উজানের ঢেউ পর্ব-১২

0
691

#উজানের_ঢেউ ( ১২)
কলমে✍️ #রেহানা_পুতুল
ফোন রিসিভ হলো না। আমি হতাশ ও বিরক্ত হলাম বাবার উপরে। এভাবে একা একজন মেয়েমানুষ কতক্ষণ অপেক্ষা করতে পারে। উঠে দাঁড়ালাম। ব্যাগ হাতে নিলাম। চলে যাবার উদ্যত নিতেই আমার সামনে ধুমকেতুর মতো উপস্থিত হয়ে গেলো বাবার সেই কাঙ্ক্ষিত পাত্র।

আমি ভয়ানকভাবে হোঁচট খেলাম গোপনে। সপ্তাচার্য দেখার মতো বিষ্ফোরিত নয়নে তারদিকে চেয়ে রইলাম। বড় কালো সানগ্লাস দিয়ে পুরো চোখদুটো ও নাকের অধের্ক ঢাকা। তাই তাকে আধো চেনা আধো অচেনা লাগছে আমার কাছে। এ যেনো সন্ধ্যার আলো আঁধারি খেলা।

সে দাঁড়িয়েই আছে আমার মুখ বরাবর টেবিলের সামনে। তার হাত দুটি পিছনে। আমিও দাঁড়িয়ে রইলাম। পাশের টেবিলে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম। এই ছেলেটাকেই ত পাশের টেবিলে দেখলাম। কিন্তু সেখানে অন্য অপরিচিত দুজন লোক বসা। আমি কিছুই বললাম না তাকে।

চেয়ার সরিয়ে পা বাড়াতেই সে তার দুহাত পিছন থেকে সামনে নিয়ে এলো। আমার দিকে টকটকে রক্তিম গোলাপ গুচ্ছটি বাড়িয়ে ধরলো। আমি হাত বাড়িয়ে নিলাম না। বরং অপরিচিত ও বিরক্তিকর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম তারদিকে। সে এবার চোখ থেকে সানগ্লাস সরিয়ে নিলো। স্থির দৃষ্টিতে অবিকল চেয়ে রইলো আমার মুখপানে।

আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম তাকে দেখেই। চেয়ার সরিয়ে পা বাড়ালাম চলে যাওয়ার জন্য। সে মুরগী ধরা চোরের মতো খপ করে আমার এক হাত ধরে ফেলল। দুষ্টমিষ্ট চোখে ইশারা দিলো বসার জন্য। মুখে কিছু বলছে না। আমি দপ করে চেয়ারে বসে পড়লাম। সেও মুখোমুখি বিপরীত চেয়ারে বসল এবার। গোলাপগুলো এগিয়ে ধরলো আমার দিকে। আমি নিলাম না। গোপনে ক্রোধে ফুঁসে উঠছি সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের ন্যায়। সব মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। বাবা কি গেম খেলল আমার সাথে? আসার কথা কে। আর এলো কে।

সে টেবিলের দিকে একটু ঝুঁকে বসল। যত্ন করে আমার দুহাত টেনে নিলো। গোলাপ গুচ্ছটি জোর করে আমার হাতের মুঠোয় পুরে দিলো।
ভরাট অথচ কোমল কন্ঠে বলল,

” নিরপরাধ ফুলের অপরাধ কি পানকৌড়ি? চেনা মানুষ থেকে ফুল নেয়া নিষেধ নাকি? ”

আমি তাতানো সুরে বললাম,

” এসব কি হচ্ছে মাহমুদ ভাই? আপনি এমন র‍্যাব সেজে এখানে কেন?”

” কাউকে দ্বিধায় ফেলার জন্য। যতটুকু পসিবল অচেনা গেটাপ নিলাম। দেখিস না আজ চুল ও উল্টো করে আঁচড়ানো। তোর পছন্দ হয়নি বুঝি ? ”

” উফফস ! মাহমুদ ভাই। কৌতুক ছাড়েন। পাত্র কই? আপনি কেন এলেন?”

” এই পাত্রকে তোমার পছন্দ হচ্ছে না পানকৌড়ি? সেই পাত্র চরের জমিনে ধান কাটতে গিয়েছে।”

” নাহ। একদম হচ্ছে না। আপনার মধু মধু কথা ও আবেগ আমার কাছে টক টক লাগছে খুউব।”

” আমার তাতে কিছুই যায় আসে না। আমার হাত থেকে ফুল উপহার নিতে চাইলি না কেন? অন্য কেউ দিলে তো ঠিকই নিতি।”

” এতই যখন বুঝেন। তখন কেন এলেন আমার সাথে দেখা করতে এত ছল চাতুরী করে? ”

” আমি কারো সাথে দেখা করতে আসিনি। কাউকে দেখতে আসছি।এবং সারপ্রাইজড় দিতে আসছি। ”

” হাহ!আমার মাঝে দেখার কি আছে? অদ্ভুত! ”

” হ্যাঁ। অদ্ভুত! কিম্ভুত! লাল সাদা যত ভূত আছে এই বাংলার গাছে গাছে। সব ভূত। কি আছে আর কতটা আছে,তা কেবল এই মন জানে। এই হৃদয় জানে। আর কেউ জানতে হবেনা। নো নিড।”

আচম্বিতে এমন সিচুয়েশন আমি হজম করতে পারছি না। আবারো উঠে যেতে লাগলাম। মাহমুদ ভাই আস্তে করে ধমকে উঠলেন। বললেন,

” এখানে কোন সিনক্রিয়েট করবি না বলছি। বাইরে গিয়ে কিংবা বাড়ি গিয়ে যা ইচ্ছে করিস আমার সাথে। কি খাবি চুজ কর।”

ওয়েটার শুরুতেই মেন্যু লিষ্ট দিয়ে গেলো। বললাম,

” বিষ খাবো। দিতে পারবেন বিষ?”

” তুই চাইলে আমি বিষ কেন,সবই এনে দিতে পারবো। ”

পরে তিনি তার পছন্দমতো মেন্যু অর্ডার করলেন। বললাম,

” আমাকে ঘটনা ক্লিয়ার করেন। নয়তো খাবনা।”

” খেয়ে নে আগে । পরে ডিটেইলস বলছি।”

” আপনি এত পসেসিভ কেন আমার প্রতি?”

কপাল ভাঁজ করে বললাম মাহমুদ ভাইকে।

” তুই আমার আজন্ম অধিকার। তাই। তোর সংসার টেকেনি আমি পাবো বলেই। বিধাতা চায়নি এক মহা প্রেমিকের বিশুদ্ধ লাভ বিফলে যাক এভাবে। তাই সময় এখন আমার অনুকূলে চলে এসেছে।”

লাচ্ছি ও শর্মা খেয়ে আমি বাইরে চলে এলাম। উদ্দেশ্য পার্লারে যাবো। রিকশা খুঁজছি। মাহমুদ ভাই পিছন দিয়ে এসে পাশে দাঁড়ালেন। বললেন,

” বিল দিতে গেলাম। অমনি ফাঁকি দিয়ে না বলে বেরিয়ে গেলি? তুই আসলেই একটা পানকৌড়ি। চল তোর পার্লার দেখবো। ভিতরে যাওয়া যাবে একটু? দেখব কেমন কি করেছিস। ”

উনি রিকশা ডেকে উঠে বসলেন। আমি উঠতে চাচ্ছিনা। দাঁড়িয়ে আছি। মাহমুদ ভাই কৌশল করে আমাকে ডাকলেন।

” এই রত্না উঠো না।”

” মামি উঠেন না। রইদের মইধ্যে মামা বইসা আছে।”
বলল রিকশাওয়ালা।

আমি রিকশায় উঠে বসলাম। চোখ কটমটিয়ে চাইলাম মাহমুদ ভাইয়ের দিকে। চোখের পলক না ফেলতেই মাহমুদ ভাই চোখ টিপ মারলেন আলতো হেসে। নিরস ভঙ্গিতে বললাম,

” বলেন ত মূল কাহিনি। কিভাবে কি হলো? আমার ভীষণ অস্বস্তি ও অসহ্য লাগছে।”

” কাকে? আমাকে? না পুরো পরিস্থিতিটাকে?”

” সবকিছুকেই।”

” তারমানে এই ভিতরে আমিও আছি।”

” যা বুঝেন আপনি। এবার বলেন।”

” শোন,বাড়িতে গিয়ে এটা কাকা ও চাচীর থেকে শুনে নিস। ”

” আপনি বললে কি সমস্যা।”

” আমি তোকে দেখার পর সব ভুলে বসে আছি। ”

রিকশা থেকে নেমে উনাকে নিয়ে পার্লারে ঢুকলাম। উনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব দেখলেন উৎফুল্ল চিত্তে। বললেন,

” আমি স্যাটিসফাইড তোর এমন উদ্যমতায়। সাপোর্ট দিব সারাজীবন। ”

মাহমুদ ভাই খানিক বসল পার্লারে। এক গ্লাস পানি খেলো আমার হাতে।

আমি বললাম,

” মাহমুদ ভাই। আমি আজ পার্লারে থাকব না। বাড়ি চলে যাবো। রাজন বাড়িতে রয়েছে। আর আমার খারাপ লাগছে।”

এই বলে আমি বেরিয়ে এলাম পার্লার থেকে। সাংমা রয়েছে ভিতরে। উনিও আমার পিছন দিয়ে উঠে এলেন।
বললেন,

” আয় একসঙ্গেই যাই। তোর পার্লারের ‘ অঙ্গসাজ’ নামটা দেখে আমার একটা কথা বারবার মনে হচ্ছে।”

আমি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসু চোখে চাইলাম মাহমুদ ভাইয়ের দিকে। তিনি শিহরিত চোখে বললেন,

” গোপন কিছু থাকনা গোপনে
ক্ষণ হলে শুধাব তোর প্রাণে।”

আমি সংকোচবোধ করলাম। উনি রিকশা ডেকে নিলে উঠে বসলাম দুজনে। উনি আমার একহাত পেঁচিয়ে ধরলেন। বললেন,

” বিয়ের ডেট কবে ফেললে তোর সুবিধা হবে বল?”

” কিসের বিয়ে মাহমুদ ভাই? আমার বিয়ের দরকার নেই। কোন পুরুষকেই আমার জীবনে জড়াতে চাই না।”

উনি অধিকারসুলভ কন্ঠে বললেন,

” তুমি কি বলবা কবে হলে তোমার ভালো হয়? নাকি আমার ইচ্ছেমতো ডেট ফেলব মা,কাকা,চাচীর সাথে আলাপ করে?”

” আমি স্বৈরাচারী কারো বউ হবনা। যে কেবল অধিকার খাটায়। অন্যের চাওয়া পাওয়ার কথা ভাবে না। মূল্যায়ন করে না।”

এরপর পুরো পথ মাহমুদ ভাই আর কোন কথা বলেনি আমার সাথে। চুপচাপ ছিলো বিরহে পোড়া ক্লান্ত ডাহুকের মতো।

উনি বাড়ির কাছাকাছি পথেই নেমে গেলো রিকশা ভাড়া মিটিয়ে। আমাকে বলল,

” তুই চলে যা। আমিসহ কেউ দেখলে কথা উঠবে এখন।”

” আপনি কই যাবেন? ”

” আমি বাজারে যাবো। ঘরের জন্য কিছু ফলমূল কিনবো। মার মেডিসিন নিতে হবে।”

আমি ঘরে গেলাম। রাজন কে বাবা আমার, বলে কোলে তুলে নিলাম। তারপর হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেস হলাম। জামাকাপড় চেঞ্জ করলাম। রেস্ট নিলাম কিছুক্ষণ। দেখলাম ঘুরেফিরে মা, রাবু,নয়ন আমার সামনে আসছে কিছু শোনার অপেক্ষায়।

আমি মেঘমুখ করে থাকাতে কিছু জিজ্ঞেস করছে না তারা আমাকে। আমিও নিরব আছি কিছু না বলে।

সন্ধ্যায় বাবা আসলে জিজ্ঞেস করলাম,

” বাবা কই তোমার পছন্দের পাত্রতো এল না? ”

” কেন মাহমুদ ঢাকা থেকে আসেনি মা?”

” হুম আসছে। কাহিনী টা কি বাবা?”

” যেই ছেলে তোর বিয়ের জন্য প্রস্তাব দিয়েছে। তা সবই ঠিক ছিলো। পরে আমরা তাকে মানা করে দিয়েছি।”

” কেন বাবা?”

” কারণ তার পর মাহমুদের মা এলো আমাদের কাছে প্রস্তাব নিয়ে। এবং মাহমুদ আমাকে ফোন দিয়ে বলল, সে তোর দায়িত্ব নিতে চায় রাজনসহ। সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতে বলল তারা। তাদের মা ছেলের কথা হিসেবে আমরা বুঝে নিলাম, রাজন আমাদের চোখের সামনেই থাকবে। কেউ তাকে ও তোকে অবহেলা ও অনাদর করার সুযোগটুকু পাবে না। তারাতো রাজন কে এমনিতেই অনেক আদর করে।

পরে মাহমুদ বলল সেই ছেলে সেজে তোর সাথে দেখা করতে আসবে চমকে দেওয়ার জন্য। আমাদের বারবার অনুরোধ করছে যেনো তোকে না বলি। আর যেই নাম্বারে কথা বলছিস। সেটা মাহমুদ নতুন কিনেছে। যা আগে তুই জানতি না। শার্টের কালার ইচ্ছে করেই মিথ্যে বলছে তোকে,কনফিউজড করার জন্য। ও তোকে জানায়নি। কিন্তু সব আমাদের সাথে শেয়ার করেছে মা। আমার ভাতিজা টা অনেক ভালো রে মা।”

রাবু ও নয়ন হেসে কুটিকুটি হচ্ছে পাশে। মা ও হাসছে। আমি বাবাকে আরো বললাম,

” আমার অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন মনে হয়নি তোমাদের কারো কাছে?”

পাশ থেকে রাবু ও মা বলল,

” আমরা এটা মাহমুদ কে বলেছি ভালো করেই। সে বলল,তুই নাকি লজ্জায় প্রকাশ করিস না। কিন্তু তুই ও তাকে চাস। পছন্দ করিস।”

” মাহমুদ ভাই এমন মিথ্যা বানোয়াট কিছু বলতে পারলো? আমি কাউকেই বিয়ে করব না। কাউকেই না।”

ক্রোধান্বিত হয়ে রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলাম। রাতে ভাত খেলাম না মাহমুদ ভাইয়ের উপর অভিমান করে।

তার পরেরদিন দুপুরে বাড়ির দুজন মহিলা এলো আমাদের ঘরে । টনটনে গলায় মাকে বলল,

” ছিহ! রত্নার মা এইসব কি শুনতাছি?”

” কি হইছে ভাবি?”

বিস্মিত স্বরে জিজ্ঞেস করলো মা।

” কি হইতে আর বাকি? বাড়ির নাম কাম সব ডুবলো এবার। তোমার বড় মাইয়ার নাকি মাহমুদের লগে বিয়ার আগ থেইকাই প্রেম চলতাছে। গতকাইল তো তারে মাহমুদের লগে রিকশায় ঘুরাঘুরি করতে কেউ কেউ দেখলই। মাহমুদের কাছে বিয়া বসনের লাইগাই নাকি সে নিজের সংসার ভাঙ্গনের ব্যবস্থা করছে? কি ছিনালগিরি শুরু হইলো দুনিয়াতে। আল্লাহ! রহম করো।”

শুনে মা তৎক্ষনাৎ ক্ষিপ্র গতিতে গর্জন করে উঠলো তাদের উদ্দেশ্যে। আমি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম। আর যাইহোক। মাহমুদ ভাইকে বিয়ে করা যাবে না কিছুতেই। নয়তো মানুষের ধারণা ও বাস্তব মিশে এক হয়ে যাবে জল ও নুনের মতো। মানুষ চারদিকে রিউমার ছড়িয়ে দিবে। একলাই রবো আজীবন।

চলবে.. ১২

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে