উইল ইউ ম্যারি মি? পর্ব-১০ এবং শেষ পর্ব

0
1998

#উইল ইউ ম্যারি মি?
পর্ব–১০ এবং শেষ পর্ব

বন্ধুদের জোরাজুরি আর তোপের মুখে পড়ে নওশাদের দেওয়া এংগেজমেন্ট রিং আপাত অবস্থায় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিল প্রীতি। কিন্তু পরবর্তীতে নওশাদকে সকলের আড়ালে নিয়ে হাত-জোর করে ক্ষমা চেয়ে রিংটা সে ফিরিয়ে দেয়। নওশাদ হকচকিয়ে প্রশ্ন করল,” তোর কি হয়েছে প্রীতি? আমি কি কোনো ভুল করেছি?”
” তোর কোনো ভুল নেই। ভুলটা আমারই। এতোবছরেও তোকে সত্যি কথা কখনও বলা হয়নি।”
” কিসের সত্যি? এখন বল।”
” আমার জীবনে একটা অতীত আছে।”
নওশাদ হেসে ফেলে বলল,” এইটা কোনো ব্যাপারই না। মাত্র একটা অতীত? তোর যদি হাজার অতীতও থাকে তাও আই ডোন্ট কেয়ার। আমি জানতেও চাই না। আমি শুধু জানি, তোকে আমি ভালোবাসি৷ শুধু তোকে বিয়ে করার স্বপ্ন নিয়ে ফ্রান্সে গিয়েছিলাম। যাতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে তোর সামনে যোগ্য পাত্র হয়ে দাঁড়াতে পারি।”
প্রীতির কথাটা বলতে খুব খারাপ লাগছিল। কিন্তু না বলেও উপায় নেই। প্রীতি দুঃখী গলায় বলল,” আই এম স্যরি নওশাদ। তুই আমাকে ক্ষমা করে দে। কারণ আমি তোকে বিয়ে করতে পারবো না।”
নওশাদের চেহারা অন্ধকার হয়ে গেল। উতলা হয়ে জানতে চাইল,” আমি কি করেছি প্রীতি?”
” বললাম তো তোর কোনো দোষ নেই। সব দোষ আমার। শুধু তোকে না, আমি কাউকেই কোনোদিন বিয়ে করতে পারবো না। আমি সারাজীবন আমার বাবার সাথে থাকবো। আমি ছাড়া বাবার এই পৃথিবীতে কেউ নেই। যদি আমার বিয়ে হয়ে যায় তাহলে বাবা পুরোপুরি নিঃসঙ্গ হয়ে যাবে।”
নওশাদ এই কথার পর আবারও হাসতে লাগল। প্রীতি করুণ চোখে চেয়ে রইল। তার চোখ ছলছল করছে নওশাদের প্রাণবন্ত হাসি দেখে। নওশাদ বলল,” এটা কোনো ব্যাপারই না প্রীতি। তুই স্টাবলিশড মেয়ে। এসব নিয়ে তুই কেন চিন্তা করছিস? শোন, আমি তোকে আমাদের ফিউচার প্ল্যান বলি। আমরা একটা বিশাল বাড়ি কিনবো। ওই বাড়ির দক্ষিণ সাইডে থাকবে তোর বাবা আর উত্তর সাইডে থাকবে আমার বাবা-মা। মাঝখানে আমি আর তুই। ভালো হবে না?”
প্রীতি অধৈর্য্যের মতো চিৎকার করে বলল,” আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি নওশাদ। তোর সাথে বিয়ে হলে আমি কোনোদিনও তোকে ভালোবাসতে পারবো না।”
নওশাদের হাতে জুসের গ্লাস ছিল। কথাটা শোনার পর জুসের গ্লাস হাত ফসকে পড়ে ভেঙে গেল। দু’জনেই বিব্রত। নওশাদ হাসি দেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করল। এই শুনে সে একদমই বিচলিত নয় এমন একটা ভাব করে বলল,” অন্যকাউকে ভালোবাসিস এটা কোনো প্রবলেম না। কিন্তু আমি কি জানতে পারি সে কে?”
প্রীতি আশরাফকে নিয়ে তার জীবনের সমস্ত ঘটনা সাজিয়ে-গুছিয়ে বলে দিল। নওশাদ বলল,” তাহলে তো ওই ছেলের সাথে তোর বিয়ে হওয়ার কোনো স্কোপ নেই। তুই কি সারাজীবন বিয়ে না করেই থাকবি? সবাইকেই সংসারী হতে হয়। একা একা কেউ জীবন কাটাতে পারে না। তোকেও একদিন সবকিছু মেনে নিয়ে নিজের জীবনে কাউকে বেছে নিতেই হবে। এখন আমার কথা হলো তোর যদি অন্যকাউকেই বেছে নিতে হয় তাহলে সেই অন্যকেউটা আমি কেন হতে পারবো না?”
” কারণ তুই খুব ভালো ছেলে নওশাদ। আমি চাই না তোকে কষ্ট দিতে৷ আমি চাই তুই সারাজীবন খুব ভালো থাকবি। আমার চেয়েও হাজার গুণ ভালো মেয়ে বিয়ে করবি। যে তোকে সবসময় ভালো রাখবে। কিন্তু আমাকে বিয়ে করলে তুই সুখী হতে পারবি না। কারণ আমার মনে অন্য একজনের বসবাস। তুই কি চাস তোর স্ত্রী সারাজীবন তোর সঙ্গে থাকুক কিন্তু ভালোবাসুক অন্যকাউকে?”
” প্রীতি তুই যদি আমাকে বিয়ে করিস সেটাই আমার জন্য অনেক বড় ব্যাপার। আমার আর কিছু লাগবে না। ভালোবাসা তো মনের ব্যাপার। সেটা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। অন্তত আমি তোর জীবনের ভালোবাসা না হই, ভালোলাগা হয়ে থাকলাম। একদিন তুই আমাকেও ভালোবেসে ফেলবি। যদি ভাগ্য সহায় হয়। কিন্তু প্লিজ, আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা ভাবিস না। আমি তোকে ছাড়া পারবো না থাকতে।”
” তাহলে পাঁচবছর ফ্রান্সে কি করে থেকেছিস?”
” তোকে বিয়ে করার স্বপ্ন নিয়ে।”
প্রীতি এই কথার পিঠে আর কিছু বলতে পারল না। সেদিন পার্টি থেকে চলে আসার পর বাবার সাথে পুরো বিষয়টা আলোচনা করে প্রীতি। প্রমথ সাহেবও অনুমতি দেন৷ তাঁর একমাত্র মেয়ে এতোদিন পর বিয়ে নিয়ে চিন্তা করছে এই কথা ভেবেই খুশিতে মন ভরে ওঠে। কিন্তু প্রীতির মনে তখনও দ্বিধা। সে নওশাদকে সারাজীবন ঠকিয়ে যেতে চায় না। নওশাদ ক্রমাগত প্রীতিকে বিরক্ত করতে থাকে। প্রীতি যদি তাকে বিয়ে না করে তাহলে নাকি সেও আর কোনোদিন বিয়ে করবে না। কারণ নওশাদ আর কখনোই প্রীতির মতো করে কাউকে ভালোবাসতে পারবে না। অবশেষে বিয়েতে রাজি হয়েছিল প্রীতি। রাজি হওয়ার মুখ্য কারণ ছিল, ভালোবাসার মানুষকে না পাওয়ার দুঃখ সে বোঝে। আশরাফকে সে কোনোদিনও পাবে না। কিন্তু নওশাদের তো প্রীতিকে পাওয়ার সুযোগ আছে। তাই প্রীতি নিজের ভালোবাসা মনে দাবিয়ে নওশাদের ভালোবাসার ফুল সেজেছিল। তাদের বিয়ে ঠিক হলো।

সেদিন ভরা সন্ধ্যা। পার্লার থেকে সেজে-গুজে কমিউনিটি সেন্টারে যাচ্ছে প্রীতি। তার সাথে মাইক্রোতে আরও অনেক মানুষ। প্রমথ সাহেব ক্রমাগত ফোন করছেন। সাথে নওশাদও। প্রীতির কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। মাঝ রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ গাড়ি আটকে দিয়েছে। সিগন্যাল পড়েছে বিরাট বড়। ইতোমধ্যে প্রীতির সাথে থাকা বন্ধুরা গাড়ি থেকে নেমে পড়েছে। আবদ্ধ গাড়িতে বসে বসে সকলে অস্থির। প্রীতি জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে ছিল৷ হঠাৎ লক্ষ্য করল একটা ছেঁড়া নীল পাঞ্জাবী পরা লোককে ঘিরে অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। লোকটি ক্রমাগত কথা বলে যাচ্ছে। মানুষ সেই কথা শুনছে অবাক হয়ে। প্রীতি গাড়ি থেকে নেমে ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করল,” ওইখানে কি হচ্ছে ভাইয়া?”
ড্রাইভার খুব আগ্রহী হয়ে হাসতে হাসতে বললেন,” ভিক্ষুক এসেছে। বিদেশী ভিক্ষুক। বিদেশীদের মতো ইংরেজি বলছে। অবাক কান্ড না?”
প্রীতির ভেতরটা ধ্বক করে উঠল। ভিক্ষুকের চেহারা দেখার জন্য সামনে এগিয়ে গেল। ড্রাইভার পেছন থেকে ডাক দিলেন,” কই যান আপা? যাইয়েন না। একটু পরেই সিগন্যাল ছাড়বো।”
প্রীতি শুনল না। সে অপ্রকৃতস্থের মতো এগিয়ে গেল। আশরাফকে এতোদিন পর সরাসরি দেখে তার বুকে দামামা বাজতে শুরু করল। রাস্তায় প্রায় জমাট বেঁধে খুব উৎসাহ নিয়ে দেখছে ইংরেজি বলা পাগলকে। প্রীতি টলমল দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। কতদিন পর? ঠিক কতদিন পর তাদের এই দেখা? হিসাব মেলাতে কষ্ট হলো না। পাঁচবছর, নয়মাস, আঠারো দিন। আশরাফ তো একদম বদলায়নি এতো বছরেও। শাড়ি-গয়না পরিহিত বিয়ের কন্যাকে দেখে অনেকেই সরে যেতে লাগল। সবাই প্রীতির আগমন দেখে হয়তো ভেবেছে প্রীতি আশরাফের কেউ হয়৷ প্রীতি ধীরে ধীরে আশরাফের একদম সামনে এসে দাঁড়ালো।আশরাফ প্রীতির দিকে একবার ভ্রু কুচকে তাকাল। ভালো মতো উপর-নিচ পর্যবেক্ষণ করল তাকে। তারপর মুখে সারল্যের হাসি ফুটিয়ে বিশুদ্ধ ইংরেজিতে বলে উঠল,” হেই প্রিটি ব্রাইড, উইল ইউ ম্যারি মি?”
প্রীতির চোখ উপচে পানি পড়তে লাগল এবার। ঠোঁটে কামড় দিয়ে কান্না সামলানোর ব্যর্থ চেষ্টা চালাতে চালাতে আশরাফের দুই কাঁধে হাত রাখল। আশরাফ তখনও আসছে। অস্বাভবিকভাবে ঘাড় নাড়ছে। তার আচরণ সাধারণ মানুষের মতো না। এখন সে বদ্ধ উন্মাদ। প্রীতি আশরাফের ডান বাহু ধরে বলল,” চলো যাই।”
আশরাফ হাসি মুখে প্রীতির সাথে পা বাড়ালো। যেতে যেতে প্রশ্ন করল,” কে তুমি? হু আর ইউ?”
প্রীতি বিষণ্ণ দৃষ্টিতে নিচে তাকিয়ে হাঁটছিল। আশরাফ তাকে চিনতে পারছে না! সে কি সব ভুলে গেছে? ফ্লোরাকেও ভুলে গেছে। ইশ, প্রীতিও যদি সব ভুলে যেতে পারতো। ভুলে থাকা মানেই তো ভালো থাকা। এইতো, যেমন আশরাফ ভালো আছে। কারণ সে ভুলতে পেরেছে। প্রীতি ভালো নেই কারণ সে ভুলতে পারেনি। আশরাফের হাত ধরে হাঁটার সময় হঠাৎ প্রীতির ফোন বেজে উঠল। মনে পড়ে গেল পিছুটানের কথা। আজ তার বিয়ে ছিল! সে সবকিছু ফেলে কোথায় যাওয়ার আয়োজন করছে? প্রীতি মোবাইল হাতে নিয়ে দেখল নওশাদের কল। প্রীতি কলটা কেটে দিল। নওশাদ এবার ম্যাসেজ করল,” হারি আপ প্রীতি, তোমাদের আর কতক্ষণ লাগবে? প্লিজ পিক আপ দ্যা কল।”
প্রীতি নিজের ফোন সুইচড অফ করে দিল। আজ সে কারো কথা ভাববে না। শুধু নিজেকে নিয়ে ভাববে। আশরাফের সঙ্গে হাঁটবে। এই হাঁটার উদ্দেশ্য নেই, গন্তব্য নেই, শুধু একরাশ আকাঙ্ক্ষা আছে। প্রীতি হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ বলে উঠল,” এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো তুমি বলো তো…”
আশরাফ ফিকফিক করে হাসছে। ওই সরলময় হাসি দেখে প্রীতি সারাজীবন হেঁটে যেতে পারবে। তার কোনোদিনও ক্লান্তি আসবে না।

সমাপ্ত।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে