#উজান_ঘাটের_মাঝি
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
#পর্ব_০২
আরফানের বোন মারিয়া খুব ভালো ছাত্রী।মারিয়া আর তিতির একই ক্লাসে পড়ে কিন্তু দুজনের চালচলন পুরো উল্টো।মারিয়া আরফানের মতো মেধাবী কিন্তু তিতির পুরো গাধা।তার মাথায় সে কিছুতেই লেখাপড়া ঢুকাতে পারে না,লেখাপড়া তার কাছে এতো কঠিন লাগে মনে হয় লেখাপড়া বাদ দিয়ে বিয়ে হয়ে যাওয়া অনেক ভালো।কিন্তু ভাগ্যক্রমে তার বিয়ের নামও তুলা হয় না,সে নাকি এখনো ছোট কিন্তু তার ইচ্ছে করে বিয়ে করতে সে এটা কাকে বুঝাবে! সে একটুও ছোট নেই,বেশ বড়ো হতে গিয়েছে।তিতিরের হাতে ধরে রাখা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বই,ইন্টারের এই বইটা তার কাছে এত্তো কঠিন লাগে মনে হয় এটা বই না স্বয়ং ডা,কাতের আস্তানা,মাঝে মাঝে পড়তে গেলে তার কান্না আসে,কেঁদে দুনিয়া ভাসিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে কিন্তু সে কাঁদেনা তার আব্বা তাকে বলেছে খুব পড়াশোনা করতে,মারিয়ার মতো ভালো নাম্বার পাওয়া চাই।ঘড়ির কাটা রাত দশটায় গিয়ে টিকটিক করছে।তিতিরের হাতে আইসিটি বই,একটা জায়গায় সে সমাধান করতে পারছেনা,অথচ এই পড়াটা কালকেই ক্লাসে দিতে হবে।বই হাতে নিয়ে অলস ভঙ্গিমায় উঠে দাঁড়ায়, ধীর পায়ে মারিয়ার রুমের দিকে যায়।
মারিয়া পড়ছে।তিতিরকে দেখে বললো,
“কি? ”
তিতির মারিয়ার সামনে বই রেখে ধপাস করে বিছানায় শুয়ে পরে।ভিষণ ক্লান্ত গলায় বললো,
” পড়াটা বুঝিয়ে দে।”
মারিয়া তিতিরের দিকে তাকিয়ে আছে।তিতিরকে দেখে মনে হচ্ছে সে রাজ্যের ক্লান্ত, পড়ালেখা করে দুনিয়া উদ্ধার করে ফেলেছে।সে বইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
“এইটা আমিও পারি না।”
মারিয়ার কথায় তিতির চকিত নয়নে তাকিয়ে বললো,
“কি বলিস!তুই পারিস না?অবাক করা কথা বার্তা।”
মারিয়া পারে কিন্তু তিতিরকে বুঝানোর ঝামেলা আপাতত মাথায় নিতে চাইছে না।সে বললো,
“অবাক হওয়ার কথা হবে কেনো?সব পারতে হবে এমন কোনো কথা আছে নাকি?”
তিতির মন খারাপ করে বসে বললো,
“তা ঠিক।কিন্তু কালকে এই পড়া না পারলে কপালে শনি আছে।”
“আমি ক্লাসে গিয়ে শিখে নেবো।”
“তোর মাথা ভালো বইন তুই পারবি আমি আগে থেকে বুঝেই মনে রাখতে পারি না আর ক্লাসে দেখলে পারবো?অসম্ভব।”
মারিয়া আফসোস করে বললো,
“হুম,বুঝলাম।”
“এই বই বের করেছে কোন সা,লায়?কি আবলতাবল লেখা।অসহ্য!”
“পড়া তো সহযই,তুই পারিস না তাই বল।”
“আমি পারি কিন্তু বইটাই আমাকে বুঝাতে পারে না।কি করি এখন?”
মারিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো,
” উপায় একটা আছে।”
“কি উপায়?”
“ভাইয়ার কাছে যা,এক তুড়িতে মাথায় পেরেকের মতো বসিয়ে দেবে।”
তিতির মুখ অন্ধকার করে বললো,
“অসম্ভব।তোর ভাই আস্ত খবিস।দেখলেই মা,রে,আমার ভাই এই মাসুম জানের ভয় আছে।”
“আচ্ছা!তাহলে কালকে স্যারের মা,র খাবি।ভাইয়া মা,রলে কেউ দেখবেনা কিন্তু স্যার পুরো ক্লাসের সামনে ইজ্জত দফারফা করে দেবে,সেটাই ভালো হবে।”
তিতির ভেবে দেখে কথা ঠিক।সে আলগোছে উঠে দাঁড়ায়।বই হাতে নিয়ে আস্তে আস্তে তাহসানের রুমের সামনে যায়।তার ভাইয়া মাহমুদ যদি বাড়ি থাকতো তাহলে এই লম্বুর কাছে আসাই লাগতো না,তাই ভাই ম্যাজিশিয়ানের মতো তার সব সমস্যা সমাধান করে দিতে পারে কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আরফানের মতো মাহমুদ এতো তাড়াতাড়ি বাড়ি আসে না।তিতির দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে।আরফান রুমে নেই বাথরুম থেকে পানি পড়ার শব্দ আসছে।তিতির বুঝে পায় না রাতে কেনো গোসল করতে হবে?দিনে তো করে আবার রাতেও,এই ডাক্তারের মাথায় নির্ঘাত সমস্যা আছে, দেখা যাবে রুগীকে ওষুধ না দিয়ে প্রতিদিন পাঁচবার গোসলের তালিকা দিলো।এই ডাক্তার দ্বারা কোনো কিছুই অস্বাভাবিক না।তিতির ডাকলো,
“ভাইয়া,ভাইয়া বের হতে কি টাইম লাগবে?”
আরফান বললো,
“কেনো?”
“আমার পড়ায় একটু সমস্যা।বুঝিয়ে দেন ।”
“তুই বস।”
তিতির আরফানের বিছানায় পা মুড়ে বসে।আরফানকে ভালো না লাগলেও আরফানের রুমটা খুব ভালো লাগে।খুব গুছানো,আর রুমে আসলেই বেলী ফুলের সুভাসযুক্ত ফ্রেশনারের ঘ্রাণে মনটা তরতাজা লাগে।তিতির বই খুলে বসে আনমনে বললো,
“পড়া থেকে বিয়ে করে সংসার করা খুব সহয।এই ঘরের মানুষ যে কেনো বুঝেনা আমার দ্বারা পড়া হবেনা,বিয়েই আমার জন্য ঠিক।”
আরফান বাথরুম থেকে বেরিয়ে তিতিরের কথাটা শুনতে পায়।ভ্রু কুঁচকে বললো,
“অহ আচ্ছা ! আপনার বিয়ের শখ হয়েছে।”
তিতির ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়।পরক্ষনেই হেসে নিজেকে স্বাভাবিক করে বললো,
“না ভাইয়া আমি ছোট না?”
“হ্যাঁ,পড়ার থেকে বিয়ে করে সংসার করা ভালো।”
“দূর,এমনি বলেছি।”
আরফান তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছে,তোয়ালেটা গায়ে ছড়িয়ে বিছানায় এসে বসে বললো,
“বেশী পেকে গিয়েছিস?”
তিতির চুপ করে বসে থাকে।আরফান বললো,
“বিয়ের বয়স হলে এমনিই বিয়ে হবে,পড়া বাদ দিয়ে বিয়ের ভূত মাথায় চাপাতে হবে না।”
তিতির হেসে বললো,
“মেয়ে মানুষ না;বিয়ের ভূত তো মাথায় আসবেই।”
আরফান এক দৃষ্টিতে তিতিরের দিকে তাকিয়ে থাকে।মনে মনে তিতিরের বউ সাজ কল্পনা করে নেয়।তারপর বললো,
“তিতির সবকিছু ভাবার একটা বয়স লাগে যা এখনো তোর হয়নি।”
তিতির নিজের হাসি চেপে বললো,
“জ্বী ভাইয়া।”
আরফান গম্ভীর গলায় বললো,
“কি সমস্যা দেখা।”
তিতির বই বের করে আরফানকে দেখায়।আরফান খুব ভালো করে তিতিরকে বুঝিয়ে দেয়।বুঝানোর পরে তিতিরকে বললো,
“বুঝেছিস?”
তিতির মাথা নেড়ে বললো,
“হ্যাঁ।”
“তাহলে এবার আমাকে বুঝা কি বুঝেছিস।”
বুঝাতে গিয়ে তিতির বুঝতে পারলো সে কিছুই পারছেনা।আরফানের দিকে তাকিয়ে বোকা বোকা হাসি দিয়ে বললো,
“ভাইয়া আমি আপনাকে পরে বুঝিয়ে দেবো।”
আরফান বালিশ কোলে নিয়ে আয়েশ করে বসে বললো,
“পরে কেনো?এখনি বুঝা।”
“মাথায় ধরে না তো।”
আরফান তিতিরের মাথায় থাপ্পড় দিয়ে বললো,
“এই এত্তোবড়ো গোলগাল মাথায় গোবর ছাড়া আর কি আছে শুনি?গোবরে মাথা।”
তিতির মাথায় হাত ভুলিয়ে বললো,
“গোবরেও পদ্মফুল ফুটে।”
“হ্যাঁ কিন্তু তোর কিছুই হবে না।”
” আমিও ভালো রেজাল্ট করে সবাইকে চমকে দেবো।”
আরফান এক দৃষ্টিতে তিতিরের দিকে তাকিয়ে থাকে।মনে মনে বলে
“তিতিরসোনা,তুমি নিজেই তো আস্ত একটা পদ্ম ফুল।এই যে আমি ক্ষনে ক্ষনে নিজের হুশ হারাই,কি জন্য? তোমার জন্যই তো।”
“আচ্ছা রুমে যা,আর সমস্যা হলে আমাকে বলবি।”
তিতির মিষ্টি করে হেসে আরফানের দিকে তাকায়।তারপর আস্তে করে উঠে দাঁড়িয়ে দূরন্ত বালিকার মতো নুপুরের রিনিঝিনি শব্দ তুলে বেরিয়ে যায়।আরফান বিবস হয়ে তাকিয়ে আছে।বুকে অনুভূতিরা লুটুপুটি খাচ্ছে।আগে নিজেকে খুব সামলাতে পারতো কিন্তু ইদানীং তিতির যেনো তড়তড়িয়ে বড়ো হচ্ছে আর তার অনুভূতিরা তিতিরকে দেখলেই পাগলের মতো ছুটে যেতে চাচ্ছে,সারা গা কাটা দিয়ে উঠে।ইশ!মেয়েটা তাকে নিজের অগোচরে এতো যন্ত্রনা দিচ্ছে অথচ সে জানেই না তার মিষ্টি হাসি,দুষ্টু কথা,মায়াবীচোখে তাকানো আরফানকে শেষ করে দিচ্ছে।সারা শরীর অবস করে দিচ্ছে।আরফান বিছানায় শুয়ে পরে,চোখ বন্ধ করে নিজেকে বুঝায়,”তিতিরটা এখনো বাচ্চা,আরো পরে;আরো পরে।কিন্তু মন উল্টো তাকে বুঝায়,পরে!আর পরে টরে হবে না,এখনি ওকে চাই ;ওর মিষ্টি সানিধ্য চাই,আমি খুব আপন করে ওকে চাই,কাছে না পেলে আমি যে ম,রে যাচ্ছি তা চোখে পরে না?প্লিজ একটা ব্যবস্থা করো।”
আরফান হাসে।তার এই গোপন অভিলাষ কেউ জানে না,কেউ বুঝেনি।জানলে কি হবে তা আরফান ভাবতে পারে না দম বন্ধ লাগে।কিন্তু আর যাইহোক পাখিটাকে তার করেই চাই,কতো বছরের ভালোবাসা মিশিয়ে রেখেছে তা কি বৃথা যাবে?আজকাল তিতিরকে সারাবাড়িতে টইটই করে ঘুরে বেড়াতে দেখে আরফানের মনে প্রলয় হয়,এই প্রলয়ের ছিটেফোঁটাও যদি কেউ জানতো তাহলে নির্ঘাত তাকে বাড়ি ছাড়া করে দিতো।
শাহাবুদ্দিন খান প্রচুর মা ভক্ত।মায়ের কথা ছাড়া এক পা ও নাড়ে না।বাড়ি থেকে বের হতে গেলেও মায়ের কাছে অনুমতি নিয়ে বের হয়,মা মানেই উনার দুনিয়া।সবকিছু পরে কিন্তু মায়ের ভালোবাসা,সম্মান আগে।জয়তুন বেগম দাম্ভিকভাবে চলাফেরা করেন।উনার বাপ-দাদারা আগের কালের ধনবান ব্যক্তি ছিলো তমিজ্জুদ্দীন খানের সাথে যখন জয়তুন বেগমের বিয়ে হয় তখন থেকেই উনি দাম্ভিক আচরণ করেন।আগের কালেই লেখাপড়া জানা মানুষ সবাই বেশ শ্রদ্ধা করে চলে।উনার কথার বাহিরে আর কোনো কথাই হয় না,উনি যা বলবে তাই সঠিক।শাহাবুদ্দিন আর জয়তুন বেগম বসার ঘরে বসে কথা বলছিলো।তখন আরফান তার রুম থেকে বেরিয়ে আসে।দাদীর পাশে বসে চামড়া কুচকানো গালে পরম স্নেহে আদর দিয়ে বললো,
“আমার সুন্দরী কেমন আছে?”
জয়তুন বেগম নাতীর দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমার ভালো থাকার খবর পরে নিস।আগে বল প্রতি সাপ্তাহে কেনো বাড়ি আসা লাগবে?বন্ধের দিন পড়া যায় না?এমন ফাঁকিবাজি করলে ডাক্তার হবি কি করে?”
আরফান মুচকি হাসে।মনে মনে বললো,”বাড়ি তো আর এমনি এমনি আসিনা দাদী,বাড়ি যে আমার সুখভ্রমর আছে,যাকে একটু দেখলেই সারা সাপ্তাহ মন দিয়ে পড়তে পারি,না দেখলে মনে বড়ো অসুখ হয়,একটুও পড়ায় মন দিতে পারি না।”
মুখে বললো,
“তোমাকে না দেখে থাকতে পারি না।”
“মাহামুদ ও তো ঢাকাই থাকে সে তো এতো আসে না।তোরই যতো বাহানা।”
আরফান হেসে বললো,
“মাহামুদ তোমাকে ভালোবাসেনা তাই আসেনা আমি খুব ভালোবাসি তাই আসি।বুঝেছো সুন্দরী!”
জয়তুন বেগম হাসে।নাতীর মাথায় হাত ভুলিয়ে বললো,
“দোয়া করি তোর বউ আমার মতো সুন্দর হোক।”
আরফান হাসে,সুন্দর করে হেসে তার দাদীর দিকে তাকিয়ে রয়।তিতির দাদীর মতো হুবুহু দেখতে,শুধু মাত্র মেজাজ ছাড়া।সে জয়তুন বেগমের গালে হাত দিয়ে বললো,
“তুমিই তো আমার বউ,আর লাগবে না।যদি খুব লাগে তো তোমার মতো দেখতে কাউকে এনে দিও।”
জয়তুন বেগম তার কথা এতো ঘাটালেন না উনিও হেসে বললো,
“আচ্ছা।”
চলবে…..