উত্তরাধিকার (৩য় পর্ব)
লেখাঃ-মোর্শেদা রুবি
**************************
গত তিনদিন ধরে নাযিয়াত পড়াতে আসছেনা প্রিয়ন্তীকে।এ নিয়ে বেলা চৌধুরী খানিকটা চিন্তিত।
কি ব্যপার?
তার মনের খবর টের পেয়ে যায়নি তো?নাহ্,এটা অসম্ভব।
তার মনের খবর নাযিয়াত কিভাবে টের পাবে?তার বংশের ওয়ারিশের জন্য তিনি যে কোন মেয়েকেই ছেলের বৌ হিসেবে চাইতে পারেন।এটা তো অস্বাভাবিক কিছু নয়!
তাহলে সেদিনের পর থেকে মেয়েটা পড়াতে আসা বন্ধ করে দিলো কেন?
নাকি সে দ্বিতীয়া হতে রাজী নয়?
কিন্তু,কেন রাজী হবেনা?
এমন রাজকীয় প্রস্তাব সে কোথায় পাবে?
*
এমনতর নানান ভাবনা ভাবতে ভাবতে প্রিয়ন্তীর রুমে গেলেন! সে কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে!ওকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন!সে কম্বলের তলা থেকেই ঘুম ঘুম গলায় উত্তর দিলো-“জানিনা,কেন আসেনা!”
-“তোমাকে ফোনে জানিয়েছে কিছু?”
-“মমম…না!”
-“তুমি ফোন করে জিজ্ঞেস করো, কেন আসছেনা!”
-“দুউর…!”বলে প্রিয়ন্তী চোখ বুঁজে পড়ে রইল।
বেলা মনে মনে কষে একটা বিশ্রী গালি দিলেন প্রিয়ন্তীকে।তার ছেলে যে বলেনা অকম্মার ধাঁড়ি..!
ঠিকই বলে।বাপের টাকার জোরে বিয়ে দিতে পেরেছে নইলে এরকম মাকাল ফল কারো উপকারে আসার না।
নাহ্,তার নিজেকেই যোগাযোগ করতে হবে।
মেয়েটা হঠাৎ আসা বন্ধ করলো কেন?তার প্রস্তাবটা নাকচ করে দিবে নাকি?এই বাজারে অমন লোভনীয় প্রস্তাব পাগল ছাড়া কেউ না করবে?
বেলা মোবাইলে নাযিয়াতের নাম্বার বের করতে করতে ড্রইংরূমে এলেন।ঠিক তখনই ডোরবেল বাজলো।ময়না দরজা খুলে দিতেই নাযিয়াত প্রবেশ করতে দেখে বেলা চাপা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন!
নাযিয়াত বেলাকে দেখে সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সালাম দিলো!
বেলা ওকে দেখে খুশি হয়ে এগিয়ে গেলেন-“আরে,তুমি এসেছো?আমি ভাবলাম,অসুখ করলো কিনা!তুমি ভালো আছো তো মা?”
-“জ্বী,আলহামদুলিল্লাহ্।”
-“তুমি বসো, আমি প্রিয়ন্তীকে ডেকে নিয়ে আসি!”
-“আন্টি…এক মিনিট!”
নাযিয়াত বাধা দিয়ে বললো!বেলা থামলেন।নাযিয়াত কিছুটা সংকোচ করে ইতস্তত কন্ঠে বললো-“তার আগে আপনার সাথে আমার একটু কথা ছিলো!”
-“হ্যাঁ…হ্যাঁ…বলো!”বেলা আগ্রহের সাথে তাকালেন।নাযিয়াত মৃদু স্বরে বললো-
-“আমি এ মাসের পর আর পড়াবোনা আন্টি!”
বেলা হাসিমুখে বললেন-“তা তো ঠিকই আছে!তুমি তো এ বাড়ীর বউ হয়ে যাবে।তখন তো আর এ বাড়ীর টিউশনি না করাটাই ঠিক হবে!”
-“ন্..না তা না!আমি…আপনার প্রস্তাবটা মেনে নিতে পারছিনা আন্টি!আমাকে ক্ষমা করবেন!”
বেলার মুখের হাসি দপ করে নিভে গেলো!
-“কেন?কেন মেনে নিতে পারছোনা?”
নাযিয়াত নিরব রইলো!
বেলা কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো-
“আমার কষ্টটা তুমি বুঝতে পারছোনা বলেই এভাবে বলতে পারলে!আজ আমার জায়গায় হলে তুমি বুঝতে আমি কতটা নিরুপায়!আমার বংশ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে আর এটা আমাকে চেয়ে চেয়ে দেখতে হবে!আমি জানি,তোমার উপর সংসারের অনেক দায়িত্ব,ঠিক সেকারনেই আমি তোমার সব দায়িত্ব নিজের মাথা পেতে নিতে রাজী আছি।তোমাদের বাড়ীটা….!”
-“আমার আপত্তিটা ওখানেই,আন্টি!”ব
েলাকে থামিয়ে দিলো নাযিয়াত!
বেলা চুপ হয়ে তাকিয়ে রইলেন।
নাযিয়াত বলে চলল-
-“বিয়েটা মানুষের ভাগ্য।আল্লাহ প্রদত্ত রিযিক।কিন্তু বিয়ের বিনিময়ে ওসব আমি কেন নেবো আপনার কাছ থেকে?এটা তো কোনো নিয়মের আওতায়ই পড়েনা।”
-“হোহো….এই কথা…?”বেলা হেসে শুরু করতে যাচ্ছিলেন।
নাযিয়াত আবার থামালো তাকে-“আরেকটা কথাও আছে।প্রিয়ন্তীকে সরিয়ে ওর জায়গা দখল করবো আমি,এটা কেন মনে হলো আপনার?আমি সবিনয়ে আপনার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করছি আন্টি।আমাকে ক্ষমা করবেন!তাছাড়া আমার অনুপস্থিতিতে আমার পরিবার সমস্যার মুখে পড়বে!ওদের দেখাশোনা আমাকেই করতে হবে!আমি এ মুহূর্তে বিয়ের জন্য প্রস্তুত নই!”
বেলা দ্রুত নাযিয়াতের হাত চেপে ধরলেন-“এজন্যেই তো বলেছি মা,তোমার পরিবারের দেখাশোনার ভার আমার!আচ্ছা,তুমি দান নিতে চাচ্ছোনা ভালো কথা,ধার হিসেবে নিতে পারো!তোমার বাবা যে দেনা রেখে গেছেন তা তুমি নিজের টাকাথেকেই শোধ দিতে পারবে! বিয়ের পর তুমি অন্তত কয়েক লক্ষ টাকার মালিক হবে!ধার শুধতে তোমার একটুও আটকাবেনা!তাছাড়া প্রিয়ন্তীকে তো সরিয়ে দিচ্ছি না মা।তোমরা দুজনই থাকবে!আর তোমার মতো সচ্চরিত্র মেয়ের পক্ষেই এটা সম্ভব।আমাদের ধর্মে একসাথে চার স্ত্রী রাখার অনুমতি আছে।এটা মানো তো!আমি তো অন্যায় কিছু করছিনা!আর আমি তোমাকেই ছেলে বৌ হিসেবে চাইছি কারন তুমি মানুষ হিসেবে সৎ।কে না চায় একজন আদর্শ বৌমা?আর তুমি আমার দান নিতে চাইছোনা…..নিওনা।বরং তোমার এই সিদ্ধান্ত আমাকে তোমার প্রতি আরো শ্রদ্ধাশীল করে তুলেছে! এ কথা শোনার পর তো আমি আরও তোমাকে ছাড়তে পারবো না মা।যে করেই হোক,এ বিয়ে হবেই!তুমি না করোনা মা।আমার দান তুমি নিওনা,কিন্তু আমার প্রস্তাবটা তুমি ফিরিয়ে দিওনা মা….প্লিজ ! জানো তো,কারো উপকার করাটাও অনেক বড় সওয়াবের কাজ! ”
*
নাযিয়াত বিপর্যস্ত বোধ করলো।বেলা দুহাতে ওর হাত চেপে ধরেছেন।সে মানা করে চলে যেতে এসেছিলো।কিন্তু এভাবে ফেঁসে যাবে ভাবেনি!কাঁপা কন্ঠে ফের বলতে চেষ্টা করলো-“কিন্তু….প্রি..প্রিয়ন্ত
ী….!”
-“ও এসব ব্যাপারে খুবই উদার। তুমি চাইলে ওর সাথে কথা বলতে পারো।”
নাযিয়াত মাথা নাড়লো-“জ্বী!”
বেলা উঠে প্রিয়ন্তীকে ডাকতে গেলেন।
প্রিয়ন্তীকে ঘুমাতে দেখে ফিরে এলেন-“ও তো ঘুমিয়ে আছে তাই ডাকিনি!তুমি বললে ডেকে তুলি?”
-“,আচ্ছা,থাক্।আজ আমি নাহয় উঠি আন্টি!”
বেলা তবু ওকে বসিয়ে জোর করে মিষ্টি খাইয়ে দিলেন।
বাড়ী ফেরার পথে নাযিয়াত চিন্তায় পড়ে গেলো!ওর বিয়ে হয়ে গেলে ওদের সংসার চলবে কি করে!মা’ও একই কথা বলছিলেন।কেবল নাদিয়া বলেছে’ নিজেদের ভবিষ্যত ঠিক রাখতে আমরা বড়াপুর ভবিষ্যত নষ্ট হতে দিতে পারিনা!এতো ভালো একটা প্রস্তাব।না করা উচিত হবেনা!সেই মা’কে ক্রমাগত বোঝাচ্ছে বিয়ের ব্যপারে রাজী হবার জন্য!
সময় এবং পরিস্থিতি সবসময় সবার অনুকূলে থাকেনা!বড়াপু’র জন্য যে প্রস্তাবটা এসেছে এটা কোনোদিক দিয়ে ফেলনা নয় তাই রাজী হওয়াটাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ!
★
★ ★
রাতে রাফিজ ফিরলে বেলা ওর সাথে কথা বললেন!রাফিজ প্রথমে হতভম্ব হয়ে গেলো তারপর বললো-“এসব তুমি কি বলছো মা?”
-“যা বলছি,ঠিকই বলছি ,একদম প্রাকটিকাল কথা বলছি।পাঁচ বছর হয়েছে তোর বিয়ে হয়েছে, আজ পর্যন্ত একটা নাতি নাতনীর মুখ দেখলাম না!তোর বাবা ডাক শুনতে ইচ্ছে না করলেও আমার তো ‘দাদু’ ডাক শুনতে ইচ্ছে করে!
তুই আমার পরিবার আর বংশের স্বার্থে রাজী হয়ে যা বাপ।কেনোকিছুই বদলাবে না,সব যেমন আছে তেমনি থাকবে,কেবল নাযিয়াত এ বাড়ীতে একজন সদস্য হয়ে আসবে!
রাফিজ নিরব রইলো!আর কেউ না জানুক,ও নিজে জানে, পিতৃত্বের আকাঙ্খা ওর ভেতরটা কতখানি পোড়ায়! কিন্তু প্রিয়ন্তীকে কষ্ট দেয়া হবে ভেবে ও সবসময় চুপ থেকেছে।
আজ মায়ের এ কথাগুলো ওর মনের বন্ধ দরজায় আঘাত করলো যেন!
তবু বললো-“আমি প্রিয়ন্তীর সাথে একটু কথা বলতে চাই,মা !”
-“ওর অনুমতি নিতে?শরীয়ত অনুযায়ী স্বামীর ২য় বারের বিয়েতে ১ম স্ত্রী’র কোনো অনুমতি লাগেনা তবে আমাদের মুসলিম আইনে আবার অনুমতি লাগে তাই আমি প্রিয়ন্তীর সাথে কথা বলেছি!ওর তো কোনো বিকার নেই!,এ কেমন মেয়ে রে বাবা!হুঁ…হাঁ…টু..টা নেই!যেন ওর কিছু যায় আস। না!তোদের কেনো ঝগড়া হয়েছে নাকি?”
রাফিজ একটা দীর্ঘশ্বাস চাপল!সে কি করে বলবে মা’কে যে প্রিয়ন্তী এক অদ্ভুত মেয়ে।কোনো বিষয়েই তার কোনো আগ্রহ নেই!নির্লিপ্ততা,নির্বিকারত্ব তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য!অত্যন্ত শীতল প্রকৃতির মেয়ে সে।তার সঙ্গে দাম্পত্য সম্পর্কটা রাফিজের কাছে একটা বোঝার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে।যে বোঝাটা সে বয়ে বেড়াচ্ছে কেবল।চিরকালের মায়ের গুডি বয় হিসেবে খ্যাত রাফিজ তার নিজের জীবন দিয়ে বুঝতে পারছে যে,দৃশ্যত বিয়ে করলেও বাস্তবিক সে কোনো সংসার পায়নি!প্রিয়ন্তীর মধ্যে কোনো উষ্ণতা নেই,রাগ নেই,জেদ নেই,খুনসুটি নেই!সত্যি বলতে প্রিয়ন্তীর সাথে কোনোরকম মানসিক বন্ধনই তার গড়ে ওঠেনি।চারিদিকে স্বামী কর্তৃক স্ত্রী’র প্রতি অত্যাচারের অনেক ঘটনা সে শুনেছে কিন্তু স্ত্রী কর্তৃক স্বামীর প্রতি এমন নিরব অত্যাচারের গল্প কেউ কি শুনেছে?যার ভুক্তোভোগী রাফিজ নিজে।অথচ বাইরে থেকে যে কেউ দেখলে বলবে পুতুলের মতো বউ পেয়েও স্বামীর মন উঠেনা! প্রিয়ন্তীকে কখনো কোনভাবেই সে উদ্দীপিত করতে পারেনি!ব্যর্থতাটা কার তা আজো রাফিজ বুঝে উঠতে পারেনা!
ছেলেকে নিরব দেখে বেলা বললেন-“শোন্,যা করছি,তা তোর ভালোর জন্যই করছি!
রাফিজ কিছু বলতে যাবার আগেই ডোরবেল বাজলো!রাফিজ উঠে নিজের রুমে চলে গেলো!ময়না এসে জানালো,প্রিয়ন্তীর বাবা মা দুজনই এসেছে!
বেলা ওদেরকে ভেতরে নিয়ে আসতে বললেন।তিনি জানতেন,এমনটা ঘটবে।তাই পূর্ব থেকেই মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন!
প্রিয়ন্তীর বাবা-মা আর বেলা চোধুরী প্রায় একঘন্টা রুদ্ধদ্বার বৈঠক করলেন।
পরিশেষে সিদ্ধান্ত হলো,রাফিজ তার নতুন বৌ কে ঘরে আনুক,সংসার করুক,ততদিন প্রিয়ন্তী তার মামার কাছে অষ্ট্রেলিয়া থাকবে!প্রিয়ন্তীর বাবা তার মেয়ের মনের ওপর কোনোরকম চাপ পড়তে দিতে চাননা!তার ইচ্ছা,পরবর্তীতে পরিস্থিতি বুঝে প্রিয়ন্তীকে বাংলাদেশে আনিয়ে নেয়া যাবে!তার আগ পর্যন্ত প্রিয়ন্তী ওর মামার কাছেই থাকবে!
বেলা তাদের মনের উষ্মা টের পেলেও মুখে কিছু বললেন না!কেবল প্রিয়ন্তীর বাবাকে এই বলে আশ্বস্ত করলেন যে,তার নাতি পৃথিবীতে আসার পরেই প্রিয়ন্তীর পথ পরিস্কার করার কাজ শুরু করবেন তিনি!এটা তার দায়িত্ব হয়ে থাকলো!প্রিয়ন্তীর সংসার প্রিয়ন্তীরই থাকবে!এটা অন্য কারো হতে দেবেন না তিনি!
প্রিয়ন্তীর বাবা-মা নির্ভার হয়ে মেয়ের সাথে দেখা করে চলে গেলেন!
*
রাফিজ ঘরে ঢুকে দেখলো প্রিয়ন্তী শুয়ে শুয়ে একটা ম্যাগাজিন পড়ছে।রাফিজকে দেখে সে ফিরেও তাকালোনা।ব্যপারটা প্রথম দিকে রাফিজের খুব খারাপ লাগতো কিন্তু এখন গা সওয়া হয়ে গেছে!সে নিজে থেকেই ডাকলো-“প্রিয়ন্তী…?”
-“(জবাব নেই)”
-“প্রিয়….তুমি কি আমার ওপর রাগ করেছো ?”
-“মমম?কিছু বললে?”
রাফিজ ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো-“আমি যে ঘরে ঢুকেছি তা কি তুমি দেখেছো?”
-“উফ্…বিরক্ত করোনা তো,আমি একটা গুরুত্বপূর্ণ নিউজ পড়ছি।অজয় আর কাজলের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে!”
রাফিজ বুকের ভেতর থেকে জেগে ওঠা রাগটাকে দমন করে বললো-“তোমার নিজের জীবনে কি ঘটতে চলছে সে বিষয়ে তোমার কোনো হুঁশ নেই,তুমি এসেছো আরেকজনের দাম্পত্য নিয়ে গসীপ করতে!”
প্রিয়ন্তী ‘ধ্যুৎ’ বলে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে ম্যাগাজিনে মন দিলো!রাফিজ পেছন দিক থেকে ওর দিকে চেয়ে রইলো!তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে পড়লো!বারান্দায় এসে সিগারেট ধরালো।মাথার ভেতর বিক্ষিপ্ত চিন্তা এলোমেলো জট পাকাচ্ছে!কি ঘটতে যাচ্ছে তার জীবনে!না জানি কোন্ নতুন অশান্তি আবার এসে জুটবে!এক অশান্তি তো রোজকার চলছেই!এরপর যে কি নতুন অশান্তি হবে!
লম্বা করে সিগারেটে টান দিয়ে নাকমুখ দিয়ে ধোঁয়ার সাথে সমস্ত চিন্তা উদ্বেগগুলোকে যেন বের করে দিতে চাইলো রাফিজ !
★
পরের সপ্তাহেই প্রিয়ন্তী হাসিমুখে অষ্ট্রেলিয়া চলে গেলো।যাবার আগের দিন রাতে রাফিজ প্রিয়ন্তীকে জড়িয়ে ধরে ওর মনের খবর নিতে চেষ্টা করেছিলো!প্রিয়ন্
তী ছটফটিয়ে নিজেকে মুক্ত করে সরিয়ে নিয়ে বলল-“আরে তুমি এমন করছো কেন,আমাদের তো আর বিচ্ছেদ হচ্ছে না,এসব সিলি বিষয়,হরহামেশাই হচ্ছে!তাছাড়া আমাদের সম্পর্ক তো থাকছেই!কেন তুমি দিব্যাভারতীর ঐ ছবিটা দেখনি..?”
-“শাটআপ…জাষ্ট শাটআপ!”(প্রচন্ড ধমকে প্রিয়ন্তীকে থামিয়ে দিয়েছিলো রাফিজ)সবসময় খালি,ঐ নায়ক এই নায়িকা,অমুক সিনেমা তমুক সিরিয়াল।এসবের বাইরে কিছু ভাবতে শেখোনি?”
-“আগামীকাল আমি অষ্ট্রেলিয়া চলে যাচ্ছি আর তুমি আমাকে ধমকাচ্ছো?যাকগে ,আমার ওসব নিয়ে মাথাব্যথা নেই!আমি তোমার মতো এসব সিলি সেন্টিমেন্টে ভুগি না!এসব আমাদের জীবনেরই অংশ,বুঝলে?একটু প্রাকটিক্যাল হতে শেখো!”
রাফিজ আর কথা বাড়ায়নি!প্রিয়ন্তী খুব স্বাভাবিক ভাবেই বিদায় নিয়ে চলে গেলো!সারাটা দিন এক অস্থিরতার মধ্যে কাটলো রাফিজের।এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশঙ্কা পেয়ে বসেছে ওকে।আর কতবার ওকে মায়ের স্বেচ্ছাচারীতার বলি হতে হবে!
★
এর দিন দুয়েক পরেই এক ঘরোয়া পরিবেশে,খুব ঘনিষ্ট দু একজন আত্মীয়ের উপস্থিতিতে রাফিজের সাথে নাযিয়াতের বিয়েটা হয়ে গেলো!
বেলা চৌধুরী তেমন কাউকেই জানাননি এ বিয়ের কথা!ঘনিষ্ট দুচারজনকে নিয়ে ঘরোয়াভাবে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সারলেন তিনি!নাদিয়া,নাঈ
মা,নিকিতা,রেশমা চোখের জলে ভাসতে ভাসতে নাযিয়াতকে বিদায় দিলো!বিয়েতে নাযিয়াতের বড় মামা উপস্থিত ছিলেন।ওর বাবার অনুপস্থিতিতে তিনিই ওদের একমাত্র অভিভাবক!নাযিয়াতের বিয়ের স্বপক্ষে তার ভূমিকাটাই ছিলো সবচে বেশী জোরালো!
★
নিরবে চোখের পানি ফেলছিলো নাযিয়াত।কয়েকবার চারিদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলো,আরেকজনের সাজানো সংসারে ঢুকে পড়েছে সে!নাযিয়াত জানে,এখনো দ্বিতীয় বিয়ে বা ২য় স্ত্রী’র মানসিকতা মুসলিম সমাজে এতটা সমৃদ্ধি লাভ করেনি!এখনো এটাকে মন্দ চোখেই দেখা হয়।পুরুষ মানুষ একসাথে দশটা গার্লফ্রেন্ড পুষলেও তাকে কেউ ততটা খারাপ বলেনা যতটা খারাপ বলে অধিক বিয়ে করলে।অথচ সম্মাণিত সাহাবায়ে কেরামগণের প্রায় অনেকেরই একাধিক স্ত্রী ছিলো।তারা সুখে সংসার কাল কাটিয়ে গেছেন।অথচ এখন তো একক সংসারগুলোতেও কেবল স্বামী স্ত্রী’র মাঝেই সে সুখের ছিটেফোঁটাও নেই!অধিক স্ত্রী’গণের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপনের নজির স্বয়ং রাসুল সাঃ স্থাপন করে গেছেন।তবু মুসলিম সমাজে কত দুর্বাক্য বলা হয় এই বিষয়টাকে নিয়ে!বর্তমান সময়ে যে পরিস্থিতি এসেছে,একজন পুরুষ একাধিক স্ত্রী গ্রহন না করলে হাজার হাজার মহিলাকে অবিবাহিতা কুমারী জীবন কাটাতে হবে!কারন বর্তমান জরিপে দেখা গেছে,পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে।ইসলাম সবসময়ই মানবতার সমাধান দিয়ে আসছে।এমন সমস্যা হবে জানে বলেই স্রষ্টা অধিক স্ত্রী’র সুন্নত আমাদের সামনে রেখেছেন।
এখন কেবল কিছু মানুষের বোঝার বাকি!
*
নাযিয়াত নিজ ধর্মের প্রতিটি বিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল বলেই সে এটাকে অন্য অর্থে গ্রহন করেনি বরং খুব স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছে!তবে প্রিয়ন্তী এটাকে কিভাবে নিয়েছে সেটাই ওর জানার ইচ্ছে ছিলো!
প্রিয়ন্তীর সাথে দেখা করে ওর সাথে কথা বলতে চেয়েছিলো নাযিয়াত।কিন্তু সেটাও আর হয়ে উঠলো না!
দুহাঁটুতে কপাল ঠেকিয়ে বসে আছে নাযিয়াত!ওর চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ফুলের পাপড়ী!
সম্ভবত বসে থাকতে গিয়ে ওর চোখটা লেগে এসেছিলো!আচমকা খাটের উপর কারো বসার শব্দে নাযিয়াত তটস্থ হলো!মুখ তুলে তাকিয়ে রাফিজকে দেখে ঘোমটাটা আরেকটু টানলো!
রাফিজের দীর্ঘশ্বাস ফেলার শব্দ স্পষ্ট।
কিছুক্ষণ নিরবতার পর নাযিয়াত বিশুদ্ধ উচ্চারণে সালাম দিলো।
রাফিজ কিছুটা চমকে তাকিয়ে তারপর সালামের উত্তর দিলো!তারপর উঠে বারান্দায় চলে গেলো!
*
নাযিয়াত খানিকক্ষণ বসে থেকে খাট থেকে নামলো!ধীর পায়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো!
-“একটা কথা ছিলো যে…!”
রাফিজ একবার তাকিয়েই মুখ ফিরিয়ে নিলো!
নাযিয়াত কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে চলে আসতে নিলে রাফিজ বললো-“কথা ছিলো বলে চলে যাচ্ছো কেন!কথা শেষ করে যাও!”
নাযিয়াত চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো-“বিয়েটা কি আপনার স্বইচ্ছায় হয়েছে?”
রাফিজ ঘাড় ফেরালো-“মানে?”
-“মানে,বিয়েটা কি আপনি নিজের ইচ্ছেতে করেছেন নাকি মায়ের চাপে…”!
-“আমাকে কি বাচ্চা ছেলে মনে হয়?”
-“না…তা না !মিনিমাম পঞ্চাশের ওপরে তো হবেনই!”বিড়বিড় করে বললো নাযিয়াত।
রাফিজ ঘুরে দাঁড়ালো-“কি?”
-“,আরো বেশী?”
-“তুমি কি আমার সাথে ফাজলামী করার চেষ্টা করছো?”
নাযিয়াত ভীরু চাহনীতে তাকিয়ে মাথা নাড়লো!
রাগে রাফিজেরর মুখে কথা আটকে গেলো-”
-“তুমি ইচ্ছে করেই এটা বলেছো যেন আমি রেগে যাই!আমার এখনো চল্লিশ পেরোয়নি আর….!”
-“স্যরি,বুঝতে ভুল করেছি!”
-“না,বুঝতে কেন ভুল করবে,আমাকে কি এতো বয়স্ক দেখায়?”
-“স্যরি,আমার ধারনার মেশিনটা একদমই অকেজো!”
-“স্বীকার করার জন্য ধন্যবাদ!এখন কি বলবে বলে বিদায় হও!”
-“কোথায় বিদায় হবো?”
-“উফ্….মানে ঘরে যাও!”
-“ও…..আমি,বাসর ঘরের কিছু নিয়ম সম্পর্কে আপনাকে জানাতে এসেছিলাম!”
-“কিসের নিয়ম?”ভ্রু সামান্য কুঁচকে জানতে চাইলো রাফিজ!”
নাযিয়াত হেসে ফেললো!-“কেন,আপনার প্রথম বাসর রাতে নিয়মগুলো পালন করেননি?”
রাফিজের মুখ শক্ত হয়ে গেলো!মনে পড়ে গেলো প্রথম বাসর রাতের কথা!তার সাথে প্রিয়ন্তীর কথাও!এরকম শীতল প্রকৃতির মেয়ে রাফিজ তার জীবনে আরেকটা দেখেছে কিনা বলতে পারবেনা!
রাফিজ সেরাতে কত কথা বলে যে প্রিয়ন্তীকে হাসাতে চেষ্টা করেছিলো কিন্তু প্রিয়ন্তী যেন মুখে ছিপি এঁটে বসেছিলো।একদম এক্সপ্রেশন লেস একটা মানুষ।প্রথমে রাফিজ ভেবেছিলো বাড়ীর জন্য হয়তো মনখারাপ কিন্তু পরে জেনেছে সে মানুষটাই এমন।কোনো উত্তেজনা নেই,উদ্দীপনা নেই!
রাফিজকে চিন্তায় ডুবতে দেখে নাযিয়াত বললো-“বিয়ের রাতে স্ত্রী’র কপালে হাত রেখে দু’আ পড়তে হয় আর দুজন দুরাকাত নামাজ পড়বো,ব্যস্।তারপর আপনাকে আর বিরক্ত করবোনা!
-“কেন?’রাফিজের মুখ ফসকে স্বভাবজাত দুষ্টুমিটা বেরিয়ে এলো! অবচেতন মনটা যেন জানতে চাচ্ছে সব মেয়েই কি প্রিয়ন্তীর মতো আবেগহীন ?
নাযিয়াত মুখ নামিয়ে বললো-“কেন মানে?”
-“মানে ঐ যে বললে,আমাকে আর বিরক্ত করবেনা?”
নাযিয়াত আরক্ত মুখে চুপ করে রইলো।
রাফিজ এগিয়ে এসে বললো-“চলো দেখি,কি কি করতে হবে… শিখিয়ে দাও!”
নাযিয়াত ওর পাশে পাশে চললো!
তারপর
ঘরে এসে বললো-“বসুন!”
রাফিজ বসলে নাযিয়াত ওর হাতে এক টুকরো কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বললো-“এটা পড়তে হবে!”
-“কপালে হাত রেখে?”
-“জ্বী!”
রাফিজ তাই করলো!
নাযিয়াত কাগজটা হাতে নিয়ে বললো-“এবার,অযু করে আসুন!”
-“আবার অযু করতে হবে?”
-“কেন,করা আছে?”
-“ও…না করে নিচ্ছি!”
কিছুক্ষণ পর দুজনে নামাজে দাঁড়ালো।
নামাজ পড়তে গিয়ে রাফিজের মনে হলো সে এই প্রথম কোনো মেয়ের পাশে দাঁড়িয়েছে যে তার স্ত্রী!পরক্ষণেই চিন্তাটাকে উড়িয়ে দিলো!এভাবে প্রিয়ন্তীকে ছোট করার কোনো মানে হয়না!নামাজ শেষে পূর্ব মুডে ফিরে গেলো সে!পুনরায় বারান্দায় চলে গেলো!এবার আর নাযিয়াত তাকে ডাকলো না কিন্তু রাফিজের ইচ্ছে হচ্ছিলো মেয়েটি তাকে ডাকুক,কথা বলুক।কারন তার কথা শোনার মতো এতদিন যে কেউ ছিলোনা!
……
চলবে……