উত্তরাধিকার (৫ম পর্ব)
লেখাঃ-মোর্শেদা রুবি
***********************
সকালের একরাশ সোনালী রোদ চোখের উপর পড়তেই ঘুম ভেঙ্গে গেলো নাযিয়াতের।চোখ কুঁচকে মোবাইলটা হাতে নিয়ে ঘড়ি দেখে আঁতকে উঠলো সে।
সাড়ে আটটা! ইস্,একদমই টের পায়নি!
দ্রুত ধাক্কা দিয়ে জাগালো রাফিজকে।
রাফিজ ঘুম ঘুম গলায় বললো-
–“দশটা বাজতে এখনো অনেক দেরী……!”
-“এখুনি না উঠলে পরে কিন্তু দেরী হয়ে যাবে….!”
–“একদিন দেরী হলে কিছু হয়না!”
-“কে বলেছে কিছু হয়না?এভাবেই অভ্যেস খারাপ হওয়া শুরু করে!উঠুননা… প্লিজ।”
-“প্রতিদিনতো আমিই তোমাকে ডেকে তুলি,আজ একেবারে……!”
বলেই থেমে গেলো রাফিজ।চোখ মেলে তাকালো নাযিয়াতের দিকে ওর প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য।আসলে প্রিয়ন্তী ভেবে কথাগুলো মুখে চলে এসেছে ওর।
নাযিয়াত মুচকি হেসে বললো-“যম্মিন দেশ যদাচার” বলে একটা কথা আছে।আমার দেশে আলসেমীর কোনো স্থান নেই!এবার উঠে ফ্রেশ হয়ে নিন!আপনার না কি যেন কাজ আছে বললেন…!”
-“ওহ্…একদম মনেই ছিলোনা!”
রাফিজ আড়মোড়া ভাঙ্গতে গিয়ে নাযিয়াতকে ফের টান দিতে গেলে নাযিয়াত দ্রুত বিছানা থেকে নেমে পড়লো!
-“আজ ঠিক দেরী হয়ে যাবে!”
রাফিজ হতাশ গলায় বলরো-“আমি সবসময় ঠেলাগাড়ীতে চলে অভ্যস্ত।তুমি এভাবে জেট প্লেন ছোটালে তো মুশকিল!”
-“ঠেলাগাড়ীতে বসে থাকলে বুড়ো হবেন তাড়াতাড়ী!”
-“উঁহুঁ….একটুও না! বরং নিজেকে বেশ ইয়াং মনে হচ্ছে সকাল থেকে।”
নাযিয়াত কড়া চোখে তাকিয়ে অপরূপ ভ্রূ ভঙ্গিতে শাসনের চেষ্টা করলে রাফিজ চোখ টিপে প্রত্যুত্তর দিলো!
*
নাযিয়াত চটপটে হাতে চারপাশটা গুছিয়ে ফেললো!
মোটামুটি চল্লিশ মিনিটের মধ্যেই ফ্রেশ হয়ে সব কাজ গুছিয়ে রাফিজকে অফিসের জন্য তৈরী করে ফেললো!
রাফিজ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে জানতে চাইলো নাযিয়াতের মাদ্রাসা বন্ধ কবে!
নাযিয়াত জানালো, আপাতত কোনো বন্ধ নেই!
-“তাহলে দুতিনদিনের ছুটি নাও!”
-“ছুটি দিয়ে কি করবো?”
-“দিনগুলো আমাকে দেবে!আমরা বেড়াতে যাবো!”
নাযিয়াত বোকার মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো রাফিজের দিকে।
রাফিজ পেপার রেখে উঠে যেতে যেতে নাযিয়াতের মাথায় আলতো টোকা মেরে বললো-“কক্সবাজার যাবো!”
*
রাফিজকে অফিসে বিদায় দিয়েই নাযিয়াত মাদ্রাসায় ছুটলো।ফিরতে সেই বিকেল চারটা!বিয়ের আগে সকাল সাতটার দিকে মাদ্রাসায় চলে যেতো,বিয়ের পরপর রাফিজের অফিসের সাথে টাইম মিলিয়ে দুঘন্টা পিছিয়ে নিয়েছে।
রাফিজ পৌণে দশটার দিকে অফিসের জন্য বেরোয়।ও বেরুনোর ঠিক দশ মিনিটের মধ্যে নাযিয়াত মাদ্রাসায় চলে যায়!
*
ইদানীং রাফিজের অভ্যেস হয়েছে রাত জেগে গল্প করার।প্রত্যেক দিনই বিভিন্ন বিষয়ের ওপর আলোচনা করে ওরা।বেশীরভাগই নাযিয়াত বলে আর রাফিজ শোনে!
ওদিকে রাত সাড়ে এগারোটার পরপরই নাযিয়াত হাই তুলতে থাকে কিন্তু রাফিজ ওর কাছ থেকে প্রতিদিনই কিছু না কিছু শুনবে বলে ওকে আটকে রাখে !
নাযিয়াত কখনো বই থেকে পড়ে শোনায় কখনো নিজের জানা থেকে বলে।
রাফিজ খুব মনোযোগ দিয়ে সেসব শোনে।ওর আগ্রহ দেখে নাযিয়াতের ভালো লাগে কারন ইসলামের প্রতি আগ্রহ থাকাটা হেদায়েতের একটা লক্ষণ।
নাযিয়াত ওকে বিভিন্ন নবীদের সাহাবীদের তাবেয়ীদের জীবনীগুলো শোনায়।এ পর্যন্ত রাফিজের বেশ কিছু কাহিনী শোনা হয়ে গেছে।
একদিন রাফিজ হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসলো-“আচ্ছা,একটা সত্যি কথা বলবে?”
-“আমি সবসময় সত্যি কথা বলারই চেষ্টা করি!সজ্ঞানে কখনো মিথ্যা বলেছি বলে মনে পড়েনা! আপনি জিজ্ঞেস করুন!”
-“আজকালকার মেয়েরা তো স্বামীর সেবা করাকে দাসত্ব বলে মনে করে,কিন্তু লক্ষ্য করে দেখেছি তুমি খুব আগ্রহ নিয়ে গুরুত্বের সাথে কাজটা করো,কেন বলো তো?”
নাযিয়াত হেসে ওঠে-“আমরা মেয়েরা সবচে বেশী দাসত্ব কার করি, জানেন?”
রাফিজ উত্তর না দিয়ে চুপ করে তাকিয়ে থাকে!
নাযিয়াত বলে চললো-”
-“নিজেদের সন্তানের।আমরা মেয়েরা স্বামীর চেয়ে বেশী সন্তানের খেদমতে অনেক বেশী শ্রম দিয়ে থাকি এবং এটা করতে গিয়ে নিজেদের আরামকে হারাম করতে এতটুকু দ্বিধা করিনা।দেখবেন যেসব স্ত্রী তার নিজে স্বামীকে ঠিকমতো রেধেবেড়ে খাওয়ায় না সেই স্ত্রী’টিও তার প্রিয় ছেলেমেয়ের বেলায় স্নেহময়ী মা হয়ে তাদের পছন্দের খাবারটা নিজ হাতেই রাঁধে!
সন্তানের কোন্ খাবারে রুচি বেশী,সে কোন্ খাবারটা পছন্দ করে, না পেলে আব্দার করে, পেলে খুশী হয়ে একটু বেশী খায় এসব কিছু মায়েদের নখদর্পনে! আর এসব করতে গিয়ে খেদমতের পাশাপাশি ছেলেমেয়েদের ঝাড়িঝাপটা মায়েদের জন্য ফ্রি থাকে! তবু দেখবান কোনো মা’ই এই কাজটাকে দাসত্ব মনে করেনা!কেন জানেন?কারন সন্তানকে মা ভালোবাসেন,সে যে তার নাড়ীছেঁড়া ধন।
কিন্তু যার ঔরসের বদৌলতে সে এই নাড়ী ছেঁড়া ধনের গর্বিতা মা হলো তাকে তার প্রাপ্য সম্মানটুকু দিতে আজকের একদল তথাকথিত শিক্ষিতারা নারাজ!সত্যি বলতে,একজন নারীর কাছে স্বামী অনেক বড় ব্যপার!কারন একজন নারীর জান্নাত যাবার চারটি শর্তের একটি হলো স্বামীর সন্তষ্টি! স্বামীকে মান্য করা একজন আদর্শ নারীর বৈশিষ্ট্য!এর কারনটাও পরিস্কার!আমরা মেয়েরা বাবার বাড়ী কতদিন থাকি বলুন তো!আঠারো বিশ কি বাইশ বছর!কিন্তু বিয়ের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত চল্লিশ পঞ্চাশ কি ষাট বছর পর্যন্ত আমাদের যাবতীয় দায়-দায়িত্ব থাকে সেই পুরুষটির ঘাড়ে যার নাম স্বামী! বিয়ে নামক বন্ধনের কারনে সে নারীর উপর দায়িত্বপ্রাপ্ত!সে রোজগার করে বউকে খাওয়াতে বাধ্য ,সাধ্যমতো সে তার প্রয়োজন পুরো করবে,তার আব্দার আহ্লাদ সব মেটাবে,ভরনপোষণ করা সহ তাকে দেখেশুনে রাখার সকল দায়িত্ব সে পালন করবে কেবল একজন স্বামী হবার কারনে!সেখানে স্ত্রী হিসেবে তার আনুগত্য করাকে দাসত্ব মনে করা হবে কেন?ওই কাজটুকু কি স্ত্রী’র দায়িত্বের মধ্যে পড়েনা?
বরং স্বামীর প্রোটেকশন মেনে সংসারকে সাজিয়ে রাখাই তো নারীর কাজ।স্বামীর সমকক্ষ হবার প্রশ্ন আসে কোথা থেকে?আল্লাহপাক যাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন তার সেটাই করা উচিত!আকাশের কাজ আকাশের,পাতালের কাজ পাতালের।পাতাল যদি আকাশ হয়ে ভেসে বেড়াতে চায় তবে সমস্ত সৃষ্টিকূল পা রাখবে কোন্ জমিনে?স্বাভাবিক ভাবেই সব ধ্বংস হয়ে যাবে!তেমনি নারীও যদি পুরুষের সাথে তাল মিলিয়ে ঘর ছেড়ে পথে নামে তখন সন্তান বেড়ে উঠবে কার ছত্রছায়ায়?আজকের প্রজন্মের বিকৃত উন্মাদনার সবচে বড় কারন প্রপার ম্যাটারনিটির অভাব কারন আজকের সন্তানরা মায়ের ছত্রছায়ায় কম আর ডে কেয়ার ও বুয়ার তত্ত্বাবধানেই বেড়ে উঠছে বেশী।
এর ফলাফল হিসেবে হিসেবে আমরা এই প্রজন্মকে পেয়েছি ড্রাগ,পর্ণ,অবৈধ রিলেশন,হাজারটা গফ,লক্ষটা বফ,অবৈধ সন্তান জন্মদান,আত্মহত্যা,জরায়ু ক্যানসারের পাকচক্রে।
কই,আগে তো এসব কখনো শোনা যায়নি?কারন তখন মায়েরা সন্তানের দেখাশোনা করতেন!দেখুন,নারী পুরুষ যিনি বানালেন
তাঁর চেয়ে বেশী কে জানবে এই দুই প্রজাতির ভালো মন্দ কিসে ?”
রাফিজ হেসে বললো-“সত্যি, এভাবে কখনো ভেবে দেখিনি তো! সবাই এভাবে ভাবলে আজকে পৃথিবীতে এতো বড় সমস্যার জন্মই হতো না!”
★
রাতে খাবার টেবিলে রাফিজ মা’কে জানালো সে নাযিয়াতকে নিয়ে তিনচার দিনের জন্য কক্সবাজার যেতে চায়।
বেলা চৌধূরী
নাযিয়াতের দিকে তাকালেন-“কই,তুমি তো আমাকে কিছু বলো নি!”
নাযিয়াত কিছু বলার আগেই রাফিজ বলে উঠলো-“কথাটা ওকে এখনো জানাইনি আমি।তোমাকে বলেই ওকে জানাবো ভেবেছি,তুমি কি বলো?”
বেলা আমতা আমতা করতে লাগলেন-“না,মানে বলছিলাম,এদিকে আবার কি না কি কাজ বেরিয়ে আসে।আমি একা ক’দিক সামলাবো!”
নাযিয়াত স্মিত হেসে বললো-“এখন নাহয় এসব থাক্,আম্মা বাড়ীতে একা পড়ে যাবে!আপনি….!”
-“আমি টিকিট কনফার্ম করে ফেলেছি যে,কারন জানি আম্মা বারন করবেনা।আর বাড়ীতে এত লোক্,আম্মার একা হবার প্রশ্ন আসেনা!কাজ তো সবসময় থাকবেই তাই বলে তো আর সব ফেলে ঘরে বসে থাকা যাবেনা!”
বেলা হাসতে চেষ্টা করে বললেন-“তুই নাকি প্রিয়ন্তীর সাথে ঠিকমতো যোগাযোগ করিসনা?”
-“কে বললো,একথা!প্রায়ই তো নাযিয়াতের সাথে ওর কথাবার্তা হচ্ছে!”
-“নাযিয়াত আর তুই এক হলি!”
-“আচ্ছা,কাল বলে নেবো!কিন্তু আমি কথা বলিনা’ এমনতরো অভিযোগ করার মেয়ে তো প্রিয়ন্তী নয়! কারন আমার যোগাযোগ করা না করাতে তার কিছু এসে যায় না।তুমি নিজেও ভালো করে জানো সে কতটা আত্মকেন্দ্রিক!”
-“ও তো চিরকালই অমন তাই বলে তুই ওকে এভাবে ভুলে থাকবি এটা কেমন কথা?”
-“আমি ভুলে থাকি কোথায়?আমি তো নিয়মিতই যোগাযোগ করছি,ও কয়বার ফোন দিয়েছে তুমিই বলো?আমার দিকটা তুমি বুঝবেনা?”
নাযিয়াত নিরবে সেখান থেকে সরে গেলো!
মা ছেলের আরো কিছুক্ষণ কথাবার্তা চললো।
*
খানিক বাদে নাযিয়াত কাপড় ভাজ করছিলো তখন রাফিজ এসে ওর পাশ ঘেষে বসলো!
-“কি,মন খারাপ?”
-“নাহ্,মন খারাপ হবে কেন?”
-“না,আমি ভাবলাম,মায়ের কথা শুনে…..!”
-“না না..মা এমন কিছু খারাপ তো বলেন নি!উনি দুজনের দিকই দেখার চেষ্টা করছেন!এটা তো বরং ভালো।”
-“আসলে বাবা মারা যাবার পর থেকে আমি মায়ের সাথে কখনো কোনো বিষয়ে তর্ক করিনা।তাঁকে অমান্যও করিনা।আমার মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি নিজে আর বিয়ে করেন নি,আমিই তার একমাত্র সম্বল!তাই আমি কষ্ট না দিয়ে সবসময় খুশি রেখেই চলার চেষ্টা করি!”
-“খুবই ভালো করেন! আর এটাই তো উচিত।মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেস্ত।বরং এটা জেনে ভালো লাগছে যে,আপনি তাঁকে মান্য করেন!আপনাকে শুধু মা’ই না,আমাদের দুজনের মধ্যেও সমতা বজায় রেখে চলতে হবে!রাসুল সাঃ মৃত্যুর পূর্বে নয়জন স্ত্রী রেখে মারা যান,কোনো একজন স্ত্রী কখনো তাঁর দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তুলতে পারেন নি!কারন তিনি স্ত্রীদের মধ্যে সবসময় সমতা রক্ষা করে চলতেন।প্রত্যেক স্ত্রী’র ঘরে একই সময়কাল অবস্থান করতেন!”
-“সব বুঝলাম,তিনি হচ্ছেন আমাদের আদর্শ!সব বিষয় তিনিই আমাদের অনুসরনীয়।কিন্তু মন?
মনের উপর তো কারো হাত নেই!আমার যদি তোমাকে বেশী ভালো লাগে সে দোষ কি আমার?আমি যদি তোমার মাঝে আমার জীবনের ভালোলাগাগুলো খুঁজে পাই তো আমি কি করবো?”
নাযিয়াতের হাত কিছুক্ষণের জন্য থেমে গেলো!
তারপর ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললো-“রাসুল সাঃ মা আঈষাকে অত্যাধিক ভালোবাসতেন,কিন্তু কেনোদিন তাঁর ঘরে অন্য স্ত্রীদের তুলনায় পাঁচমিনিট সময় বেশী কাটাননি।মা আঈষি রাঃ বর্ণিত আছে–
-“হযরত সাওদা রাঃ যখন বেশী বৃদ্ধ হয়ে পড়েন তখন বলেন-“ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনার কাছে আমার প্রাপ্য পালা আমি আঈষাকে দিলাম।তখন রাসুল সাঃ দুই পালা নির্ধারন করতেন-তাঁর নিজের পালা ও বিবি সওদার পালা(বুখারী/মুসলিম)!
এমনকি তাঁর মৃত্যুর পূর্বে রাসুল সাঃ জিজ্ঞেস করছিলেন-“আগামীকাল আমি কার ঘরে থাকবো?তিনি ইচ্ছা করেছিলেন, আঈষা রাঃ দিনের পালার কথা!সকল স্ত্রীগণ তখন তাঁকে অনুমতি দিলেন, যে ঘরে তাঁর ইচ্ছা তিনি থাকতে পারেন!অতঃপর তিনি আঈষা রাঃ ঘরেই ছিলেন।এমন কি তিনি সেখানেই ইন্তেকাল করেন!(বুখারী)উনি যদি কোথাও সফরে যেতে ইচ্ছে করতেন তখন স্ত্রীদের নামের লটারী করতেন,তাতে যার নাম উঠতো তাকেই সাথে নিয়ে যেতেন(বুখারী/মুসলিম)!
-“আসলে ন্যায়বিচার জিনিসটা সবাই করতে পারেনা।উনি খুব ভালোভাবেই সেটা করতে পেরেছিলেন।কারন উনি আল্লাহর নবী! ইনশাআল্লাহ, আমি ওনার সুন্নত প্রাণপন মেনে চলার চেষ্টা করবো!কিন্তু যে অবহেলা আমি প্রিয়ণ্তীর কাছ থেকে পেয়েছি তার কি?”
-“সেটা তার অংশের হিসাব যা সে আল্লাহর কাছে জবাবদিহী করবে।আপনি আপনার দিক থেকে নিষ্কলুস থাকুন! কারন আবু হুরায়রা রাঃ এর বর্ণনায় আছে-” যখন কোনো ব্যক্তির কাছে দুই স্ত্রী থাকে,সে তাদের মধ্যে ন্যায়বিচার না করে, কিয়ামতের দিন সেই ব্যক্তি এক অঙ্গহীন অবস্থায় উঠবে!”(তিরমিযী,আবু দাউদ,নাসায়ী)! তাই আপনি নিজেকে গুনাহমুক্ত রাখুন!”
*
রাফিজ নাযিয়াতের হাত ধরে কাছে টেনে বললো-“সর্বান্তকরনে আমি চেষ্টা করবো!তবু কখনো ভুল হলে ধরিয়ে দিও! আল্লাহর অশেষ রহমত,যে তোমাকে পেয়েছি!তোমাকে পেয়ে আমি এমন এক জীবন লাভ করেছি যার প্রতিটা ক্ষণ অর্থবহ আর বরকতময়!
-“আমরা রক্তমাংসের মানুষ,ভুল তো হতেই পারে!ভুল হলেও সংশোধন করতে দেরী করবো না!মানুষের সবচে প্রিয় তার সন্তান,অধিক সন্তান থাকলে তাদের ভালোবাসতে কোনো বাবা মায়ের কখনো সমস্যা হয়না,ভালোবাসা ভাগ হয়ে যায়না কিন্তু স্বামী স্ত্রীর বেলায় এই প্রশ্নটা তৈরী করা হয়েছে কারন স্ত্রী তার স্বামীর উপর একচ্ছত্র রাজত্ব করতে চায়।স্বামীকে একার করে রাখতে চায়।কিন্তু এটা করতে গিয়ে জিনিসটা কতটা ঘোলাটে হয়ে গেছে দেখুন,স্বামী তার কর্তব্যকর্ম যেমন পিতামাতার হক আদায়,ভাইবোনের হক আদায়, নিজ ঘনিষ্ট আত্মীয়দের হক আদায় করতে গিয়েও স্ত্রীর দিকে তাকায় যে সে রাজী কিনা!
আল্লাহর ভয় তার মন থেকে চলে গিয়ে স্ত্রী’র ভয় তার মনে গেঁথে যায়!
আল্লাহর বান্দা তার হুকুম মেনে চলবে এটাই ঠিক !কিন্তু দেখা যায় ঐ স্বামী তার স্ত্রীর মন রাখতে গিয়ে, স্ত্রীর পরিবারের ঘানি টানে যা তার উপর ফরয নয় অথচ
এদিকে নিজ হকদারদের বঞ্চিত করে ফেলে ! এতে সে মারাত্মক গুনাহগার হয়!সে নিজের ভাইবোনকে হক না দিয়ে শালাশালিকে গিফট দেয়,বাবা-মা’র হক বঞ্চিত করে শ্বশুড় শ্বাশুড়ীকে খুশী করে।এটাই মুল কারন,স্বামীকে ভাগ করতে না পারার!
কারন স্বামী তো তাহলে তাকে একা এটেনশন দিতে পারবেনা!
আপনিই বলুন,এসব করে কয়টা স্বামী স্ত্রী জীবনে সুখী হতে পেরেছে?স্বামীর গুনাহ তাকে মনে মনে অসুখী রাখে আর স্ত্রী নিজেকে সুখী ভাবলেও সারাক্ষণ স্বামী হাতছাড়া হয়ে যাবার ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকে,স্বামীর সাথে ঝগড়া করে!মোটকথা তার গুনাহের অনলে সে জ্বলতেই থাকে!সুখ বা আত্মতৃপ্তি জিনিসটা তার ভাগ্যেই জোটেনা!
-“হমম,ঠিকই বলেছো! আচ্ছা,তাহলে তুমি মাদ্রাসা থেকে ছুটি নিয়ে নিও।আমরা বুধবার রাতে রওনা দেবো আর একেবারে আগামী সোমবারে
ফিরবো!”রাফিজ প্রসঙ্গান্তরে বলে উঠলো!
নাযিয়াত মাথা নাড়তেই ওর ফোন বেজে উঠলো!নাযিয়াত ফোনের দিকে তাকিয়ে রাফিজের দিকে তাকালো!
রাফিজ জিজ্ঞেস করলো –“কি?”
নাযিয়াত ফোন দেখিয়ে হাসলো-“প্রিয়ন্ত
ী!”
রাফিজ হতাশ ভঙ্গিতে উঠে যেতে নিলে নাযিয়াত ওর কাঁধ ধরে বসিয়ে ফোন রিসিভ করলো!
নাযিয়াতের প্রানোবন্ত আচরনের কারনে হোক বা যে কারনেই হোক,প্রিয়ন্তী ওর সাথে সহজ
ভঙ্গিতেই কথাবার্তা বলে!
নাযিয়াত নিজেই ফোনটা রাফিজের হাতে গুঁজে দিলো!তারপর উঠে ভাঁজ করা কাপড়গুলো নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলো!
অগত্যা রাফিজ ফোনটা কানে ঠেকালো-“আসসালামুআলাইকুম!”
-“বাব্বাহ্,নাযিয়াত দেখি তোমাকে ভালোই শিক্ষা দিয়েছে!”
-“এটা তো সালামের জবাব হলোনা!”
-“ওয়ালাইকুমুসসালাম!”
-“তা দেশে কবে ফিরছো?”
-“আমার ফেরা না ফেরাতে তোমার কি আর কিছু যায় আসে?তুমি তো তোমার মনমতো হুকুমের গোলাম পেয়েই গেছো!যে সকাল বিকাল তোমার মুখের সামনে চায়ের কাপ ধরবো আর এ্যাসট্রে হাতে দাঁড়িয়ে থাকবে!চাওয়ার আগেই তোমার মনোবাসনা পূরন করে দেবে তোমাকে……!”
-“তুমি কি এসব বলতেই ফোন করেছো?”
-“ফোন তো তোমাকে করিনি,নাযিয়াত কে করেছি!ও বেশী ভালোমানুষী দেখিয়ে তোমাকে দিতে গেছে কেন?”
-“তুমিই বলে দিতে যে,তুমি আমার সাথে কথা বলতে চাও না!তুমি তো আর কারো হুকুমের গোলাম না!আর পাশাপাশি এও জেনে রাখো, নাযিয়াত আমার হুকুমের গোলাম নয়।ও আমার বউ,আমার অর্ধাঙ্গিনী,আমার সসহধর্মিনী!যার মর্ম তুমি এ জীবনেও বুঝলেনা!”
-“আমার অতো বুঝে কাজ নেই,আমি এতটুকু বুঝি!আমি একজন মানুষ।আমার একটা নিজস্বতা আছে।কারো দাসী হয়ে তার পায়ের সামনে পড়ে থাকার জন্য আমার জন্ম হয়নি।এখানে এসে বরং আমি নিজেকে খুঁজে পেয়েছি।আমার আঁকার হাত ভালো আমি জানতাম কিন্তু এখানে সেটা ব্যপক সাড়া ফেলেছে।আজ সন্ধ্যায় আমার এক্সিজিবিশন!তোমার ওখানে থাকলে নিজের এই প্রতিভার কথা আমার অজানাই থেকে যেতো।আমি সুখী রাফিজ।খুব সুখী!”
-“যে নিজেকে যেভাবে দেখতে চায় সে সেভাবে থাকাকেই ‘সুখে থাকা’ মনে করে।থাকো,সুখে থাকো!আমার কিছু বলার নেই!”
-“তোমার বলার থাকলেই বা শুনছে কে?কাগজে কলমে তোমার বউ আছি বলে তোমার হুকুম ছাড়া চলতে পারবোনা ভেবেছো?”
-“এটা ভাবার মতো বোকা আমি কোনোকালেই ছিলাম না!”
-“নাযিয়াত কোথায়,ওকে দাও।কয়েকটা কথা বলে ফোনটা রাখি!”
-“ও আমাকে তোমার সাথে নির্বিঘ্নে কথা বলতে দিয়ে বাইরে গেছে।যদি বলো,তো ডেকে দেই?”
-“না থাক্,আমি নাহয় পরে ফোন করবো!এখন তাহলে ছাড়ি…..বাই !”
রাফিজ ফোন রেখে চুপ করে বসে রইলো।মনটাই খারাপ হয়ে গেছে।মা যদি ওকে বিয়েই করালো তো এই যন্ত্রনাটাকে ওর সাথে বেঁধে রাখলো কেন!ডিভোর্স করিয়ে দিলো না কেন!এক জ্বলন্ত অশান্তি নিত্য পোড়াচ্ছে ওকে।কোনদিন যে এসে ওর সুখের ঘরে হানা দিবে কে জানে!
রাফিজের মাঝে আজকাল নাযিয়াতকে হারানোর ভয়টা প্রকট হয়ে উঠছে।ওকে ছাড়া যে রাফিজ অসম্পূর্ণ!
★
রাত আটটার মধ্যেই খাওয়া দাওয়া সেরে নিয়েছে ওরা।নয়টার দিকে বেরিয়ে পড়বে!নাযিয়াত নিজের হাতেই সবকিছু গুছিয়ে রেখেছে।যাবার আগ দিয়ে মা’কে বলেই ওরা বেরিয়ে পড়বে।
এমন সময় বেলা ঘরে ঢুকে ওদের প্রস্তুতি দেখলেন।রাফিজ ফোনে কথা সেরে মায়ের দিকে ফিরলো-“মা,আমরা এখন বেরুব!ওখানে পৌঁছে তোমাকে ফোন দিবো!”
বেলা বললেন-“তোরা ফিরবি কবে?”
-“ইনশাআল্লাহ্।সব ঠিক থাকলে সোমবার!”
-“দেরী করিসনা যেন।মঙ্গলবারে প্রিয়ন্তী আসবে! কেন,তোকে প্রিয়ন্তী কিছু বলেনি?”
রাফিজ একটা হার্টবিট মিস করলো যেন!
-“কবে বলেছে একথা?”
-“দুপুরে ফোন করে বলেছে।ওর বাবা-মায়ের ম্যারেজ ডে উপলক্ষে ও আর ওর ভাই আসবে বলেছে!ওর ভাইয়ের জন্য পাত্রীও নাকি ঠিক করা হয়েছে!দেখে পছন্দ হলে বিয়ে করিয়ে দেবে!সেজন্যেই আসছে ওরা!”
রাফিজ আর কথা না বাড়িয়ে হাতের জিনিসগুলো গোছাতে লাগলো!মনে মনে ভাবছে,প্রিয়ন্তী এসে কোন্ ঝামেলা লাগায় কে জানে!ওর কপালে যেন সুখ জিনিসটাও বেশিদিন সয় না!”
…..
চলবে…..