উধয়রনী পর্ব-১৭ এবং বোনাস পর্ব

0
361

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-১৭(১ম ভাগ)||

২৭।
চার বছর পর আফিফের মুখোমুখি হলো আহি। মানুষটাকে দেখেই তার মুখের হাসিটা বিলীন হয়ে গেলো। যাকে আহি চার বছর আগে পেছনে ফেলে এসেছিল, সে কল্পনাও করতে পারে নি সেই মানুষটা আবার তার সামনে এসে দাঁড়াবে। আহির চোখ ছলছল করছে। আফিফ এখনো আহিকে খেয়াল করে নি। সে ব্যস্ত তার হাতে থাকা কাগজপত্র দেখায়। এদিকে রাদ আহিকে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রূ কুঁচকে সামনে তাকালো। আহির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটিকে সে কিছুদিন আগেও ক্যাম্পাসের গেটের সামনে দেখেছিল। আহি নিজেই রাদকে দেখিয়ে দিয়েছিল। তাহলে সেদিন আফিফের ক্যাম্পাসের সামনে দাঁড়ানো কোনো কাকতালীয় ব্যাপার ছিলো না। তার সাথে এখনো হয়তো এই ক্যাম্পাসের কোনো যোগসূত্র আছে। রাদ এতোটুকু জানে আফিফ আর আহি একই ডিপার্টমেন্টে। এখন যদি আফিফ ভার্সিটির প্রফেসর হয়, তাহলে আহির মানসিক ভাবে আরো কষ্ট সহ্য করতে হবে।

যন্ত্রণাদায়ক অতীত যদি বর্তমানে চলে আসে, তাহলে বর্তমানটাই এলোমেলো হয়ে যায়। আহি তো আফিফকে অতীত আর কল্পনার মাঝেই রাখতে চেয়েছিল, তাহলে কেন এই মানুষটা আবার তার সামনে এলো? তার কি আরো কষ্ট পাওয়া বাকি আছে? এই মুহূর্তে আহির মনে হচ্ছে সে শূন্যের উপর ভাসছে। পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাওয়া প্রবাদটি সে আজ অনুভব করতে পারছে। আদতে মাটি সরে না গেলেও তার মনের শূন্যতা পৃথিবীর ব্যস্ততাকে ক্ষণিকের জন্য থামিয়ে দিয়েছে। আহির অস্থির মনটা মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষগুলোকে দুর্বল করে দেওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা করছে।

আহির প্যানিক এট্যাক আসার সম্ভাবনা আছে। খালি চোখে আহিকে দেখে কেউ বুঝবেই না তার মনের অবস্থা। কিন্তু রাদ সূক্ষ্মভাবে দেখছে তাকে। আহির হাত কাঁপছে। রাদ আহির কাছে এসে তার হাত ধরে তাকে নিজের দিকে ফিরালো। আহি রাদের দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো। রাদ চাপা স্বরে বলল,
“আহি, রিল্যাক্স। প্লিজ নিজেকে শক্ত কর। তোর অবস্থা দেখলে ছেলেটা বুঝে যাবে, তুই এখনো তাকে মনে রেখেছিস। এমন হয় না আহি। ওর সামনে তুই দুর্বল হতে পারবি না।”

আহি কাঁপা কন্ঠে বললো,
“আমার এমন লাগছে কেন, রাদ?”

রাদ আহির দুই হাত শক্ত করে নিজের হাতে আবদ্ধ করলো। তারপর মুচকি হেসে বলল,
“আমার এখন ইচ্ছে করছে তোকে জড়িয়ে ধর‍তে।”

আহি রাদের কথা শুনে চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকালো। রাদ আবার বলল,
“আহি, আমি তোকে ভালোবাসি।”

আহি রাদের হাত ছেড়ে দিয়ে স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ালো। ভ্রূ কুঁচকে বললো, “কি বললি!”

রাদ হেসে বলল,
“আলহামদুলিল্লাহ, তোকে শান্ত করতে পেরেছি।”

আহি মলিন হেসে বলল,
“তুই আসলেই আমার মেডিসিন।”

(***)

আহি উলটো দিকে ঘুরে দাঁড়ালো। পেছনেই আফিফ দাঁড়িয়ে আছে। তাই আহি আর পেছনে তাকালো না। কিন্তু ভাগ্যটা আজ তার বিপক্ষেই দাঁড়িয়েছে। হঠাৎ পেছন থেকে তার নাম ধরে মেয়েলী কন্ঠে কেউ একজন ডাক দিলো। আহি কন্ঠটা শুনেই চমকে উঠলো। আহি পেছন ফিরে তাকানোর সাহস পাচ্ছে না। কিন্তু আবার সেই কন্ঠটি আহির নাম ধরে ডাকলো। এবার আর ডাকটি উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। আহি পেছন ফিরে তাকাতেই সামনে থাকা মেয়েটির চোখে আনন্দাশ্রু ভীড় করলো। আহিও মেয়েটির দিকে তাকিয়ে নিজের অশ্রু আটকে রাখতে পারলো না। দু’জনই প্রায় আবেগী হয়ে গেছে। এবার দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো।

পদ্ম চোখের পানি মুছে আহির দিকে তাকালো। কাঁপা কন্ঠে বলল,
“কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলি তুই? কতো খুঁজেছি তোকে! একটা কল দেওয়া কি যেতো না? কতো স্বপ্ন দেখেছিলাম আমরা। সব ভুলে গেলি, আহি?”

আহি পদ্মের হাত ধরে বলল,
“আমি কখনো তোদের ভুলতে পারি নি। তোরা আমার কাছে বেস্ট ছিলি।”

“বেস্ট, এটাকে বেস্ট বলে? এভাবে যোগাযোগ শেষ করে দূরে চলে যাওয়ার কোনো মানে হয়? সবার কাছেই ফোন আছে এখন। একটা কলও কি দেওয়া যেতো না? আমি তো তোকে অনেক খুঁজেছিলাম। কিন্তু তুই আমাকে ব্লক করে দিয়েছিলি। কেন আহি? আমার অপরাধ কি ছিল?”

“তোর কোনো অপরাধ ছিলো না। আমিই অপরাধী। এখন কারণ জানতে চাস না প্লিজ। এতোটুকু জেনে রাখ, আমার পারিবারিক অবস্থা ভালো ছিলো না। আর আমিও ভালো ছিলাম না।”

পদ্ম আহির হাতে কপাল ঠেকিয়ে বলল,
“আমার আজ এতো খুশি লাগছে, আমি বলে বোঝাতে পারবো না। এখন বল, কেমন আছিস?”

“ভালো, তুই কেমন আছিস?”

“আমিও ভালো। এই মুহূর্তে আরো বেশি ভালো আছি। কতো বছর পর তোর সাথে দেখা হলো! তুই এমন শুকিয়ে গেছিস কেন? খাওয়া-দাওয়া করিস না না-কি? শুনেছি বাইরের দেশে গেলে মানুষ মোটাসোটা হয়ে ফিরে। আর তোকে দেখে মনে হচ্ছে, সেই দেশে দুর্ভিক্ষ ছিল।”

আহি পদ্মের দিকে তাকিয়ে মলিন হেসে তাকে জড়িয়ে ধরলো, আর মনে মনে বলল,
“জগতের দুর্ভিক্ষ আমার মনের দুর্ভিক্ষের কাছে হেরে গেছে, পদ্ম। যদি ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় আর চাঁদ ঝলসে যাওয়া রুটির মতো মনে হয়, তবে আমার প্রণয় বিরহে পৃথিবী মরুভূমি আর পদ্মফুল সেই মরুভূমিতে উঠা ধূলিঝড়।”

আহি এবার পদ্মকে ছেড়ে দিয়ে বলল,
“তুই তো ভীষণ সুন্দর হয়ে গেছিস। তোর রূপের রহস্য কি?”

পদ্ম লাজুক হেসে পেছন ফিরে তাকালো। আহিও পদ্মের দৃষ্টি অনুসরণ করলো। আফিফ এতোক্ষণ শান্ত দৃষ্টিতে দুই বান্ধবীর উষ্ণ আলিঙ্গন দেখছিলো। দু’টি তৃষার্ত প্রাণকে জল খুঁজে পাওয়ার আনন্দে মত্ত দেখে আফিফের মনটা কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠল।
পদ্ম আফিফের কাছে এসে তার হাত ধরে তাকে আহির মুখোমুখি এনে দাঁড় করালো। রাদ একপাশে দাঁড়িয়ে আহির দিকে তাকিয়ে আছে। আর মনে মনে বলছে,
“আল্লাহ, আহিকে ধৈর্য ধরার শক্তি দাও। ও অন্তত দুর্বল না হোক।”

এবার পদ্ম আফিফকে বলল,
“আফিফ, ও আমার ছোট বেলার বান্ধবী, আহি। আপনার মনে আছে, ও আমাদের বিয়েতে এসেছিল!”

পদ্মের কথা শুনে আফিফ সেকেন্ড খানিক আহির দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো। পদ্ম বলল,
“আমি আপনাকে ওর কথায় বলতাম। হুট করেই মেয়েটা গায়েব হয়ে গিয়েছিল।”

পদ্ম এবার আহির হাত ধরে বলল,
“এখন আর পালাতে পারবি না তুই।”

আফিফ গলা খাঁকারি দিয়ে পদ্মকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“তুমি কথা বলো। আমি কাজ শেষ করে আসছি।”

আফিফ দ্বিতীয়বার আর আহির দিকে তাকানোর সাহস পেলো না। তার মনটা কেমন যেন কচকচ করছে। সে সোজা ক্যাম্পাসের প্রশাসনিক ভবনে ঢুকে পড়লো। কিন্তু আহির চোখ দু’টি এখনো আফিফের যাওয়ার পানেই স্থির। তার চোখ জোড়া আবার ছলছল করে উঠলো। লজ্জা আর জড়তায় তার গলায় কথা আটকে গেছে। সে মনে মনে ভাবছে, যদি একবার জানতো তাকে আবার কোনো একদিন আফিফের মুখোমুখি হতে হবে, তাহলে চার বছর আগে সেই বর্ষার রাতে কখনোই তার মনে জমিয়ে রাখা কথাগুলো সে আফিফকে জানাতো না। মনের কথা মনেই রেখে দিতো।

পদ্মের কথায় আহির ঘোর কাটলো। সে জিজ্ঞেস করলো,
“তোর সাথে লিনুর কিছু হয়েছে?”

আহি না সূচক মাথা নেড়ে বলল,
“এখন এসব কথা রাখ। আগে বল, তুই এখানে কি করছিস?”

পদ্ম বলল,
“এখানে আমি আমার কাজে আসি নি। আফিফের কাজে এসেছি।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“উনি কি এখানে চাকরি নিয়েছে?”

পদ্ম হেসে বলল,
“না। আফিফ এ বছর মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছে।”

পদ্মের কথা শুনে আহির বুকটা কেঁপে উঠলো। সে পদ্মকে আর কিছু জিজ্ঞেস করতে পারলো না। সে যতোদূর জানে আফিফ চার বছর আগে অনার্স শেষ করেছিল। তাহলে চার বছর পর সে মাস্টার্সে কেন ভর্তি হতে এসেছে? যাই হোক, ভর্তি হচ্ছে, কিন্তু সেই মুহূর্তেই বা কেন, যখন আহিও মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছে?কয়েকদিন আগে জানলে আহি কখনোই এখানে ভর্তি হতে আসতো না।
হঠাৎ পুষ্প কোথা থেকে এসে পদ্মকে দেখে চমকে উঠলো। সে চোখ বড় বড় করে বলল,
“পদ্ম! আমাদের নাওশিন পদ্ম যে!”

পুষ্প গালে হাত দিয়ে অবাক দৃষ্টিতে পদ্মের দিকে তাকিয়ে রইলো। পদ্ম পুষ্পের এমন কান্ড দেখে হেসে বলল,
“কেমন আছিস তুই?”

পুষ্প ভাব নিয়ে বলল,
“আমি তো সবসময়ই ভালো থাকি। পলি আপু গ্রুপে আমার চেয়ে সুখী কেউ নেই।”

পদ্ম পুষ্পকে জড়িয়ে ধরলো। পুষ্প পদ্মের গাল টেনে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“তো এখানে কেন তুই? চার বছর পর আবার নতুন করে পড়াশুনা শুরু করতে এসেছিস নাকি? তোর ঝগড়ুটে শাশুড়ি এতো ভালো হলো কবে থেকে রে?”

পদ্ম হেসে বলল,
“আরেহ না। আমার বরের সাথে এসেছি।”

পুষ্প অবাক হয়ে বলল,
“দুলাভাই কি আমাদের ক্লাস পাবে নাকি?”

“ধুর, ও মাস্টার্সে ভর্তি হতে এসেছে।”

পুষ্প চোখ দু’টি গোল গোল করে আহির দিকে তাকালো। আহি পুষ্পের এমন মুখভঙ্গি দেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।
পুষ্পের এই এক অভ্যাস! নতুন কিছু শুনলে সে মুখের এমন ভাবভঙ্গি দেখাবে, মনে হবে কোনো ভয়ংকর খবর শুনেছে। পুষ্পের মুখভঙ্গি দেখে পদ্ম হাসতে হাসতে বলল,
“তোর সেই কার্টুন ভাবটা এখনো গেলো না, তাই না?”

পুষ্প মুখটা স্বাভাবিক করে বলল,
“আচ্ছা, এসব বাদ দে। আগে বল, ভাইয়া কি আমাদের সেইম ব্যাচ নাকি?”

“না, উনি তো আমাদের সিনিয়র।”

“তো এতোদিন পর মাস্টার্স করতে কেন এসেছে?”

“আসলে আমাদের বিয়ের পর উনি চাকরি নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। চাকরিটা ওই সময় খুব দরকার ছিল৷ আর উনি একসাথে দুইটা সামলাতে পারছিলেন না, তাই তখন মাস্টার্স করেন নি।”

“আর এখন কি চাকরি চলে গেছে নাকি?”

পুষ্পের কথা শুনে আহি পুষ্পের মাথায় গাঁট্টা মেরে বলল,
“তুই এতো প্রশ্ন করিস কেন, ভাই? চুপ কর না।”

পুষ্প ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“তোর সমস্যা কি? আমার বান্ধবী, আমি প্রশ্ন করবো না? আর ও তো বিয়ে করেছিল, ভাইয়া যখন বেকার ছিল তখন, তাই না?”

পদ্ম হালকা হেসে মাথা নাড়লো। পুষ্প তাকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলল,
“ভাইয়া কিন্তু খুবই ভাগ্যবান পুরুষ। বামুন হয়েই চাঁদ ধরে ফেলেছিলেন।”

আহি পদ্মের দিকে তাকিয়ে ধরা কন্ঠে বললো,
“চাঁদটা ধরা দিয়েছে বলেই তো ধরতে পেরেছে। ধরা না দিলে আজ বামুন ভিন্ন কিছু পেতো।”

পুষ্প বলল,
“কাচ পেতো, কাচ। কোনো মেয়েই ভাইয়াকে পদ্মের মতো ভালোবেসে আগলে রাখতে পার‍বে না।”

আহি মলিন হাসলো। পুষ্প যদি জানতো, আহির এআর, পদ্মের বর, তাহলে আহির সামনে কখনোই এই কথা বলতো না। অগোচরে তার বান্ধবীগুলো তাকে আঘাতের পর আঘাত করেই যাচ্ছে। কিন্তু সে নিরব দাঁড়িয়ে শুধু নিজের ক্ষতের যন্ত্রণা বাড়াচ্ছে।
রাদ আহির দিকেই তাকিয়ে ছিলো। সে বুঝতে পেরেছে পদ্ম আর পুষ্পের কথোপকথন আহিকে কষ্ট দিচ্ছে। তাই সে এসে আহির হাতটা ধরলো। এই মেয়েটা যে এখন নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই! হুট করে কি না কি করে বসে বলা যায় না। রাদই তো তাকে সামলাতে পারবে।

(***)

প্রশাসনিক ভবন থেকে বের হতেই আফিফ আর আহির চোখাচোখি হলো। আহি আফিফকে দেখে আবার দুর্বল হয়ে পড়লো। ছেলেটাকে একটা সময় দেখলেই তার হৃদ স্পন্দন বেড়ে যেতো, আর আজ তার চোখাচোখি হতে আহির প্রাণটাই বেরিয়ে যাচ্ছে।

আফিফ পদ্মের কাছে এসে বলল,
“ওরা বলছে অনার্সে ভর্তি হওয়ার এখনো সময় আছে। চলো তোমাকে ভর্তি করিয়ে দেই।”

পদ্ম আফিফের হাত ধরে চাপা কন্ঠে বলল,
“মা যা চান না, আমি তা কেন করবো?”

আফিফ শান্ত কন্ঠে বললো, “মাকে আমি বোঝাবো।”

“না, আফিফ। এখন আমার দায়িত্ব সংসার সামলানো। এমনিতেই আমার উপর মায়ের অভিযোগের শেষ নেই। আমাকে বিয়ে করার পর আপনি মাস্টার্সটা শেষ করতে পারেন নি। এ নিয়ে কি কম কথা শুনেছি? তার ইচ্ছে ছিল, তার ছেলে মাস্টার্স করবে। এখন তার সেই ইচ্ছেটা পূরণ করার দায়িত্ব আপনার। প্রতিবেশীর ছেলে, আপনার বন্ধুরা মাস্টার্স শেষ করে মাকে মিষ্টি খাইয়েছে, আর আপনি নাকি আমার জন্য তার স্বপ্ন পূরণ করতে পারেন নি!”

পদ্ম আক্ষেপ নিয়েই কথাগুলো বললো। পদ্মের কথা শুনে আফিফ তার কাঁধে হাত রেখে বলল,
“দেখবে, সব ঠিক হয়ে যাবে। মা তো বুঝে না যে মাস্টার্স ছাড়াও ভালো চাকরি পাওয়া যায়। দেখো, আমি নতুন চাকরি নিয়ে মায়ের ভুলটা ভাঙিয়ে দেবো। মা মনে করছে মাস্টার্স করি নি, তাই চাকরিটা চলে গেছে। কিন্তু আসল কারণ তো কোম্পানিটা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।”

আহি দূরে দাঁড়িয়ে আফিফ আর পদ্মকে দেখছে। এসব দেখতে ভালো লাগছে না তার। সে চোখ বন্ধ করে নিজের আবেগ লুকোনোর চেষ্টা করতে লাগলো। আফিফ তার আবেগ। আর বর্তমানে তার বান্ধবীর বর। আফিফের উপর এখন তার কোনো অধিকার নেই। তাহলে শুধু শুধু এই ছেলেকে ভেবে কেঁদেকেটে বুক ভাসিয়ে কি তার কোনো লাভ হবে? দিনশেষে তার বুকটাই ভেসে যাবে, আর পদ্মের বুকে আফিফ মাথা রেখে ঘুমাবে। আহির এই খালি বুকটাতে আফিফের কোনো জায়গা নেই। আর প্রকৃতির শৃঙ্খলার বিরুদ্ধে গিয়ে সে আফিফকে নিজের করেও রাখতে পারবে না।

(***)

পুষ্প ধপাস করে আহির পাশে বসতেই আহি চোখ কচলে চোখের জল আড়াল করে নিলো। পুষ্প আহির কাঁধে হাত রেখে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“দেখ, ভাইয়া কিভাবে ফিসফিস করছে পদ্মের সাথে!”

আহি চোখ ছোট করে বলল,
“তো! এসব আমাকে কেন বলছিস?”

“ধুর, বোকা। কিছুই বুঝিস না তুই। মানুষ কখন ফিসফিস করে, বল তো?”

“আমি কিভাবে বলবো?”

“আরেহ, যখন প্রেমের কথা বলে তখন। দেখ, ওদের বিয়ে হয়েছে চার বছর হয়ে গেছে। কিন্তু এখনো কতো সুন্দর সম্পর্ক তাদের! আর এদিকে আমরা। বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু এখনো প্রেমিক পুরুষ কপালে জুটে নি। আর তুই কেন বসে আছিস, বল তো? তোর সেই এআরের খবর কি?”

আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“জানি না সে কোথায় হারিয়ে গেছে। এসব কথা আর জিজ্ঞেস করিস না।”

আহির দৃষ্টি আবার আফিফ আর পদ্মের দিকেই গেলো। তাদের দেখে আহি মনে মনে বলল,
“হারানো জিনিস হারিয়ে যাওয়ায় ভালো। পেয়ে গেলে হয়তো আগলে রাখতে পারতাম না। ভাগ্য যেখানে আমাকে আগলে রাখে নি, আমি আবার কাকে আগলে রাখবো? পুষ্প ঠিকই বলেছে, আমি আফিফের কাছে কাচ আর পদ্ম চাঁদ। কাচের হৃদয় আজ মরুভূমি। যেখানে ভালোবাসার জল নেই। আছে শুধু হাহাকার। প্রিয় মানুষগুলোকে হারানোর হাহাকার।”

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-১৭(২য় ভাগ)||

২৮।
পেছনের চাকা থেকে ধোঁয়া বের করতে করতে একটা মোটর সাইকেল ক্যাম্পাসে ঢুকলো। পদ্ম আর আফিফ ক্যাম্পাসের মাঠেই দাঁড়ানো ছিল। মোটর সাইকেলের ধোঁয়াগুলো সব পদ্মের নাকে-মুখে ঢুকে গেছে। পদ্ম হাত নাড়িয়ে ধোঁয়াগুলো তাড়াতে লাগলো। বাইকটি ক্যাম্পাসে ঢুকে প্রশাসনিক ভবনের সামনে কয়েক চক্কর দিয়ে থামলো। আহি আর পুষ্প বাইকারটির দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে আছে। পুষ্প রীতিমতো বাইকারটির চেহারা দেখার জন্য উদগ্রীব। কি চমৎকার ভাবেই না বাইকারটা রোলিং বার্নআউট স্টান্ট করলো! পুষ্পের বরাবরই স্টান্ট বাইকারদের উপর প্রবল আকর্ষণ। আর যদি তার হাতের নাগালেই এমন ছেলে থাকে, তাহলে তাকে পটাতে সে ভীষণ আগ্রহী হবে। কিন্তু পরক্ষণেই পুষ্প ভাবতে লাগলো, সে মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছে। আর এই বাইকারটি যদি অনার্স পড়ুয়া ছাত্র হয়, তাহলে তো তার সব আশা জলে যাবে।

বাইক থামিয়ে হেলমেট খুলতেই বাইকারের চেহারা দৃশ্যমান হলো। পুষ্প বাইকারকে দেখে ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“আরেহ, এটা তো লাবীব!”

লাবীব বাইকের হ্যান্ডেলে দুই হাত উঠিয়ে হালকা ঝুঁকে বলল,
“কেন ক্লাসের ব্যাকবেঞ্চারদের কি এমন স্কিল থাকতে পারে না?”

লাবীবের কথায় পুষ্পের সেদিন রেস্টুরেন্টে বলা কথাটা মনে পড়ে গেলো। পুষ্পের মুখটা ছোট হয়ে যেতে দেখেই লাবীব হাসলো।
এদিকে আফিফকে লাবীবের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে রাদ আর আহি ভ্রূ কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। পদ্ম আফিফকে বার-বার আটকানোর চেষ্টা করছে। আহি বুঝতে পারলো আফিফ ভীষণ রেগে আছে। কিন্তু হঠাৎ তার রেগে যাওয়ার কারণ কি?

(***)

লাবীব বাইক থেকে নামতে যাবে তখনই পেছন থেকে গম্ভীর কন্ঠে আফিফ বলে উঠলো,
“ক্যাম্পাসের মতো সুন্দর পরিবেশে এমন অভদ্র ভাবে প্রবেশ করার কি খুব প্রয়োজন ছিল?”

লাবীব পেছন ফিরে আফিফের দিকে তাকিয়ে ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“এক্সকিউজ মি!”

“এটা বাইক স্টান্টের জায়গা নয়। এটা একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।”

“তো! আপনার সমস্যা কোথায়?”

“তোমার বাইকের ধোঁয়া অন্যদের বিরক্তির কারণ হয়েছে।”

“এই দেশে এতো ধোঁয়া উড়ছে, আর আপনি এসেছেন আমার বাইকের ধোঁয়া নিয়ে কথা বলতে।”

“ভদ্র ভাবে কথা বলো। বাইক আমাদেরও আছে। আমরা তো এভাবে চালাই না।”

“চালাতে জানলেই তো চালাবেন।”

রাদ লাবীবের উত্তর শুনে ভবনের পিলারে হেলান দিয়ে আয়েশ করে দাঁড়ালো। তার ঠোঁটে হাসি। আহি রাদের কাছে এসে বলল,
“রাদ, লাবীবকে গিয়ে থামা।”

রাদ চাপা স্বরে বলল,
“তোর আলগা পিরিত দেখাতে হবে না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে সিনেমা দেখ।”

আহি রাগী দৃষ্টিতে রাদের দিকে তাকালো। রাদ দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,
“আমার এই সিনেমা খুব ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে এই বছরের হিট সিনেমা হবে এটা।”

রাদ মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করে আহির হাতে দিয়ে বলল,
“যা পপকর্ন কিনে নিয়ে আয়। তারপর আমরা একসাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবো।”

আহি টাকাটা রাদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে লাবীবের সামনে এসে দাঁড়ালো। আফিফ লাবীবের অভদ্রতা দেখে আরো রেগে যাচ্ছিলো, তখনই আহি লাবীবকে বলল,
“তুই প্রথম দিনেই ঝামেলা করবি?”

লাবীব আফিফের দিকে আঙ্গুল তাক করে বলল,
“উনি আমাকে ভদ্রতার জ্ঞান দিচ্ছে, সেটা দেখছিস না?”

পুষ্প আফিফের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“ভাইয়া, আমরা দুঃখিত। ও আসলে বুঝে নি ব্যাপারটা। এতো বছর দেশের বাইরে ছিল। এসব ওখানে স্বাভাবিক। লাবীব পদ্মকে বিরক্ত করতে চাই নি।”

লাবীব আহির কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
“কে এটা!”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বলল, “পদ্মের হাসবেন্ড।”

“তোর ফ্রেন্ড, পদ্ম?”

“হ্যাঁ।”

লাবীব বাইক থেকে নামতে নামতে বলল,
“ওত্তেরি, আমি কি সবসময় ভুল সময়েই এন্ট্রি নেই না-কি? এখন হিরো সাজতে গিয়ে জিরো হয়ে যাবো না তো!”

“সরি বলে দে। ঝামেলা শেষ।”

লাবীব আফিফের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
“সরি শ্রদ্ধেয় দুলাভাই।”

লাবীবের সম্বোধনে পুষ্প অবাক হয়ে তার দিকে তাকালো। রাদ হাই তুলতে তুলতে বিড়বিড় করে বলল,
“আহিনি, এতো সুন্দর হিট হওয়া সিনেমাটাই তুই ফ্লপ করে দিলি। সব মজা এক নিমেষেই শেষ করে দিলি। ইচ্ছে করছে তোকে আর তোর নিরামিষ তেলোপোকাকে এখনই আমিষ হীন জাদুঘরে রেখে আসতে। ধুর, ভাল্লাগে না।”

এদিকে আফিফ লাবীবকে আর কিছু বললো না। লাবীব এবার পদ্মের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আরেহ, তুই তো আমাদের স্কুলের সেই টু’জি ডিভাইসটা! দেখেছিস, আমার মেমোরি খুব শার্প।”

পদ্ম লাবীবের সম্বোধনে ইতস্ততবোধ করতে লাগলো। সে একটু পর পর আফিফের দিকে তাকাচ্ছে। আহি বুঝতে পেরে লাবীবের হাত ধরলো। আফিফ ভ্রূ কুঁচকে সেই হাতের দিকে তাকালো। আহি তার নখগুলো দিয়ে লাবীবের হাতে আঁচড় দিয়ে তাকে চুপ করতে ইশারা করছিলো। কিন্তু লাবীব সেই ইশারা বুঝলো না। সে আহির হাত সরিয়ে দিয়ে পদ্মকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“পদ্ম, ইউর কিলিং আইজ।”

লাবীব এই কথা বলে বুকে হাত রাখলো। পদ্ম লজ্জায় মাথা নিচু করে নিলো। লাবীব এবার জিজ্ঞেস করলো,
“তো মিস. ভদ্রমহিলা, কেমন আছেন?”

পদ্ম হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। আফিফ পদ্মের হাত ধরে বলল,
“বাসায় চলো। দেরী হয়ে যাচ্ছে।”

পদ্ম মাথা নেড়ে আহি আর পুষ্পের দিকে তাকিয়ে মলিন হাসলো। এরপর আফিফের পিছু পিছু চলে গেলো। এদিকে রাদ এসব দেখে হাসছে। আফিফ আর পদ্ম চলে যেতেই পুষ্প রাগী দৃষ্টিতে লাবীবের দিকে তাকালো। লাবীব পুষ্পের চাহনি দেখে বলল,
“খেয়ে ফেলবে না-কি আমাকে?”

“তুমি কোথায় কি বলতে হয় জানো না?”

“আমি আবার কি করলাম?”

“পদ্মের হাসবেন্ডের সামনে অন্তত ভদ্রভাবে কথা বলতে পারতে।”

“আমি কি পদ্মের গালে চড় লাগিয়েছি না-কি!”

আহি লাবীবকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“লাবীব, মেয়েটা তোর কথায় অস্বস্তি বোধ করছিলো, তুই খেয়াল করিস নি?”

“অদ্ভুত তো! আমি এমন কি করলাম ভাই?”

রাদ লাবীবের কাছে এসে তার কাঁধে হাত রেখে বলল,
“ভীষণ ভালো করেছিস। আমি মজা পেয়েছি।”

আহি রাগী দৃষ্টিতে রাদের দিকে তাকালো। পুষ্প ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“তোমার মজা পাওয়ার কারণ কি? এমনিতেই পদ্মের সংসারে ঝামেলার শেষ নেই। এখন ভাইয়া যদি বিষয়টা নেগেটিভলি নেন? পদ্মের হাসবেন্ড একটু কন্সার্ভেটিভ। আর একদম সাদা মনের মানুষ। এসব জিনিস উনি সহজে নিবেন কি-না সন্দেহ!”

আহি অন্যমনস্ক হয়ে কিছু একটা ভেবে বলল,
“আচ্ছা, আমি বাসায় যাই। তোরা থাক। কাল অরিয়েন্টেশন প্রোগ্রামে দেখা হবে।”

রাদ কিছু বলতে যাবে তার আগেই আহি দ্রুত পায়ে চলে গেলো।

(***)

আহি ক্যাম্পাস গেট দিয়ে বেরিয়ে দেখলো আফিফ মোটর সাইকেলে চাবি ঘুরাচ্ছে। আহি দৌঁড়ে তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। আহিকে দেখে আফিফ ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। পদ্ম সিট থেকে নেমে আহির হাত ধরে বলল,
“কিছু বলবি?”

আহি পদ্মের হাত ধরে আফিফকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আপনি প্লিজ লাবীবের ব্যবহারে কিছু মনে করবেন না। স্পেশালি পদ্মকে ভুল বুঝবেন না। টু’জি ডিভাইস বলতে ও বুঝিয়েছে ক্লাসে পদ্ম অনেক দেরীতে লেখা শেষ করতো। আর ও ক্লাসে অনেক শান্ত ছিল। চুপচাপ থাকতো। তাই এমন বলেছে।”

আফিফ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“আমি পদ্মকে ভুল বুঝি নি। আমি এতোটাও ডোমিনেটিং নই।”

আহি হালকা হেসে পদ্মের কাছ থেকে বিদায় নিলো। পদ্ম যাওয়ার আগে বলল,
“আবার পালিয়ে যাস না কিন্তু। আমি কিন্তু আফিফ থেকে প্রতিদিন তোর খবর নেবো। এখন তো তুই উনার ক্লাসমেট।”

আফিফ পদ্মের কথা শুনে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে মোটর সাইকেলে চাবি ঘোরালো। আহি মলিন হেসে হাত নাড়িয়ে পদ্মকে বিদায় দিলো।

রাস্তার মোড়ে যতোক্ষণ আফিফের মোটর সাইকেলটি দেখা যাচ্ছিলো, আহি সেদিকেই তাকিয়ে ছিল। আফিফ আর পদ্ম চোখের আড়াল হতেই আহির চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। সে বুকে হাত দিয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো একজন নিঃস্ব পথিকের মতো। এদিকে দূর থেকে রাদ আহিকে দেখছে। সেও তখন আহির পিছু নিয়েছিল। আর যখন দেখলো আহি আফিফ আর পদ্মের সাথে কথা বলছে, তখন আর সামনে এগিয়ে যায় নি। রাদ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মনে মনে বললো,
“শুনেছি ছেলেদের উন্মাদ প্রেমে মেয়েরা ঘায়েল হয়ে যায়। আর এতো চমৎকার একটা মেয়ের এতো সুন্দর করে ভালোবাসতে পারাটা আপনাকে একটুও টানলো না, মিস্টার আফিফ? আপনি ভাগ্যবান হয়েও দুর্ভাগায় রয়ে গেলেন।”

২৯।

পদ্ম আর আফিফ বাসায় ঢুকতেই আফিফা বেগম নাক সিঁটকে বললেন,
“পড়তে গিয়েছিলি, না-কি বউ নিয়ে ঘুরতে গিয়েছিলি।”

আফিফ শান্ত ভঙ্গিতে ব্যাগটা টেবিলের উপর রেখে মায়ের দুই হাত আলতো করে স্পর্শ করলো। আফিফা বেগম ছেলের নিরব আর উষ্ণ ব্যবহারে আবেগী হয়ে গেলেন। হুট করেই তার চোখ জোড়া ছলছল করে উঠল। আফিফ মাকে সোফায় বসিয়ে মায়ের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
“মা, তোমার স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়েছিলাম। মাস্টার্সে ভর্তির বাকি টাকাটাও দিয়ে এসেছি। এক বছর পর তুমিও সবাইকে মিষ্টিমুখ করাতে পারবে।”

আফিফা বেগম পদ্মকে দেখিয়ে দিয়ে বললেন,
“বউকে ঘরে রেখে যেতে পারিস নি?”

“মা, এরপর আমরা ডাক্তারের কাছেও গিয়েছিলাম। ওকে তো যেতেই হতো।”

আফিফা বেগম উৎসুক কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
“ডাক্তার কি বললো? আমি দাদী হতে পারবো?”

পদ্ম শাশুড়ির উৎসুক মুখের দিকে তাকিয়ে মাথা নামিয়ে নিলো। আফিফ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“আমার সন্তান লাগবে না, মা। তুমি আর পদ্মই আমার সব।”

আফিফা বেগম ছেলের হাত সরিয়ে দিয়ে বললেন,
“এই অপয়াকে বাঁচাতে চাইছিস? কে সন্তান চাই না, বল? এই মেয়ে তোকে সুখ দিতে পারবে না। তুই আরেকটা বিয়ে করে নে।”

পদ্ম শাশুড়ির কথা শুনে মলিন মুখে নিজের ঘরে চলে গেলো। আফিফ এবার গম্ভীরমুখে বলল,
“আমি পদ্মকে ভালোবাসি, মা। ওর বর্তমানে আমি সেই জায়গা অন্য কাউকে দিতে পারবো না।”

“ভালোবাসলে বাস। তালাক দিতে বলি নি। দুই বউ নিয়ে সংসার করবি!”

“বাস্তবিক দিক দিয়ে আমি একটা সংসার চালাতেই হিমশিম খাচ্ছি। যেখানে আমার চাকরিটাও চলে গেছে। সেখানে আমি দুই জনকে চালাতে পারবো না। আর যদি আমার দিক দিয়েই চিন্তা করো, তাহলে আমি নিজেই একসাথে দুইজনকে সমান ভাবে ভালো রাখতে পারবো না। আমি পদ্মকে ভালোবাসি, মা। নতুন কাউকে সেই জায়গাটা এতো সহজে দিতে পারবো না আমি। আর তখন নতুন জনের সাথেই অন্যায় হবে।”

আফিফা বেগম করুন স্বরে বললেন,
“তুই আমার একমাত্র ছেলে। তোর যদি সন্তান না হয়, আমাকে দাদি বলে ডাকবে কে?”

“তুমি দাদি ডাক শোনার জন্য এমন করছো? আর যে মা ডাক শুনতে পারছে না, তার জন্য কষ্ট হচ্ছে না? তোমার আর আমার চেয়ে পদ্মের কষ্টটা অনেক বেশি। ও আমাকে ভালোবাসে, এই সংসারটাকে ভালোবাসে, তোমাকে ভালোবাসে। তুমি ওর সাথে এমন ব্যবহার করো না।”

আফিফা বেগম ছেলের কথায় দমে গেলেন। কিন্তু তার মন থেকে আফিফকে দ্বিতীয় বিয়ে করানোর সিদ্ধান্তটা এখনো গেলো না। ছেলে মানুষ যেকোনো সুন্দরী মেয়ে দেখলেই বিয়ে করতে আগ্রহী হবে। এখন তিনি মনে মনে ভাবছেন, ছেলের জন্য এবার তাকে সুন্দরী মেয়ে খুঁজতে হবে।

(***)

পদ্ম মেঝেতে বসে কাঁদছে। আফিফকে রুমে ঢুকতে দেখে পদ্ম চোখের পানি মুছে নিলো। আফিফ পদ্মের কাছে এসে পা গুটিয়ে তার সামনে বসে পড়লো। পদ্ম আফিফকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আমি তোমাকে অন্য কারো সাথে সহ্য করতে পারবো না। কিন্তু আমি চাই, তুমি বাবা হও। আমার দুর্বলতাগুলো আমি মেনে নিয়েছি। তুমি এবার বিয়ে করে নাও। কিন্তু আমাকে ছেড়ে দিও না। আমি এই বাড়ির এক কোণায় পড়ে থাকবো।”

আফিফ হালকা হেসে পদ্মকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
“পদ্মফুলকে ছেড়ে দেওয়া অসম্ভব। পদ্মফুল আমার জীবনে তখন এসেছিল, যখন আমি একদম নিঃস্ব ছিলাম। যখন মনে হয়েছিল, আমি কাউকে পাওয়ার যোগ্য নই। এমন একদিন পদ্মফুল তার লাজুক মুখখানা আমাকে দেখে আড়াল করেছিল। তার মিষ্টি হাসি আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, আমি এতোটাও অযোগ্য নই।”

আফিফের চোখ দু’টি ছলছল করে উঠলো। সে পদ্মকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে দেয়ালে লাগিয়ে রাখা চিত্রটির দিকে তাকালো। ধীরে ধীরে তার মন ভারী হয়ে যেতে লাগলো। সে নিজেও জানে না কেন এই ভার তাকে ঝেঁকে ধরেছে। তবে আজ তার মন কাঁদছে। কিন্তু অশ্রুগুলো অদৃশ্য।

(***)

অরিয়েন্টেশন প্রোগ্রামে বাদামি শার্ট আর কালো জিন্স পরে এসেছে আহি। আহিকে দেখতেও আজ ভীষণ আকর্ষণীয় লাগছে। যদিও আহি তার আজকের পোশাকে একদম সন্তুষ্ট নয়। শার্ট-জিন্স পরতে অভ্যস্ত হলেও সে যতোবারই শার্ট পরেছিল, তার উপরে জ্যাকেট বা কোট পরতো বা গলায় একটা স্কার্ফ থাকতো। কিন্তু আজ সে এসব ছাড়াই বের হয়েছে।স্কার্ফটি পর্যন্ত গলায় ঝুলাতে পারে নি সে। আহি যদিও সেলোয়ার-কামিজ তেমন একটা পরে না। কারণ রিজওয়ান কবির নিজেই চান না মেয়ে দেশীয় পোশাক পরুক। তিনি মনে করেন ওয়েস্টার্ন পোশাক পরলেই আহিকে বেশি স্মার্ট লাগবে। আর তার বেশভূষায় বোঝা যাবে সে দেশের প্রভাবশালীর মেয়ে। যদিও আহি বাবার এই চিন্তা ভাবনা একদমই পছন্দ করে না। কিন্তু প্রতিবাদ করার সাহসও পায় না। আর আহির আজকের পোশাকটি লাবণি মেহেরার ব্যক্তিগত সহকারী ঠিক করে দিয়েছে। মেয়েটির নাম সুনেহরাহ। প্রচুর গায়ে পড়া স্বভাব আছে মেয়েটির। লাবণির সামনেই রিজওয়ান কবিরের সাথে রসিয়ে রসিয়ে কথাবার্তা বলে। লাবণির এতে কোনো অভিযোগ নেই। কিন্তু আহি এসব দেখলেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। অন্যদিকে সুনেহরাহ আহিকে খুব পছন্দ করে। তার দৃষ্টিতে যেই মেয়েগুলো সুন্দর, তাকে সে নিজের মতো করে সাজিয়ে রাখতে পারবে। আহি এতোদিন দেশের বাইরে ছিল, তাই সুনেহরাহ তার এই ইচ্ছেটা পূরণ করতে পারে নি। কিন্তু যখন লাবণি তাকে ফোন দিয়ে জানিয়েছে, আহির আজ অরিয়েন্টেশন প্রোগ্রাম আছে, সে সাথে সাথেই সব কাজ ফেলে চলে এসেছে। আহি যদিও তাকে দেখে যথেষ্ট বিরক্ত হয়েছে। আর এসব আদিখ্যেতা তার ভালো লাগে না। সাধারণ একটা প্রোগ্রামের জন্য এতো আয়োজন করার কি আছে সে বুঝতে পারছে না। কিন্তু লাবণি এসব ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন। আহি একজন প্রভাবশালীর কন্যা। যদি কেউ তার ছবি তুলে রাখে? তাই অন্তত আহিকে আকর্ষণ করার মতো নিজেকে তৈরী করে বের হতে হবে। যদিও রিজওয়ান কবির যে আহির বাবা তা তেমন কেউ জানে না। এমনকি রিজওয়ান কবিরের মেয়ে সম্পর্কেও কোনো তথ্য কারো হাতে নেই।
বাবার জীবনে সে বইয়ের প্রথম পাতা মাত্র। যেখানে কোনো লেখা থাকে না। বিশেষ কারণ ছাড়া যেমন বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠায় পাঠকের অনুভূতি বা লেখকের শুভেচ্ছা স্বাক্ষর পড়ে না। ঠিক তেমনি রিজওয়ান কবিরও বিশেষ কারণ ছাড়া আহির সাথে কথা বলেন না বা তার ব্যাপারে মাথা ঘামান না। তবুও পাঠকের কাছে বইয়ের বাকি পৃষ্ঠাগুলোর মতো প্রথম শূন্য পাতাটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি রিজওয়ান কবিরের কাছে আহি সেই পাতা। যাকে তিনি নিজের মতো করেই রাখতে চান। নিজের মতোই তার সাথে ব্যবহার করেন। যা ইচ্ছে তার উপর চাপিয়ে দেন। যেমন আজ সুনেহরাহর কারণে স্কার্ফ ছাড়া তাকে বের হতে হয়েছে। আহি লাবণিকে কয়েকবার বলেছিল, সে অস্বস্তিবোধ করছে। কিন্তু তার কথাটা যেন কোনো মূল্যই পেলো না।

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||বোনাস পর্ব||

৩০।
আহি ক্যাম্পাসে ঢুকার পর থেকে খুব অস্বস্তিবোধ করছিল। নিজের পোশাক নিয়ে আত্মবিশ্বাস না থাকলে যে কাউকেই বেমানান লাগবে। আহিরও নিজেকে তেমনই মনে হচ্ছে। এদিকে প্রতিটা ডিপার্টমেন্টের অরিয়েন্টেশন আলাদা জায়গায় হচ্ছে। হয়তো পুষ্প, রাদ আর লাবীব তাদের প্রোগ্রামেই ব্যস্ত আছে।
আহি নিজের টোকেন দেখিয়ে অরিয়েন্টেশন প্রোগ্রামে ঢুকতে যাবে তখনই আফিফের মুখোমুখি হলো। সে অডিটোরিয়াম রুমের সামনেই দাঁড়ানো ছিলো। আহির চোখাচোখি হতেই সে চোখ নামিয়ে নিলো। আহি ভেতরে ঢুকতেই রাদের কল এলো। সে কল রিসিভ করার জন্য তার টোকেনটা ফেরত নিয়ে বলল,
“আমি একটু পর ঢুকবো।”

আহি এই বলে অডিটোরিয়াম রুমের বাইরে এসে রাদের কল রিসিভ করে বলল,
“রাদ, কোথায় তোরা?”

“আমি আর লাবীব একটু পর প্রোগ্রামে ঢুকবো। তুই কোথায় সেটা জানার জন্যই ফোন দিলাম।”

আহি আমতা-আমতা করে বলল,
“আসলে আমি না ঝামেলায় আছি। একটা হ্যাল্প করবি?”

রাদ উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল, “কি, কোনো সমস্যা হয়েছে?”

“তুই এদিকে আয় না একটু।”

রাদ ফোন রেখে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আহির ডিপার্টমেন্টে চলে এলো। দূর থেকে আহির হাবভাব দেখে রাদ আন্দাজ করে ফেলেছে সমস্যাটা কি! সে আহির সামনে দাঁড়িয়ে সাথে সাথেই বলল,
“উড়না ছিঁড়ে গেছে?”

আহি কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল,
“মিসেস লাবণি আমাকে জোর করে এভাবে পাঠিয়েছেন। গাড়িতেও উনি ছিলেন। নয়তো ড্রাইভারকে বলে একটা কিনে নিতাম। ভাই, আমার অস্বস্তি লাগছে।”

“ব্যাগে করেই নিয়ে আসতি।”

আহি তার হাতের ব্যাগটা উঠিয়ে রাদের সামনে ধরলো। রাদ ব্যাঙ্গ করে বলল,
“এই ব্যাগটা আর না আনলেও পারতি। আমি বুঝি না এতোটুকু একটা ব্যাগ নিয়ে বের হওয়ারই বা কি আছে? ফোনটা হাতে নিলেও হয়।”

আহি চোখ ছোট করে রাদের দিকে সেকেন্ড খানিক তাকিয়ে বলল,
” ব্যাগটাও সুনেহরাহর পছন্দের।”

রাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“তোর লাইফে এতো ভিলেন কেন, ভাই? আর তুই বোকা আমাকে একটা মেসেজ দিয়ে রাখতে পারতি। আমি আসার সময় কিনে নিয়ে আসতাম।”

আহি রাদের হাত ধরে বলল,
“আজকের দিনটাও আমার খারাপ করে দিয়েছে। আর কতো সহ্য করবো ওদের? ওরা আমাকে নিজেদের ইচ্ছেমতো নাচাচ্ছে। আমিও তো মানুষ! আমার কষ্ট হয়, রাদ। নিজের বাবাই যেখানে এমন, আমি আর মিসেস লাবণির আলাদাভাবে কি দোষ দেবো?”

রাদ নিজের ব্যাগ আহিকে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“এখন আর কি করার আছে? এসব কথা এই মুহূর্তে রাখ। এখন তুই এক কাজ কর। আমার ব্যাগটা ধর, আমি আসছি।”

রাদ আহিকে ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলো। এদিকে আহি মলিন মুখে এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে। আফিফ অডিটোরিয়াম থেকে বের হয়ে দেখলো আহি অন্যমনস্ক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে কোনো কথা না বলে আহিকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। আহি দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। রাদের কন্ঠ শুনেই সে চোখ খুললো। রাদ তার ব্যাগটা নিয়ে একটা কালো উড়না আহির গলায় ঝুলিয়ে দিলো।

আহি জিজ্ঞেস করলো, “কোথায় পেলি?”

“ভাগ্যিস ক্যাম্পাসের বাইরে একটা হিজাবের ভ্যান ছিল।”

আহি রাদের হাত ধরে বলল,
“তুই আমার সব রোগের মেডিসিন রে।”

(***)

আফিফ মায়ের সাথে ফোনে কথা বলে অডিটোরিয়ামের দিকে যেতে লাগলো। সে সামনে কয়েক পা এগিয়ে যেতেই দেখলো আহি আর রাদ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। আর আহি রাদের হাত ধরে রেখেছে। আফিফ তাদের দিকে সেকেন্ড খানিক তাকিয়েই তাদের পাশ কেটে চলে যেতে লাগলো। আহি আফিফকে যেতে দেখেই রাদকে বলল,
“আমিও যাই। এন্ড থ্যাংক ইউ সো মাচ, মাই মেডিসিন।”

রাদ আহির গাল টেনে দিয়ে বলল,
“তুই আমার একমাত্র মেয়ে বান্ধবী। তোর জন্য আমি সব করতে পারি। এখন যা।”

রাদ চলে যেতেই আহি অডিটোরিয়ামে ঢুকে গেলো। আফিফও তার সিটে এসে বসলো। এদিকে আহি দেখলো আফিফের পাশের সারিতেই একটা সিট খালি আছে। আহি একবার আফিফের দিকে তাকালো, আরেকবার খালি সিটটার দিকে। তারপর আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নিলো। আশেপাশে কোথাও সিট খালি নেই। পেছনের দিকে কয়েকটা খালি আছে। কিন্তু এই মুহূর্তে সামনে সিট পেয়েও এতো পেছনে গিয়ে বসাটা সুন্দর দেখাবে না। আর আফিফও বুঝে যাবে, আহি এখনো তার উপর দুর্বল। সে আর যাই হোক আফিফকে বুঝতে দেবে না। তাই সেই সিটেই বসে পড়লো আহি।

প্রোগ্রাম শুরু হয়ে গেছে। কেউ কেউ মনোযোগ দিয়ে অতিথিদের বক্তব্য শুনছে, আর কেউ কেউ নিজেদের মাঝেই ফিসফিস করছে। আর আহি পাথরের মতো বসে আছে। মনে হচ্ছে সে নিষ্প্রাণ। নয় বছর আগের সেই প্রথম দেখা, চারুশিল্পে একই সারিতে বসা, আফিফের দিকে তাকিয়ে থাকা, সবকিছুই চোখের সামনে ভেসে উঠছিলো আহির। এসব মনে পড়তেই চোখ দু’টি ছলছল করে উঠলো তার। একটু পর পর জোরে জোরে শ্বাস ছাড়ছে সে। এবার আফিফ আহির দিকে তাকালো। আহি সামনে তাকিয়ে থাকলেও আফিফের তার দিকে তাকানোটা খেয়াল করলো সে। ঝাপসা মুখটি স্পষ্টভাবে দেখার জন্য আহিও এবার পাশ ফিরলো। আর আফিফ সাথে সাথেই চোখ সরিয়ে নিলো। হঠাৎ আফিফ উঠে পেছনের সারিতে চলে গেলো। আহি বুঝতে পেরে দাঁত দিয়ে নিজের ঠোঁট চেপে ধরে তার কষ্টটা দমানোর চেষ্টা করলো। এই মুহূর্তে নিজের উপরই রাগ হচ্ছে তার। মনে হচ্ছে মনটাকে আটকানো এতো সহজ হবে না। সে নিজের বুকে হাত রেখে মনে মনে বলল,
“রিল্যাক্স আহি। রিল্যাক্স।”

আহি হঠাৎ খেয়াল করলো আফিফ তার একদম পাশে এসে বসেছে। পাশে বসা মেয়েটি আপনা-আপনি উঠে চলে যাচ্ছে। আহি সিটের হাতলে হাত রাখতেই আফিফ তার হাতটা ধরে মুচকি হাসি ফেরত দিলো। আহি সামনে তাকালো। আফিফ তার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
“প্রিয় অলকানন্দা, তোমাকে সুন্দর লাগছে আজ।”

আহি জানে এটা তার হ্যালুসিনেশন। এমন তার সাথে প্রায়ই হয়। সে তো অসুস্থ। সাধারণ মানুষ যেই অসুস্থতাকে পাগলামী বলে। আহি এমনই একজন পাগল প্রেমিকা, যার হুশ-জ্ঞান ঠিকই আছে, শুধু মিছেমিছি তার হারিয়ে ফেলা প্রেমিককে অনুভব করে, যে তার আশেপাশেও নেই।

(***)

অরিয়েন্টেশন প্রোগ্রাম শেষ হতেই আফিফ অডিটোরিয়াম থেকে বের হয়েই দেখলো আফিফা বেগম পদ্মকে নিয়ে তার ডিপার্টমেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। মাকে এখানে দেখে আফিফ রীতিমতো অবাক। সে নিচে নামতেই আফিফা বেগম বললেন,
“আফিফ, তোকে দেখতে এসেছি!”

আফিফ ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“মা, এখানে আসার কি দরকার ছিল? আমি তো বাসায় আসবোই।”

“জানি তো। এমনিতেই তোর ভার্সিটি দেখতে এসেছি। এখন তোর ক্লাসমেটদের সাথে পরিচয় করিয়ে দে না।”

পদ্ম মলিন মুখে আফিফের দিকে তাকালো। আফিফ মায়ের এমন আচরণে ভীষণ রেগে গেলো। কিন্তু সে আজ পর্যন্ত মায়ের সাথে উচ্চবাচ্য করে নি। তাই মুখ ঘুরিয়ে কপালে আঙ্গুল ঘষতে লাগলো। পদ্ম বুঝতে পারলো আফিফ রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। সে আফিফা বেগমকে বলল,
“মা, উনি আজই প্রথম এসেছেন। ক্লাসও শুরু হয় নি। হয়তো ধীরে ধীরে পরিচিত হবেন।”

তখনই আহি অডিটোরিয়াম থেকে বের হয়ে পদ্মকে দেখে দূর থেকে হাত নাড়লো। পদ্মও আহিকে দেখে ইশারা করলো। আফিফা বেগম পদ্মের দৃষ্টি অনুসরণ করে আহিকে দেখে বললেন,
“মেয়েটা কে?”

আফিফ মায়ের প্রশ্নে পেছন ফিরে আহিকে দেখে আরো ভড়কে গেলো। সে মায়ের হাত ধরে বলল,
“মা প্লিজ, তুমি চেয়েছো আমি পড়াশুনা শেষ করি। তাই তোমার জন্য মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছি। এখানে এমন কিছু করো না।”

“আরেহ, আমি কি করবো? আমি তো দেখতে এসেছি মাত্র।”

আফিফ মায়ের সাথে আর তর্কে জড়ালো না।
এদিকে আহি নিচে নামতেই পদ্ম আহির কাছে এসে বলল,
“কেমন আছিস?”

“ভালো। তোর কি অবস্থা?”

“হুম।”

পদ্মের মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো আহি। তখনই আফিফা বেগম বলে উঠলেন,
“কেমন আছো, মা?”

আহি সালাম দিয়ে বলল, “ভালো। আপনি?”

আফিফা বেগম সালামের উত্তর নিয়ে বললেন,
“আমিও ভালো।”

আহি একনজর আফিফের দিকে তাকালো। এই মানুষটার খবর নেওয়ার জন্যই কিছু বছর আগেও সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্র মহিলাকে ফোন করতো আহি। ভাবতেই কেমন যেন লাগছে তার। যদিও আফিফা বেগমের হাবভাব দেখে বোঝা যাচ্ছে, তিনি আহিকে চিনতে পারেন নি। চেনার কথাও নয়। সেই স্কুল পড়ুয়া মেয়েটির সাথে বর্তমান আহির কোনো মিলই নেই।

এদিকে আফিফ মাকে আটকানোর জন্য তার হাত ধরে তাকে নিয়ে যেতে চাইলে, তিনি আহিকে জিজ্ঞেস করলেন,
“তুমি পদ্মকে কীভাবে চেনো?”

“আমরা স্কুল ফ্রেন্ড।”

“আচ্ছা? তোমার বাবা-মা কি করেন?”

আহি সেকেন্ড খানিক আফিফা বেগমের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। শাশুড়ির এমন উদ্ভট আচরণে পদ্ম লজ্জায় নুইয়ে পড়ছে। আহি পদ্মের দিকে তাকালো। পদ্মকে এমন বিমর্ষ ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আহি আন্দাজ করতে পারলো ব্যাপারটা। কারণ পুষ্পের কাছেই সে পদ্মের শাশুড়ির স্বভাব সম্পর্কে শুনেছিলো। তাই আহি হাসি ফেরত দিয়ে বললো,
“বাবা ব্যবসা করেন। আর মা কি করেন জানি না।”

“সে কি, তোমার মা কি করেন, তুমিই জানো না?”

“মায়ের সাথে আমার যোগাযোগ নেই। আমার বাবা-মা অনেক আগেই আলাদা হয়ে গেছেন। আমি বাবা ও তার দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে থাকি। তবে বাবার বর্তমান স্ত্রী কিছুই করেন না। তিনি শুধু বাবার টাকাই খরচ করেন।”

আহির এমন উত্তরে পদ্ম অবাক হয়ে তার দিকে তাকালো। আফিফও ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে আছে। আফিফা বেগম বিষ্মিত মুখে বললেন,
“আহারে, তোমার খুব কষ্ট হয়, তাই না?”

“না। আমার ভালোই লাগে। আমি ইচ্ছেমতো বন্ধুদের সাথে ঘুরি, পার্টি করি। ওরা আমাকে যথেষ্ট ফ্রিডম দিয়েছে।”

আফিফা বেগম জোরপূর্বক হাসলেন। পদ্ম আহির হাত ধরে ইশারায় বলল, কি বলছিস এসব?

আহি মনে মনে বলল, “মিথ্যে তো আর বলি নি।”

আফিফা বেগম আবার বললেন,
“আচ্ছা, বিয়ে কবে করছো তুমি!”

আফিফ মায়ের দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। সে কিছু বলতে যাবে তার আগেই আহি প্রতিত্তোরে বলল,
“আন্টি, বিয়ে আর আমি? এক গ্লাস পানি নিয়েই খেতে পারি না। তবে পদ্মের মতো সংসারী হলে তো কথায় ছিলো না। আর বিয়ের সাথে দূর দূরান্তের বিচ্ছেদ।”

আফিফা বেগম হাসলেন। পদ্মও মুখ চেপে হাসলো। আহি যে তাকে বাঁচানোর জন্য এমন কথা বলছে সে বুঝতে পারলো। আফিফ এবার মায়ের হাত ধরে বলল,
“এখন চলো।”

তখনই রাদই তার ডিপার্টমেন্ট থেকে বের হয়ে আহির দিকে এগিয়ে এলো। রাদ কাছাকাছি আসার আগেই আহি নিজেই তার কাছে গিয়ে হুট করে তাকে জড়িয়ে ধরে চাপা স্বরে বলল,
“আমাকেও একটু জড়িয়ে ধর। পদ্মের শাশুড়ির সামনে বর্তমান জেনারেশানের একটা নমুনা দেখাই।”

রাদও আহিকে জড়িয়ে ধরলো। আফিফ আর পদ্ম অবাক হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। আফিফা বেগম চোখ ছোট করে তাকিয়ে আছেন। এরপর তিনি নিজেই বিড়বিড় কর‍তে করতে চলে গেলেন। আফিফও মায়ের পিছু নিলো। আফিফা বেগম বলতে লাগলেন,
“আজকাল মেয়ে-ছেলেদের লজ্জা বলতে কিছু নেই। বড়দের সামনেও কেউ এমন করে?

আফিফ মায়ের হাত ধরে বলল,
“তুমি এসবে কেন জড়াচ্ছ? মাথা থেকে আমাকে বিয়ে করানোর চিন্তাটা ফেলে দাও। আর এখানে এসে সবাইকে এমন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে, দেখা যাবে আমার পড়াশুনাটা এবারও থেমে যাবে।”

আফিফা বেগম ছেলের হাত ধরে বললেন,
“এভাবে বলছিস কেন? আর আসবো না আমি।”

আফিফ মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“রাগ করো না, মা।”

“তোর সাথে কি আমি রাগ করে থাকতে পারি, বল?”

(***)

আফিফা বেগম আর আফিফ চলে যেতেই আহি রাদকে ছেড়ে দিয়ে বলল,
“মাইন্ড করেছিস?”

রাদ বলল,
“এসবে ছেলেরা মাইন্ড করে না। খুশি হয়!”

আহি রাদের বাহুতে ঘুষি মেরে বলল,
“ফাজিল ছেলে।”

এরপর আহি পদ্মের কাছে এসে বলল,
“তোর শাশুড়ি এমন করছে কেন রে? এগুলো বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে।”

পদ্ম মলিন মুখে বলল,
“মা হতে পারবো না তাই। এটা হয়তো আমার কোনো কালের শাস্তি।”

“ডাক্তার দেখাস নি?”

“হুম, দেখিয়েছি। সমস্যাটা আমারই। ট্রিটমেন্ট করেও লাভ হচ্ছে না।”

“ভালো ডাক্তার দেখা।”

“ঢাকায় গিয়েছি। তাও কাজ হয় নি। আমি কখনোই সন্তান ধারণ করতে পারবো না। তাই আফিফকে আবার বিয়ে দেওয়ার কথাবার্তা চলছে।”

“তো! দ্বিতীয় বিয়ে কোনো সমাধান নয়। এখন অনেক পদ্ধতি আছে। চিকিৎসা সেবাও অনেক উন্নত হয়েছে। আইভিএফ পদ্ধতিও বাচ্চা নেওয়া যায়।”

“আহি, এসবে অনেক খরচ। এতো টাকা থাকলে তো অনেক আগেই আমরা বাবা-মা হয়ে যেতাম। আফিফের বেতন কম। কোনোভাবে আমাদের চলে যাই। এখন তো উনার চাকরিটাও চলে গেছে।”

“কেন? উনি ছবি আঁকে না এখন?”

পদ্ম মাথা নেড়ে বলল,
“বিয়ের পর থেকে কখনোই আঁকতে দেখি নি। বিয়ের পরই একটা চাকরি নিয়েছিলেন। পিয়নের চাকরি। উনার ছোট বোনের স্বামী অনেক বড়লোক। অনেক টাকার মালিক। সে-ই আফিফকে চাকরিটা দেয়। তারপর একদিন চাকরিটাও চলে যায়। কি হয়েছে জানি না। আমাকে বলে নি। তবে আমার ননদ আর শাশুড়ীর কাছ থেকে শুনেছিলাম, আমার ননদের স্বামীরও একজন বস ছিল, তিনিই না-কি আফিফকে বের করে দিয়েছিলেন।”

“কেন?”

“জানি না। আফিফ তো বলে নি আমাকে।”

“তুই চিন্তা করিস না। তোর শাশুড়িকে বোঝা, বল যে অন্য পদ্ধতিতেও তুই মা হতে পারবি। খরচ বেশি তাই সময় লাগছে। আর একদিন ঠিকই উনার ভালো জব হবে। তখন টাকা জমিয়ে তোদের স্বপ্ন পূরণ করিস। বিয়ে করতে দিস না। দ্বিতীয় স্ত্রীগুলো কখনোই ভালো হয় না।”

আহি কথাটি বলেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। হঠাৎই তার মায়ের কথা মনে পড়ে গেলো। পদ্ম চলে যেতেই আহি রাদকে বলল,
“তোদের বাড়ির পাশেই তো আমার নানার বাড়ি। তুই মায়ের খোঁজ নিয়ে আসবি, রাদ?”

রাদ আহির হাত ধরে বলল,
“তুই না বললেও আমি যেতাম। হাতে দুই সপ্তাহের ছুটি আছে। আমি বাড়িতে যাবো। অনেক বছর তো যাওয়া হয় নি।”

“আমাকেও নিয়ে যাবি?”

“তোকে যেতে দেবে?”

“ট্যুর বলে যাবো। পুষ্পের সাথে গেলে নিশ্চয় বাঁধা দেবে না।”

“তাহলে চল।”

আহির চোখে অশ্রু ভীড় করলো। সে কান্নাভেজা কন্ঠে বলল,
“মা আমাকে মনে রেখেছে তো!”

“মা কি তার সন্তানকে ভুলতে পারে?”

“আমার জন্য নানাভাইয়ের কোনো খবর নেই। নানু আমাকে পছন্দ করেন না। মামারাও করেন না হয়তো। আচ্ছা, ওরা যদি মাকে অন্য কোথাও বিয়ে দিয়ে দেয়?”

“কি বলিস এসব?”

“আজকাল তো মেয়েরাও দ্বিতীয় বিয়ে করে। মাও তো করতে পারেন। মায়ের বিয়ে হয়ে গেলে, আমাকে তো মা মেনেই নেবে না। বাবার কাছ থেকে পালাতে পারলে, আমি তখন কোথায় গিয়ে আশ্রয় নেবো? আমার মনে হয় না আমার কেউ আছে?”

“কেউ থাকুক না থাকুক, যতোক্ষণ আমি আছি তুই কখনো নিজেকে একা ভাবিস না।”

আহি হালকা হেসে অশ্রুগুলো আড়াল করে বলল,
“মেডিসিন একটা।”

রাদ আহির কথায় হাসলো। তারা দু’জনই ক্যাম্পাস থেকে বের হয়েই দেখলো তাজওয়ার গাড়ি নিয়ে ক্যাম্পাসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আহি রাদকে বলল,
“এই উটকো আপদটার চোখ ফাঁকি দেওয়ার কোনো উপায় আছে?”

আহি আর রাদ চোখ ফাঁকি দেওয়ার পরিকল্পনা করার আগেই তাজওয়ার আহির সামনে এসে দাঁড়ালো। আহি চোখ ছোট করে তাজওয়ারের দিকে তাকালো। তাজওয়ার হালকা হেসে রাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমার গর্জিয়াস লেডিকে শুধু আমার সাথেই মানায়। উড ইউ প্লিজ এক্সকিউজ আজ?”

রাদ আহির দিকে তাকালো। আহি রাদকে ইশারায় চলে যেতে বললো। রাদ চলে যেতেই আহি ভ্রূ কুঁচকে তাজওয়ারকে বলল,
“আমি তোমার কেউ নই। আমাকে বিরক্ত করবে না।”

“আমি যতোদিন বেঁচে আছি, তুমি তো আমারই। এই স্টেটমেন্ট আমি কখনোই তুলবো না।”

“তোমার মতো ক্যারেক্টরলেস ছেলেদের স্টেটমেন্টের কোনো বিশ্বাস নেই।”

“আমি ক্যারেক্টরলেস হতে পারি, কিন্তু তোমার ব্যাপারে আমি খুবই লয়াল। তোমার জন্য আমি সব ছেড়ে দিয়েছি।”

“ফার্জিয়াকেও?”

তাজওয়ার ফার্জিয়ার নাম শুনেই বিরক্ত হলো। সে হালকা রাগ দেখিয়ে বলল,
“আহি, প্লিজ। মেয়েটাই আমার পেছনে পড়ে ছিল। আর এখন ও আমাদের মাঝে আসবেই না। ওকে আমি কড়া ভাবে বলে দিয়েছি, তুমিই আমার সব।”

“আচ্ছা? কড়াভাবে বলেছো? না-কি তোমার বন্ধুদের দিয়েই সব কাজ করিয়েছো?”

তাজওয়ার আহির কথা শুনে চুপ হয়ে গেলো। আহি রাগী কন্ঠে বলল,
“তোমার বন্ধুদের দিয়েই তো ওকে তোমার পথ থেকে সরিয়েছো। এখন ভিডিও বানিয়ে ওকে ব্ল্যাকমেইল করছো। তোমার কড়া হওয়ার ডেফিনিশন দেখে আমি রীতিমতো অবাক হয়েছি। এটাকে যদি কড়া হওয়া বলে, তাহলে তোমার আর হিংস্র পশুর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আর এমন পশু একদিন আমাকেও সরানোর জন্য তার বন্ধুদের সাহায্য…..”

তাজওয়ার আহিকে থামিয়ে দিয়ে তার হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
“তুমি আর বাকিরা এক নও। তুমি আমার ছাড়া আর কারো হতে পারবে না।”

“আমাকে চ্যালেঞ্জ করো না। আমি তোমাকে বিয়ে না করার জন্য সব সীমা ছাড়িয়ে যাবো। তুমি তো আমাকে কখনোই পাবে না। মিস্টার খান, কিপ ইট ইন ইউর মাইন্ড।”

তাজওয়ার বাঁকা হেসে বলল,
“তুমি আমাকে চেনোই নি, আহি। যতোটুকু চিনেছো, আমি এর চেয়ে ভয়ংকর হতে পারি। কিন্তু আমি তোমার কোনো ক্ষতি করবো না। তবে তোমার আশেপাশে যারা আছে, তাদের কিছু হলে আমি দায়ী নই।”

চলবে-

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে