#উজানের_ঢেউ ( ২)
কলমে ✍️ #রেহানা_পুতুল
শুনে মা নিদারুণ কন্ঠে বলল,
” একদম বুদ্ধিমানের মতো কাজ করেছিস। কারো সামনে খড়কুটো হয়ে থাকার চেয়ে আড়ালে এসে জীবের মতো থাকা উত্তম।”
আশরাফুলের কিছু নিষ্ঠুর কথা আমার মৌনাকাশে রাশি রাশি মেঘপুঞ্জ হয়ে ভাসতে লাগলো অবাধ আধিপত্য নিয়ে। এর শেষ পরিণতি কি আমি জানিনা।
মায়ের সামনে থেকে সরে গেলাম। রূপচর্চা ও ত্বকের যত্ন, প্রাকৃতিক উপাদান দিয়েই শুরু করলাম। কৃত্রিমতায় আমি আবার স্বল্প বিশ্বাসী। ফেসপ্যাক বানিয়ে সারামুখে ও ঘাড়ে লাগিয়ে নিলাম যত্ন করে। হাতে পায়ে কাঁচা হলুদ,মধু,চালের গুঁড়োর প্যাক লাগিয়ে নিলাম আলতো করে।
সুশ্রী থেকে বিশ্রী হয়ে আসা কেশগুলোতে দিলাম কাঁচা আমড়ার খোসা বাটা ও হাঁসের ডিমের মিশ্রণ দিয়ে তৈরি পেস্ট।
টক আমি ভীষণ পছন্দ করি। তাই নার্সারি থেকে এই আমড়া গাছের চারাটি এনে পাঁচ বছর আগে আমাদের ঘরের একপাশে লাগিয়ে ছিলাম। আজ আমার জীবনে এই আমড়া বৃক্ষটার ঔদার্যতা দেখে নিজেই আপ্লুত। আনত দৃষ্টিতে গাছটার দিকে আরেকবার চাইলাম। সেদিন কত যে মায়ের বকুনি শুনেছি। তার স্পষ্ট কারণও রয়েছে। সেদিকে আর না যাই।
দশ মিনিট অপেক্ষা করে পুকুর ঘাটে চলে গেলাম গোসল করতে। হাঁটু অবধি উদাম পায়ে,হাতে,কোমরে, বুকে, পেটে,পিঠে নতুন একটি ক্যামেলিয়া সাবান ঢলে নিলাম। গা মাজুনিটা ধুন্দলের খোসা দিয়ে তৈরি। তাও আমাদের গাছের ধুন্দলের। রেডিমেড মাজুনি নস্যি এটার কাছে। সাবানের সুবাস আমার ছোটবেলা থেকেই অন্যরকম ভালোলাগে। নতুন সাবানের প্যাকেট সবসময় আমিই খুলি। সাবানের সাথে সাথে প্যাকেটটাও নাকে চেপে ধরি। নিঃশ্বাস ভরে ঘ্রাণ নিই। এ নিয়ে দাদীজান খুউব তামাশা করতো।
মাকে ডেকে বলতো,
“ও রত্নের মা। তোমার রত্নরে বিয়া দিবা সাপুন সওদাঘরের লগে। যেনো হারাদিন সাপুনের খুশবু নাকে লাগায়া রাখতে পারে। ”
পাশ থেকে রাবু নাক কুঁচকে দাদীকে ক্ষেপিয়ে বলতো,
“এই বুড়ি কিচ্ছু ঠিকভাবে বলতে পারেনা। রত্নারে কয় রত্ন। সাবানরে বলে সাপুন।”
আহারে আমার সারল্যমাখা মায়াবী মুখের দাদীজান। আজ বেঁচে থাকলে বিপন্ন আমাকে দেখে কেঁদেকেটে বুক ভাসাতেন।
#রেহানা_পুতুল পেইজে লাইক ও ফলো দিয়ে প্রেরণা দিবেন প্লিজ।
পুকুরের অপরঘাট থেকে আমাকে দেখছে এক চাচি ও ভাবি। চাচী চলে গেলে চাচাতো ভাবি পারুল গলায় আওয়াজ তুলে বলতে শুরু করলো,
” আমার কথা কাজে লাগছে এবার রত্না? কত বললাম, রূপ যৌবন ধরে রাখ স্বামী সোহাগী হতে হলে। গতর খাটুনি দিয়া শ্বশুর বাড়ির সবার নজর কাড়া যায়। কিন্তু এক পুরুষের অন্তর পাওয়া যায়না। সেই হলো স্বামী। কানেই নিতিনা আমার কথা। ফুঁ মেরে উড়িয়ে দিতি শুকনো পাতার মতন। বলতি, আজাইরা বলি আমি। স্বামীর মন পেতে এসবের দরকার হবে কেনো। সে কি প্রেমিক নাকি তোর। রসিয়ে রসিয়ে ভংচং করে তার মন ভুলাতে হবে। বলি কি রত্না, স্বামীর জাত হলো প্রেমিকের চেয়েও ডেঞ্জারাসরে। এইসব পাষাণ হৃদয় তোর জন্য ঠিক ততদিন গলবে। যতদিন তোর রূপের চুল্লীতে আগুন জ্বলবে। বুঝলি। বেশিরভাগ পুরুষজাতি হইলো রূপের বেসাতি করে। অন্তরের নয়। তুই দেখসনা, নানান ছুতোয় বুইড়া খাটাইস বেটারা অল্প বয়েসী নারীকে বউ করে। কেনো করে? তুই নিজেরে জিজ্ঞেস করে দেখ একবার। ”
পাটের দড়ি পাকানোর মতো করে চিবিয়ে চিবিয়ে কথাগুলো বলে থামলো পারুল ভাবি। আমি ঝিম মেরে তেতো ঔষধের ন্যায় ভাবির সবকথা হজম করলাম। করতেই হলো। কারণ ভাবি একদন্ডও ভুল বলেনি।
কিন্তু ভাবি কিভাবে সত্যিটা জানলো বা বুঝলো। সেটা জানার বিশেষ আগ্রহ আমার চিত্তে উদয় হলনা। মন্দ কিছু হাওয়ার বেগে দশকান রটে যায়। কেবল গোপনে বললাম,
তুমি ঠিকই বলছ ভাবি। এদের মতো স্বামী নামক পুরুষদের জন্য সৌন্দর্যের ডালি আর রূপের পসরা সাজিয়ে বসে থাকতে হয় বারবনিতাদের মতো। স্বামী নামক মানুষটির উপর আমার অগাধ বিশ্বাস,শ্রদ্ধা ও ভরসা তলিয়ে গেলো মহাকালের অতলান্তে। আমার ধারণাও পাল্টে গেলো জীবন নিয়ে। তাই শুধু দৈহিক সৌন্দর্যই নয়,তার পাশাপাশি নিজেকেও আত্মনির্ভরশীল করে তুলবো মজবুত করে।
ঝুপঝাপ করে সাঁতরে গোসল সেরে নিলাম। ঘরে এসে দেখি আমার একমাত্র শিশু রাজন খেলছে। শত বিষাদেও রাজনের মুখের সরল হাসি আমাকে এনে দেয় অনাবিল সুখ ও প্রশান্তি। মা তাকে গোসল করিয়ে এখন সঙ্গ দিচ্ছে খেলার সাথী হয়ে। এত প্রাণোচ্ছল দৃশ্য দেখে প্রাণ জুড়িয়ে গেলো। আমার পরিবারের কারো কাছেই আমি উপেক্ষার আভাস পাইনি এখন পর্যন্ত।
আর হোসেনপুর থাকতে অর্থাৎ আশরাফুলদের বাড়ি থাকতে রাজনের সবকিছু আমার একা সামলাতে হতো। বড় জা লায়লা একা হাতে তার ভিন্ন একার সংসার চালায়। চার সন্তানের দেখভাল,সবজি বাগান করা, একপাল রাজহাঁস ও বেশকিছু মুরগী পালা, এক ঝাঁক কবুতর পালা,অবসরে ময়দার চুটকি সেমাই বানানো, সন্ধ্যায় নাস্তা তৈরি, নকশী কাঁথায় রঙিন সুতোর ফোঁড় ও অনান্য গৃহকার্য নিয়েই তার বেলা ফুরোয়। ফুরসত মেলেনা আমার দিকে চেয়ে দেখার।
শ্বশুরের ভিটায় আছি শাশুড়ী, তাদের ছোট ছেলে আশরাফুল,আমি ও রাজন। মোট পাঁচজন। পরিবারের সদস্য সংখ্যা বেশি না হলেও এদের গৃহস্থালি কাজ নেহাৎ কম নয়। দশজনের পরিবারের সাথে তুলনা করা যায়। লায়লা ভাবির সমান কাজ করতে হয় আমার। কিন্তু আমি এত কাজ করে অভ্যস্ত নয়। নিপুণাও নই। তাই শ্বশুর শাশুড়ীর মন যুগিয়ে চলার জন্য কায়িক শ্রম দিয়ে নিজের দিকে ফিরে চাইবার অবকাশটুকু মেলেনা। এটাই বোধ হয় জীবনের বড় একটা ভুল হয়ে গিয়েছে আমার। সিলিং ফ্যানের নিচে দাঁড়িয়ে চুলের পানি ঝেড়ে নিলাম ভালো করে। মা উঠে গেলো কাজের ব্যস্ততায়।
রাজনের দিকে দুহাত প্রসারিত করতেই আমার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়লো । আধো আধো বোলে তার ভাষা তো আমিই বুঝি। অবুঝ শিশুর খলবল করা হাসি, নিষ্পাপ মধুর চাহনি, আহ্লাদ করে চোখ ভেজানো,অভিমান করে জেদ করা, অনর্গল ভাঙ্গা ভাঙ্গা স্বরে ভুলভাল শব্দ বলার মাঝেও যে অবর্ণনীয় শান্তি ও স্বর্গীয় আনন্দ লাভ করা যায়। এই নিগুঢ় সত্য মা না হলে কোনদিন উপলব্ধি করতে পারতাম না। সত্যিই মাতৃত্ব মহান। মাতৃত্ব ত্যাগের। মাতৃত্ব বিসর্জনের।
বাবাসহ দুপুরে খেতে বসলাম। গ্রামে বাড়ির নিকটবর্তী বাজারেই বাবার দোকান। ব্যস্ততার জন্য এর আগে বাবা আমার সাথে কথা বলতে পারেনি। তখন বাবা আশ্বাস দিয়ে কিছুকথা বললো আমাকে।
যার সারাংশ হলো,
স্বার্থ আর বিভেদের পৃথিবীতে সবাই ছেড়ে গেলেও সন্তানকে কখনোই বাবা মা ফেলে দেয়না। সেই ছোট্টবেলার মতই আগলে রাখে। সত্যি বলতে তখন আমি অনেক বেশি আবেগাপ্লুত হয়ে গিয়েছি। আমার আঁখিকোণ ছলছল করে উঠলো নির্ভরতার আশ্রয়কেন্দ্রটি পেয়ে। বাবার সাথে কথায় তাল মেলালো মা,রাবু,ছোটভাই নয়ন।
আমি আসার পর হতে আশরাফুল একবারও ফোন করেনি। আমিও করিনি। আমি কেনো করবো। আমিতো তার কাছে উপেক্ষিত! নিগৃহীত! আমি নারী। এর চেয়ে বড় সত্যি আমি একজন মানুষ। আমারও আত্মমর্যাদা বোধ রয়েছে। ব্যক্তিত্ব রয়েছে। সে নিজের জন্ম দেওয়া শিশুপুত্রেরও খবর নেয়নি। মনে পড়লো,
‘ আউট অব সাইট আউট অব মাইন্ড ‘ কথাটি। কিন্তু আমি সবসময় এটা মানতাম না। মনে হতো, চোখের আড়াল হলেতো মনের আরো কাছাকাছি চলে আসে প্রিয়জন। হায়! দেখি বচনটাই সত্যি। আমিই মিথ্যা।
সবার কুশলাদি জানার জন্য আমিই নিজ থেকে ফোন দিলাম শাশুড়ীর ফোনে। তিনি তো মূল বিষয় জানেন না। তাই স্বভাব সুলভ কন্ঠেই কথা বলছেন। পাশ থেকে কয়েকজনের হাসিঠাট্টা শুনতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
“আম্মা বাড়িতে মেহমান এলো মনে হয়। আপনার ছেলেরও কথা শোনা যাচ্ছে।”
” হ। বুলি আসছে। তোমার ছোট খালা শাশুড়ী। তার পালা হাঁস ভুনা কইরা আর রুটি বানায়া আনছে সবার জন্য। আরো এটা সেটা আনলো।”
” খালাম্মা একা আসছে আম্মা ?”
” নাহ। শিরিনও আসছে। তার নাকি কলেজ বন্ধ এখন।”
তখন মনে হলো শিরিন আপাকে ফোন দিয়ে বিষয়টা শেয়ার করবো। দেখি কি পরামর্শ দেয় তার খালাতো ভাইয়ের হৃদয় হরণ করার জন্যে।
বললাম,
” আম্মা শিরিন আপার কাছে মোবাইলটা দেন। একটু কথা বলি।”
” খাড়াও দিতাছি। তোমাদের ননদ ভাবির তো আবার গলায় গলায় ভাব। শিরিন আশুর সাথে কথা বলতাছে। ”
আম্মা ফোন নিয়ে তাদের কাছাকাছি গেলো। তখন আশরাফুল ও শিরিনের উচ্ছ্বল হাসি শোনা গেলো। আমি বিষম খেলাম। কই আমার সাথে তো এমন করে ও প্রানবন্ত হাসি দিয়ে কথা বলেনি কখনো। বিশেষ করে এবার বাড়ি আসার পর।
চলবে…