#উদাসীনী (২)
লেখনীতে – Ditipriya Roy
প্রভাতের আলো ফুটতেই ঘুম ভেঙে যায়।আড়মোড়া ভেঙে জানালার পর্দা খুলে দেই। তারপর ফ্রেশ হয়ে রান্না ঘরে চলে যাই। তেলের বোতলে তেল নেই দেখে চোখের কোণে অশ্রু চলে আসে। আমার কাছে টাকাও নেই সেরকম, যে টা আছে এই কয়েক দিন চলতে হবে। বাবার শরীর টাও সেরকম ভালো নেই। সব কিছু ভেবে চোখের অশ্রু মুছে নিয়ে ভাতের মধ্যে আলু দিয়ে দেই। আলু ভর্তা আর ভাত নিয়ে বাবা রুমে চলে যাই।
বাবা খাবে না উঠে বসো।”
–হ্যাঁ,রে মা তুই আজকে কলেজে যাবি।” যেতে তো হবে আজকে নাকি নতুন স্যার আসবে তাই সবাইকে উপস্থিত থাকতে বলেছে। তুমি খেয়ে নেও ওষুধ খেতে হবে তো। খাওয়ানোর পর ওষুধের বক্সে হাত দিয়ে দেখি ওষুধ শেষ, বুকটা কেমন মোছর দিয়ে উঠলো। যেটা ছিলো ওটাই বাবাকে খাইয়ে দিয়ে ওষুধের বক্সটা লুকিয়ে রাখি যাতে দেখতে না পায়। মনের মধ্যে বিষন্নতা ছোঁয়া তাই না খেয়েই কলেজের দিকে রওনা দেই।”
— কলেজে এসেই অলক আর হাসির সাথে দেখা। এগিয়ে গিয়ে তাদের সাথে কথা বলি। কলেজে এই দুইটা মানুষ আমাকে খুব ভালোবাসে। ক্লাসে গিয়ে থার্ড ব্রেঞ্চে বসে পড়ি হাসি আর আমি।”
–একটু পর ক্লাসে স্যারের সাথে চেনা একটা মানুষ ঢুকে পরে। আমি থ মেরে সেই লোকটার মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে আছি।” হাসি পিঠের মধ্যে কিল বসিয়ে দিয়ে বলে,
— ওভাবে কি দেখিস, মুখের মধ্যে মাছি ঢুকে যাবে। তখনি আমি নিজের মধ্যে চলে আসি। প্রিন্সিপাল স্যার পরিচয় করিয়ে দেন।”
–তোমাদের নতুন স্যারের নাম হচ্ছে ফারহান তানভীর চৌধুরী। তিনি তোমাদের পদার্থবিজ্ঞান ক্লাস নিবেন। এবং স্যার চাইছেন আজকে থেকেই ক্লাস নিতে। তোমরা যারা পদার্থবিজ্ঞানের স্টুডেন্ট আছো তোমরা কি চাও বলো?
— হ্যাঁ স্যার আমরা ক্লাস করবো।” প্রিন্সিপাল স্যার সবার উদেশ্য বলে,ঠিক আছে স্যার কে আমি ক্লাসটা দেখিয়ে দিচ্ছি তোমরা চলে এসো। এই বলে ক্লাসরুম ত্যাগ করে।
— আমি দুইবার স্যারের নাম মনে মনে বলে নেই ফারহান তানভীর। স্যারের সাথে একবার চোখে চোখ পরেছিলো,সাথে সাথে চোখ টা নামিয়ে নেই। কারণ ভয়ে আমার গা কাঁপছে, কিন্তু কেনো কাঁপছে তা আমি জানি না।হাসি কে রেখে অলকের সাথে গেলাম। ক্লাসে ঢুকতে সাহস পাচ্ছি না অলক পিছন থেকে ঠেলছে। ” কি রে উদাসী চল না।” আমার কেমন যেনো ভয় লাগছে রে।
–তোকে যেতে হবে না আমি যাচ্ছি। ” অলকের পিছন পিছন রুমে ঢুকে সেকেন্ড ব্রেঞ্চে বসে পরি। ক্লাসে ২০ জন শুধু স্টুডেন্ট, তাই খুব ভালো করেই সবার মুখশ্রী গুলো দেখা যাচ্ছে।”
–তোমরা সবাই কেমন আছো?”
–আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি স্যার।আপনি কেমন আছেন?”
— আলহামদুলিল্লাহ আমিও ভালো আছি। তো তোমাদের সাথে পরিচয় হই কি বলো তোমরা?
— হ্যাঁ স্যার।”
— তাহলে এক এক করে তোমাদের নাম বলো আর কার কি স্বপ্ন এটাও বলবে?” কথা টা বলেই বুকে হাত গুঁজে নিলেন। এক এক করে সবাই বলে ফেললো বাকি থাকলাম আমি। একটা শুঁকনো ঢোক গিলে জবাব দিলাম,
— আমার নাম উদাসীনী। আমার স্বপ্ন আমি ডাক্তার হবো।” সবাই কথাটা শুনে হাসতে শুরু করলো। সবার হাসি দেখে মাথা নত করে নিলাম। পরক্ষণে অলক সবার উদেশ্য করে বলে,
–এখানে হাসার কি আছে, একটা মানুষের স্বপ্ন থাকতেই পারে৷ গরিব বলে যে স্বপ্ন দেখতে পাবে না কোথাও কি লেখা আছে।” অলকের কথা শুনে সবার হাসি বন্ধ হয়ে যায়। পাশের একটা মেয়ে বলে, স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই রয়ে যাবে পূরণ আর হবে না।”
— স্যার শান্ত কন্ঠে বলে, বসে পরো। আমি একবার স্যারের দিকে তাকিয়ে বসে পরলাম।”
— জীবনে কারা প্রকৃত বন্ধু জানো,যারা দুঃসময়ে পাশে থাকে। মনে মধ্যে সাহস জোগাবে, সবাই বিপরীত পার্শ্বে চলে গেলেও তোমার বন্ধু তোমার পাশে থাকবে। ঠিক তেমনি উদাসীনী আর তোমার নাম যেনো কি?
— অলক স্যার।”
–ওদের বন্ধুত্ব টাও সে রকম। তোমরাও তো উদাসীনীর ফ্রেন্ড তাহলে ওকে নিয়ে উপহাস কেনো করো। জীবনে একজন ভালো মানুষ হতে গেলে কাউকে নিয়ে উপহাস করবে না। এটা যেমন ধর্মের দিক দিয়ে খারাপ ঠিক তেমনি একজন আদর্শ মানুষ হতে বেঘাত ঘটায়।”
–আর উদাসীনী ক্লাস শেষে আমার সাথে দেখা করবে।
স্যার কিছু পড়া বুঝিয়ে দিয়ে হোমওয়ার্ক দিলেন।” এখন মস্তিষ্কে একটাই কথা, স্যার আমাকে কেনো ডাকলেন।”
–গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেলাম স্যারের রুমের দিকে।
দপ্তরি চাচা স্যারের জন্য কফি নিয়ে যাচ্ছেন। আমাকে দেখে বলে, উদাসীনী তুই এখানে কি করিস মা।চাচার প্রত্যুত্তরে জবাব দিলাম,স্যার ডেকেছেন তাই আর কি। ” ওহ তুই এখানে থাক স্যার কে গিয়ে বলি।” স্যার আপনার কফি।
— টেবিলে রাখো। ” স্যার আপনি নাকি উদাসীনী মারে ডাকছেন।
— হ্যাঁ, পাঠিয়ে দেও।
— চাচা ভিতরে যেতে বললে, দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ভিতরে ঢুকে যাই। ” স্যারের দিকে দৃষ্টি যেতেই চোখে চোখ পড়ে যায়। দৃষ্টি সরিয়ে গুটিসুটি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি আর মনে মনে বললাম,”আরে আমার হাত পা কেনো কাঁপছিস।
— সাপের মতো আঁকাবাকা হয়ে না দাঁড়িয়ে চেয়ারে বসো।”
— চুপচাপ চেয়ারে গিয়ে বসে পড়লাম।
— এই নেও বিস্কুট খাও।”
— আমি একবার মুখ তুলে তাকিয়ে আবার মাথা নত করে ভাবছি, ভয়ে আমার মাটির নিচে ঢুকে যেতে ইচ্ছে করছে আর স্যার আমাকে বিস্কুট খেতে বলছে। স্যারের বিস্কুট খাবো এই সাহস কি আছে রে উদাসী।
— কি হলো নেও। ”
— স্যারের এমন কথা শুনে চমকে উঠলাম। আসতে আসতে মুখটা তুলে হাত বাড়িয়ে একটা বিস্কুট নিলাম।
বিস্কুট কামড় দিতেই স্যার বললেন,
— টিউশনি করাবে।”
— টিউশনি করাটা তো আমার জন্য জরুরি। তাই মাথা ঝুঁকিয়ে হ্যাঁ বলে দিলাম।”
— আজকে বিকালে চৌধুরী বাড়িতে চলে এসো।”
— ঠিক আছে স্যার, আমি এখন যাই।”
— যাও।”
— কলেজ ছুটি দিলে হাসি আর অলকের সাথে গল্প করতে করতে বেরিয়ে পরি। হাসি আর অলক আমার সাথে যেতে চাইলে আমি তাদের কে মানা করে দেই।
— ওরা চলে গেলে ওষুধের দোকানের দিকে যাই। কলেজের পাশেই বাজার। সেখানে গিয়ে আবার বিপদ। কারণ সামনে স্যার দাঁড়িয়ে আছে। অল্প একটু ফাঁক, পিছন ঘুড়লেই দেখতে পাবে। এখান থেকে পালাতে চাইলে তা আর সম্ভব হয়ে উঠে না।” স্যার দেখে ফেলেছে আর ডাকছে।
–উদাসীনী এদিকে আসো।
–অনিচ্ছা থাকা সত্যেও স্যারের কাছে গেলাম।
–চাচা আমাকে দেখা মাত্রই বলে দেয়, কি রে তোর বাবার ওষুধ শেষ হয়েছে বুঝি। আগের কিন্তু ৫০০ টাকা বাকি রয়েছে।
— চাচা কথা গুলো শুনে বুকের ভিতরে খুব কষ্ট হচ্ছে। খুব জোড়ে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে, কেনো আল্লাহ, তুমি আমাকে এরকম পরিস্থিতির মধ্যে কেনো ফেলে দেও। ” নিজেকে কোনো রকম সামলিয়ে নিয়ে চাচা কে বললাম,
— চাচা আমার কাছে ৫০০ টাকা আছে এটা রেখে দেও। টাকা হলে আমি ওষুধ নিয়ে যাবো।”
–কোথায় পাবি টাকা,তোর বাবার প্রতিবন্ধী ভাতা এখনো দেড়ি আছে। ওষুধ না খেলে তোর বাবা বেশি করে অসুস্থ হয়ে পরবে তখন কি করবি৷ এই সব কিছুর জন্য তোর মা দায়ী।
— থাকনা চাচা এসব কথা, এই নেও তোমার টাকা। স্যার আমি চলে যাই।” চাচা স্যারের উদ্দেশ্য বললেন” স্যার আপনার গ্যাসের টেবলেট।
— দাঁড়াও উদাসীনী। তোমার বাবার ওষুধ নিয়ে যাও।”
— স্যার আমার লাগবে, বাড়িতে টাকা আছে এসে নিয়ে যাবো না হয়। আমি এখন আসি।”
— উদাসীনী আমি কিন্তু তোমার স্যার। স্যারের কথা অমান্য করছো তুমি। নিয়ে যাও ওষুধ। চাচা ওকে ওর বাবার ওষুধ গুলো দিয়ে দেন।”
— এই নে উদাসী ওষুধ।” স্যারের কথা আর অমান্য করতে পারলাম না। ওষুধ গুলো নিয়ে সেখান একমুহূর্ত আর না থেকে প্রস্থান ত্যাগ করলাম। বাড়িতে এসে ফ্রেশ হয়ে সব কাজ সেরে নিয়েছি। তারপর দোকান থেকে তেল নিয়ে এসে তরকারি রান্না করে নেই। বাবা মেয়ে মিলে খেয়ে নেই। রওনা দিলাম চৌধুরী বাড়ির দিকে জানি না আমার জন্য কি অপেক্ষা করছে।
— বড় গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছি। দারোয়ান চাচা কে বললাম স্যার আমাকে ডেকেছে। তিনি প্রত্যুত্তরে বললেন, আমি স্যার কে ফোন করে বলছি।
ফোনে কথা বলে আমাকে ভিতরে যেতে বললেন।”
— ভিতরে গিয়ে দরজায় কলিং বেল বাজালাম। দরজাটা খুলে দিলেন একজন মহিলা। সাথে একটা ৮ বছরের একটা মেয়ে। আমাকে দেখা মাত্রই বললো, তুমি কি উদাসীনী।” শঙ্কিত কন্ঠে উত্তর দিলাম, হ্যাঁ।”
— আসো ভিতরে, আমার এই ছোট মেয়েটাকে পড়ানোর জন্য তোমাকে আসতে বলেছিলো ফারহান।
তারপর ভিতরে ঢুকে এক বৃদ্ধ মহিলাকে দেখতে পেলাম। তিনি বসে টিভি দেখছিলেন। আমাকে একটা রুমে নিয়ে যায়, সেখানেই মেয়েটাকে পড়াবো। কিন্তু আশেপাশে স্যারকে দেখতে পেলাম না। ছোট মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার নাম কি?”
–নূর। ”
–তুমি দেখতে অনেক মিষ্টি।”বই বের করো পড়া শুরু করি।”
— তুমিও অনেক কিউট দেখতে, আমার মিষ্টি আপু।” পড়ানো শুরু করলাম, পড়ার মাঝখানে নূরকে বললাম, আচ্ছা স্যার কেথায়?” ভাইয়া তো ল্যাপটপে কাজ করছে। ভইয়া দরকার ছাড়া রুমের বাইরে বের হয় না। ভইয়াকে প্রচুর ভয় পাই জানো। আম্মু তো বলেছিলো ভাইয়ার কাছে পড়তে, আমি মানা করে দিয়েছি। কাল রাতে ভাইয়া বলছে আমাকে পড়ানোর জন্য একটা মেয়ে আসবে আর সেটা তুমি। কথা গুলো বলেই হাসতে শুরু করলো।”
#চলবে