উত্তরাধিকার (৭ম পর্ব)

0
1224

উত্তরাধিকার (৭ম পর্ব)
লেখাঃ-মোর্শেদা রুবি
***********************
প্রিয়ন্তী কোনোভাবেই মনকে বোঝাতে পারছেনা যে,ইট ওয়জ আ গেইম।
ফ্রিক ব্যপারটাকে যতই হালকাভাবে নিক না কেন প্রিয়ন্তী বিশ্বাস করে শরীরের সাথে মনের একটা গভীর সম্পর্ক রয়েছে।শরীর হলো মনের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ!বরং মনের ইচ্ছা অভিলাষ বাস্তবায়নের মাধ্যমই হলো শরীর।সেখানে ফ্রিক কিভাবে বলতে পারে তার প্রিয়ন্তীর প্রতি কোনো ইন্টারেষ্ট নাই?
চলে আসার আগের দিন প্রিয়ন্তী ফ্রিককে জিজ্ঞেস করেছিলো যে,সে প্রিয়ন্তীকে ভালোবাসে কিনা বা বিয়ে করতে চায় কিনা।ফ্রিক প্রবল বিস্ময়ে ভাঙ্গা বাংলায় বলেছিলো-“এই তোমরা এশিয়ানরা বড্ড বেশী ইমোশনাল।তোমাকে দেখে ভালো লেগেছে এন জাষ্ট আই টুক দ্যা টেষ্ট, দ্যাটস ইট।আ’ম স্যরি টু সে,সারাজীবনের সঙ্গী বানাবার মতো ম্যাটেরিয়াল তোমার মাঝে নাই!তাছাড়া যেখানে আমি নিত্য নতুন গার্লফ্রেন্ড পাচ্ছি সেখানে কোনো একজনকে পায়ের বেড়ী বানাবার কোনো কারন তো দেখিনা।”
প্রিয়ন্তীর চোখে পানি চলে এসেছিলো ওর কথাগুলো শুনে!নিজেকে একটা সস্তা ছেঁড়া কাগজ মনে হচ্ছিলো ওর !
ফ্যাসফ্যাসে কন্ঠে বলেছিলো-“দেন হোয়াই ডিড ইউ টাচ মি?আমার সতীত্ব হরণের সময় তোমার মনে ছিলোনা, আমি আরেকজনের স্ত্রী?”
-“সতীত্ব?হোয়াট ইজ ইট?আ’ থিঙ্ক সতীত্ব ইজ আ সিলি ইস্যু লাইক আ ওয়েট ট্যিসু…হা হা হা!”
প্রিয়ন্তী চোখ মুছে বলেছিলো-“আমি আমার স্বামীর সামনে দাঁড়াবো কি করে?”
-“কেন,তাকে তো এসব বলার কোনো দরকার দেখিনা!দেশে যাও…গিয়ে ধুমসে সংসার কর অথবা এখানে ফিরে এসো ,দুজনে হেসেখেলে জীবনটা কাটিয়ে দেই!বাধাবন্ধনহীন জীবন! বাট স্যরি, নো ম্যারিজ এটসেটরা ওকে?”
প্রিয়ন্তী যা বোঝার বুঝে গিয়েছে।ফ্রিক অতি আধুনিক যুগের আধুনিক মনের মানুষ।সে এখন পুরোদমে অষ্ট্রেলিয়ান।ওর কাছে প্রিয়ন্তী এখন এশিয়ান।
বাঙালী সেন্টিমেন্ট ওর মাঝে নেই!ইসলাম বা মুসলিম শব্দ দুটো তো ওর কাছে পুরোপুরি অচেনা।ওর মনে রোজ কেয়ামতের ভয় নেই।কিন্তু প্রিয়ন্তী কি করবে!মনকে যে বহুবার বোঝাতে চেষ্টা করেছে যা হয়েছে ভুলে যাও,ফিরে গিয়ে রাফিজের সাথে সংসার শুরু করো!
কিন্তু রাফিজ আর তার মাঝখানে এখন নাযিয়াত নামের মেয়েটা আছে যে তাকে অনবরত আখেরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।এক অজানা ভয়ে প্রিয়ন্তী শিউরে উঠে।
গতরাতে শোবার আগে জীবনে প্রথমবারের মতো সেই অদৃশ্য অথচ মহাক্ষমতাধর প্রতাপশালী বাদশার দরবারে হাত তুলে বলেছিলো!আমাকে শান্তি দাও।অন্তর্দহনে যে আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি!আমি কি করবো?আমাকে পথ দেখাও!কাউকে বলতে পারছিনা আমার কষ্টের কথা।তোমাকেই জানালাম।তুমি আমার কষ্ট দুর করে দাও!”
বাকী রাতটা আর ঘুমাতে পারেনি প্রিয়ন্তী।সবার অগোচরে ওর জীবনে ঘটে যাওয়া এক নিরব বিপর্যয় ওকে ঘুমাতে দেয়নি!

***
***

সন্ধ্যার পরপরই ওরা প্রিয়ন্তীদের বাড়ী চলে এলো!নাযিয়াতকে দেখে প্রিয়ন্তী চোখ নামিয়ে নিলো!এক অদৃশ্য বাধা ওকে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে ধরেছে।নাযিয়াতই সালাম দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলো!ওর স্পর্শে প্রিয়ন্তীর মনে পাপবোধ যেন আরো বেশী জেগে উঠলো!নিজেকে অচ্ছ্যুৎ মনে হচ্ছে ওর কাছে!
রাফিজ ওদের পাশ কাটিয়ে ভেতরে চলে গেলো!প্রিয়ন্তী রাফিজের দিকেও তাকাতে পারলোনা!
নাযিয়াত প্রিয়ন্তীর মা’কে সালাম দিয়ে মুসাফাহার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলো!শাজিয়া ভদ্রতা রক্ষার্থে কোনোরকমে সালামের জবাব দিয়ে হাতটা ছুঁয়েই ছেড়ে দিলেন!
প্রান্তিক খুবই আন্তরিকভাবে রাফিজকে দরাজ গলায় সালাম দিয়ে কোলাকুলি করে মুসাফাহা করলেন।পেছনে আপাদমস্তক কালো কাপড়ে আবৃতা রমনীকে দেখেই বুঝলো যে,ইনিই তাহলে রাফিজের নাযিয়াত।মাশাআল্লাহ্,প্রিয়ন্তীর ওর কাছ থেকে কিছু শেখা উচিত।প্রান্তিক ওদের দুজনকে দেখে মনে মনে রবের দরবারে ওদের অটুট বন্ধনের জন্য দু’আ করলো!
রাতে খাবার দাবারের সময়ও শাজিয়া কৌশলে নাযিয়াতকে সুক্ষ্মভাবে অপমানের চেষ্টা করলো!
নাযিয়াত তখন ভেতর ঘরে বোরকা খুলে মেয়েদের সাথে খেতে বসেছে।
অমনি শাজিয়া এসে পেছন থেকে নাযিয়াতকে ধরে বললেন-“তুমি একটু পরে বসো মা,তুমি তো আমাদের ঘরেরই মেয়ে,বাইরের ওরা খেয়ে নিক,কেমন?”
নাযিয়াত মৃদু হেসে উঠে পড়লো-“কোনো সমস্যা নেই আন্টি!”
নাযিয়াত অপমানটা গায়ে মাখলো না কেবল মনে মনে -“ক্বুলিল্লাহুম্সা মালিকাল মুলকি তু’তিল মুলকা মানতাশা.উ….থেকে বিগয়রি হিসাব”….পর্যন্ত আউড়ে গেলো!যার সংক্ষিপ্ত ভাবানুবাদ এই,সম্মান আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে।যাকে ইচ্ছা আল্লাহ সম্মাণিত করেন,যাকে ইচ্ছা অপদস্থ করেন,যাকে ইচ্ছা অপরিমিত রিযিক দান করে থাকেন(সুরা আলে ইমরান)!
এই আয়াতটি পাঠ করলে নাযিয়াতের মনে এক ধরনের প্রশান্তি কাজ করে। আর মনে হয় যা হচ্ছে তাতে আল্লাহর ইচ্ছে শামিল রয়েছে!
নাযিয়াত উঠে দাঁড়ানোর সাথে সাথেই প্রিয়ন্তীর বাবা ঘরে ঢুকে এসব দেখে শাজিয়ার উপর ক্রোধে প্রায় ফেটে পড়লেন-“বাইরের কে আছে এখানে যে তুমি ওকে তুলে দিলে?তোমার আক্কেল বলে তো কিছু আগেও ছিলোনা এখনো নাই!”
বলে নাযিয়াতের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে ক্ষমা চেয়ে বললেন-“তুমি কিছু মনে করোনা মা!বসো…বসো!”
শাজিয়া চুপসে গেলেন।
প্রিয়ন্তীর বাবার এই এক স্বভাব,মানুষজন দেখেনা,হাউ হাউ করে চিৎকার শুরু করে দেয়।তিনি তৎক্ষণাত কিছু বললেন না!
পরে বারান্দায় আড়ালে এলে চাপা অথচ ঝাঁঝালো স্বরে শাজিয়া প্রিয়ন্তীর বাবাকে ধরলেন-“এই যে শোনেন,ঐ মেয়েটার জন্য দরদ একবারে উথলে উঠলো যে বড়?সে আপনার কোন জনমের মেয়ে যে সবার সামনে আমাকে অপমান করলেন?”
-“সে আমাদের মেহমান শাজিয়া!অন্তত আজকের দিনে তার সাথে তুমি এমন করতে পারোনা!”
শাজিয়া কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই পেছন থেকে প্রান্তিক বলে উঠলো-“যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস করে সে যেন তার মেহমানকে সম্মান করে!” বিষয়টা কতটা মারাত্মক ভেবে দেখেছো মা!তোমার চরম শত্রুও যদি তোমার ঘরে মেহমান হয়ে আসে তার অপমান করা তো দুরে থাক্ অনাদরটুকু করার অনুমতি নেই,করলে তুমি আল্লাহ ও আখিরাতে অবিশ্বাসী বে-ঈমান হয়ে যাবে”!
শাজিয়া মুখ ঝামটা দিয়ে চলে গেলেন সেখান থেকে!
বিদায় নেবার সময় সবাইকে বিস্মিত করে দিয়ে প্রিয়ন্তী হঠাৎ বেলাকে বলে উঠলো-“আমি কিছুদিন আম্মুর কাছে থাকতে চাই মা!”
শাজিয়া অবাক হয়ে মেয়ের দিকে তাকালেন-“সে কি রে,এতদিন পরে এলি।দুটো দিন ও বাড়ী হয়ে আয় তারপর নাহয় আমার কাছে এসে থাকিস।”
রাফিজ দ্রুত বলে উঠলো-“আমি তোমাকে যাবার জন্য চাপাচাপি করবোনা,আম্মার কাছে থাকতে চাইছো থাকো যেদিন ইচ্ছে হবে ফোন দিয়ো,এসে নিয়ে যাবো!”
প্রিয়ন্তী বুঝলো রাফিজ ভদ্রতা রক্ষার্থে কথাগুলো বলেছে!
নাযিয়াত প্রিয়ন্তীর হাত চেপে ধরে বললো-“তুমি এলে ভালো হয় প্রিয়ন্তী ,তাহলে আমি কিছুদিন আমার মায়ের ওখানে বেড়িয়ে আসতে পারতাম।আমি ভাবলাম তুমি আজই যাবে আমাদের সাথে।চলো না প্রিয়ন্তী!”
প্রিয়ন্তী নাযিয়াতের দিকে তাকিয়ে বললো-“না..না..আমার ক’টা দিন মায়ের কাছেই থাকার ইচ্ছা।তুমি মনের ওপর কোনো চাপ নিওনা!তোমার উপর আমার কোনো রাগ নেই!”
নাযিয়াত এর পরেও বারদুয়েক অনুরোধ করলো প্রিয়ন্তীকে যাবার জন্য,শাজিয়াও চাপাচাপি করলেন কিন্তু প্রিয়ন্তী যেন না যাবার পণ করেছে।
বেলা কিছু বললেন না,কেবল তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে প্রিয়ন্তীর দিকে তাকিয়ে রইলেন।
শুধু রাফিজ একবার সুযোগ মতো পেয়ে নাযিয়াতে কনুই আঁকড়ে ধরে বলেছে-“তুমি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছো!সে যেতে চাচ্ছেনা তারপরেও জোর করছো কেন?”
নাযিয়াত কোনো উত্তর দেয়নি!


ওরা চলে যাবার পর শাজিয়া প্রিয়ন্তীকে ধরলেন-“তুই গেলি না কেন?তোর অনুপস্থিতিতে ওই মেয়ে তো সুখের সংসার পেতে বসেছে!তুই আমার বাড়ী মুখ কালো করে পড়ে থাকবি আর ঐ মেয়ে উড়ে এসে জুড়ে বসে তোর সংসারে রাজত্ব করবে, এটা আমি মা হয়ে বসে বসে দেখবো ভেবেছিস?”
প্রিয়ন্তী দ্রুত শ্বাস নিচ্ছে কিন্তু কোনো কথা বলছে না!
শাজিয়া বুঝলেন,মেয়ে তার সংসারে ফিরে যেতে চায় কিন্তু নাযিয়াতের জন্য পারছেনা!তিনি মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন-“আমি জানি,তুই নিজের সংসারে ফিরে যেতে চাস কিন্তু ঐ চালাক মেয়েটার জন্য পারছিস না।আমি সব বুঝি।তুই ভাবিসনা,আমার বান্ধবী শায়লা এসব অনেকদিন থেকে করছে! ও এসব কাজে ওস্তাদ বলতে পারিস!ও তো বলেছে,কিছুদিনের মধ্যেই নাযিয়াতকে ওই বাড়ীছাড়া করবে।রাফিজের মনে….
এমন সময় প্রান্তিক ঘরে প্রবেশ করায় কথাবার্তা বন্ধ হয়ে গেলো শাজিয়ার।
ছেলের সামনে এসব কথা বলতে চান না তিনি!এমনিতেই একরোখা ছেলে তার উপর যে কথা বলেছে তাতে শাজিয়ার হার্ট এ্যাটাক হতে বাকী ছিলো!ওকে দেখে শাজিয়া মুড পাল্টে ফেললেন।
ছেলের পেছন পেছন গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন-“খাবি এখন? আয় তোকে দিয়ে দেই!”
-“একটু পরে খাবো মা।সন্ধ্যের হেভী নাস্তা এখনো হজম হয়নি!আচ্ছা,প্রিয়ন্তী গেলো না কেন?”
-“কেন আবার ঐ নাযিয়াত….(স্বভাবসূলভ ভঙ্গিতে বলতে গিয়ে থেমে গেলেন শাজিয়া) স্বর পাল্টে বললেন-“ওর মন খারাপ,
নাযিয়াত রয়েছে সে বাড়ীতে,কি ভাবে যাবে ও!কোনো স্ত্রী কি নিজের স্বামীর পাশে অন্য মেয়েকে সহ্য করতে পারে?”
-“অন্য মেয়ে কোথায়?সে তো রাফিজ ভাইয়ের বিবাহিতা স্ত্রী!”
-“যত যাই হোক।সে তো সতীনই!
–“আসলে আমাদের এসব প্রেজুডিস থেকে বেরিয়ে আসা উচিত।ধর্মটা এখন আমাদের পোষাকি হয়ে গেছে।ধর্মীয় বিধানের ওপর আমাদের আস্থা নেই বলেই এমনটা ভাবছো মা !আমাদের কাছে ধর্মটা এখন শুধু জন্মের সময় কানে আযান দেয়া আর মৃত্যুর সময় জানাযা পড়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে!মাঝখানের পুরোটা জীবন আমরা নিজেদের খেয়াল খুশিমতো চলতে শুরু করেছি!নতুবা অন্যের রীতি ধার করে চলি! এজন্যই তো মুসলমানদের আজ এই অবস্থা!”
-“হয়েছে…লেকচার বন্ধ করে খেয়ে নে চল্!”
-“বন্ধ করলাম লেকচার কিন্তু ঐ কথাটা তোমাকে আরেকবার স্মরণ করিয়ে দেই।যে কারনেই হোক,নাযিয়াত যদি রাফিজের সংসার করতে না পারে, তাহলে তার জন্য ঘর আর বর দুটোই প্রস্তুত আছে।তোমাকেই তখন তাকে বরন করে নিতে হবে,বলে দিলাম! ”
শাজিয়া তেতে উঠলেন-“সে কোন রূপনগরের রাজকন্যা যে,তুই ওকে বিয়ে করবি?তুই তো ওকে চোখেও দেখিসনি!হতদরিদ্র ঘরের ফকিন্নী একটা।চারটা পাঁচটা বোন ঘরে…!”
প্রান্তিক হাসলো-“রূপ দেখে বিয়ে করার মতো বোকা আমি নই!তাহলে ঠকতে হবে কারন রূপ আলগা সাজে চমকানো যায় আর এটা সাময়িক।সংসার জীবনে রূপ কোনো কাজেই আসেনা মানসিক একটা সান্তনা ছাড়া!
বরং রূপসী মেয়ে বদচরিত্রের হলে তার রূপটাও তখন আর দেখতে ভালো লাগেনা!আমি তো বিয়ে করবো রাসুল সাঃ এর বলে দেয়া সিষ্টেমে!তিনি বলেছেন-“চার কারনে নারীকে বিয়ে করা হয়,তাদের ধনসম্পদের কারনে,তাদের বংশমর্যাদার কারনে,তাদের রূপ সৌন্দর্য্যের কারনে এবং তাদের ধার্মিকতার কারনে।সুতরাং ধার্মিক নারী লাভ করতে চেষ্টা করবে,তুমি ধ্বংস হও যদি অপর নারী চাও!”(বুখারী/
মুসলিম)!
প্রিয়ন্তী চুপ করে শুনছিলো কথাগুলো।প্রান্তিকের কথাগুলো ওর বুকের ভেতরে গিয়ে আঘাত করছিলো যেন!সে উঠে সেখান থেকে চলে গেলো।
শাজিয়া বিরক্ত হয়ে ছেলেকে বললেন-
–“তোকে না বলেছি,উল্টাপাল্টা কথা বলিস না!দিলি তো বোনের মনটা খারাপ করে।তোর কথাটা তো ওর ওপরেই যায়,কারন ও দেখতে সুন্দর কিন্তু ধার্মিক না, আর নাযিয়াত ধার্মিক?”
-“মা আমি এসব ভেবে কথাটা বলিনি!যাই হোক ওকে স্যরি বলে দেবো আর তোমাকে বিনীত অনুরোধ ঐসব গুনাহের কাজ থেকে বেঁচে থেকো।ওদেরকে শান্তিতে থাকতে দাও!তোমার ওসব কাজের পরিণতি কিন্তু ভয়ংকর!নাযিয়াতের কতটুকু ক্ষতি করতে পারবে জানিনা কিন্তু নিজের ক্ষতি যে করতে যাচ্ছো এ বিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত!”
প্রান্তিক বেরিয়ে গেলে শাজিয়া চিন্তিত মুখে বান্ধবীকে ফোন লাগালেন।

দুদিন ধরে অফিসের কাজের প্রচুর চাপ যাচ্ছে রাফিজের।ব্যবসায় একটা ছোটখাটো লসও খেয়েছে এবার!মেজাজটা যেন অকারনেই খিঁচড়ে আছে।গতরাতেও হঠাৎ করে নাযিয়াতের উপর ক্ষেপে গিয়েছিলো ও।বলা নেই কওয়া নেই আচমকা নাযিয়াতের বাড়িয়ে ধরা চায়ের কাপটা ধাক্কা মেরে জমিনে ফেলে দিয়েছে রাফিজ।নাযিয়াত বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে ছিলো।রাফিজ নিজেও অবাক,ও এমন কেন করলো নিজেও বুঝতে পারছেনা!
বেচারী ওর সামনে চায়ের কাপ ধরে দাঁড়িয়েছিলো এটাই ওর দোষ।রেখে চলে যেতে পারতো!
যায়নি!
কেবল এই তুচ্ছ অযুহাতে এমনটা করার মানুষ রাফিজ নয়।কোনো কালে ছিলোনা!
অথচ……..কি হলো তার?
পরে নাযিয়াতের কাছে রাফিজ ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে।ও অবশ্য ব্যপারটাকে স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছে।ওর সহনশীলতাটা রাফিজকে মুগ্ধ করে।চট করে কোনো ব্যপারেই উত্তেজিত হয়না!কিন্তু রাফিজ নিজে কষ্ট পেয়েছে ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করে।
আজকাল যে কি হয়েছে ওর।কিছুতেই টেম্পার ধরে রাখতে পারেনা!প্রায়ই ও ক্ষেপে যাচ্ছে নাযিয়াতের ওপর।এবং সে লক্ষ্য করেছে কেবল নাযিয়াতের সাথেই ওর এমনটা হচ্ছে!
অন্য সবার সাথে ও স্বাভাবিক থাকছে কেবল নাযিয়াতের সামনে এলেই ওর অস্থির লাগছে।
দুদিন ধরে মাথাটাও খুব ব্যথা করছে।ঠান্ডা লাগলো কিনা কে জানে!
জ্বর জ্বর লাগছে কিন্তু থার্মোমিটারে জ্বর ধরা পড়ছেনা।

রাতে শোবার সময় রাফিজ চিৎ হয়ে শুয়ে ডান হাতটা কপালে উল্টে রেখে নানান কথা ভাবছিলো!নাযিয়াত চুপ করে শুয়ে আছে ও মুখো হয়ে।গত কয়েক দিনের ওর উল্টাপাল্টা আচরণে ও বিভ্রান্ত।আজকে সন্ধ্যায়ও বাঁজখাই কন্ঠে ধমক দিয়ে বলেছে-“যাও তো এখান থেকে!”
নাযিয়াত তখন কথা না বাড়িয়ে সরে গেছে।
ওর ক্ষিপ্ত আচরণের কারনেই রাফিজকে না ঘাটিয়ে চলার চেষ্টা করছে ও!
বিয়ের পর থেকে এ পর্যন্ত সবসময় নাযিয়াত ওর বুকে মাথা রেখে শুয়েছে।কিন্তু আজ রাফিজের কারনেই ও রাফিজ থেকে দুরে!রাফিজের খুব কষ্ট হচ্ছে।রাফিজ ভাবছে ওকে কাছে টেনে নেবে কিন্তু হাতপা যেন নড়াতেই ইচ্ছে করছেনা।
এমন কেন লাগছে?
কিছুক্ষণ পর মনের উপর জোর খাটিয়েই নাযিয়াতের বাহু ধরে ওকে নিজের দিকে ফেরালো।কিন্তু ততক্ষণে নাযিয়াত ঘুমিয়ে পড়েছ।
রাফিজ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
কি নিষ্পাপ একটা মুখ অথচ রাফিজ তাকে কষ্ট দিচ্ছে!নাযিয়াত সর্বক্ষণ ওর খুশির জন্য কি না করছে আর সে?
নাযিয়াতের ঘুম ভেঙ্গে গেলো রাফিজের তপ্ত নিঃশ্বাসে!চোখ মেলেই রাফিজকে ওভাবে দেখে চমকে গেলো সে।
রাফিজ কোমল স্বরে ডাকলো-
–“নাযিয়াত….আ’ম স্যরি সোনা!”
নাযিয়াত ফুঁপিয়ে উঠলো যেন।
রাফিজ ওকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো!

শাজিয়া মুখের ওপর হাত দিয়ে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইলেন প্রিয়ন্তীর দিকে!
প্রিয়ন্তী ফুঁপাচ্ছে!
শাজিয়া ক্রোধে দাঁতে দাঁত পিষে বললেন-
-“আমি আজই বড় ভাইয়ার সাথে কথা বলবো!ফারিকের এতো অধঃপতন?”
-“না,মা।বড়মামাকে কিছু বলতে যেওনা।অযথা একটা বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে।তাছাড়া ফারিক অনেক বদলে গেছে!ভুলটা আমারই!ওর ওপর অনেক বেশী নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলাম।ভেবেছিলাম,ওর মতো প্রগতিশীল মানুষ এসব ব্যপারে আরো উদারমনা হবে!”
-“আরে কিসের প্রগতিশীল?ব্যাটা জাত মানেই নারীলোলুপ!শোন্,তুই কিন্তু এসব ব্যপারে আর কারো সাথে আলাপ করবিনা।এটা একটা দুর্ঘটনা,যে কারো সাথেই ঘটতে পারে!”
-“কিন্তু মা….!”
-“কোনো কিন্তু না!তুই তোর মতো স্বাভাবিক থাক।নাযিয়াতের ব্যপারটা শেষ করে তোকে ও বাড়ীতে পাঠানো না পর্যন্ত শান্তি নাই!এখন তো ব্যপারটা আরো জরুরী হয়ে দেখা দিয়েছে!”
-“এখন আমি ও বাড়ী যেতে পারবোনা মা!আমার শ্বাশুড়ী খুব অন্যরকম।সে কোন না কোনো ভাবে বুঝে ফেলবে!তাছাড়া আমি এখনো কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি!”
প্রিয়ন্তী চোখ মুছে বললো!
শাজিয়া অবাক হয়ে বললেন-“কিসের সিদ্ধান্ত!”
প্রিয়ন্তীর মুখ কিছুটা কঠিন দেখালো-
-“ফারিককে আমি এমনি এমনি ছেড়ে
দেবোনা মা!”
-“কি করবি?”
-“কি করবো তা এখনো জানিনা!”
শাজিয়া মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন!মেয়ের মধ্যে একধরনের প্রতিশোধ প্রবণতা কাজ করছে কিন্তু সে কিইবা করতে পারবে বরং আরো বদনাম হবে তারচে নাযিয়াতকে সরিয়ে ওকে ওর ঘরে পাঠিয়ে দেয়াই সবদিক থেকে ভালো হবে!তিনি শায়লার সাথে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিলেন!যা করার দ্রুত করতে হবে!
*★
*
রাফিজ অফিস থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে বসেছে।নাযিয়াত নাস্তার প্লেটটা এগিয়ে দিয়ে বললো-“একটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম!”
-“বলো…!”
-“আপনি অনুমতি দিলে আমি দুতিন দিনের জন্য বাসায় যেতে চাচ্ছিলাম।নাদিয়ার বিয়ের কথা পাকা হয়েছে!খালামনি শুক্রবার আকদ করাতে চাচ্ছে।আমাকে যেতে বলেছে!”
রাফিজ নিরবে নাস্তা খেতে খেতে ওর কথাটা শুনলো।কোনো জবাব দিলোনা!
নাযিয়াত আবার বললো-“আম্মা বলেছে,ঐ ক’দিন প্রিয়ন্তীকে আনিয়ে নিতে!”
রাফিজ গম্ভীর স্বরে বললো-“চা দাও!”
নাযিয়াত চায়ের কাপ বাড়িয়ে ধরলে রাফিজ কাপটা হাতে নিয়ে বললো-“এমন হলে তো তোমাকে যেতেই হবে।যাও,কি আর করা!”
নাযিয়াত ছোট্ট করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল!
রাফিজ চিন্তিত মুখে চায়ে চুমুক দিলো!
*
বেলার ফোন পেয়ে শাজিয়া উচ্ছসিত হয়ে বললেন-“এটা তো খুবই ভালো কথা!প্রিয়ন্তীকে তো সেদিনই বলেছিলাম!ও আসলে বাইরে থেকে এসে ইজি ফিল করছিলো না।আমি কালই ওকে পাঠিয়ে দেবো!”
রাফিজ কখন আসবে ওকে নিতে?
-“অফিস থেকেই চলে যেতে বলে দেবো !”
-“তাহলে তো খুবই ভালো হয়!”
ফোন রেখে শাজিয়া আনন্দিত!
প্রিয়ন্তীকে জানালেন যাবার কথা।প্রিয়ন্তী মৃদু আপত্তি তুললেও তিনি ওর কথা কানে নিলেন না!মেয়েকে যে করেই হোক এবার ও বাড়ীতে পাঠাতে চান তিনি!
খুব ভালো হয়েছে যে নাযিয়াত বাপের বাড়ী যাচ্ছে।
এই যাওয়াই ওর শেষ যাওয়া হবে।
ওকে আর ফিরতে দেবেন না তিনি!
রাফিজের কাছে!
………..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে