#উজানের_ঢেউ ( ১৫
কলমে✍️ #রেহানা_পুতুল
” এই পুলিশ কেন? মাহমুদ কই তুই বাবা?”
” চাচী এখন একটা নাটক হবে আমাদের বাড়িতে। সেই নাটকটি জমাতে উনাদের ভূমিকা শতভাগ। সবাই আসুন বাইরে।”
আমার কাছ থেকে ছিটকে সরে গিয়ে মাকে বলল মাহমুদ ভাই।”
চিন্তাগ্রস্ত কন্ঠে মা জানতে চাইলো,
” কিসের নাটক বাবা ? কিছুই তো বুঝতেছি না?”
মাহমুদ ভাই মায়ের কথার জবাব দিল না। হাত উঁচিয়ে ইশারায় বাবা,মাকে তাদের পিছনে যেতে বলল। আমরা সবাই তাদের পিছুপিছু সন্তপর্ণে এগোতে লাগলাম বিড়াল পায়ে। পুলিশ চারজনকে নিয়ে মাহমুদ ভাই বাড়ির শেষ প্রান্তে চলে গেলো। জুলেখা ও করিমন অর্থাৎ সেই দুই জেঠিদের ঘরের সামনে গিয়ে থামলো। পুলিশ দুজন করে চারজন ভাগ হয়ে গেলো দুই ঘরের সামনে।
মাহমুদ ভাই মাকে ও আমাকে কানে কানে শিখিয়ে দিলো,তাদের দরজায় নক করার জন্য। কারণ অন্য পুলিশ বা মাহমুদ ভাইয়ের কন্ঠ শুনলে তারা দরজা খুলবে না। তারা ঘরের ঢেলার একপাশে কিছুটা আড়াল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
মা ও আমি সেই অনুযায়ী কাজ করলাম। করিমন জেঠিদের দরজা খুলল তার স্বামী। মা বলল,
” ভাবিরে একটু ডাক দেন ভাই কষ্ট করে। জরুরী দরকার।”
জেঠা জেঠিরে ঘুম থেকে ডেকে উঠালো। অমনি পুলিশ তিনপায়ে এগিয়ে এলো।জেঠির হাতে হাতকড়া পরিয়ে ফেলল। নরম সরম হলেও হিংসুটে জেঠি কেঁপে উঠলো ঝড়ো হাওয়ায় দুলতে থাকা সুপারি গাছের মতন।
আমি ডাকলাম জুলেখা জেঠিকে। উনার ছোট ছেলে তাকে ডেকে আনলো দরজায় আমার অনুরোধে। বাকি দুজন পুলিশ একই কায়দায় এগিয়ে এলো। উনার হাতে হাতকড়া পরিয়ে নিলো। উনি চেঁচিয়ে উঠলেন ঝাঁঝালো স্বরে। তুই তোকারি শুরু করলেন পুলিশের সাথে। দুই ঘরের সব মানুষের নিদ্রা ভঙ্গ হলো। এবং সবাই জড়ো হয়ে গেলো একত্রে।
বিদুৎ চলে এলো। উঠানোর হাই ভোল্টেজের বাল্ব জ্বলে উঠলো। মাহমুদ ভাই এগিয়ে এলো। মা নির্বিকার চোখে বাড়ির দুই জাকে দেখতে লাগলো। মায়ের চোখের ভাষা এমন,
একি কুৎসিত বিদঘুটে রূপ তোমাদের। একি নগ্ন কার্যকলাপ। অথচ যুগ যুগ ধরে এই একই বাড়িতে আমরা পাশাপাশি বাস করে আসছি। ভালোতে ছিলাম। মন্দতে ছিলাম। মমতায়,আন্তরিকতায়। সঙ্গী হয়ে। আপন হয়ে। বোন হয়ে। বছর দুয়েকের তিক্ততায় তোমরা এত হিংস্র হয়ে উঠলে? নারী হয়ে নারীর উপর জুলুমের পাঁয়তারা করলে? ধিক জানাই ধিক! ওয়াক থু করে মা এক দলা থুথু ছুঁড়ে মারলো মাটিতে।
তাদের দুই পরিবারের লোক, মাহমুদ ভাই ও পুলিশকে জিজ্ঞেস করলো ক্ষেপানো স্বরে,
” বুঝলাম না। নিখোঁজ হইলো হেগো মাইয়া। আবার ফিরাও পাইলো। কিন্তুক আপনারা অবলা মাঝবয়েসী দুই নারীকে কেন এই রাইতের কালে এরেস্ট করলেন? হাতকড়া খুলেন কইতাছি। ”
মাহমুদ ভাই নিঃশ্চুপ। তবে চোখের চাহনি রুক্ষ,বিরক্তিকর ও র’ গ*চ* টা।
পুলিশ বলল,
” আমরা আইন অমান্যকারী নই। ভঙ্গকারী নই। আমরা আইন রক্ষাকারী। আইনকে যথাযথ সম্মান করতে জানি। এই দুজন নারী অন্যায়ভাবে বিনা কারণে রাবু নামের মেয়েটিকে ব্ল্যাকমেইল করালো। উপযুক্ত প্রমাণ হাতে রয়েছে। তাই এখন থানায় নিয়ে যাচ্ছি তাদের দুজনকে। যা বলার আপনারা কাল থানায় গিয়ে নির্দোষ প্রমাণ করে ছাড়িয়ে নিয়ে আসবেন।”
ঘটনার আকস্মিকতায় আমরা সবাই বেহুঁশ হওয়ার উপক্রম। আমরা নারী জাতি এত কেন এতটা প্রতিশোধ পরায়ন? কেন এত জেলাসী? ওহ নো! মাথা ভনভন করছে আমার।
সেই নিরব নিশির আঙিনা সরব হয়ে উঠল বাড়ির কিছু মানুষের পদাচারণায়। অদূরে হাসনাহেনার গাছের উপরে একঝাঁক ঝিঁঝি পোকা এই জ্বলছে। এই নিভছে। দারুণ পিনিক লাগছে দেখতে।
মাহমুদ ভাইয়ের বড় ভাবি পারুলও আছে একপাশে দাঁড়িয়ে। মামা বেকুবের মতো চেয়ে আছে দুই জেঠির দিকে।
তখন সেই দুই জেঠি আহত কন্ঠে বলে উঠলো পুলিশের দিকে চেয়ে,
” অসম্ভব! আল্লাহর দোহাই লাগে, রাবুর বিষয়ে আমরা কিছুই জানিনা। আমাদের মান খোয়াবেন না। আমরা কেন এসব করাবো? আমাগো ছাইড়া দেন পুলিশ বাবাজিরা। এসব মাহমুদের কাম। ওই বেশী ভালা পোলা না। ”
তখন ঘরের ভিতর থেকে জেঠির মেয়ে মেরিনা বলে উঠলো,
” জ্বি স্যার। আমার আম্মা, চাচী ঠিক বলছে। মাহমুদ ভাই করছে এই কাজ। কারণটাও শুনেন। মাহমুদ ভাই রাবুকেও পছন্দ করে। রাবুকে ব্ল্যাকমেইল করেছে। যেন রাবুর চরিত্রে স্পট পড়ে যায়। তার আর কোথাও বিয়ে হবে না। তখন মাহমুদ ভাই তাকে বিয়ে করবে। দুই বোনকে তার দুইপাশে রাখবে।”
মুহূর্তেই বাবা ককর্শ কন্ঠে ধমকে উঠলো তাকে। এবং তেড়ে যাচ্ছে মেরিনার দিকে। তার আগেই মাহমুদ ভাই দু পা এগিয়ে গেলো। মেরিনার একহাত পিছনে নিয়ে উল্টিয়ে ধরলো। কন্ঠস্বরকে মাঝারি উচ্চতায় রেখে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল,
” মেয়ে মানুষের গায়ে হাত দেয়া খুব বাজে বিষয়। নইলে তোকে এখন জ্যান্ত পুঁতে ফেলতাম তোদের ঘরের ভিটাতেই। নিজে বিয়ে বসতে চেয়েছিস আমার কাছে। পারিসনাই দেখে অন্যের নামে বদনাম রটিয়ে জ্বালা মিটাতে চাস। নাহ?”
মেরিনা কুঁকিয়ে উঠলো। মেরিনার স্বামী এসে মাহমুদ ভাইয়ের নাকমুখে ঘুষি মেরে বসল ধুম করে। মাহমুদ ভাই উল্টো তাকে লাথি মেরে বসল। সে পেটে হাত চেপে ধরে সরে গেলো। মাহমুদ ভাই পুলিশদের অনুরোধ করে বলল,
” আপনারা উনাদের নিয়ে যান।”
তারা দুই জেঠিকে গাড়িতে তুলে ফেলল। গাড়ি ছেড়ে দেওয়ার আগে মাহমুদ ভাই গাড়ির সামনে গিয়ে তাদের বলল সবাইকে শুনিয়ে,
” আপনারা ধরা পড়তেন না। কিন্তু যেই নাটক সাজিয়েছেন, তা প্ল্যান মোতাবেক হয়নি। সেয়ানের উপরেও তো সেয়ানা আছে। যাকে দিয়ে চাল দিয়েছেন দাবার গুটি। সে ব্যর্থ হয়েছে। আপনাদের লোক হলেও সব হুড়হুড় করে উগরে দিয়েছে। কারণ প্রাণের ভয় সবার আছে। মানুষ সবচেয়ে বেশী নিজেকেই ভালোবাসে। মেয়ে মানুষের বুদ্ধি আসলেই পুরুষের হাঁটুর নিচে থাকে। শুনতে তিতা লাগলেও এটাই সত্যি। আর আপনারা কেন করেছেন? সেটা আমি যেমন জানি। তেমনি আপনারাও দুজন জানেন। ”
পুলিশ গাড়ি ছেড়ে দিলো। আমরা সবাই আমাদের ঘরের দিকে পা বাড়ালাম। তাদের দুই ঘরের মানুষ এক হয়ে গেলো। জটলা বেঁধে তারা চেঁচামেচি শুরু করলো। অভিসম্পাত দিতে থাকলো মাহমুদ ভাইকে।
উজানের ঢেউ সবার জীবনেই আছড়ে পড়ে কমবেশি। এই কঠিন সত্য আরেকবার উপলব্ধি করতে সক্ষম হলাম আমি।
মাহমুদ ভাই গালে হাত দিয়ে মাকে বলল,
” নাটক দেখেছেন চাচী?”
” দেখলাম। এত কাছের মানুষজন থেকে এত বিষাদের নাটক আমার কল্পনাতীত ছিলো বাবা।”
নিদারুণ স্বরে বলল মা।
নাটক শেষ হয়নিতো চাচী। আরো যে বাকি আছে।”
মা চমকানো দৃষ্টিতে মাহমুদ ভাইয়ের দিকে চাইলেন। বাবা বললেন,
” তাতো তখন তোমার কথা শুনেই বুঝলাম। আগে নাকমুখে বরফ ঘঁষে ভাত খেয়ে নাও।”
” নাহ কাকা। ঘরে যাবো। ফ্রেস হবো। খাবো। আমি খুব টায়ার্ড। আপনারা সবাই এখন ঘুমিয়ে যান। সকালে বাকি বিষয় জানাবো। সবার উপরেই ধকল গেলো।”
মাহমুদ ভাই চলে গেলো তাদের ঘরে। যাওয়ার আগে সবার অলক্ষ্যে আমার দিকে চাইলো। ক্লান্ত নেত্রপল্লব দুটিকে একবার বুঁজে নিলো। আমি কিছু কল্পনা করলাম। মাহমুদ ভাই যেন আমাকে ছুঁয়ে বলছে,
” প্রথম যেদিন দেখেছিলাম তোর ওই মায়াবী চোখ।
সেদিন হতে তোকে ভালবাসি, তুই আমার সুখ।
তুই আমার সকাল সন্ধ্যা, তুই আমার ভোর।
তুই আমার সকল নেশা,তুই আমার ঘোর। ”
গোপনে রোমাঞ্চিত হলাম। ভালোলাগার মানুষকে কল্পনা করলেও এত সুখ। তা আগে কখনো টের পাইনি।
রাতে আমরা রাবুকে কেউই কিছু বললাম না। কিছু জানতেও চাইলাম না। রাবুও দরকার না হলে আমাদের কারো সাথে কোন কথা বলেনি।
রাবুসহ নৈশভোজ সেরে যার যার বিছানায় চলে এলাম।
রাবু রুমে এসে ঘুমন্ত রাজনের গালে গাল ঠেকিয়ে ধরলো আদুরে ভঙ্গিতে। আমাদের অপেক্ষা সকালের। আমি রাবুকে পরখ করে দেখলাম অনুসন্ধিৎসু চোখে। রাবুর সারামুখজুড়ে একাকীত্বের ছাপ। শূন্যতা, অভিমান,দোটানা রাবুকে অক্টোপাসের মতো ঘিরে আছে। কোন গভীর দুঃখবোধ রাবুকে কাবু করে ফেলছে। কোন কবি লেখক এখন এই রাবুকে দেখলে একটা মন খারাপের গল্প নয়তো কবিতা রচনা করে ফেলতে পারতো।
ভুল করে হলেও আমার অচেতন মনে একবার মনে হলো,
” রাবু কি শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়েছে? না না। একি ভুলভাল ভাবছি আমি। ”
পরেরদিন সকালে মামার তাড়া আছে বলে চলে গেলো। নয়ন স্কুলে চলে গেলো। রাবুর কলেজ খোলা। মন খারাপ বলে যাবে না জানিয়ে দিলো।
মা বলল,
” থাক একদিন না গেলে এমন ক্ষতি হবে না। পুষিয়ে নিতে পারবে পরে।”
বাবা আমাকে বলল,
” মাহমুদ তো এখনো এলনা। একটু ডেকে আন মা। আমি দোকানে যেতে হবে। বাকি বিষয় আশয় ওর থেকে শুনে নিই। দুই লক্ষ টাকা কে কার জন্য দেয়। কত মহান আমার ভাতিজাটা।”
মা পাশ থেকে বলল বাবাকে,
” আপনার যা কথা। রত্না এখন কি ওদের ঘরে যায়? যাওয়া মানায়? কয়দিন বাদেই বউ হয়ে যাবে ওদের ঘরে। আমিই গিয়ে ডেকে আনতেছি।”
মাহমুদ ভাই নাস্তা করে আমাদের ঘরে এলো। আমার রুমে উঁকি দিলো চোরের মতো। সেইক্ষণে আমার মুখ দিয়ে অজান্তেই বেরিয়ে এলো,
” মাহমুদ ভাই,আপনাকে খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে ভালো লাগছে। মজনু সেজেছেন কার জন্য?”
তিনি হঠাৎ করে কিছু পাওয়ার মতো চাইলেন আমার দিকে। উনার চোখের পাড়ে খেলা করছে ছলচাতুরী। ভাবুকের মত করে বললেন,
” থ্যাংকস গুরুত্বপূর্ণ ইনফরমেশনটা দেওয়ার জন্য।”
আমি নাক কুঁচকে ঠোঁট বাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
“কি? বুঝিনি।”
উনি আমার নাক টিপে দিয়ে বললেন,
“এটা ফুলসজ্জার সময়ের কাজ।তখন বলব।”
আমি আড়ষ্ট হয়ে নিজের দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললাম।
” ওরে ঢংগীরে আমার। একবার কেবল পাই কাছে। সংঘর্ষ কারে বলে বুঝিয়ে দিব। রাবুকে নিয়ে এদিকে আয়। ”
আমি,মা,বাবা,রাবু,মাহমুদ ভাই বসা। মাহমুদ ভাই বলল,
” এই রাবু। তুই নিজের মুখেই সব বল। পরে আমার পার্ট আমি বলছি।”
রাবু নিচু মাথায় ঠায় বসে আছে আসামীর মতো। মুখ খুলছে না। মা রাবুকে ঠান্ডা মেজাজে বলল,
” কিরে বল? কিভাবে কি হলো? কে তোকে ব্ল্যাকমেইল করলো? কিছুই তো আগামাথা বুঝতেছি না। এই দুইদিনে আমাদের কেয়ামতের আলামত দেখা হয়ে গেছে৷ ”
রাবু তবুও মেলানো ঠোঁট মেলছে না। সং হয়ে বসেই আছে দুই হাঁটু ভাঁজ করে কুণ্ডলী পাকিয়ে। সম্ভবত বাবার সামনে বেশ সংকোচবোধ করছে।
তখন মাহমুদ ভাই বলে উঠলো,
” বুঝেছি। আমারই শুরু করতে হবে।”
” হ্যাঁ বাবা। তুই বল তো কাহিনীর আগাগোড়া? তোর কাকা দোকানে যেতে হবে। তাড়া আছে।”
তীক্ষ্ণ স্বরে মাহমুদ ভাই বলল,
” আমাদের রাবুকে ব্ল্যাকমেইল করেছে তার ভালোবাসার মানুষটা। মানে ওর প্রেমিক। তার জীবনের প্রথম অনুভূতি! প্রথম প্রণয়! তার প্রেমিকটা বড় স্বার্থপর! সিরিয়াস রকমের ধড়িবাজ! সেই প্রেমিকটাকে মন প্রাণ দিয়ে রাবু আজ রিক্ত! নিঃস্ব! ”
চলবে.. ১৫