#উইল ইউ ম্যারি মি?
পর্ব–২
®Fareen Ahmed
জানালার বাহিরে শীতল শুভ্র রাত। বরফ এখনও জমেনি। তাই গাড়ি চালানো সহজ হচ্ছে। কিছুক্ষণ পরেই আর এই রাস্তায় গাড়ি নিয়ে নামা সম্ভব হবে না। যা বোঝা যাচ্ছে, প্রীতিকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার পর আবার নিজের বাড়ি ফিরে যেতে ভালোই সমস্যা হবে আশরাফের। তবে এই নিয়ে প্রীতি বিচলিত নয়। লোকটার সমস্যা হওয়াই উচিৎ। প্রীতিকেও তো সে কতবড় সমস্যায় ফেলে দিয়েছে। প্রীতি এখন কিভাবে বিয়েটা ভাঙবে? বাড়ি ফিরে জেরিনের সাথে এই নিয়ে আলোচনায় বসতে হবে। এসব ব্যাপারে জেরিনের মাথা থেকে অনেক কুবুদ্ধি বের হয়। প্রীতি সহজ-সরল মেয়ে। তার চেহারার মতো মনটাও খুব সাদা। জটিলতার সে কিছুই বোঝে না। তার চিন্তা-ভাবনাগুলোও তার মতোই সরল।
আশরাফ পাশে বসে ড্রাইভিং করছে আর নানান কথা বলছে। প্রীতি শুনছে আবার শুনছে না। ফ্লোরা সংক্রান্ত আলোচনায় তার আগ্রহ নেই। এর চেয়ে জানালার বাহিরে সারি সারি ম্যাপল গাছের সৌন্দর্য্য উপভোগ করতেই বেশি আগ্রহী সে।
বিরাট অট্টালিকার সামনে গাড়ি থামল। আশরাফ হাসি মুখে বলল,” নামো, চলে এসেছি।”
প্রীতি হতচকিত দৃষ্টিতে আশেপাশে দেখতে লাগল। এ কোথায় এসেছে তারা? এটা তো নাফিসা ফুপুর বাড়ি না।
” এখানে কেন নামবো?”
আশরাফের সম্বিৎ ফিরল প্রীতির প্রশ্ন শুনে। কপালে হাত রেখে বলল,” ওহ মাই গড! কথা বলতে বলতে একদম খেয়াল ছিল না। তোমাদের বাড়ির রাস্তা না ধরে নিজের বাড়ির রাস্তায় চলে এসেছি। এক্সট্রিমলি স্যরি প্রিটি।”
প্রীতির মুখ চুপসে গেছে। মনে হচ্ছে মেয়েটা এখুনি কেঁদে ফেলবে। আশরাফ বলল,” তুমি খেয়াল করবে না? আমার না হয় মনে ছিল না। তুমি তো বাহিরেই তাকিয়ে ছিলে। একটু বলবে না আমাকে যে ভুল পথে যাচ্ছি?”
প্রীতি বোকার মতো তাকিয়ে আছে। সে কিভাবে বুঝবে কোনটা ভুলপথ আর কোনটা সঠিক? তার কাছে তো সব রাস্তা একই রকম লাগে। আশরাফ হাত মুঠো করে স্টেয়ারিং এ সজোরে একটা ধাক্কা মারল। আফসোস করে বলল,” ড্যাম! কি হবে এখন? আবার গাড়ি ঘোরাতে হবে। একদম অপোজিট রোড!”
প্রীতি চিন্তিত গলায় প্রশ্ন করল,
“এখান থেকে যেতে কতক্ষণ লাগবে?”
” মিনিমাম ওয়ান আওয়ার। আর যদি ফুল স্পিডে চালাই তাহলে হাফ এন্ড আওয়ার লাগতে পারে। কিন্তু তুমি সেটা টলরেট করতে পারবে না।”
প্রীতির ভয় লাগছে। বাড়ি ফিরতে আরও একঘণ্টা সময়! কি একটা অবস্থা। বাবা তাকে আর কখনোই একা বের হতে দিবে না। এতোবড় ভুল কিভাবে করল আশরাফ? প্রীতি হতাশ দৃষ্টিতে তাকাল।
আশরাফ সহসা সিট বেল্ট খুলতে খুলতে বলল,” বাদ দাও প্রিটি। যা হয় ভালোর জন্যই হয়। এই সুযোগে তুমি আমাদের বাড়িতে ডিনার করতে পারবে। বাবা-মা’ও খুব খুশি হবে তোমাকে দেখলে।”
আশরাফের প্রস্তাব শুনে চোখ কপালে উঠে গেল প্রীতির।
” না, না, এটা কি করে হয়? আমি এখন আপনাদের বাড়িতে ঢুকলে তো আমার ফিরতে আরও লেইট হয়ে যাবে। বাবা টেনশন করবে।”
” ফোন করে বলে দিও। আঙ্কেল নিশ্চয়ই সিচুয়েশন বুঝবেন। এখন আবার গাড়ি ঘোরানো ঠিক হবে না। ওয়েদার ভালো নেই। তাছাড়া তুমি আমাদের বাড়িতে প্রথমবার এসেছো। আমি তোমাকে এতো সহজে যেতে দেই কিভাবে? আফটার অল, ইউ আর মাই গুড ফ্রেন্ড।”
প্রীতি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বলল,” গুড ফ্রেন্ড?”
” আমরা কাপল না হতে পারলাম। এটলিস্ট ফ্রেন্ড তো হতেই পারি। তাছাড়া তুমি আমার কতবড় উপকার করেছো!”
প্রীতি মনে মনে একটু হাসল। যাকে এতোদিন প্রেমিক পুরুষ রূপে কল্পনা করেছে তাকে হঠাৎ করে বন্ধু ভাবা প্রীতির জন্য একদম সহজ ব্যাপার না। সে যাকে স্বামী হিসেবে পায়নি তাকে বন্ধু হিসেবেও চায় না। প্রীতি ছোট নিঃশ্বাস ছেড়ে উত্তর দিল,
” উপকার এখনও করিনি। বিয়ে ভাঙার ব্যাপারে আমি বাবার সাথে কথা বলবো। তারপর দেখা যাক।”
” সেজন্যই বলছি। তোমাকে ভেতরে যেতেই হবে। একটা ট্রিট তোমার পাওনা। আজকে রাতে আমাদের সাথে এখানেই থাকো না। কাল সকালে চলে যেও।”
প্রীতি বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকাল। কি সহজভাবেই না আশরাফ কথাটা বলে ফেলেছে। প্রীতি বাবার অনুমতি ছাড়া কলেজেও যায় না। সেখানে আশরাফদের বাড়িতে একরাতের জন্য থাকা মানে বিনা নোটিশে বাবার হার্ট ফেইলের ব্যবস্থা করা। অসম্ভব!
আরোহী হক প্রীতির প্লেটে আরও একটু সালাদ তুলে দিলেন। প্রীতির খেতে ইচ্ছে করছে না। রেস্টুরেন্ট থেকে তারা ইতিমধ্যে খেয়ে এসেছে। তাই পেটে বেশি জায়গা নেই। কিন্তু আরোহী খুব যত্ন নিয়ে প্রীতিকে খাওয়াচ্ছেন। এইভাবে কেউ যত্ন করলে নিষেধ করা যায় না। প্রীতির আবার একটা বাজে স্বভাব হলো, সে কখনোই কাউকে নিষেধ করতে পারে না। এমন রোগ অনেক মানুষেরই থাকে। কিন্তু প্রীতির রোগটা একটু বেশি করেই আছে। যেমন আশরাফকেও সে নিষেধ করতে পারেনি। ঠিকই জোর করে আশরাফ তাকে বাড়িতে নিয়ে এসেছে। হবু শাশুড়ী আরোহী প্রীতিকে দেখে কতই না খুশি! তাকে সাথে নিয়ে খেতে বসেছেন। প্রীতির পেট ভরা ছিল। তবুও সে আরোহীকে নিষেধ করতে পারল না। শত হলেও তার হবু শাশুড়ী। যদিও এই বিয়েটা হবে না। কিন্তু সেই কথা তো এখনও কেউ জানে না। একটু পর সরফরাজ ইসলাম এলেন। গায়ে সাদা পাঞ্জাবী আর পায়জামা। মাথায় সাদা রুমাল বাঁধা। বোঝাই গেল নামায ঘর থেকে উঠে এসেছেন। গা থেকে আতরের সুভাষ আসছে৷ তজবী হাতে নিয়ে মুচকি হেসে প্রীতির সাথে কুশল বিনিময় সারলেন তিনি। কথা বললেন না কারণ জরুরী দোআ পড়ছেন। প্রীতির খুব মায়া হলো। আহারে, কত পরহেজগার একজন মানুষ! অথচ তার ছেলেটাকে দেখো, খ্রিস্টিয়ান মেয়ের সাথে লিভ টুগেদার করার জন্য বিয়ে ভেঙে দিচ্ছে। যদিও অন্য মানুষের জীবন নিয়ে প্রীতির নাক গলানোর ইচ্ছে নেই। আশরাফ এখন তার কাছে অন্য মানুষই বটে। বিয়েটা হলেই না নিজের মানুষ হতো।
” আর কিছু খাবে মা?”
” না আন্টি। আমার পেট ভরে গেছে।”
আরোহী আহ্লাদী দৃষ্টিতে প্রীতির মিষ্টি চেহারার দিকে তাকিয়ে রইলেন। কোমল স্পর্শে প্রীতির চিবুক ছুঁয়ে বললেন,
” প্লিজ আমাকে মা বলে ডাকো। আর কয়েকটা দিন পরেই তো বিয়ে। এখন থেকে প্র্যাকটিস না করলে অভ্যাস হবে না তো।”
প্রীতি কৃত্রিম লজ্জা মেশানো হাসি দিল। তার আসলে অস্বস্তি লাগছে। আরোহী প্রীতির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,” তুমি আসলেই খুব প্রিটি একটা মেয়ে।”
প্রীতি মনে মনে বলল, “আপনার ছেলেও আমাকে একই কথা বলে। কিন্তু প্রশংসা করে না, ভুল করে। নামের ভুল উচ্চারণ। প্রীতি থেকে প্রিটি।” সরফরাজ সাহেবের দোআ শেষ হয়েছে। তিনি প্রীতির কাছে এসে হাসিমুখে জানিয়ে দিলেন,” তোমার বাবার সাথে কথা হয়েছে মা। তিনি তোমাকে আমাদের সঙ্গে থাকার অনুমতি দিয়েছেন।”
প্রীতি অবাক হয়ে গেল।
” সত্যি বাবা অনুমতি দিয়েছেন? আপনি কি বলে রাজি করালেন আঙ্কেল?”
সরফরাজ হেসে ফেললেন। আরোহী বললেন,” রাজি না হয়ে উপায় কি? তোমার বাবা তো আর বরফে ঢাকা রাস্তা পেরিয়ে তোমাকে নিতে আসতে পারবে না। তাই অনুমতি দিয়েছেন। আমি জানতাম দিবেন।”
প্রীতি চিন্তিত মুখে পানির গ্লাস হাতে নিল। ঘটনা এখানেই শেষ হবে না। বাবা নিশ্চয়ই কিছুক্ষণের মধ্যে প্রীতিকে ফোন করে একশো একটা ঝারি দিবেন।
আরোহী সরফরাজের দিকে চেয়ে উৎসাহী কণ্ঠে বলল,” জানো আমার কি ইচ্ছে করছে?”
” কি?”
” কাজী ডেকে এখনি দু’জনের বিয়ে পড়িয়ে দিতে।”
প্রীতির মুখ থেকে পানি ছিটকে দেয়ালে গিয়ে পড়ল।খুকখুক করে কাশি উঠল। আরোহী মাথায় হাত দিয়ে কাশি থামানোর চেষ্টা করলেন।
” কি হয়েছে মা?”
” কিছু না আন্টি। ওই একটু বিষম উঠেছে আর কি।”
” বিষম কেন উঠল?”
প্রীতি উত্তর না দিয়ে বড় করে নিঃশ্বাস ছাড়ল। যে ভয়ংকর কথা সে শুনেছে, বিষম তো উঠবেই। হার্ট ফেইল যে করেনি এটাই বেশি। সরফরাজ হাসতে হাসতে বললেন,” আন্টির কথায় কিছু মনে করো না। তোমার বাবার অনুমতি ছাড়া আমরা তোমাকে পারমানেন্টলি ঘরে তুলবো না।”
সরফরাজ আর আরোহী একসাথে হাসতে লাগলেন। খুব প্রাণবন্ত তাদের হাসি। দু’জনই অমায়িক মানুষ। এমন বন্ধুর মতো প্রাণোচ্ছল শ্বশুর-শাশুড়ী কে না চায়?
আরোহী খুব শৌখিন মহিলা। প্রীতিকে নিজের ঘরে এনে আলমারী খুলে বসেছেন। একের পর এক শাড়ি গয়না বের করছেন। তিনি হয়তো সাজসজ্জা নিয়ে আলোচনা করতে খুব ভালোবাসেন। প্রীতিও ভালোবাসে। বিয়েটা হলে শাশুড়ীমায়ের সাথে তার খুব জমতো। এই কথা ভেবে প্রীতি নিজেই নিজেকে একটা গালি দিল। ঘুরে-ফিরে সে বিয়ে না হওয়া নিয়েই আফসোস করছে। অথচ বিয়েটা হয়ে গেলে যে তার কতবড় সর্বনাশ হতো সেটা নিয়ে তো একবারও শুকরিয়া আদায় করছে না। প্রীতি এই বিয়ে ভাঙতে চায়। আশরাফ তার ভালোবাসা নিয়ে সুখে থাকুক। প্রীতিও খুব শীঘ্রই আশরাফকে ভুলে যাবে। এতো গয়নাগাটি দেখে প্রীতির মনে পড়ে যায়, তার হাতেও একটা হিরার আংটি আছে। যেটা আশরাফের পরিবার দেখতে এসে তাকে পরিয়ে দিয়েছিল। বিয়ে ভাঙার পর এই জিনিসটা কি ফেরত দিতে হবে?
আরোহী প্রীতিকে স্বর্ণের বড় বড় নেকলেস দেখাচ্ছেন। সবকিছু এই বাড়িতে বউ হয়ে আসার পর প্রীতি পাবে। আশরাফের কোনো ভাই-বোন নেই। সব সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী আশরাফ। সেই একমাত্র ছেলের একমাত্র বউ হলে প্রীতিই পাবে সব স্বর্ণ-গয়না। কিন্তু প্রীতির কখনোই স্বর্ণের প্রতি আকর্ষণ নেই। তবে একটা ছোট্ট পাতলা নেকলেস দেখে তার ভালো লাগল। নেকলেসটা হাতে নিয়ে আয়নার কাছে গেল। গলার কাছে ধরল। এমন একটা নেকলেস তার মায়েরও আছে। আরোহী এই কান্ড দেখে প্রীতিকে নেকলেসটা পরিয়ে দিলেন। প্রীতি পরতে চাইছিল না। আরোহী জোর করলেন। তারপর একে একে তাকে আরও গয়না পরালেন। একটা দুইকেজি ওজনের লাক্সারি লেহেঙ্গা পরানোর পর প্রীতিকে একদম বউয়ের মতো লাগছিল।
প্রীতি আয়নায় নিজেকে দেখে লজ্জায় কুকড়ে গেল। গা ভর্তি দামী গয়না। প্রীতি কখনও ভাবেনি এইভাবে সে কোনোদিন সাজতে পারবে। আশরাফের বউ হওয়ার স্বপ্ন সে দেখে না। কিন্তু আরোহীর স্নেহও সে অগ্রাহ্য করতে পারছে না। শুধু ভদ্রহিলার মন রাখতেই হাসিমুখে নিজেকে সাজাতে দিয়েছে। আরোহী সাজগোজের পর প্রীতিকে জোর করে আশরাফের ঘরে পাঠালেন। আশরাফ প্রীতিকে এই অবস্থায় দেখে হেসেই খু*ন।
” তোমাকে একদম থিয়েটার গার্ল লাগছে প্রিটি।”
প্রীতি মুখ ভার করে বলল,” আমি সাজতে চাইনি। আন্টি জোর করে সাজিয়ে দিলেন। মানাও করতে পারিনি।”
আশরাফ ঠোঁটের নিচে হাত রেখে কিছু একটা ভাবছিল। হঠাৎ মনে পড়ায় বলল,” গট ইট, তোমাকে একদম সাউথ ইন্ডিয়ান ফিল্মের ক্যারেক্টর মনে হচ্ছে।”
” আপনি সাউথ ইন্ডিয়ান মুভিজ দেখেন?”
” ইংলিশ সাবটাইটেল দিয়ে দেখি মাঝে মাঝে। তুমি ওই মুভিটা দেখেছো? অনুশকা প্রাচীনকালের রানী থাকে। বিশ্বাস করো, ওই মুভিতে আনুশকার যেই লুক ছিল তোমার লুকও একদম সেইম। হাতে একটা তলোয়ার থাকলেই পারফেক্ট মানাতো। একদম লেডি ভিলেন।”
প্রীতির রাগ লাগছে। তাকে তো এখন লেডি ভিলেন লাগবেই। তাহলে হিরোইনটা কে? ওই সাদা চামড়ার ভুতনী? লালচুলো বান্দরী? কি যেন নাম? ফ্লোরা!
আশরাফ বলল,” এদিকে এসো তোমাকে একটা ম্যাজিক দেখাই। মজা পাবে।”
” আপনি কি ম্যাজিশিয়ান?”
” উহুম। কিন্তু টুকটাক জানি আর কি। ম্যাজিশিয়ানদের মতো এতো ডেডিকেশন আমার নেই। থাকলে ঠিক হয়ে যেতাম।”
” তাই বুঝি? আচ্ছা আপনার এইম ইন লাইফ কি?”
” বাংলাদেশে যাওয়া।”
প্রীতি অবাক হলো। কি বলে এই ছেলে! আমেরিকার মতো দেশে থেকে তার জীবনের উদ্দেশ্য নাকি বাংলাদেশে যাওয়া! তার মতো ছেলের জন্য বাংলাদেশে যাওয়া তো পান্তাভাতের মতো ব্যাপার।
” আপনি কখনও বাংলাদেশে যাননি?”
” কখনই যাইনি।”
” কি বলেন? নিজের মাতৃভূমিতেই যাননি? আঙ্কেল-আন্টি কখনও আপনাকে নিয়ে যায়নি?”
” উহুম!”
খুব মনখারাপ করে কথা বলছে আশরাফ। প্রীতি বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,” কেন নিয়ে যায়নি?”
” কারণ বাবা-মা চায় না আমি বাংলাদেশে যাই।”
” আআশ্চর্য! তারা কেন এটা চাইবে না?”
” এর পেছনে একটা কারণ আছে। আমি ঠিক করেছি বাংলাদেশে গেলে কমপক্ষে তিনমাস থাকবো। টানা একমাস আমি রিক্সা চালাবো। তারপরের একমাস ভ্যান চালাবো আর রেলওয়ে স্টেশনে কুলির কাজ করবো। পনেরো দিন ভিক্ষা করবো আর বাকি পনেরো দিন কৃষিকাজ করবো।”
” কৃষিকাজ ঠিকাছে। কিন্তু রিক্সা চালোনো, কুলিগিরি, ভিক্ষা, এসব কেন?”
” শখ! মানুষের কি শখ থাকতে পারে না?”
” এগুলো আবার কেমন শখ? আমাদের দেশের মানুষ তো এসব বাধ্য হয়ে করে।”
” এজন্যই আমি শখ থেকে করবো। আমি দেখতে চাই, শখের বশে রিকশা চালাতে কেমন লাগে। ভাঙা থালা আর ছেঁড়া শার্ট পরে সবার কাছে ইংরেজিতে ভিক্ষা চাইবো। সবাই বলবে শিক্ষিত ভিক্ষুক। ব্যাপারটা মজাদার হবে না?”
প্রীতি বক্রদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আশরাফ হাসছে। ফিচেল হাসি। ছেলেটা আসলে তার সাথে ফাজলামি করছে। ফাজিল কোথাকার! প্রীতি ঠিক করল আর এই ফাজিলের সাথে কথাই বলবে না। সে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলো। আশরাফ পেছন থেকে ডেকে বলল,” লিসেন প্রিটি।”
যদিও প্রীতি ভেবেছিল থামবে না তবুও তার পা দু’টো থেমে গেল। আশরাফ চেয়ার থেকে উঠে এসে বলল,” তোমার ফুপা আর ফুপুর মধ্যে সারাক্ষণ ঝগড়া লেগে থাকে তাই না?”
প্রীতি একটু চমকে গেল। ছেলেটা হঠাৎ পারিবারিক বিষয় টেনে কথা বলছে কেন? প্রীতি ভ্রু কুচকে বিরক্ত কণ্ঠে বলল,” হ্যাঁ লেগে থাকে। তো কি হয়েছে?”
” তুমি আসার পর থেকে ঝগড়াটা আর হচ্ছে না। তুমি তাদের সব ঝামেলা মিটিয়ে দিয়েছো। রাইট?”
” হ্যাঁ। এটা আমি ছোটবেলা থেকেই পারি। শুধু আমার বাড়ি না, যেকোনো বাড়িতে ঝামেলা হলেই আমি মিটিয়ে দিয়ে আসি।”
” ভেরি গুড। এজন্যই তোমাকে আমার দরকার।”
” কেন? আপনার মা-বাবাও কি ঝগড়া করে? কিন্তু দেখে তো মনে হয় না। আঙ্কেল-আন্টি কত হাসিখুশি!”
” আরে আমার মা-বাবা না। আমি ফ্লোরার জন্য বলছি।”
ফ্লোরার নামটা শুনেই কান আবার গরম হয়ে গেল প্রীতির। মুখ হয়ে গেল ভার। আশরাফ বলল,” ফ্লোরার মা-বাবা রোজ ঝগড়া করে। তাদের ঝামেলাটা ডিভোর্সের পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। বাবা-মায়ের ডিভোর্স হলে ফ্লোরা বেচারি প্রচন্ড ভেঙে পড়বে। সামনে ওর এক্সাম। পড়াশোনায় মন দিতে পারছে না মেয়েটা। বাড়ি ফিরলেই সারাক্ষণ বাবা-মায়ের হাউকাউ। মাঝে মাঝে আমাকে ফোন করে কাঁদে। সে তার বাবা-মাকে খুব ভালোবাসে তো। তুমি কি তাদের আলাদা হওয়াটা আটকাতে পারবে প্রিটি?”
প্রীতির খুব বিরক্ত লাগছে। তার গার্লফ্রেন্ডের বাবা-মায়ের ডিভোর্স হলে এখানে প্রীতির কি করার আছে? প্রীতি কিভাবে তাদের আলাদা হওয়া আটকাবে? আর চেনা নেই, জানা নেই এমন দু’জন মানুষ প্রীতির মিষ্টি কথায় কি ডিভোর্স নেওয়া থামিয়ে দিবে? কি আজব! প্রীতি মনে মনে আশরাফকে বিছরি কয়েকটা গালি দিলেও মুখে বলল,” আমি চেষ্টা করে দেখতে পারি।”
চলবে