উত্তরাধিকার পর্ব-০৫

0
1267

#উত্তরাধিকার
#৫ম_পর্ব
#অনন্য_শফিক



অফিসে খুব কানাঘুষা চলছে।অনেক মেয়েই হিংসা করছে সাঁজবাতিকে। ওকে দেখে হিংসা করার যথেষ্ট কারণ আছে।প্রথমত ওর যা দারুণ চেহারা! এমন চেহারার একটা মেয়ে নাটক ফাটক করবে,মিডিয়া কাঁপাবে এসব না করে এখানে এসে কী করছে!
দ্বিতীয়ত, এই অফিসের অনেক মেয়েই মেহের স্যারের কাছে ঘেঁষে দুটো কথা বলতে খুব মুখিয়ে থাকতো! কিন্তু তাদের এই সুযোগটুকুই হতো না।অথচ কাল এসে আজই এই মেয়ে স্যারের গা ঘেঁষে হাঁটে। সকাল নাই দুপুর নাই সাঁই সাঁই করে গাড়িতে উঠে কোথায় জানি চলে যায় দুজনে।
এটাও হতে পারে কানাঘুষার কারণ।
অবশ্য এসব কানাঘুষা করে কোন লাভও নাই।মেহের কিংবা সাঁজবাতি এখানে কখনো আসবে না ওদের কানাঘুষা শুনতে!

সাঁজবাতি কদিনেই মেহেরের কাছের বন্ধু হয়ে গেল। আপনি থেকে ওরা নেমে এলো তুমিতে।সাঁজবাতি অবশ্য এর জন্য কম চেষ্টা করেনি! একেক দিন একেক রকম করে সেজেগুজে এসেছে। নিজেকে সব সময় এমন ভাবে উপস্থাপন করেছে যেন মেহের ওর প্রেম দরিয়ায় নাকানিচুবানি খায়।তা বেশ খেয়েছেও। গতকাল যে শাড়ি পরে এসেছিল সে তা ছিল কুচিবিহীন। সাদামাটা।শাড়ির দামও কম। তবে রং ভালো। কলাপাতার মতো।মেহের ওর দিকে চোখ রাখতে পারছিলো না যেন!
এসব দেখে দেখে তার মন ব্যকুল হয়ে উঠলো।আর তর সইছিলো না!সে এক পর্যায়ে বলেও ফেললো,’সাঁজ, আমরা কী তুমি করে বলতে পারি না?’
সাঁজবাতি কামনার হাসি হেসে বললো,’কেন নয়! আপনি আমার স্যার। আপনি যেভাবে বলবেন সেভাবেই হবে।’
মেহের বললো,’আমার- তোমার ভেতর কেউ স্যার কিংবা সেক্রেটারি এমন কোন বিষয় নেই। আমার তোমার ভেতর যা থাকবে তা ফ্রেন্ডশীপ।’
‘ও মাই গড্! ইটস্ মাই প্লেজার!স্যার আপনি আমায় চমকে দিলেন!’
‘আবার স্যার! আবার আপনি?’
সাঁজবাতি বললো,’সরি!মেহের তুমি আমায় চমকে দিয়েছো একেবারে!’
মেহের হাসলো। হেসে বললো,’সবে তো শুরু।আরো কত চমক যে বাকী রয়ে গেছে!’
সাঁজবাতি গোলাপের পাপড়ির মতো লাল টুকটুকে ঠোঁট মেলে হাসলো। সেই ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে ওর মুক্তোর মতো সাদা ঝকঝকে দাঁত দেখা গেল স্পষ্ট।কী সুন্দর কী সুন্দর! তারপর বললো,’আমি ভীষণ ভাবে ওয়েট করে যাবো ওইসব চমক মাখা দিনগুলোর জন্য!’
তারপর ওরা দুজন হাঁটলো গাড়ি থেকে নেমে। গাছতলায় মাদুর পেতে বসে আইসক্রিম খেলো।বাদাম খেলো। সন্ধ্যা নেমে এলে মেহের বললো,’কখনো স্মোক করেছো সাঁজ?’
সাঁজবাতি হেসে বললো,’করেছি। একবার খুব কাশি হয়েছিল।মা তখন তেজপাতা দিয়ে বিড়ি বানিয়ে দিলো।বললো টেনে ধোঁয়াটা গিলতে।আমি গিলেছিলাম!’
মেহের হাত তালি দিয়ে হেসে উঠলো। তারপর পকেট থেকে সিগারেট আর লাইটার বের করলো।একটা নিজে ধরালো।আরেকটা ধরিয়ে ওর হাতে দিলো।সাঁজবাতি সিগারেট হাতে নিয়ে বললো,’স্যার, আপনার জন্য আমি সব করতে পারি।যেহেতু আপনি আমার বস। সিগারেট খেতে বলেছেন এতে যদি আপনি আনন্দ পান তবে আমি আনন্দ দিতে রাজি আছি!’
মেহেরের কী যে ভালো লাগে এই মেয়েটির আচরণ! আজকালকার যুগে এমন মেয়েও পাওয়া যায়? আহ্! তাকে এতো টা সম্মান করে!
কিন্তু মেহের আবার বললো ওকে।সতর্ক করে দিয়ে বললো,’তুমি কিন্তু বারবার স্যার ডাকছো আমায়।এসব চলবে না বলে দিলাম!’
সাঁজবাতি চেইন স্মোকারদের মতো সিগারেট টেনে টেনে বললো,’এটা আর হবে না!’
কিন্তু মেহের কিছুই বুঝতে পারলো না।সে ভাবলো,মেয়েটি জীবনে এই প্রথম স্মোক করছে। এবং তাও শুধুমাত্র তার কথা রাখতে গিয়ে। উফ্ কী ভালো মেয়ে!
তারপর সে বললো,’একটু আগে তোমার মার কথা বললে!উনি এখন কোথায় আছেন?’
সাঁজবাতি যেন থমকে গেল। থমকে গিয়ে বললো,’জানি না।’
‘কেন? জানো না কেন?’
‘আমার যখন দশ বছর বয়স তখন মা বাবার এক বন্ধুর সাথে পালিয়ে যায়। একবছর পর লুকিয়ে মা এসেছিল আমায় নিয়ে যেতে।আমি যাইনি। এরপর আর জানি না মা কোথায় আছে। তবে শুনেছি মানুষের কাছে।মা বাবার ওই বন্ধুকে নিয়ে সুইজারল্যান্ড আছে।’
মেহের দুঃখ পেলো কথাটা শুনে।সে বললো,’সরি সাঁজ! তোমায় দুঃখ দিলাম আমি!’
সাঁজবাতি বললো,’আরে না,না।আমি নিজ থেকেই আরো কিছু বলবো। আমার বাবা এরপর সুইসাইড করলেন। তারপর আমি দাদির কাছে ছিলাম। আমার যখন মাস্টার্স শেষ হলো তখন দাদিও মারা গেলেন। এরপর থেকে আমি একা।চির একা। আমার আর কেউই নেই!’
সিগারেটের ধোঁয়ার ভেতর মেহের দেখলো একটা অপূর্ব সুন্দর মেয়ে জলে চোখ ভাসিয়ে দিয়ে কাঁদছে। এই প্রথম সে মেয়েটির হাত শক্ত করে ধরলো। তারপর বললো,’সাঁজ, তোমার কেউ নাই এই কথাটি ভুলে যাও।আমি আছি এখন থেকে।সব সময় ছায়ার মতো মিশে থাকবো তোমার সাথে।’
সাঁজবাতি জলভরা চোখে ওর দিকে তাকালো। তাকিয়ে বললো,’থ্যাংক য়্যু মেহের!’

রাত বারোটা বাজলেও যখন মেহের বাসায় ফিরলো না তখন ফোন করলো হেমা। ফোন বন্ধ মেহেরের। বারংবার ডায়েল করছে ও।সেই এক কথায়।বন্ধ বন্ধ বন্ধ!
এর আগে কখনোই এমন হয়নি।অত রাত করেনি কখনো বাসায় ফিরতে।
হেমার কাছে অফিসের নম্বর আছে।সে ফোন করলে একজন জানালো স্যার তো আজ বিকেল থেকেই অফিসে নেই। এবার চিন্তাটা আরো বেড়ে গেল। আজকাল একটানা গাড়ি এক্সিডেন্ট হচ্ছে।কী জানি মেহেরের কিছু হয়ে গেল কি না!
হেমার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। ধুকপুক করছে বুক।সে দু রাকাত সালাতুল হাজাত নামাজ আদায় করলো। তারপর দু হাত তুলে ওর জন্য দোয়া করলো।বড় আকুতি মিনতি করে আল্লাহর কাছে সে বললো আল্লাহ যেন তার ভালোবাসার মানুষটিকে কোন প্রকার বিপদের সম্মুখীন না করেন!

মেহের অবশ্য বাসার পথ ধরেছে মাত্র।এর আগে সে ছিল সাঁজবাতির বাসায়।সাঁজবাতি একলা একা একটা ফ্ল্যাটে থাকে।ওর মন খুব খারাপ ছিল আজ।কাঁদছিলো খানিক পর পর।তাই সে সঙ্গ দিয়ে মন ভালো করে রেখে এলো।
বাসায় ফিরে অবশ্য সে একটা মিথ্যে কথা বলবে বলে ঠিক করলো।
মেহের যখন বাসায় ফিরলো তখন রাত একটা পঁচিশ মিনিট বাজে।সে কলিং বেল চাপতেই দরজাটা হাট করে খুলে দিলো হেমা। এবং দরজা খুলেই সে ঝাঁপিয়ে পড়লো মেহেরের বুকে। তারপর কাঁদতে কাঁদতে বললো,’ফোন বন্ধ কেন তোমার মেহের?অত দেরি করলে কেন ফিরতে?’
মেহের মিথ্যে কথাটিই বললো।বললো,’অফিসের একটা লোকের হঠাৎ স্ট্রোক হলো। তাকে নিয়ে হসপিটালে দৌড়ঝাঁপ করলাম। ওদের বাসায় গেলাম। আর ফোন যে কখন সুইচ অফ হয়ে গেল তার খেয়াল ছিল না। ফোন দেখার সময়টুকুও ছিল না আমার!’
হেমার ভীষণ খারাপ লাগছে তার ভালোবাসার মানুষটির জন্য।আহারে বেচারা!কী পরিশ্রমটাই না করলো আজ!সে বললো,’তুমি ফ্রেস হয়ে আসো।আমি তোমার জন্য কোল্ড কিছু নিয়ে আসছি!’
মেহের বললো,’আমি কিচ্ছু খেতে পারবো না। তুমি তো জানোই হসপিটাল থেকে ফিরে আমি কিছু খেতে পারি না!বমি হয়ে যায়!’
হেমার কী যে খারাপ লাগছে এখন!একটা মানুষ অফিস সামলাবে আবার অফিসের লোকদেরও!আর কতো কুলাতে পারে ও একা?সেও তো একটা মানুষ। তারও তো ক্লান্তি আছে!
কবে যে তার মানুষটা একটু মুক্তি পাবে!শান্ত হয়ে দু’টা দিন বাসায় বিশ্রাম নিতে পারবে!
এসব ভাবে হেমা।
মেহের যে খাবে না এর কারণ হসপিটাল টসপিটাল কিছু না।না খাওয়ার কারণ হলো সে সাঁজবাতির বাসা থেকে খেয়ে এসেছে।সাঁজবাতি নিজে ওকে রান্না করে খাইয়েছে। কিন্তু এই কথা তো আর ঘরে বলা যায় না।বললে কী আর সংসার ঠিক থাকবে!

মেহেরের অবশ্য এখন আর হেমার কাছাকাছি হতে ভালো লাগে না। পাঁচ বছর তো অনেক হলো।হেমা এখন পুরনো বস্তুর মতোই।তার সাথে স্যুইট করে না কিছুতেই যেন! ওরকম চাঁদ সুন্দরী মেয়ের সাথে রাতদিন ঘুরাফেরা করলে শ্যামবর্ণের একটা মেয়ে যে কি না তার দাসীর মতোই তার পায়ের কাছে সব সময় পড়ে থাকে ওকে কী করে তার ভালো লাগবে? তবুও নিজের সাথে যুদ্ধ করে ওর কাছাকাছি হয় সে।কেন হয় সে নিজেও জানে না।এতে সে কতোটা তৃপ্ত হয় তাও অনুভব করতে পারে না। কিন্তু অনুভব করতে পারে হেমা।তার কেবল মনে হয়,মেহেরের ভালোবাসা দিন দিন বাড়ছে তার প্রতি। আগে সপ্তাহেও একটাদিন কাছে ঘেঁষতো না। এখন রোজ রোজ ঘেঁষে।আদর করে তাকে কতো কী নামে ডাকে। এমন একজন মানুষের জন্য সে মরে গেলেও ধন্য হবে।তার এই ঠুনকো জীবন ওর জন্য মরতে পেরে স্বার্থক হবে!

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে