,,পর্ব-২
,,উড়বে হওয়ায় বিষন্ন চিঠি
,,জিনাত আফরোজ
ডায়েরির পাতায় পাতায় সোহেব ভাইয়ের জন্য যে চিঠি,কবিতাগুলো লিখে রাখছি সে পাতা গুলোতে হাত বুলিয়ে কান্না ভেঙে পড়ি। এতক্ষণ আটকে রাখা কান্না গুলো হাউমাউ করে বের হয়ে আসে। যেনো পাতায় পাতায় লিখা চিঠি গুলো বিষন্ন স্বরে বলছে,
“এবার তোর কী হবে রে ইলু? তুই তো আর তোর সোহেব ভাইকে নিয়ে কোন কবিতা,চিঠি লিখতে পারবি না তোর সোহেব ভাই অন্য কারোর হয়ে যাচ্ছে।
নানার বাড়ির পাশে আমাদের বাড়ি তাই রাত হলেও আসতে সমস্যা হয় না। মা’কে বলে হেলেদুলে কোনরকমে বাড়িতে চলে আসি। মা আর খালামুনিরা বারবার বলছে রাতের খাবার খেয়ে যেতে। কিন্তু আমি না খেয়ে চলে আসি, খাবার আমার গলা দিয়ে নামবে না।
নিজেকে পাগল পাগল লাগছে, যদি সোহেব ভাই একবার হ্যাঁ বলে দেয়। খালামুনি মোটেইও দেরী করবে না মেয়ে দেখতে। হইতো দেখে রাখছেও ছেলের সম্মতি পাচ্ছে না দেখে কাউকে বলেনি।
এর মধ্যে দরজা ঠক ঠক আওয়াজ হলে, আমি নিজেকে সামলে নিই। কিন্তু তাড়াহুড়োই ডায়রিটা আলমারিতে না রেখে উপরে রাখি ভাবছিলাম পরে আলমারির ভেতরে রাখবো। আর সে ভুলেটাই যে সকালে আমার উপর ঝড় বয়ে যাবে সেটা কে জানতো।
দরজা খুলে দেখি, তুলি,তনয়া,জেমি আপা দাড়িয়ে আছে।
( জেমি আপা, জামির ভাই, জায়িন এরা তিনজন আমার মেঝ খালামুনির ছেলে মেয়ে। আর তুলি,তুশি আপা,সহেব ভাই,সোহাইল ভাই বড়ো খালামুনির ছেলে মেয়ে, তনয়া বড়ো মামার মেয়ে )
– কিরে তোরা?
তনয়া মুখ বাঁকা করে বলে,
– হু আমরা, তুমি রাতের বেলা না খেয়ে একা একা চলে আসছো তাই সহেব ভাই তোমাকে কানের নিচে একটা দিতে বলছে। আম্মু তোমার জন্য খাবার দিয়েছে।
আমি গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলি, এটা সোহেব ভাইর স্বভাব কথা না বললেও, কেউ একটু ভুল করলে উনি সবাইকে এরকম শাসন করেন।
জেমি আপা মেয়েকে ঘুম পাড়ানোর জন্য আমার রুমে যায়। আমি তুলি আর তনয়ার সাথে বসার ঘরে আজকে সোহাইল ভাইয়ের কাহিনী নিয়ে কথা বলছি। ওদেরকে কোন মতো বুঝতে দেওয়া যাবে না আমি কান্না করছি। আমি চাই না আমার অনুভূতি গুলো কেউ জানুক। সে গুলোকে নিয়ে হাসাহাসি করুক। আমার অনুভূতি গুলো একান্তই শুধু আমার।
কিছুক্ষণ পরে জামির ভাই আসে,এসে উনি আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়।
আমি অবাক হয়ে বলি,
– ভাইয়া তুমি!? আজকে না তোমাকে সোহাইল ভাইর সাথে থাকতে বলছে।
জামির ভাই বিড়বিড় করে বলে
– হু তোর পাগল প্রে,,,,
আমি আবার জিজ্ঞেস করলে, জামির ভাই এবার হেসে বলে
– হু আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোদের মতো কিচিরমিচির চুড়ুই পাখিদের সাথে থাকতে। বাড়ির বড়োরা বলছে বলে আসতে হইছে তোদেরকে পাহারা দিতে।
– কেনো আম্মু আসবে না?
– না আজকে খালামুনিরা ওইখানে থাকবে, পরে ইশান আর জায়িন আসবে ওরা ঘুরতে বের হইছে।
জামির ভাই আর কিছু না বলে চুপচাপ মোবাইল নিয়ে শুয়ে পড়ে। আমরা যার যার রুমে চলে যাই।
সকাল সকাল জেমি আপা মেয়েকে নিয়ে তাড়াহুড়ো করে চলে যায়। ওকে দেখে কেমন অস্থির অস্থির লাগছে।
আমি টুকটাক কিছু কাজ করে সবাইকে জাগিয়ে দিই নানার বাড়িতে গিয়ে নাস্তা করার জন্য।
যাওয়ার সময় জায়িন আর ইশান বলে, রাতে না-কি ওরা আশার সময় বড়ো খালামুনি আর সোহেব ভাইর জোরে কথাবার্তা শুনছে।
নানার রুমে সবাইকে দেখে একটু অবাক হয়, এখন তো নাস্তা বানানোর সময় সবাই এখানে কী করছে?
আচমকা আব্বু আমাকে দেখে ঝড়ের গতিতে এসে, দুই গালে দুইটা থাপ্পড় মারে। আব্বুর শক্ত হাতের মাইর খেয়ে আমি পড়ে যেতে নিলে পিছন থেকে তুলি,আর ইশান আমায় ধরে ফেলে।
তারপর ভালো করে তাকিয়ে দেখি আম্মুর হাতে সোহেব ভাইকে নিয়ে লিখা আমার ডায়রিটা।
আম্মু ডায়রিটা মাঝখান থেকে ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে আমার দিকে তেড়ে আসে। আর আমার আবেগ,ভালোবাসা মিশানো অনুভূতি উড়ছে হওয়ায় বিষন্ন চিঠি গুলো। জামির ভাই ডায়রিটা তুলে নেয়। আম্মু আমাকে মারতে গেলে তুশি আপা আর সোহেব ভাই আসতে গেলে খালামুনি সোহেব ভাইকে আবার বসিয়ে দেয়। তুশি আপা আর ছোট মামুনি আম্মুর হাত থেকে আমাকে ছাড়িয়ে নেয়।
এবার নানাও গরম হয়ে যায়, আম্মু, আব্বুর উপর আমাকে মারতে দেখে।
আমি এতক্ষণে বুঝতে পারি জেমি আপা কেনো সকাল সকাল আমাদের বাড়ি থেকে চলে আসছে। জেমি আপা ৬ বছর আগে আমার অজান্তে ভুলের প্রতিশোধ এভাবে নিবে আমি ভাবতেও পারিনি।
তখন আমি ক্লাস এইটে পড়তাম একদিন দেখি জেমি আপা কলেজ থেকে এসে লুকিয়ে লুকিয়ে একটা চিঠি পড়ছে। আমি চিঠিটা নিয়ে দুষ্টামি করে ভয় দেখাতে থাকি। আর সে মূহুর্তেই খালামুনি চলে আসে আপার রুমে। আমি লুকাবার আগে আমার হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে দেখে চিঠিতে জেমি আপার নাম।
তারপর কি এক প্রকার জোর করে আপার পড়াশোনা বন্ধ করে ১৫ দিনের মধ্যে আপার বিয়ে ঠিক করে ফেলে । আমি অনেক কান্না কাটি করছি আপার কাছে মাফ চেয়েছি। আপা তখন মাফও করে দিছে কিন্তু এখন সুযোগ পেয়ে সে শোধটা নিয়েছে।
আব্বু হুংকার দিয়ে আম্মুকে বলে,
– তুমি কি যাবে না-কি মেয়েকে নিয়ে আমি একা চলে যাবো?
বাবার চিল্লাচিল্লিতে আম্মু তাড়াতাড়ি করে সব গুছিয়ে নেয়। আমি সোহেব ভাইর দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে হাইমাউ করে কাঁদতে থাকি। কিন্তু সোহেব ভাই নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। মানুষটা কেনো কিছু বলছে না?, উনার কী একটুও খারাপ লাগছে কেউ একজন উনাকে ভালোবেসে এভাবে মা*ই*র খাচ্ছে।
আব্বু নির্দয় হয়ে আমাকে টেনে নিয়ে যায়, আব্বু অনেক রাগী কিন্তু আমাদের দু’ভাইবোনের সাথে কখনো রাগ করতো না। আজকে আব্বুর এমন রূপ দেখে আমি আরও কুঁকড়ে যাই।
বাড়িতে এনে আব্বু শাসিয়ে দেয়, আমি যদি উল্টা পাল্টা কিছু করি, তাহলে এর জন্য আম্মু শাস্তি পাবে। আমি ডুকরে ডুকরে কেঁদে যাচ্ছি। আব্বু ভালো করে জানে আমি কখনো আম্মুকে কষ্ট পেতে দিবো না।
আমি তো নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমার অনুভূতির কথা সোহেব ভাইকে কখনো বলবো না। উনি উনার মায়ের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করুক। যেটা হবে না সেটা নিয়ে জল গোলা করার কোন মানে হয় না। কিন্তু মাঝখান থেকে জেমি আপা প্রতিশোধ নিতে গিয়ে সব কিছু শেষ করে দিয়েছে।
আস্তে আস্তে দিন গড়িয়ে রাত হয়, ভাই দু,তিনবার এসে খেতে ডেকে গেছে আমি যাইওনি কিছু খাইওনি। রাতের খাবারও খাইনি, সকাল থেকে রাত অব্ধি এক জায়গা বসে আছি। ভাই বলছে বড়ো মামুনি ভাত,তরকারি রান্না করে পাঠায়ছে। আব্বু আম্মু কেউ খাইনি। আব্বু না-কি সবাইকে আমার সাথে দেখা করতে মানা করছে।
কষ্টে বুকের ভেতর জ্বলে যাচ্ছে, শুধু বারবার সোহেব ভাইর কথা মনে আসছে। উনি এতো শান্ত হয়ে কীভাবে বসে থাকতে পারলেন? উনি তো এমন না, আমাদেরকে যতোই শাসন করুক, ধমক দিয়ে ভয় দেখায়। কখনো কাউকে মা*রে*ন না আর আজ উনার সামনে উনার জন্য এভাবে একটা মেয়ে মা*ই*র খাচ্ছে উনার তাতে যেনো কোন হেলদোল নেই।
আমি আর কিছু ভাবতে পারছি না।
খুট করে দরজার আওয়াজ শুনে তাকিয়ে দেখি আম্মু দাঁড়িয়ে আছে। আমি অভিমান দৃষ্টিতে আম্মুর দিকে তাকিয়ে থাকি। আম্মুর হাতে খাবার প্লেট। আম্মু আমার মাথায় গালে আদুরী হাত বুলিয়ে দেয়। আমি আম্মুকে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কাঁদতে থাকি।
আম্মু আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
– কেনো সোহেবকে ভালোবাসতে গেলি? তুই তো জানিস তোর আব্বু আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে কুটুমতা পছন্দ করেন না। আর তোর খালামুনি তুই ওর নিজের বোনের মেয়ে বলে হইতো তোকে আদর করে কিন্তু ও আমার বোন আমি জানি ও কেমন।ও কালো,শ্যামলাদের পছন্দ করে না। সেখানে ওর ছেলের বউ হিসেবে তো নই। আর এতো বাঁধার মধ্যে তুই সোহেবকে ভালোবাসতে গেলি, যে পরিবারের সবাইর মধ্যমুনি।
আমি আম্মুকে আরও জোরে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকি।
চলবে,,,