#উজানের_ঢেউ (পর্ব ১৬ ও সমাপ্তি)
কলমে✍️ #রেহানা_পুতুল
তীক্ষ্ণ স্বরে মাহমুদ ভাই বলল,
” আমাদের রাবুকে ব্ল্যাকমেইল করেছে তার ভালোবাসার মানুষটা। মানে ওর প্রেমিক। তার জীবনের প্রথম অনুভূতি! প্রথম প্রণয়! তার প্রেমিকটা বড় স্বার্থপর! সিরিয়াস রকমের ধড়িবাজ! সেই প্রেমিকটাকে মন প্রাণ দিয়ে রাবু আজ রিক্ত! নিঃস্ব! ”
মুহূর্তেই দৃশ্যপট পরিবর্তন হয়ে গেলো। মা ও বাবার মুখের উদ্বিগ্নতা,মমতা উবে গেলো কর্পূরের ন্যায়। এবং তার বদলে তাদের মুখাবয়বে স্থায়ী হলো রা*গ ও বিরক্তি। রাবু মাথা হেঁট করে বসে আছে। বাবার শাণিত দৃষ্টি রাবুর দিকে। মা অগ্নিমূর্তি ধারণ করলো। রক্তচক্ষু নিয়ে রাবুকে কর্দয ভাষায় বকুনি দিতে লাগলো গমগমে কন্ঠে।
মাহমুদ ভাই মাকে অধিকারসুলভ ভঙ্গিতে থামিয়ে দিলেন। বাবা মায়ের বড় ছেলে নেই বলে মাহমুদ ভাইর কিছুটা আধিপত্য আছে আমাদের পরিবারে। সেই প্রশ্রয়টুকু তারাই উনাকে দিয়েছে। এটার পিছনে কিছু ছোট বড় কারণও রয়েছে। সেসব বাকি থাকুক আজ। মাহমুদ ভাই রাবুকে বললেন,
” রাবু কথা বল। চুপ করে থাকা কোন সমস্যার সমাধান বয়ে আনতে পারে না।”
রাবু থম মেরে আছে মেঘাচ্ছন্ন গুমোট আকাশের ন্যায়। রাবু ভুল করে ভুল কাউকে মন দিয়ে বসে আছে। হৃদয়ে প্রচণ্ড আঘাত পেলো। প্রাপ্তি হলো সেই ছেলের সাথে তার কাটানো অম্লমধুর স্মৃতিগুলো। এই ভেবে রাবুর জন্য আমার দুঃখবোধ হচ্ছে। আমি মাহমুদ ভাইকে বললাম,
” মাহমুদ ভাই, আপনি যদি রাবু থেকে সব জেনে থাকেন,তাহলে আপনি ই বলেন।”
তখন মাহমুদ ভাই বলল,
রাবু কলেজে উঠার পর এক ছেলের সাথে সম্পর্ক শুরু হয়। আপনাদের ফোন দিয়েই সেই ছেলের সাথে সে যোগাযোগ করতো। দেখা হতো কলেজে মাঝে মাঝে। তো সেদিন রাবু ও সেই ছেলে মিলে সিনেমা দেখার কথা ছিলো। রাবু কলেজ শেষে রিকশা নিয়ে সেই ছেলের বলা স্থানে যায়। জায়গাটা নাকি নিরব ছিলো।
রাবু রিকশা থেকে নামলে দুটো ছেলে তাকে একটি রুমে নিয়ে আটকে ফেলে। তাদের মুখ ঢাকা ছিলো। খোলার পরেও রাবু তাদের চিনতে পারেনি। রাবুর কোন ক্ষতি করেনি তারা। কারণ তারা ছিলো ভাড়াটে। তারা রাবুকে দিয়েই দুই লক্ষ টাকা চায় আপনাদের কাছে। ব্ল্যাকমেইল করার উদ্দেশ্যেই ছিলো টাকা ও আপনাদের মান সম্মান নষ্ট করা।
আমি গতকাল সকালেই গ্রামে চলে আসি। থানায় গিয়ে পুরো বিষয় পুলিশদের অবগত করি। এবং পুলিশদের সঙ্গে নিয়েই বাকি সব কাজ সম্পন্ন করি।সেই একাউন্ট নাম্বারে দুই লক্ষ টাকা জমা দিই। পুলিশ তাদের পুরো বিষয় খুলে বলে সহযোগিতা করার জন্য। আমি ও দুজন পুলিশ ব্যাংকের পাশে নিচে লুকিয়ে থাকি। পুলিশ নাম্বার দিয়ে রাখে ব্যাংকে। যেনো টাকা নিতে এলেই মিসকলড দেয়। বেশ কিছু সময় পার হয়ে যায়। তারপর রাবুকে তারা ব্যাংকের সামনে ছেড়ে দেয়। টাকা তুলতে গেলে মিসকলড় আসে। পুলিশ দ্রুতগতিতে ব্যাংকে প্রবেশ করে এবং টাকা নিতে আসা ব্যক্তিদের আটক করে থানায় নিয়ে যায়। তারা অপরাধ স্বীকার করে। বলে তাদেরকে ঠিক করেছে চয়ন নামের একটি ছেলে। তাদের দিয়ে কৌশলে মিথ্যে বলিয়ে চয়নকে থানায় আনা হয়।
রাবু তখন ভালোবাসার মানুষের বিভৎস রূপ দেখে কেঁপে উঠে ভূমিকম্পের ন্যায়। আমিও বিস্মিত হই শুনে। চয়নকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করলে সে স্বীকারোক্তি দেয়,
তার খালা জুলেখা তাকে অনেক অনুনয় বিনয় করে রাজী করে। তারও খুব টাকার দরকার। তখন সে খালার কথায় গলে যায়। সে ধরা পড়ে যাবে এটা বুঝতে পারেনি। কন্ট্রাক্ট করে সেই দুইজন কিডন্যাপার পাবে পঞ্চাশ। তারা দুই জা নিবে পঞ্চাশ। আর এক লক্ষ নিবে চয়ন ব্যবসা করার জন্য।
আর চয়নের সাথে রাবুর পরিচয় আগে থেকেই ছিলো। কেননা চয়ন জেঠির ভাগিনা। আসা যাওয়া ছিলো আমাদের বাড়িতে। তবে আমি চয়নকে আজ গতকাল প্রথম দেখেছি। দেখতে সুবোধ বালক।
তবে এর মূল হোতারা এটা করেছে আমার জন্যই। কয়দিন আগে যে আমি রূঢ় বিহেভিয়ার করেছি। সেজন্যই নিজেদের ভিতরে আক্রমণাত্মক পশুটা জেগে উঠেছে। এই হলো ঘটনা।
মাহমুদ ভাই থামলেন। নিজেই উঠে গিয়ে টেবিল থেকে নিয়ে এক গ্লাস পানি খেলেন গলা তুলে। ফের এসে চেয়ারে বসলেন। মা বললেন,
” চিন্তা কর হারামজাদির কাজ কারবার। শত্রুর লগে পিরিত করতে গেছে উনি। বাবা তোর টাকা পাইছিস ?”
” টাকা তখনই নিয়ে ফেলছি চাচী।”
বাবা কিছুই বলল না কেন জানি। উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো বিমর্ষ চিত্তে। রাবু বিমূর্ত নয়নে আমার দিকে চাইলো। আমি রাবুকে বললাম,
” চয়ন যে কেমন ছেলে আর তোর জন্য সঠিক নয়। তাতো চাক্ষুষ প্রমাণ পেলিই। ঘৃণা কর জঘন্যটাকে।”
রাবুর মুখে কোন রা নেই। অবনত দৃষ্টিতে নিঃশব্দ পায়ে আমাদের সামনে থেকে চলে গেলো। মা ভারি ভারি পা ফেলে বাইরে গেলে গৃহকর্মে মনোযোগ দেওয়ার জন্য।
আমিও রুমের বাইরে পা রাখলাম যাওয়ার জন্য। পিছন হতে আমার হাতে টান পড়লো বড়শীর মতন। ঘাড় হেলিয়ে বললাম,
” কি মাহমুদ ভাই?”
” এই ফাজিল মেয়ে? লজ্জা করে না,হবু বরকে ভাই বলতে? ভাই শব্দটি আর একটিবারও তোমার মুখে শুনতে চাইনা আমি। ”
” আচ্ছা বলব না। হাত ছাড়েন না। উহু! কেউ এসে পড়বে তো?”
” জ্বিনা ম্যাডাম। এখন এই রুমে কেউই আসার নেই। কেউই আসবে না। হাত ছাড়ব তখন। বিয়ে করবে কবে, বলবে তুমি যখন।”
আমি মাহমুদ ভাইয়ের মুষ্টিবদ্ধ হাত থেকে আমার হাতকে ছাড়ানোর জন্য মোচড় দিচ্ছি। কিছু বলছি না। তিনি বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলেন, এক লহমায় আমার বুকের উপর থেকে পিনপিনে পাতলা জর্জেট ওড়নাটি সরিয়ে নিলো।
সেইক্ষণে আমার চোখে মুখে কোন কাঠিন্যতা এলনা। কোন তেজ ছড়িয়ে পড়ল না। কেবল অস্তমিত সূর্যের মতো আমার সমস্ত অনূভুতি মিলিয়ে গেলো এক লহমায় কোন সূদুরে। আমি বিবশ হয়ে দু’ নয়ন মুদে ফেললাম। উনি ওড়নাটাকে আমার মাথার উপরে দিয়ে বলল,
“বলনা বধূ কবে সাজবে? কবে বুকে আসবে?”
দেখলাম উনি নাছোড়বান্দা হয়ে আছেন। কিছু একটা না বলা পর্যন্ত আমার কাছ থেকে নড়বেন না।
বললাম,
” আমি জানিনা। আপনার ইচ্ছা।”
নিমিষেই উনার চোখের কোণে সুখের ফল্গুধারা বয়ে যেতে লাগল। আমার নাকের সাথে উনার নাক ঘষে বলল,
” মিষ্টি বউটা আমার। থাকো। আমি কিছুক্ষণ পরে ঢাকায় যাচ্ছি। একবারে বিয়ের সময় আসব।”
তার পরেরদিন দুই পরিবার বসে বিয়ের দিন চুড়ান্ত করে নিলো। একমাস পর বিয়ে। আমি নিয়মিত পার্লারে যাচ্ছি। পার্লার এগিয়ে যাচ্ছে ঠিকঠাকমতো। কাস্টমার বাড়ছে। নিজেকে আত্মপ্রতিষ্ঠা করতে পারব। এই বিশ্বাস আমার মনে স্থায়ী আসন গেঁড়েছে।
ডিভোর্স মানেই নারীর অবহেলা নয়। ডিভোর্স মানেই নারীর জীবন শেষ হয়ে যাওয়া নয়। নারী বাঁচুক সম্মানের সাথে আত্বনির্ভরশীল হয়ে।
একদিন নিজ থেকেই রাজনের বড় চাচী লায়লা ভাবিকে ফোন দিলাম। আলাদা আলাদা করে তাদের ঘরের সবার ভালোমন্দ খবর নিলাম। একসময় তাদের কত আপন ছিলাম।
জীবন ও জগত বড়ই রহস্যময়। তার রঙ্গখেলা বোঝার সাধ্য কারোই নেই। আপনকে পর করে দেওয়া,পরকে আপন বানিয়ে দেওয়া যেন তার হাতের তুড়ি মাত্র।
রাজনের দাদী নাকি আজকাল প্রায় শয্যাশায়ী হয়ে যায়। বিড়বিড় করে রাজনের কথা বলে সবার সাথে। রাজনকে দেখার আকুলতা প্রকাশ করে। আশরাফুল পঙ্গুত্ব বরণ করে নিয়েছে। লাঠি ভর দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলাফেরা করে। কোন কাজকর্ম করতে পারেনা। নিজের অক্ষমতা ও দূর্গতির জন্য নিয়তিকেই দায়ী করে। প্রায় তাদের উপোস থাকতে হয়। সে ও শিরিন নাকি এখন বাড়িতেই থাকে অনাহুতের মতো। সন্তানের লাঞ্চিত জীবন দেখে করুণা করে বাড়িতে আশ্রয় দেয়া হয়েছে তাদের। শিরিনের ও আশরাফুলের দাম্পত্য নামেই ঝুলে আছে কলাবাদুড়ের ন্যায়। শিরিন চাকরি খুঁজতেছে হন্যে হয়ে। নিজের জন্য হলেও তার টাকার দরকার। টাকা পথ চলার শক্তি। টাকা বেঁচে থাকার অবলম্বন।
কারণ সে তার বাবার পরিবার থেকেও বিতাড়িত। তার বড় ভাইয়ের বাধা অতিক্রম করে চাইলেই তার মা বোনেরা তাকে কোনভাবে সাহায্য করতে পারেনা। বাড়িতে যেতে বলতে পারে না। তার ভাই বিদেশ থাকে। কিন্তু লোক লাগিয়ে রেখেছে। শিরিন বাড়িতে আসলেই যেনো তাকে জানানো হয়।
লায়লা ভাবির সাথে কথা শেষ করলাম। নিজের অজান্তেই মুখ দিয়ে তপ্তস্বাস বেরিয়ে এলো আক্ষেপ ও আফসোসের। এই আক্ষেপ আশরাফুলের জন্য নয়। শিরিনের জন্য নয়। করিমন ও জুলেখা জেঠির জন্য নয়। একজন মানুষ হিসেবে মানুষের জন্য। স্রস্টার সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের জন্য।
বিয়ে নিয়ে নানান ব্যস্ততায় দুই পরিবারের একমাস গত হলো। আজ আমার আরেকটি নব জীবন সূচিত হলো। ঘরোয়া আয়োজনে সবার উৎফুল্লতায়, আনন্দমুখর পরিবেশে গায়ে হলুদ ও বিয়ে সম্পন্ন হয়ে গেলো। রাবুও ছিলো বেশ প্রানবন্ত। এই ভিতরে সে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে। কেটে গেলো তার জীবনে ধেয়ে আসা ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবলীলার প্রভাব। রাজন ঘুরে ঘুরে আমাকে দেখছে অদ্ভুত চোখে। আমি রাজনকে কোলে তুলে অঝোরে কাঁদলাম নিজের অতীত স্মরণ করে।
বিকেলে আমাকে কোলে করে সেই ঘরে নিয়ে গেলো মাহমুদের বড় বোনের জামাই।কেননা কয়েক হাত ব্যবধানে দুই ঘর। তাই গাড়ি নিষ্প্রয়োজন। গ্রামে এই রীতি। বউ পায়ে হেঁটে স্বামীর ঘরে ঢুকবে না।
আমি আমার শ্বাশুড়িকে পা ছুঁয়ে সালাম দিলাম। তিনি হেসে উঠে বললেন,
” হইছে থাক। ঘরের মাইয়া ঘরে আইছে। এত নিয়ম মানামানিতে আমি নাই। সালাম ত এমনেই কত দেস। রুমে যাইয়া বইসা থাক মা।”
বড়াম্মু মানে শ্বাশুড়ির কথা শুনে ঘোমটার ভিতর আমার মুখে এক চিলতে প্রশান্তি দোল দিয়ে গেলো ধানের শিষের মতো।
রাত বেড়ে যাচ্ছে। আঁধার ঘন হচ্ছে। ঘড়ির কাঁটা ঘুরে এগারোটায় চলে গেলো। বধূ সাজে সজ্জিত আমি। ফুলসজ্জার মাঝ বরাবর বসে আছি। মাহমুদ ভাই বর বেশে রুমে ঢুকলো। দরজা বন্ধ করে দিলো। আমার হৃৎপিণ্ড ধুকপুক করছে ক্রমাগত। মাহমুদ ভাইকে আজ অন্যরকম সুন্দর লাগছে। যা এর আগে কখনো লাগেনি আমার চোখে। হঠাৎ করেই চেনা মাহমুদ ভাইকে কেমন অচেনা লাগছে। আমি গোপনে পুলকিত হচ্ছি। আবার ভারি সংকোচ ও লাগছে।
মাহমুদ ভাই বিছানায় উঠে এলো আমার হাত টেনে নিয়ে উষ্ণ চুমু খেলো। মাথার উপর থেকে ঘোমটা নামিয়ে নিলো। পলকহীন নেশাতুর চাহনিতে আমার মুখের দিকে চেয়ে রইলো অবিকল। পরক্ষণেই আমার পানকৌড়ি বলে,
আমার খোলা ঘাড়ে তার চিবুক ঠেকিয়ে ধরলো। মাহমুদ ভাইয়ের ভারি গরম নিঃস্বাস আমি টের পাচ্ছি। অস্থির হয়ে উঠছি। আমার সমস্ত অনুভূতি অবশ হয়ে আসছে। উনি অধরজোড়াকে ঘাড় থেকে ধীরে ধীরে গলার সামনের অংশে বুকের মাঝে নিয়ে এলেন। আমি লাজুকলতার মতো মিইয়ে যাচ্ছি বুঁজে আসা আঁখিদ্বয় নিয়ে।
বাইরে মাঝারি দমকা হাওয়া বইছে। বাঁশঝাড়ের শাখায় শাখায় ঘর্ষণ হচ্ছে। একটা অশরীরী আওয়াজ ভেসে আসছে সেখান হতে৷ আমার শরীর হিম হয়ে আসছে। মাহমুদ ভাইদের ঘরের পিছন বরাবর এই বাশঁঝাড়টা। আমার শরীরের সমস্ত ভার ছেড়ে দিলাম তার উপরে।
শুধু তার পূর্বে মৃদু উচ্চারণ করলাম,
” মাহমুদ ভাই কি করছেন? বলে। ”
উনি নিরবতা ভাঙ্গলেন। দুষ্টমিষ্ট শিহরিত চোখে বললেন,
” ওই দেখো কারে কি কয়? স্বামীকে বলে ভাই। ইচ্ছে ছিলো এই মধুর রজনী উতলা করব মুখে কথা না বলেই। এই রাত তোমার আমার। কথা হবে না। শুধু কাজ আর কাজ হবে বিরতিহীনভাবে বন্য উল্লাসে। ”
আমি কিছুই বলতে পারছি না। তবে টের পাচ্ছি কিছু। মাহমুদ ভাই আমার মাঝে একান্ত সুখে বিভোর হয়ে আছে। সুখের নির্যাস নিতে তিনি ডুবুরির মতো সারা শরীরে হাতড়ে বেড়াচ্ছে হাতের ও দুই ঠোঁটের নিবিড় আলিঙ্গনে। একে একে সব গহনা উনি খুলে ফেলল। ওড়না সরিয়ে নিলো। শাড়ির আঁচল সরিয়ে বক্ষ উন্মোচন করল। তারপর আমার আর কিছুই মনে নেই। সকালে ঘুম ভাঙ্গতেই নিজেকে আবিষ্কার করি মাহমুদ ভাইয়ের কোলে আমার মাথা। ধড়পড়িয়ে উঠে ওয়াশরুমে গিয়ে গোসল সেরে নিলাম। রাবুকে ফোন দিয়ে রাজনকে কাছে আনালাম। আমার কাছে রেখে দিলাম রাজনকে। মাহমুদ ভাই সেদিন আমাকে দেখলেই কেবল কামুক হাসি দিয়ে চোখ টিপ মারতো।
তার তিনদিন পর মাহমুদ ভাই ঢাকা চলে গেলো। সুযোগ পেলেই আমাকে ভিডিও কল দিচ্ছে। ফাজলামো করছে। মাহমুদ ভাইকে দেখলেই মনে হয়,
এমন নির্মল আর সতেজ মনের কাউকে ভালো রাখার জন্য হলেও জীবনের শেষ মুহূর্তে অবধি তার পাশে থাকতে হবে।
আমাদের দাম্পত্যের তিনমাস চলছে। দুই পরিবারের হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক এখন আরো আন্তরিক। আরো বোঝাপড়ার। করিমন ও জুলেখা জেঠি তাদের অপরাধ স্বীকার করেছে পুলিশের কাছে। প্রাপ্য সাজা পেয়েই তারা মুক্তি পেয়েছে। আমার রাজন দুই পরিবারের আদরে,যত্নে বড় হচ্ছে। মাহমুদ ভাই আমার চেয়েও বেশী রাজনের প্রতি দায়িত্বশীল। মাহমুদ ভাইকে আমি আজকাল বড় বেশী ভালোবেসে ফেলার এটাই বড় কারণ। একজন মায়ের কাছে তার সন্তান পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ। খোদায় দেওয়া নেয়ামত।
সাংমা আমাকে জানাল। নতুন বিউটিশিয়ান পেয়ে গিয়েছে। মেয়েটা কাল থেকে চাকরিতে জয়েন দিবে। সকালেই চলে আসবে। এটা শুনে মাহমুদ ভাই বলল,
” সমস্যা নেই। আসুক। তুমি পার্লার ভাড়া,ও তাদের দুজনের সেলারি দিতে কোন মাসে আটকে গেলে আমিতো আছি। ”
শুনে অফুরন্ত ভালোলাগায় ভরে গেলো মনটা। পরেরদিন পার্লারে গেলাম ফুরফুরে মেজাজে। ভিতরে ঢুকেই চিরচেনা মুখটি দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। সেও লজ্জাবনত চোখে বিমূঢ় হয়ে চেয়ে রইলো আমার দিকে। সাংমা একবার শিরিনকে একবার আমাকে দেখছে।
যেই শিরিন আমাকে বন্ধুর মতো ভাবতো। পোশাকে,চলনে বলনে ছিলো যার ঠাটবাট। সেই শিরিনকে দেখতে এখন আমার চেয়েও বয়েসী মনে হচ্ছে। সেই শিরিন এখন আমাকে ম্যাডাম বলে ডাকবে। আমার দেওয়া বেতনে সে দিনানিপাত করবে। ভাবতে আমারই খারাপ লাগছে। আমি শিরিনকে তাড়িয়ে দিলাম না। কারণ মনুষ্যত্ববোধ আর মানবিকতার বীজ ছোটবেলায় মা বাবা আমার মাঝে বুনে দিয়েছে। পরে সাংমা থেকে জেনে নিলাম কিভাবে শিরিনকে পেলো। আমার বিষয়টা গোপন রাখলাম সাংমার কাছে।
কেবল বললাম,
“ওকে চিনি আমি।”
“নিজের দূর্বলতা কারো কাছে প্রকাশ করা মানেই নিজেকে তার কাছে দূর্বল করে তোলা। ”
আজ মাহমুদ বাড়ি এলো। বললাম,
” আমাকে নদীর পাড়ে নিয়ে যাবেন? আর কেউ না। কেবল আমরা দুজন। আমি উজানের ঢেউ দেখব। এখন তো বর্ষাকাল। দেখা যাবে। তাইনা?”
মাহমুদ ভাই আমার কোমর পেঁচিয়ে ধরলো। নিজের সাথে ভিড়িয়ে নিলো। দু’চোখের পাতায় কোমল চুমু খেলো।বলল,
” তাই হবে আমার পানকৌড়ি। কালই চলো মেঘনার ঘাটে।”
সময়টা শ্রাবণ মাসের কোন এক মধ্য দুপুর। আমি আর মাহমুদ ভাই মেঘনার পাড়ে বসে আছি খুব কাছাকাছি হয়ে। মাথার উপরে উদার আকাশ। তার বুক চিরে দু’ ডানা মেলে উড়ে গেল একটি শঙ্খচিল।
বিস্তৃত প্রান্তর। দিগন্ত জুড়ে স্বচ্ছ জলরাশি। দু’চোখ যেদিকে যায়। তাতে পানি আর পানি। সেই উথাল-পাথাল পানিতে খেলা করছে ছোট বড় ঢেউ। আমি ভাবছি জীবনের উজানের ঢেউ সবার উপরেই আছড়ে পড়ে। এটাকে মোকাবিলা করে টিকে থাকতে পারে কজন। পারলেও কি সবাই একভাবে পারে? কজন আমার মতো সাঁতার কেটে কূল ছুঁতে পারে সফলতার সঙ্গে। সবার জীবনে কি মাহমুদরা থাকে? জীবনের এই উজানের ঢেউ হানা দিয়েছে আশরাফুল, শিরিন,রাবু,আমি,করিমন,জুলেখা,চয়ন সবার জীবনেই।
আমার ভাবনার ইতি ঘটে মাহমুদ ভাইয়ের নরম ডাকে।
“এই তোমার চুলগুলোকে সাবধানে রাখতে পারনা? এত অবাধ্য কেনো?”
” আমার চুলে কি করেছে আপনাকে?”
” কি করেনি? বারবার আমার মুখের উপর বেসামাল হয়ে তেড়ে আসছে। সরে বসো। খোঁপা করে ফেলো নইলে।”
আমি কপাল কুঁচকে হুহ, করে সরে গেলাম তার পাশ থেকে। একটু পরেই উনি আমার বাহু ঝাঁকিয়ে টেনে ধরে বলল,
” এই রত্না দেখো দেখো,ওই যে উজান ঢল আসছে স্রোতের বিপরীত দিক হতে। দেখছ? এই উজান ঢলেই কত মানুষ হয় বাস্তুহারা। নিঃশ্চিহ্ন হয়ে যায় তাদের জীবনের সব। ভালোভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারে কজন।”
মাহমুদ ভাইয়ের কাঁধের উপর আমি মাথা এলিয়ে দিলাম। উজান স্রোতের ভয়াল ঢেউয়ের দিকে এক আশ্চর্য দৃষ্টিতে ঠায় চেয়ে আছি ধ্যানমগ্ন ঋষির ন্যায়।
সমাপ্তি।
Khub valo lglo golpo ta,,,,,,,,