উজানের ঢেউ পর্ব-১৪

0
601

#উজানের_ঢেউ ( ১৪)
কলমে✍️ #রেহানা_পুতুল
মা বুক চাপড়ে গগন কাঁপিয়ে আর্তনাদ করছে। আমরা সবাই অশ্রুবিলাপে ভেসে যাচ্ছি আমাদের চঞ্চল চড়ুয়ের মতো নিখোঁজ রাবুটার জন্য।

বাড়ির অনান্যরাও এগিয়ে এসেছে আমাদের এই ঘোর সংকটে। যাদের সাথে আমাদের বিবাদ। সেই দুই জেঠি ও এক জেঠাও এগিয়ে এলো আমাদের ঘরে। আক্ষেপ ও আফসোসে তাদের দুই জায়ের কপালে শত ভাঁজ বিদ্যমান।

বাবা আমার এক মামাকে নিয়ে থানায় চলে গেলো জিডি করার জন্য। আমি কান্না করতে করতে জড়ানো স্বরে মাহমুদ ভাইকে জানালাম। ততক্ষণে মাহমুদ ভাই ঢাকার কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছেন। মাহমুদ ভাই বাকরুদ্ধ কন্ঠে বললেন,

” কি বলছিস এটা! আমি আর স্থির থাকতে পারছি না। ব্যাক আসাও সম্ভব নয়। এখানে জরুরী কাজ আছে কাল। এই সময় তো গ্রামে যাইনা। কাল গেলাম কেবল তোর সাথে দেখা করতেই। আমার যত যা করণীয় সবই করবো। কাকাকে থানায় যেতে বল। বসে থাকলেই ক্ষতির সম্ভাবনা প্রবল। কেননা, রাবু তরুণী একটা মেয়ে।”

” এজন্যই তো রুহটা কবজ হয়ে যাচ্ছে মাহমুদ ভাই।”

মোবাইল রেখে দিলাম। আমি ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করছি,

হঠাৎ করে আমার প্রাণচঞ্চল বোনটা কই গেলো? নাকি নিখোঁজ হলো? হলেও কি সেই কারণ? নাকি কোন নষ্ট ছেলের দলের খপ্পরে পড়ে গেলো? নাকি কোন মলম পার্টি বা অজ্ঞান পার্টির কবলে? নাকি কেউ প্রতিশোধের হাতিয়ার হিসেবে রাবুকে ইউজ করলো? নাহ কি সব আবোলতাবোল ভাবছি। মা বিছানার উপরে বসে আছে হাত পা ছড়িয়ে। মায়ের বেশ উম্মাদিনীর মতো। নয়নকে বুকে লেপ্টে ধরে আছে মা।

বাড়ির অনান্যদের দিকে চেয়ে মা অস্ফুট স্বরে বলল,

” আমার রাবুটারে কি ভালোভাবে ফিরে পাবো না আমার বুকে?”

তারা মায়ের পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে শান্তনার বুলি শুনালো যত যা পারলো। মা ও আমার ফোনে সব নিকট আত্মীয় দূরাত্মীয়রা ফোন দিতে লাগল রাবুর খোঁজ নেওয়ার জন্য।

বাবা ও মামা চলে চলে এলো থানা থেকে। বাবা নির্জীবের ন্যায় বসে আছে কাঠের চেয়ারের হাতল ধরে। মামা আমাদের সবাইকে শুনিয়ে বলল,

পুলিশ আমাদের থেকে প্রয়োজনীয় সব তথ্য নিয়েছে রাবু সম্পর্কে। পুলিশ আরো বলছে কাউকে সন্দেহ হলে যেন তার নামে মামলা দিই। দুলাভাই বলল, আপনাদের সাথে কারোই মারাত্মকভাবে দ্বন্দ্ব নেই। অল্পস্বল্প আছে বাড়ির জায়গা নিয়ে। তখন সেই দুই জেঠি ও জেঠা ছিলনা কিন্তু।

তার কিছুক্ষণ বাদেই বাবার ফোন বেজে উঠলো। অচেনা নাম্বার। বাবা রিসিভ করলো। লাউড স্পিকার দেওয়া। আমরা উপস্থিত সবাই বাবার সেলফোনের দিকে চাতক পাখির মতো তাকিয়ে আছি হা হয়ে।

বাবা হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো রাবুর কন্ঠ,

” আব্বা আমি রাবু। তোমরা চিন্তা করো না আমার জন্য। আমার কোন সমস্যা হয়নি। কিন্তু আমি অন্যরকম একটা বিপদে আছি আব্বা।”

মা, রাবুউউ… বলে চিৎকার দিতে গেলেই আমি নিজের ঠোঁটে আঙ্গুল চেপে মাকে,

হিসসসস… বলে চোখ দিয়ে ইশারায় চুপ করিয়ে দিই।

” কি বিপদ আম্মা? তুই কই গেলি? কই আছিস? ”

” আব্বা এখন এত কথা বলার সময় নাই। আমি একটা ব্যাংক একাউন্ট নাম্বার দিতাছি। এখানে কাল সকালে দুই লক্ষ টাকা পাঠিয়ে দিও। নয়তো আমি তোমাদের কাছে আসতে পারব না। ”

” কি কস আম্মা? আমি এত টাকা কই পাবো?”

” বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে বলল বাবা।”

” আপার টাকা আছে না? সেগুলো পাঠায়া দাও। নয়তো মাহমুদ ভাইরে বল ব্যবস্থা করে দিতে। আব্বা মনে রেখো, টাকা যত দেরিতে দিবে, আমাকে তত দেরিতে পাবে। আর এটা কাউকেই জানাবে না দয়া করে।”

” আচ্ছা জানাব না। পাঠিয়ে দিব আম্মা।”

আব্বার কথা শেষ না হতেই পট করে লাইন বিচ্ছিন্ন হলো। ওপাশ থেকে রাবুর আর কোন কথা শুনা গেল না। সেই নাম্বারে আমরা অজস্রবার ফোন দিলাম। কিন্তু সুইচড অফ পেলাম। বাবার মোবাইলে একটা বেসরকারি ব্যাংকের একাউন্ট নাম্বার এলো মেসেজের মাধ্যমে। আমরা সবাই নির্বাক হয়ে গেলাম। বাড়ির ছোট বড় যারা ছিলো, তারা সবাই হায়-হুতাশ করতে করতে বেরিয়ে গেলো।

মামা,বাবা,মায়ের অনুমতিক্রমে মাহমুদ ভাইকে সব জানালাম। মাহমুদ ভাই বলল,

” তোরা এত অধৈর্য হস না। একাউন্ট নাম্বার টা আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে দে। এবং ফোন আসা নাম্বারটাও দিয়ে রাখ। আর তোর টাকায় হাত দিতে হবে না। টাকা আমি ব্যবস্থা করে দিবো।”

আমি উৎকন্ঠা ও ভীরু কন্ঠে বললাম,

” সত্যি সত্যি দুই লক্ষ টাকা সেই একাউন্টে পাঠিয়ে দিবেন?”

তিনি অসিহষ্ণু কন্ঠে বললেন,

” উদ্ভূত তো! রাবুর চেয়ে দুই লাখ টাকা বেশী? একজন মানুষের জীবনের চেয়ে কখনোই অর্থ বেশী মূল্যবান হতে পারে না। মনে রাখবি,
” অর্থ সম্পদ মানুষের জন্য। মানুষ অর্থ সম্পদের জন্য নয়।”

তোরা স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা কর। কাকা ও চাচীর দিকে খেয়াল রাখিস। আমি এদিকটা দেখছি। এবং রাবুকে নিয়ে কালই বাড়ি ফিরবো যত দ্রুত সম্ভব। ”

আমরা সবাই একে অপরের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করলাম। রাবু ও পরিস্থিতি নিয়ে আমাদের জল্পনা কল্পনার অন্ত নেই। নানান প্রশ্ন, বহুমুখী জিজ্ঞাসা নিজেরা নিজেদের করছি। মামা বলল,

” মাহমুদ ছেলেটা বিচক্ষণ ও দূরদর্শী। সে মনে হয় ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু আঁচ করতে পেরেছে। এখন আমাদের সবর করা ছাড়া আর কোন গতি নেই। নামাজ পড়ে দোয়া করেন রাবুর উপর যেনো কোন নির্যাতন না হয়।”

আমি মামাকে বললাম,

” মামা খেয়াল করেছেন,রাবুর কন্ঠটা কেমন জড়ানো ও অসংলগ্ন ছিলো?”

” খেয়াল না করার কি? ওকে দিয়ে কেউ সামনে থেকে কথাগুলো বলিয়েছে। মোটকথা রাবু বিপদে আছে। এটাই বড় সত্যি এখন।”

মায়ের মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না। বোধহীন, প্রাণহীন পাথরের ন্যায় মা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে আমাদের মুখপানে। একজন মায়ের জায়গায় এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক।

সেদিন আমাদের সবার নির্ঘুম রাত কাটল দূর্বিষহভাবে। রাতে কেউই কিছু খাইনি আমরা, মামা ও রাজন ছাড়া। পাখি ডাকা প্রভাতেই সবাই বিছানা ছাড়লাম। ক্ষুধাটা বেশ উৎপাত শুরু করেছে পেটের ভিতরে। তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সবাই রেডিমেড নাস্তা খেয়ে নিলাম। ঘরে কিছু বানানোর মতো মানসিক ও শারিরীক শক্তি কারোর মাঝেই অবশিষ্ট নেই। তাই মামা বাজারে চলে গেলো। গরম গরম খাস্তা পরোটা ও নেহারি নিয়ে এলো। সাথে বুটের ডাল ভুনা।

আমাদের প্রতিটি প্রহর কাটছে রুদ্ধশ্বাসকর প্রতিক্ষায়,চরম উত্তেজনা ও দুর্ভাবনায়। ভোর গড়িয়ে দুপুর শুরু হলো। চারপাশ আলোকিত করে কমলা রঙের রোদ উঠেছে। সেই রোদ্দুরের কড়া ঝাঁঝকে উপেক্ষা করেও আমি পার্লারে চলে গেলাম রাজনকে নিয়ে।

যাওযার পর সাংমা আমাকে বলল,

” ম্যাডাম আমাদের পার্লার তো একটু একটু করে এগোচ্ছে। আপনি মাঝে মাঝে আসতে পারেন না বাবুর জন্য। আমি প্রায়ই হিমশিম খেয়ে যাই। কাস্টমার অপেক্ষা করে একজন দেখে চলে যায় কাজ না করিয়েই। এতে পার্লারের রেপুটেশন খারাপ হয়ে যাবে।”

” তো কি করতে বলছ সাংমা?”

” বলছিলাম কি,
আরেকজন বিউটিশিয়ান হলে একদম ঠিক হয় এখন। তখন আপনি না আসলেও চলবে।”

” কোথায় পাবো বিশ্বস্ত মেয়ে?”

” আপনি দায়িত্ব দিলে আমি খুঁজে বের করতে পারব ম্যাডাম।”

উমমম.. বলে একটু সময় ভাবলাম। দেখলাম সাংমার বলাটা অমূলক নয়। সামনে বিয়ে হলেও পার্লারে রোজ সময় দেয়া যাবে না। আর বেতন আপাতত জমা টাকা থেকেই চালিয়ে নিবো। ব্যবসা দাঁড় করাতে হলে শুরুতে ঢালতে হয় পকেট থেকে। কথায় আছে, টাকায় টাকা আনে। টাকা না খরচ করতে পারলে টাকা কখনো ধরা দেয়না হাতের মুঠোয়। এমন ভাবনা শেষে মিনিট পাঁচেকের ব্যবধানেই বললাম তাকে,

” ঠিকাছে। তুমি খুঁজে একটা মেয়েকে জয়েন দিয়ে দাও। সমস্যা নেই।”

কাজের ফাঁকে ফাঁকেই বাবা,মাকে কল দিচ্ছি রাবুর কোন খোঁজ পেল কিনা। জবাব আসে, নাহ। দুঃশ্চিন্তা গাঢ় হয় তখন মনের ভিতর। মাহমুদ ভাইকে একবার কল দিলাম। উনি বলল,আর যেনো কল না দিই উনাকে। উনি খুব পেরেশানিতে আছে।

ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরি। বাবাও দোকান থেকে চলে এসেছে। মায়ের চুপসানো মুখে তাকানো যায়না। নয়নের মলিন মুখের অবস্থাও খড়কুটোর মতো হয়ে আছে। মা অনুযোগ করে বলল আমাকে,

” তোর বাবা থানায় গিয়েছে। কিন্তু তারা কোন সন্ধান বের করতে পারেনি এখনো। মাহমুদ কে ফোন দিলে কেটে দেয়। আজ দুইদিন একটা বিয়ের উপযুক্ত মেয়ে কই আছে একাকী। আল্লাহ মালুম। বুকটা আমার খানখান হয়ে যাচ্ছে। ”

আমাকে বলা মাহমুদ ভাইয়ের কথাটা বাবা,মাকে বললাম।

নিশুতি রাত। প্রকৃতির গায়ে ঢলে পড়লো পল্লীর গা ছমছমে নির্জনতা । বিদুৎ চলে গেলো। ঘরে ঘরে দ্বীপ ও লন্ঠন জ্বলে উঠলো। চারপাশ জুড়ে ভুতুড়ে পরিবেশ। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে যাচ্ছি আমরা। আমাদের সবার হৃৎপিণ্ডের প্রতি ভাঁজে ভাঁজে যন্ত্রণার বুদবুদেরা ফেনা তুলছে থেকে থেকে।

ঠিক এমনক্ষণে ঘরের দরজায় অচেনা কিছু ভারি ভারি পায়ের আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমরা হুড়মুড়িয়ে দরজা খুলে দাঁড়ালাম সবাই। দেখলাম মাহমুদ ভাই, চারজন পুলিশ।এবং তাদের পাশে জড়োসড়ো হয়ে আছে রাবু। রাবু এসে মায়ের বুকে লুটিয়ে পড়ল। রাবুকে নিয়ে ব্যস্ত মা, বাবা,নয়ন। পুলিশরা এদিক সেদিক তাকাচ্ছে।

প্লিজ 👉 #রেহানা_পুতুল পেজে 👉 লাইক ও ফলো দিয়ে বাঁচার আনন্দটুকু দিবেন।🙏💚

এই সুযোগে মাহমুদ ভাই আমার পাশে এসে নিরবে দাঁড়ালো। আবছা অন্ধকারে চোখ টিপ মেরে আস্তে করে বলল,

“বিয়ের ডেট কবে ফেলব পানকৌড়ি? আর কতকাল বিরহে পুড়ে পুড়ে ছাঁই করবা?”

” আপনি এত অসভ্য,নিলজ্জ্ব কেনো?”

মা পাশ থেকে বিস্মিত ও ভয়ার্ত চোখে উঠলো,

” এই পুলিশ কেন? মাহমুদ কই তুই বাবা?”

” চাচী এখন একটা নাটক হবে আমাদের বাড়িতে। সেই নাটকটি জমাতে উনাদের ভূমিকা শতভাগ। সবাই আসুন বাইরে।”

আমার কাছ থেকে ছিটকে সরে গিয়ে মাকে বলল মাহমুদ ভাই।

চলবে.. ১৪

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে