশুড় বাড়ি যাবো না উনি চাকরি ছাড়বেন না। এখন তো চাচা ঠিক করেছেন, তিনি চুনির বিয়ে দেবেন তার ভাইয়ের ছেলের সাথে।”

“বাহ! বেশ তো। এবার তোমার কথা বলো। মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছো?”

“হুম।”

“ক্লাস কেমন যায়?”

“ভালোই। তুমি কোথায় কাজ করো?”

“একটা এনজিওতে। ছোট একটা ব্যবসাও আছে।”

“বাহ, বিজনেস উইমেন।”

সালমা ফাওজিয়া হাসলেন। মেয়ের গালে চুমু খেয়ে বললেন,
“আমার মা’টা অনেক সুন্দর হয়ে গেছে।”

“তোমার মতো। তুমিও অনেক সুন্দর হয়ে গেছো।”

“তোমার বাবার ছত্রছায়া থেকে মুক্তি পেয়েছি তাই নিজের যত্ন নিতে পারছি।”

আহি হাসলো। বলল,
“তাহলে আমি মুক্তি পেলে এর চেয়ে বেশি সুন্দর হয়ে যাবো।”

সালমা ফাওজিয়া মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার চোখে অশ্রু ভীড় করতে লাগলো। এদিকে আহি মেন্যু দেখায় মনোযোগ দিলো। সে মায়ের দিকে মেন্যুটা এগিয়ে দিতে গেলেই সালমা ফাওজিয়া বললেন,
“তুমি খাবার অর্ডার করো। আজ আমার মেয়ের পছন্দের খাবারই আমি খাবো।”

আহি মুচকি হাসি ফেরত দিয়ে খাবার অর্ডার করলো। সালমা ফাওজিয়া এবার আহির হাত ধরে বললেন,
“তোমার নানু তোমার ছোট মামার বাসায় গেছে। এমনিতে আমার সাথেই থাকে। আমি তো ট্রেনিং থেকে ফিরেছি বেশিদিন হচ্ছে না। উনি না-কি আরো কিছুদিন ওখানে থাকবেন। তোমার ছোট মামার দু’টো জমজ বাচ্চা হয়েছে তো, তাই।”

“ভালো তো।”

“বলছি কি, তুমি না হয় দু’দিন আমার সাথে থাকবে। চলো!”

আহি মলিন মুখে বললো, “বাবা যদি জেনে যায়?”

“আইনগত ভাবে সপ্তাহে দু’দিন তুমি আমার সাথে থাকতেই পারো। কিন্তু মিস্টার রিজওয়ান কবির তো আইন মানেন না। তাই বলবো, তাকে মিথ্যে বলে এসো। ঘুরতে যাচ্ছি বলবে।”

সালমা ফাওজিয়া কথাটি বলেই ফুঁপিয়ে উঠলেন। মেয়ের হাতে চুমু খেয়ে বললেন,
“কি কপাল আমার! নিজের মেয়ের সাথে সময় কাটানোর জন্য পৃথিবীর সাথে ছলনা করতে হচ্ছে। একদিকে তোমার নানু জানলে আমাকে বকবেন। অন্যদিকে তোমার বাবা জানলে তোমার সমস্যা হবে।”

আহি মায়ের হাত শক্ত করে ধরে বলল,
“আমি মিথ্যে বলবো। নিজের ভালো থাকার জন্য একটা মিথ্যে বলা যায়। এমনিতেই কতো মিথ্যে বলি।”

সালমা ফাওজিয়া আহির থুতনিতে হাত রাখলেন। বললেন,
“সত্যিই আমার মেয়েটা সুন্দর হয়ে গেছে। চুলগুলোও অনেক লম্বা হয়েছে। বেণি কে করে দেয়?”

“আমিই করি। মা তো আমার পাশে নেই৷ তাই নিজের কাজ নিজেই করি।”

মেয়ের কথায় সালমা ফাওজিয়ার বুকটা হুঁ হুঁ করে উঠলো। মনে মনে বললেন,
“আমার রাজকন্যাকে আমি সেই ফেরাউনের হাত থেকে কখন মুক্ত কর‍তে পারবো?”

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-২১||

৩৮।
আহি রেস্টুরেন্টের ওয়াশরুম থেকে বের হতেই থমকে দাঁড়ালো। তার সামনের টেবিলে পদ্ম আর আফিফ বসে আছে। আর পদ্ম আফিফকে নিজ হাতে খাইয়ে দিচ্ছে। আহি সেকেন্ড খানিক সেদিকে তাকিয়ে সামনে পা বাড়াতে যাবে তখনই পদ্ম তাকে দেখতে পেলো। পদ্ম আহির নাম ধরে ডাক দিতেই আফিফ থতমত খেয়ে গেলো। সে সামনে তাকিয়ে আহিকে দেখে চোখ নামিয়ে নিলো। আহি পদ্মের ডাক শুনে সেখানে দাঁড়িয়ে গেলেও তাদের টেবিলের কাছে গেলো না। পদ্ম এবার নিজেই উঠে এলো। এরপর আহির কাছে এসে তার হাত ধরে বলল,
“কি রে, আমাকে দেখেও দেখছিস না মনে হচ্ছে।”

আহি হালকা হেসে বলল,
“আরেহ, এমন কিছু না। কেমন আছিস তুই?”

“ভালো রে। তুই কেমন আছিস?”

আহি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। পদ্ম একনজর আফিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“একটা খুশির খবর আছে জানিস?”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো, “তুই প্রেগন্যান্ট!”

পদ্ম মলিন মুখে বলল, “না রে। অন্য একটা।”

আহি পদ্মের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
“সরি। বল না, কি খবর?”

পদ্ম আহির হাত ধরে তাকে আফিফের সামনে নিয়ে এলো। আহি আফিফের দিকে তাকিয়ে সৌজন্যমূলক হাসি ফেরত দিলো। আফিফও প্রতিত্তোরে মৃদু হাসলো। এবার পদ্ম আহিকে বলল,
“আফিফের চাকরি হয়ে গেছে।”

আহি মৃদু হেসে বলল, “বাহ। ভালো তো!”

“হ্যাঁ রে। তবে যেমন তেমন চাকরি নয়। চট্টগ্রামের নামকরা কোম্পানিতে চাকরি হয়েছে। আফিফ তাই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন।”

আহি শুকনো মুখে আফিফের দিকে তাকালো। এদিকে আফিফ কিছুক্ষণ পর পর দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়াচ্ছে। পদ্ম আফিফের পাশে বসে তার কাঁধে হাত রেখে বলল,
“আপনাকে চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন?”

আফিফ পদ্মের কথা শুনে জোরপূর্বক হাসলো। আহি তা দেখে বলল,
“আচ্ছা, আমি তাহলে যাই।”

পদ্ম বলল,
“তুই কোথায় যাচ্ছিস? চল না একসাথেই লাঞ্চ করি।”

“না, আসলে আমি একা আসি নি।”

পদ্ম মজার ছলে বলল,
“ওহো, তাই না-কি? কেউ এসেছে তাহলে! কে সে? আমার বান্ধবীর এআর?”

আফিফ চোখ-মুখ কুঁচকে পদ্মের দিকে তাকালো। আহি আফিফের দিকে একনজর তাকিয়ে শুকনো হেসে বলল,
“মায়ের সাথে এসেছি।”

পদ্ম অবাক হয়ে বলল,
“তাই না-কি! আন্টিকে অনেক দিন দেখি নি। আচ্ছা, তুই যা। আন্টি অপেক্ষা করছেন হয়তো।”

আহি মাথা নেড়ে বিদায় নিয়ে নিজের টেবিলে চলে এলো।

(***)

সালমা ফাওজিয়া অনেকক্ষণ ধরে খেয়াল করছেন আহি ওয়াশরুম থেকে ফিরে আসার পরই তার চোখে-মুখে অস্থিরতা বিরাজ করছে। তিনি আহির হাত ধরে বললেন,
“আমার মায়ের কি হয়েছে?”

আহি হালকা হেসে বলল,
“কিছু হয় নি। চলো খাই।”

সালমা ফাওজিয়া নিজ হাতে আহির প্লেটে খাবার বেড়ে দিলেন। আহি চামচ নিতে যাবে, তখনই সালমা ফাওজিয়া আহির হাত ধরে বললেন,
“আজ আমি আমার মেয়েকে নিজ হাতে খাইয়ে দেবো।”

মায়ের কথা শুনে আহির চোখে অশ্রু ভীড় করলো। সালমা ফাওজিয়া হাত ধুয়ে এসে আহির মুখের সামনে খাবার মেখে ধরলেন। আহি আশেপাশে তাকাতেই সালমা ফাওজিয়া বললেন,
“আশেপাশে কি দেখছো, আহি? আমার মেয়েকে আমি খাইয়ে দিচ্ছি। কতো বছর পর আমি আবার মা হওয়ার সুযোগ পেয়েছি। এই অনুভূতি কেউ বুঝবে না।এখন কি আমি আমার মেয়েকে একটু আদর করে খাইয়ে দিতে পারবো না?”

আহি মায়ের কথা শুনে মৃদু হেসে মুখ খুললো। তার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তেই সালমা ফাওজিয়া নিজ হাতে আহির চোখ মুছে দিলেন। এদিকে পদ্ম আর আফিফের খাওয়া শেষ হতেই পদ্ম আফিফের সামনে একটা বক্স বের করে রাখলো। আফিফ বক্সটির দিকে তাকিয়ে বলল,
“কি এটা!”

পদ্ম লাজুক হেসে বলল,
“আমি আপনার জন্য কেক বানিয়েছি। আপনি যখন বললেন নতুন চাকরি উপলক্ষে আজ আমরা বাইরে খাবো, তখনই এই কেকটা বানিয়েছিলাম। ভেবেছি একসাথে কাটবো। চলুন না ওখানে গিয়ে কাটি!”

আফিফ ভ্রূ কুঁচকে বললো, “কোথায়?”

“আহি আর আন্টিও তো আছেন। অনেক বছর আন্টিকে দেখি নি। উনার সাথেও দেখা হয়ে যাবে। আপনার সাথেও উনার পরিচয় করিয়ে দেবো।”

“কি দরকার, পদ্ম?”

“চলুন না। উঠুন তো!”

আফিফ যেতে না চাইলেও পদ্ম তাকে জোর করে আহিদের টেবিলের সামনে নিয়ে গেলো। সেখানে গিয়ে তারা দেখলো সালমা ফাওজিয়া নিজ হাতে আহিকে খাইয়ে দিচ্ছেন। পদ্ম আর আফিফকে দেখে আহি নিজের চোখ মুছে নিলো। পদ্ম সালমা ফাওজিয়াকে সালাম দিয়ে বলল,
“কেমন আছেন আন্টি?”

সালমা ফাওজিয়া সালামের উত্তর নিয়ে ভ্রূ কুঁচকে বললেন, “পদ্ম?”

পদ্ম লাজুক হেসে বলল, “জ্বি।”

সালমা ফাওজিয়া হেসে বললেন,
“আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছো, মা?”

“আমিও ভালো।”

“বসো, বসো।”

পদ্ম আফিফের হাত ধরে তাকে জোর করে বসালো। সালমা ফাওজিয়া ভ্রূ কুঁচকে আফিফের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“আমি তোমাকে আগে কোথাও দেখেছি!”

আহি ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“মা পদ্মের হাজবেন্ড। ছবিতে দেখেছো হয়তো।”

সালমা ফাওজিয়া আহির কথায় আফিফের দিকে তাকালেন। আফিফ শুকনো হেসে সালাম দিলো। সালমা ফাওজিয়া সালামের উত্তর নিয়ে এবার আহির দিকে তাকালেন। তিনি খেয়াল করলেন আফিফকে দেখে আহি বার-বার তার দুই হাত ঘষছে। তিনি বুঝতে পারলেন, এই ছেলেটাই সে-ই, যাকে আহি ভালোবাসতো। আহি নিজেই তাকে আফিফের কথা বলেছিল। আর তিনি মুনিয়া খালার কাছে শুনেছিলেন, পদ্মের বিয়ে থেকে ফেরার পরই আহির শরীর খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। ডাক্তারও তখন জানিয়েছিলো, আহির মানসিক অবস্থা ওতোটা ভালো নয়। তাহলে আফিফকে পদ্মের স্বামী হিসেবে দেখেই সেদিন আহির এমন অবনতি হয়েছিলো?

সালমা ফাওজিয়া আহির হাত ধরলেন। আহি মায়ের দিকে তাকালো। তখনই পদ্ম কেকটা সামনে রেখে বলল,
“আন্টি, উনার চাকরি হয়েছে। তাই আমি নিজের হাতে এই কেক বানিয়েছিলাম। চলুন না, একসাথে কাটি।”

সালমা ফাওজিয়া মুচকি হেসে আফিফকে বললেন,
“কংগ্রাচুলেশনস। কোথায় চাকরি হয়েছে?”

আফিফ বলল, “খানস গ্রুপে।”

সালমা ফাওজিয়া আর আহি দু’জনই অবাক দৃষ্টিতে আফিফের দিকে তাকালো।

(***)

তমসাচ্ছন্ন গগন, বাতাসে ভেজা মাটির ঘ্রাণ, মৃদু সমীরণে বাগানের ফুটন্ত অলকানন্দাগুলো দোল খাচ্ছে। আহি বারান্দার স্লাইডিং ডোর খুলে দিয়ে তার এক পা বের করে রাখলো। বৃষ্টির ছাঁট তার সেই পায়ে এসে পড়ছে। আর আহি চোখ বুজে সেই স্পর্শ অনুভব করছে।

আহি অলকানন্দা ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে মলিন হেসে বলল,
“এআর, খুব তো সুখেই আছো। তুমি কি কখনো গভীর রাতে বৃষ্টি দেখতে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিলে?”

আহি পরক্ষণেই তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,
“কেনই বা দাঁড়াবে? তোমার শরীরে উষ্ণ স্পর্শ দেওয়ার মানুষ তো তোমার পাশেই আছে। তুমি তো আর আমার মতো একাকীত্বে নেই, যে গভীর রাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখবে। এআর দেখো, আজ আকাশে কতো শত মেঘ ভীড় জমিয়েছে। ঠিক সেই রাতের মতো। এমনই এক রাতে আমি নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলাম। একদম নিঃস্ব।”

আহি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। তার চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো হতাশার অশ্রু।

(***)

বারান্দায় এসে দাঁড়ালো আফিফ। বৃষ্টি আসায় বারান্দার মেঝেতে পানি জমে গেছে। আফিফ রেলিঙে পিঠ ঠেকিয়ে সেই জমে থাকা পানিগুলোর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। তার চোখে শূণ্যতা। মনটা ভারী হয়ে আছে। তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো আহির অশ্রুসিক্ত চোখ। চার বছর আগে সে প্রথম সেই মেয়েটিকে দেখেছিল, যে তার জীবনের ক্ষণকালীন খেয়াল হিসেবে এসেছিল। কিন্তু সেই মুহূর্তগুলো আফিফের কাছে ভীষণ চমৎকার ছিল।
কিছু সুন্দর মুহূর্ত চোখের পলকে হারিয়ে যায়। আফিফও হারিয়ে ফেলেছিল সেই বেনামী চিরকুটের মেয়েটিকে। তবে হারিয়ে ফেলে নি, ইচ্ছে করেই হারাতে চেয়েছিল। চাইলে তো সে ধরে রাখতে পার‍তো। কিন্তু ধরতে পারে নি। আফিফের বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। সে রেলিঙে পিঠ ঠেকিয়ে তার মাথাটা বারান্দার বাইরে বের করে দিয়ে আকাশের দিকে তাকালো। বৃষ্টির তেজ কমে এসেছে। এখন গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। আফিফের মুখে সেই বৃষ্টির ছিঁটেফোঁটা জায়গা করে নিচ্ছে।

(***)

আহি বারান্দায় এসে রেলিঙে হাত রাখলো। রেলিঙে জমে থাকা পানিগুলো স্পর্শ করতে করতে বলল,
“এই বৃষ্টি তোমাকে স্পর্শ করলে বুঝবে, আমি তোমাকে স্পর্শ করছি। আমি তো আর বৃষ্টি হয়ে তোমাকে স্পর্শ করতে পারছি না। কিন্তু এই আকাশ জুড়ে ভেসে বেড়াচ্ছে আমার ভালোবাসার গল্প। আর আমার সেই গল্পটাই মেঘ হয়ে তোমাকে ছুঁয়ে দেবে। এভাবে যদি তোমাকে পাওয়া যায়, তাহলে এভাবেই হোক।”

আহি আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
“মেঘ, যাও না ও বাড়ি। তোমার সখী পবনমালাকে বলো, ঘুমন্ত এআরকে স্পর্শ করে দিয়ে আসতে। পবনমালার স্পর্শে একটু যদি তার চোখের পাতা নড়ে উঠে, এক রাত যদি সে আমায় নিয়ে স্বপ্ন দেখে, যেই স্বপ্নে তুমি তাকে জানিয়ে দেবে আমি ভালো নেই। আমি তাকে ভালোবেসে মরুভূমি হয়ে গেছি। যেই মরুভূমিতে বৃষ্টির স্পর্শ মরীচিকার মতো। যা ধরতে গেলেই মিথ্যে হয়ে যাবে।”

(***)

আফিফের মুখে বিন্দু বিন্দু জল। আহির মেঘমালা হয়তো নিজে এসেই তার আবদার পূরণ করে দিয়েছে। ছুঁয়ে দিয়েছে আহির প্রিয় অলকানন্দকে। আফিফ চোখ খুলে শূণ্য আকাশের দিকে তাকালো। মনে মনে বলল,
“কেন আমাকে মনে রেখেছো, খেয়াল? আমি তো তোমাকে কখনোই ভালোবাসতে পারি নি। তাহলে কেন মনে রেখেছো আমায়? কেন কষ্ট দিচ্ছো নিজেকে? আমি তো ভেবেছি, তুমি আমাকে মনেই রাখো নি। এতো বছর হয়ে গেছে। আমি তো পদ্মফুলকে নিয়ে ভালোই আছি। তুমি শুধু কিছু বেনামি পত্রের ভীড়েই রয়ে গেছো। পদ্মফুল আমার জীবনে আসার পর থেকে কোনো নারী আমার হৃদয় স্পর্শ করতে পারে নি। তোমার জায়গাটা আমার জীবনে ক্ষণকালের জন্য ছিল। কিছু চিরকুটের ভীড়ে, কিছু বইয়ের পাতায়, কিছু রঙের ফাঁকে। আমি এখন সেগুলো স্পর্শও করি না। কারণ আমার পদ্মফুল আছে। আমি চাই তোমার জীবনেও এমন কেউ আসুক, যে তোমাকে অনেক বেশি ভালোবাসবে। তখন তুমি আমাকে মনে করার আর সময় পাবে না।”

(***)

আহি একটি অলকানন্দা ফুল স্পর্শ করলো। আর মলিন হেসে বলল,
“যতোবার তোমাকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করি, ততোবারই দম বন্ধ হয়ে আসে। আমার এই অশ্রুগুলো ঝরে গিয়েই তো আমাকে শান্তি দিচ্ছে। আমার জীবনে যদি একটু শান্তি থাকতো, তাহলে আমি হয়তো তোমাকে ভুলে থাকার চেষ্টা করতে পারতাম। কিন্তু দেখো না, তুমি তো নেই-ই, মাও নেই, লিনাশা নেই, পদ্ম থেকেও নেই, কারণ ওকে দেখলেই মনে হয়, তুমি আর আমার নও। যারা আছে তারা শুধু আমার মনটা আরো ভেঙে দেওয়ার জন্যই আছে। অসুস্থ বাড়িতে, অসুস্থ মানুষের ভীড়ে, আমি এক অসুস্থ প্রেমিকা। তাহলে কীভাবে ভুলবো তোমাকে, বলো? একটু তো সুখী হতে পারি আমি। কোনো এক দিক দিয়ে তো সৃষ্টিকর্তা আমাকে পরিপূর্ণ করতে পার‍তেন। আমার জীবনটা এখন একটা পরিহাস! যা-ই আমি চাইবো, তা-ই কুয়াশার মতো মিলিয়ে যাবে, আর দিয়ে যাবে শিশির কণার মতো দুঃখ। যেই দুঃখ কেউ স্পর্শ করতে এলেই ধ্বংস হয়ে যাবে।”

(***)

আহি সকালে উঠেই ব্যাগপত্র গুছিয়ে পুষ্পকে ফোন করলো। কাল ক্যাম্পাসেই সে আজকের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানিয়ে দিয়েছিলো পুষ্পকে। পুষ্প আহির বাসায় আসতেই রিজওয়ান কবিরকে ফোন করলো আহি। ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“বাবা, পুষ্পের কাজিনের বিয়ে। ও আমাকে ইনভাইট করেছে। বলছে সব প্রোগ্রামে যাতে থাকি।”

রিজওয়ান কবির বললেন,
“থাকো। এটা তো জানানোর বিষয় না।”

“থাকি বলতে, আমি কিছুদিনের জন্য ওখানেই শিফট হচ্ছি।”

“কোথায়?”

“পুষ্পের দাদার বাড়ি।”

“কোথায় ওর দাদার বাড়ি?”

“সিলেট।”

আহি হাতের ইশারা করতেই পুষ্প ওপাশ থেকে ন্যাকা কান্না জুড়িয়ে দিয়ে বলল,
“আহি, চল না, দোস্ত। লিনাশার সাথেও যোগাযোগ হয় না। পদ্ম তো এখন বিয়ে করে ফেলেছে। ও কি স্বামী ছাড়া আসতে পারবে? তুই চল না, প্লিজ। তুই ছাড়া আমার তো কোনো বন্ধুই নেই।”

আহি রিজওয়ান কবিরকে শুনিয়েই গলার স্বর নামিয়ে বলল,
“বাবাকে জানাচ্ছি। ওরা তো দেশে নেই।”

“আংকেল তো ভালোই। উনি বারণ করবেন না। তুই-ই যেতে চাচ্ছিস না। তাই তো কাল থেকে আমাকে ইগ্নোর করছিস। কি আছে এ বাড়িতে? আংকেল-আন্টিও নেই।”

আহি পুষ্পের কথায় মুখ চেপে হাসলো। পুষ্পও হাসছে। তাদের দেখে মুনিয়া খালা নিঃশব্দে হাসছেন আর চুনিকে নিয়ে কিছু বক্সে খাবার বাড়ছেন। এদিকে ওপাশ থেকে রিজওয়ান কবির বললেন,
“আহি, তুমি পুষ্পের সাথেই চলে যেও। সিলেটও ঘুরে আসবে। প্রোগ্রাম শেষ হলে আমি তাজওয়ারকে বলবো তোমাকে নিয়ে আসতে।”

আহি বাবার কথা শুনে চোখ বড় বড় করে পুষ্পের দিকে তাকালো। পুষ্প ইশারায় জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে। আহি ইশারায় পুষ্পকে থামিয়ে বাবাকে বলল,
“ও না আসলেও হয়। আমার ফ্রেন্ডের বাড়ির লোকেরা দেখলে কি ভাববে? যা-ই হোক, আমি যাচ্ছি তাহলে। আজই বের হবো। পুষ্প আমাকে আজই নিয়ে যাবে। সন্ধ্যায় না-কি সিলেটের জন্য বাসে উঠবে।”

আহি কথাটি বলেই কল কেটে দিলো। পুষ্প বলল,
“কথা শেষ?”

“হুম।”

“মুখটা বাঁকিয়ে ফেলেছিস কেন? আংকেল তো রাজী হয়েছে!”

“তাজওয়ারকে পাঠাবে আমাকে নিয়ে আসার জন্য।”

“তাজওয়ার, মানে তোর বাবার বন্ধুর ছেলে? আংকেল যার সাথে তোর বিয়ে ঠিক করতে চাচ্ছেন?”

“হ্যাঁ।”

“এখন কি করবি? তোকে তো এবার মিথ্যেমিথ্যি সিলেট যেতেই হবে।”

“যাবো, না হয়। কিন্তু তোর বোনের বিয়ে মিথ্যেমিথ্যি কীভাবে হবে?”

পুষ্প কিছু একটা ভেবে বলল,
“আরেহ ওটা নিয়ে ভাবিস না। আমাকে বলিস কোনদিন সিলেট যাবি, আমি চলে যাবো। আমার দু’জন কাজিন ওখানেই থাকে। উজ্জ্বল ভাইয়া আর তৃষা আপু। আপু তো ওখানেই চাকরি করে। একা থাকে। আমি ওখানেই উঠবো। তুইও ওখানে চলে আসবি। তারপর উজ্জ্বল ভাইয়াকে ফোন করবো। উনি আমাদের স্টেশনে নামিয়ে দেবেন। আর তুই তাজওয়ারকে সেই ঠিকানায় দিস। সেখান থেকে নিয়ে গেলে সন্দেহ করার কোনো চান্সই থাকবে না।”

আহি হেসে বলল,
“ঠান্ডা মস্তিষ্কের মানুষগুলোর মাথায় অনেক কিছু থাকে।”

আহি এবার তৈরী হয়ে এলো। মুনিয়া খালা তার হাতে বক্সগুলো ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
“এগুলা বড় মেডামের জন্য। ছোড মা, তুমি কইয়ো মেডামরে, আমরা তারে এহনো মনে রাখছি। তারে ছাড়া এই বাড়ি খালি খালি লাগে।”

আহি মুচকি হেসে বলল,
“হুম, আর খালা, আপনি আর চুনি ছাড়া কেউ জানে না আমি মায়ের কাছে যাচ্ছি। চাচাকেও বলবেন না। উনার বয়স হয়েছে। যদি ভুলে কাউকে বলে দেন, তাহলে অনেক ঝামেলা হবে।”

“চিন্তা কইরো না। আমরা কাউরে কিছু কমু না। তুমি যাও, মা। মায়ের লগে ভালো সময় কাটাইয়া আসো।”

আহি পুষ্পের সাথে বেরিয়ে পড়লো। সালমা ফাওজিয়া আহিকে কলেজ রোডের সামনে থেকে এসেই নিয়ে গেলেন। মায়ের সাথে রিকশায় বসে আছে আহি। বৃষ্টি ভেজা শহরে রিকশায় চড়ার প্রশান্তি অনুভব করছে আহি। কারণ পাশে একজন বিশ্বস্ত মানুষ আছে। আহি জানে, সামনের এই কয়েকটা দিন তার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিনগুলো হতে যাচ্ছে।

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-২২||

৩৯।
শূণ্যতা কেটে গেছে নতুন আবেশে। বায়বীয় জগতে যোগ হয়েছে নতুন ছন্দ। আর আহি বাঁধছে নতুন সুর। সেই সুরে সালমা ফাওজিয়ার আঁধার ঘেরা ফ্ল্যাটে ঠিকরে পড়ছে রবিকর।

সূর্যের আলো আহির চোখে এসে পড়তেই আবার আলোটা মিলিয়ে গেলো। আহি আধো চোখ মেলে জানালার দিকে তাকাতেই দেখলো সালমা ফাওজিয়া পর্দা টেনে দিচ্ছেন। আহি বিছানা ছেড়ে উঠে বসতেই সালমা ফাওজিয়া বললেন,
“তুমি আরেকটু ঘুমিয়ে নাও।”

আহি উঠে বসে বলল,
“অনেক বছর পর কাল রাতেই আমি শান্তিতে ঘুমিয়েছি। মনে হচ্ছিলো, এতো ভালো ঘুম আমার কখনোই হয় নি। মা, তুমি তো দেখছি শুধুই মেডিসিন নও, একদম এন্টিবায়োটিক।”

সালমা ফাওজিয়া হাসলেন। আহি তার হাত ধরে তাকে বিছানায় বসিয়ে তার কোলে মাথা রাখলো। সালমা ফাওজিয়া আহির চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। আহি মায়ের কোমড় জড়িয়ে ধরে বলল,
“মা, তুমি কি আমাকে এভাবেই তোমার কাছে রেখে দিতে পারবে না?”

সালমা ফাওজিয়া মলিন হাসলেন। মেয়ের মাথায় চুমু খেয়ে বললেন,
“একদিন অবশ্যই পারবো। তোমার জন্যই তো এতো পরিশ্রম করছি।”

আহি মাথা তুলে সালমা ফাওজিয়ার হাত ধরে বলল,
“এর আগে যদি তাজওয়ারের সাথে বিয়ে হয়ে যায়?”

“তোমার অনুমতি ব্যতীত তোমাকে বিয়ে দেওয়ার সাধ্য কারো নেই।”

“আমার ইচ্ছায় আজ পর্যন্ত কিছুই হয় নি। ওরা আমাকে ব্ল্যাকমেইল করে। কখনো তোমার ক্ষতি করবে বলে, কখনো রাদ আর লাবীবের ক্ষতি করবে বলে। লিনাশাকে হারিয়ে ফেলার পর রাদ আমার খুব কাছের বন্ধু। সাড়ে চার বছর আগে আমার জন্যই লিনাশার জীবনের দুর্ভোগ নেমে এসেছিল। রাদের সাথেও যদি এমন কিছু হয়, তাহলে আমি আরো নিঃস্ব হয়ে যাবো।”

সালমা ফাওজিয়া মেয়ের গালে হাত রেখে বললেন,
“রাদের কিছু হবে না। ওরা শুধু তোমাকে ভয় দেখাচ্ছে, আহি। তোমাকে আরো স্ট্রং হতে হবে। এখন উঠো, নাস্তা দিচ্ছি আমি।”

(***)

আজ আকাশ পরিষ্কার। মিষ্টি রোদ বারান্দা ছুঁয়ে দিচ্ছে। আহি সেই মিষ্টি রোদ তার গায়ে মাখানোর জন্য বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। সালমা ফাওজিয়াও কিছুক্ষণ পর আহির পেছনে এসে দাঁড়ালেন। তিনি আহির চুলে হাত রেখেই বললেন,
“এতো অযত্ন কেন, আহি? আসো, আমি তোমার চুলে তেল লাগিয়ে দেই।”

আহি বাধ্য মেয়ের মতো মায়ের পিছু পিছু চলে এলো। সালমা ফাওজিয়া তেল নিয়ে সোফায় বসলেন। আর আহি মেঝেতে বসলো। সালমা ফাওজিয়া হাতে তেল মেখে আহির মাথায় লাগিয়ে দিতে লাগলেন। আহি চোখ বন্ধ করে রেখেছে। আহি তেল দেওয়া একদমই পছন্দ করে না। কিন্তু আজ সে নিষেধ করবে না। কারণ এই মুহূর্তগুলোই তার কাছে অমূল্য।

সালমা ফাওজিয়া আহির চুলে তেল লাগিয়ে দিয়ে তার চুলে বেণি করে দিলেন। আহি পেছন ফিরে মায়ের কোলে মাথা রেখে বলল,
“এভাবে যদি রোজ তুমি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে, তাহলে আমার মাথাটা ঠান্ডা থাকতো।”

“আচ্ছা? এতোদিন বুঝি গরম ছিল?”

“উহুম, নষ্ট ছিল।”

(***)

বিকেলে সালমা ফাওজিয়া একটি ক্যাসেট নিয়ে এলেন। আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“মুভি?”

সালমা ফাওজিয়া মুচকি হেসে বললেন,
“হুম। খুব সুন্দর মুভি।”

“কি নাম?”

“নাম ছাড়া মুভি। দেখার পর বরং তুমিই নাম ঠিক করো।”

আহি টিভির স্ক্রিনে তাকিয়ে আছে। সালমা ফাওজিয়া ক্যাসেটটি চালু করতেই স্ক্রিনে ভেসে উঠলো আহির ছোটবেলার ছবি। সালমা ফাওজিয়া এবার আহির পাশে এসে বসলেন। দু’জন বসে সেই ভিডিও গুলো দেখতে লাগলো। আহির জন্মের আগে সালমা ফাওজিয়া প্রতি মাসে একটা করে ভিডিও তৈরী করেছিলেন। প্রতি মাসে আহির বেড়ে উঠার অনুভূতিটা কেমন সেটা তিনি ভিডিওতে ধারণ করেছিলেন। ভিডিওগুলো দেখেই আহির চোখে অশ্রু ভীড় করলো। সে মায়ের কোলে মাথা রাখলো। এরপর স্ক্রিনে ভেসে উঠতে লাগলো আহির হাসপাতাল থেকে প্রথম ঘরে ফেরা, তার প্রথম হামাগুড়ি দেওয়া, বসতে শেখা, দেয়াল ধরে দাঁড়ানো, কাঁপা কাঁপা পায়ে হেঁটে সালমা ফাওজিয়ার কোলে ঝাপিয়ে পড়া। এসব দেখে আহির চোখে অশ্রু ভীড় করলো। সে মায়ের হাত ধরে বলল,
“দিনগুলো অনেক সুন্দর ছিল, তাই না? আমি আবার কখন তোমাকে আগের মতো করে কাছে পাবো? আমি বাবার সাথে থাকতে চাই না।”

“আমিও তো তোমাকে নিজের কাছেই আনতে চেয়েছি। কিন্তু তোমার বাবা তোমাকে কখনোই হাতছাড়া করবেন না।”

আহি রাগী স্বরে বলল,
“সব ঝামেলার মূল ওই তাজওয়ার খান৷ ওর জন্যই বাবা আমাকে বন্দি করে রেখেছে।”

সালমা ফাওজিয়া ভ্রূ কুঁচকে বললেন,
“কি বলছো, আহি? তাজওয়ারের জন্য কেন বন্দি করবে?”

“তুমি জানো না?”

“না।”

আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“মনে আছে আমি যখন স্কুলে পড়তাম, তখন থেকেই তাজওয়ার আমার পিছু নিতো! বাবা তো তখন থেকেই ওকে পছন্দ করতো। আমাকে বলতো আমি যাতে তার সাথে বন্ধুত্ব করি। কিন্তু আমি যখন স্কুলে, ওর তখন পড়াশুনা শেষের দিকে। এতো বড় ছেলের সাথে তো আমি কখনোই বন্ধুত্ব করবো না। আর তুমি যতোদিন বাসায় ছিলে, ততোদিন তাজওয়ারও বাসায় আসার সাহস পায় নি। কিন্তু তুমি চলে যাওয়ার পর খানদের বাসায় আসা যাওয়া যেন নিত্যদিনের ব্যাপার হয়ে গিয়েছিলো। বাবাকে তখন থেকেই আমি সহ্য করতে পারতাম না। বাবা সেই ছেলেকে হুটহাট আমার রুমে পাঠিয়ে দিতো। আর ছেলেটাও আমার অনুমতি ছাড়া আমার বিছানায় শুয়ে পড়তো। এমন ভাব দেখাতো, যেন আমার উপর একমাত্র তারই অধিকার। এসবে আমি আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। তুমি তো জানো, আমি এসব একদমই পছন্দ করি না। এমন অভদ্র ছেলের সাথে বাবা তখনই আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছিল। সিরাজ খান না-কি আলটিমেটাম দিয়েছেন, আমার সাথে তাজওয়ারের বিয়ে দিলে, খানস গ্রুপের ত্রিশ ভাগ অংশ বাবার নামে লিখে দেবেন। আর তাজওয়ার তার সবকিছু আমার নামে লিখে দেবে। আর এরপর থেকেই বাবা পালটে গেছে। মা, তাজওয়ারের কাছে থাকলে আমি একদম সেইফ ফিল করি না। ও কেমন যেন! ওর সম্পর্কে অনেক খারাপ তথ্য পেয়েছি। রিসেন্টলি ওর প্রাক্তন প্রেমিকা আমাকে ফোন করে জানিয়েছে, তাজওয়ার না-কি তার সাথে ফিজিক্যালি ইনভলভ ছিল। এরপর আমি ইউকে থেকে ফেরার পর তাজওয়ার আর সম্পর্ক রাখতে চায় নি। কিন্তু মেয়েটা ওকে ছাড়ছিল না, তাই ওর বন্ধুদের দিয়ে মেয়েটার সাথে অনেক জঘন্য কাজ করেছে, যেটা তোমাকে বলতেই পারছি না।”

আহি কিছুক্ষণ থেমে বলল,
“মা, তুমিই বলো, এমন একটা ছেলের সাথে কোনো বাবা কি তার মেয়েকে বিয়ে দিতে চায়?”

সালমা ফাওজিয়া চুপ করে রইলেন। আহি আবার বলল,
“এমনিতেই আমি যাকে ভালোবেসেছি, তাকে হারিয়ে ফেলেছি। সেই ট্রমা থেকে এখনো বের হতে পারছি না। তাহলে নতুন করে তাজওয়ার নামক টক্সিক মানুষটাকে আমার জীবনে এনে আমি কেন আরো ট্রমার মধ্যে থাকবো? মা, আমি ওই বাড়িতে গেলে পাগল হয়ে যাবো। ওপেনলি ওরা বাড়িতে মেয়ে এনে, যাচ্ছেতাই করে। এমন পরিবেশে আমি বিয়ে করবো, আমার সন্তান আসবে, এটা আমি মানতেই পারছি না। যেখানে তোমার আর বাবার অসুস্থ সম্পর্কের কারণে আমার কৈশোরকাল, যৌবনকাল সব শেষ হয়ে গেছে। আমি আমার ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সেই একই পরিবেশ দিতে চাই না।”

সালমা ফাওজিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“তোমার বাবাই তোমার সবচেয়ে বড় শত্রু। তাজওয়ার সম্পর্কে আমি তেমন কিছুই জানি না। কিন্তু সিরাজ খান ভালো মানুষ নয়, এটা অনেকেই জানে। তাহলে তার ছেলে আর কেমনই বা ভালো হবে? কিন্তু তোমার বাবা সেই শুরু থেকেই তোমাকে ব্যবহার করছে।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো, “মানে?”

“তোমার মনে আছে, তোমার বাবা আমাকে একবার বেধড়ক পিটিয়েছিল, আর এরপর আমি আমার আট মাসের বাচ্চাটা হারিয়ে ফেলেছিলাম?”

“হ্যাঁ।”

“তোমার বাবা আমাকে কেন মেরেছে জানো?”

“কেন?”

“কারণ তিনি জেনে গিয়েছিলেন, তোমার দাদা তার নামে কোনো সম্পত্তি লিখে দেন নি। আগ্রাবাদে তোমার দাদার একটা বাড়ি আছে। বিশাল বাড়ি। তাছাড়া ঢাকায় তিনি অনেকগুলো জায়গা কিনেছেন। মৃত্যুর আগে তিনি এমন উইল করেছিলেন, যেখানে লেখা ছিল তোমার বাবার সন্তানরাই শুধু সেই সম্পত্তির মালিক হতে পারবে। তোমার বাবা কিছুই পাবেন না। তাই তিনি ছেলে চান নি। যেখানে বাবা-মা নিজ সন্তানের জন্য খেটেখুটে টাকা সঞ্চয় করে তাদের ভবিষ্যৎ গড়ে দেওয়ার জন্য উন্মাদ হয়ে পড়ে, সেখানে তোমার বাবা সম্পদ ভাগাভাগি না হওয়ার জন্য সন্তান নেন নি। তোমার বাবা শুধু টাকা ভালোবাসেন। নিজে তো অনেক বড় ব্যবসায়ী। চাইলে তার বাবার সম্পদ ছাড় দিতে পারতো। কিন্তু তার ক্ষোভ জন্মেছিল। তার ইগোতে আঘাত এসেছিল। কেন তার নামে লিখে না দিয়ে তার সন্তানের নামে লিখে দিয়েছে! আর তাই মিস্টার রিজওয়ান কবির আমার বাচ্চাকে আর পৃথিবীতেই আসতে দেন নি। এখন বাকি তুমি। তুমি মেয়ে, তোমার সাথে যার বিয়ে হবে সেও সেই সম্পত্তির মালিক হবে। আর তোমার বাবা এজন্যই তোমাকে আমার সাথে থাকতে দিচ্ছে না। আর তাজওয়ারের সাথে বিয়ে হলে তোমার বাবা এমনিতেই যে-কোনো ভাবে সেই সম্পত্তি পেয়ে যাবে। আর না পেলেও তার কিছুই আসে যায় না। সে তো এমনিতেই অনেক টাকার মালিক।”

“মা, আমি যদি বাবাকে সেই জায়গা আর বাড়িটা লিখে দেই, তখন কি আমি মুক্তি পাবো?”

“না। তোমার বাবার তো সেই জায়গা লাগবেই না। তার কিসের অভাব আছে, বলো? তোমার বাবা আসলে তোমার দাদাকে হারাতে চায়ছে। তার ইগো তখনই সেটিস্ফাইড হবে, যখন সে তোমাকে কষ্ট দিতে পারবে। যদি তোমার দাদা সেই উইলটা না করতেন, তাহলে তোমার বাবা তোমাকে আর ধরে রাখতো না। আর তার এতোটা পরিবর্তনও হতো না। হয়তো লাবণীর প্রতি সে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। কিন্তু মানুষটা এতোটা নিচু মনের ছিল না। হয়তো বা ছিল, ভালোবাসতাম বলে তাকে চিনতে পারি নি। কিন্তু তোমার বাবা আমাকে কখনোই ভালোবাসে নি, কারণ আমি তার দৃষ্টিতে নিতান্তই সাধারণ ছিলাম। আমি তার চোখে মডার্ন নারী ছিলাম না। কিন্তু লাবণি ছিল ইয়াং মেয়ে, তার ফ্যাশন সেন্স ভালো, সে জিন্স-টপস পরে, দশজন ছেলের সাথে সহজে ওঠাবসা করতে পারে। আমি পারতাম না। আমি শাড়ি পরি, সাধারণ ভাবে চলি। আর আমাদের মতেরও অমিল হতো। আমি অনেক অত্যাচার সহ্য করেছি। শুধু তোমার জন্যই সেই বাড়িতে পড়েছিলাম। এখন দেখো, তোমাকেও সেভাবে চালাচ্ছে।”

আহি মাথা নিচু করে রইলো। সালমা ফাওজিয়া আহির গালে হাত রেখে বললেন,
“অনেক বড় হয়ে গেছো তুমি। এখন একটু শালীন ভাবে চলাফেরা করতে হবে। এই সমাজটা এতোটাও ভালো না, আহি। এই দেশের সংস্কৃতির সাথে তোমার এই পোশাক যায় না। জানি তোমার বাবা তোমাকে এভাবেই চলতে বাধ্য করছে। কিন্তু নিজের ইচ্ছেটা চাপিয়ে দিতে পারো। একটু স্ট্রং হও। এসব ছোটখাটো ব্যাপারে তুমি তোমার জন্য স্ট্যান্ড নিতে পারো। এতোটুকু স্ট্যান্ড নিতে না পারলে, তুমি কীভাবে তোমার বিয়ে আটকানোর সাহস দেখাবে? কীভাবে বলছো যে তুমি ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসবে? আগে নিজেকে শক্ত করো। তুমি শক্ত হলে, তোমার পাশে দাঁড়ানোর অনেকেই আছে। তোমার মা আছে।”

আহি সালমা ফাওজিয়াকে জড়িয়ে ধরলো। তিনি আহির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
“তুমি অনেক সুন্দর আহি। তোমাকে শাড়ি পরলে, সেলোয়ার-কামিজ পরলে ভালোই লাগবে৷ অন্তত লং টপস পরতে পারো, গায়ে ওড়না ঝুলাতে পারো। আর স্লিভলেস পোশাক তো একদমই বেমানান।”

“আমি তো স্লিভলেস পরতে চাই না, ওড়না ঝুলিয়েই আমি বাসা থেকে বের হই। কিন্তু মাঝে মাঝে মিসেস লাবণির পিএ সুনেহরাহ এসেই আমার জামা-কাপড় সিলেক্ট করে দেয়। আমার খাওয়া, পরা, সবকিছুই তাদের পছন্দে হয়। যদিও ইউকে’তে আমি নিজের ইচ্ছেমতো চলতে পেরেছি। আর ওখানে এমন ড্রেস পড়লে কেউ চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে না।”

“তাও, আহি। তোমার বন্ধুরা তো দেশের ছেলে। রাদ, লাবীব, ওরা কি অন্য দেশের? ওরা এই দেশের ছেলে। ওরা তোমাকে সম্মান করে, তাই হয়তো বাজে দৃষ্টিতে তাকায় না। কিন্তু কারো নিয়ত সম্পর্কে তুমি কতোটুকুই বা জানবে?”

“কি করবো আমি এখন?”

“আপতত স্লিভলেস পরো না। ওদিন তুমি এমন পোশাকে রাদের সাথে রিকশা করে কোথায় যেন যাচ্ছিলে। আমি তোমাকে দেখেছিলাম। আমার ভালো লাগে নি, আহি।”

আহি মুখ ছোট করে বলল,
“সরি। আমি হয়তো ভালো না।”

“তুমি ভালো। তুমি অনেক লক্ষী একটা মেয়ে। শুধু তোমার পরিবেশটা খারাপ। আমি চাই, আমার মেয়েটা ভালো পরিবেশে থাকুক। আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে তোমার জন্য একজন উত্তম সঙ্গী চাই, যে আমার মেয়ের যত্ন নেবে, তাকে ভালোবাসবে, তার সম্মান করবে, আর তাকে সকল খারাপ দৃষ্টি থেকে রক্ষা করবে।”

আহি মুচকি হেসে বলল,
“শুনেছি মায়ের দোয়া কবুল হয়ে যায়৷ তুমি আমার জন্য আরেকটা দোয়া করবে?”

“কি!”

আহি কাঁপা কন্ঠে বললো,
“আমি যাতে আফিফকে ভুলে যেতে পারি।”

কথাটি বলতে গিয়েই আহির চোখ ছলছল করে উঠলো। সালমা ফাওজিয়া মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে বললেন,
“তুমি আমার রাজকুমারী। তোমার সব ইচ্ছের জন্য আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে চাইবো। আমার দোয়া সবসময় তোমার সাথেই থাকবে।”

(***)

চারটা দিন আহির খুব ভালোই কেটেছে। এই চার দিনে সালমা ফাওজিয়া আর আহি অনেক গল্প করেছে, একসাথে বই পড়েছে, সালমা ফাওজিয়া রান্না করলে আহি মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে তাকে সাহায্য করেছে, টুকটাক শিখেও নিয়েছে, আর রাতে মাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়েছে। আজ তার এই বাড়িতে শেষ দিন। আহি সকাল থেকেই মুখ ভার করে বসে আছে। এদিকে পুষ্প সিলেট পৌঁছে তাকে কয়েকবার ফোন দিয়ে ফেলেছে। সেখানে তারা দু’দিন থাকবে।

হঠাৎ সালমা ফাওজিয়া এসে আহির মুখে একটা মিষ্টি পুরে দিলেন। আহি মিষ্টি মুখে নিয়েই মায়ের দিকে তাকালো। সালমা ফাওজিয়া একগাল হেসে বললেন,
“কেমন হয়েছে?”

আহি মিষ্টিটা খেয়ে বলল, “ভীষণ মজা!”

“তুমি বললে না, লাবণি তোমাকে মিষ্টি খেতে দেয় না। তাই আমি এটা তোমার জন্য বানিয়েছি।”

“তুমি বানিয়েছো? কখন?”

“তুমি যখন ঘুম ছিলে। ভোরেই বানিয়ে রেখেছি।”

“তুমি মিষ্টিও বানাতে পারো?”

“না, দু’দিনে শিখেছি। কাল বানিয়েছিলাম, কিন্তু ভালো হয় নি, তাই তোমাকে আর দেই নি। আজকেরটা মোটামুটি ভালো হয়েছে।”

আহি মায়ের হাত ধরে বলল,
“ভাবছি, যাদের মা আছে, তারা রোজ এমন যত্ন পাচ্ছে। আর আমি আজ থেকে আবার একা হয়ে যাবো।”

সালমা ফাওজিয়া আহির গালে চুমু খেয়ে বললেন,
“কেন একা হবে? যখনই তোমার মন চায়বে, আমার কাছে চলে আসবে। আর আমি তোমার জন্য নতুন সিম কিনেছি। এখন তুমি আমাকে সেই নম্বর থেকেই ফোন করতে পারো।”

“আচ্ছা।”

সালমা ফাওজিয়া এবার নিজের ঘরে গেলেন। একটা প্যাকেট এনে আহির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
“এটা পরে নাও। তোমাকে নিয়ে বের হবো।”

আহি প্যাকেটটা হাতে নিয়ে খুশি হয়ে বলল,
“আমরা তাহলে ঘুরতে যাচ্ছি?”

সালমা ফাওজিয়া মুচকি হেসে বললেন, “হুম।”

(***)

লাল হলুদাভ শাড়ি পরে আহির সামনে এসে দাঁড়ালেন সালমা ফাওজিয়া। মায়ের দিকে তাকিয়ে আহি অবাক হয়ে বলল,
“একদম একই শাড়ি!”

সালমা ফাওজিয়া বললেন,
“হুম, তোমার জন্য কিনেছিলাম। তার সাথে মিলিয়ে আমিও একটা কিনেছি। মা-মেয়ের টুইনিং হয়ে গেলো।”

“বাহ! আমার মা তো দেখছি বেশ স্মার্ট।”

“তা তুমি শাড়িটা পরো নি কেন?”

আহি মুখ ছোট করে বলল, “পরতে পারি না।”

সালমা ফাওজিয়া আহির হাত ধরে তাকে নিজের সামনে দাঁড় করালেন। এরপর শাড়িটা হাতে নিয়ে আহির হাতে দিলেন। তারপর শাড়ির কুঁচি ধরে আহিকে শিখিয়ে দিতে লাগলেন।

(***)

শূণ্য আকাশে কালো মেঘেরা ভাসছে। সেই সাথে বাতাবরণে যোগ হয়েছে শীতল হাওয়া। হাওয়ার তালে বারান্দার পর্দাটি দোল খাচ্ছে।

নিস্তব্ধ ঘরে দাঁড়িয়ে আছে আহি। সালমা ফাওজিয়া মেয়ের সামনে বসে কুঁচি ঠিক করছেন। তাদের কথোপকথনে নীরব ঘরটিতে মৃদু গুঞ্জন সৃষ্টি হলো। পুরো ফ্ল্যাটে সেই গুঞ্জন বাতাসের তালে ছড়িয়ে পড়েছে, আর প্রতি কোণায় গিয়ে জানিয়ে দিচ্ছে আজ বিদায় বেলা।

মেয়েকে আয়নার সামনে বসিয়ে খোঁপা বেঁধে দিলেন সালমা ফাওজিয়া। তারপর নিজ হাতে সেই খোঁপায় গাদা ফুলের মালা লাগিয়ে দিলেন। আহি মায়ের হাত ধরে বসালো। মাকে নিজ হাতে সাজিয়ে দিলো সে। এবার সালমা ফাওজিয়া আহির হাতে হলুদ ও লাল কাচের চুড়ি পরিয়ে দিলেন। আর আহি মায়ের জুতার ফিতা বেঁধে দিলো। দু’জনই হাত ধরে নেমে পড়লো ভেজা রাস্তায়। ফুটপাত ধরে হাঁটলো কিছুক্ষণ। তারপর টংয়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে দু’জনই চা খেলো। রিকশা নিয়ে সদ্যস্নাত শহরে মধ্যাহ্নবেলা উপভোগ করলো।
এরপর সালমা ফাওজিয়া আহিকে নদীর পাড়ে নিয়ে গেলেন। দু’জনই নৌকায় উঠে বসলো। মাঝিকে বললেন পাড় ঘুরিয়ে আনতে। আহি নৌকার পাঠাতনে বসে আঙ্গুল ডুবিয়ে স্রোতস্বতীকে অনুভব করতে লাগলো। সালমা ফাওজিয়া মনে মনে বললেন,
“এই নদী আজ সার্থক হয়েছে। কারণ মা তার সন্তানকে কাছে পেয়েছে। এই চারটি দিন আমার জীবনের সবচেয়ে চমৎকার দিন হয়ে থাকবে। আমি আমার সাধ্যের মধ্যে আমার মেয়ের মুখে হাসি ফোটাতে পেরেছি। যদি রিজওয়ান কবিরকে দেখাতে পারতাম, সব সুখ টাকা দিয়ে কেনা যায় না, কিছু সুখ ভালোবাসা দিয়েও কেনা যায়, তাহলে আমি পুরোপুরি সার্থক হতাম।”

মা-মেয়ে নদীর পাড়ে হেঁটে সূর্যাস্তের সময়টুকু পার করলো। তারপর ফুটপাতে দাঁড়িয়ে দু’জনই ফুচকা খেয়ে বাসায় ফিরলো। বাসায় এসেই আহি ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিলো। এরপর কাপড় পাল্টে এসে ব্যাগ নিয়ে বের হতেই দেখলো, সালমা ফাওজিয়া সোফায় বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। আহি মাকে কাঁদতে দেখে আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না। তারপর দু’জনই অনেকক্ষণ কাঁদলো। এরপর আহি চোখ মুছে বললো,
“ট্রেন ধরতে হবে আমাকে।”

সালমা ফাওজিয়া আর কিছু বললেন না। আহি এবার মায়ের চোখ মুছে দিয়ে বলল,
“এই চারদিনে আমার নিজেকে একটুও একা মনে হয় নি। আমার মনে যতো দুঃখ জমানো ছিল, আমার মধ্যে থাকা সব হতাশা, আক্ষেপ সবকিছুই আমি ভুলে গিয়েছিলাম। মা, আমার সুখী হওয়ার সবচেয়ে বড় মেডিসিন তুমিই। তোমাকে পেলে আমার আর কিচ্ছু লাগবে না। আমরা এখান থেকে পালিয়ে যদি বাইরের দেশে সেটেল্ড হয়ে যাই, তখন বাবা আমাদের কিছুই করতে পারবে না। তার সব দাপট দেশেই। বাইরের দেশে সে কিছুই না।”

সালমা ফাওজিয়া মলিন মুখে বললেন,
“বাইরের দেশে যাওয়া, চাকরি নেওয়া, খরচ, এতো টাকা কোথায় পাবো? তোমার বাবার টাকায় তুমি ইউকে থেকে পড়াশুনা করে এসেছো। তোমার নিজের কিছুই নেই।”

আহি সালমা ফাওজিয়ার কথায় দমে গেলো। সে মনে মনে ভাবতে লাগলো, কখন তার জীবনে আশার আলো ফিরে আসবে! কখন সে মুক্তি পাবে এই হিংস্র মানুষগুলোর হাত থেকে!

(***)

নয়টার ট্রেনে উঠে পড়লো আহি। সালমা ফাওজিয়া ট্রেন ছাড়া অব্ধি স্টেশনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে চলে যেতেই তার বুকটা খালি হয়ে গেলো। আহিও নিঃশব্দে অশ্রু ফেললো।

মা-সন্তানের এমন বিচ্ছেদও কি হয়? প্রবাসী সন্তানকে বিদায় দিতে এসে কতো মা নীরবে কাঁদেন, হোস্টেল ফেরা সন্তানদের চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে কতো মা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। কিন্তু এই বিচ্ছেদের যন্ত্রণা ভয়ংকর। যেখানে মা-মেয়ে একই শহরে থেকেও অনেকদূরে, যেখানে দু’দন্ড কথা বলতে গেলে শকুনের দৃষ্টি থেকে বাঁচতে হয়। স্বাধীন দেশে, এমন পরাধীন জীবনটাই যে ভয়ংকর। যেখানে একটাই ভীতি, যদি প্রিয় মানুষটিকে কাছে পেতে চাইলে, তার নিথর শরীর ফেরত আসে?

চলবে-

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে