#উইল ইউ ম্যারি মি?
পর্ব–৫
আশরাফ যেভাবে সারাক্ষণ ফ্লোরার নাম জপ করতে থাকে আর ফ্লোরাকে নিয়ে মুগ্ধতার ঘোরে ডুবে থাকে তাতে প্রীতি ধরেই নিয়েছিল ফ্লোরা হয়তো পৃথিবীর সেরা সুন্দরী হবে। সেরা না হলেও অন্তত কিছু মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে চেয়ে থাকার মতো আশ্চর্য সুন্দর কেউ হবে। কিন্তু এখন ফ্লোরার ছবিটা দেখে প্রীতি সত্যিই চমকে গেল। কারণ ফ্লোরা এতো আহামরি সুন্দর তো নয়ই বরং কৃষ্ণবর্ণের, কোঁকড়ানো চুলের একটি অতি সাধারণ মেয়ে। এমন একটি সাধারণ মেয়ের জন্যই আশরাফ খুব অসাধারণভাবে দিওয়ানা। ব্যাপারটা ভয়ংকর সুন্দর। মেয়েটি প্রীতির চেয়ে সুন্দরী না। তবুও তার প্রতি প্রীতির খুব ঈর্ষা। কারণ সুন্দরী না হয়েও সে যা পেয়েছে প্রীতি হয়তো সারাজীবন সাধনা করলেও তা পাবে না! আশরাফের দিকে তাকালো প্রীতি। ছেলেটা বিভোর দৃষ্টিতে তার প্রেয়সীর ছবি দেখছে। ঠোঁটে মিশে আছে আলতো হাসি। আশরাফ ঘোর লাগা কণ্ঠে বলল,” দেখেছো আমার ফ্লোরাকে? খুব মিষ্টি মেয়ে তাই না? সামনে থেকে দেখতে আরও মিষ্টি। শী ইজ ওয়ান্ডারফুল। ”
আশরাফ এমনভাবে কথা বলছে যেন কোনো অমৃত সুধা পান করছে। এইভাবে যদি প্রীতির ছবির দিকে আশরাফ তাকিয়ে থাকতো তাহলে প্রীতি নিজেকে ধন্য মনে করতো। ধূর, কি ভাবছে সে এসব? ভালোবাসায় কখনও জবরদস্তি চলে না। ভালোবাসা খুব পবিত্র ও স্নিগ্ধ অনুভূতি। ইচ্ছে করলেই কারো প্রতি ভালোবাসা জন্মানো যায় না। আর কেবল সৌন্দর্য্য দেখে যে ভালোবাসা হয় সেটা তো মোহ। সেই ভালোবাসায় ভেজাল আছে। কিন্তু আশরাফের ভালোবাসায় কোনো ভেজাল নেই। তাই তো পৃথিবীতে এতো অনিন্দ্য সুন্দরী থাকতেও আশরাফের চোখে তার ফ্লোরাই ওয়ান্ডারফুল! প্রীতি হেসে বলল,” ঠিক বলেছেন। ফ্লোরা সত্যিই ওয়ান্ডারফুল। আমার কল্পনার থেকেও অনেক বেশি ওয়ান্ডারফুল।”
আশরাফ আগ্রহ নিয়ে তাকালো। প্রসন্ন হেসে বলল,” সত্যি প্রিটি? তাহলে এই ওয়ান্ডারফুল মেয়েটিকে তুমি হেল্প করবে তো? ওর কষ্ট মুছে দাও প্লিজ। একবার তাকিয়ে দেখো ওর আইস। কি ম্যাজিক্যাল তাই না? এই ম্যাজিকেল চোখে আমি টিয়ার্স কখনও দেখতে চাই না। ”
প্রীতি কি বলবে বুঝতে পারল না। সে তো ফ্লোরার বাবা-মাকে চেনেও না। তারা কেন ডিভোর্স করতে চায় সেটাও প্রীতি জানে না। পারিবারিক ছোট-খাটো ঝামেলা না হয় সে বুদ্ধি করে মিটিয়ে ফেলতে পারে। কিন্তু ডিভোর্সের মতো বড় একটা ব্যাপার সে কি করে সামলাবে?
আশরাফ মোবাইল টিপে কাকে যেন ফোন করছে। ওই পাশ থেকে ফোন রিসিভ হওয়া মাত্রই অস্থির কণ্ঠে একনাগাড়ে কথা বলতে লাগল আশরাফ। তাও ইংরেজিতে। যেভাবে বিদেশীরা ইংরেজি বলে ঠিক সেভাবে। প্রীতি তেমন কিছু বুঝল না। তবে এইটুকু বুঝতে পারল যে আশরাফ ফ্লোরাকেই ফোন করেছে। সে এখন ফ্লোরাকে প্রীতির ব্যাপারে বলছে। প্রীতি যে ফ্লোরার খুব প্রশংসা করেছে এটাও আনন্দ নিয়ে বলছে। কথার বলার ধরণটা কি সুন্দর! প্রতিটি বাক্য যেন ভালোবাসায় মোড়ানো চিরকুট।
প্রীতি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। সে জেরিনের সাথে এখানে এসেছিল আশরাফকে ভালো-মন্দ দু’টো কথা শোনানোর জন্য। জেরিন তাকে সব শিখিয়েও দিয়েছিল। প্রীতি কঠিন মুখ করে বলতে চেয়েছিল,” বিয়ে ভাঙতে চেয়েছেন, ভেঙে দিবো। আপনার সাথে কন্ট্রাক্ট এখানেই শেষ। খবরদার আমাকে আর ডিস্টার্ব করবেন না। ”
কিন্তু এখন মনে হচ্ছে কথাগুলো আশরাফের জন্য মোটেও উপযুক্ত নয়। প্রীতি এতো কঠিন হতে পারবে না। তার ইচ্ছে করছে ফ্লোরার বাবা-মায়ের ডিভোর্সের ঝামেলা সত্যি যদি মিটিয়ে দিতে পারতো! যেকোনো উপায়ে!
মানুষের ভালোবাসা দেখতেও ভালো লাগে। আশরাফ আর ফ্লোরার ভালোবাসা সবসময় সুন্দর থাকুক। প্রীতি মনে মনে প্রার্থনা করে, তার জীবনেও এমন একটি ভালোবাসা আসুক।
আশরাফ ফোন রেখেই বিচলিত হয়ে পড়ল।
” আমাকে এখনি যেতে হবে প্রিটি। তুমি কি একা বাড়ি ফিরতে পারবে?”
” কি হয়েছে?”
” ফ্লোরা খুব বিপদে। এখানে আসার পথে ওর একটা সিরিয়াস প্রবলেম হয়েছে। এজন্যই দেরিটা হচ্ছিল। ফোন না করলে জানতেও পারতাম না।”
” তাহলে আপনার উচিৎ এখনি ওর কাছে যাওয়া। আপনি চলে যান। আমি নিজের মতো বাড়ি ফিরে যেতে পারবো।
” শিউর তুমি?”
” হুম।
” ঠিকাছে তাহলে চলে যেও। ফ্লোরার সাথে না হয় তোমাকে অন্য আরেকদিন দেখা করাবো। সেদিন ওর প্রবলেম তুমি মন দিয়ে শুনবে। আর সবকিছু সোলভ করে দিবে। করবে তো?”
” ঠিকাছে করবো।”
” থ্যাঙ্কিউ প্রিটি গার্ল।”
আশরাফ মুচকি হাসি উপহার দিয়ে দ্রুত কফিশপ থেকে বের হয়ে গেল। প্রীতি একটু থমকালো। কারণ আজকে প্রথমবারের মতো আশরাফ তাকে ভুল করে নয় বরং বুঝে-শুনেই প্রিটি ডেকেছে। আচ্ছা, আশরাফের চোখে কি সে আসলেই প্রিটি?
আশরাফ পুরোপুরি কফিশপ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর প্রীতি বুঝতে পারল সাংঘাতিক একটা ভুল হয়েছে। প্রীতির কাছে কোনো টাকা নেই। সে কিভাবে বাড়ি ফিরবে? ট্যাক্সি ড্রাইভারকে বাড়ির এড্রেস ঠিক করে বলতে হবে। সেটাও প্রীতি পারবে না। জেরিন থাকলে ট্যাক্সি ঠিক করে দিতো। কিন্তু এখন জেরিনও নেই। প্রীতি মোবাইল নিয়ে জেরিনকে ফোন করতে গিয়ে দেখল তার ফোনে ব্যালেন্সও শেষ। কি ঝামেলা! অনলাইনে জেরিনকে পাওয়া গেল না। প্রীতির ভয় করতে লাগল। এই দুশ্চিন্তার মধ্যে একটা বিষয় তার হঠাৎ মনে পড়ল। আশরাফ বলছিল ফ্লোরাকে ফোন না করলে বিপদের কথা জানতেই পারতো না। তাহলে ফ্লোরা বিপদে পড়েও কেন নিজে থেকে আশরাফকে ফোন দেয়নি? প্রীতি এসব ভাবতে ভাবতে আবারও নিজের উপর বিরক্ত হলো। সে এইসময় এসব অহেতুক চিন্তা কেন করছে? তার উচিৎ এই কঠিন পরিস্থিতি থেকে বের হওয়ার উপায় নিয়ে চিন্তা করা। কিন্তু কিছুই মাথায় আসছে না। প্রায় দুই-তিন ঘণ্টা প্রীতি কফিশপের রুফটপেই বসে রইল। সূর্য ডুবে সন্ধ্যা নামল। সন্ধ্যার দিকে কফিশপের ভীড় প্রচুর বেড়ে গেল। একটা টেবিলও ফাঁকা নেই। প্রীতি একপাশে নিঃসঙ্গের মতো চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। যতক্ষণ সে এখানে থাকবে ততক্ষণ নিরাপদে থাকবে। বাহিরে বের হলেই বিপদ। হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। এতোক্ষণে প্রীতির একবারও মনে হলো না যে সে রিসিপশনে গিয়ে জেরিনের নাম্বারে ফোন করতে পারে। যখন এই ব্যাপারটা মাথায় এলো তখন আর ফোন করার প্রয়োজন নেই৷ কারণ জেরিন প্রীতিকে খুঁজতে খুঁজতে কফিশপে চলে এসেছে। প্রীতি জেরিনকে দেখেই উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠল,” জেরিন, তুই এসেছিস? থ্যাংক গড!”
” আশরাফ ভাইয়ের সাথে কথা হয়েছিল। তিনি বললেন তুই নাকি একা বাড়ি চলে গেছিস। কিন্তু বাড়িতে ফোন করে জানলাম তুই যাসনি। আমি কত টেনশনে পড়ে গেছিলাম জানিস?”
প্রীতি জীভে কামড় দিয়ে বলল,” স্যরি, আসলে আমার কাছে তো টাকা নেই। কিভাবে যাবো বল?”
” ট্যাক্সি নিয়ে চলে যেতি৷ বাড়ি গিয়ে ভাড়া দিতি।”
” এটা একদম মাথায় আসেনি।”
” গাঁধী কোথাকার!”
জেরিন আর প্রীতি কফিশপে বসে দুই কাপ কফি খেল। তারপর বাড়ি ফেরার জন্য ট্যাক্সি নিল। ট্যাক্সিতে উঠার পর প্রীতির মোবাইল বেজে উঠল। অনলাইনে ফোন করেছে অর্পিতা। প্রীতির বাংলাদেশী কাজিন। তার বড় চাচার মেয়ে। প্রীতি জেরিনের দিকে চেয়ে বলল,” অর্পি ফোন করেছে।”
জেরিন একটু থতমত খেল। সে খুব ভালো করেই জানে অর্পি কেন ফোন করেছে। জেরিনের সাথে আজ অর্পির কথা হয়েছিল। তখন জেরিন আশরাফ আর প্রীতির সবঘটনা অর্পিকে বলে ফেলেছে। এই বিষয়ে নিশ্চয়ই অর্পি এখন প্রীতির সাথে কথা বলবে। এখানেই জেরিনের ভয়টা। প্রীতির অনুমতি না নিয়ে তার ব্যক্তিগত বিষয় সে অর্পির সাথে শেয়ার করেছে। এটা জানলে প্রীতি যদি রাগ করে?
প্রীতি ফোন লাউড স্পিকারে রেখে কথা বলল,” হ্যালো অর্পি, কেমন আছিস? কতদিন পর!”
” শুনলাম তুই নাকি নিউইয়র্কে জেরিনদের বাড়িতে আছিস?”
” হুম। ঠিক শুনেছিস। পারলে তুইও চলে আয়। আমরা খুব মজা করছি।”
” কেন আসবো? বিয়ে ভাঙার ব্যাপারে সাহায্য করতে নাকি তোর হবু বরের গার্লফ্রেন্ডের বাপ-মায়ের ডিভোর্স ঠেকাতে?”
এই কথা বলেই হাসিতে ঢলে পড়ল অর্পি। খুব সস্তা রসিকতা। প্রীতি বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে জেরিনের দিকে তাকালো। অর্পি এসব কিভাবে জানে? জেরিন আগে মাফ চাওয়ার উদ্দেশ্যে কানে ধরল। তারপর ইশারায় বোঝালো সে নিজেই বলেছে। প্রীতি কটমট করে তাকানো মাত্রই জেরিন নরম স্বরে বলল,” স্যরি!”
প্রীতি তীক্ষ্ণ কণ্ঠে অর্পিকে উত্তর দিল,” এসব নিয়ে তোকে চিন্তা করতে হবে না। এগুলো আমার ব্যক্তিগত বিষয়।”
” ব্যক্তিত্বহীনের আবার ব্যক্তিগত বিষয়ও থাকে নাকি?”
অর্পি যেন ফোঁড়ন কাটছে। প্রীতি রেগে বলল,” কে ব্যক্তিত্বহীন?”
” তুই ব্যক্তিত্বহীন। আমার তো মনে হয় তোর চোখের চামড়া নেই। আত্মসম্মানবোধ নেই। যদি থাকতো তাহলে যেই ছেলে তোকে রিজেক্ট করল সেই ছেলের সাথে তুই আবার দেখা করতে যাস কিভাবে?”
” আশরাফ আমাকে রিজেক্ট কেন করবে? ও তো একবারও বলেনি যে ওর আমাকে পছন্দ নয়। আর যদি পছন্দ নাও হয় তাহলে এখানে ইনসাল্ট ফীল করার কি আছে? পৃথিবীর সবার যে আমাকে পছন্দ হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। আমি নিজেকে এতোটাও পারফেক্ট মনে করি না। তাছাড়া আশরাফ অন্য একজনকে ভালোবাসে। ওর ফ্যামিলি ওদের সম্পর্ক না মেনে আমার সাথে বিয়ে ঠিক করেছে। আর ও জাস্ট বিয়েটা ভাঙার জন্য আমার থেকে হেল্প চেয়েছে। এখানে খারাপ কি আছে? আত্মসম্মানে আঘাত লাগার মতো কোনো ব্যাপারই আমি খুঁজে পাচ্ছি না।”
” তাই বুঝি? তোর জায়গায় আমি হলে এই ছেলের মুখও দেখতাম না। এর চেয়েও হাজার গুণ ভালো পাত্র বিয়ে করে দেখিয়ে দিতাম যে আমি কত ভালো ডিজার্ভ করি।”
” এগুলো হচ্ছে হিপোক্রিসি চিন্তা-ভাবনা। তোমার আমাকে ভালো লাগেনি মানে তোমাকে এর জন্য আফসোস করতে হবে__ মানে এটা কেমন মানসিকতা? আত্মসম্মানের দোহাই দিয়ে এসব হিপোক্রিটের মতো ইগো দেখানো বন্ধ কর প্লিজ।”
” আমি হিপোক্রিট হলে তুই কি? সিনেমার নায়িকা? এখন ভালোমানুষ সেজে আত্মত্যাগ করবি? যে তোর সাথে বিয়ে ভাঙল তার গার্লফ্রেন্ডের বাবা-মা’র ডিভোর্স ঠেকাবি?”
” বিয়ে ভেঙে ও কোনো ভুল করেনি। বরং ঠিক করেছে। একটা অসুস্থ সম্পর্ক তৈরী হওয়ার আগেই থামিয়ে দিয়েছে। ও তো আমাকে কিছু না জানিয়ে বিয়ে করে ফেলতে পারতো। আমি কিছু বুঝতামও না। কিন্তু আশরাফ এটা করেনি কারণ ও অনেস্ট। আর ও শুধু একজনকেই ভালোবাসে এবং সারাজীবন তার সঙ্গেই কাটাতে চায়। আর ডিভোর্স ঠেকানোর কথা বলছিস? একটা মানুষ হেল্প চাইতেই পারে। আমার যদি ইচ্ছে হয় আমি হেল্প করবো। তোর এতো প্রবলেম হচ্ছে কেন?”
প্রীতির চটাং চটাং জবাব শুনে অর্পি ফোন কেটে দিল। প্রীতিও আর কলব্যাক করল না। ঠুনকো বিষয় নিয়ে ঝগড়া করতে ইচ্ছে করছে না। কপালে হাত রেখে নিজেকে শান্ত করে নিল। তারপর প্রীতি জেরিনের দিকে চেয়ে হতাশ কণ্ঠে প্রশ্ন করল,” তুই এসব কেন জানালি ওকে?”
” আমি বুঝতে পারিনি যে ও ব্যাপারটা এইভাবে নিবে।”
” ও তো এমনি। জাজমেন্টাল, টক্সিক। এটা তুই জানিস না? যাইহোক, তুই একটা সত্যি কথা বলতো জেরিন। তোরও কি মনে হয় যে আমার আত্মসম্মান নেই?”
” একদম না প্রীতি। তুই খুব পরিষ্কার মনের একটা মেয়ে। ক্লিন হার্টেড গার্ল। আমি তোকে খুব পছন্দ করি।”
প্রীতি হেসে বলল,” থ্যাংকস। আমি কি ঠিক করেছি জানিস?”
” কি?”
” আশরাফ আর ফ্লোরাকে হেল্প করবো।”
” আমি জানতাম। ভেরি গুড ডিসিশন। চেষ্টা করে দ্যাখ কিছু হয় কি না। যদি সত্যি হেল্পটা করতে পারিস তাহলে আশরাফ ভাই খুব খুশি হবে। আমিও আছি তোর সাথে।”
প্রীতির হৃদয় স্বস্তিতে ভরে উঠল। জেরিনের মতো কাজিন থাকলে বেস্টফ্রেন্ডের দরকার নেই। জেরিন সবসময় প্রীতিকে খুব ভালো করে বুঝতে পারে। মাঝে মাঝে প্রীতির মনে হয় জেরিন বুঝি তার বেটার হাফ।
প্রমথ সাহেব বিছানায় শুয়ে আছেন। ডিনারে সবাই একসাথে খেতে বসেছে। প্রমথকে ডাকা হলো। কিন্তু তিনি এলেন না। জানালেন শরীর খারাপ। প্রীতি নিজের আর বাবার খাবার নিয়ে বেডরুমে চলে এলো। খাবার টেবিলে রেখে বাতি জ্বালিয়ে নিল। বাবার কাছে গিয়ে আদুরে স্পর্শে কপালে হাত বুলিয়ে বলল,” আব্বু কি হয়েছে? শরীর কি বেশি খারাপ?”
প্রমথ সাহেব চোখ বন্ধ রেখেই মুচকি হাসলেন।
” নারে মা। বেশি খারাপ না। ”
” তাহলে খেতে এলে না যে?”
” বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছে না। তুই খেয়েছিস?”
” উহুম। জীবনে কখনও তোমাকে রেখে খেয়েছি? চলো একসাথে খাবো। খাবার এখানে নিয়ে এসেছি। ওঠো, উঠে বসো।”
প্রীতি বাবাকে জোর করে উঠিয়ে বসাল। প্লেট এগিয়ে দিল। প্রমথ সাহেব খাওয়া শুরু করার আগে প্রীতিকে বললেন,” তুইও বস।”
” বসছি।”
প্রীতি বাবার মুখোমুখি বিছানায় খেতে বসল। একটু পর বলল,” আচ্ছা আব্বু, ফুপুর সাথে কি তোমার কিছু হয়েছে?”
প্রমথ সাহেবের খাওয়া এক মুহূর্তের জন্য থামল। পরে তিনি আবার স্বাভাবিক হয়ে খেতে লাগলেন। বাবার বিষণ্নতা প্রীতির চোখ এড়ালো না। প্রমথ বললেন,” না। কি হবে?”
” মিথ্যে। ”
প্রমথ সাহেব মাথা নিচু করে থাকলেন। মেয়ের কাছে মিথ্যে বললে সবসময় ধরা পড়েন তিনি। কারণ প্রীতি তার মেয়ে নয়, মা। মায়ের কাছে মিথ্যে বলতে গেলে ধরা তো খেতেই হবে। প্রীতি চোখ-মুখ শক্ত করে বলল,” আমি কি জানতে পারি কি হয়েছে? যার জন্য তুমি রাতের খাবার না খেয়েই ঘুমিয়ে যাচ্ছিলে? নিশ্চয়ই সিরিয়াস কিছু!”
প্রমথ সাহেব চুপ করে খাবার খাচ্ছেন। সত্যি কথা বলতে গেলে এখন প্রীতি চিল্লাচিল্লি করবে। ফুপুর সাথে ঝগড়াও করতে যেতে পারে। কি দরকার ফুপু-ভাতিজির সম্পর্ক নষ্ট করার? প্রীতি খাবারের প্লেট নামিয়ে বলল,” তুমি কথা বলছো না কেন? আমি খাবো না।”
প্রমথ সাহেব পালটা হুমকি দিলেন।
” ঠিকাছে না খা। আমিও তাহলে রাতের ঔষধ খাবো না।”
প্রীতি বিরক্ত গলায় বলল,” ঠিকাছে। না বললে নেই। আমি জোর করে জানতে চাইবো না। যখন ইচ্ছে হবে তখন অন্তত বোলো।”
” দেখা যাবে। খাওয়া শেষ কর।”
প্রীতির মনে হলো, গুরুত্বপূর্ণ কথাটা বলার উপযুক্ত সময় এখনি। কিভাবে কি বলবে সব ঠিক করা আছে। শুধু বলতেই প্রীতির ভয় লাগছে। বাবা বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে ভীষণ খুশি। এই বিয়ে ভাঙলে তিনি কষ্ট পাবেন নিশ্চিত। কিন্তু বিয়েটা হয়ে গেলে আরও বেশি কষ্ট পেতেন। সেই কষ্টের কাছে এই কষ্ট কিছু না। প্রীতি মাইন্ড সেট করে বলতে নিচ্ছিল তার আগেই প্রমথ সাহেব বললেন,” খাওয়া শেষ হলে আমার ফোন থেকে সরফরাজ ভাইকে একটু অনলাইনে কল লাগিয়ে দিস। জরুরী কথা বলবো।”
” কেন? কি জরুরী কথা বলবে?”
” বিয়ের ডেইট এগিয়ে আনবো। একমাস না, এক সপ্তাহের মধ্যে যেন বিয়েটা হয়ে যায়।”
প্রীতি বিস্ফোরিত কণ্ঠে বলল,” কেন আব্বু?”
” এমনি। তোর বিয়ে দিয়ে আমি দ্রুত দেশে ফিরবো। অনেক কাজ।”
” আমি এতোবড় বোঝা হয়ে গেছি তোমার? তাড়ানোর জন্য একদম উঠে-পরে লেগেছো?”
প্রমথ এবার নরম গলায়,” মারে, তুই এই কথা কেমনে বললি মা? তুই আমার বোঝা! আমার শুন্য জীবনের একমাত্র পূর্ণতা তুই। বোঝা না, তুই হলি আমার সম্পদ!”
” জানি বাবা। তাহলে কেন তুমি তোমার সম্পদ অন্যকাউকে দিয়ে দিতে চাইছো?”
প্রমথ হেসে বললেন,” তো বিয়ে কি দিবো না তোকে?”
প্রীতি কিছু মুহূর্ত চেয়ে রইল। একটু পর এক নিশ্বাসে বলে উঠল,” বাবা আমি এই বিয়ে করবো না। তুমি সরফরাজ আঙ্কেলকে ফোন করে আজকের মধ্যেই বিয়ে ভেঙে দিবে।”
চলবে