,,পর্ব- ৩
,, উড়বে হওয়ায় বিষন্ন চিঠি
,,জিনাত আফরোজ
,,তোর আব্বু আত্মীয় স্বজনের মধ্যে সমন্ধ করা পছন্দ করে না। তার অনেক বড়ো কারণ আছে।
এ কথা গুলো আমি চাইনি কখনো তোরা জানিস।
কিন্তু আজকে না বললেই নয়।
তোর আব্বু আমাকে বিয়ে করার আগে, পছন্দ করে উনার এক ফুপাতো বোনকে বিয়ে করে। কিন্তু বিয়েটা ১ মাসও টিকে না, ওই মেয়েটা ১ মাস পর বাবার বাড়িতে গিয়ে আর আসেনি। এমনকি এ সম্পর্ক থেকেও মুক্তি চাইছে। তোর আব্বু অনেক করে জিজ্ঞেস করে ওর কি ভুল ছিলো। কিন্তু মেয়েটা তখন কিছুই বলেনি। তার দুই,তিন মাস পর শুনে ও ওর ভাইয়ের বন্ধুর সাথে পালিয়ে গেছে। তারপর তোর আব্বু আমাকে বিয়ে করে,।
তারপর তোর ছোট ফুফুরও বিয়ে হয় এক আত্মীয় মধ্যে। ভাগ্যের কি পরিহাস সে বিয়েটাও টিকলো না।তখন তোর দাদাও বললো আরও আগেও না-কি তোদের বংশে আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে বিয়ে টিকেনি। সে থেকে তোর আব্বুও ধরে নিয়েছে ওদের মধ্যে আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে কুটুমতা কখনো টিকবে না, এমনিতেই ভালো।
আব্বুর এ কুসংস্কার ধারণা আমার মোটেও পছন্দ হয়নি। আল্লাহ চাইনি বলে উনাদের সংসার টিকেনি তাই বলে যে সবাইর এরকম হবে তা নয়। তবে আমি আম্মুকে আর কিছু বলিনি, যেখানে সোহেব ভাই অপারাগ সেখানে আমি আর কী করতে পারি।
মনকে যতোই এগুলো বলে স্বান্তনা দিই না মন কোন কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না।
রাত প্রায় ১০ টার কাছাকাছি আমার গাঁ কাঁপিয়ে জ্বর আসে।
জায়িন এসে খবর দেয় নানা না-কি আব্বু আর আম্মুকে ডাকছে। আব্বু আমার কাছে এসে বলে,
– আশা করি এমন কিছু করবে না যেটার জন্য অন্যদের ভুগতে হয়।
এ বলে জায়িন আর ইশানকে আমার কাছে রেখে যায়।
আমি আবারও হাইমাউ করে কান্না করতে থাকি।
জ্বরের ঘোরে আবোলতাবোল বকতে থাকি।
রাত কত জানি না হুট করে কিছুর আওয়াজে ঘোর থেকে বের হয়। জ্বরের জন্য বিছানা থেকে উঠে আম্মুকে বলতেও পারছি না যে আমি আর সহ্য করতে পারছি না।
এর মধ্যে আব্বুর কন্ঠ শুনতে পাই, কার সাথে যেনো মোবাইলে কথা বলছে। তার মানে নানার বাড়ি থেকে চলে আসছে, ওইখানে কী হইছে?
আব্বুর কন্ঠ আরও একটু জোরালো হয়। আমি ভালো করে শুনে বুঝতে পারি। আব্বু কাকে যেনো কালকে চলে আসতে বলছে। বলছে তারাহুরো করে ঠিক করছি, এ বন্ধের মধ্যে বিয়েটা দিয়ে দিই। বিয়ের পরেও পড়তে পারবে। আমার কলিজায় মোচড় দিয়ে উঠে। বেশ বুঝতে পারছি আব্বু আমার বিয়ের কথা বলছে।
আমি আবারও হুহু করে মুখে হাত চাপা দিয়ে কাঁদতে থাকি।
আব্বু রাতে রাতে বিয়ে ঠিক করে ফেলছে, সোহেব ভাই কিছুই বলেনি? এ আমি কাকে ভালোবেসেছি?
সকাল সকাল আম্মু ডেকে তুলে, নাস্তা করতে বলে। কিছুক্ষণ পরে পাশের বাড়ির ভাবিরা আসবে গোছল করাতে। যেহেতু আজকেই বিয়ে এখন হলুদ লাগিয়ে গোছল করিয়ে একেবারে রেড়ি করে ফেলবে। একে একে আমার ফুফু,চাচারা আসতেছে তাদের সামনে যেনো কোন রকম পাগলামী না করি শাসিয়ে দেয়। আম্মু আরও কিছু বলতে নিবে আব্বুর ডাকে চলে যায়।
আমি নাস্তা না করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকি। ভাবিদের আওয়াজ শুনে কান্না বন্ধ করে নিজেকে সামলে নিই। ওরা এসে হাসি ঠাট্টা করে আমাকে গোছল করাতে নেয়। ভাবি একটা আমার হাত ধরে নিতে গেলে বুঝতে পারে জ্বরে আমার গাঁ পুড়ে যাচ্ছে। সে কথা বলতে আম্মু চমকে উঠে, তাড়াতাড়ি আমার গায়ে কপালে হাত দিয়ে দেখে আসলে আমার অবস্থা অনেক খারাপ।
আমি আম্মুর অস্থিরতা দেখে অভিমানী কন্ঠে বলি,
– আমি ঠিক আছি আমার কিছুই হয়নি, এত অস্থির হইও না আম্মু।
মনে মনে বলি, ” জ্বর তো কিছুই না আমার ভিতরে তো আরো পুড়ে যাচ্ছে কিন্তু তোমরা সেটা বুঝতে পারছ না আম্মু।
আশেপাশে তাকিয়ে তুলি, ইশানদের কাউকে দেখছি না, এ ঘটনা পর থেকে ওরা আমাকে ঘৃণা করছে না তো? জানিনা ওরা সবাই কোথায়? কেউ নেই এখানে।
আমার আবার খুব কান্না পাচ্ছে কিন্তু এতগুলা মানুষ, আমি কান্নাও করতে পারছি না। কাউকে জিজ্ঞাসও করতে পারছি না কোথায়? কার সাথে বিয়ে দিচ্ছে?
আমাকে গোসল করিয়ে শাড়ী পরিয়ে হালকা সাজিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ পর একটা প্রাইভেট কার আসলে আমাকে নিয়ে ফুফু, চাচীরা গাড়ীতে উঠে। কোথায় যাচ্ছে? আমি বোবার মত শুধু দেখে যাচ্ছি।
পরে দেখি গাড়িটা নানাদের বাড়িতে থামে আমি অবাক হয় এখানে কেনো? বিয়ের আয়োজনও তো এখানে হচ্ছে। অজানা ভয়ে আমি আতংকিত হয়ে পড়ি।গাড়ী থেকে নেমে দেখি তুলি,জায়িনরা সবাই এখানে হাসি হাসি মুখে সবাই আমাকে নিতে আসে। তুশি আপা আমাকে নিয়ে একটা সোফায় বসিয়ে দেয় আর বলে
– তোকে খুব সুন্দর লাগছেরে ইলু।
জামির ভাই আমার মাথায় গাট্টা মেরে বলে,
– কিরে নতুন বউ কেমন আছিস? কী ভাগ্য দেখ তোদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে আর আমি যে বিয়ে বিয়ে করে শুকিয়ে যাচ্ছি সে দিকে কারোর খেয়াল নেই।
আমি জামির ভাইয়ের কথা শুনছি না, আমার ভাবনা এখানে কেনো নিয়ে আসছে? সোহেব ভাই কই?
অদূরে জেমি আপু মুখ ভার করে তাকিয়ে আছে। বেশ বুঝা যাচ্ছে কেউ ওর সাথে কথা বলছে না।
জ্বরে,দুইদিন না খাওয়ায় মাথাটা কেমন ভোঁ ভোঁ করছে, বোধহয় মাথা ঘুরে পড়ে যাবো।
একটু পর ছোট মামুনি ডালিয়া ভাবিকেও নিয়ে আসে অন্য সোফায় বসায়। চোখা চোখি হতে উনি আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসে। আমি লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিই, না জানি উনি কী ভাবছেন কালকের ঘটনাটায়।
সে মুহূর্তে আমার পাশে দপ করে সোহেব ভাই বসে পড়ে। আমি অবাক হয়ে উনার দিকে তাকিয়ে দেখি উনি কালকের মতো নির্বাক হয়ে বসে আছে। যেনো এসব কিছুতে উনার কোন ইন্টারেস্ট নেই। কী সুন্দর লাগছে সাদা একটা পাঞ্জাবি পড়ছে, পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে রাখছে।
ছোট মামা হুজুর, আর উকিল নিয়ে আসেন, একে একে রুমের মধ্যে সবাই প্রবেশ করে সবাইর মুখে মোটামুটি হাসি থাকলেও, আব্বু আর খালামুনির মুখে হাসি নেই। আব্বুর মুখটা শুকিয়ে আছে, আর খালামুনি গম্ভীর থমথম মুখে বসে আছে। উনারা কাছে আসতে সোহেব ভাই বলে উঠে,
– আঙ্কেল তাড়াতাড়ি করেন আমাকে একটু শহরে যেতে হবে জরুরীর কাজ আছে।
উনার কথা শুনে আমার পুরো শরীরে শিহরিত বয়ে যায়। ভয়ার্ত চোখে উনার দিকে তাকিয়ে দেখি উনি হাতের কব্জি উল্টে ঘড়ি দেখছে।
উকিল আঙ্কেল সব কাগজ পত্র তৈরী করে উনাকে দেখিয়ে দেন কোথায় সিগনেচার করতে হবে। তারপর আমাকে সিগনেচার করতে বলে আমার পুরো শরীর কাঁপতে থাকে। হাতের তালু ভিজে ওঠে কলমটা ধরতে পারছি না। সোহেব ভাই আমার হাত ধরে বলে,
– আমি হাত ধরছি তুই সিগনেচার কর।
কাঁপা কাঁপা হাতে সিগনেচার করি, খুশি হবো না কাঁদবো বুঝতে পারছি না।তারপর সোহাইল ভাই আর ডালিয়া ভাবির বিয়ে হয়।
দোয়া-দরুদ পড়ে সবাই মিষ্টি মুখ করে। একে একে সবাই উঠে যায়। সোহেব ভাই উঠে খালামুনিকে বলে
– আম্মু আমি একটু বাহিরে যাচ্ছি আসতে রাত হবে।
খালামুনি কিছু না বলে এখনো সেভাবে বসে আছে। খালু সোহেব ভাইকে ইশারায় চলে যেতে বলে,
– সাবধানে যাবে আর তাড়াতাড়ি চলে আসবে দেরী করো না।
সোহেব ভাই মাথা নেড়ে একবার আমার দিকে তাকিয়ে চলে যায়। আব্বু, মামারাও বাহিরে খাওয়ার আয়োজনে চলে যায়।
আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না আমি আজকে থেকে সোহেব ভাইর বউ। আজকে থেকে উনি শুধু একান্তই আমার। কাজিনদের দিকে তাকিয়ে দেখি ওরা হাসতেছে। আমি ইশারায় বলি এগুলো কখন হলো?
চলবে,,,