#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-১১||
১৬।
আহির দুই বাহু শক্ত করে চেপে ধরে আছে তাজওয়ার। আহি তাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করেও পারছে না। তাজওয়ার আহির কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল,
“তুমি আমার কাছে খুবই স্পেশাল, আহি। এতো সহজে আমি তোমাকে পেতে চাই না। ধীরে ধীরে তোমাকে নিজের করে নেবো। তোমার বাবার কাছে হয়তো তুমি ইনভেস্টমেন্ট। কিন্তু আমার কাছে ডায়মন্ড।”
আহি তাজওয়ারকে ধাক্কা দিয়ে বলল,
“তোমার মতো অসভ্য লোকেদের কাছে সব মেয়েরাই ডায়মন্ড। তোমাকে আমি অনেক ভালো করে চিনি, তাজওয়ার খান। তুমি আমাকে তোমার কথার জালে ফাঁসাতে পারবে না।”
“আহি, তুমি আমাকে মানুষ হিসেবে চিনেছো, প্রেমিক হিসেবে চিনো নি। অন্যদের কাছে আমি অসভ্য হলেও তোমার কাছে আমি বরাবরই সভ্য। তুমি মানতে না চাইলে আমার কিছুই করার নেই। তবে মনে রেখো, আমি তোমাকে যে-কোনো মূল্যেই চাই।”
তাজওয়ার কথাটি বলেই আহির গালে তার অধর স্পর্শ করতে যাবে তখনই আহি তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। তাজওয়ার তাল সামলাতে না পেরে দেয়ালের সাথে ঠেকে গেলো। সে আহির দিকে কিছুক্ষণ ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে ঠোঁটে হালকা হাসি ফুটিয়ে বলল,
“যেই জিনিস আমার ভালো লাগে, তা আমি নিজের করেই ছাড়ি। এর জন্য যদি আমাকে তার ক্ষতি করতে হয়, আমি একবারো ভাববো না।”
আহি দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “আমি মানুষ, কোনো পণ্য নই।”
তাজওয়ার রুমের বাইরে এসে দরজা টেনে দিতে গিয়ে আবার খুলে বাঁকা হেসে বলল,
“তুমি আমার পণ্য। আমি তোমাকে কিনে নিচ্ছি। মাইন্ড ইট।”
তারপর ধড়াম করে দরজা আটকে দিয়ে চলে গেলো। তাজওয়ার চলে যেতেই আহি দৌঁড়ে এসে ভেতর থেকে দরজা আটকে দিলো। এরপর দরজা ঘেঁষে মেঝেতে বসে পড়লো। সবকিছুই তার শূন্যের উপর ভাসছে। কোন উদ্দেশ্যে সে পৃথিবীতে এসেছে, সেটা সে নিজেই জানে না। বাবা সন্তানের রক্ষক হয়। আর তার বাবা একজন কাপুরুষ। হাঁটুতে কপালে ঠেকিয়ে আহি ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। হয়তো কাঁদার জন্যই তাকে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে।
(***)
তাজওয়ার খান আহির বাবা রিজওয়ান কবিরের বাল্যবন্ধু সিরাজ খানের ছোট ছেলে। সিরাজ খান নিজেই অনেক বড় ব্যবসায়ী। আবার তার দুই ছেলে সরওয়ার খান আর তাজওয়ার খানের আলাদা ব্যবসা আছে। বংশগত ঐতিহ্যকে ডুবিয়ে দিয়ে তারা অসৎ উপায়ে কোটি কোটি টাকা আয় করেছে। সিরাজ খান দেশে দূর্নীতি মামলা খেয়ে আমেরিকায় পলাতক আছেন। প্রায় দশ বছর ধরে তিনি দেশেই আসেন নি। স্ত্রী রেহানা খানকে রেখেই তিনি পালিয়েছেন৷ বর্তমানে আমেরিকান মেয়েকে বিয়ে করে নতুন সংসার পেতেছেন। বিন্দাস চলছেন তিনি। অন্যদিকে তার বড় ছেলে সরওয়ার খান তার অর্ধেক বয়সী গরিব ঘরের এক মেয়েকে বিয়ে করে এনে দিন-রাত তাদের সংসারে খাটাচ্ছে। আহি মেয়েটিকে একবার দেখেছিল। নাম দোয়েল। মেয়েটা দোয়েলের মতোই সুন্দর দেখতে। কিন্তু দেখে মনে হবে না সে শিল্পপতির স্ত্রী। স্বামীর অবহেলায় তার সর্বাঙ্গে মলিনতা ছেয়ে গেছে। প্রতি রাতে সরওয়ার নতুন নতুন মেয়ে ঘরে এনে আমোদ-ফূর্তি করে। আর দোয়েল নীরবে অশ্রু মুছে। সরওয়ারের কাছের দুই বন্ধু ফারিদ আর কাইসারের কুনজর দোয়েলের দিকে সর্বদাই থাকে। স্বামীর কাছে কয়েক বার অভিযোগ করায় উলটো মার খেতে হয়েছে তাকে। সরওয়ার এমন নিচু স্তরের মানুষ যে তার বন্ধুদের এমন আবদারে তার কোনো আপত্তি নেই। তবে দোয়েল শাশুড়ীর কারণেই নিজের সম্মান রক্ষা করে এখনো সেই সংসারে ঠিকে আছে। শাশুড়ি না থাকলে অনেক আগেই সরওয়ারের বন্ধুদের কাছে নিজেকে সঁপে দিতে হতো তার। এদিকে তাজওয়ার খানও কোনো অংশে কম নয়। অনেকগুলো মেয়ের সাথেই তার প্রেমের সম্পর্কের গুঞ্জন মিডিয়াতে মাঝে মাঝেই প্রকাশ পায়। তাজওয়ারের বন্ধুগুলোও নামি-দামি পরিবারের বিগড়ে যাওয়া সন্তান। দুই বছর আগে সবকটার নামে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছিল। কিন্তু প্রভাব-প্রতিপত্তির জোরে তারা জামিন পেয়ে গেছে। পরবর্তীতে যেই মেয়ে এই মামলা করেছিল, তার পুরো পরিবার এখনো নিঁখোজ। বেশ কয়েক মাস ছাত্র-ছাত্রীরা প্লেকার্ড আর ব্যানার নিয়ে প্রতিবাদ করেছিল। কিন্তু এখন মেয়েটা কারো মস্তিষ্কেই আর বেঁচে নেই। নতুন-নতুন মশলাযুক্ত খবর এসে পুরোনো খবরগুলোকে দাফন করে দিয়ে গেছে। তবে তাজওয়ার সেই কলঙ্ক থেকে ভাগ্যক্রমে মুক্তি পেয়েছিল, কারণ সে বাবার সাথে দেখা করার জন্য সেই সময় আমেরিকায় গিয়েছিল। যদিও সে এই অঘটন ঘটিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল কি-না সেই বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
তাজওয়ার আর তার পরিবার সম্পর্কে এমন ভয়ংকর সব তথ্য আহি ভালোভাবেই জানতো। তাজওয়ার আহিকে ভালোবাসে কি বাসে না, এটা আহির কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো, এমন একটা ছেলেকে বিয়ে করে সে কোনো অনিশ্চিত ভবিষ্যতে পা দিতে চায় না। যদি সে আফিফকে ভালো না বাসতো, তবুও সে এমন একটা ছেলেকে বিয়ে করতে চাইতো না। এমনকি কোনো বাবাও নিজের মেয়েকে এমন পরিবারে বিয়ে দিতে চাইবেন না। কিন্তু আহির কপালে এমন মন্দ রেখার স্পর্শ পড়েছে যে তার কোনো দিক দিয়েই পালানোর পথ নেই।
(***)
গভীর রাত। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টগুলো একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সুবর্ণ মঞ্জিলের বাইরে পাহারারত দারোয়ানরা ঝিমুচ্ছে। বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে বাড়ির ভেতরে সব বাতি নেভানো। জানালাগুলোও সব বন্ধ, শুধু একটা জানালা উন্মুক্ত। আর সেই জানালার বাইরে ঝুলছে ঘন কালো কেশগুচ্ছ। হালকা হাওয়ায় তা নৃত্য করছে। আর অন্ধকার রাস্তায় দাঁড়িয়ে একটি অবয়ব সেই জানালার দিকে তাকিয়ে আছে।
আহি চোখ বন্ধ করে অনুভব করছে কেউ তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আচমকা তার কানের কাছে ভারী নিঃশ্বাস ধাক্কা খেলো। এবার আহির গলা কাঁপতে লাগলো। চোখ খুলবে কি খুলবে না এই নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে সে। আহি তার পাশে কারো উপস্থিতি টের পেতেই চোখ বন্ধ রেখেই আওয়াজ করতে যাবে তখনই সে তার ঠোঁটে আলতো স্পর্শ পেলো। কেউ তার অধর জোড়ায় আঙ্গুল ছুঁয়ে দিয়েছে। এবার আহির কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করলো। তার বুকটা ধরফর করছে। নিঃশ্বাস যেন আটকে আছে। আহি বুঝতে পারছে তার সাথে কি হচ্ছে, কিন্তু সে নিরুপায়। হঠাৎ সেই সুধাময় সুর তার কানে ফিসফিসিয়ে বলল,
“তুমি এসেছো? আমি তোমার অপেক্ষায় কতো রাত জেগেছি। আমাকে ফেলে কেন চলে গিয়েছিলে? তুমি কি জানতে চাও না, আমার উত্তর? জানতে চাও না, তোমাকে নিয়ে আমার অনুভূতি?”
আহি জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো। তার শরীর যেন অবশ হয়ে যাচ্ছে। বালিশ শক্ত করে চেপে ধরে চোখ খুললো আহি। চোখ খুলতেই সব আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে গেলো। অন্ধকার ঘরে আহি ছাড়া কেউ নেই। মাথা তুলে জানালার বাইরে তাকালো আহি। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টগুলো ঠিকই জ্বলছে। রাস্তায় কোনো অবয়ব নেই। পাহারাদাররা নিষ্ঠার সাথে তাদের দায়িত্ব পালন করছে। নীরব পরিবেশে দুই পাহারাদারের কথোপকথন হালকা গুজন সৃষ্টি করেছে। তাহলে এতোক্ষণ পুরোটাই কি আহির স্বপ্ন ছিল? আহি ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়লো। এ আর নতুন কি! গত চার বছর ধরেই সে মাঝরাতে আফিফের কন্ঠের স্বর শুনতে পায়। লন্ডনেও এমনটা হতো। তার সমস্যাটা রাদই প্রথমে ধরেছিল। লন্ডনে থাকাবস্থায় একদিন রাতে আহির খুব জ্বর এসেছিল। সে বিছানা থেকে উঠতেই পারছিলো না। তাই রাদকে বাসায় আসতে বলেছিল। সেদিন রাতে রাদ খেয়াল করলো আহি নিজের ঘরে একা একা কথা বলছে। আহির ঘরে উঁকি দিতেই রাদ দেখলো আহি এমনভাবে কথা বলছে যেন সামনে কেউ বসে আছে। আফিফের ব্যাপারটা রাদ সেদিনই জানতে পেরেছিল। পরবর্তীতে রাদ নিজেই আহিকে ডাক্তার দেখিয়েছিল। ডাক্তার জানিয়েছে, আহি সিজোফ্রেনিয়া নামক মারাত্মক মানসিক রোগে ভুগছে। তিনি শীগ্রই আহির চিকিৎসা শুরু করতে বলেছিলেন। কিন্তু আহি দ্বিতীয় বার আর সেই ডাক্তারের কাছে যায় নি। এমনকি রাদকে কড়া ভাবে জানিয়ে দিয়েছে, সে যদি না বলে তাকে কোনো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়, তাহলে তার সাথে সব সম্পর্ক শেষ করে দেবে। রাদ বুঝতে পেরেছে আহি মুখে যতোই বলুক, সে আফিফকে ভুলতে চায়। কিন্তু তার মন আফিফকে ভুলতে চায় না। বরং আফিফকে কল্পনা করেই আহি সুখে থাকে।
(***)
আহি চুপচাপ অন্ধকারে বিছানায় বসে আছে। সে তার হাত এগিয়ে দিয়ে বলতে লাগলো,
“এআর, আমার হাতটা একটু ধরো। আমার চেয়ে বেশি কেউ তোমাকে ভালোবাসবে না। আমার ভালোবাসাটা একটু বোঝো। সবে তো চব্বিশ চলছে আমার। আরো কতো যুগ পড়ে আছে। আমি চারটা বছর তোমাকে ছাড়া থাকতে পারছি না। এতোগুলো যুগ কীভাবে পার করবো? ভালোবাসি, এআর। হয়তো তুমি সারাজীবন আমার কাল্পনিক প্রেমিক হয়ে থাকবে। তোমাকে একটু ছুঁয়ে দিতে গেলেই তুমি মেঘের মতো মিলিয়ে যাবে। আমি তোমাকে ছুঁয়ে দেওয়ার জন্য ছুটতেই থাকবো। কিন্তু তুমি কখনো আমার স্পর্শ পাবে না।”
আহি জানালার পাশে এসে বসলো। দুই পা জানালার বাইরে বের করে দিয়ে এক দৃষ্টিতে ল্যাম্পপোস্টগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হারিয়ে গেলো অতীতে।
………………………….
এক বছরের বেশি সময় ধরে আফিফকে চেনে আহি। সেদিন মাধ্যমিক বিভাগের পরীক্ষা শুরু হয়েছিল। প্রতি সপ্তাহের শুক্রবার সেই পরীক্ষাটা হতো। তাত্ত্বিক বিষয়ের পাশাপাশি চিত্রায়ণ, প্রাচ্যকলা, গ্রাফিক ডিজাইনের পরীক্ষা। কিন্তু আফিফ একটা পরীক্ষাও দেয় নি। আহি আফিফের সিটটা খালি দেখে মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষায় দিতে পারছিলো না। এক মাস পর মাধ্যমিক বিভাগের পরের সেশন শুরু হয়ে যায়। আর আহি তৃতীয় স্থান নিয়ে অন্য সেশনে ভর্তি হয়ে যায়। সে ধরেই নিয়েছিল আফিফকে দেখার জন্য তাকে পূর্ব সেশনের ক্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। কিন্তু তার ভাগ্য ভালো ছিল। আফিফ দ্বিতীয় সেশনেই ভর্তি হয়েছে। এরপর স্যার এসে সবাইকে বলল, আফিফের বড় বোন মারা যাওয়ায় সে পরীক্ষা দিতে পারে নি। পরে সে চারদিনের মধ্যে আলাদা ভাবে পরীক্ষা দিয়ে দ্বিতীয় সেশনে ভর্তি হয়েছে। সেদিন আফিফের মুখটা আরো বেশি ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। সে চোখ তুলে কারো দিকে তাকায় নি। মনে হচ্ছে সে মারাত্মক অপরাধী। এভাবে দু’মাস কেটে গেলো। শীগ্রই ক্যালিগ্রাফির প্রদর্শনী মেলা শুরু হবে। চারুশিল্পে প্রায়ই মেলা হয়৷ ছাত্র-ছাত্রীরা নিজেদের আঁকা ছবি বিক্রি করে টাকা আয় করতে পারে। বেশি ছবি বিক্রি করতে পারলে চারুশিল্প থেকেই তাকে পুরষ্কৃত করা হবে।
আফিফ দুই সপ্তাহ ক্লাসে না এসে সেই মেলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। দুই সপ্তাহ পর মেলায় আটটা ক্যালিগ্রাফি নিয়ে এলো আফিফ। প্রতি ক্যালিগ্রাফির দাম পাঁচশো টাকা। নিঁখুত ভাবে সে এঁকেছিল। রঙের মিশ্রণটাই বেশি সুন্দর ছিল। সালমা ফাওজিয়াও মেয়ের সাথে মেলায় এসেছিলেন। আহি তার মাকে বার-বার আফিফের ক্যালিগ্রাফিগুলো কিনে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করছিলো। এতো টাকা আহির হাতে সেই মুহূর্তে ছিল না। সে অন্তত একটা কিনতে পারবে। কিন্তু সালমা ফাওজিয়া তো মেয়ের অস্থিরতা বুঝতে পারছিলেন না। তিনি মেলায় ঘুরতে ব্যস্ত। আহি শেষমেশ নিজেই আফিফের স্টলের সামনে এসে বলল,
“আমি একটা কিনতে চাচ্ছি।”
আহির কন্ঠ শুনে আফিফ তার দিকে তাকালো। এই প্রথম তাদের চোখাচোখি হলো। আফিফের চোখাচোখি হতেই আহির অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। আফিফ নিজের হাতে কাগজে মুড়িয়ে আহিকে ক্যালিগ্রাফিটা দিয়ে দিলো। যতোক্ষণ আফিফ কাগজ ক্যালিগ্রাফিটা বাঁধায় ব্যস্ত ছিলো, ঠিক ততক্ষণ আহি তার দিকে তাকিয়ে ছিল। এতো কাছ থেকে আফিফকে দেখার সুযোগ সে হাতছাড়া করতে চায় নি। আহি ছয়শো টাকা দিয়ে চলে যেতে নেবে তখনই আফিফ পিছু ডেকে বলল,
“আপনি একশো টাকা বেশি দিয়েছেন।”
আহি আফিফের চোখে চোখ রেখে বলল,
“মাত্র পাঁচশো টাকা দিয়ে বিক্রি করছেন? এর মূল্য তো এর চেয়ে বেশি হওয়া উচিত।”
আফিফ নিরুত্তর ছিল। আহি মনে মনে বলল,
“আমার কাছে তোমার প্রতিটা জিনিসের মূল্য অনেক বেশি, এআর। টাকা দিয়েও এর মূল্য ঠিক করা যাবে না।”
এবার আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আফিফকে বলল,
“আমি এমন ক্যালিগ্রাফি অনেক খুঁজেছি। কিন্তু কোথাও পাই নি। তাই একশো টাকা বেশি দিয়েছি। কারণ আমি যা খুঁজছিলাম, তা আপনার জন্য সময়ের মধ্যে পেয়ে গেছি।”
আফিফ প্রতিত্তোরে মুচকি হেসে ধন্যবাদ দিলো। আহিও পেছন ফিরে চলে এলো। আফিফের দিকে আর তাকানোর সাহস নেই তার৷ আজকের এই চমৎকার দিন আহি কখনো ভুলতে পারবে না। এদিকে সালমা ফাওজিয়া মেয়ের কর্মকান্ড দেখছেন। একটা ক্যালিগ্রাফি কিনে তার মেয়ে এতো খুশি? তাও আবার সেই ছেলের কাছ থেকে, যার কাছ থেকে এতোক্ষণ ক্যালিগ্রাফি কেনার জন্য আহি জোরাজোরি করছিল। সালমা ফাওজিয়া মেয়ের খুশির জন্য আফিফের সব ক’টা ক্যালিগ্রাফি কিনে নিলেন। সব বিক্রি হওয়ায় আফিফের চোখেও অশ্রু ভীড় করছে। আহি তা দেখে মায়ের কাছে এসে তার হাতের উলটো পিঠে চুমু খেয়ে বলল,
“থ্যাংক ইউ মা। তুমি অনেক ভালো।”
সালমা ফাওজিয়া মেয়ের থুতনি ধরে বললেন,
“ছেলেটা কে?”
আহি লাজুক হেসে বলল,
“এখনো তো কেউ না। কিন্তু ও অনেক ভালো। ভালো ছবি আঁকে। বলতে পারো অতি উত্তম।”
সালমা ফাওজিয়া ভ্রূ কুঁচকে বললেন,
“তুমি কি এই ছেলের জন্য নামাজ ধরেছিলে?”
আহি মাথা নেড়ে বলল,
“হ্যাঁ, ও তো মসজিদে গিয়ে পড়ে। আমি দেখেছি, মা। ও বাবার চেয়েও ভালো। আমায় কখনো মারবে না।”
সালমা ফাওজিয়া মেয়ের কথায় থমকে গেলেন। আহিকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
“এভাবে বলে না, মা। তুমি আমার শাহজাদী। তোমার জীবনে যে আসবে সে তোমাকে সম্রাজ্ঞীর মতো রাখবে।”
(***)
আহি মায়ের সাথে বাসায় ফিরলো না। মায়ের হাতে ক্যালিগ্রাফিটা ধরিয়ে দিয়ে বলল, সে পরে বাসায় আসবে। সালমা ফাওজিয়া বাসায় ফিরে গেলেন। আহি আফিফের অপেক্ষায় বসে আছে। আফিফের সবগুলো চিত্র বিক্রি হয়েছে, তাই সে স্যারের সাথে কথা বলতে গিয়েছিল। স্যার তার নাম টুকে নিয়েছেন। আফিফ আজ ভীষণ খুশি। সে খুশি মনেই বের হয়েছে চারুশিল্প থেকে। আহিও তার পিছু নিয়েছে। আফিফ আজ বাসে উঠলো না। রাস্তার ওপাড়ে যেতে লাগলো। আহি ভ্রূ কুঁচকে আফিফের যাওয়া দেখছে।
ব্যস্ত রাস্তা। ট্রাফিক পুলিশও দেখা যাচ্ছে না। চারদিক থেকে গাড়ি আসা-যাওয়া করছে। আহি এক দৃষ্টিতে আফিফের দিকে তাকিয়ে আছে। অজানা ভয় তার মনে ভীড় করতে লাগলো। হঠাৎ চোখের পলকে একটা মিনি বাস এসে আফিফকে ধাক্কা দিলো। রাস্তা ব্যস্ত থাকায় গাড়ির গতি কম ছিল। নয়তো আফিফের শরীরটা হয়তো চাকার নিচেই পড়তো।
আহি এক মুহূর্তও সেখানে দাঁড়ালো না। দৌঁড়ে আফিফের কাছে গেলো। ততোক্ষণে রাস্তায় ভীড় জমে গেছে। মিনি বাসের ড্রাইভার যাত্রী রেখেই পালাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু যাত্রীরাই তাকে ধরে রেখেছে। রাস্তায় একটা হট্টগোল শুরু হয়ে গেছে। আহি চেঁচিয়ে বলল,
“আগে ওকে হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করুন।”
ভীড়ের মধ্যে আফিফের নড়নচড়ন না দেখে অনেকেই বলতে লাগলো,
“ছেলেটা হয়তো মারা গেছে।”
আহি আফিফের মাথাটা উঠিয়ে দেখলো মাথার পেছন থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। এভাবে রাস্তায় পড়ে থাকলে ক্ষতস্থানে সংক্রমণ হবে, তাই আহি আফিফের মাথাটা তার কোলে রাখলো। এরই মধ্যে আফিফকে উঠিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। আফিফের কাছে আজকে আয় করা টাকা আর একটা অল্প দামী ফোন ছিল। আহি সেখান থেকেই আফিফের মায়ের নম্বরে কল দিলো। তিনি বিশ মিনিটের মধ্যেই হাসপাতালে চলে এলেন।
(***)
আফিফের মাকে আহি প্রথম দেখছে। আহি তার হাতে আফিফের মানিব্যাগ আর মোবাইলটা দিয়ে বলল,
“আন্টি আমি উনার সাথেই চারুশিল্পে ক্লাস করি। আপনি চিন্তা করবেন না। উনি ঠিক হয়ে যাবেন।”
আফিফের মা, আফিফা বেগম আহির হাত ধরে কান্নাভেজা কন্ঠে বললেন,
“আমার ছেলেটা না বাঁচলে আমি শেষ হয়ে যাবো। ও ছাড়া আর কেউ নেই আমার।”
আহি আফিফা বেগমকে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বলল,
“আংকেল….”
আফিফা বেগম বললেন,
“সে তো অনেক আগেই মারা গেছে। তিন সন্তানকে আমি একাই মানুষ করেছি। আফিফ আমার মেজো ছেলে। আমার বড় মেয়েটা মারা গেছে বেশি দিন হচ্ছে না। এখন আফিফের কিছু হলে আমি বাঁচবো না।”
আফিফা বেগম নিজেই কান্নার সুরে বিড়বিড় করতে লাগলেন,
“আমার ছেলেটা বোনের সম্মান বাঁচানোর জন্য এভাবে পাগলের মতো টাকা জোগাড় করছিল। এখন ওকে বাঁচানোর টাকা আমি কোথা থেকে জোগাড় করবো?”
আহি বেসরকারি হাসপাতালে আফিফকে নিয়ে এসেছিল। হাসপাতালে যেই পরিমাণ খরচ হবে, তা জোগাড় করতেই আফিফা বেগম হিমশিম খেয়ে যাবেন। আহি সেটা বুঝতে পেরে বাসায় এসে মাকে জানালো। সালমা ফাওজিয়া মেয়ের সাথে হাসপাতালে এসে আফিফা বেগমের অগোচরেই কিছু টাকা জমা করিয়ে দিলেন। বাকি টাকা আফিফকে রিলিজ দেওয়ার পর দিতে হবে। আর ওষুধের টাকা তিনি আফিফা বেগমকে নিজ হাতেই দিলেন।
আফিফা বেগম নিরুপায়। হাত পেতে চাওয়া তার পক্ষে সম্ভব না। কিন্তু ছেলের জীবন বাঁচানো এই মুহূর্তে তার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই তিনি বিনাবাক্যে টাকাটা নিয়ে নিলেন। এখন আফিফের রিপোর্ট আসার পরই বোঝা যাবে তার অবস্থা কেমন।
এদিকে বাসায় আসার পর আহি তার পরণের জামাটা খুলে রেখে দিতেই সালমা ফাওজিয়া মেয়ের কাছে এসে বললেন,
“কি করছো, আহি? মুনিয়াকে জামাটা দিয়ে দাও। ও ধুয়ে দিক।”
আহি চকিত দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকালো। সে কোনো ভাবেই এই জামা ধুতে দেবে না। আফিফের রক্ত তার জামায় লেগে আছে। এই জামায় আফিফের স্পর্শ আছে। সে এটাতে ছিঁটেফোঁটা পানিও লাগাবে না। সালমা ফাওজিয়া মেয়ের হাত ধরে বললেন,
“আমার মনে হয় না তোমার বাবা এই সম্পর্ক কখনো মেনে নেবেন। আর তুমি এখনো ক্লাস টেনে পড়ো। তুমি অনেক ছোট। আগে বড় হও। তারপর এসব নিয়ে ভেবো।”
আহি মায়ের হাত ধরে বলল,
“আমার ওকে ছাড়া চলবে না মা। আমি ওকে ভালোবাসি।”
“আমি চাইলে তোমাকে বকা দিতে পারি। কিন্তু দেবো না। একটা কথা মনে রেখো, তোমার বাবার বিরুদ্ধে যাওয়া তোমার পক্ষে সম্ভব নয়। এখন তোমার জন্য সেই ছেলের কোনো ক্ষতি না হলেই হলো। তুমি বড় হলে আমার কথাটা ঠিক বুঝবে। আপতত তুমি ওর সাথে কোনো সম্পর্কে যেও না। ওকে ভালো একটা ভবিষ্যৎ গড়তে দাও। তুমিও নিজের পায়ে দাঁড়াও, যাতে নিজের ভালোবাসার জন্য সবার বিরুদ্ধে যেতে পারো। এমন একটা ক্যারিয়ার গড়ো, যাতে তোমার নাম তোমার বাবার চেয়েও উপরে থাকে। তখনই তুমি সব জয় করতে পারবে।”
………………….
আহির চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। মায়ের কথাটা ঠিক ছিল। বাবার চেয়ে উপরে না উঠলে, সে বাবার বিরুদ্ধে কখনোই যেতে পারবে না।
চলবে-
#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-১২||
১৭।
সূর্যোদয়ের আগমুহূর্তে আকাশটা তার অভূতপূর্ব রূপের প্রকাশ ঘটায়। নীরধর শব্দহীন তরঙ্গের খেলায় মেতে উঠে। তার ফাঁকে ফাঁকে দেখা যায় লালচে আভা। যেই আভা নীরধরের রূপ ঝলসে দেয়। আহি মেঘগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল,
“গগণের মেঘ আজ মিলেমিশে একাকার।
ভূমিতে বসে আমি তোমার ভাবনায় বেসামাল।
শিল্পী আজ রঙ হারিয়েছে, বে-রঙিন হাল তার।
তোমায় ছুঁতে এতো কারণ, তবে কেন হয়েছিলে আমার প্রিয় বর্ষাকাল?”
“একা একা কার সাথে কথা বলছো?”
রিজওয়ান কবিরের কণ্ঠ শুনে আহি চমকে উঠলো। পাশ ফিরে বাবাকে দেখে সে উঠে দাঁড়ালো। রিজওয়ান কবির আহিকে ইশারায় বসতে বললেন। আহিও চুপচাপ বসে পড়লো।
(***)
বাগানের বেঞ্চে রিজওয়ান কবির আর আহি পাশাপাশি বসে আছে। অনেকক্ষণ যাবত দু’জনই নীরব। আহি কখনোই তার বাবাকে অনর্থক বসে থাকতে দেখে নি। বাগানে বসলে তার হাতে পত্রিকা বা ফোন বা ল্যাপটপ যে-কোনো একটা থাকবেই। আজ তিনি হঠাৎ এমন শান্ত হয়ে কেন আহির পাশে বসে আছেন, এই প্রশ্নটাই এই মুহূর্তে আহির মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। অনেকক্ষণ পর নীরবতা ভেঙে রিজওয়ান কবির বললেন,
“তুমি অনেকদিন পর দেশে এসেছো। বন্ধুদের সাথে কোথাও ঘুরতে যাও।”
আহি ভ্রূ কুঁচকে রিজওয়ান কবিরের দিকে তাকালো। তিনি গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
“লিনাশার সাথে কথা হয়েছে?”
আহি মলিন হেসে বলল,
“সেই পরিস্থিতি তো আর নেই। আপনার জন্য আমি সবাইকে হারিয়ে ফেলেছি।”
“দেখো আহি, বন্ধুত্ব বলতে কিছুই নেই। সবাই শুধু প্রয়োজনে পাশে থাকে। তুমি নিজেই এর প্রমাণ দেখেছো। আমি কিছু করি নি। তোমার প্রিয় বান্ধবী যদি তোমার সাথে সম্পর্ক রাখতে না চায়, সেখানে আমার দোষ কোথায়?”
আহি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। রিজওয়ান কবির বললেন,
“তুমি যদি মনে করো, কেউ তোমাকে ভালোবাসে, এটা তোমার ভুল ধারণা। এই পৃথিবীতে তোমাকে কেউ ভালোবাসে না। তোমার মা তোমাকে রেখেই চলে গেছে। গত চার বছরে একবারো তোমার খোঁজ নেয় নি। লিনাশার সাথে কতো বার দেখা হলো। সে কখনো তোমার কথা জিজ্ঞেস করে নি। আর তোমার সেই বন্ধু… কি নাম যেন? রিদমাম রাদ। শোনো আহি, ছেলেরা কখনো বন্ধু হয় না। সে নিশ্চয় কোনো লোভে পড়ে তোমার আগে-পিছে ঘুরছে।”
আহি দাঁতে দাঁত চেপে হাত মুঠো করে রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতে লাগলো। রিজওয়ান কবির আবার বললেন,
“একমাত্র তাজওয়ার তোমাকে ভালোবাসে।”
আহি এবার রাগী স্বরে বলল,
“সে আমাকে ভালোবাসে না। তার পৃথিবীর সব মেয়েকেই ভালো লাগে। নিশ্চয় এর চেয়ে বেশি ভেঙে আপনাকে বলতে হবে না! আমি আপনার মেয়ে। কিন্তু আমার মনেই হয় না আমি আপনার আসল সন্তান।”
রিজওয়ান কবির বেঞ্চ ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
“তুমি আমার সন্তান, তাই তোমার উপর অধিকার প্রয়োগ করতে পারছি। জীবন আমার কাছে বিজনেস ফিল্ড। যেখানে প্রফিট আমরা সেখানেই আমাদের সম্পদ ইনভেস্ট করি। তাজওয়ারকে বিয়ে করলে তুমি একাই কোটি কোটি টাকার মালিক হবে। সাথে আমিও সেই অংশের ভাগ পাবো।”
আহি তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। রিজওয়ান কবির গম্ভীরমুখে বললেন,
“দুপুরের আগে তাজওয়ার এসে তোমাকে নিয়ে যাবে।”
আহি ভ্রূ কুঁচকে বলল, “কেন?”
“অবশ্যই তোমার সাথে সময় কাটানোর জন্য। এছাড়া আর কোনো কারণ তো থাকবে না।”
“বাবা, আমি ওর সাথে সেইফ না।”
“আই ডোন্ট কেয়া’র। সেইফ হও বা না হও। তোমার ডেস্টিনি তাজওয়ার খানই হবে।”
(***)
আড়মোড়া ভেঙ্গে সামনে তাকাতেই আহি চিৎকার করতে যাবে তখনই তাজওয়ার লাফিয়ে এসে আহির উপর উঠে তার মুখ চেপে ধরলো। আহি চোখ বড় বড় করে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে রইলো। তাজওয়ার আহিকে ছেড়ে আহির পাশে শুয়ে পড়তেই আহি ধাক্কা দিয়ে তাজওয়ারকে বিছানা থেকে ফেলে দিলো। তাজওয়ার মেঝেতে শুয়ে পায়ের উপর পা তুলে দু’হাত মাথার পেছনে দিয়ে বলল,
“ঘুমন্ত আহিকে দেখে আমার মাথা নষ্ট হয়ে গেছে। যাও আরেকটু ঘুমাও। আমি তোমাকে আরেকটু ভালোভাবে দেখবো।”
আহি বিছানার উপর দাঁড়িয়ে কোমড়ে দুই হাত রেখে চোখ ছোট করে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে রইলো। তাজওয়ারের ঠোঁটে হাসি। আহি চেঁচিয়ে ডাকলো,
“চাঁদনি! চাঁদনি…”
তাজওয়ার আহিকে চেঁচাতে দেখে আহির বিছানায় উঠে শুয়ে পড়লো। আহি লাফিয়ে বিছানা থেকে নেমে রাগী কন্ঠে বলল,
“তোমার এতো বড় সাহস, তুমি আমার রুমে আমার পারমিশন ছাড়া ঢুকেছ?”
“তোমার রুমে, তোমার মনে, এককথায় তুমি মানেই নো পারমিশন।”
এদিকে চুনি আহির ডাকে দৌঁড়ে তার ঘরে ঢুকে তাজওয়ারকে বিছানায় দেখে চোখ বড় বড় করে তাকালো। আহি চুনির চাহনি দেখে বলল,
“তুমি এভাবে কি দেখছো? আর এই ছেলে আমার রুমে কিভাবে ঢুকেছে?”
চুনি উত্তর দেওয়ার আগেই তাজওয়ার বলল,
“চাঁদ, তুমি যাও। আমি আমার মিসেসকে এক্সপ্লেইন করছি।”
তাজওয়ারের মুখে চাঁদ সম্বোধন শুনে চুনি সপ্তম আকাশে উঠে গেলো। সে যাওয়ার আগে নিচু স্বরে বলল,
“স্যার, আপনে ভালো ইংরাজি বলেন। আপনে ঘরে আইলে আমার লগে ইংরাজিতে কথা বইলেন। আমি ইংরাজি ছাড়া কিছু বুজি না৷ আপনেরে ইংরাজিতে একশো দিলাম।”
আহি চেঁচিয়ে চুনিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“তোমার ভাংরেজির বিজ্ঞাপন শেষ হলে এখান থেকে যাও।”
চুনি মুখ ছোট করে বলল, “আফাই তো ডাকলেন।”
তাজওয়ার মাথা নেড়ে বলল,
“একদম ঠিক। তুমি নিজে ডেকেই মেয়েটাকে বকে দিলে। আর ভাংরেজি মানে কি?”
আহি বলল, “ভাঙা ভাঙা ইংরেজি।”
“বাহ, তুমি কি শব্দ আবিষ্কারও করো না-কি?”
“এসব এপার-ওপারের কথা রেখে উত্তর দাও, এখানে কিভাবে এসেছো?”
তাজওয়ার গম্ভীরমুখে বলল,
“আমার ইয়াং মাদার-ইন-ল আমাকে তোমার রুমের চাবি দিয়েছিল। এখন থেকে চাবিটা আমার কাছেই থাকবে। আমার যখন ইচ্ছে আমি তখন তোমার কাছে চলে আসবো।”
“আমি দোয়েল ভাবী নই। তাই আমাকে স্পর্শ করার চেষ্টাও করবে না।”
আহির কথা শুনে তাজওয়ারের মুখটা লাল হয়ে গেলো। সে আহির বিছানা থেকে উঠে তার মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো। আহি শক্ত মুখে দাঁড়িয়ে আছে। তাজওয়ার হুট করে আহির গালে তার অধর ছুঁয়ে দিতেই আহি চমকে উঠলো। সে পিছু যেতে নিবে তখনই তাজওয়ার তার দুই বাহু শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
“আমি সরওয়ার খান নই। আমি তাজওয়ার খান। আর তুমি রক্ষিতা নও। তুমি আমার অভিমান।”
“যার কাছে এক নারী রক্ষিতা, তার কাছে অন্য নারী অভিমান হতে পারে না।”
“সব নারীকে ভালোবাসা যায় না। ভালো একজনকেই বাসা যায়।”
“আমি তোমার মতো অসভ্য লোকের ভালোবাসা চাই না।”
“তোমাকে চায়তে কে বলেছে? আমি চাইলেই হলো। এখন ঝটপট তৈরী হয়ে নাও।”
“হবো না।”
তাজওয়ার কপালে আঙ্গুল ঘষে বলল,
“আমি তো তোমাকে সরাসরি জোর করতে পারবো না। তবে ভিন্ন পন্থায় আমার ইচ্ছে পূরণ করেই ছাড়বো। তখন তোমার বাবা যদি কারো ক্ষতি করে বসে, তার জন্য তুমি আর তোমার বাবা দায়ী। আমি এর মধ্যে নেই।”
(***)
আহিকে একপ্রকার বাধ্য হয়েই তাজওয়ারের সাথে বের হতে হলো। গাড়িতে উঠেই তাজওয়ার আহির কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। আহি এক নজর ড্রাইভারের দিকে তাকালো। ড্রাইভার মনোযোগ দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে। তবুও আহির ইতস্ততবোধ হচ্ছে। সে বিরক্ত মুখে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে রইলো। তাজওয়ার আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“এভাবে তাকিয়ে থাকলে আমি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবো। তখন আশেপাশে কে আছে, কে নেই, এসব পরোয়া করবো না।”
আহি সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নিয়ে বাইরে তাকালো।আর তাজওয়ার মুচকি হেসে চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলো।
থেমে থেমে গাড়ি চলছে। মাঝে মাঝে হালকা জ্যামে পড়ছে। হঠাৎ গাড়িটা ঘুরে সেই রাস্তার মোড়ে ঢুকলো যেই মোড়ে অনেক বছর আগে আফিফের এক্সিডেন্ট হয়েছিল। আহির শরীর হঠাৎ কাঁপতে লাগলো। সে এক দৃষ্টিতে সেই স্থানটির দিকে তাকিয়ে রইলো যেখানে আফিফের শরীরটা নিথর পড়েছিল। তাজওয়ার মাথা তুলে আহির দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“তুমি ঠিক আছো?”
আহি তাজওয়ারের কাছ থেকে সরে বসে বলল,
“তুমি একটু দূরে থাকো। আমার দম বন্ধ লাগছে।”
তাজওয়ার গাড়ির কাচ নামিয়ে দিয়ে বলল,
“হাওয়া আসলে ভালো লাগবে।”
আহি ব্যস্ত রাস্তার দিকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইলো। তাজওয়ার আহির কোনো সাড়া না পেয়ে সোজা হয়ে বসে ফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
……………………………….
দু’মাস পর সুস্থ হয়ে আফিফ চারুশিল্পে ক্লাস করতে এলো। এই দু’মাস ছিল আহির কাছে দুই যুগের সমান। সে আফিফা বেগমের নম্বরে প্রতিদিন কল দিয়ে আফিফের খবর নিতো। আফিফা বেগমের এই উষ্ণতা ভালোই লাগতো। তিনি আহির অগোচরেই আহিকে পছন্দ করে ফেললেন। কোনো এক অচেনা মেয়ে তার ছেলের জন্য এতো চিন্তা করছে, ভাবতেই তার আনন্দ হচ্ছিলো। তিনি প্রতিদিন আফিফকে বলতেন,
“আজ মিষ্টি মেয়েটা কল দিয়েছে। তোর কথা জিজ্ঞেস করেছে।”
আফিফ কোনো উত্তর দিতো না। সে এতোটুকুই আন্দাজ করেছে এই মেয়েটা হয়তো সেই মেয়ে, যে তাকে চিরকুট দিয়েছিল, তার ছবি এঁকেছিল, আবার তার জন্য এক জোড়া স্যান্ডেল কিনেছিল, আর কিছুদিন আগেই মেয়েটা তাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। আফিফ মায়ের কাছে শুনেছে মেয়েটার মা এসে হাসপাতালের বিল দিয়ে গেছেন। আফিফের যখন রক্তের প্রয়োজন ছিল, তখন তারা দাতা জোগাড় করে এনেছিল। আফিফ এখন ভালোভাবেই জানে মেয়েটা তার সাথেই চারুশিল্পে ক্লাস করে। কিন্তু মেয়েটা কে, সেটা আফিফ এখনো জানতে পারে নি। তবে তার জানার আগ্রহটা ঠিকই বেড়ে গেছে। তাই আজ সে মেয়েটা কে তা জানার জন্য ক্লাস শেষে ক্যানভাস নিয়ে চারুশিল্পের মাঠে চলে গেলো। সেখানে বসেই রঙ মাখাতে লাগলো।
এদিকে আহি আফিফকে আজ মাঠে দেখে অবাক হলো। সে ধীর পায়ে তার দিকে এগুতেই আফিফ হঠাৎ পাশ ফিরতেই তাদের চোখাচোখি হয়ে গেলো। আফিফ আহিকে দেখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। কিন্তু আহি এখনো স্থির হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। আফিফ কেন দৃষ্টি সরাচ্ছে না, সেই প্রশ্নটাই এই মুহূর্তে আহির মনে ধাক্কা খেতে লাগলো। এভাবে আফিফ তাকিয়ে থাকলে সে তো নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবে। আহির চারপাশ কেমন যেন ঘোলা ঘোলা লাগছে। মনে হচ্ছে তার শরীর থেকে কিছু একটা বের হয়ে যেতে চাইছে। আহি নিজেকে স্বাভাবিক করে আফিফের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
“আপনি সেদিন আমার কাছে একটা ক্যালিগ্রাফি বিক্রি করেছিলেন, মনে আছে?”
আফিফ ভ্রূ কুঁচকে কিছু একটা ভেবে বলল,
“হ্যাঁ, মনে পড়েছে।”
“আমার মায়ের ভীষণ পছন্দ হয়েছে। তার জন্মদিনে তাকে গিফট করেছিলাম।”
আফিফ মৃদু হাসলো। আহি নিজেও মনে মনে হাসলো। সে কি সুন্দর করে মুখের উপর বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে বলে দিলো, আর আফিফ বুঝলোই না? আহি সেখানে আর দাঁড়ালো না। আফিফ যদি বুঝে যায় চিরকুটের মেয়েটা আহি? তাই নিজের আবেগ দমিয়ে রেখে সোজা সামনে চলে গেলো। চলে যাওয়ার সময় তার বার-বার ইচ্ছে করছিলো পেছন ফিরে তাকাতে। কিন্তু পিছু ফিরলেই সে ধরা খেয়ে যাবে। তাই সে হেঁটে চলে গেলো। সেদিন যদি আহি পিছু ফিরতো তাহলে দেখতে পেতো, আফিফ নামের প্রিয় পুরুষটি এক দৃষ্টিতে তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে ছিল।
(***)
আহি বাসায় এসে ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়লো। তার ঠোঁটে মিষ্টি হাসি। আজ আফিফ তার দিকে তাকিয়েছে। ইশ! এর চেয়ে চমৎকার মুহূর্ত হয়তো আহির জীবনে খুব কম এসেছে। আহি তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে উঠে তালা দেওয়া বক্সটি খুললো। পলিথিনে মুড়ানো আহির সেই জামা, যেখানে আফিফের রক্তের অস্পষ্ট দাগ এখনো বর্তমান। সালমা ফাওজিয়া জীবাণু ছড়াবে সেই ভয়ে জামাটা ধুয়ে দিয়েছিলেন। জামা ধুয়ে দেওয়ায় আহি দুই দিন খাওয়া-দাওয়া করে নি। শেষে সেই জামাটার গায়ে অস্পষ্ট যেই দাগ রয়ে গিয়েছিলো, ওটাকেই শেষ সম্বল করে আহি জামাটা বক্সে রেখে দিয়েছিল। এখন আহি সেই জামাটা পরেই ইজেলে নতুন ক্যানভাস বসালো। আর বসে পড়লো আজকের মুহূর্তটার ছবি আঁকতে।
খোলা মাঠে বসে একটা ছেলে ছবি আঁকার প্রস্তুতি নিচ্ছে, তার পাশে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর ছেলেটা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছে।
ছবিটা এঁকেই আহি বলল,
“এআর, এই ভালোবাসার নাম কি দেওয়া যায়?”
নিজের প্রশ্নে নিজেই হাসলো আহি। গানের সুরে বলল,
“রানী কো রাজা সে পিয়ার হো গেয়া…
পেহলি নাযার মে পেহলা পিয়ার হো গেয়া..
দিল জিগার রানী গায়েল হুয়ে
তেরে নাযার দিলকে পার হো গেয়া…
রানী কো রাজা সে পিয়ার হো গেয়া।”
…………………………….
আহির চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তেই তাজওয়ার তার গা ঘেঁষে বসলো। আহি চোখ মুছতে যাবে তখনই তাজওয়ার বলল, “কেন কাঁদছো?”
আহি তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমার একা থাকতে ইচ্ছে করছে। একটু সরে বসলে খুশি হবো।”
তাজওয়ার সরে বসতেই আহি আবার বাইরে তাকালো আর মনে মনে বলল,
“এআর, তুমি আমার জন্য ছবি হয়েই থাকবে। আর সেই ছবির নাম হবে রানীর অস্পর্শে রাজা।”
চলবে-
#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||বোনাস পর্ব||
১৮।
আহি মনোযোগ দিয়ে খাবারের মেন্যু দেখছে। আর তাজওয়ার আহিকে দেখতে ব্যস্ত। কতো মেয়ের সাথেই তার প্রেমের সম্পর্ক ছিল। এমনকি দু’জন মেয়ের সাথে এখনো তার সম্পর্ক আছে। দু’জনের মধ্যে একজন ভালোভাবেই জানে তাজওয়ার এই সম্পর্কে আগ্রহী নয়। কিন্তু টাকার লোভে সে তাজওয়ারকে ছাড়ছে না। আর অন্য মেয়েটা বোকাসোকা প্রকৃতির। বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে মেয়েটিকে প্রেমের ফাঁদে ফেলেছিল তাজওয়ার। আহি দেশে আসার পর অনেক চেষ্টা করেছিল সম্পর্কটা শেষ করতে। কিন্তু ছিঁচকাঁদুনী মেয়েটা তাজওয়ারকে ছাড়া পাগলপ্রায়। হুট করে ছেড়ে দিলে মেয়েটা নিশ্চিত উল্টাপাল্টা কিছু করে বসবে। আর এই মুহূর্তে তার ঘাড়ে মামলা উঠলে আহির মনে জায়গা পাওয়া আরো দুষ্কর হয়ে পড়বে। তাই সে ভেবেচিন্তে প্রতিটা পদক্ষেপ নিচ্ছে। অন্যদিকে আহির সাথে তার কোনো প্রেমের সম্পর্ক নেই। তবুও তাকে মুগ্ধ হয়ে দেখে তাজওয়ার। কোনো মেয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে তাজওয়ার কখনো মুগ্ধ হয় নি। এমনকি কোনো মেয়েই আজ পর্যন্ত তাজওয়ারকে উপেক্ষা করতে পারে নি। চেহারায় মোটামুটি আকর্ষণ থাকলেও তাজওয়ার যে কাউকে তার কথা দ্বারায় সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করতে পেরেছে। বোকাসোকা মেয়েরা তার কথার জালে সহজেই আটকা পড়ে যায়। আর ধূর্ত মেয়েদের কাছে তাজওয়ার খানের টাকাটাই আকর্ষণের বিষয়বস্তু৷ কিন্তু আহি এসবের ঊর্ধ্বে। তাই হয়তো তাজওয়ার আহির মায়ায় পড়ে গেছে।
এমনিতেই সহজে পেয়ে যাওয়া কোনো কিছুর মূল্য নেই। মানুষের আগ্রহ দুর্লভ বিষয়ের দিকেই একটু বেশি।
(***)
আহি মেন্যু একপাশে রেখে তাজওয়ারের দিকে তাকালো। তাজওয়ার এখনো আহির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আহি তা দেখে বিরক্তির সুরে বলল,
“অনেকক্ষণ ধরে খেয়াল করছি তুমি অসভ্যের মতো আমার দিকে তাকিয়ে আছো।”
তাজওয়ার বাঁকা হেসে বলল,
“অসভ্যের মতো তাকিয়ে থাকলে তুমি এই সভ্য রেস্টুরেন্টের পরিবর্তে কোনো হোটেল রুমে থাকতে।”
আহি তাজওয়ারের কথায় রেগে গেলো। সে উঠে চলে যেতে যাবে তখনই তাজওয়ার হাত ধরে বলল,
“তোমার কথার উত্তর দিলাম মাত্র। তুমি রেগে যাচ্ছো কেন?”
আহি হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু তাজওয়ার এতো সহজে এই হাত ছাড়বে না। হঠাৎ একটা হাত এসে তাজওয়ারের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলো। তাজওয়ার ভ্রূ কুঁচকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির দিকে তাকালো। এদিকে হাত ঢিলে হতেই আহি নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে পাশ ফিরে দেখলো রাদ দাঁড়িয়ে আছে। রাদকে দেখে আহি বলল,
“তুই এখানে?”
তাজওয়ার আহির সম্বোধনে স্বাভাবিক হয়ে উঠে দাঁড়ালো। রাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি আহির ফ্রেন্ড?”
রাদ আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, কিন্তু আপনি কে?”
তাজওয়ার আহির পাশে দাঁড়িয়ে তার কাঁধে হাত রাখতেই রাদ ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। তাজওয়ার আহির দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমি আহির উড বি হাজবেন্ড।”
আহি তাজওয়ারের হাত সরিয়ে দিয়ে রাদের পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“মোটেও না। এ হচ্ছে উড়ে এসে জুড়ে বসা শকুন।”
তাজওয়ার আহির কথা শুনে তার দিকে শীতল দৃষ্টিতে তাকালো। আহি তাজওয়ারের দৃষ্টি উপেক্ষা করে রাদের হাত জড়িয়ে ধরে বলল,
“চল, আমরা অন্য কোথাও গিয়ে বসি। বাবা আমাকে জোর করে এই লোকটার সাথে পাঠিয়েছে। আমার একদম ইচ্ছে ছিল না।”
তাজওয়ারের হাত মুঠো হয়ে এলো। সে আহিকে এক ঝটকায় নিজের কাছে টেনে এনে চাপা স্বরে বলল,
“তুমি বদ্ধ ঘরে আমাকে শত অপমান করো, আমি কিচ্ছু বলবো না। কিন্তু বাইরের মানুষের সামনে এমন ব্যবহার আমি একদম সহ্য করবো না।”
রাদ থমথমে কন্ঠে বললো,
“জোর করে কিছু পাওয়া যায় না মিস্টার ডট ডট ডট।”
তাজওয়ার আহিকে ছেড়ে দিয়ে রাদকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আই এম তাজওয়ার খান৷ মাইন্ড ইট। এন্ড ডোন্ট ডেয়া’র টু টাচ মাই লেডি।”
“মিস্টার ডট, ওপস সরি। মিস্টার তাজওয়ার খান, সি ইজ মাই ফ্রেন্ড। ইনফ্যাক্ট ভেরি ক্লোজ ফ্রেন্ড। সো ইউ ডোন্ট ডেয়া’র টু টাচ মাই ফ্রেন্ড উইদাউট হার পারমিশন।”
তাজওয়ার আর রাদ দু’জনেই রাগী দৃষ্টিতে একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে আছে। আহি শক্ত করে রাদের হাত চেপে ধরলো। কারণ রাদ রাগ নিয়ন্ত্রণ করে হয়তো আজকের দিনটা ভুলেও যেতে পারে। কিন্তু তাজওয়ার এই দিনটা মনে রেখেই রাদের উপর হামলা করতে দু’দন্ডও ভাববে না। হঠাৎ লাবীবের আগমনে থমথমে পরিবেশটা জেগে উঠলো। তাজওয়ার স্বাভাবিক হয়ে আহির পাশে বসে পড়লো। রাদ আর লাবীব তাদের মুখোমুখি বসেছে।
লাবীব এক গাল হেসে আহিকে টিটকারি দিয়ে বলল,
“ওই পলস, তুই একদিনেই আস্ত একটা টাল পটিয়ে ফেলেছিস!”
আহি চোখ বড় বড় করে লাবীবের দিকে তাকালো। তাজওয়ার কপাল ভাঁজ করে জিজ্ঞেস করল,
“টাল মানে?”
“মালের সভ্য সমার্থক শব্দ।”
তাজওয়ার হালকা হেসে বলল,
“এই শব্দ কি তুমি আবিষ্কার করেছো?”
“ইয়েস। জিনিয়াস না আমি?”
“ভীষণ।”
রাদ চাপা কন্ঠে লাবীবকে বলল,
“তোর মাথায় কি গোবর আছে?”
“আরেহ, দুলাভাইয়ের সাথে একটু মশকরা না করলে জমে না।”
“দুলাভাই না, এ বাংলাদেশের টপ ক্রিমিনাল সিরাজ খানের ছেলে।”
লাবীব চেঁচিয়ে বলে উঠলো, “কি?”
তাজওয়ার আর আহি লাবীবের দিকে অবাক চোখে তাকালো। লাবীব মাথায় হাত দিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে তাজওয়ারকে বলল,
“শ্রদ্ধেয় দুলাভাই, আপনি কি আমার নাম জানেন?”
তাজওয়ার মাথা নেড়ে বলল,
“না, তুমি বললেই তো জানবো।”
লাবীব আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আলহামদুলিল্লাহ। আমি চলি দুলাভাই। অনেক কাজ আছে আমার।”
লাবীব লাফিয়ে উঠে চলে গেলো। রাদ আহির দিকে তাকিয়ে রইলো। তাজওয়ার রাদকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“তোমার বন্ধু তো চলে গেছে। তুমিও এখন যেতে পারো। আসলে আমাদের একটু প্রাইভেসি দরকার।”
অনিচ্ছাসত্ত্বে এবার রাদকে উঠতে হলো।
(***)
মেজাজটা খারাপ হয়ে আছে রাদের। কি দরকার ছিল লাবীবের লাফিয়ে চলে আসার? এখন তার আহিকে বাধ্য হয়েই একা ছাড়তে হলো! রাদ নিচে নেমে লাবীবের কান মলে দিয়ে বলল,
“ওই মদন, চলে এলি কেন?”
লাবীব কানে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
“চলে আসবো না? গুম হয়ে যাবো না-কি! জানিস না, ওরা মানুষ গুম করে দেয়।”
“আহিকে নিয়ে একসাথে বের হতাম। আর ওই ছেলের সাথে আহিকে একা ছাড়ার কোনো মানেই হয় না। আমি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবো। যতোক্ষণ আহি বাসায় যাবে না, ততোক্ষণ ওর পিছু নিবো।”
লাবীব মুখ ছোট করে বলল,
“ভাই, এই আহি কি জিনিস রে!”
রাদ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “কি জিনিস মানে?”
“ওর পুরো চৌদ্দগোষ্ঠি ক্রিমিনাল। এই মেয়ে কোথা থেকে পদ্মফুল হয়ে সেই গোবরে জন্ম নিলো, বুঝলাম না।”
রাদ বিরক্তির সুরে বলল,
“তুই কিছু বুঝবিও না। তোর মতো মাথা মোটা যেখানেই যাবে, সেখানেই একটা না একটা ভেজাল করে আসবে।”
চলবে-