উত্তরাধিকার পর্ব-০১

0
2527

#উত্তরাধিকার
#১ম_পর্ব
#অনন্য_শফিক

হেমার হাতের ডিভোর্স পেপারটা ভিজে চুপসে গেছে। সারারাত কেঁদেছে বলে বালিশটা ভিজে গিয়ে সামনে থাকা পেপারটাও ভিজেছে।
কোনমতে একটু শান্ত হয়েছিল হেমা। কিন্তু আবার সেসব মনে হয়ে যাওয়ায় ডুকরে কেঁদে উঠেছে সে!

গতরাতে হেমার ফিফ্থ এনিভার্সারি ছিল।সে সুন্দর করে সেজেছিল।একটু উজ্জ্বল রঙা শাড়ি পরেছিল যাতে করে তার গায়ের শ্যামলা রংটা খানিকটা উজ্জ্বল দেখায়।আর ঠোঁটে মেখেছিল গোলাপ রঙা লিপস্টিক। চোখে কাজল দিয়েছিল। এবং পরিপাটি করে চুল আঁচড়ে নিয়েছিল।
ওর বর মেহের অফিসে ছিল। ফিরবে রাত আটটায়।মেহেরের জন্যই অপেক্ষা করছিলো হেমা। ভেবেছিল মেহের বুঝি ওর জন্য একটা ভালো গিফট নিয়ে আসবে। হয়তোবা তাকে চমকাতে চাইবে গিফট দিয়ে!
কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হলো হেমাকে মেহের ঠিকই চমকে দিয়েছে। তবে তা কাছে টেনে নেয়ার মতো কোন গিফট দিয়ে নয়। একটা বৈবাহিক সম্পর্ক নষ্ট করে দেয়ার ছাড়পত্র দিয়ে।
মেহের এসে যখন দরজায় টোকা দিলো তখন মনে উৎফুল্ল আর ধোকপোকানি ভরা বুক নিয়ে এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলে দিলো হেমা।
আর তখনই তার হাতে পেপারটা দিলো মেহের।
হেমা ভাবলো তাকে বুঝি লাভ লেটার দিয়েছে। হয়তোবা অফিসে বসে বসে টাইপ করেছে সারা বিকেল। তারপর আসার সময় বাইরে থেকে প্রিন্ট করে নিয়ে এসেছে।
হেমা ওর হাত থেকে চিলের মতো ছিনিয়ে নিলো পেপারটা। এবং দৌড়ে গিয়ে ওপাশের ছোট্ট ঘরটার ভেতর ঢুকে খাটের উপর শুয়ে যেই না পেপারটা চোখের সামনে মেলে ধরলো তখনই দেখলো এটা কোন লাভ লেটার নয়।ডিভোর্স পেপার! তখনই ওর ভেতরটা কেঁপে উঠলো।
চোখের পাতা দুটো আপনা আপনিই ভিজে চুপসে গেল।
মেহের তাকে ডিভোর্স দিয়ে দিতে চায় তবে?তাও এমন একটা দিনে যেই দিনটিতে নাকি তারা যুগলবন্দী হয়েছিল!
হেমার হাতে ধরা ডিভোর্স পেপারখানি জলে ভিজে চুপসে গেছে।সে বালিশের ভেতর মুখ গুঁজে কাঁদছে। খুব খুব করে কাঁদছে।
কান্না শোনে মেহের ওর কাছে এসে দাঁড়ালো। তারপর বললো,’তোমায় আমি ডিভোর্স দিতে চাই না হেমা!সত্যিই চাই না!’
হেমা কথাটা শুনে তড়াক করে বিছানা থেকে উঠলো। তারপর মেহেরকে জড়িয়ে ধরে বললো,’আমার সাথে এমন করে মজা করলে কেন তবে?জানো না আমি একটা ভীতু মেয়ে!
দেখো আমি ভয়ে মরে যাচ্ছিলাম!মেহের,এই মেহের,আমি তোমাকে ভালোবাসি। প্রচন্ড রকম ভালোবাসি।তোমায় ছেড়ে আমি কিছুতেই থাকতে পারবো না জানো!’
মেহের ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,’আমি জানি।জানি বলেই তোমায় ডিভোর্স দিতে চাই না আমি। কিন্তু!’
‘কিন্তু কী মেহের?বলো কী?’
মেহের বললো,’তোমার তো কোন বেবি হবে না।কত ডাক্তার দেখালাম।সবার এক কথাই। তুমি কোনদিন মা হতে পারবে না। কিন্তু আমার বেবি চাই! আমাকে আরেকটি বিয়ের অনুমতি তুমি দাও।যদি অনুমতি না দেও তবে আমি অসহায় হয়ে তোমায় ডিভোর্স দিতে বাধ্য হবো হেমা!’
হেমা চমকালো। এবং সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে দিলো ওকে। তারপর বিছানায় এসে ঝট করে বসে পড়লো।
না ওর তো কোন দোষ নেই। একটা মানুষ সন্তানের শখ করতেই পারে। মানুষ বিয়ে করে পরিবারের বৃদ্ধির জন্য।আর ধর্মেও তো এমন নিষেধ নাই যে একটা বিয়ের পর আর কোন বিয়ে করা যাবে না।কারণ থাকলে অবশ্যই করা যাবে!
কিন্তু হেমা কেন জানি এটা মানতে পারছে না। কীভাবে মানবে সে এটা!মেহের যদি আরেকটা বিয়ে করে তবে যে মেহেরকে সে অর্ধেক করে পাবে। হয়তোবা কোন এক রাতে তার খুব ইচ্ছে করছে মেহেরকে জড়িয়ে ধরে রাখতে।ওর চুলে বিলি কেটে দিতে। কিন্তু দেখা গেল সে রাতে মেহের তার দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে।অথবা দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে চলে গেল। তখন সে কীভাবে এটা সহ্য করবে!
দিনে দিনে সে মেহেরের কাছে জড় বস্তুর মতো হয়ে যাবে।মেহেরের দ্বিতীয় স্ত্রী সন্তান দিবে।এতে তার কদর বাড়বে। ভালোবাসা বাড়বে।আর সে হয়ে যাবে মেহেরের দু চোখের বালি!
এরপর আর ভাবতে পারে না হেমা।
সেই ছোট্ট বেলা থেকেই একটা কষ্ট নিয়ে সে বড় হয়েছে।কালো মেয়ে। গায়ের রং অতটা উজ্জ্বল নয় বলে কত বিয়ে ভেঙে গেছে তার।বাবা মা ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলো একেবারে। ভেবেছিল মেয়েকে বুঝি আর ভালো ঘরে বিয়েই দেয়া হলো না! কিন্তু হঠাৎ যেন ভাগ্যের চাকা ঘুরে গেল। উচ্চবিত্ত পরিবারের মেহেরের মা রং বিচার করেননি। তিনি গুণ বিচার করে বউ ঘরে আনলেন।এতে অবশ্য মেহের শুরুর দিকে তার সাথে খুব একটা ভালো আচরণ করেনি। হেমার স্পষ্ট মনে আছে, বিয়ের প্রথম রাতেই মেহের তাকে বলেছিল,’আমার মারে কী তোমরা জাদু করছিলা?শুনছি তোমার এক মামা জাদুকর। কবিরাজি করে। মানুষকে ধোঁকা দিয়ে বেড়ায়?’
হেমা জানে তার এক মামা কবিরাজ। কিন্তু এমন কিছু তিনি করেন না।আর তার বিয়ের ক্ষেত্রে তা তো প্রশ্নই আসে না।
সে এই কথার কোন উত্তর দেয়নি।
উত্তর না পেয়ে মেহের হেসেছিল। হেসে বলেছিল,’আহ্ কপাল! আহ্।সারা জীবন মানুষের খোঁটা শুনতে হবে।বলবে, অমুকের বউটা পাতিলের নিচের কালি!’
কথাগুলো শুনে হেমা কাঁদতে শুরু করেছিল হাউমাউ করে।
কিন্তু ওর প্রতি একটুও মায়া দেখায়নি মেহের। বরং সেই কনকনে শীতের রাতে তাকে বলেছিল,’যাও।নিচে গিয়ে শুয়ে পড়ো।আমি আবার এ খাট ছাড়া ঘুমোতে পারি না!আর তোমার সাথে এক খাটে থাকার আমার কোন প্রশ্নই আসে না। তুমি আমার নাম মাত্র স্ত্রী। কিন্তু সত্যিকারে তুমি আমার স্ত্রী হওয়ার কোন যোগ্যতাই রাখো না!’
সে রাতে কোন কিছু বলার ক্ষমতা ছিল না হেমার।তাই সে চুপচাপ একটা কাঁথা বিছিয়ে ফ্লোরে শুয়ে পড়েছিল।রাতে শীতে কনকন করে কেঁপেছিল।মশা কামড়ে খেয়েছে তাকে।আর বুকের ভেতরটা কামড়ে কামড়ে খেয়েছিল কষ্ট, দুঃখ,আর যন্ত্রণা নামক পোকারা।
সারা রাত মিন মিন করে কেঁদেছিলো সে। শেষ রাতে কী যে জ্বর এলো গায়ে! এরপর একেবারে টাইফয়েড।
বিয়ের দু’ তিন মাস মেহের ওর কাছেই আসেনি।এক ঘরে থাকলেও কেউ কাউকে ছুঁয়ে দেখেনি। কিন্তু দিন যেতে যেতে মেহেরের কেমন মায়া জমে গেল ওর প্রতি।আস্তে আস্তে ওরা দুজন এক জোড়া চড়ুই পাখির মতো হয়ে গেল। ভালোবাসা এসে ঘর বাঁধলো ওদের দুটি মন নিয়ে।মেহের ওর গায়ের রং নিয়ে আর কখনো কথা বলেনি। বরং সব সময় এটা বলতো, তোমার এই রংটাই বেস্ট। সাদা রঙে তোমায় বিচ্ছিরি দেখাতো!
হেমা তখন খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠতো।
কিন্তু এই এতো দিন গোনলে হবে পূর্ণ পাঁচ বছর।এই পাঁচ বছর পর ফের বদলে গেলো মেহের।
হেমা কেঁদে কেঁদে বললো,’আর কটা দিন দেখি না মেহের!যদি আমি মা হতে পারি?’
মেহের তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,’উঁহু। তুমি এটা কখনোই হতে পারবে না।ইন্ডিয়ার সবচেয়ে নামকরা ডাক্তার পরেশ গাঙ্গুলী যেখানে তোমায় বলেছে তুমি কখনো কনসিভ করতে পারবে না ওখানে আবার এমন কথা বলো কী করে তুমি?
তাছাড়া তোমার জন্য তো আর কম পয়সা খরচা করিনি আমি। তোমার পেছনে যতো টাকা খরচা করেছি এই টাকা জমিয়ে রাখলে একটা বাড়ি করা যেতো নতুন!’
হেমা আর কী বলতে পারে তখন?
তবুও সে বেহায়ার মতো মেহেরের দুটি পায়ে লুটিয়ে পড়লো। তারপর রোদন করে করে বললো,’মেহের, আমার উপর দয়া করো তুমি!তুমি এমন কিছু করো না প্লিজ!আমি সহ্য করতে পারবো না মেহের!মরে যাবো আমি!’
হেমার দু বাহু ধরে টেনে উপরে তুললো মেহের। তারপর বললো,’বোকামি কেন করছো হেমা! সবকিছুতেই যদি আমরা আবেগী হয়ে যাই তবে দুনিয়া কীভাবে চলবে বলো? তোমার দিকটাই যে শুধু আমি দেখবো তবে আমার দিকটা কে দেখবে শুনি?এই যে অত অত মিল ফ্যাক্টরি গাড়ি বাড়ি বিজনেস এসব কে দেখবে বলো? আমার যদি কোন উত্তরাধিকারিই না থাকে তবে এসবের ভেল্যু কী বলো?সো,আর পাগলামি নয়।ডিভোর্স কোন ভালো বিষয় নয়। তোমাকে আমি ভালোও বাসি। এই জন্য ওসব চিন্তা বাদ দিয়েছি।আমি এখন আরেকটা বিয়ে করতে চাই।এর জন্য তুমি নিশ্চিত অনুমতি দিবে।যেহেতু আমি তোমায় সেক্রিফাইস করেছি।ডিভোর্সে যাইনি। তবে তোমারও তো উচিৎ আমার প্রতি সেক্রিফাইস করা। সেক্রিফাইস করে আমায় আরেকটা বিয়ে করার জন্য অনুমতি দেয়া?’
হেমা কী করে অনুমতি দিবে?তার হৃদয় যে ফালি ফালি হয়ে যাচ্ছে!
সে বেহায়ার মতো আবার বললো।
ডুকরে কেঁদে কেঁদে।
‘মেহের, তুমি বিয়ে করো না প্লিজ।আমরা একটা দত্তক ছেলে আনবো বরং।দেশে তো অনেক পাওয়া যায় এমন!’
মেহের এবার রেগেই গেল। রেগে গিয়ে সে বললো,’ভেবেছিলাম তোমার সাথে ভালো আচরণ করবো।সারা জীবন আমার বউ করেই রাখবো। কিন্তু এখন দেখছি তুমি এটা চাচ্ছো না।যেহেতু চাচ্ছো না তবে আর আমার কী করার থাকে বলো? এবার তবে সহজটাই হোক।ওই যে খাটের উপর পেপার তো আছেই। সিগনেচার করে দিও।আর অফিসিয়াল ব্যপারগুলো আমি মেইন্টেইন করবো।কাজি অফিস যেতে হলে তোমায় নিয়ে যাবো একদিন।’

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে