#উজানের_ঢেউ ( ৩)
#কলমে ✍️ #রেহানা_পুতুল
আম্মা ফোন নিয়ে তাদের কাছাকাছি গেলো। তখন আশরাফুল ও শিরিনের উচ্ছ্বল হাসি শোনা গেলো। আমি বিষম খেলাম। কই আমার সাথে তো এমন করে সে প্রানবন্ত হাসি দিয়ে কথা বলেনি কখনো। বিশেষ করে এবার বাড়ি আসার পর।
ঠিক ওই মুহূর্তে তাদের দুজনের হাসিকে আমার কাছে সীসার মতো ঠেকলো। নিমিষেই মনে হলো কোন চেনারূপী অচেনা পাষণ্ড আমার কর্ণকুহরে ফুটন্ত গরম সীসা ঢেলে দিচ্ছে।
” শিরিন নে। আশুর বউ তোর লগে কথা কইবো। ”
শিরিন ফোন ধরেই,
” কি ভাবি, আশু ভাই দেশে আসার পর আমারে ভুলেই গেলা? নিখোঁজ তুমি। ”
মধুর হেসে বলল শিরিন। আশরাফুলকে তার মা ও নিকটজনেরা আশু বলেই ডাকে।
গ্রামে প্রচলিত কথা ,স্বামীর বাড়ির কুকুর বিড়ালকেও নাকি সম্মান করতে হয়। আপনি করে সম্বোধন করতে হয়। তাই শিরিন বয়সে আমার ছোট হলেও আপনি করেই বলি। বিয়ের পর এই খালাতো ননদটাকে অনেক আপন করে পেয়েছি। আমার শাশুড়ী ও বুলি খালা, এই দুইবোনের ঘনিষ্ঠতা অনেক। দুই বাড়ির যাতায়াতও অধিক। বলা যায় অন্তরে অন্তরে মাখামাখি। বুলি খালা আসতে প্রায়ই শিরিনকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতো। কারণ শিরিন উনার সর্বকনিষ্ঠ আদরের সন্তান। যুবতী মেয়েকে একা নির্জন বাড়িতে রেখে আসা সমীচীন নয়। অপরদিকে আমার শ্বাশুড়িও বলতো নিয়ে আসার জন্য। এভাবেই শিরিনের সাথে আমারও সখ্যতা ঘটে।এবং তা আজকের এই সময় পর্যন্ত বহমান থাকে বহতা নদীর স্রোতের মতই।
খুব চতুর ও বুদ্ধিমতী মেয়ে শিরিন। কিন্তু চালচলনে যথেষ্ট শালীন ও মার্জিত। রূপেও আগুন সুন্দরী আমার চোখে। শিরিন কথাচ্ছলে কখনো সখনো তার গোপন প্রণয়ের গল্প শুনাতো আমায়।
আমি বিবশ হয়ে শুনতাম শিরিন ও সেই অজানা,অদেখা যুবকের শিহরণ জাগানো প্রণয়কাব্য। তখন নিজেই দূর বনের উদাস পাখি হতে যেতাম। তার আবেগ অনুভূতিকে প্রশ্রয় ও আশ্রয় দিয়ে বলতাম,
” যে আপনাকে এত ভালোবাসে। সে যেনো এ জনমে একবার হলেও পায় আপনাকে।”
অবশ্য শিরিন তখন কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতনা। কেবল অবুঝের ন্যায় চুপ হয়ে থাকতো।
মুঠোফোনের এপ্রান্ত থেকে নরম হেসে শিরিনকে বললাম
” ভুলার সুযোগ কই শিরিন আপা? প্রিয়জনদের ভোলার উপায় তো নেই। আপনার আশু ভাই আসার পর কাজের ব্যস্ততা বেড়ে গেলো। এইই।”
” হ্যাঁ। বুঝি বুঝি। সব বুঝি গো সখী। ”
এভাবে সামান্যক্ষণ কথা বলে বিদায় নিলাম। পরিস্থিতি অনুকূলে নয় বলে মূল প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেলাম। শিরিনকেও বুঝতে দিলাম না কথা বলতে চাওয়ার কারণটুকু।
মাস খানেক পর টের পেলাম নতুন কিছু। আমার পরিবর্তন। মায়ের রুমের স্টিলের আলমারির লম্বা আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। যুগের বিবর্তনের মতো ধীরে ধীরে আমার দৈহিক সৌন্দর্য ফিরে এলো। চেহারাও ঝলমলে হয়ে উঠলো ভোরের টলটলে কুয়াশার মতো। আমড়ার খোসার অপার কল্যাণে কৃষ্ণকায় কেশগুলো বেশ সিল্কি ও ঝরঝরে হলো। মুঠিভরে আলগোছে সেগুলোকে ঘাড়ের একপাশ করে বুকের উপর নিয়ে এলাম। রেশমি সুতোর ন্যায় মুগ্ধ চোখে কেশগুলো উলটে পালটে দেখলাম। পা হতে মাথা অবধি সুচারু চাহনিতে চাইলাম। নাহ। আশরাফুলের ভাষায় এখন আর আমাকে ভাঙ্গাচোরা নড়বড়ে বেড়ার ঘর মনে হয়না। এখন তো দেখি রত্নাকে দামী প্রাসাদ মনে হচ্ছে। কিংবা রাজকীয় সাজে সজ্জিত কোনো অট্রালিকা। তবে এর পুরো কৃত্বিত্ব আমার মা জননীর।
মা রোজ ডিম,দুধ,মাছ,ফলমূল থেকে শুরু করে খাদ্যতালিকায় সুদৃষ্টি রেখেছে বলেই এমনতরো সম্ভব হয়েছে। এসবই বাজারের কেনা নয়। আমাদের নিজেদেরই। টাটকা ও বিশুদ্ধ শতভাগ। নয়তো আমার শারীরিক গঠন হতো বস্তির জীর্ণকুটিরের ন্যায়। সত্যি, একজন মা হলো সংসার ও সন্তানদের প্রাণ। আলহামদুলিল্লাহ। নিয়ম করে সযতনে টানা একমাসের পরিচর্যায় আমি এখন আগের সেই টগবগে লাস্যময়ী রত্না। আমার পরিশ্রম সার্থক। বাকি বিষয় সময় সাপেক্ষ। ভেবে চিন্তে প্ল্যান করে এগোতে হবে। এবার আর আশরাফুল মুখ ফেরাতে পারবে না নিশ্চয়ই। তার ভালোবাসায় না হয় ভুলেই যাবো সেদিনের বৃহৎ অপমানটকু। স্বামীর অফুরন্ত ভালোবাসা থাকলে সব মানিয়ে নেয়া যায়। মেনে নেওয়াও সম্ভব।
আয়না থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিতেই চোখ গেলো জানালার বাইরে। মায়ের রুমের জানালা বরাবর চাচীদের ঘরের এক রুমের জানালা। বলা যায় দুই ঘরের দুই রুমের দুই জানালা মুখোমুখি। যেনো একে অপরকে পাহারা দিচ্ছে। একি! এক জোড়া পুরুষ চোখ আমার দিকে মুগ্ধতা নিয়ে অবিকল চেয়ে আছে।
আমি তব্দা খেয়ে গেলাম। হতচকিত হয়ে তার কাছে এগিয়ে গেলাম। অর্থাৎ আমাদের জানালার ধারে গিয়ে দুহাত দিয়ে গ্রীল ধরে দাঁড়ালাম।
#রেহানা_পুতুল পেইজে প্লিজ লাইক ও ফলো দিয়ে আমাকে প্রেরণা দিবেন লেখা চলমান রাখতে। আপনারা খালি গল্প পড়ে চলে যান। দুঃখ। 🥲
চিরচেনা চোখদুটো নতুন করে কি দেখছে আমার মাঝে। এটা আমার বোধগম্য হলোনা। আমিও আংশিক বিরক্তি নিয়ে তারপানে ঠায় চেয়ে রইলাম। আমার জড়তাহীন সাহসী দৃষ্টি দেখে এবার সে মেলানো ঠোঁট মেলে ধরলো। রহস্যময় সুরে বলল,
” নয়ন আমার সার্থক আজি এ দিবসে।
ভালো হতো কেউ এসে যদি বসতো খানিক পাশে।”
” বাড়িতে কবে এলেন মাহমুদ ভাই?”
” কাল। আগের মতই তুই আমার নজর বন্দী হয়ে গেলি। তুই যেমন তোকে নতুন করে আবিষ্কার করেছিস এতক্ষণ ধরে। আমিও তেমনি তোকে দেখে চমকিত! শিহরিত! পুলকিত!”
ঘোর লাগা কন্ঠে বলল মাহমুদ ভাই।
” এইই মাহমুদ ভাই, আমি কি চিড়িয়াখানার কোন বিরল প্রাণী? এভাবে ড্যাবড্যাব করে দেখছেন বেকুবের মতো?”
“ঠিক ধরেছিস। তোকে অস্ট্রেলিয়ার জংগল থেকে ধরে আনা হয়েছে। ফাজিল রয়ে গেলি আগের মতোই। ডানপিটেও কম ছিলিনা। কেবল এই মানুষটাকেই বুঝলিনা। ”
” বুঝাবুঝির নেই কাজ। আমি ভালো আছি আমার স্থানে।”
” নেই তো কাজ। তো খই ভাজ। হ্যাঁ কাল বাড়িতে এসেই তোর ভালো থাকার গল্প শুনলাম পারুল ভাবির কাছে। খুউব সুখেই আছিস।”
কন্ঠে অভিমান অনুযোগ মিশিয়ে বলল মাহমুদ ভাই।
অমন বাক্যখানি শুনে চোখ তুলে চাইবার কোনো জো রইলনা। সপাটে বন্ধ করে দিলাম জানালার দুই কপাট। পারুল ভাবি রেডিও স্টেশন ও বাচাল উপাধি এমনি এমনি পায়নি।বুঝলাম।
বন্ধ জানালার বাহির হতে কানে ভেসে এলো মাহমুদ ভাইয়ের হেঁড়ে গলা।
” বলবো না গো…আর কোনদিন ভালোবাসো মোরেএএ…।”
মাহমুদ ভাই ছোটবেলা থেকেই আমাকে ভালোবাসে। কিন্তু পাত্তা পেতনা। পরে চালাকি করে সরাসরি বাবার কাছে তার মাকে দিয়ে প্রস্তাব দিয়েছে। তার বিশ্বাস ছিলো বিয়ে হলে ভালোবাসাটা হয়ে যাবে। বাবা একশব্দে বিনা দ্বিধায় সেই প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছে। তখন মাহমুদ ভাই পুরোদমে বেকার ছিলো। চলাফেরা ছিলো ছন্নছাড়া বাউণ্ডুলের ন্যায়। পরে সেই ক্ষোভে মাহমুদ ভাই গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছে। শহরে ব্যবসা শুরু করেছে। এখন বড় ব্যবসায়ী। মাহমুদ ভাই আজো বিয়ে করেনি। সেই গল্প বলতে গেলে আরেক ইতিহাস।
” এই আপা তোর জামাই আসলেই খারাপ মানুষরে। তোরে ভুজুংভাজুং বুঝায়া পার করাই ছিলো তার অসৎ অভিলাষ। এতদিন হয়ে গেলো সে তোকে নিতে আসছেনা। বা যেতেও বলছেনা। কি আজব পুরুষ! ভেবে দেখ।”
” দাঁড়া,আরো দু চারদিন দেখি। তারপর নিজেই চলে যাবো। দেখবি তোর বোনের জেল্লা রূপ দেখেই বেচারা কাত হয়ে যাবে এইবার। বিদেশে রাতদিন সাদা চামড়ার মেয়েদের দেখে দেখে অভ্যস্ত। তাই গ্রামে এসে আমার গায়ের রঙকে তার কাছে কৃষ্ণবর্ণা মনে হয়েছে। সহজভাবে নিতে পারেনি।”
” হইছে আপা থাক। আর স্বামীর স্তুতি গাইতে হবেনা। ভালো বুঝেছিস আর ভালো বলেছিস। মনকে প্রবোধ দিচ্ছিস না আমাকে বুঝাচ্ছিস তা তুই বেশ জানিস।”
“এই রাবু চুপ কর মেয়ে। বেশী পাকনামো শিখেছিস আজকাল। তুই দেখি মানুষের মন বিষিয়ে তুলতে ওস্তাদ।এভাবে কেউ বলে নিজের বোনকে?”
মায়ের ঝাড়ি খেয়ে কলেজে পড়া রাবু চুপ হয়ে গেলো। মুখ ভেংচিয়ে উঠানের দিকে পা বাড়ালো।
তার তিনদিন পর সন্ধ্যা মিলিয়ে গেলে বাবা দোকান থেকে বাড়ি এলো। হাতে একটি লম্বা সাইজের পাতলা খাম। মরামুখে আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো সেটা।
” কি এটা বাবা?”
” কি জানি। ডাকযোগে এলো তোর নামে। এই যে তোর পুরো নাম লিখা। জাহানারা আখতার রত্না। লোক নাকি দুপুরেই আমাদের বাড়িতেই এসেছে। তোদের কাউকে না পেয়ে সামনে উত্তর ঘরের খালিদকে পেয়ে তার হাতেই নাকি দিলো।”
আমিও নিলাম সযতনে। ভাবলাম যেহেতু ব্যাংকে আমার একাউন্ট আছে। সেই রিলেটেড কিছু হবে হয়তো।
মা,রাবু,নয়ন ও আমাদের সামনে এলো। মায়ের দৃষ্টি বিভ্রান্ত। সারামুখে ক্লান্তির ছাপ। রাবু টান মেরে নিয়ে খামের মুখ খুলল আস্তে করে। ভালোকরে পড়লো। রাবু বিদুৎ শক খেলো মনে হলো। ভয়ংকর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো আমার দিকে।
” আপা! এটা ডিভোর্স লেটার। উকিল নোটিশ পাঠিয়েছে তোর পেয়ারের স্বামী আশরাফুল!”
চলবে…