উধয়রনী পর্ব-১৬ এবং বোনাস পর্ব

0
351

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-১৬||

২৫।
উচ্চতর বিভাগের প্রথম সেশনে উঠেই আহি সিদ্ধান্ত নিলো আফিফের সামনে গিয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু হুট করে সামনে যাওয়ার সাহস পাচ্ছিলো না সে। আহি চাচ্ছে আফিফ নিজেই তাকে বলুক সামনে এসে দাঁড়াতে। শেষমেশ অনেক চিন্তা ভাবনার পর আহি চমৎকার একটা বুদ্ধি বের করলো। কাস্টমাইজড করা যায় এমন দোকানে গিয়ে তার পরিকল্পনাটা তাদের জানালো। তারাও আহির কথামতো তাকে একটা কার্ড বানিয়ে দিলো। অনেক সাহস নিয়ে সে পরের সপ্তাহের প্রথম দিনেই কার্ডটি আফিফের খাতার ভাঁজে রেখে দিলো।
আজ তার তিন বছরের এক তরফা ভালোবাসার একটা গতি হতে যাচ্ছে। ভাবতেই আহির হাত-পা আনন্দে কাঁপছিল। তবে আহিকে অবাক করে দিয়ে আফিফ সেদিন ক্লাসে আসে নি। পরের দিনও আফিফ আসে নি। তাই আহি তার কার্ডটা আবার নিজের ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলো। তারপর আফিফের কি হয়েছে তা জানার জন্য তার মহল্লায় গেলো। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখলো আফিফ যেই বাসায় থাকতো, সেখানে তালা দেওয়া। পাশে সাইনবোর্ড ঝুলছে, ঘর ভাড়া দেওয়া হবে। সাইনবোর্ডটা দেখেই আহির বুকটা কেঁপে উঠলো। সে কি তাহলে আফিফকে হারিয়ে ফেলেছে? আহি অনেকক্ষণ সেই বাসার নিচে দাঁড়িয়ে রইলো। হঠাৎ একজন মহিলাকে পাশের বাড়িতে ঢুকতে দেখে আহি জিজ্ঞেস করলো,
“আন্টি, আপনি কি জানেন এই বাসায় যারা ছিল, তারা কোথায় গেছে?”

মহিলাটি আহিকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বললেন,
“ওরা তো অন্য জায়গায় চইলা গেছে।”

“কোথায়?”

“সেইডা তো বলে নাই।”

“হঠাৎ বাসা ছেড়ে দিয়েছে কেন?”

মহিলাটি ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন,
“তুমি তাদের কি অও?”

“আমি আফিফের ক্লাসমেট। ও দু’দিন ধরে ক্লাসে আসে নি, তাই ওকে দেখতে এসেছি।”

“তাইলে তুমি ভেতরের খবরডা জানো না!”

আহি ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, “কি খবর?”

“ওরা তো আর এমনি এমনি যায় নাই। বলতে পারো, পালাইয়া গেছে।”

“পালিয়ে গেছে মানে?”

“চয়ন রে চেনো?”

“হ্যাঁ, আফিফের বড় বোন।”

“কেমনে মরছে জানো?”

“না।”

“গলায় দড়ি দিছিলো। হায় আল্লাহ গো, আফিফা আপার পোড়া কপাল! মাইয়াডা মইরা তারে বদনাম কইরা গেছে। কোন না কোন দোকানে চাকরি নিছিলো। ওই দোকানের মালিকরে কাউরে না কইয়া বিয়ে করছে। ওই মালিকের আবার আরেক বউ আছিলো। সেই বউ এখানে আইসা চুল ধইরা যে কি মাইরটাই না দিলো চয়ন রে। তারপর কি হইছে জানো নি? চয়নের ভিডিও একটাও ছাড়ছে। গ্রামের এক পোলার লগে চক্কর ছিল ওই মাইয়ার। মাইয়াডা সুবিধার ছিল না। সে তো চিল্লায় চিল্লায় কইতেছিলো, তার কোনো দোষ নাই। যে পোলার লগে প্রেম ছিল, সে না-কি তারে ধোঁকা দিয়া এমন করছে। আর ভিডিও কইরা ছাইড়া দিছে।”

আহি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মহিলাটি আক্ষেপের সুরে বললেন,
“আরেহ আফিফ পোলাডা বোনের সম্মান বাঁচাইবার জন্য পাগলের মতো দৌঁড়াইছে। টাকা দিয়া ভিডিওটা ওই শয়তান পোলাডার থেকে নিছে। ধার-কর্জ বহুত ছিল তাদের। এই কয়েক মাস আগেই ছোড মাইয়াডারে বিয়া দিয়া দিসে বড় ঘরে।”

আহি অবাক কন্ঠে বলল, “ও তো আফিফের ছোট।”

“হ। আফিফ তো চায় নাই। ওর মা দিয়া দিসে। টাকা নাই, পালবো কেমনে? এক বেলা খাইতে তাদের দুই বেলা খাটতে হয়। আর তারা তো আমগো মতো না। মাইনসের বাড়িত কাম করে খাই না। হাতও পাতে না। বাপ মরার পর অভাবে পইড়া গেছে। আর যাই কও, আফিফ পোলাডা বেশি ভালা।”

আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাসায় চলে এলো। বাসায় এসে আফিফের ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“এজন্যই কি তোমার চোখে-মুখে এতো বিষন্নতা ছেয়ে থাকে? এআর, আমি তোমার পাশে আছি। আমার জীবনটাই আমি তোমার নামে লিখে দিয়েছি। আমি তোমাকে এতো ভালোবাসবো যে তোমার অতীতের কিছুই আর মনে থাকবে না।”

এরপর আহি লিনাশাকে ফোন করে পুরো ঘটনা বললো। শুধু চয়নের সাথে কি হয়েছিল সেসব জানালো না। এদিকে সব শুনে লিনাশা বলল,
“চিন্তা করিস না। পরের সপ্তাহে ক্লাসে যায় কি-না দেখ। যদি না যায়, তাহলে স্যারের কাছ থেকে ফোন নম্বরটা নিবি। আর আফিফের মায়ের নম্বর তো আছেই!”

“লিনু, উনার নম্বর কয়েক মাস ধরে বন্ধ। ওই নম্বর খোলা থাকলে তো আমি চিন্তাই করতাম না।”

“এখন!”

“যদি পরের সপ্তাহে না আসে তাহলে স্যারের কাছ থেকে ওর ফোন নম্বরটা নিতে হবে।”

(***)

পরের সপ্তাহে আহি আবার আফিফের সেই খাতাটিতে কার্ডটি রেখে দিলো। আর আফিফ সেদিন আহির চিন্তার রেখা মুছে দিয়ে চারুশিল্পে এলো। প্রতিদিনের মতো আজও আফিফ তার খাতাটা যত্ন নিয়েই খুললো। কিন্তু আজ তো চিরকুট বা স্কেচ কিছুই রাখা নেই। রাখা আছে একটা সাদা রঙের কার্ড। আফিফ সেটা খুলতেই দেখলো ভেতরে লেখা,
“আমি আজ তোমার সামনে আসবো। কিন্তু তোমার অনুমতিতেই। ক্লাস শেষে মাঠে চলে যেও। আমি আশেপাশেই থাকবো। কার্ডে দু’টো বাটন দেখছো না? একটা কালো, আরেকটা সাদা! দু’টো বাটনেই দুই ধরণের উত্তর আছে। তুমি যদি চাও, আমি তোমার সামনে আসি। আমার সুপ্ত অনুভূতির কথা তোমাকে সামনা-সামনি এসে জানাই। তাহলে তোমার প্রিয় রংটিতে চাপ দেবে। আর যদি না চাও, তাহলে কালো বাটনে চাপ দেবে। কালো বাটনে চাপ দিলে আমি হয়তো আর তোমার সামনে এসে দাঁড়াতে পারবো না। অনেক সাহস নিয়েই তোমার সামনে দাঁড়ানোর চিন্তা করেছি। তোমার হ্যাঁ বা না আমার সাহস বাড়িয়ে বা কমিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।”

(***)

ক্লাস শেষ হতেই আফিফ মাঠে গিয়ে দাঁড়ালো। আহি গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে। সে আজ সাদা জিন্স-টপস পরেই এসেছে। সে জানে আফিফ সাদা বাটনেই চাপ দেবে। আফিফ চায়, আহি তার সামনে আসুক। তাই আহি তৈরী হয়েই এসেছে। সাথে আফিফের পছন্দের অলকানন্দা ফুলের চারা নিয়ে এসেছে। আহি চোখ বন্ধ করে আছে। সাদা বাটনে চাপ দিতেই বাজবে আহির প্রিয় গানের একটি লাইন।

“তুমি আর তো কারো নও শুধু আমার।”

আর কালো বাটনে চাপ দিলে শোনা যাবে আহির কন্ঠ। আফিফের প্রতিক্রিয়া দেখছে না আহি। সে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাত-পা কাঁপছে। এখন সেই গান তার কর্ণ গুহর স্পর্শ করলেই হয়তো সে নয়ন জোড়া খুলবে। এই গানটি শুনে শুধু তার শ্রবণেন্দ্রিয় সন্তুষ্ট হবে না, তার অস্থির মনটাও কিনারা খুঁজে পাবে। কিন্তু আহিকে অবাক করে দিয়ে আফিফ কালো বাটনে চাপ দিলো। কালো বাটনে চাপ দিতেই আহির কন্ঠ শুনতে পেলো আফিফ। আহি বলছে,
“আমি তবুও তোমাকে ভালোবাসা ছাড়বো না।”

আহি স্তব্ধ হয়ে গাছের আড়ালেই দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ জোড়া ভিজে যাচ্ছে। আফিফ কি তাহলে চায় না আহির ভালোবাসা? আফিফ কি তাকে দেখতে চায় না? আহি আড়ালের বাইরে এসে দেখলো মাঠের একপাশে বেঞ্চের উপর কার্ডটি রেখে আফিফ চলে যাচ্ছে। আহি নীরবে দাঁড়িয়ে আফিফের চলে যাওয়া দেখছে। কেন যেন তার মনে হচ্ছে, এটাই আফিফ আর তার ভালোবাসার দূরত্বের সূচনা। কিন্তু এই দূরত্ব আহি চায় না। সে আফিফকে ছাড়া কখনোই ভালো থাকবে না।
সেদিন আহি কার্ডটি নিয়ে বাসায় চলে এলো। বাসায় এসেই তার কান্না যেন ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছিল। আফিফের প্রত্যাখ্যান সে মেনে নিতে পারছিলো না। এতোটুকুতেই যদি আহির জীবনটা চলতো, তবুও হতো। কিন্তু সেদিন সে শুধু তার প্রিয় প্রেমিক পুরুষকে হারায় নি। সেদিন সে তার মাকেও হারিয়েছিল।

(***)

আফিফের হাত ধরার অধিকারটা আজ আফিফ তাকে দেয় নি। তাই সে আফিফের ভাস্কর্যটিকেই বুকের সাথে জড়িয়ে রেখেছে। হঠাৎ নিচ থেকে ভাংচুরের শব্দ শুনতেই আহির কান্না ক্ষণিকের জন্য থেমে গেলে। ওয়াশরুমে গিয়ে মুখ ধুয়ে নিচে নেমেই দেখলো রিজওয়ান কবির সালমা ফাওজিয়াকে জবানি তালাক দিয়ে দিয়েছেন। সালমা ফাওজিয়া স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। মুনিয়া খালা আহির কাছে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন। আহি জানে না এসব কি হচ্ছে! সাধারণ ঝগড়া হচ্ছে ভেবেই সে বাবাকে শান্ত করার জন্য গেলো। আর রিজওয়ান কবির সাথে সাথেই আহিকে সরিয়ে দিয়ে বললেন,
“তোমার মাকে আমি তালাক দিয়েছি। কাগজে কলমেও এই সম্পর্ক থেকে আমি মুক্তি পাবো। তোমার মাকে বলো, নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে যাতে এখনই এই বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়।”

সালমা ফাওজিয়া বললেন,
“আমার এই বাড়িতে থাকার কোনো ইচ্ছেও নেই। তবে আমি একা যাবো না। আহিও আমার সাথে যাবে।”

রিজওয়ান কবির তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন,
“আহিকে তুমি কখনোই পাবে না।”

বাবার কথার অর্থ সেদিন আহি না বুঝলেও এখন সে বুঝে। রিজওয়ান কবিরের কথায় সেদিন আহির প্রতি ভালোবাসা লুকোনো ছিল না। তিনি তো আহিকে বন্দী করেছেন নিজের স্বার্থে।

এরপর কয়েক মাসের মধ্যেই আহির বাবা-মায়ের আইনগতভাবে তালাক হয়ে যায়। সালমা ফাওজিয়া মায়ের বাড়িতে চলে যান। তিনি আহিকে আইনগত ভাবে পাওয়ার জন্য বড় বড় উকিলের সাহায্য নেন। আহির আঠারো হয়ে যাওয়ায় তার মতামতটাই গ্রহণযোগ্য ছিল। কিন্তু রিজওয়ান কবির কোনো সুযোগই ছাড়েন নি। তিনি আহিকে সময় দিয়ে তার মন জয় করার চেষ্টা করেন। সালমা ফাওজিয়ার নামেও অনেক উল্টোপাল্টা কথা মেয়েকে বুঝিয়েছেন। আহি জানে তার বাবা মিথ্যে কথা বলছে। সে তার বাবা-মা দু’জনকেই ভালোবাসে। কিন্তু সে মন থেকে মায়ের সাথেই থাকতে চায়। আদালতেও সে মায়ের সাথে থাকার ইচ্ছে পোষণ করেছে। রিজওয়ান কবির যখন দেখলেন, মেয়েকে তিনি নিজের দিকে করতে পারছেন না, তখন তিনি নিজের ভাঙা সংসারটি বড় বড় মন্ত্রীদের সামনে মেলে ধরলেন। আর এরপর বিদ্যুৎ গতিতে ঘটনা মিডিয়াতে ছড়িয়ে পড়লো। সালমা ফাওজিয়াকে প্রাক্তন স্বামীর কাছ থেকে দুশ্চরিত্রা উপাধী পেতে হলো। কিন্তু তবুও তিনি আহিকে পাওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলেন। শেষমেশ তাকে দমানোর জন্য সিরাজ খানের লোকেরা তার বাবাকে গুম করে ফেলে। এখন পর্যন্ত আহির নানার কোনো খবর পাওয়া যায় নি। এরপর আহির মামাকে মিথ্যে মামলায় ফাঁসিয়ে দেন সিরাজ খান। সালমা ফাওজিয়ার মা ছেলের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে মেয়ের পক্ষ থেকে সরে যান। তিনি নিজে গিয়েই রিজওয়ান কবিরের কাছে ক্ষমা চেয়ে ছেলের প্রাণ ভিক্ষা চান। রিজওয়ান কবির আহির মামাকে ছাড়িয়ে আনেন। বিনিময়ে লিখিতভাবে আহির কাস্টাডি পেয়ে যান। এই প্রতিযোগিতার শহরে যেখানে টাকা ছাড়া একদিনও চলা যায় না, সেখানে আহি মাত্র কলেজ ছাত্রী। সে বাবাকে ছাড়লে তার ভবিষ্যৎ অন্ধকার। মায়ের কাছে যাওয়ারও কোনো পথ নেই। তাই বাধ্য হয়েই তাকে বাবার সাথেই থেকে যেতে হয়েছে। রিজওয়ান কবিরও মেয়ের প্রতি যথেষ্ট নরম ছিলেন৷ তাহলে শুধু শুধু আহি কেন বাবাকে ছেড়ে যাবে? কিন্তু আহি জানতো না এটা তার বাবার একটা পরিকল্পনা ছিল।

এদিকে চারুশিল্পের উচ্চতর বিভাগের প্রথম সেশনের পরীক্ষাগুলো তেমন একটা ভালো হয় নি আহির। বাবা-মার ঝামেলায় সে কয়েক মাস ছবি আঁকা বন্ধ রেখেছিল। ফলাফল স্বরূপ আফিফ দ্বিতীয় সেশনে উঠে যায়, আর আহি তাকে দ্বিতীয়বারের মতো হারিয়ে ফেলে। কিন্তু আহি তবুও থেমে যায় নি। সে আফিফের নতুন বাসাটিও খুঁজে নেয়। আফিফের ভার্সিটির ঠিকানাও পেয়ে যায়। এরপর থেকে প্রায়ই কলেজ শেষে আহি আফিফের ভার্সিটির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। আড়ালে দাঁড়িয়ে আফিফকে দেখতো। আর বাসায় এসে তার অনুভূতির কথা সেই ডায়েরীতে লিখতো। আর একা একাই ভাস্কর্যটির সাথে কথা বলতো। এভাবেই নীরব ভালোবাসায় আহির দিনগুলো কাটছিলো।

…………………………….

মলিন মুখে নিজের কাপড় ভাঁজ করছে পদ্ম। ভেতর থেকে তার শাশুড়ি চেঁচিয়ে যাচ্ছেন।

“মুখপুরি মেয়েটা মাথা খেয়েছে আমার ছেলের। ছেলেটা আমার সারাদিন শুধু বউ বউ করে। এই অপয়া মেয়ের জন্য আমার ছেলেটা পড়াশুনা শেষ করতে পারে নি। আমার ছেলের বন্ধুরা সব পড়াশুনা শেষ করে বাইরের দেশে চলে গেছে।”

পদ্ম নীরবে চোখের জল মুছছে। তার শাশুড়ি মা যখন জানতে পারলো সে কোনোদিন মা হতে পারবে না, সেদিন থেকেই সে তার শাশুড়ী মার চক্ষুশূল। বিয়ের পর থেকেই কোনো এক অজানা কারণে পদ্মের শাশুড়ি তাকে দেখতে পারেন না। পদ্ম তার স্বামীকে অনেক বার জিজ্ঞেস করেছিলো, কেন তার উপর এতো ক্ষীপ্ত থাকেন তিনি। কিন্তু পদ্মের স্বামী কোনো উত্তর দিতে পারে নি। বরং সে উত্তরে শুধু তার স্ত্রীর কপালে অধর স্পর্শ করে বলেছিল,
“আমার ভালোবাসা কি তোমার জন্য যথেষ্ট নয়?”

পদ্মের শাশুড়ি ঘরে ঢুকে বললেন,
“যাদুকরী মেয়ে, নতুন বউয়ের মতো দিন-রাত ঘরে বসে না থেকে, রান্নাটা চুলায় বসিয়ে দাও গিয়ে। না-কি আমাকেই তোমাকে রেঁধে খাওয়াতে হবে?”

পদ্ম মাথা নেড়ে বলল,
“মা, আপনি বিশ্রাম নিন। আমি আসছি।”

“বিশ্রাম! মৃত্যুর সময় হয়ে গেছে, তাও শান্তিতে মরতে দিচ্ছো না। একমাত্র ছেলে আমার! একটা সন্তান দেওয়ার ক্ষমতা নেই তোমার! যাদুকরী তুমি। মাথা খেয়ে নিচ্ছো ওর।”

“মা, উনি তো বলেছেন আপনার স্বপ্ন পূরণ করবেন।”

“চুপ করো তুমি। যাও রান্নাঘরে। কাজগুলো সব পড়ে আছে। আর আমার ছেলে আসলে কিন্তু ওকে মেয়ে দু’টোর ছবি দেখিয়েছি না, ওদের ব্যাপারে ভাবতে বলবে। পুরুষ মানুষ ঘরে দু’টো বউ রাখতে পারে। আমার ছেলের সন্তান হলে তোমাকেও মা বলে ডাকবে। মাথায় রেখো কিন্তু।”

শাশুড়ীর কথায় পদ্মের চোখ ভিজে গেলো। পদ্মের শাশুড়ি সেই অশ্রু দেখে মুখ বাঁকিয়ে চলে গেলেন। পদ্ম রান্নাঘরে গিয়ে চুলায় ভাত বসাতেই তার ফোনে কল এলো। স্ক্রিনে প্রিয় মানুষটির নাম দেখে তার মলিন মুখে হাসি ফুটে উঠলো। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে মিষ্টি সুরে তার প্রিয় মানুষটি বলল,
“পদ্মফুল, কি করছো?”

“রান্না করছি। আপনি কবে ফিরবেন?”

“আজ ফিরতে রাত হবে। শোনো, তুমি মায়ের কথায় রাগ করো না।”

“আপনি কীভাবে বুঝলেন?”

“আমার পদ্মফুলের ভেজা কন্ঠই আমাকে জানিয়ে দিয়েছে।”

“তাড়াতাড়ি আসবেন। আপনার জন্য ইলিশ ভাজা করে রাখছি।”

কথা বলা শেষ হতেই পদ্ম ফোনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। তার ফোনের স্ক্রিনে তার বান্ধবীদের ছবি। আহি, লিনাশা আর পুষ্পের সাথে তার তোলা শেষ ছবিটা এখনো তার ফোনের ওয়ালে শোভা পায়। পদ্ম ছবিটিতে আলতো হাত রেখে বলল,
“তোরা থাকলে আমার জীবনে এতো বিষন্নতা থাকতো না। কতো বছর তোদের সাথে দেখা হয় না। কতো বছর হয়ে গেছে, তোদের ছুঁয়ে দেখতে পারি না। পুরোনো দিনগুলোই সুন্দর ছিল। যদি বাকি পড়াশুনাটাও করতে পারতাম, তোদের সাথে ঠিকই যোগাযোগ রাখতে পারতাম। এখন কোথায় তোরা, আর কোথায় আমি। তবে বরটা আমি ভালোই পেয়েছি। আমাকে অনেক ভালোবাসে। আমি হয়তো তার ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য নই। কিন্তু সে আমাকে বুঝতেই দেয় না সেটা। আহি, লিনু, পুষ্প আমি তোদের হারিয়ে একটা নতুন বন্ধু পেয়েছি। কিন্তু তোদের জায়গা কি কেউ নিতে পারবে, বল? ভীষণ ভালোবাসি তোদের।”

(***)

আহি ফোন হাতে নিয়ে বসে আছে। আজ কোনো কারণ ছাড়াই আফিফের টাইমলাইনে ঢুকলো সে। কতো শত স্ট্যাটাস আর ছবি সে ছেড়েছে। কিন্তু আহি গত চার বছরে একবারো তাকে দেখার জন্য ঢুকে নি। সেই যে বর্ষার রাতে তাকে শেষবার দেখলো, আর দ্বিতীয়বার দেখার সাহস তার নেই। কিন্তু চার বছর আগে এই টাইম লাইনটিতেই আহি প্রতিদিন ঢুকতো। আফিফের দেওয়া প্রতিটা স্ট্যাটাস, শেয়ার করা পোস্ট, আফিফের আপলোড করা ছবি আহি দিনে কয়েকশো বার করে দেখতো। মন না ভরলে, সেই আপলোড দেওয়া ছবিগুলো স্কেচ করে রাখতো, আর যেই স্ট্যাটাসগুলো বেশি ভালো লাগতো সেগুলো স্ক্রিনশট নিয়ে প্রিন্ট করে বের করে দেয়ালিকা তৈরী করতো। দেয়ালিকাটা এখনো তার ঘরের একপাশে জীর্ণশীর্ণ হয়ে পড়ে আছে।
আহি কিছুক্ষণ আফিফের টাইম লাইন ঘেঁটে মাথাটা বিছানায় ফেলে দিলো। সেই ভয়ংকর দিনটির কথা মনে পড়লেই তার শরীরটা নিথর হয়ে আসে। কিন্তু আজ বার-বার সেই মুহূর্তটি তার চোখের সামনে ভেসে আসছে।

……………………….

আহিদের ইন্টার পরীক্ষা শেষ হয়েছে অনেক আগেই। সবাই ভার্সিটিতে ভর্তির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। আর আহি ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হওয়ার পরিকল্পনা করছে। কারণ আফিফও সেই বিভাগেই পড়ছে। আফিফ যা-ই করবে আহিও ঠিক তা-ই করতে পছন্দ করে। এই কয়েক বছরে আফিফের পছন্দই তার পছন্দ হয়ে গেছে। মানুষটাকে স্পর্শ না করেই তার হৃদয়ের প্রতিটি স্পন্দন অনুভব করতে পারে আহি।
দিনটি ছিল আষাঢ়ের মাঝামাঝির বৈরী বেলা। আকাশে ছিলো কালো মেঘের ছোটাছুটি। লিনাশা, আহি আর পুষ্প ভর্তি কোচিং করে সবেমাত্র বের হয়েছে। হঠাৎ লিনাশার নম্বরে পদ্মের কল এলো। লিনাশা কল ধরতেই পদ্ম বলল,
“তোদের সাথে জরুরি কথা আছে। কোথায় তোরা?”

লিনাশা বলল, “আমরা তিনজন একসাথেই আছি।”

“আমি আসছি। কোন জায়গায় আছিস!”

“কি এমন কথা বলবি? ভয় লাগছে আমার।”

“আরেহ না। আগে আসি, তারপর বলছি। এখন কোথায় আসবো সেটা তো বল।”

“চকবাজারেই আছি। চলে আয়। সৈয়দ সেন্টারে উঠে যাচ্ছি আমরা। তুই ওখানেই আসিস।”

প্রায় বিশ মিনিট পর পদ্ম সেখানে চলে এলো। পদ্মকে দেখে সবাই ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। পুষ্প পদ্মের জন্য জায়গা ছেড়ে দিয়ে অন্য চেয়ারে বসলো। পদ্ম বসেই সবার দিকে একবার একবার তাকিয়ে বলল,
“আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে।”

আহি, লিনাশা আর পুষ্প চেঁচিয়ে বলে উঠলো, “সত্যি?”

“হুম।”

পুষ্প পদ্মের হাত ঝাঁকিয়ে বলল, “দুলাভাই কি করেন?”

“এখনো পড়াশুনা করছে।”

লিনাশা ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“বেকার ছেলেকে বিয়ে করছিস?”

“উনি আসলে আমাকে বিয়ে করে নিতে চাচ্ছেন।”

আহি গালে হাত দিয়ে বলল,
“তোর উনিটা কে শুনি!”

“আছে একজন।”

“তার মানে তুই লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করেছিস?”

“লুকিয়ে প্রেম করি নি। সব হুট করেই হয়ে গেছে।আমাদের অনেক আগে থেকেই পরিচয় ছিল। উনি আমাদের পাশের বাসায় থাকেন। ছাদে গেলে মাঝেমাঝে আমাদের দেখা হতো। ওভাবেই পরিচয় হলো। আর উনি আমাকে পছন্দও করতেন। তারপর আমাকে জানানোর পর আমি আপুকে বলেছিলাম। তোরা তো জানিস, বাবা আমাকে পড়াতে পারবেন না।আমাদের পারিবারিক অবস্থা ওতোটাও ভালো না। আপুকে যখন বলেছি, আমার উনাকে ভালো লাগে। আপু বাবা-মাকে রাজি করিয়ে ফেলেছে। এরপর উনি বাসায় প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন। এখন আমার বিয়ে আগামী মাসের শুরুতে।”

লিনাশা আর পুষ্প চেঁচিয়ে বলল,
“আগামী মাসে ঢাকায় আমাদের পরীক্ষা।”

আহি মুচকি হেসে বলল,
“বাহ, আমার জন্য কিন্তু ভালোই হয়েছে। আমার কোনো পরীক্ষা নেই। আমি চট্টগ্রামেই আছি।”

পদ্ম আহির হাত ধরে বলল, “তুই আসিস তাহলে।”

“হুম, অবশ্যই। আমার বান্ধবীর বিয়ে, আর আমি আসবো না, তা কি হয়? তোর বিয়েতে সবুজ লেহেঙ্গা পরে আসবো।”

পদ্ম হেসে বলল,
“বিয়ে কিন্তু গ্রামে হবে। অনুমতি পাবি তো?”

“অবশ্যই। বাবা আমাকে যথেষ্ট ফ্রিডম দিয়েছে। আমি আসবোই।”

এবার পুষ্প বলল,
“কিন্তু ছেলেটা তোকে খাওয়াবে কি? আর এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে চাচ্ছে কেন?”

“উনি ভালো ছবি আঁকতে পারেন। ছবি বিক্রি করেই উনি অনেক টাকা পান।”

আহি ভাবুক মনে পদ্মের দিকে তাকালো। পদ্ম উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“বিয়ের কার্ড এখনো ছাপানো হয় নি। তোরা আসিস তবুও। তোদের সাথে আর ফর্মালিটি কীসের! এখন আমার ননদ আসবে একটু পর। ও আমাকে নিয়ে বিয়ের বাজার কর‍তে যাবে। আমি যাই তাহলে। তোরা আসবি কিন্তু। বাই।”

পদ্ম চলে যেতেই আহি অন্যমনস্ক হয়ে গেলো। লিনাশার ঝাঁকুনিতেই আহি নড়েচড়ে বসলো।
সেদিন বাসায় ফেরার পর থেকেই আহির অস্থিরতা কাটে নি। প্রতিদিন সে আফিফের টাইমলাইন ঘুরে দেখেছে। আর নিজেকে বুঝিয়েছে, পদ্ম হয়তো অন্য কারো কথা বলছে। আফিফ তো জানে কেউ একজন তাকে ভীষণ ভালোবাসে। তাহলে সে কেন অন্য কাউকে পছন্দ করতে যাবে?

(***)

শ্রাবণের বারিধারায় রাস্তাঘাট মুক্তো দানার মতো চিকচিক করছে। তিন ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে আহি পদ্মের বাড়িতে পৌঁছালো। আজই পদ্মের বিয়ে। সন্ধ্যায় তাদের আক্দ হবে। আর রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর পদ্মকে উঠিয়ে দেবে। গ্রামের রাস্তাঘাট বর্ষার মাসে যে কি পরিমাণ অচল, তা আহি আজ না এলে বুঝতোই না। ড্রাইভার গাড়ি থেকে নেমেই বলল, গাড়ি আর ভেতরে নেওয়া সম্ভব না। তাই আহি গাড়ি থেকে নেমেই ড্রাইভারকে চলে যেতে বললো। আজ সে পদ্মের বাড়িতেই থাকবে। সন্ধ্যা হয়েই গেছে। এতোক্ষণে পদ্মের আক্দ হয়ে যাওয়ার কথা। আহি যদি আগে জানতো এখানে পৌঁছাতে তার অনেক সময় লাগবে তাহলে সকালেই বাসা থেকে বের হয়ে যেতো।

(***)

পদ্মের বাড়িতে ঢুকতেই পদ্মের বড় আপু আহিকে ভেতরে নিয়ে গেলেন। পদ্মকে দেখে আহি গালে হাত দিয়ে বলল,
“বাব্বাহ, আমাদের বউটাকে তো সে-ই লাগছে।”

পদ্ম লাজুক হেসে আহির হাত ধরে বলল,
“আমার কিন্তু খুব ভয় লাগছে, আহি।”

“যাকে ভালোবাসিস তার সাথেই বিয়ে হচ্ছে। ভয় পাওয়ার কি আছে? ভালোবাসার মানুষকে কাছে পাওয়ার মতো সুখের অনুভূতি দ্বিতীয়টা হয় না।”

“হুম, আমি আর আমার বর তোর আর তোর এআরের বিয়েতে আসবো।”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমাদের মতো আমাদের বরদের মধ্যেও যদি বন্ধুত্ব হয়ে যায়, তাহলে সে-ই হবে।”

পদ্ম মুচকি হাসলো। তারা দু’জন অনেকক্ষণ গল্প করলো। তারা জানতোও না এটাই তাদের শেষ কথোপকথন ছিল। হঠাৎ পদ্মের মা পদ্মের ঘরে এসে বললেন,
“পদ্ম, তোর বর এসেছে।”

পদ্ম শাড়ি গুছিয়ে নিয়ে আহির হাত ধরে বলল,
“তুই সহ যাবি কিন্তু।”

“আমি গিয়ে কি করবো?”

“আমার লজ্জা লাগছে তো ভাই।”

“প্রেম করার সময় তো আর লজ্জা পাস নি!”

“ধুর আহি।”

আহি পদ্মের হাত ধরে বলল,
“আগে দুলাভাইকে বল সেলামি দিতে। নয়তো এই হাত আমি তার হাতে তুলে দেবো না।”

পদ্মের কাজিনরা আহির কথায় হাসতে লাগলো। তখনই পদ্মের রুমে সাদা শেরওয়ানী পরা এক যুবকের প্রবেশ ঘটলো। পদ্ম আহির হাত ঝাঁকিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“আহি, তুই নিজেই সালামি খুঁজে নিস।”

আহির হাত আলগা হয়ে এলো। সে স্থির দৃষ্টিতে সামনে থাকা মানুষটিকে দেখছে। কি হচ্ছে এসব? কি দেখছে সে? আফিফ পদ্মের বর?

আহি অস্ফুটস্বরে বলে উঠলো, “অসম্ভব!”

পদ্ম আহির হাতটা শক্ত করে ধরে বলল,
“আহি, আমার হাত ছাড়িস না। আমি পড়ে যাবো। শাড়িটা বেশ ভারী।”

আহি শক্ত করে পদ্মের হাতটা ধরলো। আফিফ পদ্মের দিকে হাত এগিয়ে দিয়ে মুচকি হেসে বলল,
“পদ্মফুল, তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে।”

আফিফের কথা শুনে আহির বুকটা ভেতর থেকেই চুরমার হয়ে যাচ্ছে। অশ্রুগুলো বরফের মতো চোখের কোণে জমে আছে। কিন্তু তারা ঝরে যেতে পারছে না।

আফিফ পদ্মের হাত ধরে তাকে নিয়ে বিয়ের আসনে গিয়ে বসালো। আহিও ঘোরের মধ্যে হাঁটছে। বিয়ের স্টেজে উঠতেই পদ্ম আফিফকে চাপা স্বরে বলল,
“আমার ফ্রেন্ড, আহি।”

আফিফ এতোক্ষণ পর আহির দিকে তাকালো। আহিকে দেখেই আফিফ ভ্রূ কুঁচকালো। আহি নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ তুলে মানুষটাকে দেখার সাহস নেই তার। সে তো আর আহির মানুষ না। সে এখন পদ্মের প্রিয় মানুষ। আফিফ আহির দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে পারলো না। মেয়েটাকে সে চারুশিল্পে দেখেছিলো। এর চেয়ে বেশি পরিচয় সে জানে না। আহির চোখের অশ্রুগুলো আর বাঁধা মানলো না। টুপ করে গড়িয়ে পড়তেই আহি মলিন মুখে আফিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমার বান্ধবীর খেয়াল রাখবেন। ও অনেক মিষ্টি একটা মেয়ে।”

আফিফ মুচকি হেসে বলল,
“জানি, মিষ্টি মেয়ে দেখেই তো আমার মনে জায়গা করে নিয়েছে।”

আহি দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে হাসলো। পদ্ম আহির হাত ধরে বলল,
“কাঁদছিস কেন?”

“হয়তো আমাদের আর দেখা হবে না।”

“কেন দেখা হবে না? আমাদের চারজনের বরদের বন্ধুত্ব হওয়া এখনো বাকি। তোর এআরের সাথে আমার বরের বন্ধুত্ব করিয়ে দেবো না!”

পদ্মের কথায় আফিফ চমকে উঠলো। সে অবাক দৃষ্টিতে আহির দিকে তাকালো। আহি পদ্মকে বলল,
“এআর আমার কল্পনা। যার আর কোনো অস্তিত্ব নেই। তুই ভালো থাকিস শুধু।”

আহি পদ্মকে স্টেজে রেখেই নেমে গেলো। এলোমেলো ভাবে সামনে হেঁটে যেতেই পদ্মের মা তার হাত ধরে বললেন,
“চলো আহি। তোমাকে খেতে বসিয়ে দেই।”

আহি পদ্মের মায়ের পিছু পিছু চলে গেলো। পদ্মের বড় আপু আহির প্লেটে এটা-ওটা বেড়ে দিচ্ছেন। আহির খাবারগুলো দেখেই বমি আসছে। সবই তার পছন্দের খাবার। কিন্তু যেখানে আফিফ তাকে এতো বড় সারপ্রাইজ দিয়ে পেট ভরিয়ে দিয়েছে, সেখানে এই খাবার গলা দিয়ে নামার প্রশ্নই আসে না। তবুও আহি খাচ্ছে। তার প্রিয় মানুষ আর তার প্রিয় বান্ধবীর বিয়ের ভোজন সে করেই যাবে। আহিকে কাঁদতে কাঁদতে খেতে দেখে পদ্মের মা বললেন,
“কি রে, কাঁদছো কেন আহি?”

আহি কাঁপা কন্ঠে বললো,
“আন্টি, আমি বেশি ঝাল খেতে পারি না।”

“আচ্ছা, তাহলে যাও। মুখ ধুয়ে আসো। আহারে, ঝালে মেয়েটার চোখ-মুখ ফুলে গেছে।”

আহি কোনোমতে ওয়াশরুমে গিয়ে গলগল করে সব বের করে দিলো। শরীরে কোনো শক্তিই তার অবশিষ্ট নেই। অনেকক্ষণ ওয়াশরুমের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে ছিল সে। ইচ্ছে করছে এখনই পদ্মকে গিয়ে বলতে, আফিফ শুধু তার। আর কারো না। আবার আফিফের মুখে পদ্মফুল সম্বোধনের কথাটা মনে পড়তেই তার বুক ফেটে যেতে লাগলো। দেয়ালে কিছুক্ষণ মাথা ঠুকেও কষ্ট কমলো না আহির। ড্রাইভারকেও চলে যেতে বলেছে। এখন এই তিন ঘন্টার পথ সে কীভাবে পার করবে। বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি। আহির মনে হচ্ছে, আজই হয়তো তার মৃত্যু হবে। এই যন্ত্রণা তো মৃত্যুর চেয়ে ভয়ংকর। এর চেয়ে ভালো এখনই সে মরে যাক।

(***)

প্রায় ঘন্টাখানেক পর আহি ওয়াশরুম থেকে বের হলো। ক্লাবে বিয়ে হচ্ছে না। পদ্মের চাচার বাসার নিচ তলার গ্যারেজে বিয়েটা হচ্ছে। খুব সাদামাটা বিয়ে। এটাই যেন এই এলাকার জন্য জমকালো।
আহি আয়নায় নিজেকে একবার দেখে নিলো। কি কমতি ছিল তার? পদ্মের চেয়ে সুন্দর আহি। এমনকি সে যথেষ্ট আকর্ষণীয় আর স্মার্ট। তাজওয়ারের মতো ছেলে আহির পেছনে ঘুরঘুর করছে। তাহলে আফিফ কি একবারো তাকে দেখলো না? কেন দেখলো না? আহি নিজেকেই প্রশ্ন করছে। ইচ্ছে করছে পদ্ম হয়ে যেতে। পদ্ম হয়ে যদি আফিফকে পাওয়া যেতো!

পদ্মের বাবা আফিফের হাতে পদ্মকে তুলে দিলেন। পদ্মের বিদায়ের সময় ঘনিয়ে এলো। আপন মানুষগুলোর গলা জড়িয়ে কাঁদছে সে। আফিফ নিচে নেমে দাঁড়িয়েছে।

(***)

আহির হঠাৎ কি হলো সে নিজেও জানে না, এতোটুকুই জানে আজ সে আফিফকে তার মনের কথা জানিয়েই ছাড়বে। অনুমতি ব্যতীত আজ সে তার ভালোবাসা প্রকাশ করবো। নয়তো এই কথা মনে পুষে রাখলে দম বন্ধ হয়ে আসবে তার। আর এভাবে সে বাকী জীবন কাটাতে পারবে না। পরবর্তীতে কি হবে আহি জানে না। জানতে চায়ও না। কিন্তু আজ আফিফকে এই কথা বলেই সে সামনে পা বাড়াবে। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাবে না।

(***)

আহি আফিফের সামনে এসে দাঁড়াতেই আফিফ চমকে উঠলো। আহির চোখগুলো ফুলে গেছে। আফিফ স্থির দৃষ্টিতে সেই ফোলা চোখগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। আফিফের চোখ দু’টিও কেমন অস্থির হয়ে আছে। এই অস্থিরতা কীসের? একটা মেয়ের মন ভেঙে দেওয়ার অস্থিরতা, না-কি নতুন জীবনে কোনো ঝড় আগমনের আভাস পাওয়ায় এই অস্থিরতা! সে আহিকে কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলো না। তার গলায় কথা আটকে গেছে। আহি বলল,
“আমি চলে যাচ্ছি। অনেক দূরে চলে যাবো আমি। চিন্তা করো না। কখনোই পদ্মকে আমি এআরের পরিচয় জানাবো না। কিন্তু একটা কথা তোমাকে জানিয়ে যাবো। কেউ একজন বলেছে, মনের কথা লুকিয়ে রাখলো যন্ত্রণা বাড়ে, প্রকাশ করে ফেললেই শান্তি।”

আফিফ অবাক হলো। এই কথা আফিফ নিজেই কয়েক মাস আগে টাইমলাইনে লিখেছিলো। তাহলে মেয়েটা কি তাকে এখনো মনে রেখেছে? মেয়েটা কি তাকে নীরবে অনুসরণ করে যাচ্ছে?

আহি এবার বলল,
“তুমি সেদিন জানতে চাও নি, আমি কে! কেন জানতে চাও নি, তা আর জানার অধিকার নেই আমার। কিন্তু আমি সত্যিই তোমাকে ভালোবেসেছিলাম। এখনো ভালোবাসি।”

আফিফ কিছু বলতে যাবে, তখনই আহি তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“আমার আর কখনো তোমাকে দেখা হবে না, এআর। আমি আজ শুধু আমার ভালোবাসা হারাই নি, তোমার জন্য আমি আমার ছোটবেলার বান্ধবীকেও হারিয়ে ফেলেছি। আমি আর কখনো পদ্মের সামনে দাঁড়াতে পারবো না। সহ্য হবে না আমার। আমার এতো বছরের শখের মানুষটাকে সে কেঁড়ে নিয়েছে।”

আফিফ কাঁপা কন্ঠে বলল,
“পদ্ম আমাকে ভালোবাসে নি। আমি পদ্মকে ভালোবেসেছি বলেই সে আমাকে ভালোবেসেছে। এখানে ওর কোনো অপরাধ নেই। তোমার সাথে যা হয়েছে, সেটার জন্য কেউ অপরাধী নয়। ভাগ্যে হয়তো এটাই ছিল। তোমাকে নিয়ে আমি কখনোই কিছু ভাবি নি। তুমি যখন আমার জীবনে আসতে চেয়েছিলে, তখন আমার জীবনটা একদম এলোমেলো ছিল। এমন জীবনে কারো আগমন সুখকর হয় না।”

আহি মলিন হেসে বলল,
“ভালো থাকবেন। পদ্মকেও ভালো রাখবেন।”

আহি তুমুল বৃষ্টির মধ্যেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো। অন্ধকার রাস্তা। আহির সবুজ রঙের হালকা কাজের লেহেঙ্গাটা বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে। আফিফের গলা কাঁপছে। এই অপরাধবোধ নিয়ে সে বাকি জীবন কীভাবে কাটাবে? তার সাহস নেই, সেই হারিয়ে যাওয়া মেয়েটির মাথায় ছাতা এগিয়ে দেওয়ার, তাকে আটকানোর, তাকে একবার বলার, বৃষ্টি কমলে চলে যেও।
আফিফ এবার পদ্মের দিকে তাকালো। পদ্মকে দেখেই তার ঠোঁটে প্রশান্তির হাসি ফুটে উঠলো। মনে মনে বলল,
“আমি আমার পদ্মফুলকে হারাতে চায় না।”

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||বোনাস পর্ব||

২৬।
ভেজা বাতাসে থরথর করে কাঁপছে আহি। গ্রামের বৃষ্টি স্নাত কর্দমাক্ত রাস্তায় পা ফেলার উপায় নেই। আহির জুতা জোড়া বার-বার কাঁদায় আটকে যাচ্ছে। কিন্তু সে হেঁটে যাচ্ছে। ঘোরের মাঝেই সে সামনে এগুচ্ছে। একবারো ভাবে নি এতো রাতে সে পায়ে হেঁটে শহরে কীভাবে পৌঁছাবে? বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়ায় আহির লেহেঙ্গাটা আরো ভারী হয়ে গেছে। কাঁধ থেকে উড়নাটা রাস্তায় ফেলে দিলো আহি। কষ্টটা ধীরে ধীরে রাগে পরিণত হতে লাগলো তার। বাসায় তো সে এমনই করে। মন মতো কিছু না হলে জিনিসপত্র ছোঁড়াছুড়ি করবে। আর এখন তো তার সবচেয়ে প্রিয় সম্পদটিই তার কাছে নেই। হাতের ব্যাগটা রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দিলো সে। আর হেঁটে যাওয়ার শক্তি নেই তার। পিচ ঢালা রাস্তায় উঠেই সেখানে ধপ করে বসে পড়লো আহি। লেহেঙ্গাটা খামচে ধরেছে সে। রাগ সব সেই লেহেঙ্গার উপরই ঝাড়ছে। চিৎকার করে অনেকক্ষণ কাঁদলো আহি। ভাগ্যিস জায়গাটা নিরিবিলি ছিল। গ্রামের পথ, অন্ধকার রাত, ভারী বর্ষণ এই মুহূর্তে কাকপক্ষীরও রাস্তায় থাকার কথা না।
হঠাৎ নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবেই দুর্বল শরীর নিয়ে উঠে দাঁড়ালো আহি। ব্যাগটা আবার রাস্তা থেকে কুঁড়িয়ে নিয়ে ফোনটা বের করলো। ফোনটা ভিজে যাচ্ছে। আহি যতোটুকু পারছে বৃষ্টির ছাঁট থেকে ফোনটাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। কিন্তু সে অক্ষম। নিজেই যেখানে পুরোপুরি বৃষ্টিতে ভিজে গেছে, সেখানে ফোনকে রক্ষা করবে কীভাবে!
মোজাম্মেল চাচার নম্বরে ফোন দিলো আহি। ঘড়িতে রাত দশটা। শহরের মানুষ এতো তাড়াতাড়ি ঘুমাবে না। মোজাম্মেল চাচা কল ধরতে দেরী করলেন না। আহি কাঁপা কন্ঠে বললো,
“চাচা, আমাকে একটু এসে নিয়ে যাবেন প্লিজ?”

মোজাম্মেল চাচা ব্যস্ত কন্ঠে বললেন,
“মা, আমি আসতাছি। তুমি চিন্তা কইরো না। সাহেব যখন শুনছে তুমি রাতে গ্রামে থাকবা, তখনই আমারে পাঠাই দিসে।”

আহির ফোন বন্ধ হয়ে গেলো। আহি ফোনটা ব্যাগে ঢুকিয়ে রাস্তার পাশে জড়োসড়ো হয়ে বসে পড়লো। মুহূর্তটা এতো ভয়ংকর ছিল যা আহি কখনোই ভুলতে পারবে না। সেদিন প্রায় দুই ঘন্টা পর মোজাম্মেল চাচা আহিকে নিতে আসেন। রাস্তায় অচেতন অবস্থায় লেহেঙ্গা পরা একটি মেয়েকে দেখেই তিনি বুঝে ফেলেছিলেন মেয়েটিই আহি। বাসায় পৌঁছাতে দেড় ঘন্টা লেগেছে মাত্র। ড্রাইভার রাস্তা খালি থাকায় দ্রুতগতিতে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে আসেন। পুরো রাস্তা ড্রাইভার আর মোজাম্মেল চাচা উদ্বিগ্ন ছিলেন। বাসায় আনার পর মুনিয়া খালা আহির কাপড় পালটে দেন। আহির শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে দেখে রিজওয়ান কবির তাকে জরুরি বিভাগে নিয়ে যান। এতো রাতে হাসপাতালে কোনো ডাক্তার উপস্থিত ছিলো না। তাদের ফোন করতে হবে। রিজওয়ান কবির পরিচিত ডাক্তারকে ফোন করলেন। আর নার্সরা আপতত আহিকে দেখে নাঁড়ি পরীক্ষা করে স্যালেইন দিলো। এরপর ডাক্তার এসে চেক আপ করে গম্ভীরমুখে বলল,
“বৃষ্টিতে ভেজার জন্য অচেতন হয় নি। মনে হচ্ছে অন্য কিছু। আমাকে সময় দিন, আমরা আপনাকে জানাচ্ছি।”

আহিকে এরপর আইসিউতে স্থানান্তর করা হলো। রিজওয়ান কবির প্রচন্ড রেগে আছেন। আহির কিছু হলে তিনি যে বিবাহিত দম্পতির সাথে খুব একটা ভালো কিছু করবেন না তা মোজাম্মেল চাচা তার কথার ধরণেই আঁচ করতে পেরেছেন। কিন্তু এখানে তো পদ্মের কোনো দোষ ছিলো না। সে তো জানেই না আহি কেন চলে গেছে। উলটো সে বিদায়ের সময় আহিকে অনেক খুঁজেছিলো। এদিকে সালমা ফাওজিয়াও মুনিয়া খালার কাছ থেকে খবর পেয়ে মেয়েকে দেখতে এসেছেন। তিনি বার-বার রিজওয়ান কবিরকে শাসাচ্ছেন। তার জন্যই না-কি মেয়ের এই পরিণতি হয়েছে।

অনেকক্ষণ পর ডাক্তার এসে জানালো, আহি মাইল্ড স্ট্রোক করেছে। তবে এখন পুরোপুরি সুস্থ আছে। জ্ঞান ফিরতে সময় লাগবে। ডাক্তার এ-ও বলে দিয়েছেন আহিকে যাতে কোনোরকম মানসিক চাপ দেওয়া না হয়। সেদিনের পর থেকেই আহি সিজোফ্রেনিয়া নামক রোগে ভুগছে।

(***)

আহিকে হাসপাতাল থেকে বাসায় আনার পরই লিনাশা তাকে দেখতে এলো। আহি লিনাশাকে ধরে অনেক কান্নাকাটি করলো। লিনাশা আহির হাত ধরে বলল,
“আগেই বলেছি, জানিয়ে দে, জানিয়ে দে। বোকার মতো চুপ ছিলি। তুই বোকা পদ্ম আর পুষ্পকে আফিফের কথাটা জানাতে দিস নি। আজ যদি পদ্ম আফিফকে চিনতো তাহলে কি তোর ভালোবাসা কেঁড়ে নিতো? ভুল তো তুই করেছিস। আফিফ কেন মনে করবে তুই ওকে এখনো ভালোবাসিস? এটা তোর এক তরফা ভালোবাসা ছিল।”

“আমি ওকে পাগলের মতো ভালোবেসেছি, লিনু।”

লিনাশা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“ভালোবাসা আর উন্মাদের মতো ভালোবাসা দু’টির মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য আছে। তুই আফিফকে ভালোবাসিস এটা হয়তো সে বুঝেছে। কোনো কারণে হয়তো তোকে মেনে নেয় নি। হয়তো তুই যখন ওর লাইফে আসতে চেয়েছিলি, তখন ও প্রস্তুত ছিল না। এরপর কি তুই আর ওর সামনে গিয়েছিলি? আড়াই বছরে একবারো তুই ওকে বলেছিস, তুই এখনো ওর অপেক্ষায় আছিস? ও কি জানতো বিষয়টা, আহি? ছেলেটা তোকে না করে দেওয়ার পর তুই আর দ্বিতীয়বার ওর সামনে যাস নি। তাহলে ও কীভাবে বুঝবে তুই ওকে এখনো ভালোবাসিস? বলতে পারিস, এটা তোর ভাগ্যের দোষ। ও তো জানতো না তোর ওর প্রতি উন্মাদনা কেমন ছিল! জানলে তোকে কখনোই ফেলতে পারতো না।”

লিনাশা এর চেয়ে বেশি সান্ত্বনা দিতে পারবে না আহিকে। কিন্তু সেই সান্ত্বনা আহির কাছে তুচ্ছ। এতো বড় ধাক্কা এতো সহজে কাটিয়ে উঠতে পারবে না আহি। তার ভালোবাসা হারানোর রাগটা পদ্মের উপর ঝাড়লো সে। সব দিক থেকে ব্লক করে দিলো পদ্মকে। পদ্ম অনেকবার লিনাশাকে ফোন দিয়েছিল, আহির খবর নেওয়ার জন্য। লিনাশাও টুকটাক কথা বলেই কল রেখে দিয়েছে। আহির ব্যাপারে খোলাখুলিভাবে কিছুই বলে নি।
এদিকে আহির দিনগুলো কেমন উষ্কখুষ্ক ভাবেই কাটছে। সারাদিন তার একা একা ছাদে বসে থাকা, খাওয়া-দাওয়ার অনিয়ম, মাঝ রাতে অস্বাভাবিক আচরণ রিজওয়ান কবিরকে ভাবিয়ে তুলছে। এরপর আহিকে ডাক্তার দেখানো হলো। একমাস পরও আহির কোনো পরিবর্তন হলো না। সে সারাদিন আফিফের ভাস্কর্যটির সামনে বসে নিজে নিজে কথা বলেই সময় পার করতো।

(***)

একদিন বিকেলে কলিং বেলের শব্দ শুনে মুনিয়া খালা দরজা খুলে দিয়েই থমকে গেলেন। রিজওয়ান কবিরের পাশে দাঁড়িয়ে আছে লাবণি মেহেরা। লাবণিকে দেখে মুনিয়া খালা চমকালেন খুব। এই মেয়ে বধূ সাজে কেন? রিজওয়ান কবির আহিকে ডাকলেন। আহি নিচে নেমে লাবণিকে দেখে মুচকি হেসে বলল,
“আপু, আপনি কখন এলেন?”

মুহূর্তেই আপাদমস্তক লাবণিকে দেখে আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“আপনি বিয়ের শাড়ি পরে..!”

লাবণি আহির কাছে এসে থুতনিতে হাত রেখে বলল,
“এখন থেকে আমি তোমার আপু নই। আমি তোমার মা।”

আহি কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে বলল,
“আর ইউ ক্রেজি!”

রিজওয়ান কবির মেয়ের দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে বললেন,
“ক্রেজি, হোয়াট? আহি, তুমি লাবণির সাথে ভদ্রভাবে কথা বলবে।”

এবার লাবণি আহিকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“ধীরে ধীরে শিখে যাবে। আমিই আহিকে শিখিয়ে দেবো।”

আহি লাবণিকে সরিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে চলে এলো। এরপর লিনাশার নম্বরে কল করলো। লিনাশা প্রায় সাথে সাথেই কলটা রিসিভ করলো। আহি কিছু বলতে যাবে তার আগেই লিনাশা বলল,
“আহি, তুই আমার পুরো লাইফটা এলোমেলো করে দিয়েছিস।”

আহি লিনাশার ঝাঁজালো কন্ঠের প্রতিত্তোরে বলল,
“লিনু, কি বলছিস এসব?”

লিনাশা বলল,
“বাবা হসপিটালে ভর্তি। তোর বাবা আমার বাবাকে খুন করতে চেয়েছে।”

“লিনু, আমি….”

লিনাশা আহিকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“চুপ, তোর সাথে বন্ধুত্ব করাই আমার ভুল সিদ্ধান্ত ছিলো। বাবা-মা আমাকে কতো বার বারণ করেছিলো, সেই ক্রিমিনালের মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব করিস না। কিন্তু আমিই শুনি নি। এখন, কি করলো তোর বাবা? আমার আপুকে বিয়ে করে নিয়ে গেলো? তার লোক এসে আমার বাবা-মাকে মেরেছে। বাবা তাদের বিয়ে মেনে নিচ্ছিলো না দেখে মিস্টার রিজওয়ান কবির আমার বাবাকে মেরেছে। শুধু বাবাকে মারে নি। মাকেও মেরেছে। পুরো সোসাইটিতে আমাদের নাম খারাপ করে দিয়ে গেছে। আমার ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দিয়েছে। সব কিছুর জন্য তুই দায়ী। তুই যার জীবনে যাবি, তার জীবনটাই এলোমেলো হয়ে যাবে। আফিফের কপাল ভালো ছিল, তাই তোর মতো মেয়ের কাছ থেকে বেঁচে গেছে।”

আহি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। লিনাশা আহির কান্নার শব্দ পেয়েই কল কেটে দিলো।

(***)

রিজওয়ান কবির আর লিনাশার বড় আপু লাবণি মেহেরার অনেক দিনের সম্পর্ক ছিলো। লাবণিকে পছন্দ করতেন বিধায় সালমা ফাওজিয়াকে তালাক দিয়েছিলেন তিনি। আহির চেয়ে মাত্র চার বছরের বড় লাবণি। এ বছরেই অনার্স শেষ করে রিজওয়ান কবিরের কোম্পানিতে চাকরি নিয়েছে। তাদের সম্পর্কের কথা লিনাশার মা রুনা খানম জেনে যান। লাবণিকে শাসন করার জন্য তার গায়ে হাত তুলেছিলেন তিনি। কারণ প্রথমত রিজওয়ান কবির তার বাবার বয়সী, দ্বিতীয়ত রিজওয়ান কবির একজন অসৎ চরিত্রের লোক, যেটা চট্টগ্রামের প্রায় সবারই জানা। এমন একটা লোকের সাথে সম্পর্ক মেনে নেওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। কিন্তু লাবণি সেই শাসনের প্রতিশোধ নিয়েছে রিজওয়ানের লোকেদের দিয়ে নিজের বাবা-মাকে মার খাইয়ে।
সম্ভ্রান্ত পরিবারের মহিলা রুনা খানম। আপন স্বামী যেখানে কখনো তার গায়ে হাত তুলে নি, সেখানে বাইরের কিছু লোক এসে তাকে মারছে, এটা মেনে নিতে পারেন না। এখন তিনি অস্বাভাবিক আচরণ করছেন। লিনাশা মাকে একা সামলাতে পারছে না। নিকট আত্মীয়রা এসে মিসেস রুনাকে গ্রামের বাড়ি নিয়ে যান। এদিকে লিনাশার বাবা, ফখরুল হক মেয়ের সম্পর্কের কথা জেনে যাওয়ার পর মেয়েকে কিছুই বলেন নি। শুধু শান্তভাবে বুঝিয়েছিলেন। কিন্তু লাবণি বাবার কথার অমান্য হয়ে রিজওয়ান কবিরকে বিয়ে করে ফেললো। ফখরুল হক লাবণির বিয়ের খবর শুনে রিজওয়ান কবিরকে গালিগালাজ করলেন। এ জন্যই রিজওয়ান কবির তাকে মারার জন্য লোক পাঠিয়েছিলেন। এরপর গুরুতর অবস্থায় ফখরুল হককে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। বর্তমানে তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে। স্ট্রোক করেছিলেন তিনি। তার মস্তিষ্ক একদমই কাজ করছে না। ডাক্তাররা জানিয়ে দিয়েছে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে তার সাড়া না পেলে তাকে মৃত ঘোষণা করা হবে।

(***)

রাত এগারোটায় পুষ্পের কল দেখে আহি চমকে উঠলো। কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে পুষ্প বলল,
“আহি, লিনুর বাবা আর নেই।”

আহি খবর পেয়েই হাসপাতালে চলে এলো। এখান থেকেই লিনাশার বাবাকে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হবে। আহি লিনাশাকে দেখে তার কাছে এসে বলল,
“লিনু, পুষ্প আমাকে ফোন দিয়ে বলল….”

লিনাশা আহিকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“আমার বাবা মারা গেছে। এটাই তো বললো, তাই না? শুনেছিস? খুশি হয়েছিস?”

“কি বলছিস এসব তুই?”

“তোর বাবা একজন খুনী। তুই খুনীর মেয়ে।”

আহি লিনাশার হাত ধরতে যাবে, তার আগেই লিনাশা আহির গালে চড় বসিয়ে দিলো। আহি গালে হাত দিয়ে লিনাশার দিকে তাকালো। লিনাশা আঙ্গুল তাক করে বলল,
“আই হেইট ইউ, আহি। তোর সাথে বন্ধুত্ব করার পরিণাম এতো খারাপ হবে জানলে, আমি তোর দিকে কখনো ফিরেও তাকাতাম না। আমি আজ আমার বাবাকে হারিয়েছি তোর জন্য। একটা জলজ্যান্ত সুস্থ মানুষ এক রাতেই শেষ হয়ে গেছে, তোর জন্য। আমার মায়ের গায়ে হাত তুলেছে তোর বাবার লোকেরা। আমার সব শেষ হয়ে গেছে, শুধু তোর জন্য। তুই একটা অশুভ। তোর ভাগ্য যেমন, তুইও তেমন। আর কখনো আমার সামনে এসে দাঁড়াবি না। তোর সাথে আমার সব সম্পর্ক শেষ।”

আহি মাথা নিচু করে কাঁদছে। সে লিনাশার কাছে এসে বলল,
“তুইও আমাকে একা করে দিচ্ছিস, লিনু। প্লিজ…”

লিনাশা গম্ভীর সুরে বলল,
“আরেকটা কথা। আমি আর মা এই শহরে আর থাকবো না। থাকার মতো অবস্থায় আর নেই। পুষ্প এগুলো জানে না। আল্লাহর দোহাই লাগে, এই কথা আর কাউকে বলিস না। স্কুল গ্রুপ, কলেজ গ্রুপের কোনো বন্ধুরা যাতে না জানে আমার আপু তোর বাবাকে বিয়ে করেছে। অন্তত এটা সিক্রেট রেখে আমাকে উদ্ধার করিস।”

(***)

প্রথমে মা, তারপর ভালোবাসা আর আজ প্রিয় বান্ধবীকেও হারিয়ে ফেলেছে আহি। নিজেকে এর চেয়ে বেশি নিঃস্ব কখনোই মনে হয় নি তার। বেশিই সুখ পেয়েছিল এতোদিন। অতি সুখ তার জীবনের কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আহি বাসায় ফিরে দেখলো লাবণি হাত ভর্তি চুড়ি পরে বসে আছে। তার সামনে আংটির বক্স। সে বক্সটি থেকে এক একটি আংটি বের করে আঙ্গুলে পরে দেখছে। আহি ক্ষুব্ধ কন্ঠে বলল,
“আপনি কি জানেন আংকেল মারা গেছেন?”

আহির কথা শুনে কিছুক্ষণের জন্য স্থির হয়ে বসে রইলো লাবণি। তারপর আহির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
“বাবার আয়ু যদি কম থাকে, আমার কি করার আছে?”

“আমি আপনাকে দেখে অবাক হচ্ছি। আপনার মতো জঘন্য মেয়ে আমি একটাও দেখি নি।”

লাবণি এক গাল হেসে বলল,
“আমি এখন আর লাবণি মেহেরা নই। মিসেস লাবণি রিজওয়ান কবির। দেখো, তোমার বাবা আমার জন্য কতোগুলো ডায়মন্ডের রিং এনেছে! আমার বিয়ের গিফট। তুমি একটা পছন্দ করো। এতোগুলো দিয়ে আমি কি করবো? একটা তুমিও নাও।”

আহি ডায়মন্ডের বক্সটি হাতে নিয়ে মেঝেতে ফেলে দিলো। আর সাথে সাথেই আংটিগুলো পুরো ঘরে ছড়িয়ে পড়লো। লাবণি চেঁচিয়ে বলল,
“কতো লাখ টাকার রিং ছিল, জানো?”

আহি বলল,
“জানি, বরং দেখতে দেখতেই বড় হয়েছি। আপনি হয়তো হঠাৎ দেখেছেন। তাই হজম করতে পারছেন না। হজম করার জন্য নিচে বসে আংটিগুলো কুড়িয়ে নিন। এন্ড ফার্দার, আপনার আদিখ্যেতা আমাকে দেখাবেন না। আর আমার মা হওয়ার চেষ্টা তো কখনোই করবেন না। আই হেইট ইউ মিসেস লাবণি।”

লাবণি আহির কথায় অট্টহাসি দিয়ে বলল,
“তুমি একটু আগে আমাকে জঘন্য মেয়ে বলেছিলে। আমি তোমাকে শীগ্রই আমার সেই জঘন্য রূপটা দেখাবো।”

(***)

আহির দিন কাটছে যন্ত্রের মতো। বেলা করে ঘুম ভাঙছে। দুপুরে নাস্তা করে, আবার ঘুমাচ্ছে। সন্ধ্যায় ঘুম ভাঙলে আফিফের ভাস্কর্যের সাথে কথা বলে সময় কাটাচ্ছে। রাতে খোলা চুলে ছাদের মেঝেতে শুয়ে আকাশ দেখছে। মুনিয়া খালা আহির চিন্তায় অস্থির। চুনি আহিকে দেখলেই পালিয়ে যায়। চোখগুলো ফুলে থাকে তার। চুনির মনে হয় তার ভেতরে লিনাশার বাবার আত্মা ঢুকে গেছে। সে লাবণিকে এই কথা বলতে বলতে তার মাথা খেয়ে ফেলছে। লাবণি নিজেও আহির ব্যবহারে বিরক্ত।
আজ সে আহির ঘরে বিনা অনুমতিতেই ঢুকে গেলো। রুমে ঢুকে দেখলো আহি একটা ভাস্কর্য জড়িয়ে ধরে রেখেছে। আহিকে এই অবস্থায় দেখে লাবণি বলল,
“তুমি কি পাগল হয়ে গেছো, আহি?”

আহি লাবণির কথায় চমকে উঠলো। লাবণি বলল,
“কার ভাস্কর্য এটা!”

আহি ভাস্কর্যটিকে আড়াল করে দাঁড়ালো। লাবণি বাঁকা হেসে বলল,
“নিশ্চয় এই ভাস্কর্যে তোমার প্রাণ আটকে আছে। যদি তোমার এই প্রাণটা কেঁড়ে নেই, তাহলে তুমি আমার জঘন্য রূপ সম্পর্কে জানতে পারবে।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে আছে লাবণির দিকে। লাবণি রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। আহি সাথে সাথেই দরজাটা বন্ধ করে দিলো। আফিফকে নিয়ে আঁকা ছবি, জিনিসপত্র সবকিছুই সে লুকিয়ে ফেললো। শুধু ভাস্কর্যটি লুকোনোর স্থান খুঁজে পেলো না। লাবণি একটু পর দরজায় জোরে জোরে ধাক্কা দিতে লাগলো। আহি তা দেখে মুখ চেপে কাঁদছে। এই ভাস্কর্যটি যদি তার কাছ থেকে সরিয়ে নেয়, তাহলে সে পাগল হয়ে যাবে। এটাই তো আফিফের প্রতিচ্ছবি।

(***)

দরজা ভেঙে রুমে ঢুকলেন রিজওয়ান কবির। আহির রুমে সেই ভাস্কর্যটি দেখে আহির কাছে জিজ্ঞেস করলেন,
“কার ভাস্কর্য এটা?”

আহি কাঁপা কন্ঠে বললো,
“আমি ভালোবাসি একটা ছেলেকে। ওর ভাস্কর্য বানিয়েছিলাম।”

“কি করে ছেলেটা?”

আহি মাথা নেড়ে বলল, “বলবো না।”

রিজওয়ান কবির চিৎকার দিয়ে বললেন,
“নাম কি সেই ছেলের?”

আহি কাঁপা কন্ঠে বললো,
“ও জানেই না, আমি ওকে ভালোবাসি।”

লাবণি রিজওয়ান কবিরের কাছে এসে নিজ হাতে স্বামীর কোমরের বেল্টটা খুলে তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“মেয়েকে শাসন করতে শেখো। বেশি আস্কারা দিয়ে মাথায় তুলে ফেলেছো।”

আহি দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুনিয়া খালা দৌঁড়ে ঘরে ঢুকে রিজওয়ান কবিরের পা ধরে বললেন,
“স্যার, ছাইড়া দেন ওরে। বুঝে নাই মাইয়াডা। ছোড মানুষ।”

লাবণি বলল,
“একটা রাস্তার ছেলেকে ভালোবেসে তার প্রতিমূর্তি বানিয়ে ঘরে তুলেছে, আর তুমি বলছো ছোট মানুষ?”

আহি চেঁচিয়ে বলল,
“ও রাস্তার ছেলে না। আপনি রাস্তার মেয়ে।”

আহির কথাটি মুখ থেকে বের করতে দেরী, রিজওয়ান কবিরের বেল্টের আঘাত তার শরীরে পড়তে দেরী হলো না।

২৬।

জীবনে প্রথম আহির বাবা মেয়ের গায়ে হাত তুলেছেন, তাও আবার বেল্ট দিয়ে মেরেই সেই অত্যাচারের সূচনা ঘটিয়েছেন। এই মুহূর্তে আহির শরীর জ্বলে যাচ্ছে। রিজওয়ান কবির আহির দিকে আঙ্গুল তাক করে বললেন,
“একবার এই ছেলের পরিচয় জানতে পারলে, তার লাশ তোমার সামনে এনে রাখবো। ভুলেও সেই ছেলে তোমার মনে যাতে বেঁচে না থাকে। তোমার জন্য আমি অনেক আগেই তাজওয়ারকে পছন্দ করে রেখেছি। তোমার বর্তমান, ভবিষ্যৎ, ভালোবাসা, সবটাই যেন তাজওয়ার হয়।”

রিজওয়ান কবির কথাটি বলেই চলে গেলেন। লাবণি আহির দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমার জঘন্য রূপ কেমন লেগেছে, আহি? মারটা হজম হয়েছে? না-কি হজম করার জন্য এই ভাস্কর্যটা ভেঙে দেবো?”

আহি কাঁপা শরীর নিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে ভাস্কর্যটির সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“প্লিজ ও এমনিতেই কখনো আমার হবে না। অন্তত এটা আমার সাথে থাকুক। আপনি যা বলবেন, আমি সব মেনে নেবো। এই ভাস্কর্যটার সাথে আমার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। প্লিজ, এটা ভাঙবেন না।”

লাবণি লোহার গরাদ নিয়ে এসেছিলো সাথে করে। সেটা হাতে নিয়েই ভাস্কর্যের এক হাত ভেঙে দিলো।
আহি তাকে আটকাতে যাবে, তখনই লাবণি বলল,
“সবে তো শুরু আহি। আমার আরো জঘন্য রূপ তুমি দেখবে।”

আহি লাবণির পায়ের কাছে বসে বলল,
“প্লিজ। আমি আর কখনো আপনার সাথে খারাপ ব্যবহার করবো না। আমি ওকে হারিয়ে ফেলেছি। এটা ভেঙে গেলে, আমি কীভাবে বাঁচবো?”

“তো মরে যাও।”

লাবণি নিজের সর্বশক্তি দিয়ে ভাস্কর্যটিতে কয়েকটা আঘাত করল। ভাস্কর্যটি আহির চোখের সামনে গুঁড়িয়ে গেলো। লাবণিও চলে গেল। আহি অঝোর ধারায় কাঁদছে। চিৎকার করে কাঁদছে। তার কান্নার শব্দ নিচ তলা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। মুনিয়া খালা চুনিকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন আর মিনমিনিয়ে বলছেন,
“আল্লাহ, মেয়েডারে বাঁচাও। এই জানোয়ারগুলা থেকে মুক্তি দাও।”

(***)

আহি রাতে কাঁদতে কাঁদতেই ঘুমিয়ে পড়েছে। লাবণি সকালে ঘরে এসে দেখলেন, আহি মেঝে হাতড়াতে হাতড়াতে কাঁদছে। আহির পাগলামো দেখে লাবণি লিনাশাকে কল করলো। লিনাশা বোনের সাথে কথা বলতে আগ্রহী ছিলো না। কিন্তু আহির শোচনীয় অবস্থার কথা শুনে আহিদের বাসায় আসতে বাধ্য হলো। লিনাশা এসেই আহিকে শান্ত করালো। আহি লিনাশার হাত ধরে বলল,
“তুই ঠিক বলেছিস, লিনু। আমি অশুভ। সব হারিয়ে ফেলেছি আমি। আমার বেঁচে থাকার কোনো দরকার নেই। এখন আমি কীভাবে মরবো, বল? ফ্যানে ঝুলে যাবো? ছাদ থেকে পড়ে যাবো? কোনটা করবো!”

লিনাশা আহির হাত ঝাঁকিয়ে বলল,
“তুই কি পাগল হয়ে যাবি নাকি? শোন আহি, যেই ভালোবাসা তোর জন্য নিষিদ্ধ হয়ে গেছে, তাকে আর কারো সামনে প্রকাশ করতে যাবি না। এটাই তোর জন্য ভালো হবে। সবকিছুর একটা সীমা থাকে৷ তোর ভালোবাসা সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বেহায়া হয়ে যাস না। এমন বেহায়াদের কেউ ভালোবাসে না। আর মরে গিয়ে কি লাভ হবে? আফিফ ঠিকই পদ্মের সাথে সুখে সংসার করবে। দহন হবে তোর।”

“এটা কি দহন না?”

“একদিন ঠিকই সব মায়া কেটে যাবে। মানুষ কেউ কাউকে বেশিদিন মনে রাখে না। এটা তোর আবেগ। আমি আসতাম না আজ। কিন্তু বাধ্য হয়ে এসেছি। প্লিজ আহি, আমাকে আর বাধ্য করিস না। আমার তোকে দেখলে মায়াও হয়, আবার ঘৃণাও হয়। আমাকে শক্ত হতে দে। আমি আমার বাবাকে হারিয়েছি। মা জানে না তোর বাসায় এসেছি। জানলে অনেক সমস্যা হবে। তুই নতুন বন্ধু পাবি, ভালোবাসাও পাবি। সুন্দর তুই। একটা না একটা চলেই আসবে।”

আহি কাঁপা কন্ঠে বললো,
“আমার বিন্দু বিন্দু গড়া ভালোবাসার মূল্য তোদের কারো কাছে নেই। কি চমৎকার ভাবে বললি, একটা না একটা চলেই আসবে। দেখতে মনে হচ্ছে এটা আবেগ। কিন্তু আমার আবেগ আমাকেই খেয়ে ফেলছে। আমার কি পরিমাণ কষ্ট হচ্ছে তোরা বুঝবি না। আমি আর কাউকে বলবও না। এটাই শেষ। আমার ভালোবাসা, আমার অনুভূতি আমার মৃত্যুতেই এই পৃথিবী ছাড়বে। আমি শেষ মুহূর্ত অব্ধি আফিফকে ভালোবাসা ছাড়বো না। যেদিন আমার মৃত্যু হবে, আফিফ পৃথিবীর সবচেয়ে দামি জিনিস হারাবে। আফিফকে ভালোবাসার জন্য আমার কারো অনুমতির প্রয়োজন নেই। কারো চাওয়া না চাওয়া আমার ভালোবাসার সমাপ্তি ঘটাতে পারবে না। আমি বেহায়া হই, আর যাই হই। আমি কখনো ওর সামনে দাঁড়াবো না। ওর কাছে অধিকার চাইবো না। কিন্তু ভালোবাসার অধিকার আমারই আছে। পদ্মও পারবে না আমার চেয়ে বেশি ভালোবাসতে।”

“তোর বাবা অন্যের সংসার ভেঙেছে। এখন তুইও ভাঙবি?”

“ছিঃ লিনু। পদ্মকে আমি কষ্ট দিতে পারবো না। পদ্মের জায়গায় অন্য কেউ হলে, আমি হয়তো জোর করেই আফিফকে নিজের করে নিতাম। হয়তো বা নিতাম না। জানি না কি করতাম। মাথায় ঠিক নেই আমার। কিন্তু পদ্ম আমার বান্ধবী। আমি ওকে ভীষণ ভালোবাসি। এজন্যই তো আমি ওর সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছি। না হবে কথা, না হবে দেখা, না মরণ যন্ত্রণার সুযোগ পাবো। দূরত্বই আমাদের ভাগ্যে আছে। আমি কাঁদবো, ভালোও বাসবো। কিন্তু পদ্ম-আফিফের সংসারে ঝামেলা করবো না।”

…………………………………….

আহি বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। আজ সে অলকানন্দার চারা কিনে এনেছে। মানুষটা তার না হোক, কিন্তু তার ভালোলাগাগুলো তো তার সাথেই থাকবে। এভাবেই মিষ্টিভাবে দূর থেকে ভালোবাসে সে আফিফকে। ছোট ছোট অলকানন্দা ফুল ফুটেছে চারায়। আহি সেগুলো আলতো হাতে ছুঁয়ে দিতে দিতে বলল,
“প্রিয় অলকানন্দ, আমি তোমাকে ভালোবাসতে এতোটাই মগ্ন ছিলাম যে তোমাকে বলার সুযোগটা হাতছাড়া করে ফেলেছি। আমি তোমাকে দেখতে এতোটাই ব্যস্ত ছিলাম যে তোমাকে চোখের সামনে বসিয়ে রাখার সুযোগটাই হারিয়ে ফেলেছি। আমি তোমাতে ডুব দিয়েছিলাম। খেয়াল করি নি তুমি এতোটা গভীর হবে। তোমার এই গভীরতা আমাকে সাঁতার ভুলিয়ে দিয়েছিল। আর আমি তলিয়ে গেলাম। তুমি কি কখনোই আমার প্রেমে পড়ো নি? আমার কৌতূহলী আবেগ, তোমাতে আটকে থাকা মন, আমার ব্যস্ত চোখ, কিছুই কি তোমাকে আকর্ষণ করে নি? আমি কি তোমার কিছুই ছিলাম না? আমি তবে কাকে ভালোবেসেছি, যার মনে কখনো আমিই ছিলাম না!”

চলবে-

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে