#ইলশে_গুঁড়ি
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব_০২
তিথি হতম্বভ হয়ে খাটে বসে আছে। সাথে একটু লজ্জাও লাগছে। ছিঃ! মানুষ যে এতো নির্লজ্জ কিভাবে হয় সে বুঝতে পারে না। সকালে তাঁর ঘুম ভেঙেছে পাখির কিচিকিচি শব্দে। ঘুম ভেঙেই সে অবাক । ঢাকা শহর, আর পাখি। তাঁর ঘুম ভাঙা উচিত ছিলো কাকের কা কা শব্দে। অবশ্য এটা অভিজাত এলাকা। তবুও! সে শব্দের খোঁজে বারান্দায় আসলো। এই বাড়ি বিশাল জায়গা নিয়ে করা। বারান্দাও করা হয়েছে মন মতো করে। বারান্দায় আসতেই তাঁর মুখ হা আর চোখ ছানাবানা । বাড়ির পিছনে কয়েকটা বড় বড় পাখির খাঁচা। তাঁর মধ্যে হরেক রকমের পাখি। তিথি মুগ্ধে বাক্য হারা হয়ে গেলো। তাঁর কাছে গিয়ে দেখতে ইচ্ছা হলো। সে তারাতারি নিচে যাওয়ার জন্য ঘুরতেই ঝটকাটা খেলো।
তাঁর পাশের বারান্দায় নোমান দাঁড়িয়ে আছে । সে তাঁর বড় চাচার ছেলে। তাঁর এক হাতে সিগারেট আরেক হাতে পেনটিং ব্রাস। মনোযোগ দিয়ে কিছু আকার চেষ্টা করছে। করুক ! এটা কোন সমস্যা না। সমস্যা হলো! এভাবে নেংটো হয়ে আকার মানে কি? এভাবে কি কোন বিশেষ ছবি আঁকা যায়। কি জানি? বড় লোকদের বড় বড় কারবার। তবুও এইরকম একটা ছোট্ট তোয়ালেতে, তাও যেটা কিনা উপর থেকে বিপদসীমার নিচে আর নিচে থেকে বিপদসীমার উপরে। নিজেরও তো একটা স্বস্তি আছে নাকি। এতো টাকা পয়সা তোয়ালে কিনবে শাড়ির সমান সমান তা না কিনেছে রুমালের মতো। ছিঃ!
সে ধীরে ধীরে কেটে পড়তে চাইলো। আর মনে মনে আল্লাহ, আল্লাহ করলো। এই ছেলে যেন তাঁকে না দেখে। দেখলে সে লজ্জায় শেষ।
এদের না থাক তার তো আছে। ছিঃ ছিঃ। রুমে এসে সে হাফ ছেড়ে বাঁচলো। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানালো।এই বাসায় আরো কতো কি যে দেখতে হবে কে জানে। কালকে রাতেও দেখলো। খাবার টেবিলে যখন সে সবার সাথে পরিচয় হলো।তখন দেখলো নিধি নামের মেয়েটাকে। যে কিনা বড় চাচার ছোট মেয়ে। সে খেতে এসেছে লেগিংস আর হাতা কাটা টপস জাতীয় কিছু পড়ে। তাঁর এতো লজ্জা লাগলো। কারণ! খাবার টেবিলে তখন বড় চাচা, ছোট চাচা, নোমান সবাই ছিলো। এরা এতে অভ্যস্ত। এদের মহলে হয়তো এগুলো সহজ ব্যাপার। কিন্তু সে তো না। আচ্ছা সে যদি এখানেই বেড়ে উঠতো সেও কি এমন নির্লজ্জ হতো? নাকি তাঁর মা এখানেও সব সময়ের মতো তাঁকে আগলে রাখতো।
হয়তো রাখতো! তিথি মন খারাপ করে খাঁটে বসলো। তাঁর স্থান হয়েছে বিলাসবহুল একটা রুমে। যেই রুমে বিলাসিতার ছড়াছড়ি। তবুও তাঁর শান্তি লাগছে না। তাঁর তো শান্তি লাগতো, তাঁদের টিনের চালের ছোট্ট একটা ঘরে। যেখানে ছিলো ছোট্ট একটা খাট, ছোট্ট একটা আলমারি, আর একটা পড়ার টেবিল। তবুও কি যে শান্তি। এই শান্তি কি বাবা নামের মানুষ টি দিতে পাড়বে? বাবা! হ্যা বাবা! এই মানুষটাকে তিথি এখনো দেখেনি। দেখার ইচ্ছা আছে এমনও না। মা তো কখনও তাঁকে বেঁধে রাখে নি। জ্ঞান হওয়ার পরে মা তাঁকে সবই বলেছে। আর সাথে এও বলেছে। তুমি যদি বাবার কাছে যেতে চাও যেতে পার। কোন বাধা নেই। সে আসেনি! কেন আসবে? তাঁর বাবার জীবনে কি সত্যিই তাঁদের প্রয়োজন ছিল?
দরজার টোকার শব্দে তাঁর ধ্যান ভাঙলো। হালিমা খালা ডাকছেন। তিনি হচ্ছেন কাজের লোকদের হেড। কন্ঠে মধু মেখে বলছেন, ” — আম্মা উঠছেন? অনেক বেলা হইছে, নাস্তা করবেন না। আপনের আব্বাও আইছে । তিনি আপনার জন্য বসে আছে। দেখা করবেন না ?
তিথি উত্তর দিলো না। তবে হাসলো! কাজের লোকেরা অতি সহজে বুঝে যায়। কার কদর কতোটুকু। এই যে হালিমা খালা একদিনেই বুঝে গেছে। এই সিধে সাদা, মলিন কামিজ পড়া মেয়েটা। যেন তেন না। এই বাড়ির মেজ ছেলে মাহবুবের মেয়ে! বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মাহবুব আহমেদের একমাএ মেয়ে। যে কিনা একাই আহমেদ গ্রুপ অফ ইন্ডস্ট্রিকে টেনে এই পর্যন্ত এনেছেন। আর তাঁর টাকাই সবাই গা ভাসিয়ে বিলাসিতা করছে।
—–
তিথি নিচে নামলো দুপুরেরও পরে। বাসায় বলতে গেলে কেওই নেই। দাদু আর বড় চাচী ড্রইং রুমে বসে আছে। তিথি নামতে নামতে বড় চাচীকে দেখলো। তাঁর নাম রেহনুমা। দেখতে ছোট খাটো একটা পুতুলের মতো। তাঁকে দেখে বয়স বোঝার উপায় নেই। তাঁর মতো তাঁর দু মেয়ে আর বংশের একমাএ প্রদীপ নোমান তিনজনেই হয়েছে দুধে আলতা গায়ের রং। এই অহংকারেই সে সম্ভাবতো মাটি দিয়ে হাঁটে না। বাড়িতে দুই দুইটা বউ থাকলেও বাড়ির একমাএ কর্তী সে। তাঁর হুকুম ছাড়া এ বাড়ির একটা জিনিসও এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাবে না।
তিথি তাঁদের সামনে এসে দাঁড়ালো। তাঁকে দেখেই রেহনুমা বললো, “–
কি ব্যাপার বলতো তিথি? তোমার কথা শুনে তোমার বাবা সব কাজ টাজ ফেলে ইমার্জেন্সি টিকিট নিয়ে দুবাই থেকে ব্যাক করলো। আর তুমি দরজা আটকে বসে আছো। কতো ডাকাডাকি, তোমার খবর নেই। তুমিতো দেখি তোমার মায়েই মতো। যা ইচ্ছে হয় তাই করো।
তিথি কিছু বললো না। সে এক দৃষ্টিতে চাচীর চিন্তত মুখটা দেখলো। আমার দরজা না খোলায় হয়তো বাবার চেয়ে চাচীই বেশি কষ্ট পেয়েছে।
— আহ্! রেহনুমা! চুপ থাকো তো ! হয়তো দাদু ভাই ঘুমাচ্ছিলো। অচেনা জায়গা, রাতে হয়তো ভালো ঘুম হয়নি। এই হালিমা কোথায় গেছিস? টেবিলে তারাতারি খাবার দে । সকাল থেকে মেয়েটা না খাওয়া।
— আপনিও না মা! একদিনেই নাতনির স্নেহে অন্ধ হয়ে গেছেন। তাঁর টা দেখছেন অথচো নিজের ছেলের টা চোখে পড়ছে না। মাহবুবও তো দুপুরে বলতে গেলে খেলোই না।
—- আহ্! বাদ দাও তো। আয় দাদু ভাই, আয়! আমার সাথে আয়। বলেই মরিয়ম বানু উঠতে গেলেন।
— আপনি বসুন! আমি দেখছি। বলেই তিথি আবার উপরে যাওয়ার জন্য এগিয়ে গেলো ।
— আবার কোথায় যাচ্ছিস ! খাবি না।
— খাবো! আপনার ছেলেকে নিয়ে আসি।
রেহনুমা মুখ বাকালো। বাকিয়ে বললো, “— মাহবুবের খাওয়া খাদ্যে সব কিছুই টাইম টু টাইম। একদম নিয়ম মাফিক। নিয়মের বাইরে সে যাবে না। তুমি বরং খেয়ে নাও। পরে গিয়ে বাবার সাথে দেখা করো। লং জার্নি করে এসেছে। এবার একটু আরাম করুক। সকাল থেকেতো তোমার জন্য অপেক্ষাই করলো।
তিথি শুনেও শুনলো না। সে আস্তে আস্তে উপরে উঠতে লাগলো। আর মনে মনে বললো,– নিয়ম! নিয়মের নিয়মইতো ভাঙা “। সে এগিয়ে গেলো। দরজার সামনে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। তাঁর চোখে টলমলে পানি। সে ধীরে ধীরে চোখের পানি মুছলো। একেই বলে বুঝি রক্ত। স্নেহ নেই, ভালোবাসা নেই, সামান্য চোখের দেখাটাও নেই। তবুও এই টানের কতো জ্বালাপোড়া।
তিথি মৃদু ভাবে দরজায় টোকা দিলো।
— এসো!
তিথি ভিতরে ঢুকলো! মাহবুব ইজিচেয়ারে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। তাঁকে দেখলে কেও বলবে না সে তাঁর বাবা। এখনো সুন্দর, লম্বা চওরা সুদর্শন যুবক। শুধু চুলগুলো সাইডে হালকা পাক ধরেছে। তিথি হয়েছে একদম তাঁর মায়ের মতো। তিথি দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ফেলতেই তাঁর চোখ পড়লো দেওয়ালে টানানো একটা ছবির উপর। ছবিটা তাঁর মায়ের। বিয়ের ছবি! মা বধু বেসে লজ্জায় নিচু হয়ে বসে আছে। কি মায়াময় একটা মুখ!
—- খেয়েছো?
তিথি ধীর গলায় বললো, “– না।
—- তুমি সকাল থেকে দরজা আটকে ছিলে কেন? নোমানতো বললো তুমি উঠেছো।
তিথি দাঁতে দাঁত চাপলো। ওহ! ছেলেটা তাহলে তাঁকে দেখেছে। তবে মুখে কিছু বললো না।
— দাঁড়িয়ে আছো কেন? বসো!
তিথি ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো। মাহবুবের ইজি চেয়ারের ঠিক সামনে খাটে পা তুলে বসলো।
মাহবুব চোখ বন্ধ করেই একটু হাসলো। এভাবে তাইয়্যেবা বসতো। সে কখনো ঘরে জুতো পরে থাকতে পারতো না। খালি পায়ে ঘর ভরে হাঁটতো আবার সেই পায়েই খাটে উঠে পরতো। সে এসব দেখতে পারতো না। এর জন্যও মেয়েটা কতো কথা শুনতো।
— এতোদিন কোথায় ছিলে?
—- ফরিদপুর! ফরিদপুরের মফস্বল একটা গ্রামে।
—আমি যতোটুকু জানি তোমার মায়ের তেমন কোন আত্মীয় স্বজন ছিলো না। সেখানে কিভাবে?
— হয়তো আপনার জানার মধ্যে ভুল ছিলো। বা এমনো হতে পারে আপনি কখনও জানতেই চান নি।
মাহবুব চোখ তুলে তাঁকালো। তাঁকিয়েই কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেলো। তাঁর মনে হলো তাঁর সামনে তাইয়্যেবা বসে আছে।
সে উঠে বসলো। তাঁর গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। বসে বললো,”– ওখানে পানি আছে। আমাকে এক গ্লাস পানি দাও।
তিথি নড়লো না। যেমন বসে আছে তেমনি বসে রইলো।
মাহবুব ঢোক গিললো। আর অবাক হয়ে তাঁকিয়ে রইলো। তাঁর সামনে বসা এই মেয়েটা দেখতে হুবুহ তাইয়্যেবার মতো হলেও। আসলে সে তাইয়্যেবার মতো না। কোথায় যেন একটু। সে আর ভাবতে পারলো না। সে এক সময় চাইতো তাঁর সন্তান হবে তাঁর মতো। তাহলে! এখন কেন ভয় পাচ্ছে? সে বিরসভাবে বললো,”–
— তাইয়্যেবা কোথায়?
— সেটা জানার অধিকার কি আপনার আছে ।
—- আমি তাঁকে অনেক খুঁজেছি।
— কেন?
মাহবুব এই কেনর উত্তর খুঁজে পেলো না । সত্যি তো কেন? সে কথা ঘোরালো।
— তুমি কি ফরিদপুর থেকে একা এসেছো?
— না।
— কার সাথে এসেছো?
তিথি উত্তর দিলো না। সে তাঁকিয়ে আছে বাবা নামক মানুষটার দিকে। কি সুন্দন স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছে। যেন তিথি তাঁর আশে পাশেই বড় হয়েছে। প্রায় তাঁদের এমন মান অভিমান চলে। আবার ঠিক হয়ে যায়।
মাহবুব দীর্ঘশ্বাস ফেললো! এই মেয়ে নিজের ইচ্ছের বাইরে একটা উত্তরও দেবে না। যতোটুকু সে জানাতে চায় ততোটুকুই সে বলবে। এটা সে বুঝতে পারছে। সে নিজেও এমন। সে উঠে দাঁড়ালো। দাঁড়িয়ে বললো, — এসো! খাবে! সকাল থেকে তুমি না খেয়ে আছো।
তিথি নির্বকার ভাবে বললো —- আমি এখানেই খাবো! এই রুমে, এই খাঁটে এবং আপনিও আমার সাথে খাবেন।
মাহবুব কিছুক্ষণ নিরবে তাঁকিয়ে রইলো। তাইয়্যেবা বিয়ের পরপর এরকম বাইনা করতো। তবে তাঁর বায়না কখনও গ্রহনযোগ্য হয়নি।
মাহবুব বাইরে বেড়িয়ে আসলো। এসে উপর থেকে চেঁচিয়ে বললো,”— হালিমা! হালিমা!
হালিমা দৌঁড়ে এলো। তাঁর হাত, পা কাঁপছে। মেজ স্যারের কন্ঠ এই বাড়ির কোন দেওয়ালে শুনছে কিনা সন্দেহ। আর আজ কি হলো?
— আমার আর তিথির খাবার রুমে নিয়ে এসো।
তিথি রুমে বসে মুচকি হাসলো!
আর এদিকে মরিয়ম বানু আবাক হলেন। আর রেহনুমা স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। তাঁর মনে হলো তাইয়্যেবা ফিরে এসেছে আর তাঁর দিকে তাঁকিয়ে মুচকি হাসছে।
চলবে…..