,,পর্ব-৪(শেষ পর্ব)
,,উড়বে হওয়ায় বিষন্ন চিঠি
,,জিনাত আফরোজ
,,তুই যখন কালকে না খেয়ে বাড়ি চলে গেলি সোহেব ভাই চিল্লাচিল্লি করে তয়নাদের পাঠায় খাবার নিয়ে। এর পরও ভাইয়া শান্তি পাচ্ছিলো না উনি কালকে বুঝতে পারছে, তুইও ভাইয়াকে পছন্দ করিস। যখন ওর বিয়ের কথা বলছে খালু তখন তুই না-কি চোখ মুখ বন্ধ করে ছিলি। চোখ খুলার পর তোর চোখে পানি ছিলো। ভাইয়ার আর বুঝতে বাকি নেই তুইও ভাইয়াকে পছন্দ করিস। তারপর সোহাইল ভাইকে ডেকে নিয়ে যায় নিজের কাছে আর আমাকে পাঠায় তুই কেমন আছিস দেখতে। ওরা ছোট বুঝতে পারেনি তুই যে কান্না করছিস কিন্তু আমি ঠিকেই ধরে ফেলছি তুই কান্না করছিস। ভাইয়ার ভয় ছিলো তুই না আবার উল্টা পাল্টা কিছু করে বসিস।
– তুমি কী আগে থেকে জানতে জামির ভাই, সোহেব ভাই আমাকে পছন্দ করে?
– হুম, শুধু পছন্দ করে না সোহেব ভাই তোকে অনেক ভালোবাসে। আর এটা শুধু আমি আর সোহাইল ভাই জানতাম। তোর মনে আছে ছোট মামার বিয়ের সময় খুব সুন্দর একটা ছোট্ট শোপিচ পড়ছিলো, অনেক দামী। তুই নিতে চাইছিলি কিন্তু খালামুনি তোকে বকা দিছে অন্যর জিনিস চাওয়াতে। তখন না-কি তোর মুখটা শুকিয়ে গেছে। তার কয়েকদিন পরে আমি আর সোহাইল ভাই ঢাকা গিয়েছিলাম। ভাইয়া আমাদেরকে শোপিচটা আনতে বলে। আনার পর আমি আর সোহাইল ভাই চেপে ধরি ভাইয়াকে। তখন না পারতে ভাইয়া স্বীকার করে যে ও তোকে ভালোবাসে।
জামির ভাইর থেকে এতো গুলো কথা শুনে এতক্ষণে আটকে রাখা শ্বাসটা ফেলি। আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না জামির ভাইর কথা গুলো। এটাও কী সম্ভব? এ রাগী, গম্ভীর মানুষটা আমাকে এতোটা ভালোবাসে।
তাহলে কালকে আমাকে আব্বু মা*রা*র সময় ধরলো না কেনো? কাউকেই বা কিছু বলেনি কেনো?
– কাল রাতে কি হইছে জামির ভাই ?
এবার তুশি আপা রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলে,
– ভাবতেই পারবি নারে ইলু,কালকে রাতে কী হইছে। আমার যে ভাই কখনো কারোর সাথে ভালো করে কথা বলে না, কারোর কাছে নিজের জন্য কিছু চায়না। সে ভাইটা আমার কালকে তোর জন্য, খালু আর আম্মুর পা ধরে বসে ছিলো ততক্ষণ, যতক্ষণ না ওরা রাজি হইছে বিয়ের জন্য।ভাবতে পারিস আমার রাগী,গম্ভীর ভাইটা তোকে কতটা ভালোবাসে।
– তাহলে কালকে কেনো কিছু বলিনি তুশি আপা?
আপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
– আমরা তো আর জানতাম না এসব, ভাইয়া না-কি কালকে আম্মুকে তোর কথা বলছে। আম্মু না-কি চিল্লাচিল্লি করছে ভাইয়ার সাথে। ভাইয়াকে ওয়াদা করাইছে তোর কথা জেনো আর না মুখে আনে। ভাইয়া অসহায় হয়ে পড়ে কি করবে না করবে। ভাবছিলো আরও কয়েক দিন সময় নিয়ে আম্মুকে বুঝাবে। কিন্তু সকালে এরকম ঘটনা ঘটে যাবে ভাবেনি। তখন খালুর মাথা গরম ছিলো আম্মু না-কি তখনো ভাইয়াকে কসম দেয়। তাই ভাইয়া তখন কিছু বলেনি। খালামুনিকে শুধু বলছে তোকে যেনো একটু বুঝায় তুই যেনো উল্টা পাল্টা কিছু করে না বসিস। কিন্তু কাল রাতে যখন শুনে তুই কিছু খাসনি, সারাটা দিন কান্না করছিস। তখন ভাইয়া আর নিজেকে আটকাতে পারেনি নানার কাছে সব বলে। খালা,খালমুনিকে ডেকে আনে, তারপর আর কী কাঁদতে কাঁদতে আম্মুকে বলে ওয়াদা ফিরিয়ে নিতে, হাত-পা ধরে অনেক কষ্টে রাজি করায়।
– আপা খালামুনি এখনো রেগে আছে তাই না?
– হুম তাতো আছে, তুই মন জয় করে নিবি।
তখন ডালিয়া ভাবি আর সোহাইল ভাইও সেখানে আসে।
ভাবি আমার হাতে হাত রেখে বলে,
– তুমি খুব ভাগ্যবতি আপু, ভাইয়ার মতো এমন একটা জীবনসঙ্গী পেয়েছো। আমি দেখেছি ভাইয়া তোমার জন্য সবাইর কাছে কান্না কাটি করছে।
সোহাইল ভাই বিরস মুখে বলে,
– তুমি শুধু ওর কথা কেনো বলছো? তুমিও তো ভাগ্যবতি আমার মতো বর পেয়ে।
জামির ভাই সোহাইল ভাইকে টিপন্নি কেটে বলে
– সুযোগ পাইয়া নিজেরে প্রোমোট করে দিলা ভাই।
– হুর তুই সিঙ্গেল মানুষ এগুলোর কী বুঝবি।
– আজ সিঙ্গেল বইললা এভাবে অপমান করলা? একদিন দেখবা আমিও টাস করে বিয়ে করে টাস্কি খাওয়াই দিমু।
– টাস্কি মাস্কি খেয়ে পেট ভোরবে না জামির ভাই , তুমি আমাদেরকে গ্রিল খাওয়াও তাতেই হবে।
ইশানের কথা শুনে সবাই হাসতে থাকে।
তখন সেখানে জেমি আপা এসে আমার হাত ধরে বলে,
– সরি রে ইলু আমি বুঝতে পারিনি খালু তোকে এভাবে মা*র*বে। আমার উচিৎ হয়নি এ কাজ করার।
জামির ভাই থমথমে গলায় বলে,
– আপা তুমি আমার বড়ো না হলে কালকে তোমায় কি করতাম নিজেও জানি না। ওর ছোট বেলায় অজান্তা একটা ভুলের কারণে তুমি এরকম একটা কাজ করবে আমি ভাবতেও পারিনি।
তুশি আপা জামির ভাইকে থামিয়ে বলে
– থাক জামির ও এমনি তে কষ্ট পাচ্ছে আর কিছু বলিস না। ইলুকে খালু মা*র*ছে এটার জন্য খারাপ লাগছে, তবে একটা দিক দিয়ে ও ভালো কাজ করছে না হলে ব্যাপারটা আরও খারাপ দিকে মোড় নিতো।
আমিও তুশি আপার সাথে একমত, যেটা হয়েছে ভালোই হইছে।
হাসি হই হুল্লোড় করে বিকাল হয়ে যায়, ওদেরকে যখন জিজ্ঞেস করি, আমাকে সকাল থেকে বলেনি কেনো তখন ওরা বললো, সারপ্রাইজ দিবে ভাবছে তার উপর একদিনে এতো আয়োজন করা তো সম্ভব ছিলো না সবাই মিলে কাজ করতে গিয়ে আর বলেনি।
সবাইর থেকে বিদায় নিয়ে বর ছাড়া বড়ো খালামুনির বাড়িতে নিয়ে আসে আমাকে। আজ থেকে এ বাড়ি, বাড়ির মানুষ গুলো আমার। আমাকে সবাইর মন জয় করতে হবে।
প্রায় সন্ধ্যার সময় সোহেব ভাই এক গাদা শপিং কিনে বাড়িতে আসে। আমার আবারও গাঁ কাঁপিয়ে জ্বর আসে। তবে কাউকে বুঝতে দিচ্ছি না। দুপুরে আম্মু ঔষধ খাইয়ে দিয়েছে তাও কমছে না।
_________________________________________
রাতে আমাকে সোহেব ভাইর রুমে নিয়ে আসে। সুন্দর করে অল্প সময়ের মধ্যে সবাই রুমটাকে সাজিয়েছে। কিন্তু আমার শরীর আর কুলাচ্ছে না বসে থাকতে। আমি কোন রকম ফুল এলোমেলো না করে কাথাঁ গায়ে দিয়ে সাইড করে শুয়ে পড়ি। এক দিক দিয়ে জ্বর আসছে ভালো হইছে আজকে অন্তত সোহেব ভাইর মুখামুখি হতে হবে না।
ইশ ভাবতেই কেমন সুখ সুখ লাগছে এ মানুষটা আমাকে এতো ভালোবাসে। আজ থেকে এ বিছানা আমার, রুমটা আমার, রুমের মালিকও আমার।
______________
সোহেব ভাই তার আরও পরে আসে। এসে আমাকে শুয়ে থাকতে দেখে বলে,
– এই যে মহারানী ইলিয়ানা, এটা কী ঠিক হলো? বরকে রেখে শুয়ে পড়লি।
সোহেব ভাইর কথা শুনে আমি হালকা মাথা উঠিয়ে উনাকে দেখতে বুকের ভেতর রক্ত ঝলকে উঠে। ইশ কী সুন্দর লাগছে, এখন আবার সাদা টিশার্ট পড়ছে। সাদা রং সোহেব ভাইর অনেক পছন্দের। আমি জ্বরের ঘোরেও লজ্জা পাই।
উনি আমার কাছে এসে কপালে হাত দিয়ে বলে,
– ঔষধ আনছি অল্প কিছু খেয়ে ঔষধ খা।
আমি মাথা নাড়লে উনি একটা ধমক দিয়ে বলে
– আর একটা কথা বললে মা*র*বো, উঠ আজ তিনদিন যে পেটে কিছু দিসনি আমার জানা আছে।
তারপর আমাকে জোর করে উঠিয়ে ২,৩ টুকরো ফল খাইয়ে ঔষধ খাইয়ে দেয় ।
আমি আবার শুয়ে পড়লে বলে
– এটা ঠিক না ইলু, আমি কিন্তু বলে দিচ্ছি আমি বাসর রাত করবো, বাসর জ্বর করবো না। সবাইকে কেঁদে কেটে রাজি করায়ছি কী বাসর জ্বর করার জন্য? এটার জন্য কিন্তু কঠিন শাস্তি পাবি।
আমি ফিসফিস করে বলি
– এটা শুধু ব্যাথার জ্বর নয় সোহেব ভাই এটা সুখের জ্বর। এটা প্রেমে গাঁ ভাসিয়ে দেওয়ার জ্বর, এ জ্বরের জোয়ারে তুমি ভেসে যাবে সোহেব ভাই ।
– হুম আপনি তো কাব্যিক মানবী সব কিছুতে কাব্যিক খুঁজে পান।
তারপর উনি আমার ডায়রিটা নিয়ে পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বলে,
– বাহ্ কবি, তুই তো অনেক ভালো ভালো কবিতা লিখিস? এই শুন না কবির ফিমেল ভার্সন কিরে?
– আমি জানি না সোহেব ভাই,
– তো কি জানিস তুই? জ্বর নিয়ে পড়ে আছিস বাসর রাত কি সেটাও জানিস না।
আমি তপ্ত শ্বাস ফেলে মনে মনে বলি
– এ সে সোহেব ভাই তো! যে সব সময় রাগী, আর মুড়ে থাকে।
– এ ইলু ঘুমাস না, বাহিরে জোছনা রাত চল দু’জনে জ্বর জোছনা বিলাস করবো।
আমি মাথা নেড়ে না বলি, উনি আমাকে শক্ত করে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে। আমি ব্যথায় কুঁকড়ে গিয়ে বলি,
– ছাড়ুন আমি ব্যাথা পাচ্ছি।
– পা ব্যাথা, আমি যে তোর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছি তাতে কিছু না। আমি তোর থেকে কিছুটা জ্বর আমার কাছে নিয়ে নিই, তাহলে দু’জনে জ্বর জোছনা বিলাস চমৎকার হবে।
– কচু হবে
তারপর টের পাই আমি সোহেব ভাইর কোলে উনি আমাকে কোলে করে বারান্দায় নিয়ে আসে। বারান্দায় একটা রকিং চেয়ারে নিজে বসে উনার কোলে আমাকেও বসায়। আমি লজ্জায় কুঁকড়ে যাই।
– উফফ,, এই তোর ওয়েট কতো রে? দেখতে মনে হয় পুচকি একটা ২০ কেজিও হবে না। আমার হাত গুলো গেলো।
সোহেব ভাইর কথা শুনে চোখ মুখ কুঁচকে উনার দিকে তাকায়, যে ভাবে বলেছে মনে হচ্ছে সত্যি সত্যি হাত ভেঙ্গে গেছে। এতো ঢং কী করে করতে পারে ? যেভাবে থাকতো মনে হতো এগুলো উনার ডিশকনারীতে নেই। এখন দেখো মুখে খই ফুটছে।
আমাকে চোখ-মুখ কুচঁকে তাকাতে দেখে উনি ফিক করে হেসে, আমার নাকে নাক ঘষে কপালে চুমু দিয়ে দু’গালে আলতো হাত বুলিয়ে বলে,
– সরি ইলু সব কিছু এভাবে হয়ে যাবে ভাবিনি, খুব ব্যাথা পেয়েছিস?
আমি ছলছল নয়নে জ্বরের ঘোরে উনার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে, না বলি।
উনি আমার হাতে একটা রিং পরিয়ে দিয়ে, হাতের উল্টো পিঠে চুমু দেয়।
আমি আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলি, উনি আমাকে আদরে আদরে প্রেমের জোয়ারে ভাসিয়ে দিচ্ছে। কখন যে জ্বরের ঘোরে ঘুমিয়ে গেছি জানি না।
সোহেব ইলমার দিকে তাকিয়ে দেখে ইলমা ঘুমিয়ে গেছে। ও যেমন অবাক হয় তেমন হাসিও পায়। এটা তার জন্য জীবনের শ্রেষ্ট মূহুর্ত, বউকে আদর করতে না করতে ঘুম!!
বড়ো আদর করতে গেলে কী করে বসে,,, ভাবতে পারছি না। এ বউ যে ওকে প্রতিনিয়ত জ্বালাবে এটা ও ভালো করেই বুঝে গেছে। ঘুমন্ত ইলমাকে আবার কোলে নিয়ে সোহেব রুমে এসে ওকে বিছানায় শুয়ে নিজেও ওকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ে।
এ শ্যামাবতি মানবী একান্তই শুধু আমার। জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে, তার উত্তাপ ওর গায়েও লাগছে,তবে এতেও সোহবের ভালো লাগছে। ইলমা ঠিক বলছে এটা ব্যাথার জ্বর নয়, এটা অপ্রত্যাশিত প্রিয় মানুষকে পেয়ে যাওয়া সুখের জ্বর, এটা প্রেমের জোয়ারে গাঁ ভাসিয়ে দেওয়ার জ্বর।
“” তুমি চলে আসো বৃষ্টিস্নাত এই দুপুর রাতে,
জ্বরতপ্ত ললাটে জল দিও,তেতো মুখে তুলে দিও খিচুড়ি।
হৃদয় জঠরে বাড়ন্ত অভিমানের ভ্রুণ গর্ভপাত করে,
শীতার্ত দেহে উষ্ণতা দিও মরচিকার হৃদয়ে নিও শাণ। (কবিতা কালেক্ট)
~সমাপ্ত ~