উজান ঘাটের মাঝি পর্ব-০৮

0
715

#উজান_ঘাটের_মাঝি
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
#পর্ব_০৮

আগামী শুক্রবার বিয়ে।এতো জলদি বিয়ে দেয়ার কি আছে এটাই সবার বোধগম্য হচ্ছে না কিন্তু শাহাবুদ্দিন খান এর কথার উপরে কেউ কোনো কথা বলার সাহসও পাচ্ছে না।মহিবুল্লাহ খুশী হবে নাকি বেজায় হবেন এটাই বুঝতে পারছেনা।মারিয়া তাদের নিজেদের মেয়ে, নিজের হাতে মানুষ করা,খুবই শান্ত মেয়ে,বউ হিসেবে এমন মেয়েই সবাই খুঁজে কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায় তানিয়া বেকে বসেছে।একটা মাত্র ছেলে হাজারটা মেয়ে দেখে, বেছে বিয়ে করাবে তা না হুট করেই বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।ভাইজানের উপর তার সব রা,গ ইঞ্জিনিয়ার ছেলে পেয়েছে বিধায় নিজের মেয়েকে সুপাত্রে দিতে এতো তাড়া কিন্তু তার স্বামী কি কিছুই বলতে পারে না?ছেলেকে জন্ম দিয়ে যদি এইটুকু অধিকার না থাকে তাহলে!তানিয়া রুমের মধ্যে রা,গে ফেটে পরে,শাহাবুদ্দিন খানকে কিছু না বলতে পারলেও মহিবুল্লাহ খানকে ঠিকই কথা শুনালো,
“আমার ছেলের বিয়ে আর সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় আমিই থাকবো না?উনি এতোবড়ো সিদ্ধান্ত নেবে কেনো?”

মহিবুল্লাহ বললো,
“বড়ো ভাই হয় না এটা নিতেই পারে।”

“আমি মানি না।”

“কেনো?”

“আমি দশটা দেখে একটা বউ আনতাম।”

“মারিয়া কম কিসে?”

তানিয়া দমে যায়।মারিয়া কোনো কিছুতেই কম না,কিন্তু ছেলেকে যাচাই বাছাই করে বিয়ে করানোর খায়েশটা যে অপূর্ণই থেকে যাবে।
“মাহামুদ কি রাজী?আজকাল কার যুগে ছেলেমেয়ের অমতে এসব মাতব্বরি করা ভালো না।”

“মাহামুদের সামনেই তো সব জানানো হলো কই সে তো আপত্তি করেনি।”

“হয়তো উনার ভ,য়ে কিছু বলেনি।তুমি একবার ভাইয়ের সাথে কথা বলো।”

বাবা মায়ের রুম থেকে উচ্চকণ্ঠ শুনে মাহামুদ সেদিকে যায়।দরজা গলিয়ে মাথা ডুকিয়ে হেসে বললো,
“আসবো আম্মা?”

হঠাৎ ছেলেকে দেখে দুজনেই বিব্রতবোধ করে।মাহামুদ রুমে ঢুকে আয়েশ করে বিছানায় বসে বললো,
“হ্যাঁ এবার বলো। ”

তানিয়া ছেলের কাছে গিয়ে বললো,
“তুই রাজী?”

মাহামুদ মায়ের দিকে তাকিয়ে কিছু ভাবলো,তারপর হেসে বললো,
“আমি রাজী না হলে কি বিয়ে ঠিক হতো?”

মহিবুল্লাহ খান ভ্রু কুঁচকে বললো,
“তারমানে? ”

তানিয়া অবাক হয়ে বললো,
“তুই রাজী?”

মাহামুদ তার মতো করে তার আব্বা আম্মাকে বুঝানোর চেষ্টা করে।
“মারিয়াকে আমার ভালো লাগে।তোমরা যেটা কখনো বুঝতে পারোনি সেটা বড়োআব্বু বুঝেছে।আর আমি চাইনা তোমরা দুজনে এটা নিয়ে আর ঝ,গড়া করো।রুমের বাহিরে থেকে সব স্পষ্ট শোনা যায়,সবাই খারাপ ভাবছে।”

মাহামুদ চলে যায়।তারপর থেকে মহিবুল্লাহ আর তানিয়া ব্যস্ত হাতে বিয়ের শপিং করে,সব আয়োজনে যেনো কমতি না হয় সে খেয়াল রাখে।ছেলে যেহেতু পছন্দ করে তাহলে আর না করে লাভ কি?
ভাইয়ের বিয়েতে তিতিরের খুশীর অন্ত নেই।তাও কার সাথে তার একমাত্র চাচাতো বোনের সাথে।বিয়ের বাকি মাত্র দুইদিন এই দুইদিনে তিতির নিজেকে খুব ব্যস্ত রেখেছে কিন্তু বেহা,য়া মন অ,সভ্য পুরুষের জন্য আনচান করে উঠেছে।সে শতভাগ শিওর যে আরফানের দেয়া ছবিটা এডিট করা,আজকালকার যুগে এসে এইটুকু বুঝার ক্ষমতা তিতিরের আছে।কিন্তু তাকে এসব পাঠানোর মানে কি?কি বুঝাতে চায় বলদটা?সে যে অভিমান করে আছে তা কি বুঝে না?মেয়েরা অভিমান করলে কি করতে হয় জানে না নাকি?ডাক্তার হচ্ছে,কচুর ডাক্তার হচ্ছে,মেয়েদের মনই বুঝে না সে নাকি আবার অ,পারেশন করবে।তিতিরের ভাবনার মাঝে পানি ঢেলে নিনিয়া তার রুমে আসে।তিতিরের পাশে বসে বললো,
“এরপর তো তোমার পালা আপু,কেমন লাগছে?”

তিতির নিনিয়ার মাথায় থাপ্পড় দিয়ে বললো,
“পাকনা কথা বলবি না। ”

“পাকনা কথা কই বললাম।তাছাড়া তোমার আর কি লাগবে,বিয়ে তো আর দূরে হবে না বিয়ে এই বাড়িতেই তো হবে।”

নিনিয়ার কথায় তিতির ভ্রু কুঁচকে বললো,
“কি?”

নিনিয়া যেভাবে ছুটে এসেছিলো আবার সেভাবেই ছুটে চলে যায়।তিতির ভাবে নিনিয়া কি তার আর আরফানের কথা জানতে পেরেছে?না পারলে এসব বলবে কেনো?তিতির চিন্তিত্ব হয়,আরফান আর তার ব্যাপারটা কারোর জানার কথা না।

কালকে বিয়ে।আরফান মারিয়ার বড়ো ভাই সে হিসেবে তার সবার আগে থাকার কথা ছিলো কিন্তু জরুরী ক্লাসের জন্য যেতে পারেনি।এমন হুট করেই বা কেন মারিয়ার বিয়ে ঠিক করা হলো সেটাও বুঝে আসে না,পাত্র কে! পাত্র তারই ভাই মাহামুদ।আরফানের কাছে সবটা ব্যাপার কেমন লাগে কিন্তু মাহামুদ পাত্র হিসেবে যথেষ্ট ভালো এই দিকটা দিয়ে অবশ্য ভালো হয়েছে আর খারাপ দিকটা হচ্ছে তিতিরের সাথে কথা হচ্ছে না,তার সস্তি লাগছে না,সেদিন রা,গের মাথায় ভুলভাল ছবি পাঠালেও পরে মনে হয়েছে কাজটা ঠিক হয়নি,বাচ্চাদের উপর রা গ করতে হয় না বাচ্চাদের বুঝাতে হয়,আদর করে। আদরের প্রসঙ্গ আসাতেই তার হাত গালে চলে যায়।বাচ্চাটাকে আদর করতে গিয়েই থা,প্পড় খেয়েছে কই তিতির তো একবারও ফোন করে সরি বললো না আবারো তার মাঝে অভিমানের দেয়াল টইটই করে বেড়ে যায়।বাড়ি এসে পুরোদমে কাজে লেগে পরে,ভুল করেও তিতিরের দিকে তাকায় না কিন্তু কতোক্ষন না তাকিয়ে থাকা যায়?তিতির আশেপাশে থাকলে তার চোখ যেনো চুম্বকের মতো টেনে ধরে।এই যে কালো থ্রী পিছ পরে কেমন হেটে যাচ্ছে,তাকে দেখেও যেনো দেখছে না।আরফান ফুস করে শ্বাস ফেলে তিতিরের যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে।মনে মনে বলে,তোর খবর আছে তিতির।

ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়া ভালো লাগতো না আরশের।তাইতো মেট্রিক পাশ করার পরে সিংঙ্গাপুর চলে যায়।এইতো এ বছর প্রবাস জীবনের পাঁচ বছরে পা দিলো।বাড়িতে বিয়ের উৎসব তাই এবার তাকে আসতেই হলো।তাছাড়া মাহামুদ তার ছোট হয়ে কিনা তার আগে বিয়ে করে ফেলছে,এই লজ্জাজনক কথা ঢাকতে হলেও তাকে এবার দেশমুখো হতেই হলো।সকালে বাড়িতে এসে পৌছেছে।বিয়ের বাড়ি বেশ ঝাকানাকা করেই সাজানো,দেখেই বিয়ে বিয়ে ফিল হচ্ছে।কালকে বিয়ে আর আজকে সে এলো তার আসা নিয়েও বাড়িতে একটা হইচই বেধে গেছে।বাড়ির সবকিছুই আরশের ঠিক লাগলো ঠিক লাগলো না শুধুমাত্র তিতিরকে। এতো বড়ো হয়ে গেছে! আর দেখতেও একদম পরীর মতো সুন্দর।আরশের মনে হচ্ছে সে প্রথম দেখায় প্রেমে পরে গেছে,মাহামুদের বিয়েটা শেষ হলেই একটা ব্যবস্থা নিতে হবে।সে কখনোই ভাবেনি বাড়ি এসে এমন একটা পরীর দেখা পাবে।

বাড়িতে বিয়ের আমেজ লেগেছে ঠিক আছে কিন্তু ঠিক নেই মারিয়া।সেদিন রা,গের বশে ঘুমের ওষুধ খেলেও তাকে কেউ কোনো প্রশ্ন করেনি বরং প্রশ্নের বদলে শুনতে পেয়েছে বিয়ের সংবাদ।খুশী হবে নাকি কি করবে সে বুঝে উঠতে পারেনি।বিয়ে ঠিক হিওয়ার পরে মারিয়া মাহামুদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছেন কিন্তু প্রতিবারই তার সাথে মাহামুদ টু শব্দটি পর্যন্ত উচ্চারণ করেনি।মারিয়া বুঝতে পারছেনা এই মূহুর্তে তার কি করা দরকার।

হলুদের অনুষ্ঠানে তিতির মনের সবটা রঙ দিয়ে সাজলো।বারবার আরফানের সামনে দিয়ে হেটে হেটে গেলো।আরফানকে দেখিয়ে আরশের সাথে বসে গল্প করলো আর এটাও লক্ষ করলো যে আরশ তার দিকে কেমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে,চোখে মুগ্ধতার ছোঁয়া স্পষ্ট ফুঁটে উঠেছে।ছেলেদের এমন চোখের দৃষ্টি তিতিরের কেমন লাগে কিন্তু আরফানকে হিং,সাত্মক বানানোর জন্য সে আরশের সাথে অনেকক্ষণ ধরে গল্প করে,হাসে।
আরফানের মুখের আদল গম্ভীর, শক্ত হয়।চোখের দৃষ্টি হয় কঠিন।না চাইতেও ফোস ফোস করে নিঃশ্বাস ছাড়ে।তিতির আর আরশের দিকে তাকালেই বুকে জ্বলন হচ্ছে,দম আটকে আসছে।উফ তারই ভুল হয়েছে মেয়েটাকে ছাড় দেয়া উচিত হয়নি।থাপ্পড় দিক নাহয় মে,রে ফেলুক তাও এই পাখিকে ঝাপটে ধরে রাখা উচিত ছিলো।

গভীর রাত।ঘড়ির কাটা তিনটা ছুঁইছুঁই।বাড়িতে মেহমানে ভরপুর।তিতির মারিয়ার সাথে ঘুমানোর জন্য এসেছে।কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসছেনা।তার মনে হচ্ছে আরফান তাকে ডাকছে,সে উঠে বসে।ঘুমন্ত মারিয়ার দিকে তাকিয়ে আস্তে করে রুম থেকে বেরিয়ে যায়, রুম থেকে বেরিয়েই তিতির স্তব্ধ হয়ে যায়।আরফান রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে যেনো তারই অপেক্ষায় ছিলো।তিতির বের হওয়ার পরে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে পাজকোলা করে নেয়,তারপর দ্রুত পা ফেলে ছাদে চলে যায়।তিতির পুরোটা সময় নিঃশ্বাস বন্ধ করে ছিলো,কেউ দেখে ফেলে কিনা ভ,য়ে বুকটা ছটফট করছিলো।আরফানের গলায় তার হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে রেখেছিলো।ছাদে গিয়ে আরফান তিতিরকে নামায়।জোড়ে কয়েকবার নিঃশ্বাস ফেলে রাগী চোখে তাকিয়ে থাকে।তিতির চুপচাপ তাকিয়ে আছে।আরফান তিতিরের উপর হেলে পরে,চেপে ধরে তিতিরের ছোট শরীর।তিতির কেঁপে উঠে কিন্তু এমন কিছুর জন্য যেনো সে আগেই প্রস্তুত ছিলো।ফিসফিস করে বললো,
“কেউ আসবে।”

আরফান তিতিরের মতোই ফিসফিস করে বললো,
“আসবে না। ”

“সরুন।”

আরফান গো ধরে বললো,
“না।”

তিতির চুপচাপ আরফানের দিকে তাকিয়ে আছে।কেউ কাউকে না বললেও দুজনেই জানে দুজনের মনের কথা।আরফানকে এতো কাছে থেকে দেখে বুকটা কেমন করছে,গায়ের মিষ্টি ঘ্রাণে নে,শা ধরে যাচ্ছে।তিতির বিভোর হয়ে তাকিয়ে থাকে।আরফান তিতিরের হাতের আঙ্গুলের ভাজে নিজের হাত ছুয়িয়ে বললো,
“আরশ ভাইয়ের এতো কাছে কেনো গেলি?”

“ভাইয়া না!এমনি গল্প করলাম।”

আরফান তিতিরের গালে ছোট চুমু দিয়ে বললো,
“উহু,তুই কোনো ছেলের কাছে গেলে আমার একদম ভালো লাগে না।”

তিতির কেঁপে উঠে।চোখ বন্ধ করে বললো,
“আর যাবো না।আপনি কেনো অন্য মেয়ের সাথে ছবি তুললেন তাও এতো খা,রাপ ভাবে।”

“এডিট ছিলো গাধী।”

“আমি বুঝেছি। ”

“আমার পাখি তো তাই সব বুঝে।”

তিতির আর আরফান একে অপরের দিকে বিভোর হয়ে তাকিয়ে থাকে।তিতির আরফানের গালে হাত ছুঁয়িয়ে আস্তে করে বললো,
“সেদিনের জন্য সরি। আমার ভুল হয়েছিলো।”

আরফান হাসে।তারপর ফিসফিস করে বললো,
“ভালোবাসি তিতিরপাখি!তোর মনে একটু জায়গা দিবি?আমি তোকে হীনা খুবই কষ্টে থাকি,ম,রে যাওয়ার প্রয়াস হয়।আমায় আরো বেশীদিন বাঁচতে দিবি?”

তিতির উত্তরে শক্ত করে আরফানকে জড়িয়ে ধরে।ফিসফিস করে বললো,
“খুব ভালোবাসি।”

আরফান তিতিরের ভালোবাসায় সাড়া দেয়। আজকের ভালোবাসা,দুষ্টু, মিষ্টি ছোঁয়া দুজনেই সম্মতিতে হয়,ভালোবাসা গভীর হয়,দুজনের শ্বাস ঘন হয়ে মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়।তিতির আদরে গুঙ্গিয়ে উঠে,শক্ত করে আঁকড়ে ধরে আরফানের হাতের বাহু।আরফান হাসে।ফিসফিস করে বললো,
“এইটুকু আদরেই এমন বেহাল দশা!তাহলে পরে কি হবে? ”

তিতির হাসে।সেই হাসিতে মিশে ছিলো একরাশ লজ্জা।সে আরফানের বুকে মুখ লুকায়।আকাশে থালার মতো গোল চাঁদটা দুজনের ভালোবাসা দেখে হাসে।ইশ!এভাবেই যদি পূর্নতা পেতো তারা।সারাজীবন যদি এভাবেই আগলে রাখা যেতো তার তিতিরকে!

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে